শ্লোক ২১-২২

অর্জুন উবাচ

সেনয়োরুভয়োর্মধ্যে রথং স্থাপয় মেহচ্যূত।

যাবদেতান্নিরীক্ষেহহং যোদ্ধুকামানবস্থিতান ।। ২১ ।।

কৈর্ময়া সহ যোদ্ধব্যমস্মিন রণসমুদ্যমে ।। ২২ ।।

অর্জুনঃ উবাচ – অর্জুন বললেন; সেনয়োঃ- সৈন্যদের; উভয়োঃ- উভয়; মধ্যে- মধ্যে; রথম- রথ; স্থাপয়- স্থাপন কর; মে- আমার; অচ্যুত- হে অচ্যুত; যাবৎ- যাতে; এতান- এই সমস্ত; নিরীক্ষে- দেখতে পারি; অহম- আমি; যোদ্ধুকামানময়া- আমাকে; সহ- সঙ্গে; যোদ্ধব্যম- যুদ্ধ করতে হবে; অস্মিন- এই; রণ- সংগ্রাম; সমুদ্যমে- প্রচেষ্টায়।

গীতার গান

মহীপতে। পান্ডুপুত্র কহে হৃষীকেশে।

উভয় সেনার মাঝে রথের প্রবেশে।।

যাবৎ দেখিব এই যুদ্ধকামীগণে।

তাবৎ রাখিবে রথ অচ্যুত এখানে।।

দেখিবারে চাহি কেবা আসিয়াছে হেথা।

কাহার সহিত হবে যুঝিবারে সেথা।।

অনুবাদঃ অর্জুন বললেন- হে অচ্যুত। তুমি উভয় পক্ষের সৈন্যদের মাঝখানে আমার রথ স্থাপন কর, যাতে আমি দেখতে পারি যুদ্ধ করার অভিলাষী হয়ে কারা এখানে এসেছে এবং এই মহাসংগ্রামে আমাকে কাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হবে।

তাৎপর্যঃ যদিও শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান, তবুও তিনি অহৈতুকী কৃপাবশে তাঁর প্রিয় সখা অর্জুনের রথের সারথী হয়ে তাঁর সেবা করছেন। ভক্তের প্রতি করুণা প্রদর্শনে ভগবান কখনো চ্যুত হন না, তাই তাঁকে এখানে অচ্যুত বলে সম্ভাষণ করা হয়েছে। অর্জুনের রথের সারথী হবার ফলে তাঁকে অর্জুনের আদেশ অনুযায়ী কাজ করতে হয়েছিল এবং যেহেতু তা করতে তিনি কুন্ঠিত হননি, তাই তাঁকে অচ্যুত বলে সম্ভাষণ করা হয়েছে। যদিও তিনি তাঁর ভক্তের রথের সারথী হয়েছেন, তবুও তাঁর পরম পদ কেউ দাবী করতে পারে না। সকল অবস্থাতেই তিনি হচ্ছেন পরম পুরুষ ভগবান বা সমস্ত ইন্দ্রিয়ের অধীশ্বর হৃষীকেশ। ভগবানের সঙ্গে ভক্তের সম্পর্ক মধুর ও অপ্রাকৃত। ভক্ত সর্বদাই ভগবানের সেবায় উন্মুখ, ঠিক তেমনই ভগবানও তাঁর ভক্তের কোন রকম পরিচর্যা করতে সুযোগের অন্বেষণ করেন। ভগবান যখন তাঁর শুদ্ধ ভক্তের আদেশ অনুসারে তাঁকে পরিচর্যা করার সুযোগ পান, তখন তিনি অসীম আনন্দ উপভোগ করেন। ভগবান হচ্ছেন সর্বলোক-মহেশ্বর। যেহেতু তিনি হচ্ছেন প্রভু, প্রত্যেকেই তাঁর আদেশের অধীন, এবং তাই তাঁকে আদেশ দেবার মতো তাঁর ঊর্ধ্বে আর কেউ নেই। কিন্তু যখন তিনি দেখেন যে, কোন শুদ্ধ ভক্ত তাঁকে আদেশ করছেন, তখন তিনি দিব্য আনন্দ লাভ করেন, যদিও সকল অবস্থাতেই তিনি হচ্ছেন অভ্রান্ত প্রভু।

ভগবানের শুদ্ধ ভক্তরূপে অর্জুন কখনোই কৌরবদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে চাননি, কিন্তু কোন রকম শান্তিপূর্ণ মীমাংসা করতে আগ্রহী দুর্যোধনের দুর্দমনীয় মনোভাব তাঁকে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে বাধ্য করেছিল। তাই, তিনি যুদ্ধের আগে একবার দেখে নিতে চেয়েছিলেন, তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে কে কে সেই রণাঙ্গনে উপস্থিত হয়েছিল। যদিও যুদ্ধক্ষেত্রে শান্তি স্থাপন করার কোন প্রশ্নই ওঠে না, তবুও যুদ্ধের আগে অর্জুন একবার সকলকে দেখতে চেয়েছিলেন এবং তিনি দেখে নিতে চেয়েছিলেন সেই অন্যায় যুদ্ধে কৌরবেরা কতখানি উৎসাহী ছিল।

শ্লোক – ২৩

যোৎস্যমানানবেক্ষেহহং য এতেহত্র সমাগতাঃ।

ধার্তরাষ্ট্রস্য দুর্বুদ্ধের্যদ্ধে প্রিয়চিকীর্যবঃ ।। ২৩ ।।

যোৎস্যমানান- যারা যুদ্ধ করবে; অবেক্ষে- দেখতে চাই; অহম- আমি; যে- যে; এতে- যারা; অত্র- এখানে; সমাগতাঃ- সমবেত হয়েছে; ধার্তরাষ্ট্রস্য- ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রের পক্ষে; দুর্বুদ্ধেঃ- দুর্বুদ্ধিসম্পন্ন; যুদ্ধে- যুদ্ধে; প্রিয়- ভাল; চিকীর্ষবঃ- বাসনা করে।

গীতার গান

যুদ্ধকামীগণে আজ নিরখিব আমি।

দুর্বুদ্ধি ধার্তরাষ্ট্রের জন্য যুদ্ধকামী।।

অনুবাদঃ ধৃতরাষ্ট্রের দুর্বুদ্ধিসম্পন্ন পুত্রকে সন্তুষ্ট করার বাসনা করে যারা এখানে যুদ্ধ করতে এসেছে, তাদের আমি দেখতে চাই।

তাৎপর্যঃ এই কথা সকলেরই জানা ছিল যে, দুর্যোধন তার পিতা ধৃতরাষ্ট্রের সহযোগিতায় অন্যায়ভাবে পাণ্ডবদের রাজত্ব আত্মসাৎ করতে চেষ্টা করছিল। তাই, যারা দুর্যোধনের পক্ষে যোগ দিয়েছিল, তারা সকলেই ছিল ‘এক গোয়ালের গরু’। যুদ্ধের প্রারম্ভে অর্জুন দেখে নিতে চেয়েছিলেন তারা কারা। কৌরবদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ মীমাংসা করবার সব রকম প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবার ফলেই কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধের আয়োজন করা হয়, তাই সেই যুদ্ধেক্ষেত্রে শান্তি প্রতিষ্ঠা করার কোন রকম বাসনা অর্জুনের ছিল না। অর্জুন যদিও স্থির নিশ্চিতভাবে জানতেন, জয় তাঁর হবেই, কারণ শ্রীকৃষ্ণ তাঁর পাশেই বসে আছেন, তবুও যুদ্ধের প্রারম্ভে তিনি শত্রুপক্ষের সৈন্যবল কতটা তা দেখে নিতে চেয়েছিলেন।

শ্লোক ২৪

সঞ্জয় উবাচ

এবমুক্তো হৃষীকেশা গুড়াকেশেন ভারত।

সেনয়োরুভয়োমধ্যে স্থাপয়িত্বা রথোত্তমম ।। ২৪ ।।

সঞ্জয়ঃ উবাচ- সঞ্জয় বললেন; এবম- এভাবে; উক্তঃ- আদিষ্ট হয়ে; হৃষীকেশঃ- শ্রীকৃষ্ণ; গুড়াকেশেন- অর্জুনের দ্বারা; ভারত- হে ভরতবংশীয়; সেনয়োঃ- সৈন্যদের; উভয়োঃ- উভয় পক্ষের; মধ্যে- মধ্যে; স্থাপয়িত্তা- স্থাপন করে; রথ-উত্তমম- অতি উত্তম রথ।

গীতার গান

সে কথা শুনিয়া হৃষীকেশ ভগবান।

উভয় সেনার দিকে হইল আগুয়ান।।

উভয় সেনার মধ্যে রাখি রথোত্তম।

কহিতে লাগিল কৃষ্ণ হইয়া সম্ভ্রম।।

অনুবাদঃ সঞ্জয় বললেন- হে ভরত-বংশধর! অর্জুন কর্তৃক এভাবে আদিষ্ট হয়ে, শ্রীকৃষ্ণ সেই অতি উত্তম রথটি চালিয়ে নিয়ে উভয় পক্ষের সৈন্যদের মাঝখানে রাখলেন।

তাৎপর্যঃ এই শ্লোকে অর্জুনকে গুড়াকেশ বলে অভিহিত করা হয়েছে। গুড়াকা মানে হচ্ছে নিদ্রা এবং যিনি নিদ্রা জয় করেছেন, তাঁকে বলা হয় গুড়াকেশ। নিদ্রা অর্থ অজ্ঞানতাকেও বোঝায়। অতএব শ্রীকৃষ্ণের বন্ধুত্ব লাভ করার ফলে অর্জুন নিদ্রা ও অজ্ঞানতা উভয়কেই জয় করেছিলেন। শ্রীকৃষ্ণের পরম ভক্ত অর্জুন এক মুহূর্তের জন্যও শ্রীকৃষ্ণকে বিস্মৃত হতেন না, কারণ এটিই হচ্ছেন ভক্তের লক্ষণ। শয়নে অথবা জাগরণে ভক্ত ভগবানের নাম, রূপ, গুণ ও লীলা স্মরণে কখনো বিরত হন না। এভাবেই কৃষ্ণভক্ত সর্বদাই কৃষ্ণচিন্তায় মগ্ন থেকে নিদ্রা ও অজ্ঞানতা জয় করতে পারেন। একেই বলা হয় কৃষ্ণভাবনা বা সমাধি। হৃষীকেশ অথবা সমস্ত জীবের ইন্দ্রিয় ও মনের নিয়ন্তা হবার ফলে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের অভিপ্রায় বুঝতে পেরেছিলেন, কেন তাঁকে সৈন্যের মধ্যে রথ স্থাপন করতে বলেছেন। এভাবে অর্জুনের নির্দেশ পালন করার পর তিনি বললেন।

শ্লোক – ২৫

ভীষ্মদ্রোণপ্রমুখতঃ সর্বেষাং চ মহীক্ষিতাম।

উবাচ পার্থ পশ্যৈতান সমবেতান কুরূনিতি ।। ২৫ ।।

ভীষ্ম- পিতামহ ভীষ্ম; দ্রোণ- দ্রোণাচার্য; প্রমুখতঃ- সম্মুখে; সর্বেষাম- সমস্ত;চ- ও; মহীক্ষিতাম- নৃপতিদের; উবাচ- বললেন; পার্থ- হে পার্থ; পশ্য- দেখ; এতান- এদের সকলকে; সমবেতান- সমবেত; কুরূন- কুরুবংশের সমস্ত সদস্যদের; ইতি- এভাবে।

গীতার গান

দেখ পার্থ সমবেত ধার্তরাষ্ট্রগণ।

ভীষ্ম দ্রোণ প্রমুখত যত যোদ্ধাগণ।।

অনুবাদঃ ভীষ্ম, দ্রোণ প্রমুখ পৃথিবীর অন্য সমস্ত নৃপতিদের সামনে ভগবান হৃষীকেশ বললেন, হে পার্থ! এখানে সমবেত সমস্ত কৌরবদের দেখ।

তাৎপর্যঃ সর্বজীবের পরমাত্মা শ্রীকৃষ্ণ জানতেন অর্জুনের মনে কি হচ্ছিল। এই প্রসঙ্গে তাঁকে হৃষীকেশ বলার মধ্য দিয়ে বোঝানো হচ্ছে, তিনি সবই জানতেন, তিনি সর্বজ্ঞ। এখানে অর্জুনকে পার্থ, অর্থাৎ পৃথা বা কুন্তীর পুত্র বলে অভিহিত করাটাও খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। বন্ধু হিসাবে তিনি অর্জুনকে জানতে চেয়েছিলেন যে, যেহেতু অর্জুন হচ্ছেন তাঁর পিতা বসুদেবের ভগ্নি পৃথার পুত্র, তাই তিনি তাঁর রথের সারথী হতে সম্মত হয়েছেন। এখন শ্রীকৃষ্ণ যখন বললেন, “দেখ পার্থ, সমবেত ধার্তরাষ্ট্রগণ”, তখন তিনি কি অর্থ করেছিলেন? সেই জন্যই কি অর্জুন সেখানে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে, যুদ্ধ করতে অসম্মত  হননি? কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ তাঁর পিতৃষসা কুন্তীদেবীর পুত্র অর্জুনের কাছ থেকে এমন আচরণ কখনোই আশা করেননি। অর্জুনের মনের ভাব বুঝতে পেরে পরিহাসছলে শ্রীকৃষ্ণ তাঁর ভবিষ্যত-বাণী করলেন।

শ্লোক – ২৬

তত্রাপশ্যৎ স্থিতান পার্থঃ পিতৃনথ পিতামহান।

আচার্যান্মাতুলান ভ্রাতৃন পুত্রান পৌত্রান সখীসংস্তথা।

শ্বশুরান সুহৃদশ্চৈব সেনয়োরুভয়োরপি ।। ২৬ ।।

তত্র- সেখানে; অপশ্যৎ- দেখলেন; স্থিতান- অবস্থিত; পার্থঃ- অর্জুন; পিতৃন- পিতৃব্যদের; অথ- ও; পিতামহান- পিতামহদের; আচার্যান- শিক্ষকদের; মাতুলান- মাতুলদের; ভ্রাতৃন- ভ্রাতাদের; পুত্রান- পুত্রদের; পৌত্রান- পৌত্রদের; সখীন- বন্ধুদের; তথা- ও; শ্বশুরান- শ্বশুরদের; সুহৃদঃ- শুভাকাঙ্ক্ষীদের; চ- ও; এব- অবশ্যই; সেনয়োঃ- সেনাদলের; উভয়োঃ- উভয়; অপি- অন্তর্ভুক্ত।

গীতার গান

তারপর দেখে পার্থ যোদ্ধৃপিতৃগণ।

আচার্য মাতুল আদি পিতৃসম হন।।

দেখে পুত্র পৌত্রাদিক যত সখাজন।

আর সব বহু লোক আত্মীয়স্বজন।।

শ্বশুরাদি কুটুম্বীয় নাহি পারাপার।

উভয়পক্ষীয় সৈন্য সে হল অপার।।

অনুবাদঃ তখন নরজুন উভয় পক্ষের সেনাদলের মধ্যে পিতৃব্য, পিতামহ, আচার্য, মাতুল, ভ্রাতা, পুত্র, শ্বশুর, মিত্র ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের উপস্থিত দেখতে পেলেন।

তাৎপর্যঃ যুদ্ধক্ষেত্রে অর্জুন সমস্ত আত্মীয়স্বজনকে দেখতে পেলেন। তিনি ভুরিশ্রবা আদি পিতৃবন্ধুদের দেখলেন; ভীষ্মদেব, সোমদত্ত আদি পিতামহদের দেখলেন; দ্রোণাচার্য, কৃপাচার্য আদি শিক্ষা-গুরুদের দেখলেন; পুত্রতুল্য লক্ষ্মণকে দেখলেন; অশ্বত্থামার মতো বন্ধুকে দেখলেন; কৃতবর্মার মতো শুভাকাঙ্ক্ষীকে দেখলেন। এভাবে শত্রুপক্ষের সৈন্যদের মধ্যে তিনি কেবল আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদেরই দেখলেন।

error: Content is protected !!
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x