শ্লোক – ৮
ভবান ভিষ্মশ্চ কর্ণশ্চ কৃপশ্চ সমিতিঞ্জয়ঃ।
অশ্বত্থামা বিকর্ণশ্চ সৌমদত্তিস্তথৈব চ ।। ৮ ।।
ভবান- আপনি স্বয়ং; ভীষ্মঃ- পিতামহ ভীষ্ম; চ- ও; কর্ণঃ- কুন্তীপুত্র কর্ণ; চ- এবং; কৃপঃ- কৃপাচার্য; চ- এবং, সমিতিঞ্জয়ঃ- সর্বদা সংগ্রামে বিজয়ী; অশ্বত্থামা- দ্রোণাচার্যের পুত্র অশ্বত্থামা; বিকর্ণঃ- দুর্যোধনের ভ্রাতা বিকর্ণ; চ- ও; সৌমদত্তিঃ- সোমদত্তের পুত্র ভূমিশ্রবা; তথা- এবং; এব- অবশ্যই; চ- ও।
গীতার গান
আপনি আর পিতামহ ভীষ্মাদিগণ।
কৃপাচার্য রণজয়ী হয় একত্রে বর্ণন।।
অশ্বত্থামা বিকর্ণাদি সৌমদত্তি আর।
যথাযথা তথা তথা সৈন্য সে অপার।।
অনুবাদঃ সেখানে রয়েছেন আপনার মতোই ব্যক্তিত্বশালী- ভীষ্ম, কর্ণ, কৃপা, অশ্বত্থামা, বিকর্ণ ও সোমদত্তের পুত্র ভূরিশ্রবা, যারা সর্বদা সংগ্রামে বিজয়ী হয়ে থাকেন।
তাৎপর্যঃ পান্ডব পক্ষের রথী-মহারথীদের বর্ণনা করবার পর দুর্যোধন তাঁর স্বপক্ষে যে সমস্ত বীরেরা যোগদান করেছেন তাঁদের বর্ণনা করেছে। বিকর্ণ হচ্ছেন দুর্যোধনের ভাই, অশ্বত্থামা হচ্ছেন দ্রোণাচার্যের পুত্র এবং সৌমদত্তি বা ভূরিশ্রবা হচ্ছেন বাহ্লীকের রাজার ছেলে। কর্ণ ছিলেন অর্জুনের বৈপিত্রেয় ভ্রাতা, কেননা রাজা পান্ডুর সঙ্গে বিবাহ হবার আগে কুন্তীদেবীর কোলে তাঁর জন্ম হয়। কৃপাচার্যের যমজ ভগ্নীদ্বয়ের সাথে দ্রোণাচার্যের বিবাহ হয়।
শ্লোক – ৯
অন্যে চ বহবঃ শূরা মদর্থে ত্যক্তজীবিতাঃ।
নানাশস্ত্রপ্রহরণাঃ সর্বে যুদ্ধবিশারদাঃ ।। ৯ ।।
অন্যে- অন্য অনেকে; চ- ও; শূরাঃ- সেনানায়কগণ; মদর্থে- আমার জন্য; ত্যক্তজীবিতাঃ- তাঁদের জীবন ত্যাগ করতে প্রস্তুত; নানা- নানা প্রকার; শস্ত্র- অস্ত্রশস্ত্র; প্রহরণাঃ- সুসজ্জিত; সর্বে- তাঁরা সকলে; যুদ্ধবিশারদাঃ- সামরিক বিজ্ঞানে অভিজ্ঞ যোদ্ধা।
গীতার গান
আর যে অনেক বীর আমার লাগিয়া।
আসিয়াছে হেথা সব জীবন ত্যজিয়া।।
নানা অস্ত্রপাণি সব যুদ্ধে বিশারদ।
এরা সব হয় মোর যুদ্ধের সংসদ।।
অনুবাদঃ এছাড়া আরও বহু সেনানায়ক রয়েছেন, যারা আমার জন্য তাঁদের জীবন ত্যাগ করতে প্রস্তুত। তাঁরা সকলেই নানা প্রকার অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত এবং তাঁরা সকলেই সামরিক বিজ্ঞানে বিশারদ।
তাৎপর্যঃ অন্য আর যে সমস্ত বীরেরা দুর্যোধনের পক্ষে ছিলেন, যেদ্মন- জয়দ্রথ, কৃতবর্মা, শল্য আদি, এরা সকলেই দুর্যোধনের জন্য প্রাণ পর্যন্ত দিতে প্রস্তুত ছিলেন। এখানে স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, পাপিষ্ঠ দুর্যোধনের পক্ষ অবলম্বন করার ফলে কুরুক্ষেত্রের রণাঙ্গনে এঁদের সকলেরই মৃত্যু অবধারিত ছিল। দুর্যোধনের কিন্তু দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, এই সমস্ত বীরপুঙ্গবেরা স্বপক্ষে থাকায় তার জয় অনিবার্য।
শ্লোক – ১০-১১
অপর্যাপ্তং তদস্মাকং বলং ভীষ্মাভিরক্ষিতম।
পর্যাপ্তং ত্বিদমেতেষাং বলং ভীমাভীরক্ষিতম।। ১০ ।।
অয়নেষু চ সর্বেষু যথাভাগমবস্থিতাঃ।
ভীষ্মমেবাভিরক্ষন্তু ভবন্তঃ সর্ব এব হি।। ১১ ।।
অপর্যাপ্তম- অপরিমিত; তৎ- তা; অস্মাকম- আমাদের; বলম- বল; ভীষ্ম- পিতামহ ভীষ্মের দ্বারা; অভিরক্ষিতম- সম্পূর্ণভাবে রক্ষিত; পর্যাপ্তম- সীমিত; তু- কিন্তু; ইদম- এই সমস্ত; এতোষাম- পান্ডবদের; বলম- বল; ভীম- ভীমের দ্বারা; অভিরক্ষিতম- সতর্কভাবে রক্ষিত; অয়নেষু- যথাস্থানে; চ- ও; সর্বেষু- সর্বত্র; যথাভাগম- যথাযথভাবে বিভক্ত হয়ে; অবস্থিতাঃ- অবস্থিত, ভীষ্ম- পিতামহ ভীষ্মকে, এব- অবশ্যই; অভিরক্ষন্তু- রক্ষা করুন; ভবন্তঃ- আপনারা, সর্বে- সকলে; এব হি- নিশ্চিতভাবে।
গীতার গান
অপর্যাপ্ত মম সৈন্য ভীষ্ম সেনাপতি।
পর্যাপ্ত ওদের সৈন্য ভীম যার গতি্
যথাস্থানে স্থিত থাকি আপনি সকলে।
রক্ষ ভীষ্ম পিতামহে হেন যুদ্ধস্থলে।।
অনুবাদঃ আমাদের সৈন্যবল অপরিমিত এবং আমরা পিতামহ ভীষ্মের দ্বারা পূর্ণরূপে সুরক্ষিত, কিন্তু ভীমের দ্বারা সতর্কভাবে সুরক্ষিত পাণ্ডবদের শক্তি সীমিত। এখন আপনারা সকলে সেনাব্যূহের প্রবেশপথে নিজ নিজ গুরুত্বপূর্ণ স্থানে স্থিত হয়ে পিতামহ ভীষ্মকে সর্বতোভাবে সাহায্য প্রদান করুন।
তাৎপর্যঃ এখানে দুর্যোধন পান্ডব-পক্ষ ও কৌরব-পক্ষের সামরিক শক্তির তুলনা করেছে। পিতামহ বীরশ্রেষ্ঠ ভীষ্মদেবের রক্ষণাবেক্ষণাধীন অমিত শক্তিশালী এক সৈন্যবাহিনী ছিল দুর্যোধনের স্বপক্ষে। অপর পক্ষে, পাণ্ডবদের সৈন্যবাহিনী ছিল সীমিত এবং তার সেনাপতি ছিলেন ভীমসেন, যার শৌর্যবীর্য ও সৈন্য পরিচালনার ক্ষমতা পিতামহ ভীষ্মদেবের তুলনায় ছিল নিতান্তই নগণ্য। দুর্যোধন চিরকালই ভীমের প্রতি ঈর্ষান্বিত ছিল। কারণ সে জানত যে, যদি তাঁকে কোনদিন মরতে হয়, তবে ভীমের হাতেই তার মৃত্যু হবে। কিন্তু ভীষ্মের মতো বিচক্ষণ ও দুর্ধর্ষ যোদ্ধা তার পক্ষের সেনাপতি থাকায় সে নিশ্চিতভাবে ধরে নিয়েছিল, জয় তার হবেই। দুর্যোধনের প্রতিটি কথাতে বোঝা যাচ্ছে, যুদ্ধজয় সম্বন্ধে তার মনে কোনই সংশয় ছিল না।
ভীষ্মের শৌর্যবীর্যের প্রশংসা করার পরে, দুর্যোধন বিবেচনা করে দেখল, অন্যেরা মনে করতে পারে, তাঁদের শৌর্যবীর্যের গুরুত্ব লাঘব করে হেয় করা হচ্ছে, তাই তার স্বভাবসুলভ কূটনৈতিক চাতুরীর সাহায্যে সেই পরিস্থিতির ভারসাম্য বজায় রাখার জন্যসে উপরোক্ত কথাগুলি বলেছিল। এভাবে সে মনে করিয়ে দিল যে, ভীষ্মদেব যতবড় যোদ্ধাই হন, তিনি বৃদ্ধ হয়ে পড়েছেন এবং সব দিক থেকে তাই ভীষ্মদেবকে তাঁদের সকলেরই রক্ষা করা উচিত। যুদ্ধ করতে করতে যদি তিনি কোন একদিকে এগিয়ে যান, তাহলে শত্রুপক্ষ তার সুযোগ নিয়ে অন্যদিক থেকে আক্রমণ করতে পারে। তাই অন্য বীরপুঙ্গবেরা যাতে নিজ নিজ স্থানে অধিষ্ঠিত থেকে শত্রুসৈন্যকে ব্যূহ ভেদ করতে না দেয়, তার গুরুত্ব সম্বন্ধে দ্রোণাচার্যকে দুর্যোধন মনে করিয়ে দিয়েছিল। দুর্যোধন স্পষ্টই অনুভব করেছিল যে, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে তার জয়লাভ সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করছে ভীষ্মদেবের উপর। দুর্যোধনের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, সেই যুদ্ধে ভীষ্মদেব ও দ্রোণাচার্য তাঁকে সম্পূর্ণভাবে সহযোগিতা করবেন। কারণ সে আগেই দেখেছিল, যখন হস্তিনাপুরের রাজসভায় সমস্ত রাজপুরুষের সামনে দ্রৌপদীর বস্ত্র হরণ করা হচ্ছিল, তখন তাঁদের প্রতি অসহায় দ্রৌপদীর আকুল আবেদনে সাড়া দিয়ে তাঁরা একটি কথাও বলেননি। যদিও দুর্যোধন জানত, তার দুই সেনাপতিই পাণ্ডবদের বেশ স্নেহ করতেন, কিন্তু তার বিশ্বাস ছিল যে, পাশা খেলার নিয়মানুসারে তাঁরা যেমন তাঁদের স্নেহপ্রবণতা বর্জন করেছিলেন, এই যুদ্ধেও তাঁরা তাই করবেন।
শ্লোক – ১২
তস্য সঞ্জনয়ন হর্ষং কুরুবৃদ্ধঃ পিতামহঃ।
সিংহনাদং বিনদ্যোচ্চৈঃ শঙ্খং দধ্মৌ প্রতাপবান।। ১২ ।।
তস্য- তাঁর; সঞ্জনয়ন- বর্ধিত করে; হর্ষম- হর্ষ; কুরুবৃদ্ধঃ- কুরুবংশের মধ্যে বৃদ্ধ; পিতামহঃ পিতামহ; সিংহনাদম- সিংহের মতো গর্জন; বিনদ্য- কম্পিত করে; উচ্চৈঃ- অতি উচ্চনাদে; শঙ্খম- শঙ্খ; দধ্মৌ- বাজালেন; প্রতাপবান- প্রতাপশালী।
গীতার গান
তবে সেই পিতামহ বৃদ্ধ কুরূপতি।
হর্ষ উৎপাদনে যবে কৈল স্থিরমতি।।
সিংহনাদে বাজাইল শঙ্খ সেই বীর।
উচ্চরব সেই সব অতীব গম্ভীর।।
অনুবাদঃ তখন কুরুবংশের বৃদ্ধ পিতামহ ভীষ্ম দুর্যোধনের হর্ষ উতপাদনের জন্য সিংহের গর্জনের মতো অতি উচ্চনাদে তাঁর শঙ্খ বাজালেন।
তাৎপর্যঃ কুরু-রাজবংশের পিতামহ দুর্যোধনের হৃদকম্প অনুভব করতে পেরে তাঁর স্বভাবসুলভ করুণার বশবর্তী হয়ে তাঁকে উৎসাহিত করবার জন্য সিংহনাদে তাঁর শঙ্খ বাজালেন। পরোক্ষভাবে, শঙ্খধ্বনির মাধ্যমে তিনি তাঁর হতাশাচ্ছন্ন পৌত্র দুর্যোধনকে জানিয়ে দিলেন যে, এই যুদ্ধে জয়লাভ করার কোন আশাই তাঁর নেই, কারণ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন তাঁর বিপক্ষে। তবুও, ক্ষাত্রধর্ম অনুসারে জয়-পরাজয়ের কথা বিবেচনা না করে যুদ্ধ করাই তাঁর কর্তব্য এবং এই ব্যাপারে তিনি কোন রকম অবহেলা করবেন না। সেই কথা তিনি দুর্যোধনকে মনে করিয়ে দিলেন।
শ্লোক – ১৩
ততঃ শঙ্খাশ্চ ভের্যশ্চ পণবানকগোমুখাঃ।
সহসৈবাভ্যহন্যন্ত স শব্দস্তুমুলোহভবৎ ।। ১৩ ।।
ততঃ- তারপর; শঙ্খাঃ- শঙ্খসমূহ; চ- ও; ভের্যঃ- ভেরীসমূহ; চ- এবং; পণবআনক- পণব ও আনক ঢাক; গোমুখাঃ- গোমুখ শিঙ্গা; সহসা- হঠাৎ; এব- অবশ্যই; অভ্যহন্যন্ত- একসঙ্গে বাজতে লাগল; সঃ- সেই; শব্দঃ- মিলিত শব্দ; তুমুলঃ- তুমুল; অভবৎ- হয়েছিল।
গীতার গান
শুনি সেই শত্রুরব যত শঙ্খ ভেরী।
গোমুখ পণবানক বাজিল সত্বরী।।
সহসা উঠিল সেই রণের ঝঙ্কার।
তুমুল হইল শব্দ বহুল অপার।।
অনুবাদঃ তারপর শঙ্খ, ভেরী, পণব, আনক, ঢাক ও গোমুখ শিঙ্গাসমূহ হঠাৎ একত্রে ধ্বনিত হয়ে এক তুমুল শব্দের সৃষ্টি হল।
৯. পঞ্চম অধ্যায়ঃ কর্মসন্ন্যাস-যোগ
১২. অষ্টম অধ্যায়ঃ অক্ষরব্রক্ষ্ম-যোগ
১৫. একাদশ অধ্যায়ঃ বিশ্বরূপ-দর্শন-যোগ
১৭. ত্রয়োদশ অধ্যায়ঃ প্রকৃতি-পুরুষ-বিবেকযোগ
১৮. চতুর্দশ অধ্যায়ঃ গুণত্রয়-বিভাগ-যোগ
১৯. পঞ্চদশ অধ্যায়ঃ পুরুষত্তম-যোগ
২০. ষোড়শ অধ্যায়ঃ দৈবাসুর- সম্পদ-বিভাগযোগ
২১. সপ্তদশ অধ্যায়ঃ শ্রদ্ধাত্রয়-বিভাগ-যোগ
২৪. বর্তমান সংস্করণ সম্পর্কে টীকা
শ্রীমদ্ভগভদ গীতা সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ