শ্লোকঃ ৪২

দোষৈরেতৈঃ কুলঘ্নানাং বর্ণসঙ্করকারকৈঃ।

উৎসাদ্যন্তে জাতিধর্মাঃ কুলধর্মাশ্চ শাশ্বতাঃ ।। ৪২ ।।

দোষৈঃ- দোষ দ্বারা, এতৈঃ এই সমস্ত; কুলঘ্নানাম- কুলনাশকদের; বর্ণসঙ্কর- অবাঞ্চিত সন্তানাদি; কারকৈঃ কারক; উৎসাদ্যন্তে- উৎপন্ন হয়; জাতিধর্মাঃ- জাতির ধর্ম; কুলধর্মাঃ- কুলের ধর্ম; চ- ও; শাশ্বতাঃ- সনাতন।

গীতার গান

নরকে পতন হয় লুপ্ত পিন্ড জন্য।

তরিবার নাহি কোন উপায় যে অন্য।।

কুলধর্মের নষ্টকারী বর্ণসঙ্কর ফলে।

শাশ্বত জাতি ধর্ম উৎসারিত হলে।।

অনুবাদঃ যারা বংশের ঐতিহ্য নষ্ট করে এবং তার ফলে অবাঞ্চিত সন্তানাদি সৃষ্টি করে, তাদের কুকর্মজনিত দোষের ফলে সর্বপ্রকার জাতীয় উন্নয়ন প্রকল্প এবং বংশের কল্যাণ-ধর্ম উৎসন্নে যায়।

তাৎপর্যঃ সনাতন-ধর্ম বা বর্ণাশ্রম-ধর্মের মাধ্যমে সমাজ-ব্যবস্থায় যে চারটি বর্ণের উদ্ভব হয়েছে, তার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষ যাতে তাদের জীবনের চরম জীবনের চরম লক্ষ্য মুক্তি লাভে সক্ষম হয়। তাই, সমাজের দায়িত্বজ্ঞানশূন্য নেতাদের পরিচালনায় যদি সনাতন-ধর্মের যথাযথ আচরণ না করা হয়, তবে সমাজে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় এবং ক্রমে ক্রমে মানুষ তাদের জীবনের চরম লক্ষ্য বিষ্ণুকে ভুলে যায়। এই ধরনের সমাজ-নেতাদের বলা হয় অন্ধ এবং যারা এদের অনুসরণ করে, তারা অবধারিতভাবে অন্ধকূপে পতিত হয়।

শ্লোকঃ ৪৩

উৎসন্নকুলধর্মাণাং মনুষ্যাণাং জনার্দন।

নরকে নিয়ত নিয়তং বাসো ভবতীত্যনুশুশ্রুম ।। ৪৩ ।।

উৎসন্ন-বিনষ্ট; কুলধর্মাণাম- যাদের কুলধর্ম আছে তাদের; মনুষ্যাণাম- সেই সমস্ত মানুষের; জনার্দন- হে কৃষ্ণ; নরকে- নরকে; নিয়তম- নিয়ত; বাসঃ- অবস্থিতি; ভবতি- হয়; ইতি- এভাবে; অনুশুশ্রুম- আমি পরম্পরাক্রমে শ্রবণ করেছি।

গীতার গান

নরকে নিয়ত বাস সে মনুষ্যের হয়।

তুমি জান জনার্দন সে সব বিষয়।।

আমি শুনিয়াছি তাই সাধুসন্ত মুখে।

নরকের পথে চলি কে রহিবে সুখে।।

অনুবাদঃ হে জনার্দন! আমি পরম্পরাক্রমে শুনেছি যে, যাদের কুলধর্ম বিনষ্ট হয়েছে, তাদের নিয়ত নরকে বাস করতে হয়।

তাৎপর্যঃ অর্জুনের সমস্ত যুক্তি-তর্ক তাঁর নিজের অভিজ্ঞতার উপর প্রতিষ্ঠিত নয়, পক্ষান্তরে তিনি সাধুসন্ত আদি মহাজনদের কাছ থেকে আহরণ করা জ্ঞানের ভিত্তিতে এই সমস্ত যুক্তির অবতারণা করেছিলেন। প্রকৃত জ্ঞান উপলব্ধি করেছেন যে-মানুষ, তাঁর তত্বাবধানে এই জ্ঞান শিক্ষালাভ না করলে, এই জ্ঞান আহরণ করা যায় না। বর্ণাশ্রম-ধর্মের বিধি অনুসারে মানুষকে মৃত্যুর পূর্বে তার সমস্ত পাপ মোচনের জন্য কতকগুলি প্রায়শ্চিত্ত বিধি পালন করতে হয়। যে সব সময় পাপকার্যে লিপ্ত থেকে জীবন অতিবাহিত করেছে, তার পক্ষে এই বিধি অনুসরণ করে প্রায়শ্চিত্ত করাটা অবশ্য কর্তব্য। প্রায়শ্চিত্ত না করলে তার পাপের ফলস্বরূপ মানুষ নরকে পতিত হয়ে নানা রকম দুঃখকষ্ট ভোগ করে।

শ্লোকঃ ৪৪

অহো বত মহৎ পাপং কর্তুং ব্যবসিতা বয়ম।

যদ রাজ্যসুখলোভেন হন্তুং স্বজনমুদ্যতাঃ ।। ৪৪ ।।

অহো- হ্যায়; বত- কী আশ্চর্য; মহৎ- মহা; পাপম- পাপ; কর্তুম- করতে; ব্যবসিতাঃ- সংকল্পবদ্ধ; বয়স- আমরা; যৎ- যেহেতু; রাজ্য-সুখ-লোভেন- রাজ্য-সুখের লোভে; হন্তুম- হত্যা করতে; স্বজনম- আত্মীয়-স্বজনদের; উদ্যতাঃ- উদ্যত।

গীতার গান

হায় হায় মহাপাপ করিতে উদ্যত।

হয়েছি আমরা শুধু হয়ে কলুষিত।।

রাজ্যের লোভেতে পড়ে এ দুষ্কার্য করি।

স্বজন হনন এই উচিত কি হরি?।।

অনুবাদঃ হায়! কি আশ্চর্যের বিষয় যে, আমরা রাজ্যসুখের লোভে স্বজনদের হত্যা করতে উদ্যত হয়ে মহাপাপ করতে সংকল্পবদ্ধ হয়েছি।

তাৎপর্যঃ স্বার্থসিদ্ধির জন্য মানুষকে মাতা-পিতা, ভাই-বন্ধুকে হত্যা করতে দেখা যায়। পৃথিবীর ইতিহাসে এর অনেক নজির আছে। কিন্তু ভগবদ্ভক্ত অর্জুন সদাসর্বদা নৈতিক কর্তব্য অকর্তব্যের প্রতি সচেতন, তাই তিনি এই ধরণের কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকাকেই শ্রেয় বলে মনে করেছেন।

error: Content is protected !!
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x