শ্লোকঃ ৪১
সঙ্করো নরকায়ৈব কুলঘ্নানাং কুলস্য চ ।
পতন্তি পিতরো হ্যেষাং লুপ্তপিন্ডোদকক্রিয়াঃ ।। ৪১ ।।
সঙ্করঃ- এই প্রকার অবাঞ্চিত সন্তান; নরকায়- নারকীয় জীবনের জন্য সৃষ্টি; এব- অবশ্যই; কুলঘ্নানাম- কুলনাশক; কুলস্য- বংশের; চ- ও; পতন্তি- পতিত হয়; পিতরঃ- পিতৃপুরুষেরা; হই- অবশ্যই; এষাম- তাদের; লুপ্ত- লুপ্ত; পিন্ড- পিন্ডদান; উদক-ক্রিয়াঃ- তর্পণক্রিয়া।
গীতার গান
দুষ্টা স্ত্রী হইলে জন্মে বর্ণসঙ্কর দল।
বর্ণসঙ্কর হলে হবে নরকের ফল।।
যেই সে কারণ হয় বর্ণসঙ্করের।
কুলক্ষয় কুলঘ্নানি যেই অপরের।।
অনুবাদঃ বর্ণসঙ্কর উৎপাদন বৃদ্ধি হলে কুল ও কুলঘাতকেরা নরকগামী হয়। সেই কুলে পিন্ডদান ও তর্পণক্রিয়া লোপ পাওয়ার ফলে তাদের পিতৃপুরুষেরাও নরকে অধঃ পতিত হয়।
তাৎপর্যঃ কর্মকান্ডের বিধি অনুসারে পিতৃপুরুষের আত্মাদের প্রতি পিন্ডদান ও জল উৎসর্গ করা প্রয়োজন। এই উৎসর্গ সম্পন্ন করা হয় বিষ্ণুকে পূজা করার মাধ্যমে, কারণ বিষ্ণুকে উৎসর্গীকৃত প্রসাদ সেবন করার ফলে সমস্ত পাপ থেকে মুক্তিলাভ হয়। অনেক সময় পিতৃপুরুষেরা নানা রকমের পাপের ফল ভোগ করতে থাকে এবং অনেক সময় তাদের কেউ কেউ জড় দেহ পর্যন্ত ধারণ করতে পারে না। সূক্ষ্ম দেহে প্রেতাত্মারূপে থাকতে বাধ্য করা হয়। যখন বংশের কেউ তার পিতৃপুরুষদের ভগবৎ-প্রসাদ উৎসর্গ করে পিন্ডদান করে, তখন তাদের আত্মা ভূতের দেহ অথবা অন্যান্য দুঃখময় জীবন থেকে মুক্ত হয়ে শান্তি লাভ করে। পিতৃপুরুষের আত্মার সদগতির জন্য এই পিন্ডদান করাটা বংশানুক্রমিক রীতি। তবে যে সমস্ত লোক ভক্তিযোগ সাধন করেন, তাঁদের এই অনুষ্ঠান করার প্রয়োজন নেই। ভক্তিযোগ সাধন করার মাধ্যমে ভক্ত শত-সহস্র পূর্বপুরুষের আত্মার মুক্তির সাধন করতে পারেন। শ্রীমদ্ভগবতে (১১/৫/৪১) বলা হয়েছে-
দেবর্ষিভূতাপ্তনৃণাং পিতৃণাং
ন কিঙ্করো নায়মৃণী চ রাজন।
সর্বাত্মনা যঃ শরণং শরণ্যং
গতো মুকুন্দং পরিহৃত্য কর্তম।।
“যিনি সব রকম কর্তব্য পরিত্যাগ করে মুক্তি দানকারী মুকুন্দের চরণ-কমলে শরণ নিয়েছেন এবং ঐকান্তিকভাবে পন্থাটি গ্রহণ করেছেন, তাঁর আর দেব-দেবী, মুনি-ঋষি, পরিবার-পরিজন মানব-সমাজ ও পিতৃপুরুষের প্রতি কোন কর্তব্য থাকে না। পরমেশ্বর ভগবানের সেবা করার ফলে এই ধরনের কর্তব্যগুলি আপনা থেকেই সম্পাদিত হয়ে যায়।“
শ্লোকঃ ৪২
দোষৈরেতৈঃ কুলঘ্নানাং বর্ণসঙ্করকারকৈঃ।
উৎসাদ্যন্তে জাতিধর্মাঃ কুলধর্মাশ্চ শাশ্বতাঃ ।। ৪২ ।।
দোষৈঃ- দোষ দ্বারা, এতৈঃ এই সমস্ত; কুলঘ্নানাম- কুলনাশকদের; বর্ণসঙ্কর- অবাঞ্চিত সন্তানাদি; কারকৈঃ কারক; উৎসাদ্যন্তে- উৎপন্ন হয়; জাতিধর্মাঃ- জাতির ধর্ম; কুলধর্মাঃ- কুলের ধর্ম; চ- ও; শাশ্বতাঃ- সনাতন।
গীতার গান
নরকে পতন হয় লুপ্ত পিন্ড জন্য।
তরিবার নাহি কোন উপায় যে অন্য।।
কুলধর্মের নষ্টকারী বর্ণসঙ্কর ফলে।
শাশ্বত জাতি ধর্ম উৎসারিত হলে।।
অনুবাদঃ যারা বংশের ঐতিহ্য নষ্ট করে এবং তার ফলে অবাঞ্চিত সন্তানাদি সৃষ্টি করে, তাদের কুকর্মজনিত দোষের ফলে সর্বপ্রকার জাতীয় উন্নয়ন প্রকল্প এবং বংশের কল্যাণ-ধর্ম উৎসন্নে যায়।
তাৎপর্যঃ সনাতন-ধর্ম বা বর্ণাশ্রম-ধর্মের মাধ্যমে সমাজ-ব্যবস্থায় যে চারটি বর্ণের উদ্ভব হয়েছে, তার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষ যাতে তাদের জীবনের চরম জীবনের চরম লক্ষ্য মুক্তি লাভে সক্ষম হয়। তাই, সমাজের দায়িত্বজ্ঞানশূন্য নেতাদের পরিচালনায় যদি সনাতন-ধর্মের যথাযথ আচরণ না করা হয়, তবে সমাজে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় এবং ক্রমে ক্রমে মানুষ তাদের জীবনের চরম লক্ষ্য বিষ্ণুকে ভুলে যায়। এই ধরনের সমাজ-নেতাদের বলা হয় অন্ধ এবং যারা এদের অনুসরণ করে, তারা অবধারিতভাবে অন্ধকূপে পতিত হয়।
শ্লোকঃ ৪৩
উৎসন্নকুলধর্মাণাং মনুষ্যাণাং জনার্দন।
নরকে নিয়ত নিয়তং বাসো ভবতীত্যনুশুশ্রুম ।। ৪৩ ।।
উৎসন্ন-বিনষ্ট; কুলধর্মাণাম- যাদের কুলধর্ম আছে তাদের; মনুষ্যাণাম- সেই সমস্ত মানুষের; জনার্দন- হে কৃষ্ণ; নরকে- নরকে; নিয়তম- নিয়ত; বাসঃ- অবস্থিতি; ভবতি- হয়; ইতি- এভাবে; অনুশুশ্রুম- আমি পরম্পরাক্রমে শ্রবণ করেছি।
গীতার গান
নরকে নিয়ত বাস সে মনুষ্যের হয়।
তুমি জান জনার্দন সে সব বিষয়।।
আমি শুনিয়াছি তাই সাধুসন্ত মুখে।
নরকের পথে চলি কে রহিবে সুখে।।
অনুবাদঃ হে জনার্দন! আমি পরম্পরাক্রমে শুনেছি যে, যাদের কুলধর্ম বিনষ্ট হয়েছে, তাদের নিয়ত নরকে বাস করতে হয়।
তাৎপর্যঃ অর্জুনের সমস্ত যুক্তি-তর্ক তাঁর নিজের অভিজ্ঞতার উপর প্রতিষ্ঠিত নয়, পক্ষান্তরে তিনি সাধুসন্ত আদি মহাজনদের কাছ থেকে আহরণ করা জ্ঞানের ভিত্তিতে এই সমস্ত যুক্তির অবতারণা করেছিলেন। প্রকৃত জ্ঞান উপলব্ধি করেছেন যে-মানুষ, তাঁর তত্বাবধানে এই জ্ঞান শিক্ষালাভ না করলে, এই জ্ঞান আহরণ করা যায় না। বর্ণাশ্রম-ধর্মের বিধি অনুসারে মানুষকে মৃত্যুর পূর্বে তার সমস্ত পাপ মোচনের জন্য কতকগুলি প্রায়শ্চিত্ত বিধি পালন করতে হয়। যে সব সময় পাপকার্যে লিপ্ত থেকে জীবন অতিবাহিত করেছে, তার পক্ষে এই বিধি অনুসরণ করে প্রায়শ্চিত্ত করাটা অবশ্য কর্তব্য। প্রায়শ্চিত্ত না করলে তার পাপের ফলস্বরূপ মানুষ নরকে পতিত হয়ে নানা রকম দুঃখকষ্ট ভোগ করে।
শ্লোকঃ ৪৪
অহো বত মহৎ পাপং কর্তুং ব্যবসিতা বয়ম।
যদ রাজ্যসুখলোভেন হন্তুং স্বজনমুদ্যতাঃ ।। ৪৪ ।।
অহো- হ্যায়; বত- কী আশ্চর্য; মহৎ- মহা; পাপম- পাপ; কর্তুম- করতে; ব্যবসিতাঃ- সংকল্পবদ্ধ; বয়স- আমরা; যৎ- যেহেতু; রাজ্য-সুখ-লোভেন- রাজ্য-সুখের লোভে; হন্তুম- হত্যা করতে; স্বজনম- আত্মীয়-স্বজনদের; উদ্যতাঃ- উদ্যত।
গীতার গান
হায় হায় মহাপাপ করিতে উদ্যত।
হয়েছি আমরা শুধু হয়ে কলুষিত।।
রাজ্যের লোভেতে পড়ে এ দুষ্কার্য করি।
স্বজন হনন এই উচিত কি হরি?।।
অনুবাদঃ হায়! কি আশ্চর্যের বিষয় যে, আমরা রাজ্যসুখের লোভে স্বজনদের হত্যা করতে উদ্যত হয়ে মহাপাপ করতে সংকল্পবদ্ধ হয়েছি।
তাৎপর্যঃ স্বার্থসিদ্ধির জন্য মানুষকে মাতা-পিতা, ভাই-বন্ধুকে হত্যা করতে দেখা যায়। পৃথিবীর ইতিহাসে এর অনেক নজির আছে। কিন্তু ভগবদ্ভক্ত অর্জুন সদাসর্বদা নৈতিক কর্তব্য অকর্তব্যের প্রতি সচেতন, তাই তিনি এই ধরণের কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকাকেই শ্রেয় বলে মনে করেছেন।
শ্লোকঃ ৪৫
যদি মামপ্রতীকারমশস্ত্রং শস্ত্রপাণয়ঃ।
ধার্তরাষ্ট্রা রণে হন্যুস্তন্মে ক্ষেমতরং ভবেৎ ।। ৪৫ ।।
যদি- যদি; মাম- আমাকে; অপ্রতীকারম- প্রতিরোধ রহিত; অশস্ত্রম- নিরস্ত্র; শস্ত্রপাণয়ঃ- শস্ত্রধারী; ধার্তরাষ্ট্রাঃ- ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রেরা; রণে- রণক্ষেত্রে; হন্যুঃ- হত্যা করে; তৎ- তবে; মে –আমার; ক্ষেমতরম- অধিকতর মঙ্গল; ভবেৎ- হবে।
গীতার গান
যদি ধার্তরাষ্ট্রগণ আমাকে মারিয়া।
এই রণে রাজ্য লয় অশস্ত্র বুঝিয়া।।
সেও ভাল মনে করি যুদ্ধ সে অপেক্ষা।
বিনাযুদ্ধে সেই আমি করিব প্রতীক্ষা।।
অনুবাদঃ প্রতিরোধ রহিত ও নিরস্ত্র অবস্থায় আমাকে যদি শস্ত্রধারী ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রেরা যুদ্ধে বধ করে, তা হলে আমার অধিকতর মঙ্গলই হবে।
তাৎপর্যঃ ক্ষত্রিয় রণনীতি অনুসারে নিয়ম আছে, শত্রু যদি নিরস্ত্র হয় অথবা যুদ্ধে অনিচ্ছুক হয়, তবে তাঁকে আক্রমণ করা যাবে না। কিন্তু অর্জুন স্থির করলেন যে, এই রকম বিপজ্জনক অবস্থায় তাঁর শত্রুরা যদি তাঁকে আক্রমণও করে, তবুও তিনি যুদ্ধ করবেন না। তিনি বিবেচনা করে দেখলেন না, শত্রুপক্ষ যুদ্ধ করতে কতটা আগ্রহী ছিল। অর্জুনের এই ধরনের আচরণ ভগবদ্ভক্তোচিত কোমল হৃদয়বৃত্তির পরিচায়ক।
৯. পঞ্চম অধ্যায়ঃ কর্মসন্ন্যাস-যোগ
১২. অষ্টম অধ্যায়ঃ অক্ষরব্রক্ষ্ম-যোগ
১৫. একাদশ অধ্যায়ঃ বিশ্বরূপ-দর্শন-যোগ
১৭. ত্রয়োদশ অধ্যায়ঃ প্রকৃতি-পুরুষ-বিবেকযোগ
১৮. চতুর্দশ অধ্যায়ঃ গুণত্রয়-বিভাগ-যোগ
১৯. পঞ্চদশ অধ্যায়ঃ পুরুষত্তম-যোগ
২০. ষোড়শ অধ্যায়ঃ দৈবাসুর- সম্পদ-বিভাগযোগ
২১. সপ্তদশ অধ্যায়ঃ শ্রদ্ধাত্রয়-বিভাগ-যোগ
২৪. বর্তমান সংস্করণ সম্পর্কে টীকা
শ্রীমদ্ভগভদ গীতা সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ