শ্লোকঃ ৩৬

পাপমেবাশ্রয়েদস্মান হত্বৈতানাততায়িনঃ।

তস্মান্নারহা বয়ং হন্তুং ধার্তরাষ্ট্রান সবান্ধবান।

স্বজনং হই কথং হত্বা সুখিনঃ স্যাম মাধব ।। ৩৬ ।।

পাপম- পাপ; এব- নিশ্চয়ই; আশ্রয়েৎ- আশ্রয় করবে; অস্মান- আমাদের; হত্বা- বধ করলে; এতান- এদের সকলকে; আততায়িনঃ- আততায়ীদের; তস্মাৎ- তাই; ন- না; অরহা- উচিত; বয়ম- আমাদের; হন্তুম- হত্যা করা; ধার্তরাষ্ট্রান- ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রদের; সবান্ধবান- সবান্ধব; স্বজনম- স্বজনদের; হই- অবশ্যই; কথম- কিভাবে; হত্বা- হত্যা করে; সুখিনঃ- সুখী ; স্যাম- হব; মাধব- হে লক্ষ্মীপতি শ্রীকৃষ্ণ।

গীতার গান

এদের মারিলে মাত্র পাপ লাভ হবে।

এমন বিপক্ষ শত্রু কে দেখেছে কবে।।

এই ধার্তরাষ্ট্রগণ সবান্ধব হয়।

উভিত না হয় কার্য তাহাদের ক্ষয়।।

স্বজন মারিয়া বল কেবা কবে সুখী।

সুখলেশ নাহি মাত্র হব শুধু দুঃখী।।

অনুবাদঃ এই ধরনের আততায়ীদের বধ করলে মহাপাপ আমাদের আচ্ছন্ন করবে। সুতরাং বন্ধুবান্ধব সহ ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রদের সংহার করা আমাদের পক্ষে অবশ্যই উচিত হবে না। হে মাধব, লক্ষ্মীপতি শ্রীকৃষ্ণ! আত্মীয়-স্বজনদের হত্যা করে আমাদের কি লাভ হবে? আর তা থেকে আমরা কেমন করে সুখী হব?

তাৎপর্যঃ বেদের অনুশাসন অনুযায়ী শত্রু ছয় প্রকার- (১) যে বিষ প্রয়োগ করে, (২) যে ঘরে আগুন লাগায়, (৩) যে মারাত্মক অস্ত্র নিয়ে আক্রমণ করে, (৪) যে ধনসম্পদ লুন্ঠন করে, (৫) যে অন্যের জমি দখল করে এবং (৬) যে বিবাহিত স্ত্রীকে হরণ করে। এই ধরণের আততায়ীদের অবিলম্বে হত্যা করার নির্দেশ শাস্ত্রে দেওয়া হয়েছে এবং এদের হত্যা করলে কোন রকম পাপ হয় না। এই ধরণের শত্রুকে সমূলে বিনাশ করাটাই সাধারণ মানুষের পক্ষে স্বাভাবিক, কিন্তু অর্জুন সাধারণ মানুষ ছিলেন না। তাঁর চরিত্র ছিল সাধুসুলভ, তাই তিনি তাদের সঙ্গে সাধুসুলভ ব্যবহারই করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এই ধরনের সাধুসুলভ ব্যবহার ক্ষত্রিয়দের জন্য নয়। যদিও উচ্চপদস্থ রাজপুরুষকে সাধুর মতোই ধীর, শান্ত ও সংযত হতে হয়, তাই বলে তাঁকে কাপুরুষ হলে চলবে না। যেমন শ্রীরামচন্দ্র এতে সাধু প্রকৃতির ছিলেন যে, পৃথিবীর ইতিহাসে ‘রামরাজ্য’ শান্তি ও শৃঙ্খলার প্রতীক হিসাবে সর্বোচ্চ স্থান অধিকার করে আছে, কিন্তু তাঁর চরিত্রে কোন রকম কাপুরুষতা আমরা দেখতে পাই না। রাবণ ছিল রামের শত্রু, যেহেতু সে তাঁর পত্নী সীতাদেবীকে হরণ করেছিল এবং সেই জন্য শ্রীরামচন্দ্র তাকে এমন শাস্তি দিয়েছিলেন যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। অর্জুনের ক্ষেত্রে অবশ্য আমরা দেখতে পাই, তাঁর শত্রুরা ছিল অন্য ধরনের। পিতামহ, শিক্ষক, ভাই, বন্ধু, এরা সকলেই তাঁর শত্রু হবার ফলে সাধারণ শত্রুদের প্রতি যে-রকম আচরণ করতে হয়, তা তিনি করতে পারছিলেন না। তা ছাড়া, সাধু প্রকৃতির লোকেরা সর্বদাই ক্ষমাশীল। শাস্ত্রেো সাধু প্রকৃতির লোককে ক্ষমাপরায়ণ হবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং সাধুদের প্রতি এই ধরনের উপদেশ যে-কোন রাজনৈতিক সঙ্কটকালীন অনুশাসন থেকেও অধিক গুরুত্বপূর্ণ। অর্জুন মনে করেছিলেন, রাজনৈতিক কারণবশত তাঁর আত্মীয়-স্বজনকে হত্যা করার চেয়ে সাধুসুলভ আচরণ ও ধর্মের ভিত্তিতে তাদের ক্ষমা করাই শ্রেয়। তাই, সাময়িক দেহগত সুখের জন্য এই হত্যাকার্যে লিপ্ত হওয়া তিনি সমীচীন বলে মনে করেননি। তিনি বুঝেছিলেন, রাজ্য ও রাজ্যসুখ অনিত্য। তাই, এই ক্ষণস্থায়ী সুখের জন্য আত্মীয়স্বজন হত্যার পাপে লিপ্ত হয়ে মুক্তির পথ চিরতরে রুদ্ধ করার ঝুঁকি তিনি কেন নেবেন? এখানে অর্জুন যে শ্রীকৃষ্ণকে ‘মাধব’ অথবা লক্ষ্মীপতি বলে সম্বোধন করেছেন, তা তাৎপর্যপূর্ণ। এই নামের দ্বারা তাঁকে সম্বোধন করে অর্জুন বুঝিয়ে দিলেন, তিনি হচ্ছেন সৌভাগ্যের অধিষ্ঠাত্রী লক্ষ্মীদেবীর পতি, তাই অর্জুনকে এমন কোন কার্যে প্ররোচিত করা তাঁর কর্তব্য নয়, যার পরিণতি হবে দুর্ভাগ্যজনক। শ্রীকৃষ্ণ অবশ্য কাউকেই দুর্ভাগ্য এনে দেন না, সুতরাং তাঁর ভক্তের ক্ষেত্রে তো সেই কথা ওঠেই না।

শ্লোকঃ ৩৭-৩৮

যদ্যপ্যেতে ন পশ্যন্তি লোভোপহতচেতসঃ।

কুলক্ষয়কৃতং দোষং মিত্রদ্রোহে চ পাতকম ।। ৩৭ ।।

কথং ন জ্ঞেয়মস্মাভিঃ পাপাদস্মান্নিবর্তিতুম।

কুলক্ষয়কৃতং দোষং  প্রপশ্যদ্ভির্জনার্দন ।। ৩৮ ।।

যদি- যদি; অপি- এমন কি; এতে- এরা; ন- না; পশ্যন্তি- দেখছে; লোভ- লোভে; উপহত- অভিভূত; চেতসঃ- চিত্ত; কুলক্ষয়- বংশনাশ; কৃতম- জনিত; দোষম- দোষ; মিত্রদ্রোহে- মিত্রের প্রতি শত্রুতায়; চ- ও; পাতকম- পাপ; কথম- কেন; ন- না; জ্ঞেয়ম- জানবে; অস্মাভিঃ- আমাদের দ্বারা; পাপাৎ- পাপ থেকে; অস্মাৎ- এই; নিবর্তিতুম- নিবৃত্ত হতে; কুলক্ষয়- বংশনাশ; কৃতম- জনিত; দোষম- অপরাধ; প্রপশ্যদ্ভিঃ- দর্শনকারী; জনার্দন- হে কৃষ্ণ।

গীতার গান

যদ্যপি এরা নাহি দেখে লোভীজন।

কুলক্ষয় মিত্রদ্রোহ সব অলক্ষণ।।

এসব পাপের রাশি কে বহিতে পারে।

বুঝিবে তুমি ত সব বুঝাবে আমারে।।

উচিত কি নহে এই পাপে নিবৃত্তি।

বুঝা কি উচিত নহে সেই কুপ্রবৃত্তি।।

কুলক্ষয়ে যেই দোষ জান জনার্দন।

অতএব এই যুদ্ধ কর নিবারণ।।

অনুবাদঃ যে জনার্দন! যদিও এরা রাজ্যলোভে অভিভূত হয়ে কুলক্ষয় জনিত দোষ ও মিত্রদ্রোহ নিমিত্ত পাপ লক্ষ্য করছে না, কিন্তু আমরা কুলক্ষয় জনিত দোষ লক্ষ্য করেও এই পাপকর্মে কেন প্রবৃত্ত হব?

তাৎপর্যঃ যুদ্ধে ও পাশাখেলায় আহ্বান করা হলে কোনও ক্ষত্রিয় বিরোধীপক্ষের সেই আহ্বান প্রত্যাখ্যান করতে পারেন না। দুর্যোধন সেই যুদ্ধে অর্জুনকে আহ্বান করেছিলেন, তাই যুদ্ধ করতে অর্জুন বাধ্য ছিলেন। কিন্তু এই অবস্থায় অর্জুন বিবেচনা করে দেখলেন যে, তাঁর বিরুদ্ধপক্ষের সকলেই এই যুদ্ধের পরিণতি সম্বন্ধে একেবারে অন্ধ হতে পারে, কিন্তু তা বলে তিনি এই যুদ্ধের অমঙ্গলজনক পরিণতি উপলব্ধি করতে পারার পর, সেই যুদ্ধের আমন্ত্রণ গ্রহণ করতে পারবেন না। এই ধরণের আমন্ত্রণের বাধ্যবাধকতা নেই। এই সব কথা সুনিশ্চিতভাবে বিবেচনা করে অর্জুন এই যুদ্ধ থেকে নিরস্ত থাকতে মনস্থির করেছিলেন।

error: Content is protected !!
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x