শ্লোক – ৩২-৩৫

কিং নো রাজ্যেন গোবিন্দ কিং ভোগৈর্জীবিতেন বা।

যেষামর্থে কাঙ্ক্ষিতং নো রাজ্যং ভোগাঃ সুখানি চ ।। ৩২ ।।

ত ইমেহবস্থিতা যুদ্ধে প্রাণাংস্ত্যক্তা ধনানি চ ।

আচার্যাঃ পিতরঃ পুত্রাস্তথৈব চ পিতামহাঃ ।। ৩৩ ।।

মাতুলাঃ শ্বশুরাঃ পৌত্রাঃ শ্যালাঃ সম্বন্ধিনস্তথা।

এতান্ন হন্তুমিচ্ছামি ঘ্নতোহপি মধুসূদন ।। ৩৪ ।।

অপি ত্রৈলোক্যরাজ্যস্য হেতোঃ কিং নু মহীকৃতে।

নিহত্য ধার্তরাষ্ট্রান্নঃ কা প্রীতিঃ স্যাজ্জনার্দন ।। ৩৫ ।।

কিম- কি প্রয়োজন; নঃ- আমাদের; রাজ্যেন- রাজ্যে; গোবিন্দ- মহে কৃষ্ণ; কিম- কি; ভোগৈঃ- সুখভোগ; জীবিতেন- বেঁচে থেকে; বা- অথবা; যেষাম- যাদের; অর্থে- জন্য; কাঙ্ক্ষিতম- আকাঙ্ক্ষিত; নঃ- আমাদের; রাজ্যম- রাজ্য; ভোগাঃ- ভোগসমূহ; সুখানি- সমস্ত সুখ; চ- ও; তে- তারা সকলে; ইমে- এই; অবস্থিতাঃ- অবস্থিত; যুদ্ধে- রণক্ষেত্রে; প্রাণাণ- প্রাণ; ত্যক্তা- ত্যাগ করে; ধনানি- ধনসম্পদ; চ- ও; আচার্যাঃ- আচার্যগণ; পিতরঃ- পিতৃব্যগণ; পুত্রাঃ- পুত্রগণ; তথা- এবং; এব- অবশ্যই চ- ও; পিতামহাঃ- পিতামহগণ; মাতুলাঃ- মাতুলগণ; শ্বশুরাঃ- শ্বশুরগণ; পৌত্রাঃ- পৌত্রগণ; শ্যালাঃ- শ্যালকগণ; সম্বন্ধিনঃ- কুটুম্বগণ; তথা- এবং; এতান- এই সমস্ত; ন- না; হন্তুম- হত্যা করতে; ইচ্ছামি- ইচ্ছা করি; ঘ্নতঃ- হত হলে; অপি- ও; মধুসূদন- হে মধু দৈত্যহন্তা (শ্রীকৃষ্ণ); অপি- এমন কি; ত্রৈলোক্য- ত্রিভুবনের; রাজ্যস্য- রাজ্যের জন্য; হেতোঃ- বিনিময়ে; কিম নু- কি আর কথা; মহীকৃতে- পৃথিবীর জন্য; নিহত্য- বধ করে; ধার্তরাষ্ট্রান- ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রগণের; নঃ- আমাদের; কা- কি; প্রীতিঃ- সুখ; স্যাৎ- হবে; জনার্দন- হে সমস্ত জীবের পালনকর্তা।

গীতার গান

যাদের লাগিয়া চাহি সুখ-ভোগ শান্তি।

তারাই এসেছে হেথা দিতে সে অশান্তি।।

ধন প্রাণ সব ত্যজি মরিবার তরে।

সবাই এসেছে হেথা কে জীয়ে কে মরে।।

এসেছে আচার্য পূজ্য পিতার সমান।

সঙ্গে আছে পিতামত আর পুত্রগণ।।

মাতুল শ্বশুর পৌত্র কত যে কহিব।

শালা আর সম্বন্ধী সবাই মরিব।।

আমি মরি ক্ষতি নাই এরা যদি মরে।

এদের মরিতে শক্তি নাহি দেখিবারে।।

ত্রিভুবন রাজ্য যদি পাইব জিনিয়া।

তথাপি না লই তাহা এদের মারিয়া।।

ধার্তরাষ্ট্রগণে মারি কিবা প্রীতি হবে।

জনার্দন তুমি কৃষ্ণ আপনি কহিবে।।

অনুবাদঃ হে গোবিন্দ। আমাদের রাজ্যে কি প্রয়োজন, আর সুখভোগ বা জীবন ধারণেই বা কি প্রয়োজন, যখন দেখছি – যাদের জন্য রাজ্য ভোগসুখের কামনা, তারা সকলেই এই রণক্ষেত্রে আজ উপস্থিত? হে মধুসূদন। যখন আচার্য, পিতৃব্য, পুত্র, পিতামহ, মাতুল, শ্বশুর, পৌত্র, শ্যালক ও আত্মীয়স্বজন, সকলেই প্রাণ ও ধনাদির আশা পরিত্যাগ করে আমার সামনে যুদ্ধে উপস্থিত হয়েছেন, তখন তাঁরা আমাকে বধ করলেও আমি তাঁদের হত্যা করতে চাইব কেন? হে সমস্ত জীবের প্রতিপালক জনার্দন। পৃথিবীর তো কথাই নেই, এমন কি সমগ্র ত্রিভুবনের বিনিময়েও আমি যুদ্ধ করতে প্রস্তুত নই। ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রদের নিধন করে কি সন্তোষ আমরা লাভ করতে পারব?

তাৎপর্যঃ অর্জুন শ্রীকৃষ্ণকে গোবিন্দ নামে সম্বোধন করেছেন, যেহেতু শ্রীকৃষ্ণ গো অর্থাৎ গরু ও ইন্দ্রিয়গুলিকে আনন্দ দান করেন। এই তাৎপর্যপূর্ণ নামের দ্বারা তাঁকে সম্বোধন করার মাধ্যমে তিনি প্রকাশ করেছেন, কিসে তাঁর নিজের ইন্দ্রিয় তৃপ্ত হবে। বাস্তবিকপক্ষে, গোবিন্দ নিজে আমাদের ইন্দ্রিয়গুলিকে তৃপ্ত করেন না, কিন্তু আমরা যদি গোবিন্দের ইন্দ্রিয়গুলিকে তৃপ্ত করি, তবে আমাদের ইন্দ্রিয়গুলি আপনা থেকেই তৃপ্ত জয়ে যায়। দেহাত্মবুদ্ধি-সম্পন্ন মানুষেরা তাদের নিজেদের ইন্দ্রিয়গুলির তৃপ্তিসাধন করতে ব্যস্ত এবং তারা চায়, ভগবান তাদের ইন্দ্রিয়গুলির সব রকম তৃপ্তির যোগান দিয়ে যাবেন। যার যতটা ইন্দ্রিয়তৃপ্তি প্রাপ্য, ভগবান তাকে তা দিয়ে থাকেন। কিন্তু তা বলে আমরা যত চাইব, ভগবান ততই দিয়ে যাবেন, মনে করা ভুল। কিন্তু তার বিপরীত পন্থা গ্রহণ করে, অর্থাৎ যখন আমরা আমাদের ইন্দ্রিয়-তৃপ্তির কথা না ভেবে গোবিন্দের ইন্দ্রিয়ের সেবায় ব্রতী হই, তখন গোবিন্দের আশীর্বাদে আমাদের মসস্ত বাসনা আপনা থেকেই তৃপ্ত হয়ে যায়। আত্মীয়-স্বজনের প্রতি অর্জুনের গভীর মমতা তাঁর স্বভাবজাত করুণার প্রকাশ এবং এই মমতার বশবর্তী হয়ে তিনি যুদ্ধ করতে নারাজ হন। প্রত্যেকেই নিজের সৌভাগ্য ও ঐশ্চর্য তার বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনকে দেখাতে চায়। কিন্তু অর্জুন যখন বুঝতে পারলেন, যুদ্ধে তাঁর সমস্ত আত্মীয়স্বজন নিহত হবে এবং যুদ্ধের শেষে সেই যুদ্ধলব্ধ ঐশ্চর্য ভোগ করবার জন্য তাঁর সঙ্গে আর কেউ থাকবে না, তখন ভয়ে ও নৈরাশ্যে তিনি মুহ্যমান হয়ে পড়েন। সাংসারিক মানুষের স্বভাবতই হচ্ছে ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে এই ধরনের হিসাব-নিকাশ এবং জল্পনা-কল্পনা করা। কিন্তু অপ্রাকৃত অনুভূতিসম্পন্ন জীবন অবশ্য ভিন্ন ধরনের। তাই ভগবদ্ভক্তের মনোভাব সম্পূর্ণ ভিন্ন। ভগবানকে তৃপ্ত করাটাই হচ্ছে তাঁর একমাত্র ব্রত, তাই ভগবান যখন চান, তখন তিনি পৃথিবীর সব রকম ঐশ্চর্য গ্রহণ করতে কুন্ঠিত হন না। আবার ভগবান যখন চান না, তখন তিনি একটি কপর্দকও গ্রহণ করেন না। অর্জুন সেই যুদ্ধে তাঁর আত্মীয়-স্বজনদের হত্যা করতে চাননি এবং তাঁদের হত্যা করাটা যদি একান্তই প্রয়োজন থাকে, তবে তিনি চেয়েছিলেন, শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং তাদের বিনাশ করুন। তখনও অবশ্য তিনি জানতেন না, যুদ্ধক্ষেত্রে আসার পূর্বেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ইচ্ছায় তারা সকলেই হত হয়ে আছে, এবং সেই ইচ্ছাকে রূপ দেবার জন্য তিনি ছিলেন কেবল একটি উপলক্ষ্য মাত্র। পরবর্তী অধ্যায়গুলিতে এই কথা বিশদভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। ভগবানের শুদ্ধ ভক্ত অর্জুনের কোন ইচ্ছাই ছিল না তাঁর দুর্বৃত্ত ভাইদের উপর প্রতিশোধ নেবার, কিন্তু ভগবান চেয়েছিলেন তাদের সকলকে বিনাশ করতে। ভগবানের ভক্ত কখনই কারও প্রতি প্রতিহিংসা পরায়ণ হন না, অন্যায়ভাবে যে তাঁকে প্রতারণা করে, তার প্রতিও তিনি করুণা বর্ষণ করেন। কিন্তু ভগবানের ভক্তকে যে আঘাত দেয়, ভগবান কখনোই তাকে সহ্য করেন না। ভগবানের শ্রীচরণে কোন অপরাধ করলে ভগবান তা ক্ষমা করতে পারেন, কিন্তু তাঁর ভক্তের প্রতি অন্যায় ভগবান ক্ষমা করেন না। তাই অর্জুন যদিও সেই দুর্বৃত্তদের ক্ষমা করতে চেয়েছিলেন, তবুও ভগবান তাদের বিনাশ করা থেকে নিরস্ত হননি।

শ্লোকঃ ৩৬

পাপমেবাশ্রয়েদস্মান হত্বৈতানাততায়িনঃ।

তস্মান্নারহা বয়ং হন্তুং ধার্তরাষ্ট্রান সবান্ধবান।

স্বজনং হই কথং হত্বা সুখিনঃ স্যাম মাধব ।। ৩৬ ।।

পাপম- পাপ; এব- নিশ্চয়ই; আশ্রয়েৎ- আশ্রয় করবে; অস্মান- আমাদের; হত্বা- বধ করলে; এতান- এদের সকলকে; আততায়িনঃ- আততায়ীদের; তস্মাৎ- তাই; ন- না; অরহা- উচিত; বয়ম- আমাদের; হন্তুম- হত্যা করা; ধার্তরাষ্ট্রান- ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রদের; সবান্ধবান- সবান্ধব; স্বজনম- স্বজনদের; হই- অবশ্যই; কথম- কিভাবে; হত্বা- হত্যা করে; সুখিনঃ- সুখী ; স্যাম- হব; মাধব- হে লক্ষ্মীপতি শ্রীকৃষ্ণ।

গীতার গান

এদের মারিলে মাত্র পাপ লাভ হবে।

এমন বিপক্ষ শত্রু কে দেখেছে কবে।।

এই ধার্তরাষ্ট্রগণ সবান্ধব হয়।

উভিত না হয় কার্য তাহাদের ক্ষয়।।

স্বজন মারিয়া বল কেবা কবে সুখী।

সুখলেশ নাহি মাত্র হব শুধু দুঃখী।।

অনুবাদঃ এই ধরনের আততায়ীদের বধ করলে মহাপাপ আমাদের আচ্ছন্ন করবে। সুতরাং বন্ধুবান্ধব সহ ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রদের সংহার করা আমাদের পক্ষে অবশ্যই উচিত হবে না। হে মাধব, লক্ষ্মীপতি শ্রীকৃষ্ণ! আত্মীয়-স্বজনদের হত্যা করে আমাদের কি লাভ হবে? আর তা থেকে আমরা কেমন করে সুখী হব?

তাৎপর্যঃ বেদের অনুশাসন অনুযায়ী শত্রু ছয় প্রকার- (১) যে বিষ প্রয়োগ করে, (২) যে ঘরে আগুন লাগায়, (৩) যে মারাত্মক অস্ত্র নিয়ে আক্রমণ করে, (৪) যে ধনসম্পদ লুন্ঠন করে, (৫) যে অন্যের জমি দখল করে এবং (৬) যে বিবাহিত স্ত্রীকে হরণ করে। এই ধরণের আততায়ীদের অবিলম্বে হত্যা করার নির্দেশ শাস্ত্রে দেওয়া হয়েছে এবং এদের হত্যা করলে কোন রকম পাপ হয় না। এই ধরণের শত্রুকে সমূলে বিনাশ করাটাই সাধারণ মানুষের পক্ষে স্বাভাবিক, কিন্তু অর্জুন সাধারণ মানুষ ছিলেন না। তাঁর চরিত্র ছিল সাধুসুলভ, তাই তিনি তাদের সঙ্গে সাধুসুলভ ব্যবহারই করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এই ধরনের সাধুসুলভ ব্যবহার ক্ষত্রিয়দের জন্য নয়। যদিও উচ্চপদস্থ রাজপুরুষকে সাধুর মতোই ধীর, শান্ত ও সংযত হতে হয়, তাই বলে তাঁকে কাপুরুষ হলে চলবে না। যেমন শ্রীরামচন্দ্র এতে সাধু প্রকৃতির ছিলেন যে, পৃথিবীর ইতিহাসে ‘রামরাজ্য’ শান্তি ও শৃঙ্খলার প্রতীক হিসাবে সর্বোচ্চ স্থান অধিকার করে আছে, কিন্তু তাঁর চরিত্রে কোন রকম কাপুরুষতা আমরা দেখতে পাই না। রাবণ ছিল রামের শত্রু, যেহেতু সে তাঁর পত্নী সীতাদেবীকে হরণ করেছিল এবং সেই জন্য শ্রীরামচন্দ্র তাকে এমন শাস্তি দিয়েছিলেন যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। অর্জুনের ক্ষেত্রে অবশ্য আমরা দেখতে পাই, তাঁর শত্রুরা ছিল অন্য ধরনের। পিতামহ, শিক্ষক, ভাই, বন্ধু, এরা সকলেই তাঁর শত্রু হবার ফলে সাধারণ শত্রুদের প্রতি যে-রকম আচরণ করতে হয়, তা তিনি করতে পারছিলেন না। তা ছাড়া, সাধু প্রকৃতির লোকেরা সর্বদাই ক্ষমাশীল। শাস্ত্রেো সাধু প্রকৃতির লোককে ক্ষমাপরায়ণ হবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং সাধুদের প্রতি এই ধরনের উপদেশ যে-কোন রাজনৈতিক সঙ্কটকালীন অনুশাসন থেকেও অধিক গুরুত্বপূর্ণ। অর্জুন মনে করেছিলেন, রাজনৈতিক কারণবশত তাঁর আত্মীয়-স্বজনকে হত্যা করার চেয়ে সাধুসুলভ আচরণ ও ধর্মের ভিত্তিতে তাদের ক্ষমা করাই শ্রেয়। তাই, সাময়িক দেহগত সুখের জন্য এই হত্যাকার্যে লিপ্ত হওয়া তিনি সমীচীন বলে মনে করেননি। তিনি বুঝেছিলেন, রাজ্য ও রাজ্যসুখ অনিত্য। তাই, এই ক্ষণস্থায়ী সুখের জন্য আত্মীয়স্বজন হত্যার পাপে লিপ্ত হয়ে মুক্তির পথ চিরতরে রুদ্ধ করার ঝুঁকি তিনি কেন নেবেন? এখানে অর্জুন যে শ্রীকৃষ্ণকে ‘মাধব’ অথবা লক্ষ্মীপতি বলে সম্বোধন করেছেন, তা তাৎপর্যপূর্ণ। এই নামের দ্বারা তাঁকে সম্বোধন করে অর্জুন বুঝিয়ে দিলেন, তিনি হচ্ছেন সৌভাগ্যের অধিষ্ঠাত্রী লক্ষ্মীদেবীর পতি, তাই অর্জুনকে এমন কোন কার্যে প্ররোচিত করা তাঁর কর্তব্য নয়, যার পরিণতি হবে দুর্ভাগ্যজনক। শ্রীকৃষ্ণ অবশ্য কাউকেই দুর্ভাগ্য এনে দেন না, সুতরাং তাঁর ভক্তের ক্ষেত্রে তো সেই কথা ওঠেই না।

শ্লোকঃ ৩৭-৩৮

যদ্যপ্যেতে ন পশ্যন্তি লোভোপহতচেতসঃ।

কুলক্ষয়কৃতং দোষং মিত্রদ্রোহে চ পাতকম ।। ৩৭ ।।

কথং ন জ্ঞেয়মস্মাভিঃ পাপাদস্মান্নিবর্তিতুম।

কুলক্ষয়কৃতং দোষং  প্রপশ্যদ্ভির্জনার্দন ।। ৩৮ ।।

যদি- যদি; অপি- এমন কি; এতে- এরা; ন- না; পশ্যন্তি- দেখছে; লোভ- লোভে; উপহত- অভিভূত; চেতসঃ- চিত্ত; কুলক্ষয়- বংশনাশ; কৃতম- জনিত; দোষম- দোষ; মিত্রদ্রোহে- মিত্রের প্রতি শত্রুতায়; চ- ও; পাতকম- পাপ; কথম- কেন; ন- না; জ্ঞেয়ম- জানবে; অস্মাভিঃ- আমাদের দ্বারা; পাপাৎ- পাপ থেকে; অস্মাৎ- এই; নিবর্তিতুম- নিবৃত্ত হতে; কুলক্ষয়- বংশনাশ; কৃতম- জনিত; দোষম- অপরাধ; প্রপশ্যদ্ভিঃ- দর্শনকারী; জনার্দন- হে কৃষ্ণ।

গীতার গান

যদ্যপি এরা নাহি দেখে লোভীজন।

কুলক্ষয় মিত্রদ্রোহ সব অলক্ষণ।।

এসব পাপের রাশি কে বহিতে পারে।

বুঝিবে তুমি ত সব বুঝাবে আমারে।।

উচিত কি নহে এই পাপে নিবৃত্তি।

বুঝা কি উচিত নহে সেই কুপ্রবৃত্তি।।

কুলক্ষয়ে যেই দোষ জান জনার্দন।

অতএব এই যুদ্ধ কর নিবারণ।।

অনুবাদঃ যে জনার্দন! যদিও এরা রাজ্যলোভে অভিভূত হয়ে কুলক্ষয় জনিত দোষ ও মিত্রদ্রোহ নিমিত্ত পাপ লক্ষ্য করছে না, কিন্তু আমরা কুলক্ষয় জনিত দোষ লক্ষ্য করেও এই পাপকর্মে কেন প্রবৃত্ত হব?

তাৎপর্যঃ যুদ্ধে ও পাশাখেলায় আহ্বান করা হলে কোনও ক্ষত্রিয় বিরোধীপক্ষের সেই আহ্বান প্রত্যাখ্যান করতে পারেন না। দুর্যোধন সেই যুদ্ধে অর্জুনকে আহ্বান করেছিলেন, তাই যুদ্ধ করতে অর্জুন বাধ্য ছিলেন। কিন্তু এই অবস্থায় অর্জুন বিবেচনা করে দেখলেন যে, তাঁর বিরুদ্ধপক্ষের সকলেই এই যুদ্ধের পরিণতি সম্বন্ধে একেবারে অন্ধ হতে পারে, কিন্তু তা বলে তিনি এই যুদ্ধের অমঙ্গলজনক পরিণতি উপলব্ধি করতে পারার পর, সেই যুদ্ধের আমন্ত্রণ গ্রহণ করতে পারবেন না। এই ধরণের আমন্ত্রণের বাধ্যবাধকতা নেই। এই সব কথা সুনিশ্চিতভাবে বিবেচনা করে অর্জুন এই যুদ্ধ থেকে নিরস্ত থাকতে মনস্থির করেছিলেন।

শ্লোকঃ ৩৯

কুলক্ষয়ে প্রণশ্যন্তি কুলধর্মাঃ সনাতনাঃ।

ধর্মে নষ্টে কুলং কৃৎস্নমধর্মোহভিভবত্যুত ।। ৩৯ ।।

কুলক্ষয়ে- বংশনাশ হলে; প্রণশ্যন্তি- বিনষ্ট হয়; কুলধর্মাঃ- কুলধর্ম; সনাতনাঃ- চিরাচরিত; ধর্মে- ধর্ম; নষ্টে- নষ্ট হলে; কুলম- বংশকে; কৃৎস্নম- সমগ্র; অধর্মঃ- অধর্মঃ- অধর্ম; অভিভবতি- অভিভূত- অভিভূত করে; উত- বলা হয়।

গীতার গান

কুলক্ষয়ে কলুষিত সনাতন ধর্ম।

ধর্মনষ্টে প্রাদুর্ভাবে হইবে অধর্ম।।

অনুবাদঃ কুলক্ষয় হলে সনাতন কুলধর্ম বিনষ্ট হয় এবং তা হলে সমগ্র বংশ অধর্মে অভিভূত হয়।

তাৎপর্যঃ বর্ণাশ্রম সমাজ-ব্যবস্থায় অনেক রীতিনীতি ও আচার-অনুষ্ঠানের নির্দেশ দেওয়া আছে, যা পরিবারের প্রতিটি লোকের যথাযথ পারমার্থিক উন্নতি সাধনে সহায়তা করে। পরিবারের প্রবীণ সদস্যেরা পরিবারভুক্ত অন্য সকলের জন্ম থেকে আরম্ভ করে মৃত্যু পর্যন্ত শুদ্ধিকরণ সংস্কার দ্বারা তাদের যথাযথ মঙ্গল সাধন করার জন্য সর্বদাই তৎপর থাকেন। কিন্তু এই সমস্ত প্রবীণ লোকদের মৃত্যু হলে, মঙ্গলজনক এই সমস্ত পারিবারিক প্রথাকে রূপ দেওয়ার মতো কেউ থাকে না। তখন পরিবারের অল্পবয়স্ক সদস্যেরা অমঙ্গলজনক কাজকর্মে লিপ্ত হতে পারে এবং তার ফলে তাদের আত্মার মুক্তির সম্ভাবনা চিরতরে নষ্ট হয়ে যায়। তাই, কোন কারণেই পরিবারের সদস্যদের হত্যা করা উচিত নয়।

শ্লোকঃ ৪০

অধর্মাভিভবাৎ কৃষ্ণ প্রদুষ্যন্তি কুলস্ত্রিয়ঃ।

স্ত্রীষু দুষ্টাসু বারষ্ণেয় জায়তে বর্ণসঙ্করঃ ।। ৪০ ।।

অধর্ম- অধর্ম; অভিভাৎ- প্রাদুর্ভাব  হলে; কৃষ্ণ- হে কৃষ্ণ; প্রদুষ্যন্তি- ব্যভিচারে প্রবৃত্ত হয়; কুলস্ত্রিয়ঃ- কুলবধূগণ; স্ত্রীষু- স্ত্রীলোকেরা; দুষ্টাসু- অসৎ চরিত্রা হলে; বারষ্ণেয়- হে বৃষ্ণিবংশজ; জায়তে- উৎপন্ন হয়; বর্ণসঙ্করঃ- অবাঞ্চিত প্রজাতি।

গীতার গান

অধর্মের প্রাদুর্ভাবে কুলনারীগণ।।

পতিতা হইবে সব কর অন্বেষণ।।

অনুবাদঃ হে কৃষ্ণ। কুল অধর্মের দ্বারা অভিভূত হলে কুলবধূগণ ব্যবভিচারে প্রবৃত্ত হয় এবং হে বারষ্ণেয়। কুলস্ত্রীগণ অসৎ চরিত্রা হলে অবাঞ্চিত প্রজাতি উৎপন্ন হয়।

তাৎপর্যঃ সমাজের প্রতিটি মানুষ যখন সৎ জীবনযাপন করে, তখনই সমাজে শান্তি ও সমৃদ্ধি দেখা দেয় এবং মানুষের জীবন অপ্রাকৃত ঐশ্চর্যে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। বর্ণাশ্রম প্রথার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল সমাজ-ব্যবস্থাকে এমনভাবে গড়ে তোলা, যার ফলে সমাজের মানুষেরা সৎ জীবনযাপন করে সর্বতোভাবে পারমার্থিক উন্নতি লাভ করতে পারে। এই ধরনের সৎ জীবনযাপন করে সর্বতোভাবে পারমার্থিক উন্নতি লাভ করতে পারে। এই ধরণের সৎ জীবনযাপন করে সর্বতোভাবে পারমার্থিক উন্নতি লাভ করতে পারে। এই ধরণের সৎ জনগণ তখনই উৎপন্ন হন, যখন সমাজের স্ত্রীলোকেরা সৎ চরিত্রবর্তী ও সত্যনিষ্ঠ হয়। শিশুদের মধ্যে এমন অতি সহজেই বিপথগামী হবার প্রবণতা দেখা যায়, স্ত্রীলোকদের মধ্যেও তেমন অতি সহজেই অধঃপতিত হবার প্রবণতা থাকে। তাই, শিশু ও স্ত্রীলোক উভয়েরই পরিবারের প্রবীণদের কাছ থেকে প্রতিরক্ষা ও তত্বাবধানের একান্ত প্রয়োজন। নানা রকম ধর্মীয় অনুষ্ঠানে নিয়োজিত করার মাধ্যমে স্ত্রীলোকদের চিত্তবৃত্তিকে পবিত্র ও নির্মল রাখা হয় এবং এভাবেই তাদের ব্যভিচারী মনোবৃত্তিকে সংযত করা হয়। চাণক্য পণ্ডিত বলে গেছেন, স্ত্রীলোকেরা সাধারণত অল্পবুদ্ধিসম্পন্না, তাই তারা নির্ভরযোগ্য অথবা বিশ্বস্ত নয়। সেই জন্য তাদের পূজার্চনা আদি গৃহস্থালির নানা রকম ধর্মানুষ্ঠানে সব সময় নিয়োজিত রাখতে হয় এবং তার ফলে তাদের ধর্মে মতি হয় এবং চরিত্র নির্মল হয়। তারা তখন চরিত্রবান, ধর্মপরায়ণ সন্তানের জন্ম দেয়, যারা হয় বর্ণাশ্রম-ধর্ম পালন করার উপযুক্ত। বর্ণাশ্রম-ধর্ম পালন না করলে, স্বভাবতই স্ত্রীলোকেরা অবাধে পুরুষদের সঙ্গে মেলামেশা করতে শুরু করে এবং তাদের ব্যভিচারের ফলে সমাজে অবাঞ্চিত সন্তান-সন্ততির জন্ম হয়। দায়িত্বজ্ঞানশূন্য লোকদের পৃষ্ঠপোষকতায় যখন সমাজে ব্যভিচার প্রকট হয়ে ওঠে এবং অবাঞ্চিত মানুষে সমাজ ছেয়ে যায়, তখন মহামারী ও যুদ্ধ দেখা দিয়ে মানব-সমাজকে ধ্বংসোন্মুখ করে তোলে।

error: Content is protected !!
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x