শ্লোক – ২৯

বেপথুশ্চ শরীরে মে রোমহর্ষশ্চ জায়তে।

গান্ডীবং স্রংসতে হস্তাৎ ত্বক চৈব পরিদহ্যতে ।। ২৯ ।।

বেপথুঃ- কম্প; চ- ও; শরীরে- দেহ; মে- আমার; রোমহর্ষঃ- রোমাঞ্চ; চ- ও; জয়তে- হচ্ছে; গান্ডীবম- গান্ডীব নামক অর্জুনের ধনুক; স্রংসতে- সম্বলিত হচ্ছে; হস্তাৎ- হাত থেকে; ত্বক- ত্বক; চ- ও; এব- অবশ্যই; পরিদহ্যতে- দগ্ধ হচ্ছে।

গীতার গান

কাঁপিছে শরীর মোর সহিতে না পারি।

গান্ডীব খসিয়া যায় কি করিয়া ধরি।।

জ্বলিয়া উঠিছে ত্বক মহাতাপ বাণ।

হইও না হইও না বন্ধু আর আগুয়ান।।

অনুবাদঃ আমার সর্বশরীর কম্পিত ও রোমাঞ্চিত হচ্ছে, আমার হাত থেকে গান্ডীব খসে পড়ছে এবং ত্বক যেন জ্বলে যাচ্ছে।

তাৎপর্যঃ শরীরে কম্পন দেখা দেওয়ার দুটি কারণ আছে এবং রোমাঞ্চ হওয়ারও দুটি কারণ আছে। তার একটি হচ্ছে চিন্ময় আনন্দের অনুভূতি এবং অন্যটি হচ্ছে প্রচন্ড জড়-জাগতিক ভয়। অপ্রাকৃত অনুভূতি হলে কোন ভয় থাকে না। অর্জুনের এই রোমাঞ্চ ও কম্পন অপ্রাকৃত আনন্দের অনুভূতির ফলে নয়, পক্ষান্তরে জড়-জাগতিক ভয়ের ফলে। এই ভয়ের উদ্রেক হয়েছিল তাঁর আত্মীয়-পরিজনদের প্রাণহানির আশঙ্কার ফলে। তার সামান্য লক্ষণ দেখেও আমরা তা স্পষ্টভাবে বুঝতে পারি। অর্জুন এতই অস্থির হয়ে পড়েছিলেন যে, তাঁর হাত থেকে গান্ডীব ধনু খসে পড়েছিল এবং প্রচন্ড দুঃখে তাঁর হৃদয় দগ্ধ হবার ফলে, তাঁর ত্বক জ্বলে যাচ্ছিল। এই সমস্ত কিছুরই মূল কারণ হচ্ছে ভয়। অর্জুন এই মনে করে ভীষণভাবে ভীত হয়ে পড়েছিলেন যে, তাঁর সমস্ত আত্মীয়-স্বজনেরা সেই যুদ্ধে হত হবে এবং এই যে হারাবার ভয়, তারই বাহ্যিক প্রকাশ হচ্ছিল তাঁর দেহের কম্পন, রোমাঞ্চ, মুখ শুকিয়ে যাওয়া, গা জ্বালা করা আদির মাধ্যমে। গভীরভাবে বিবেচনা করলে আমরা দেখতে পাই, অর্জুনের এই ভয়ের কারণ হচ্ছে, তিনি তাঁর দেহটিকেই তাঁর স্বরূপ বলে মনে করেছিলেন এবং তাঁর দেহের সম্বন্ধে যারা তথাকথিত আত্মীয়, তাদের হারাবার শোকে তিনি মুহ্যমান হয়ে পড়েছিলেন।

শ্লোক – ৩০

ন চ শক্লোম্যবস্থাতুং ভ্রমতীব চ মে মনঃ।

নিমিত্তানি চ পশ্যামি বিপরীতানি কেশব ।। ৩০ ।।

ন- না; চ- ও; শক্লোমি- সক্ষম হই; অবস্থাতুম- স্থির থাকতে; ভ্রমতি- বিস্মরণ; ইব- যেন; চ- এবং; মে- আমার; মনঃ- মন; নিমিত্তানি- নিমিত্তসমূহ; চ- ও; পশ্যামি- দেখছি; বিপরীতানি- বিপরীত; কেশব- হে কেশী দানবন্তা (শ্রীকৃষ্ণ)।

গীতার গান

অস্থির হয়েছি আমি স্থির নহে মন।

সব ভুল হয়ে যায় কি করি এখন।।

বিপরীত অর্থ দেখি শুনহ কেশব।

এ যুদ্ধে কাজ নাহি হল পণ্ড সব।।

অনুবাদঃ হে কেশব। আমি এখন আর স্থির থাকতে পারছি না। আমি আত্মবিস্মৃত হচ্ছি এবং আমার চিত্ত উদ্ভান্ত হচ্ছে। হে কেশী দানবহন্তা শ্রীকৃষ্ণ। আমি কেবল অমঙ্গলসূচক লক্ষণসমূহ দর্শন করছি।

তাৎপর্যঃ অর্জুন অস্থির হয়ে পড়েছিলেন, তাই তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে থাকতে অক্ষম হয়ে পড়েছিলেন এবং তাঁর মন এতই বিমর্ষ হয়ে পড়েছিল যে, তিনি আত্মবিস্মৃত হয়ে পড়ছিলেন। জড় জগতের প্রতি অত্যধিক আসক্তি মানুষকে মোহাচ্ছন্ন করে ফেলে। ভয়ং দ্বিতীয়াভিনিবেশতঃ স্যাৎ (ভাগবত ১১/২/৩৭)- এই ধরনের ভীতি ও আত্মবিস্মৃতি তখনই দেখা দেয়, যখন মানুষ জড়া শক্তির দ্বারা অত্যন্ত প্রভাবিত হয়ে পড়ে। অর্জুন অনুভব করেছিলেন, সেই যুদ্ধের পরিণতি হচ্ছে কেবল স্বজন হত্যা এবং এভাবে শত্রুনিধন করে যুদ্ধে জয়লাভ করার মধ্যে কোন সুখই তিনি পাবেন না। এখানে নিমিত্তানি বিপরীতানি কথাগুলি তাৎপর্যপূর্ণ। মানুষ যখন নৈরাশ্য ও হতাশার সম্মুখীন হয়, তখন সে মনে করে, “আমার বেঁচে থাকার তাৎপর্য কি?” সকলেই কেবল তার নিজের সুখ-সুবিধার কথাই চিন্তা করে। ভগবানের বিষয়ে কেউই মাথা ঘামায় না। শ্রীকৃষ্ণের ইচ্ছাতেই অর্জুন তাঁর প্রকৃত স্বার্থ বিষয়ে অজ্ঞতা প্রদর্শন করেছেন। মানুষের প্রকৃত স্বার্থ নিহিত রয়েছে বিষ্ণু অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণেরই মাঝে। মায়াবদ্ধ জীবেরা এই কথা ভুলে গেছে, তাই তারা নানাভাবে কষ্ট পায়। এই দেহাত্মবুদ্ধির প্রভাবে মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়ার ফলে অর্জুন মনে করেছিলেন, তাঁর পক্ষে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে জয় লাভ করাটা হবে গভীর মর্মবেদনার কারণ।

শ্লোক – ৩১

ন চ শ্রেয়োহনুপশ্যামি তত্বা স্বজনমাহবে।

ন কাঙ্ক্ষে বিজয়ং কৃষ্ণ ন চ রাজ্যং সুখানি চ ।। ৩১ ।।

ন- না; চ- ও; শ্রেয়ঃ- মঙ্গল; অনুপশ্যামি- দেখছি; হত্বা- হত্যা করে; স্বজনম- আত্মীয় স্বজনদের; আহবে- যুদ্ধে; ন- না; কাঙ্ক্ষে- আকাঙ্ক্ষা করি; বিজয়ম- যুদ্ধে জয়; কৃষ্ণ- হে কৃষ্ণ; ন- না; চ- ও; রাজ্যম- রাজ্য; সুখানি- সুখ; চ- ও।

গীতার গান

কোন হিত নাকি হেথা স্বজনসংহারে।

যুদ্ধে মোর কাজ নাই ফিরাও আমারে।।

হে কৃষ্ণ! বিজয় মোর নাহি সে আকাঙ্ক্ষা।

রাজ্য আর সুখ শান্তি সবই আশঙ্কা।।

অনুবাদঃ হে কৃষ্ণ। যুদ্ধে আত্মীয়-স্বজনদের নিধন করা শ্রেয়স্কর দেখছি না। আমি যুদ্ধে জয়লাভ চাই না, রাজ্য এবং সুখভোগও কামনা করি না।

তাৎপর্যঃ মায়াবদ্ধ মানুষ বুঝতে পারে না, তার প্রকৃত স্বার্থ নিহিত আছে বিষ্ণু বা শ্রীকৃষ্ণের মাঝে। এই কথা বুঝতে না পেরে তারা তাদের দেহজাত আত্মীয়-স্বজনদের দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে তাদের সাহচর্যে সুখী হতে চায়। জীবনের এই প্রকার অন্ধ-ধারণার বশবর্তী হয়ে, তারা এমন কি জাগতিক সুখের কারণগুলিও ভুলে যায়। এখানে অর্জুনের আচরণে আমরা দেখতে পাই, তিনি তাঁর ক্ষাত্রধর্মও ভুলে গেছেন। শাস্ত্রে বলা হয়েছে, দুই রকমের মানুষ দিব্য আলোকে উদ্ভাসিত সূর্যলোকে উত্তীর্ণ হন, তাঁরা হচ্ছেন (১) শ্রীকৃষ্ণের আজ্ঞানুসারে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে যে ক্ষত্রিয় রণভূমিতে প্রাণত্যাগ করেন, তিনি এবং (২) যে সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী অধ্যাত্ম-চিন্তায় গভীরভাবে অনুরক্ত তিনি। অর্জুনের অন্তঃকরণ এতই কোমল যে, তাঁর আত্মীয়-স্বজনের প্রাণ হনন করা তো দূরের কথা, তিনি তাঁর শত্রুকে হত্যা করতে নারাজ ছিলেন। তিনি মনে করেছিলেন, তাঁর স্বজনদের হত্যা করে তিনি সুখী হতে পারবেন না। যার ক্ষুধা নেই সে যেমন রান্না করতে চায় না, অর্জুনও তেমন যুদ্ধ করতে চাইছিলেন না। পক্ষান্তরে তিনি স্থির করেছিলেন, অরণ্যের নির্জনতায় নৈরাশ্য-পীড়িত জীবন অতিবাহিত করবেন। অর্জুন ছিলেন ক্ষত্রিয়, এই ধর্ম পালন করার জন্য তাঁর রাজত্বের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু ন্যায়সঙ্গতভাবে পাওয়া সেই রাজত্ব থেকে দুর্যোধন আদি কৌরবেরা তাঁকে বঞ্চিত করার ফলে, সেই রাজ্যে তাঁর অধিকারের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার জন্য কৌরবদের সঙ্গে যুদ্ধ করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল। কিন্তু যুদ্ধ করতে এসে তিনি যখন দেখলেন, তাঁর আত্মীয়-স্বজনকে হত্যা করে সেই রাজ্যে তাঁর অধিকারের প্রতিষ্ঠা করতে হবে, তখন তিনি গভীর দুঃখে ও নৈরাশ্যে স্থির করলেন যে, তিনি সব কিছু ত্যাগ করে বনবাসী হবেন।

error: Content is protected !!
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x