বিশ্বাসের কারবারিরা শিকড় গেড়েছে

দুরস্বামী জিওফ্রে স্যামুয়েল দীনাকার ছিলেন ব্যাঙ্ক কর্মী, হয়েছেন ধর্মগুরু। তা ধর্মগুরু হতে বা দেশের সংবিধানে কোনও বাধা নেই। ছিলেন মধ্যবিত্ত, চোখের পলকে হয়েছেন উচ্চবিত্ত। তাতেও এ-দেশের সংবিধানে কোনও প্রতিবন্ধকতা নেই। ‘পবিত্র কণ্ঠস্বর’ ও যিশুর কাছে প্রার্থনা “শুনিয়ে ভক্তদের দানে তিনি আরও দশজন ধর্মগুরুর মতোই ধনী। তাঁর ছেলে পলও ‘পবিত্র কণ্ঠস্বর’ শুনিয়ে জনগণকে পরম শান্তির জগতে নিয়ে যাচ্ছেন, যেখানে রোগ নেই দুঃখ নেই । চেন্নাইতে কেন্দ্রীয় অফিস খুলেছেন। সে চারতলার এক বিশাল প্রাসাদ। এখানে রয়েছে আধুনিক রেকর্ডিং স্টুডিও, ভিডিও থিয়েটার, প্রকাশনা বিভাগ এবং ভক্ত ও রোগীদের ফোনে ‘পবিত্র কণ্ঠস্বর’ শোনবার সুন্দর ব্যবস্থা। দীনাকার ও তস্য পুত্র হেঁকে-ডেকে দাবি করে চলেছেন, তাঁদের পবিত্র প্রার্থনার চমৎকারে জাগতিক যে কোনও রোগ থেকে বিশ্ববাসী মুক্ত হন। এমন দাবি করে স্পষ্টতই তাঁরা ভারতীয় সংবিধানের লক্ষ্মণ-গণ্ডিকে লঙ্ঘন করলেন। এখানে আইন সাফ বলছে—মন্ত্রবলে বা কোনও চমৎকার দ্বারা রোগ প্রতিকারের দাবি বা দাবির প্রচার সম্পূর্ণ বেআইনি। তবু এই বেআইনি কাজ ‘চলছে, চলবে’।

INDIA TODAY-র জুন ১৪, ১৯৯৭ সংখ্যায় পৃষ্ঠা ৮৫-তে বলা হয়েছে—অতি সম্প্ৰতি দীনাকর ও পলের এক প্রার্থনাসভায় দশ বছরের এক শিশুপুত্রকে কোলে করে মঞ্চে নিয়ে এলেন মা। মায়ের কথা মতো ছেলেটি হামা দিতেও অক্ষম। এই শিশুই পবিত্র প্রাথর্নার চমৎকারিত্বে সকলকে অবাক করে দিয়ে সোজা উঠে দাঁড়াল। এমনি করে সাজানো রোগীদের দিয়ে অভিনয় করিয়ে সরল আমজনতাকে বুরবক্ বানানোর কাজ ‘চলছে চলবে’ ।

দীনাকর ও পল দেশের জনগণকে ‘পবিত্র প্রার্থনা’ শুনিয়ে পাপ ও রোগমুক্ত করতে দেশ জুড়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছে। তাঁদের বেআইনি কাজে আন্তরিক সহযোগিতা পাচ্ছেন দেশের পুলিশ ও প্রশাসনের কাছে।

পি পি জোব আর এক ‘পবিত্র কণ্ঠস্বর’-এর ব্যাপারি। দুটি টিভি চ্যানেলের ‘টাইম স্লট’ কিনে ফি শুক্রবার সকালে তাঁর ‘পবিত্র কণ্ঠস্বর’ শোনাচ্ছেন পাপী জনগণকে। জোব-এর সোচ্চার দাবি—তাঁর এই পবিত্র প্রার্থনা পরম বিশ্বাস নিয়ে শুনলে পাপ ও রোগ দুই থেকেই মুক্ত হয় মানুষ। হায়দ্রাবাদের নিজাম কলেজ গ্রাউন্ড থেকে কোট্টায়ামের নেহরু স্টেডিয়াম পর্যন্ত যেখানেই জনগণকে রোগমুক্ত করতে প্রার্থনাসভার আয়োজন করছেন, সেখানেই পুলিশ ও প্রশাসনের পরিপূর্ণ সহযোগিতা পাচ্ছেন। বেআইনি কাজে এদেশের পুলিশ ও প্রশাসনের পরিপূণ সহযোগিতার ঐতিহ্য বা পরম্পরা ‘ছিল-আছে’।

বুজরুক চিকিৎসক দলের পাণ্ডা এস শ্রীনিবাসন। (নিচে) হায়দরাবাদের জ্যান্ত মাছ পেলে দেওয়া হচ্ছে মিন্টো পার্কের পুকুরে। রবিবার। ছবিঃ শিখর কর্মকার, আজকাল

প্রতিবছর ৮ জুন হায়দ্রাবাদে জ্যান্ত মাছ খাইয়ে হাঁপানি সারাবার মহামেলা বসে। বাথিনি পরিবার পাঁচ জন পুরুষ ধরে এই ‘পবিত্র কম্মো’টি করে আসছেন। এই উপলক্ষে বাথিনি পরিবারের বাড়ির সামনের মাঠে মেলা বসে যায়। দেশের দূর-দূরান্তের হাঁপানি রোগী ও তাদের আপনজনদের অনেকেই দৈব ওষুধ পাওয়াকে নিশ্চিন্ত করতে আগের দিনই মেলাপ্রাঙ্গণে রাত কাটান মাঠ বা স্রেফ রাস্তায়। শুধু বাথিনি পরিবারের লোকজনই নাকি জানে এই দৈব চিকিৎসা।’ ইঞ্চি তিন-চার লম্বা জ্যান্ত মহাশোল মাছের মুখের কাছে এক ফোঁটা তেঁতুল দিয়ে তৈরি চ্যবনপ্রাশ বা ওই জাতীয় কিছু লাগিয়ে দেওয়া হয়। এইটা রোগীর মুখে চালান করে গিলিয়ে দেওয়ার পর হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয় ছাপানো নিয়ম-বিধি। তাতে বলা হয়েছে—রোগীদের রাতে গরম জল খেতে হবে। ধুলো এড়িয়ে চলতে হবে। ঠাণ্ডা খাওয়া চলবে না। সপ্তাহে একদিন মধু ও আদার রস খেতে হবে। স্টেট ফিশারিস ডিপার্টমেন্ট হাঁপানি সারাবার মহামেলায় মহাশোল বিক্রির পাঁচটি স্টল খুলেছিল ১৯৯৭-তে। ছিল রোগী ও তাদের আপনজনদের যাতায়াতের সুবিধের জন্য সরকারি সহযোগিতায় স্পেশাল বাসের ব্যবস্থা। ছিল আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে ব্যাপক পুলিশি ব্যবস্থা। ভি আই পি-দের অবশ্য আম-জনতার সঙ্গে লাইন দিতে হয় না। তাঁদের জন্য রয়েছে আলাদা কাউন্টারের ব্যবস্থা। ভি আই পি পাস অবশ্য ব্ল্যাকে কেনা যায়। ‘৯৭ সালের দর ছিল ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা। পুলিশের সামনেই ব্ল্যাকাররা খুল্লাম খুল্লা পাস বিক্রি করছে। পরপর তিন বছর এই দৈব ওষুধ বিশ্বাস করে খেলে এবং নিয়ম মেনে চললে হাঁপানি ভালো হবে—গ্যারান্টি! হায়দ্রাবাদসহ কর্নাটকের বহু মানুষই বাথিনি পরিবারের এই গ্যারান্টিতে বিশ্বাস রাখেন। ওষুধটা কী? কেন শুধু একটি পরিবার এই ওষুধের হদিশ জানবেন? কেন তা আরও সহজলভ্য হবে না? কেন একটি বিশেষ দিনে ওষুধ খাওয়ানো হয়? এসব বেয়াড়া প্রশ্ন কেউ কেউ করেন। তাঁদের প্রশ্ন চাপা পড়ে যায় ‘পুণ্য দিন’, ‘দৈব আশীর্বাদ’ ইত্যাদি আজন্ম বিশ্বাসী মানুষের প্রবাহের নীচে।

৯ জুন ১৯৭ এর কলকাতার অনেক দৈনিক পত্রিকাতেই প্রকাশিত হয়েছিল একটি খবর জ্যান্ত মাছ খাইয়ে হাঁপানি সারাবার দৈব ওষুধের কারবারিরা হায়দ্রাবাদ থেকে কলকাতায় এসে গ্রেপ্তার হলেন। এদের গ্রেফতার করা হয় ভারতীয় দণ্ডবিধির ৪২০ ধারায়, ১২০ বি ধারায় (ষড়যন্ত্র) এবং ‘দ্য ড্রাগস অ্যান্ড ম্যাজিক রেমেডিস ( অবজেকশন্যাবল অ্যাডভার্টাইসমেন্ট) অ্যাক্ট ১৯৫৪’ ধারা মতে। বাজেয়াপ্ত করা হয় বিভিন্ন ভাষায় ছাপা নিয়ম-বিধি ও প্রতারণাপত্র, প্রচুর চাবনপ্রাশ জাতীয় ওষুধ ও মহাশোলমাছের চারা। 

 

ছয় জালিয়াত জ্যোতিষীর দল গ্রেপ্তার

কলকাতাবাসী তথা পশ্চিমবঙ্গবাসীরা এজন্য বাড়তি গর্ব করতেই পারেন। তাঁরা মনে করতেই পারেন—এখানে বুজরুকি করে পার পাওয়া যায় না। এবং অনেকেই মনে করেনও তা। আমাকেই কয়েক ডজন পরিচিত বলেছেন, ‘এই সব বুজরুকি ও বেআইনি কারবার কর্নাটক সরকার কী করে এত বছর ধরে চলতে দিচ্ছেন !

৯ জানুয়ারি ১৯৯৭ রবিবার, ভারতের বিখ্যাততম ইংরেজি দৈনিক পত্রিকা ‘দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’-এর নাগপুর এডিসনে ছবিসহ একটি খবর বিশাল গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত হয়েছিল। খবরটির শিরোনাম ছিল ‘Gang of six impostors arrested’ অর্থাৎ ছয় বুজরুকের দল গ্রেফতার। স্থানীয় কাগজগুলোও খুবই গুরুত্বের সঙ্গে খবরটি প্রকাশ করে। খবরটি সারসংক্ষেপ হল এই যে—পশ্চিমবাংলা থেকে আসা ছয় বুজরুকের দল নিজেদের জ্যোতিষী ও ভাগ্য ফেরাবার ক্ষমতাধর বলে বুজরুকি চালাতে গিয়ে প্রতাপনগর পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছে। এই ছয় প্রতারক হল পশ্চিমবাংলার ছয় নামী জ্যোতিষী দীপঙ্কর মিত্র, অরুণরঞ্জন ব্যানার্জি, পূর্ণেন্দু ব্যানার্জি, বাসুদেব ঘোষ, শুভাশিস শুর ও দীপঙ্কর দত্ত। এদের প্রত্যেকেই ‘ভৃগু’, ‘অর্কজ্যোতি’ ইত্যাদি জাতীয় নানা বিচিত্র সব নাম ধারণ করে নিজেদের বিজ্ঞাপিত করেন। এই ছয় প্রতারকের গ্যাঙ ইংরেজি হিন্দি ও বাংলায় বিজ্ঞাপন দিয়ে জনগণকে প্রতারিত করে জানিয়েছিল ভাগ্য গণনার দ্বারা ভবিষ্যৎ জেনে সঠিক গ্রহরত্ন দিয়ে তার ভাগ্য পাল্টে দিতে পারে, মামলায় জয় এনে দিতে পারে এবং রোগমুক্তি ইত্যাদি ঘটাতে পারে। এই ধরনের প্রতারণামূলক বিজ্ঞাপন দেওয়ার জন্য ছয় প্রতারককে ‘দ্য ড্রাগস অ্যান্ড ম্যাজিক রেমেডিস (অবজেকশন্যাবেল অ্যাডভারটাইজমেন্ট) অ্যাক্ট ১৯৫৪’-এর ৪,৫ এবং ৭ ধারা মতে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের সময় পুলিশ ওই গ্যাঙের কাছে আপত্তিজনক প্যামফ্রেটস, কিছু পাথর ও প্রচুর অর্থ পায়। এই ‘জ্যোতিষী’ এবং ‘হস্তরেখাবিদ’ নামধারী প্রতারকদের বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করেছিল স্থানীয় যুক্তিবাদী সংস্থা—অন্ধবিশ্বাস নির্মূলন সমিতি।

হায়দ্রাবাদবাসী তথা কর্নাটকবাসীরা এজন্য বাড়তি গর্ব করতেই পারেন। তাঁরা মনে করতেই পারেন—এখানে বুজরুকি করে পার পাওয়া যায় না। এবং অনেকেই মনে করেনও তা। আমাকেই আমার কয়েকজন পরিচিত কর্নাটকী বন্ধু প্রশ্নবাণে বাস্তবিকই জর্জরিত করেছেন——তোমাদের পশ্চিমবঙ্গ সরকার কী করে এইসব বুজরুকি ও বেআইনি কাজ এত বছর ধরে চলতে দিচ্ছে?’

 

আইনের সন্ধানে

ছেলেবেলায় পঞ্জিকা আমাকে টানত মজার মজার বিজ্ঞাপনের জন্য। সাদামাটা ভাষার বিজ্ঞাপন দিয়েও যে মানুষকে কি সাংঘাতিক রকম আকর্ষণ করা যায়, তারই জোরালো উদাহরণ পঞ্জিকার বিজ্ঞাপনমালা। এতে থাকত তন্ত্রসিদ্ধের তৈরি ‘অত্যাশ্চর্য মাদুলির’ নানা গুণপনার কথা মাদুলি ধারণে মামলায় নিশ্চিত জয়, আর্থিক সমস্যার সমাধান, যে কোনও দুরারোগ্য ব্যাধির নিরাময়, চাকরি লাভ, কর্মে উন্নতি, ব্যবসায় উন্নতি, লটারি প্রাপ্তি, যে কোনও নারী বা পুরুষকে বশীকরণ, পরীক্ষায় সাফল্য, এমনি হরেক সমস্যার গ্যারান্টিসহ সমাধানের দৃঢ় প্রতিশ্রুতি। এইসব ‘অত্যাশ্চর্য মাদুলি’র আবার ছিল নানা শ্রেণিবিন্যাস। ‘সাধারণ’, ‘শক্তিশালী’, ‘দ্রুত কার্যকর’ এমনি আরও কত কি। মাদুলি-তাবিজ-কবজ ছাড়া বিজ্ঞাপনে হাজির হত নানা ‘তন্ত্র সম্রাট’, ‘তান্ত্ৰিকাচার্য’, ‘তন্ত্রসূর্য’, ‘জ্যোতির্বিদ’, ‘জ্যোতিষ সম্রাট’ ইত্যাদিদের ছবিসহ রোমহর্ষক সব অলৌকিক ক্ষমতার কথা। এঁরা প্রত্যেকেই সুপারম্যশন, হি-ম্যান, শ্রীকৃষ্ণ থেকে যিশু সবার সম্মিলিত ক্ষমতার চেয়েও এগিয়ে থাকা মানুষ। সব সমস্যার সমাধান এদের মুঠোবন্দি।

যখন প্রাপ্তবয়স্ক হলাম মনে হল, পঞ্জিকাগুলোতে ওইসব হিজিবিজি বিজ্ঞাপনদাতারা যা খুশি তাই বিজ্ঞাপন দিয়ে আদৌ কোনও নির্দোষ মজা করছে না। যা করছে তা হল—প্রতারণা। নিরীহ সরল মানুষদের সঙ্গে ভয়ঙ্কর রকমের প্রতারণা। এতে শুধু যে সাধারণ মানুষদের ঠকিয়ে অর্থ আত্মসাৎ করা হচ্ছে তাই নয়, বহু মানুষ যাঁরা ঠিকমতো চিকিৎসার সুযোগ নিয়ে রোগমুক্ত হতে পারতেন, তাঁদের এরা মৃত্যুর দরজায় পৌঁছে দিচ্ছে। সহজ কথায়, বহু ক্ষেত্রেই এরা স্পষ্টতই হত্যাকারী। তবে কেন এইসব বুজরুক বিজ্ঞাপনদাতা ও বিজ্ঞাপন প্রচারকারীদের বিরুদ্ধে আইন থাকবে না, সরকার কোনও ব্যবস্থা নেবে না?

আরও অনেক পরে শুনলাম, এমনসব বিজ্ঞাপন দেওয়া ও নেওয়া নাকি বেআইনি, অর্থাৎ শাস্তিযোগ্য অপরাধ। শুনলামই শুধু, কিন্তু এমন বিজ্ঞাপন দিয়ে বা ছেপে একজনও শাস্তি পেয়েছে, এমনটা শুনলাম না। আরও পরে যুক্তিবাদী আন্দোলন করতে করতে অবাক হয়ে দেখলাম পঞ্জিকার ওইসব হাস্যকর ও ভয়ঙ্কর বিজ্ঞাপন আর শুধু পঞ্জিকায় আবদ্ধ নেই, বিশাল ব্যাপকতা নিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে সরকারি-বেসরকারি প্রতিটি প্রচার মাধ্যমে। এই সময় শুনলাম, এমন সব অদ্ভুতুড়ে বেআইনি বিজ্ঞাপনের যে আইন আমাদের দেশে রয়েছে তার নাম –‘দ্য ড্রাগস অ্যান্ড ম্যাজিক রেমেডিস ( অবজেকশন্যাবেল অ্যাডভারটাইজমেন্ট) অ্যাক্ট ১৯৫৪। কিন্তু এই আইনে ঠিক কী বলা হয়েছে- ডিটেলে আমরা জানতাম না। ফলে যখনই কোনও চমৎকার দেখানোওয়ালা বুজরুকের বিরুদ্ধে পুলিশ ও প্রশাসনের কাছে ‘ড্রাগ অ্যান্ড ম্যাজিক রোমেডিস ‘অ্যাক্ট…’ অনুসারে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করেছি, তখনই শুনতে হয়েছে এমন আইনের অস্তিত্ব তাঁদের অজানা। এই আইন বিষয়ে আমরা আলোকপাত করে সাহায্য করলে তারা নাকি এইসব আইনভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবেন। কী সুন্দর ব্যাপার বলুন তো ! আইন আছে, কিন্তু আইনের দেখ-ভালের দায়িত্ব যাঁদের উপর, তাঁরা আইনটি জানেন-ই না !

শুরু হল তালাশ। সে এক আশ্চর্য তালাশ। আমরা চেনাজানা আই পি এস অফিসারদের সঙ্গে কথা বললাম। কারুরই এই আইনের হদিশ জানা নেই। জানা নেই পরিচিত কোনও আইনজীবীর। আমাদের যুক্তিবাদী সমিতির আইনি উপদেষ্টারা আন্তরিকতার সঙ্গে সক্রিয় হলেন । শেষপর্যন্ত আমাদের শ্রম ও স্বপ্ন সার্থক হল। কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী আসারাফুল হক-এর ভালোবাসা ও শ্রমের ফসল হিসেবে আমরা ‘দ্য ড্রাগস অ্যান্ড ম্যাজিক রেমেডিস অ্যাক্ট’কে জনসমক্ষে তুলে আনতে সক্ষম হলাম। আইনটির ব্যাপক প্রচারের প্রয়োজনীয়তার কথা মাথায় রেখে যুক্তিবাদী সমিতির মুখপত্র ‘যুক্তিবাদী’-র বিশেষ আইনি সংখ্যায় এই আইনটি একটি শব্দও বাদ না দিয়ে প্রকাশ করলাম মূল ইংরেজি ভাষায়। প্রকাশ করলাম বাংলা অনুবাদ। বিভিন্ন প্রচারমাধ্যম, সাংবাদিক, পুলিশের পদস্থ কর্মচারী, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং সমমনোভাবাপন্ন সংগঠনগুলোকে সংখ্যাটি উপহার হিসেবে দিলাম। সাধারণের কাছে বিক্রি করলাম। আইনটি জানতে চাওয়ার প্রবল আগ্রহ লক্ষ্য করে আমরা ‘আইন’ নামের একটি আইনের সংকলন গ্রন্থ প্রকাশ করলাম, যার অন্যতম প্রধান আকর্ষণ ছিল ‘ড্রাগ অ্যান্ড ম্যাজিক রেমেডিজ…অ্যাক্ট’। পরিণতিতে এখন এই আইনটি বহু ভারতীয় ভাষায় অনুবাদ হয়ে ব্যাপ্তি পেয়েছে।

 

ড্রাগস অ্যান্ড ম্যাজিক রেমেডিস অ্যাক্ট কী বলছে

আলোচ্য আইনটির পুরো নাম ‘The Drugs and Magic Remedies (Objectionable Advertisements) Act, 1954. পুরো আইন এই আলোচোনায় তুলে ধরবো না। আনব শুধু কিছু প্রয়োজনীয় অংশ ও ধারা।

সংসদ প্রবর্তিত এই আইন ৩০ এপ্রিল ১৯৫৪ রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পায় এবং ১ মে ১৯৫৪ ভারত সরকার কর্তৃক প্রকাশিত সরকারি গেজেটের বিশেষ সংখ্যায় দ্বিতীয় অংশের প্রথম অধ্যায়ের ২৪ নং ক্রমে প্রকাশিত হয়।

 

অ্যাক্ট নং ২১, ১৯৫৪

ওষুধ সম্পর্কিত কিছু নির্দিষ্ট বিজ্ঞাপন এবং পরাবিদ্যা (গুপ্তবিদ্যা, মায়াবিদ্যা, ভেল্কিবাজি) বা মন্ত্রবলে রোগ প্রতিকারের উপায় হিসেবে বর্ণিত বিজ্ঞাপন ও তৎসংশ্লিষ্ট বিষয়সমূহ নিষিদ্ধ করার উদ্দেশ্যে এই আইন প্রবর্তিত।

  1. সংজ্ঞা

(a) ‘বিজ্ঞাপন’ বলতে গ্রাহ্য হবে যে কোনও রকমের লিখিত প্রচারপত্র, লেবেল, মোড়ক বা অন্য যে কোনও রকমের প্রদর্শন এবং মৌখিক অথবা অন্য যে কোনও উপায়ে প্রচারিত ঘোষণা।

(b) ‘ড্রাগ’ বলতে গ্রাহ্য হবে—

(i) মানুষ বা প্রাণীর বাহ্যিক বা অন্তস্থ ব্যবহার্য ওষুধ।

(ii) মানুষ বা প্রাণীর রোগ প্রতিরোধ, চিকিৎসা, রোগের কারণ নির্ণয়, উপশম ইত্যাদিতে ব্যবহার্য ওষুধ।

(iii) মানুষ বা প্রাণীর রোগ প্রতিরোধ, চিকিৎসা, রোগের কারণ নির্ণয়, উপশম ইত্যাদিতে ব্যবহৃত যে কোনও পদার্থ।

(c) ‘ম্যাজিক রেমেডি’ হিসেবে গ্রাহ্য হবে—অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন বস্তু, মন্ত্র, কবচ ও কোনো ধরনের চমক যা অলৌকিক ক্ষমতা হিসেবে অভিযুক্ত হতে পারে। এবং অলৌকিক ক্ষমতার দ্বারা মানুষ বা প্রাণীর রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা, উপশম, সমস্যার প্রতিকার ইত্যাদি হতে পারে বলে মানুষকে প্রভাবিত করার যে কোনো চেষ্টা ।

(d) ‘বিজ্ঞাপন প্রচারে যে কোনো প্রকার অংশগ্রহণ’ বলতে গণ্য করা হবে—

(i) বিজ্ঞাপন মুদ্রণ ( Printing )

(ii) বিজ্ঞাপন প্রকাশ ( Publication)

  1. ‘ড্রাগ’ সম্পর্কিত যেসব বিভ্রান্তিকর বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ-

(a) যদি বিজ্ঞাপনটি ড্রাগটির কার্যকারিতা সম্পর্কে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোনো ভুল ধারণার

জন্ম দেয়।

(b) যদি বিজ্ঞাপনটিতে ড্রাগটির কার্যকারিতা সম্পর্কে মিথ্যে দাবি করা হয়।

(c) যদি বিজ্ঞাপনটি অন্য কোনোভাবে মিথ্যে বা বিভ্রান্তি বহন করে।

  1. দণ্ড বা শাস্তি

এই আইনি ব্যবস্থা লঙ্ঘনকারী যে কোনো ব্যক্তি দোষী সাব্যস্ত হবে এবং নিম্নরূপ দণ্ড পাবে—

(a) প্রথমবার অপরাধের ক্ষেত্রে অনধিক ছয় মাস কারাবাস অথবা জরিমানা অথবা উভয়ই। (b) পরবর্তী প্রতিবার আইনভঙ্গের ক্ষেত্রে অধিক এক বছর কারাবাসে অথবা জরিমানা অথবা উভয়ই।

 

আত্মকথন

আমাদের অযুত মুখ, আমাদের অসংখ্য মুখোশের ভিড়ে বারবার হয়ে যায় ভুল কোনটা মুখ, আর কোনটা মুখোশ।

মা-বাবার সঙ্গে মেয়েটি ঢুকল। বয়স বছর আঠারো। মুখের একাংশে বীভৎস পোড়া দাগ আত্মহত্যার চেষ্টা করার সাক্ষ্য। মা বললেন, ‘মাধ্যমিকে এবার নিয়ে দুবার ফেল করল। এবার ফেল করতে বাথরুমে ঢুকে গায়ে আগুন লাগিয়েছে। এই একটিই সন্তান। বলুন তো, ওর এই পাগলামো নিয়ে কী করি?’

মেয়েটির সঙ্গে কথা বলে জানলাম, প্রথম ফেলের স্মৃতি মোটেই ভালো নয়। মা-বাবার কাছ থেকে প্রচুর বাজে কথা শুনতে হয়েছে। পত্রিকার বিজ্ঞাপন দেখে পাস করবার গ্যারান্টি দেওয়া এক জ্যোতিষীর কাছে যায়। জ্যোতিষীর কয়েক হাজার টাকার খাঁই মেটাতে বাড়ি থেকে টাকা চুরি করে। চুরির ব্যাপারটা ধরা পড়ে। বকুনি খায়। পাস করার নিশ্চিত আশ্বাস চুরির গ্লানিকে সহ্য করার শক্তি দিয়েছিল। ফেল করার পর হাজারগুণ গ্লানি ওকে ঘিরে ধরেছিল। মুক্তির একমাত্র উপায় হিসেবে গায়ে আগুন দিয়েছিল।

পরীক্ষা পাসের তাবিজ বা পাথরের খবর বিজ্ঞানীদের জানা নেই। কিন্তু একটি সরল কিশোরী পরীক্ষার ছাপার অক্ষরে বিশ্বাস করে, জ্যোতিষীর বিজ্ঞাপন দেখে প্রভাবিত হয়ে আগুনের সঙ্গে শেষ করতে চেয়েছিল নিজের জীবনকে। যে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল এবং যে পত্রিকা বিজ্ঞাপনটি প্রকাশ করেছিল, তারা কেউই এই মেয়েটির জীবনের ভয়ংকর পরিণতির দায়কে অস্বীকার করতে পারে না।

আমার ভায়রার গলায় ক্যানসার ধরা পড়ল। বিশিষ্ট শল্যচিকিৎসক সাজেস্ট করলেন অপারেশন। বাইপাস করালে পাঁচ-দশ বছর নিশ্চিত জীবন। ক্যানসারে অপারেশন ! হই হই করে বাধা দেওয়ার মতো শুভানুধ্যায়ী আত্মীয়বন্ধুর অভাব হল না। শেষ পর্যন্ত ভায়রা চিকিৎসকের বদলে এমন একজনের স্মরণ নিলেন, যিনি গ্যারান্টি দিয়ে যে কোনো রোগ আরোগ্যের বিজ্ঞাপন দেন। পাঁচ মাস গ্যারান্টি বাঁচা বেঁচে নাবালক শিশু ও নির্ভরশীল বউকে ভাসিয়ে মারা গেলেন। রোগ আরোগ্যের তাবিজ-কবজ বা পাথরের খবর বিজ্ঞানীদের জানা নেই । কিন্তু একজন রোগী ও তাঁর পরিবার পত্রিকার বিশ্বাসের দাম গুনলেন একটি জীবন দিয়ে। বিজ্ঞাপনদাতার পাশাপাশি পত্রিকাটিও কি এই মৃত্যু নামের হত্যাটির জন্য দায়ী নয়?

আমার এক সহপাঠী এক নায়িকার প্রেমে পড়ে পড়াশুনোর পাঠ তুলে দিল। লেখাপড়ায় “ভালো একটি ছেলে পাগলামো করে জীবনটা শেষ করে দিক, আমরা, বন্ধু-বান্ধবদের অনেকেই চাইনি। অনেকের চেষ্টার ফসল হিসেবে ওকে আবার পড়াশুনোয় ফেরানো গিয়েছিল। রেজাল্ট ভালোই করল। ঠিক তখনই পত্রিকায় বশীকরণ-এর বিজ্ঞাপন দেখে এক ‘কামাখ্যা সিদ্ধ জ্যোতিষী’র সঙ্গে যোগাযোগ করে। জ্যোতিষী সব শুনে নায়িকার একটি ছবি ও হাজার টাকা আনতে বলে। তখনকার দিনে হাজার টাকা— বিশাল ব্যাপার। আমাদের মতো ছাপোষা বন্ধুদের কাছে পার চেয়ে না পেয়ে বই-পত্তর, ঘড়ি, এমনকী রক্ত পর্যন্ত বেচল। জ্যোতিষী যজ্ঞ করে কবচ বানিয়ে দিল। বন্ধু কবচ পেয়ে নায়িকার প্রেম হাতের মুঠোয় ভেবে যখন মশগুল তখনই নামিকার বিয়ের খবর আমরা পত্রিকায় পড়লাম। তারপর বন্ধুটির জায়গা হল পাগলা গারদে। কয়েক বছর আগে ওর মৃত্যুর খবর পেয়েছি। পাগল অবস্থাতেই মারা গেছে। এই মৃত্যুর দায় তো শুধু একজন বুজরুক জ্যোতিষির নয়, একই সঙ্গে বুজরুকের প্রতারণায় সহযোগিতা করা পত্রিকারও। কোনোভাবেই পত্রিকা এই দায়কে অস্বীকার করতে পারে না। তাই এই ধরনের আলৌকিক উপায়ে সমস্যা সমাধান বা ভাগ্য পাল্টাবার বিজ্ঞাপন প্রকাশের ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপনদাতা এবং বিজ্ঞাপনটি যে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, তার মুদ্রক প্রকাশকের একই শাস্তির বিধান রয়েছে এ দেশের আইনে ।

পরিবার বলতে একটি তরুণ, একটি তরুণী। দুজনেই চাকরি করেন। মোটামুটি সচ্ছল। তরুণের (চোখে বড়লোক হওয়ার স্বপ্ন। লটারি জিতে রাতারাতি বড়লোক হতে পত্রিকায় প্রকাশিত বিজ্ঞাপন দেখে ‘ধনদা কবচ’ নিলেন। শুরু হল গাদা গাদা লটারির টিকিট কেনা। লটারির টিকিট কিনতে কর্মস্থলের তহবিল তছরুপ করলেন। তিনি নিশ্চিত ছিলেন—লটারি জিতবেনই। তখন তহবিলের টাকা পুরণ করে দেবেন। তিনি চুরি করতে চাননি, ধার নিতে চেয়েছিলেন। ধনদা কবচ তাঁর আশা পূরণ করেনি। পরিবর্তে মিথ্যে লোভ জাগিয়ে তুলে চোর তৈরি করেছিল। মুক্তির খোঁজে শেষপর্যন্ত স্বপ্ন দেখা একটি তরুণ জীবন আত্মহত্যা করেছিলেন। একটি বিজ্ঞাপনে বিশ্বাস করার পরিণতিতে একটি জীবন, একটি পরিবার শেষ হয়ে গেল। পত্রিকাই এই মিথ্যে বিজ্ঞাপন দিয়ে তরুণটিকে মৃত্যুর দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছিল। পত্রিকাটির ভূমিকা কবচ বিক্রেতা বুজরুকের তুলনায় একটুও কম নয় ।

টিভিতে ঠাণ্ডা পানীয়ের বিজ্ঞাপন দেখে প্রভাবিত একটি কিশোর পায়ে দড়ি বেঁধে উঁচু থেকে ঝাঁপ দিতে গিয়ে মারা যায়। ঘটনাস্থল ছিল মুম্বাই। ঠিক একইভাবে কলকাতার এক বালক ফ্যানে দড়ি বেঁধে ঝুলতে গিয়ে গলায় ফাঁস লেগে মারা যায়। শুনছি, বিজ্ঞাপনটি নাকি বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে।

এরচেয়েও ভয়ঙ্কর বিজ্ঞাপন দিয়ে যারা মানুষ ও সমাজকে পঙ্গু করেই চলেছে, তারা কাদের বিশেষ অনুগ্রহে পার পেয়ে যাচ্ছে? জ্যোতিষী-তান্ত্রিক ও তথাকথিত অবতারদের মুখের ধর্মের মুখোশ কি আমাদের সংবিধান, আইন ও আইনের রক্ষকদের নপুংসক করে রেখেছে?

স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তি এ বছর। অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার বাণী ভাসছে হাওয়ায় । রুখে দাঁড়াতে গিয়ে বারবার একই অভিজ্ঞতা—কোমর ভাঙতে হিলহিলিয়ে উঠেছে বাণীওয়ালাদেরই হাত। ওরা সাপের গালেও চুমু খায়, ব্যাঙের গালেও চুমু খায়। ওরা পাড়ি দিতে আহ্বান জানায়, ওরাই নোঙর কাটে। পরিণতিতে এখন—আইন ভাঙাটাই আইন।

ধর্মের মুখোশের আড়ালে সমস্ত প্রতারণা, সমস্ত বেআইনি কাজ ‘চলছে চলবে’। সঙ্গে বিজ্ঞাপন গ্রহীতা প্রচারমাধ্যমগুলোর পরিপূর্ণ সহযোগিতা পেলে তো কথাই নেই। তবে কেন বাইরের থেকে আসা অলৌকিকবাবারা, ধর্মবাবারা এই বাংলার আইনের প্রহরীদের হাতে বন্দি হন? এ-প্রশ্ন অনেকেরই। ভেতরের রহস্য জানা নেই বলেই উঠে আসে প্রশ্ন।

আঁট-ঘাঁট না জেনে ব্যবসায় নামলে যা হওয়ার তাই হয়। কোনো ‘হোম ওয়ার্ক’ না করে বাইরে থেকে এখানে বেমক্কা এসে পড়া অলৌকিক ব্যবসায়ী বিপদে পড়েন। ‘হোমওয়ার্ক’ মানে পুলিশ ও রাজনৈতিক বাবাজীদের ছত্র-ছায়া পাওয়ার প্রয়োজনীয় সমস্ত ব্যবস্থা আসার আগেই করে নেওয়া। উদ্ধার পেতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। তাঁর অঞ্চলের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা যথেষ্ট উদ্যোগ নিয়ে এখানকার প্রভাবশালী ব্যক্তিদের প্রভাবিত করে ঘটে যাওয়া ঘটনার জট ছাড়ান। অর্থাৎ, আইনকে বুড়ো আঙুল দেখাবার ব্যবস্থা করে দেন ।

স্থানীয় অলৌকিক ব্যবসায়ীরা অনেক ধূর্ত। আইন ভাঙতে যাদের যেমন পুজো চড়ানো দরকার, তেমনটি চড়িয়ে বুক ফুলিয়ে হেঁকে-ডেকে ব্যবসা করে।

যুক্তিবাদী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা একটা যুগ। স্মৃতির ভি সি আর ‘রিওয়াইনডিং’ হতে থাকে।

 

জ্যোতিষীদের সম্মেলনে আমন্ত্রিত যুক্তিবাদীরা আক্রান্ত

২২ ফেব্রুয়ারি ’৯৪। রাত তখন ন’টা। ফোনটা করেছিলেন ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ পত্রিকার পথিক গুহ। বললেন, “দ্য অ্যাস্ট্রোলজিক্যাল কনফারেন্স করতে চলেছে। ভেনু-স্টেট লেবার ওয়েলফেয়ার অডিটোরিয়াম। ওদের এক ‘কি পারসন’-কে ধরেছিলাম, বললাম, ‘র‍্যাশানালিস্টরা’ তো আপনাদের ‘ফ্রড’ বলেন। জ্যোতিষ ব্যবসাকে ‘ইললিগাল’ বলেন। আপনাদের বোল্ডলি চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন সভা-সমিতিতে, বই-পত্তরে। হাজারখানেক অ্যাস্ট্রোলজারদের নিয়ে এমন একটা বড় মাপের কনফারেন্স যখন করতে যাচ্ছেন, তখন এই কনফারেন্সেই আপনারা ওঁদের চ্যালেঞ্জ অ্যাকসেপ্ট করে মুখের মতো জবাব দিচ্ছেন না কেন?’ উত্তরে উনি সাফ জানালেন——শুধু বই পত্তরে আর উল্টো-পাল্টা জায়গায় চ্যালেঞ্জ না জানিয়ে কয়েকজনের জন্ম সনদ না ছক নিয়ে ওঁরা আসুন না কেন আমাদের কনফারেন্সে, সেখানেই ফয়সালা হবে। ঠিকঠাক জন্ম সময়, ছক বা হাতের রেখা পেলে জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের পারফেক্ট ফোরকাস্ট করা যায়।’ প্রবীর, আপনি কি ওঁদের এই চ্যালেঞ্জ অ্যাকসেপ্ট করবেন ?’

তখন আক্রান্ত যুক্তিবাদীরা। তাদের মার খেতে দেখে স্থানীয় কিছু মানুষও পাশে দাঁড়ালেন। জ্যোতিষী- স্বেচ্ছাসেবী' দের সঙ্গে স্থানীয় মানুষদের খণ্ডযুদ্ধ। ছবিঃ অলোককুমার মিত্র, ২৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৪, আজকাল

বললাম, ‘নিশ্চয়ই করব। প্রকাশ্যে ওঁদের বুজরুকি ফাঁসের এমন সুযোগ কখনও নষ্ট করতে পারি?

——তরুণ গোস্বামীকে লাইনটা দিচ্ছি, ওঁর সঙ্গে কথা বলুন। ওই নিউজটা করছে।’

তারপর শ্রীগোস্বামীর সঙ্গে অনেক কথাই সে রাতে হয়েছিল। বলেছিলাম, ওঁদের চ্যালেঞ্জ অবশ্যই নিচ্ছি। কয়েকজনের জন্ম-সময় নিয়ে যাব। হাত দেখে বলতে চাইলে প্রয়োজনে হাতসহ হাতের মালিককে হাজির করব। এঁদের বিষয়ে জিজ্ঞাসা খুবই সামান্য ও সহজ—আয়, শিক্ষাগত যোগ্যতা, স্ট্যাটাস ইত্যাদি। শতকরা আশিভাগ প্রশ্নের উত্তর ঠিক হলে দেব ১ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা। এছাড়াও অর্গানাইজারদের হাতে পাঁচজন বিখ্যাত ব্যক্তির একটি তালিকা দিয়ে বলব, এঁদের মৃত্যুদিন প্রকাশ্যে আগাম ঘোষণা করুন। জ্যোতিষ শাস্ত্র বুজরুকি না সত্যি?সেটা- আমজনতা অদূর ভবিষ্যতে অভ্রান্তভাবে বুঝে নিতে পারবে। প্রতিশ্রুতি রইল, হারলে চ্যালেঞ্জ মানি তো দেবই, সঙ্গে যুক্তিবাদী সমিতিও ভেঙে দেব। তবে এ-বিষয়ে একটা আগাম ভবিষ্যৎবাণী করে রাখছি—ওঁরা যে কোনও অজুহাতে এই চ্যালেঞ্জ এড়িয়ে যাবেন। এই ভবিষ্যৎবাণী করতে আমাকে জ্যোতিষ শাস্ত্রের সাহায্য নিতে হয়নি। ওঁরা এই চ্যালেঞ্জ নিয়ে নিজেদের বুজরুকি নিজেরাই ফাস করবে না, এটুকু জানি বলেই এমন ভবিষ্যৎবাণী করতে পারলাম।’

পরের দিন ২৩ ফেব্রুয়ারি। তরুণ গোস্বামীর কলামে ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায় আমার একটা ছবি ছেপে তার তলাতে বেশ বড় করেই চ্যালেঞ্জের খবরটা প্রকাশিত হল। প্রকাশিত হল পাঁচজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের নামও—পি ভি নরসিমা রাও, জ্যোতি বসু, পণ্ডিত রবিশংকর, মৃণাল সেন এবং সুচিত্রা সেন।

২৫ ফেব্রুয়ারি। আমি যে সম্মেলনে যাচ্ছি, ইতিমধ্যে সব পত্রিকার সাংবাদিকদের কাছেই তা পুরনো খবর। সারাদিন ধরে ফোনে কয়েকটা উড়ো হুমকি পেলাম—সম্মেলনে গেলে আমার ‘জান’ নিয়ে নেবে ।

খবর পেলাম, সম্মেলন কর্তৃপক্ষ গোলমালের আশঙ্কা প্রকাশ করে কোর্ট থেকে ১৪৪ ধারা জারির আদেশ বের করেছেন। লক্ষণীয়, সকল সমস্যা সমাধানের জন্য যাঁরা তাবিজ-কবজ-পাথর ধারণের ‘অব্যর্থ’ বিধান দিয়ে থাকেন, তাঁরা নিজেদের সমস্যা মেটাতে ওইসব অব্যর্থ অলৌকিক বিধানে আস্থা না রেখে শেষপর্যন্ত লৌকিক বিচারব্যবস্থার শরণাপন্ন হলেন। সত্যি কি বিচিত্ৰ এই দেশ !

রাতে ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ থেকে খবর পেলাম, সম্মেলনের জনৈক মুখপাত্র ‘দ্য টেলিগ্রাফ’কে জানিয়েছেন, পত্রিকায় প্রকাশিত পাঁচজনের সঠিক মৃত্যুদিন আগাম ঘোষণা করা তাঁদের কাছে আদৌ বড় ব্যাপার নয়। কিন্তু আগাম মৃত্যু দিন পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পর ওইসব দেশ বরেণ্যদের কেউ কেউ মানসিক অবদমনের শিকার হতে পারেন। এই সম্ভাবনার কথা মনে রেখেই তাঁদের পক্ষে এমন চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করা সম্ভব নয়।

যুক্তিবাদী সমিতির তরফ থেকে কলকাতা পুলিশের কমিশনারকে লেখা একটি চিঠি আজই সকালে লালবাজারে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। চিঠির বক্তব্য—জ্যোতিষীরা প্রত্যেকেই ‘দ্য ড্রাগস অ্যান্ড ম্যাজিক রেমেডিস (অবজেকশ্যনাবেল অ্যাডভারটাইজমেন্ট) অ্যাক্ট ১৯৫৪’ ভঙ্গ করার দায়ে অপরাধী। কলকাতায় জ্যোতিষীরা রমরমার সঙ্গে এই আইন ভঙ্গ করে চলেছে। পাথর বিক্রি করে ভাগ্য ফেরাবার বেআইনি কারবারিরা এই শহরের গানের আসর, নাট্য উৎসব, গুণিজন সম্বর্ধনা ইত্যাদিকে স্পনসর করে বঙ্গ সংস্কৃতির জগৎকে যেভাবে দখল করে নিচ্ছে, তাতে আমরা গভীর শঙ্কা অনুভব করছি। আসন ভাঙার অপরাধে যাদের থাকার কথা জেলে, তাদের ছবি পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে সাংস্কৃতিক জগতের ‘গডফাদার’ হিসেবে। এই অবক্ষয়ের আগ্রাসন দেখার পরও আপনার কাছে অনেক প্রত্যাশা, আপনি এইসব বেআইনি কারবারিদের অসাংবিধানিক ক্ষমতার কথা জানার পরও এদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে আন্তরিক হবেন, প্রত্যাশা রাখি। প্রসঙ্গত জানাচ্ছি—‘জ্যোতিষী’ নামক বেআইনি পেশার কিছু ব্যক্তি জ্যোতিষীদের নিয়ে একটি সম্মেলন করতে চলেছেন, যা স্পষ্টতই বেআইনি। এবং এখানেও স্পনসরের ভূমিকায় রয়েছে পাথর বেচার বেআইনি ব্যবসায়ীরা। আপনার কাছে অনুরোধ এই বেআইনি সম্মেলন বন্ধে সমস্ত রকম ব্যবস্থা নিন ।

রাতে বাড়ি ফিরে শুনলাম, এক ডেপুটি কমিশনার অব পুলিশ বার দুয়েক ফোন করেছিলেন।

তাঁর বাড়িতে ফোন করলাম। পেলাম। জ্যোতিষ সম্মেলনকে ‘বেআইনি সম্মেলন বলে আমাদের চিঠিতে উল্লেখ করায় তিনি যথেষ্ট উষ্মা প্রকাশ করলেন। এ বিষয়ে আইন কি বলছে, বলতে চাইলাম। কিন্তু ও প্রান্ত শুনতে চাইলেন না। অধৈর্য চড়া সুরে বলো, কোন মশাই, এত বছর ধরে জ্যোতিষ চর্চা চলছে, জ্যোতিষ শাস্ত্রের ওপর নির্ভর করে হাজার হাজার স্টোনের দোকান চলছে, বছর বছর জ্যোতিষ সম্মেলন হচ্ছে এবং তাতে হাজির থাকছেন বিচারপতি থেকে মন্ত্রী পর্যন্ত। দেশের আর কেউ আইন বোঝেন না, আপনিই শুধু আইন বুঝে বসে আছেন? সেই সঙ্গে এও বললেন, আমরা যেন জ্যোতিষ সম্মেলনে কোন ধরনের হুজ্জুতি পাকাতে না যাই।

বললাম, ‘বহু বছর ধরে চলছে, অতএব আইনি’, ‘মন্ত্রীরা যা করেন তা-ই আইনিঃ এমন যুক্তি আমাদের দেশের সংবিধান কিন্তু মানে না। আপনি চাইলে আপনার কাছে ড্রাগ অ্যান্ড ম্যাজিক রেমেডিজ অ্যাক্ট-এর একটা কপি পাঠিয়ে দিতে পারি। সেটা পড়লেই…

না মশাই, আমাকে আপনাদের আর আইন শেখাতে হবে না। সোজা কথা, আপনারা কাল ওদের সম্মেলনে যাবেন না। গেলে পরে তার পরিণতি মোটেই ভালো হবে না ।

আমন্ত্রণ এসেছে, অতএব যেতে তো হবেই। না গেলে ওরা মানুষকে বিভ্রান্ত করার সুযোগ পাবে। প্রচার করবে—প্রকাশ্য চ্যালেঞ্জের মুখে যুক্তিবাদীরা পালিয়েছে। আর আপনি যেভাবে কথা বললেন, সেটা তো নেহাতই হুমকি। আইনের রক্ষকের কাছে এ ধরনের কথা শুনব, প্রত্যাশা রাখি না ।

২৭ ফেব্রুয়ারি। সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ আমরা পাঁচজন আমন্ত্রণপত্র দেখিয়ে জ্যোতিষ সম্মেলনে ঢুকলাম। আজ একটা খবরের প্রত্যাশায় সাংবাদিকদের প্রত্যাশিত ভিড়। সভা শুরু হওয়ার আগে সম্মেলনের প্রধান উদ্যোক্তা রামকৃষ্ণ শাস্ত্রী আমাকে ডেকে আড়ালে নিয়ে গিয়ে বললেন, এসেছেন ভালো লাগল। আমাদের বক্তব্য শুনুন। কিন্তু আপনার সঙ্গে চ্যালেঞ্জ নিয়ে কোনো আলোচনাতেই আমরা যাচ্ছি না। কারণ, নীতিগত কারণেই আমরা মৃত্যুদিন আগাম ঘোষণা করব না।

বললাম, আপনাদের নীতিগত সমস্যার কথা শুনেছি। তাই নতুন প্রস্তাব নিয়ে এসেছি। আপনারা ওই পাঁচজনের মৃত্যুদিন পাঁচটি খামে সিল-বন্দি করে প্রধান সংবাদ-মাধ্যমগুলোর হাতে তুলে দিন। খামের উপর লেখা থাকবে না। যখন যার মৃত্যু ঘটবে তখন তাঁর নাম লেখা খাম খুলবে সংবাদ-মাধ্যম। তারপর প্রকাশ্যে জানিয়ে দেবে—আপনাদের ভবিষ্যদ্বাণী মিলল কি না।

সমিতির এই লিখিত প্রস্তাব রামকৃষ্ণ শাস্ত্রীর হাতে তুলে দিলাম। এমন একটা সর্বনাশা প্রস্তাবের জন্য বোধহয় শাস্ত্রী মশায় তৈরি ছিলেন না। কয়েকজন সাংবাদিক প্রস্তাবের কপির জন্য হাত বাড়ালেন। আমাদের কথার মাঝে সাংবাদিকরা কখন যে আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, খেয়ালই করিনি। তাঁদের হাতে কপি তুলে দিলেই গোলমাল শুরু হল। শুরু করলেন শাস্ত্রী মশায়। মঞ্চে মাইক ধরে চেঁচালেন—প্রবীর ঘোষ আর ওর দালালদের ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বার করে দাও। অমনি ষন্ডাগুণ্ডা চেহারার কয়েকজন বাছাবাছা গালাগাল দিতে দিতে ধেয়ে এল। সাংবাদিকদের হাতে পস্তাবের কপি বিলি করার কাজ আমি চালাচ্ছিলাম, আর আমার উপর চলছিল কিল-চড়-ঘুষি-লাথি।

আমন্ত্রণ করে ডেকে আনার পর জ্যোতিষীদের এমন গুণ্ডামি দেখে হতচকিত সাংবাদিকরাও। প্রতিবাদ করেন ‘দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ পত্রিকার সাংবাদিক অভিজিৎ দাশগুপ্ত। তাঁকে সমর্থন করেন আজকাল’ ও ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ পত্রিকার সাংবাদিকরা। ফলে জ্যোতিষী-পোষা চামচাদের হাতে বেধড়ক মার খেলেন সাংবাদিক অভিজিৎ দাশগুপ্ত ও ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ পত্রিকার সাংবাদিক রবীন রায়। ওই এলাকার তরুণরা জ্যোতিষীদের এ-হেন বাঁদরামো দেখে প্রতিরোধে নামলেন। লোহার রডের আঘাতে আহত হলেন স্থানীয় তরুণ তপু দেবনাথ। পুলিশরা নীরব দর্শকের ভূমিকা নিয়ে জ্যোতিষীদের বেআইনি ব্যবসা ও বেআইনি গুণ্ডামি, দুটোকেই জোরালো সমর্থন জানালো।

ঘটনাস্থল মানিকতলা থানার অধীন। অভিজিৎ, তপু ও আমি জ্যোতিষীদের বিরুদ্ধে বেআইনি মারধর, হত্যার চেষ্টা, অশ্লীল গালাগাল ও লুটপাটের লিখিত অভিযোগ আনি। থানার অফিসার অভিযোগ গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন। এরপর অভিজিৎ ও আমি পুলিশ কমিশনারকে ফোনে ঘটনাটি জানাই। পুলিশ কমিশনার জানান অপরাধীদের অবশ্যই গ্রেপ্তার করা হবে।

তার পর অনেক তোলপাড়। জ্যোতিষীদের ব্যবসাটাই যখন বেআইনি তখন তাদের সম্মেলনের জন্য সরকারি প্রেক্ষাগৃহ দেওয়া হয় কী করে? কী করেই বা এমন বেআইনি কাজ পরম নিশ্চিন্তে, অনুষ্ঠিত হওয়ার জন্য পুলিশ সুরক্ষা দেন? বুদ্ধিজীবীদের স্বাক্ষর সম্বলিত প্রতিবাদপত্র পাঠালাম মুখ্যমন্ত্রীসহ প্রয়োজনীয় হিসেবে বিবেচিত ব্যক্তিদের কাছে। প্রতিবাদের মূল বিষয়—(1) জ্যোতিষীদের কোনো সম্মেলনের জন্য সরকারি প্রেক্ষাগৃহ দেওয়া চলবে না। (২) দা ড্রাগস অ্যান্ড ম্যাজিক রেমেডিস অ্যাক্ট-এর কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে।

একাধিক পত্রিকায় প্রহাররত জ্যোতিষী গুণ্ডাদের ঝক্‌ঝকে ছবি প্রকাশিত হয়েছিল, তারপরও একজন অপরাধীও গ্রেফতার হননি। শক্ত খুঁটির জোরেই হননি। পুলিশ কমিশনারের আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি অর্থহীন হয়ে গিয়েছিল।

কর্নাটকে জ্যোতিষীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া সোজা। কারণ জ্যোতিষীরা ওই প্রদেশে শিকড় গাড়তে পারেনি। সেখানেও যদি এই বাংলার মতো হত–বিচারকরা মঞ্চে বসে সম্মেলনের শোভা বাড়াতেন, মন্ত্রীরা শুভেচ্ছাবাণী পাঠিয়ে সম্মেলনের সাফল্য কামনা করতেন, তবে ব্যাপারটা বেআইনি জানার পরও কর্নাটকের পুলিশকর্তাদের আইনি ব্যবস্থা নিতে পা কাঁপত।

৯ জুন ’৯৭ মাছ খাইয়ে হাঁপানি সারাবার দৈব ওষুধের কারবারীদের কলকাতায় গ্রেফতারের খবর প্রকাশিত হয়েছিল। তারপর ঠিক এক মাসের মাথায় অর্থাৎ ৯ জুলাই আনন্দবাজার পত্রিকার ১১ পৃষ্ঠায় হাঁপানি সারাবার দৈব ওষুধের কারবারীদের বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হল—পরের দিন থেকে ‘হোটেল কাপুর কটেজ’-এ বসবেন। এই বিজ্ঞাপন দেখে কিছু বিজ্ঞান ক্লাব শিয়ালদহ চত্বরে সভা করে দৈব কারবারিদের গ্রেফতারের দাবি জানাল। না, এবার আর কারবারিরা গ্রেফতার হয়নি। তারা বহাল তবিয়তেই কর্ণাটকে ফিরে গেছে। সৎ বলে পরিচিত এক ডেপুটি কমিশনার অব পুলিশ সক্রিয় হওয়ায় এইটুকু হয়েছে যে, বুজরুকরা কলকাতার বুকে বুজরুকি না চালিয়েই ফিরে গেছে। এখানেও সেই গ্রেপ্তারের বদলে বহিষ্কারের মতো ব্যাপার। কারণ এরাও কর্নাটকের প্রভাবশালী ব্যক্তি তো !

৯ জুন ’৯৭-এর কলকাতার দৈনিক পত্রিকাগুলোতে জ্যান্ত মাছ খাইয়ে হাঁপানি সারাবার দৈব ওষুধের কারবারিদের গ্রেফতার হওয়ার খবর প্রকাশিত হয়েছিল। ওই দিনই নয়াদিল্লি থেকে প্রকাশিত ইংরেজি দৈনিক পত্রিকা ‘দ্য পাইয়োনিয়র’-এর সাংবাদিক আমার সঙ্গে ফোনে কথা বলেন এবং এই প্রসঙ্গে আমার মতামত জানতে চান। ১১ জুন ওই পত্রিকায় অতি গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত হয়েছিল আমার সঙ্গে পত্রিকা প্রতিনিধির কথোপকথন। এই মুহূর্তে ছাপা কথাগুলো মনে পড়ছেঃ

“It is great that these quacks have been arrested But let me tell you something. They will be released, too. These people have high connections I find it rather strange that such quacks and godmen who advertise and perform stants regularly in Calcutta are never arrested. Only when people come from outside the city do these arrests take place. That is significant.” julle (1941) অর্থাৎ মোদ্দা কথায় বুজরুকদের ধরা হয়েছে, নিশ্চয়ই বড় খবর। কিন্তু এও বলছি, ওরা ছাড়া পেয়ে যাবে। কারণ ওদের ভাল যোগাযোগ আছে। মজা কি জানেন কলকাতায় বুজরুক অলৌকিক ক্ষমতাধররা |-1জ্ঞাপন দিয়ে লাগাতারভাবে বুজরুকি চালিয়ে যাচ্ছে। এদের কোনও দিনই গ্রেপ্তার করা হয়৷ •না। যখন বাইরে থেকে কেউ এসে বুজরুকি করতে যায়, তখন গ্রেপ্তার হয়। এটা খুবই লক্ষণীয়।

আমার বক্তব্য আরও সিগনিফিকেন্ট হয়ে ওঠে, যখন দেখি আমার ভবিষ্যদ্বাণীগুলো একশোভাগ সত্যি হয়ে উঠেছে। এই ‘সত্যি হয়ে ওঠা’ আমাকে আদৌ আনন্দিত করে না। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বর্ষপূর্তিতে ভারতীয় গণতন্ত্রের গর্ভ থেকে উঠে আসা এমন চরম দৃষ্টান্ত আমাকে ব্যাথিত করে।

বাইরে থেকে কলকাতায় এসে যখনই কোনো বিশ্বাসে অসুখ সারাবার কারবারিরা গ্রেফতার হয়েছে তখন দুটি জিনিস লক্ষ্য করেছি—এক : কলকাতায় ওই বুজরুকদের গ্রেফতারের দাবিতে আন্দোলন হয়েছে বা ওদের বুজরুকির রহস্যভেদ কাহিনী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়ে আলোড়ন তুলেছে। দুইঃ ভিন দেশ বা ভিন রাজ্যের প্রভাবশালী মহলের হস্তক্ষেপে শেষ পর্যন্ত ওদের বিরুদ্ধে কোনো দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ সম্ভব হয়নি।

এগারো বছর আগে বিদেশি অলৌকিক চিকিৎসক ফিলিপিনো ফেইথ হিলার রোমিও পি. গ্যালার্ডো-এর বুজরুকি ফাঁস করতে গিয়ে যে ভয়ংকর অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের শুরু তা আজও একই নিয়ম ও ছন্দে চলমান। গ্যালার্ডোর খালি হাতে ব্যথাহীন অস্ত্রোপচার রোগমুক্তির বুজরুকি ফাঁস হয়েছে সে সময়কার জয়েন্ট কমিশনার অফ পুলিশ সুবিমল দাশগুপ্ত হাজির ছিলেন। গ্রেপ্তার করতে আন্তরিক ছিলেন। কিন্তু পারেননি। গ্যালার্ডোর ত্রাণকর্তার ভূমিকায় কলকাতা পুলিশেরই উঁচু তলার কেউ কেউ সক্রিয় ছিলেন। এমন এক ভয়ংকর সময় আমাদের তাড়া করে ফিরেছিল যে, চম্বল দস্যুদের ভয়াবহতাও এদের কাছে জোলো। আজও আইনের রক্ষকরাই আইনভঙ্গকারীদের অন্যতম প্রধান রক্ষাকারী।

কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা বুজরুকরা প্রতিদিন যেভাবে ম্যাজিক রেমেডিস অ্যাক্ট ভঙ্গ করে, তার কাছে ভিন দেশ ও ভিন রাজ্যের বুজরুকরা নেহাতই শিশু। স্থানীয় বুজরুকদের বিরুদ্ধে যতই আন্দোলন হোক, এদের প্রতারণা যতই প্রমাণিত ও প্রকাশিত হোক, তাতে পুলিশ-প্রশাসনের কুম্ভকর্ণীয় ঘুম একটুও ব্যাহত হয় না। বরং ওদের বিরুদ্ধে আন্দোলন হলে পুলিশদের আয় বাড়ে প্রায় ক্ষেত্রেই।

এই তো গত বছর জুলাইয়ের ঘটনা। আমরা গেলাম উত্তর চব্বিশ পরগনার গোবরডাঙায় । ওখানকার এক মনসা মন্দিরে এক প্রবীণ পুরুষের ওপর নাকি মনসার ভর হয়। ভরে বিষহরী মনসা নাকি সর্বরোগ ও সমস্যা সমাধানের অব্যর্থ উপায় বাংলান। আমরা গেলাম। ভরের অভিনয় করা মানুষটি যে আসলে তার মাইনে করা ইনফরমারদের কাছ থেকে জানা খবরকে সম্বল করে লোক ঠকায়, এটা প্রকাশ্যে ফাঁস করে থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করতে গেলাম। আমাদের অভিযোগ লেখা শেষ হওয়ার আগেই বাবা মনসার ছেলে গাড়ি বোঝাই স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা নিয়ে হাজির। পরিণতিতে আইন রইল আইনের বইতেই বন্দি ।

হাওড়ার ডোমজুড় থানার ভাণ্ডারদহ গ্রামের এক গোরাবাবা দস্তুরমতো লিফলেট ছেপে ঢালাও বিলি করে হেঁকে-ডেকে প্রচার করেছিল- পাগলা কুকুর বা পাগলা শেয়াল কামড়ালে মন্ত্র পড়া ডাবের জল খাইয়ে তাদের বিপদমুক্ত করে। এমন ভয়ঙ্কর আইন ভাঙার বিরুদ্ধে পুলিশ কী করছে? স্রেফ কিচ্ছু না। তাঁদের নীরবতার পক্ষে একটাই যুক্তি থাকতে পারে-তাঁরা ব্যাপারটা জানতেনই না। ইতিপূর্বে কেউ এ-বিষয়ে তাঁদের জানাননি। কিন্তু এই ‘সবেধন নীলমণি’ যুক্তিও খাটে না । কারণ আমরা ‘৯৬-এর জুলাইতে ডোমজুড় থানায় লিফলেটের কপিসহ গোরাবাবার বহুতর প্রতারণা ও গ্রামবাসীদের উপর গত ২০ বছর ধরে ভয়ঙ্কর অত্যাচার চালাবার ঘটনার কথা জানিয়েছিলাম। আমরা লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছি। অভিযোগ দায়ের করেছি কলকাতার তথ্যকেন্দ্রে খোলা অভিযোগ কেন্দ্রে। শ-দুয়েক স্থানীয় অধিবাসী ও তথ্যদপ্তরে গোরাবাবার বেআইনি কাজ-কর্ম ও অত্যাচারের তালিকা পেশ করেছেন। তাঁরা অভিযোগপত্রে এ-ও জানিয়েছেন, পুলিশ ও রাজনৈতিক দলের কাছে গত কুড়ি বছর ধরে বারবার জানিয়েও কোনো বিচার পাননি। বরং পুলিশ ও রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়ায় গোরাবাবার অত্যাচারের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। অভিযোগ জানাবার বদলা হিসেবে গোরাবাবা তলোয়ার দিয়ে কারো আঙুল উড়িয়েছে, কারো গায়ে ঢেলেছে অ্যাসিড—এই কথাও স্থানীয় মানুষরা রাজ্যের পুলিশ মন্ত্রীর কাছে অভিযোগ জানিয়েছেন। এই গ্রামবাসীদের প্রায় সকলেই গরিব ও তপশিলভুক্ত। এইসব অভিযোগ জানাবার পর ফল পাওয়া গেছে। পুলিশ গ্রামে ঢুকে গ্রামবাসীদের শাসিয়েছে। এই শাসানির কথা জানিয়ে গ্রামবাসীরা আবার তথ্যকেন্দ্রে অভিযোগ জমা দিয়েছে। পরিণতি এই—পুলিশ কিছু গ্রামবাসীদের ও যুক্তিবাদী সমিতির সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে ডাকাতির মামলা দায়ের করেছে।

বিচিত্র এই পুলিশদের চরিত্রের মূল স্রোত। ভালোরা ব্যতিক্রম। টাকার বিনিময়ে মিথ্যে মামলা সাজাতে ও সত্যি মামলা গুটোতে ওরা ওস্তাদ। আইনের এই রক্ষকদের সঙ্গে মধুর সম্পর্ক যত রকম অপরাধীদের। থানায় ওদের নিত্য আনাগোনা। বিদ্বজ্জনেরা ব্রাত্য এখানে। ‘৯৮-এর জানুয়ারির একটি ঘটনা। আমি যে এলাকায় থাকি সে এলাকার থানার অফিসার ইনচার্জ জানালেন—আমার বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ এসেছে। প্রতারণার অভিযোগ। আমি যেন থানায় আসি। তারপরই থানা অফিসারের পরিচয়ে একজন যোগাযোগ করে জানালেন—আমাকে এ-বিষয়ে সাহায্য করতে চান। বিনিময়ে দিতে হবে টাকা। কোথায়, কবে, কত দিতে হবে পরে সব জানাবেন। এই বিষয়টি জানালাম রাজ্য গোয়েন্দা দপ্তরকে, আমার জেলার এস. পি-কে। একজন সাংসদকে। তারপরও ওই ব্যক্তি আবারও যোগাযোগ করেছেন এবং ওর সাহায্য না নিতে চাওয়ায় হুমকি দিয়েছেন—আমাকে ও ছেলেকে হত্যা করার। আমাকে বলেছেন—’গাঁটে ডাণ্ডা দিয়ে পেটাব রাস্তার মাঝখানে, কোনও বাবা তোমাকে বাঁচাতে আসবে না’– তোমার দেবীনিবাসে গিয়ে শালা মারতে মারতে শালা ওখানে ফেলে রেখে দেব।’

টাকা দিয়ে রফা না করে আইন আইনের পথে চলুক—এইটুকু একজন নাগরিক হিসেবে দাবি করায় এই গালাগাল আমর জুটেছে। সাধ্যমত ঊর্ধ্বতন বিভিন্ন মহলকে বিষয়টি জানিয়েছি । ফল এখনও অজানা। ‘সৎভাবে আর আন্দোলন করা যায়না’–এই ভেবে লড়াইয়ের ময়দান থেকে সরে যেতে রাজি নই। আমার আন্দোলনের প্রেরণা প্রিয় পাঠক-পাঠিকা ও লক্ষ লক্ষ মানুষ । জানি তাঁরাই একদিন কোটি কোটি হয়ে শেষ কথা বলবেন।

একটি জনপ্রিয় মহিলা পাক্ষিক পত্রিকায় এ বছর মার্চের দ্বিতীয় পক্ষে রেইকি চিকিৎসা নিয়ে প্রকাশিত হল প্রচ্ছদ কাহিনি। ‘রেইকি’ চিকিৎসা কী? ওষুধ বা আস্ত্ৰাপচার ছাড়া শুধু স্পর্শ দি যে কোনো ব্যাধি নিরাময়ের নতুন আশ্চর্য চিকিৎসা পদ্ধতি। তারপরই মাস ঘোরার আগে পত্রিকায় দস্তুরমতো বিজ্ঞাপন দিয়ে কলকাতার এক অভিজাত হোটেলে ‘রেইকি’ চিকিৎসা শেখাবার আসর বসালেন প্রদীপ আগরওয়াল। দক্ষিণা মাত্র দু-হাজার টাকার কিঞ্চিৎ বেশি। আমি ফোনে কথা বলেছি। জানিয়েছি, আমার মায়ের ক্যান্সার। প্রদীপ মাকে আনতে বলেছেন এবং রোগমুক্ত করার আশ্বাস দিয়েছেন। গোটা বিষয়টি লালবাজারের নজরে এনেছি। কিন্তু প্রদীপের কিছুই হয়নি। এখনও প্ৰদীপ কলকাতার বড় বাজারে বসে জোর কদমে বেআইনি বিজ্ঞাপন দিয়ে কারবার চালিয়ে যাচ্ছেন।

জমিয়ে বসা বড়-মেজ মাপের প্রত্যেক অলৌকিক ব্যবসায়ীরাই বর্তমানে পুলিশ ও রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়ায় পালিত ও পুষ্ট হচ্ছে। বিগত দৈনিক পত্রিকাগুলোতে চোখ বুলিয়ে আমার এমন ধারণাই দৃঢ়বদ্ধ হয়েছে। আগন্তুক অলৌকিক ব্যবসায়ীদের চেয়ে শতগুণ ভয়ঙ্করভাবে আইন ভেঙেই চলেছে স্থানীয় অলৌকিক ব্যবসায়ী। আইনকে তোয়াক্কা না করেও তারা প্রবলভাবে আছে এবং দিব্বি পুষ্ট হচ্ছে শাঁসেজলে। নিত্য-দিন প্রকাশিত এমনই বেআইনি বিজ্ঞাপনের দু-একটি নমুনাঃ-

শ্রীগৌতম। জ্যোতিষী এবং ‘তারাপীঠ ও কামাক্ষায় সিদ্ধহস্ত।’ বিশেষ ক্ষমতা—ব্যর্থপ্রেম জোড়া দিতে পারেন, ভাড়াটে তুলতে পারেন। মামলা জেতাতে পারোন। (ও-ফ্; চার্লস শোভরাজ যদি আগে জানতে পারতেন! চন্দ্রস্বামী ও সজল বারুইরা যোগাযোগ করতে পারেন! উকিলবাবুরা সব কেস তুড়ি দিয়ে জেতার জন্য ট্রাই করতে পারেন। কিন্তু বাদি ও বিবাদি উভয়পক্ষই শাগৌতমের সাহায্য নিলে ব্যাপারটা কী হবে?)। শত্রু দমন করতে পারেন (ইস; সাদ্দাম হোসেনের খবরটা জানা থাকলে বুশ দমন করতে পারতেন পরম অবহেলে)। যৌনব্যাধি-সহ যে কোনো রোগ সারাতে অব্যর্থ (মাননীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী—শ্রীগৌতমের এই মহান ক্ষমতাকে দেশের কাজে লাগানোর বিষয়টা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করুন। অথবা যদি মনে করে থাকেন, এইসব শ্রীগৌতমের প্রতারণা, তবে মাননীয় মন্ত্রী যথাযোগ্য আইনি ব্যবস্থা নিন)। শ্রীগৌতম বিজ্ঞাপন দিয়ে এইসব হিজিবিজি দাবি জানিয়ে তার ব্যবসাটা চালিয়ে যাচ্ছেন কলকাতার বুকে বসে। ঠিকানা – ১২৩ এস পি মুখার্জি রোড, কলকাতা-২৬।

ড. রামকৃষ্ণ শাস্ত্রী। ভৌতিক উপদ্রব বন্ধে বিশেষজ্ঞ। দাম্পত্য কলহ মেটাতে, প্রেমে শান্তি আনতে, চাকরি দিতে (বেকাররা পরীক্ষা করে দেখতে পারেন এমনকী বেকার সমস্যা মেটাতে সরকার নথিভুক্ত বেকারদের তালিকা রামকৃষ্ণ শাস্ত্রীর কাছে পাঠিয়ে দেশের বেকার সমস্যার আশু সমাধানে আন্তরিক চেষ্টা করতে পারেন। আর যদি এই দাবিকে নেহাতই প্রতারণা বলে মনে করে থাকে, তবে আইন অনুসারে ব্যবস্থা নিক)। ড. শাস্ত্রী বশীকরণ বিশারদ। ‘সানন্দা পত্রিকায় দেওয়া সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, খরচ পড়ে নামমাত্র। দেড় হাজার থেকে তিন হাজার ঢাকা (একজন সুপার স্টার হিরোইনকে বউ করার পক্ষে ড্যাম চিপ)। শাস্ত্রীজি এইসব অদ্ভুতুড়ে দাবি গোপনে শিক্ষার সুযোগ না পাওয়া গ্রামবাসীদের কাছে করেন না। তিনি এইসব বেআইনি দাবি কলকাতার নামি-দামী পত্রিকাগুলোতে বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রচার করে চলেছেন। কলকাতার বুকে তাঁর কর্মস্থল। ঠিকানা—৭০, কৈলাস বোস স্ট্রিট, কলকাতা-৬।

ড. মনসারাম। ভাগ্য পাল্টাতে কবচ দেন। মহামৃত্যুঞ্জয় কবচ ধারণে যে কোনো ব্যাধির নিরাময় নিশ্চিত। এছাড়া অপুত্রকের পুত্র হয়, নির্ধনের ধন। বৃহৎ বগলামুখী কবচ ধারণে শত্রু বশীভূত হয়। এমন বিজ্ঞাপন বছরের পর বছর পত্র-পত্রিকায় দিয়ে কবচ বেচে চলেছেন খাস কলকাতার বুকে। ঠিকানা – ১২৯, শ্রীঅরবিন্দ সরণি, কলকাতা-৬।

মণিকার নারায়ণচন্দ্র মান্না। ‘৭৭ বৎসর সততার সহিত’ অত্যাশ্চর্য অষ্টধাতুর মাদুলি বিক্রি করে আসছে বলে বুক বাজিয়ে বিজ্ঞাপন দিয়ে তা প্রচার করে। ধারণে মামলায় জয় হয়। আর্থিক সমস্যার সমাধান হয়। লটারিতে অর্থলাভ হয়। মানসিক রোগ, কুষ্ঠ, শ্বেতী, প্যারালিসিস, হৃদরোগ, মৃগি এবং হাঁপানিসহ যে কোনো দুরারোগ্য আরোগ্য হয় (মাছ খাইয়ে হাঁপানি সারাবার বিজ্ঞাপন দেওয়ার জন্য গ্রেফতার করা হলে, মাদুলি পরিয়ে হাঁপানি সারাবার বিজ্ঞাপন দিলে কেন গ্রেফতার করা হবে না)। অত্যাশ্চর্য এই মাদুলির কারবার চলছে সুদূর পল্লিতে নয়, কলকাতার বুকে। ঠিকানা-৪৩/২, কাশীপুর রোড, কলকাতা ৩৬।

কেন্দ্রীয় সরকারের পর্যটন বিভাগের অধীন পাঁচতারা হোটেলগুলোর শপিং প্লেস ভাড়া দেওয়া হয় টেন্ডার ডেকে। কিন্তু এই প্লেসে জ্যোতিষীদের ব্যবসা চালাতে দেওয়ার জন্য সুনির্দিষ্ট ঘর আছে। এই ঘর শুধু জ্যোতিষ ব্যবসার জন্যই। টেন্ডার ডেকে বা নিলামে চড়িয়ে সর্বোচ্চ দর দেওয়া জ্যোতিষীর হাতে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ছেড়ে দেওয়া হয়।

 

লোকনাথ জন্মকথা

বছর কয়েক আগে মাঝে-মধ্যে পোস্টে অথবা লেটার বক্সে একটি লিফলেট পেতাম। তাতে মোদ্দা কথায় লেখা থাকত—লোকনাথ ব্রহ্মচারীর প্রচার মাহাত্ম্য। সেইসঙ্গে লেখা থাকত—এই লিফলেটে লেখা কথাগুলো একশোটি ছাপিয়ে বা হাতে লিখে বিলি করুন। এক মাসের মধ্যে বিলি করলে আপনি বিপুল সম্পত্তি পাবেন। আর আদেশ অগ্রাহ্য করলে আপনার প্রিয়জন অপঘাতে মারা যাবে। অমুক গ্রামের অমুক লিফলেট পেয়ে আদেশ অমান্য করার পনেরো দিনের মধ্যে তার স্ত্রী ও দুই পুত্র সাপের কামড়ে মারা গেছে।

এখন প্রচারের ব্যাপকতায় ‘লোকনাথ ব্রহ্মচারী’ একটা ক্রেজ। বাবা লোকনাথের কথা ইতিহাসে নেই। ব্যবসায়ীদের মাথা থেকেই লোকনাথের জন্ম। বাবা লোকনাথের মাথায় জল ঢালতে হাজার হাজার তরুণ-তরুণী বাঁক কাঁধে ছুটছে। এখন বাঁক কাঁধে নেওয়ার লোক ভাড়া করা হয়। নগদ টাকা ছাড়া মেলে নতুন শাড়ী, কাপড়, বাঁক। লোকনাথের জন্মস্থান কচুয়া না চাকলা তা নিয়ে বিস্তর বিবাদ চলছে। ‘বিচার আপনা আপনা’। তবে এই সুবাদে কচুয়া আর চাকেলার লোকনাথ প্রমোটারদের পোয়া বারো। কয়েক বছরে ২০০ টাকা বিঘা জমির দাম উঠেছে ৭০০০০ টাকা কাঠা। বিজ্ঞাপনের খরচ দিয়ে-থুয়েও লাভের অঙ্ক ফি-বছরই বহু কোটি টাকাতে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে। লাভের অঙ্ক যাই দাঁড়াক, তা নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা নেই। আমাদের মাথা ব্যথার কারণ—দিনের পর দিন, বছরের পর বছর এইসব ধূর্ত ব্যবসায়ীরা ড্রাগ অ্যান্ড ম্যাজিক রেমেডিস অ্যাক্টকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ভয়ঙ্কর মিথ্যে ও বেআইনি প্রচার করে চলেছে। শহর কলকাতা থেকে মফস্বল সর্বত্র বিশাল বিশাল হোর্ডিং দাঁড়িয়ে আছে বেআইনি এক বিজ্ঞাপন নিয়ে-

“রণে, বনে, জলে জঙ্গলে

যখনই বিপদে পড়িবে

আমাকে স্মরণ করিও –

আমি রক্ষা করিব।”

শ্রীশ্রীলোকনাথ ব্রহ্মচারী

এই একই বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হচ্ছে পত্রপত্রিকাগুলোতে। কি বেয়াড়া, অবাস্তব, উদ্ভট দাবি একবার ভাবুন তো। সরকার যদি মনে করেন দাবির পিছনে যুক্তি আছে, ভালো। সরকার তার প্রতিরক্ষা খাতের ব্যয় অপ্রয়োজনীয় বিবেচনায় বর্জন করুক। অন্যদেশের দ্বারা আক্রান্ত হলে শ্রীশ্রীলোকনাথ বাবার স্মরণ নিলেই চলবে। আর যদি এই দাবিকে মিথ্যা মনে করে থাকে, তবে কেন প্রতারণামূলক বিজ্ঞাপন বন্ধে আন্তরিক হবে না? সরকার যদি মনে করে—বাস্তবিকই লোকনাথের স্মরণ নিলে যে কোন বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়া যায়, তবে বেকার সমস্যার বিপদ

থেকে উদ্ধার পেতে কোনও অর্থবহুল পরিকল্পনা গ্রহণের ঝামেলায় না গিয়ে লোকনাথের স্মরণ পরিকল্পনা গ্রহণ করুক। অর্থ সমস্যা, স্বাস্থ্য সমস্যা, চিকিৎসা সমস্যা, খাদ্য সমস্যা, শিক্ষা সমস্যা, পানীয় সমস্যা, মাথার গোঁজার ঠাই সমস্যা, দুর্নীতি সমস্যা ইত্যাদির বহুতর সমস্যা নিয়ে দেশের গরিবগুর্বো মানুষগুলো যখন চরম বিপদগ্রস্ত, সরকার বিব্রত, তখন সরকার কেন সব বিপদের মুশকিল আসান করতে লোকনাথ বাবার স্মরণ নিচ্ছে না? বলিহারি লক্ষ-কোটি লোকনাথ বাবার ভক্তদের, যারা বাবার অলৌকিক ক্ষমতার প্রচার করে, অথচ বাবার অলৌকিক ক্ষমতায় একটুও ভরসা করেনা! তারা তাদের বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে বাবার স্মরণ যে কেন নেয় না, ভেবে অবাক হই! তাহলে তো দেশের সমস্যার অনেকটাই সমাধানের মুখ দেখত।

জাগতিক যাবতীয় বিপদ থেকে উদ্ধার করার মতো কোনো কিছুর অস্তিত্বের কথা বিজ্ঞানীরা আজও জানেন না। (তাত্ত্বিক ভাবেই এমন কোনো কিছুর অস্তিত্ব সম্ভব নয়। কারণ হিসেবে একটি মাত্র উদাহরণ আমার আনছি। ধরুন রণে দু পক্ষই কলাকনাথের শরণ নিল। লোকনাথ কীভাবে দুপক্ষকেই জয়ী করবেন ?) অথচ কত সরল বিশ্বাসী মানুষ ছাপার হরফে বিশ্বাস করে বিভিন্ন বিপদে যা করণীয় ছিল, তা না করে লোকনাথের শরণ নিয়ে প্রতিটি দিন, প্রতিটি মুহূর্তে চরম সর্বনাশ ডেকে আনছেন।

এই অবস্থা কি আমরণ চলতে দেব নীরব সমর্থন জানিয়ে? নাকি আমরা আন্তরিক দাবি তুলব—সরকার হয় আইনটিকে আইনের মর্যাদা দিক, নতুবা আইনটিকে বাতিল করুক। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে ‘ড্রাগস ও ম্যাজিক রেমেডিস আইন’টিকে নপুংসক করে রাখাই হয়তো জাতিকে পুলিশ ও প্রশাসনের কলঙ্কিত উপহার। যে দেশে দুর্নীতি সর্বব্যাপী, যে দেশ ভ্রষ্টাচারে সারা বিশ্বে অগ্রগণ্য, সে দেশে আইন-রক্ষকদের জুতোর ঠোক্করে আইন গড়াগড়ি খাবে, এটাই স্বাভাবিক। আমরা প্রতিবাদে সরব না হলে এই ধরনের নপুংসক আইন ভারতীয় গণতন্ত্র আরও প্রসব করার ধৃষ্টতা দেখাবে।

 

বেড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধে কে?

সুধী বুদ্ধিজীবী, প্রশাসক ও পুলিশের কাছে ‘ড্রাগস অ্যান্ড ম্যাজিক রেমেডিস অ্যাক্ট’-এর প্রয়েগের পক্ষে আন্তরিকতার সঙ্গে দাবি তোলার সমস্যা হিমালয়ের চেয়ে ভারি। এখানে আইন ভঙ্গকারী কারা? ‘ম্যাজিক রেমেডি’-র প্রচারক হিসেবে আইন ভঙ্গকারী সরকারি ও বেসরকারি মিডিয়া। কাদের বেআইনি কাজের বিরুদ্ধে এঁরা সরব হবেন? কাদের হাতে পরাবেন হাতকড়ি? ‘সর্বশক্তিমান’ মিডিয়ার বিরোধিতার অর্থ—‘সুইসাইডল স্কোয়াড’-এ নাম লেখানো। বুদ্ধিজীবীরা কলমের ডগায় বা ঠোঁটের আগায় যতখানি নীতিবাক্য আওড়ান, ততখানি জীবনে প্রয়োগ করার মতো আহাম্মকি দেখান না। বরং তাঁরা হত্যে দিয়ে পড়েন রেডিও, টিভি, কাগজে। তাঁদের প্রয়োগ করতে হচ্ছে পাবলিক রিলেশনস ও সেলসম্যানশিপের নানা প্রকরণ। তাঁরা এই সত্যটুকু বুঝে নিয়েছেন—জোনাকিকে নক্ষত্র ও নক্ষত্রকে জোনাকি করার প্রবল ক্ষমতা মিডিয়ার আছে। প্ৰশাসন ও পুলিশ দিব্বি বুঝে নিয়েছে মিডিয়ার সহযোগিতা বা বিরোধিতা তাদের কোথা থেকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে। সেই মতো পার্টিগণিত মেনে বুদ্ধিজীবী, পুলিশ, প্রশাসন ইঁদুর-চোর খেলার প্রহসনে যোগ দেয়। তাই মিডিয়া বা সরকার যখন আইন ভাঙে তখন সমস্যাটা দাঁড়ায়—বেড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে?

 

মলাটবন্দি আইনকে মুক্ত করা খুব সহজ, খুব কঠিন

স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তির মুখে এসে দেশের নাগরিক হিসেবে আইন দেখি, পঞ্চাশ বছর আগে ন্যায় বিচারের যে অঙ্গীকার করা হয়েছিল, তা আজ প্রকৃত অর্থে কোথায় দাঁড়িয়ে। ‘ন্যায় বিচার’ মানে—আইন আছে এবং আইনের সঠিক প্রয়োগ হচ্ছে। আমরা আপাতত এই বিতর্কে ঢুকছি না যে, এই পুঁজিবাদী দেশে আইনগুলোই শোষকদের স্বার্থে তৈরি হতে বাধ্য কিনা ? আমরা আপাতত দেখব, যে আইন আছে তার সঠিক প্রয়োগ কতটা হচ্ছে। আমরা আমজনতা দেখেছি—‘আইন একটা তামাসা মাত্র। বড়লোকেরা পয়সা খরচ করে এই তামাসা দেখিতে পারে।’ কিন্তু অর্থের সঙ্গে আইনের এই সম্পর্ক নিয়ে কূটকচালিতেও আমরা নামব না। আমরা সাদা-মাটা দৃষ্টিতে দেখব, এমন কোনো আইন আছে কি না, প্রবলভাবে অনুপস্থিত যে আইনের প্রয়োগ আমাদের দেশের এমনই এক (একমাত্র নয়) মলাটবন্দি আইন–‘দ্য ড্রাগস অ্যান্ড ম্যাজিক রেমেডিস (অবজেকশন্যাবেল অ্যাডভারটাইজমেন্ট) অ্যাক্ট ১৯৫৪’। আইনটিকে বলা হয়েছে—‘ম্যাজিক রেমেডি’ হিসেবে গ্রাহ্য অলৌকি ক্ষমতাসম্পন্ন বস্তু, মন্ত্র, কবচ বা যে কোনো ধরনের চমক যা আলৌকিক হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। এমন কোনো কিছু বিজ্ঞাপন প্রচারে যে কোনোরকম অংশগ্রহণ’-এর শাস্তি প্রথমবারে অনধিক ছয় মাস জেল অথবা জরিমানা অথবা উভয়ই। পরবর্তী প্রতিবারে অনধিক এক বছরের জেল অথবা জরিমানা, অথবা উবার।

অর্থাৎ এই বিজ্ঞাপন দেওয়ার জন্য জ্যোতিষী-তান্ত্রিক- বিশ্বাসের কারবারী অলৌকিক ক্ষমতার দাবিদাররা যেমন শাস্তিযোগ্য অপরাধে অপরাধী, তেমনই সম পরিমাণ অপরাধী এই বিজ্ঞাপনের মুদ্রক, প্রকাশক, প্রচারক হিসেবে রেডিও, টিভি, কাগজ ও হোর্ডিং কোম্পানিগুলোও। কোম্পানিগুলো তো আর মানুষ নয় যে জেল খাটবে। জেল খাটবেন আইন ভঙ্গকারী সংস্থার পাবলিশার, প্রিন্টার, ডিরেক্টর ইত্যাদি পদাধিকারী।

জ্যোতিষী, বিশ্বাসের কারবারি, বুজরুকদের বিরুদ্ধে যদিও বা কখনও-সখনও পুলিশ প্রশাসন একটু আধটু উদ্যোগ নিয়েছে, কিন্তু মিডিয়ার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার চিন্তা করার মতো গাড়লি-মূর্খতা একবারের জন্যেও দেখায়নি। অবশ্য এই নীরবতার পিছনে আরও কয়েকটি কারণ জড়িয়ে থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। যেমন—আইনটির সঙ্গে পুলিশ, প্রশাসন, আইন ভঙ্গকারী ইত্যাদি অনেকের সঙ্গেই হয়তো বা প্রয়োজনীয় পরিচয়ের অভাব ছিল এবং আছে। ফলে সুদীর্ঘ সময় ধরে এই আইনটি লঙ্ঘনের কাজ মসৃণ ও গতিশীল রয়েছে। অথবা আইনটির সঙ্গে ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত করার বিষয়ে দুর্বলতার হদিশ পেয়ে ধর্মীয় মুখোশ পরে প্রতারণা চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে—এক অদ্ভুত অবস্থা! আইন আছে, প্রকাশ্যে আইনের লঙ্ঘন হচ্ছে, অথচ আইনের রক্ষকরা বৃহন্নলার ভূমিকায় অবতীর্ণ। তার মানে এই নয় যে, মিডিয়ার এইসব বেআইনি কাজ-কর্ম বন্ধ করা অসম্ভব। এর জন্য প্রয়োজন বাস্তব অবস্থাকে স্বীকার করে নিয়ে ব্যতিক্রমী অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যতিক্রমী পরিকল্পনা গ্রহণ। সততা ও আন্তরিকতার সঙ্গে মলাট বন্দি আইনকে মুক্তি দিতে চাইলে পুলিশ ও প্রশাসনকে যা করতে হবে তার একটা খসড়া প্রস্তাব এখানে পেশ করা হল-

১) কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও রাজ্যের পুলিশমন্ত্রীর লেখা নির্দেশ প্রতিটি প্রচার মাধ্যমকে পাঠাতে হবে। তাতে থাকবে—

(ক) দ্য ড্রাগস অ্যান্ড ম্যাজিক রেমেডিস অ্যাক্ট-এর পুরোটাই।

(খ) প্রচার মাধ্যমকে মনে করিয়ে দেওয়া হবে—আপনার উচিত এদেশের আইনকে মর্যাদা দেওয়া ।

(গ) প্রচার মাধ্যমগুলোকে জানাতে হবে—আপনার সংস্থা সম্ভবত দ্য ড্রাগস অ্যান্ড ম্যাজিক রেমেডিস অ্যাক্ট বিষয়ে পরিপূর্ণভাবে ওয়াকিবহাল ছিল না। ফলে হয়তো অজ্ঞতার কারণে আপনার সংস্থা ইতিপূর্বে এই আইনটি বিভিন্ন সময় লঙ্ঘন করেছে। আইনটি আপনার নজরে আনার পাশাপাশি জানাচ্ছি যে আগামী দিনে আপনার সংস্থা আইনটি লঙ্ঘন করলে সমস্ত রকম আইনি ব্যবস্থা নিতে আমরা বাধ্য হব।

হবে।

২) জ্যোতিষ ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত অলঙ্কার ব্যবসায়ীদের একই ধরনের লিখিত নির্দেশ পাঠাতে

৩) রেডিও, টিভি, পত্রিকার বিজ্ঞাপন দিয়ে জনসাধারণকে আইনটির বিষয়ে জানাতে হবে, লাগাতার প্রচারে সচেতনতাবোধ গড়ে তুলতে হবে।

৪) জেলাশাসক থেকে থানা পর্যায় পর্যন্ত প্রত্যেককে আইনটি বিষয়ে ও তার প্রয়োগ বিষয়ে স্পষ্টভাবে নির্দেশ দিতে হবে।

এই পদক্ষেপগুলো নেওয়ার পর যারাই এই আইন অমান্য করবে, তাদের বিরুদ্ধে দ্বিধাহীনভাবে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করতে হবে। আইনটির সপক্ষে জনচেতনা গড়ে তোলার চেষ্টা পাশাপাশি আইন লঙ্ঘনকারীকে আগাম নোটিস দিয়ে, আইনি ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করলে, মলাটবন্দি আইনকে মুক্ত করা আর অসম্ভব বা কঠিন হবে না। বরং তা হবে একটি খুবই সহজ আইনি প্রক্রিয়া। অবশ্য রাষ্ট্রব্যবস্থা যদি ভাববাদকে পালন ও পুষ্ট করার পলিসির অঙ্গ হিসেবে আইনটিকে নির্বিষ করে রাখতে চায়, তাহলে ভিন্ন প্রসঙ্গ। তখন রাষ্ট্র ধর্মের দোহাই দেবে, মানুষের বিশ্বাসকে আঘাত না দেওয়ার পক্ষে নানা অজুহাত খাড়া করবে। কিন্তু সে-ও একটা পর্যায় পর্যন্ত । কারণ ভাববাদকে পালন ও পুষ্ট করার আরও অনেক পথ ছেড়ে গণবোধোদয়ের বিরোধিতা করে আইন ভাঙা ভাববাদী গুরুদের স্পনসর করার মতো বোকামি নিশ্চয়ই করতে যাবে না। আমাদের সমাবেশিত জনচেতনার সক্রিয় অংশগ্রহণই পারে মলাটবন্দি আইনকে মুক্তি দিতে। কারণ জনগণই শেষ কথা বলে।

Drugs And Cosmetics Act (1940) Amendment GSR 884 (E)

১৯ মার্চ ২০০৯ ভারতের প্রতিটি দৈনিক পত্রিকায় নোটিশ জারি

করল কেন্দ্রের ‘স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ দপ্তর’। এবার

থেকে শাস্তির পরিমান আজীবন কারাদণ্ড এবং

১০ লক্ষ টাকা জরিমানা।

♦ কিছু কথা

প্রথম খন্ড

♦ কিছু কথা

অধ্যায়ঃ এক

♦ মার্কিন গডম্যান মরিস সেরুলোঃ একটি ইতিহাস

অধ্যায়ঃ দুই

♦ যোগী-জ্যোতিষী হরেকৃষ্ণবাবা !

অধ্যায়ঃ তিন

♦ পঞ্চাশ বছর আগের বালক ব্রহ্মচারী এবং…

অধ্যায়ঃ চার

♦ মেঠাইবাবার রহস্যভেদ

অধ্যায়ঃ পাঁচ

♦ হাড় ভাঙ্গার দৈব-চিকিৎসা

অধ্যায়ঃ ছয়

♦ কাকদ্বীপের দৈব-পুকুর

অধ্যায়ঃ সাত

♦ আগরপাড়ায় ‘ভূতুরে’ আগুন

অধ্যায়ঃ আট

♦ প্রদীপ আগরওয়ালের সম্মোহনে ‘পূর্বজন্মে’ যাত্রা

অধ্যায়ঃ নয়

♦ কামধেনু নিয়ে ধর্মব্যবসা

অধ্যায়ঃ দশ

♦ বরানগরের হানাবাড়িঃ গ্রেপ্তার মানুষ- ভূত

অধ্যায়ঃ এগারো

♦ এফিডেভিট করে ডাক্তারের প্রশংসাপত্র নিয়ে ওঝাগিরি !

অধ্যায়ঃ বারো

♦ ‘গ্যারান্টি চিকিৎসা’র নামে হত্যাকারীর ভূমিকায় সর্পবিদ হীরেন রায়

অধ্যায়ঃ তেরো

♦ চলো যাই ফকিরবাড়ি

অধ্যায়ঃ চোদ্দ

♦ সাঁইবাবার চ্যালেঞ্জঃ পেটে হবে মোহর !

অধ্যায়ঃ পনেরো

♦ হুজুর সাইদাবাদীঃ মন্তরে সন্তান লাভ !

অধ্যায়ঃ ষোলো

♦ জলাতঙ্ক ও দৈব-চিকিৎসা

অধ্যায়ঃ সতেরো

♦ বিশ্বাসের ব্যবসায়ীরা ও নপুংসক আইন

দ্বিতীয় খন্ড

♦ কিছু কথা

অধ্যায়ঃ এক

♦ খেজুর তলার মাটি সারায় সব রোগ

অধ্যায়ঃ দুই

♦ পক্ষিতীর্থমের অমর পাখি

অধ্যায়ঃ তিন

♦ স্বামী রামদেবঃ সন্ন্যাসী, সর্বযোগসিদ্ধ যোগী, যোগচিকিৎসক !

অধ্যায়ঃ চার

♦ নাকালের দৈব-পুকুরঃ হুজুগের সুনামী

অধ্যায়ঃ পাঁচ

♦ সায়েব যখন রেইকি করে রাঘব বোয়াল চামচা ঘোরে

অধ্যায়ঃ ছয়

♦ লক্ষ্মীমূর্তি কালি হলেন আপন খেয়ালে

অধ্যায়ঃ সাত

♦ পাথর যখন কথা বলে

অধ্যায়ঃ আট

♦ ফাঁদে পড়ে জ্যোতিষী শ্রীঘরে

অধ্যায়ঃ নয়

♦ বিশ্বের বিস্ময় অলৌকিক মাতা জয়া গাংগুলী’র বিস্ময়কর পরাজয় এবং…

অধ্যায়ঃ দশ

♦ আই আই টিতে টেলিপ্যাথি দেখালেন দীপক রাও

অধ্যায়ঃ এগারো

♦ জন্ডিস সারাবার পীঠস্থান ইছাপুর

অধ্যায়ঃ বারো

♦ মালপাড়ার পেশা দাঁতের পোকা বের করা

অধ্যায়ঃ তেরো

♦ নিমপীঠের গুগি মা

তৃতীয় খন্ড

♦ কিছু কথা

অধ্যায়ঃ এক

♦ ওঝার ঝাড়ফুঁক আর টেরিজার লকেটে মণিহার রোগমুক্তিঃ কুসংস্কারের দু’পিঠ

অধ্যায়ঃ দুই

♦ ‘মেমারিম্যান’ বিশ্বরূপ-এর একটি বিশুদ্ধ প্রতারণা

অধ্যায়ঃ তিন

♦ কোটিপতি জ্যোতিষী গ্রেপ্তার হলেন

চতুর্থ খন্ড

অধ্যায়ঃ এক

♦ কিস্যা অক্টোপাস পল বিশ্বকাপ ফুটবলের ভবিষ্যৎ বক্তা

অধ্যায়ঃ দুই

♦ কিস্যা জ্যোতিষী বেজান দারওয়ালা

অধ্যায়ঃ তিন

♦ সাধারণ নির্বাচন ২০০৯ নিয়ে সব জ্যোতিষী ফেল

অধ্যায়ঃ চার

♦ মা শীতলার পায়ের ছাপ পুকুরঘাটেঃ রহস্যভেদ

অধ্যায়ঃ পাঁচ

♦ যিশুর মূর্তি থেকে রক্তপাত

অধ্যায়ঃ ছয়

♦ সত্য সাঁই-এর সত্যি-মিথ্যে

অধ্যায়ঃ সাত

♦ অলৌকিক উপায়ে সন্তান দেন ডা. বারসি

অধ্যায়ঃ আট

♦ জ্যোতিষীর বাড়িতে অলৌকিক আগুন

অধ্যায়ঃ নয়

♦ সম্মিলিত দুর্নীতির ফসল ‘মোবাইলবাবা’

অধ্যায়ঃ দশ

♦ জাতিস্মরঃ রাজেশ কুমার

♦ অলৌকিক শক্তিধরদের প্রতি চ্যালেঞ্জ

“যুক্তিবাদীর চ্যালেঞ্জাররা” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ

⇒ মন্তব্য করুন⇐

error: Content is protected !!