শ্লোকঃ ৪৬
কিরীটিনং গদিনং চক্রহস্তম্
ইচ্ছামি ত্বাং দ্রষ্টুমহং তথৈব ৷
তেনৈব রূপেণ চতুর্ভুজেন
সহস্রবাহো ভব বিশ্বমূর্তে ।। ৪৬ ।।
কিরীটিনম্—কিরীটধারী; গদিনম্ — গদাধারী: চক্রহস্তম্— চক্রধারী; ইচ্ছামি — ইচ্ছা করি, ত্বাম্ — তোমাকে, দুষ্টুম—দর্শন করতে, অহম্—আমি, তথা এব—পূর্বের মতো; তেন এব—সেই; রূপেণ – রূপে; চতুর্ভুজেন—চতুর্ভুজ; সহস্রবাহো হে সহস্রবাহো; ভব—হও, বিশ্বমূর্তে— হে বিশ্বমূর্তি।
গীতার গান
চতুর্ভুজ যে স্বরূপ দেখিবারে যে ইচ্ছুক
শংখ চক্র গদা পদ্মধারী ।
যে বিষ্ণু স্বরূপ হতে বিশ্বরূপ এ বিশ্বেতে
হও সে সহস্র বাহুধারী ॥
অনুবাদঃ হে বিশ্বমূর্তি ! হে সহস্রবাহো ! আমি তোমাকে পূর্ববৎ সেই কিরীট, গদা ও চক্রধারীরূপে দেখতে ইচ্ছা করি। এখন তুমি তোমার সেই চতুর্ভুজ রূপ ধারণ কর।
তাৎপর্যঃ ব্রহ্মাসংহিতাতে (৫/৩৯) বলা হয়েছে যে, রামাদিমূর্তিষু কলানিয়মেন তিষ্ঠন— ভগবান শত-সহস্র রূপে নিত্যকাল বিরাজমান এবং তাঁদের মধ্যে রাম, নৃসিংহ, নারায়ণ আদি রূপগুলিই হচ্ছে প্রধান। ভগবানের অসংখ্য রূপ আছে। কিন্তু অর্জুন জানতেন যে, শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন আদি পরমেশ্বর ভগবান, যিনি ক্ষণিকের জন্য তার বিশ্বরূপ ধারণ করেছেন। এখন তিনি তাঁর চিন্ময় নারায়ণ রূপ দেখতে চাইছেন। এই শ্লোকটিতে নিঃসন্দেহে শ্রীমদ্ভাগবতের বর্ণনা প্রতিষ্ঠিত করছে যে, শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন স্বয়ং ভগবান এবং সমস্ত অংশ ও কলা অবতারেরা তার থেকে উদ্ভুত হয়েছে। ভগবান তাঁর অংশ-প্রকাশ থেকে অভিন্ন এবং সমস্ত অগণিত রূপেই তিনি ভগবান। এই সমস্ত রূপেই তিনি নবযৌবন-সম্পন্ন। সেটিই হচ্ছে পরম পুরুষোত্তম ভগবানের নিত্যরূপ। শ্রীকৃষ্ণকে যিনি জানেন, তিনি তৎক্ষণাৎ এই জড় জগতের সমস্ত কলুষ থেকে মুক্ত হন।
শ্লোকঃ ৪৭
শ্রীভগবানুবাচ
ময়া প্রসন্নেন তবার্জুনেদং
রূপং পরং দর্শিতমাত্মযোগাৎ ।
তেজোময়ং বিশ্বমনন্তমাদ্যং
যন্মে ত্বদন্যেন ন দৃষ্টপূর্বম্ ॥ ৪৭ ॥
শ্রীভগবান্ উবাচ— পরমেশ্বর ভগবান বললেন; ময়া— আমার দ্বারা, गान হয়ে; তব—তোমাকে; অর্জুন— হে অর্জুন; ইদম্—এই রূপম্ – রূপ। পর। পরম দর্শিতম্—দর্শিত হল; আত্মযোগাৎ- আমার অন্তরঙ্গা শক্তির দ্বারা, ভেে তেজোময়; বিশ্বম্—সমগ্র জগৎরূপী; অনন্তম্ — অন্তহীন; আদ্যম্ — আদি, মৎ যা; মে— আমার; ত্বৎ অন্যেন— তুমি ছাড়া; ন দৃষ্টপূর্বা—পূর্বে কেউ দেখেনি। গীতার গান শ্রীভগবান কহিলেনঃ
গীতার গান
তোমার প্রসন্ন লাগি হে অর্জুন আমি যোগী
এই জড় বিশ্বরূপ দেখ ।
আমার যোগ প্রভাবে তাহা সেই সসম্ভবে
অসম্ভব নাহি যার লেখ ৷।
সেই তেজোময় বপু না দেখিল কেহ কভু
তোমার সেই প্রথম দর্শন ।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান বললেন—হে অর্জুন! আমি প্রসন্ন হয়ে তোমাকে আমার অন্তরঙ্গা শক্তি দ্বারা জড় জগতের অন্তর্গত এই শ্রেষ্ঠ রূপ দেখালাম। তুমি ছাড়া পূর্বে আর কেউই এই অনন্ত, আদি ও তেজোময় রূপ দেখেনি।
তাৎপর্যঃ অর্জুন ভগবানের বিশ্বরূপ দর্শন করতে চেয়েছিলেন। তাই, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর ভক্ত অর্জুনের প্রতি কৃপা পরবশ হয়ে তাঁকে তাঁর জ্যোতির্ময় ও ঐশ্বর্যময় বিশ্বরূপ দেখিয়েছিলেন। তাঁর এই রূপ ছিল সহস্র সূর্যের মতো উজ্জ্বল এবং তাঁর অসংখ্য মুখমণ্ডল ক্ষিপ্র গতিতে পরিবর্তিত হচ্ছিল। শ্রীকৃষ্ণ তাঁর প্রিয় সখা অর্জুনের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করবার জন্যই তাঁকে তাঁর এই রূপ দেখিয়েছিলেন। শ্রীকৃষ্ণ তাঁর অন্তরঙ্গা চিৎ-শক্তির প্রভাবে এই রূপ প্রকাশ করেছিলেন, যা মানুষের বুদ্ধির অগম্য। অর্জুনের আগে কেউই ভগবানের এই বিশ্বরূপ দর্শন করেননি। কিন্তু অর্জুনকে দেখানোর ফলে অন্তরীক্ষে স্বর্গলোক ও অন্যান্য গ্রহলোকের ভক্তেরাও তাঁর এই রূপ দর্শন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এর আগে কখনই তাঁরা এই রূপ দেখেননি, কিন্তু অর্জুনের জন্যই তাঁরা এই রূপ দেখতে সক্ষম হয়েছিলেন। পক্ষান্তরে বলা যায়, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কৃপা করে অর্জুনকে তার যে বিশ্বরূপ দেখিয়েছিলেন, পরম্পরা ধারায় অধিষ্ঠিত অন্যান্য গ্রহলোকের ভক্তেরাও তাঁর সেই রূপ দর্শন করার সুযোগ পেয়েছিলেন। কেউ কেউ বলে থাকেন যে, শ্রীকৃষ্ণ যখন শান্তির প্রস্তাব নিয়ে দুর্যোধনের কাছে গিয়েছিলেন, তখন তিনি তাকেও এই রূপ দেখিয়েছিলেন। দুর্ভাগ্যবশত, দুর্যোধন সেই শান্তির প্রস্তাব গ্রহণ করেনি, কিন্তু সেই সময় শ্রীকৃষ্ণ কতকটা তাঁর বিশ্বরূপ প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু তাঁর সেই রূপ অর্জুনকে যে রূপ দেখিয়েছিলেন তার থেকে ভিন্ন। এখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, এই রূপ এর আগে কখনও কেউ দেখেনি।
শ্লোকঃ ৪৮
ন বেদযজ্ঞাধ্যয়নৈর্ন দানৈ –
র্ন চ ক্রিয়াভির্ন তপোভিগ্রৈঃ ।
এবংরূপঃ শক্য অহং নৃলোকে
দ্রষ্টুং ত্বদন্যেন কুরুপ্রবীর ॥ ৪৮ ॥
ন-না; বেদ – বৈদিক জ্ঞান; য— যজ্ঞ; অধ্যয়নৈঃ—অধ্যয়নের দ্বারা; ন-না; দানৈঃ—দানের দ্বারা; নানা চ—ও; ক্রিয়াভিঃ পুণ্যকর্মের দ্বারা; ন–না; তপোভিঃ—তপস্যার দ্বারা, উগ্রেঃ কঠোর; এবংরূপঃ এই রূপে, শকাঃ যোগ্য: অহম- আমি; নৃলোকে–এই জড় জগতে; দ্রম্—দর্শন করতে, তুমি ছাড়া, অন্যেন—অন্য কারও দ্বারা; কুরুপ্রবীর – হে কুরুশ্রেষ্ঠ।
গীতার গান
বেদ যজ্ঞ কিংবা দান অতি পটু অধ্যয়ন
অসমর্থ সে সব বর্ণন ।।
কিংবা উগ্র তপোবল ক্রিয়াকাণ্ড যে সকল
সাধ্য নাই এরূপ দর্শনে ৷
হে কুরুপ্রবীর শুন না দেখিবে তুমি ভিন্ন
আমার সে রূপ ত্রিভুবনে ৷।
অনুবাদঃ হে কুরুশ্রেষ্ঠ ! বেদ অধ্যয়ন, যজ্ঞ, দান, পুণ্যকর্ম ও কঠোর তপস্যার দ্বারা এই জড় জগতে তুমি ছাড়া অন্য কেউ আমার এই বিশ্ব রূপ দর্শন করতে সমর্থ নয়।
তাৎপর্যঃ যে দিব্যদৃষ্টি দিয়ে অর্জুন ভগবানের বিশ্বরূপ দর্শন করেছিলেন, সেই দিব্য দৃষ্টি কি, তা আমাদের যথাযথভাবে বুঝতে হবে। কে দিব্যদৃষ্টির অধিকারী হতে পারেন ? ‘দিবা’ কথাটির অর্থ হচ্ছে দেবতুল্য। যতক্ষণ না আমরা দেবতাদের মতো দিব্য গুণাবলীতে ভূষিত হচ্ছি, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা দিব্যদৃষ্টি লাভ করতে পারি না। এখন কথা হচ্ছে দেবতা কারা? বৈদিক শাস্ত্রে বলা হয়েছে, যাঁরা ভগবান শ্রীবিষ্ণুর ভক্ত, তারাই হচ্ছেন দেবতা (বিষ্ণুভক্তঃ স্মৃতা দেবাঃ)। যারা ভগবৎ-বিদ্বেষী অর্থাৎ যারা শ্রীবিষ্ণুকে বিশ্বাস করে না, অথবা যারা শ্রীকৃষ্ণের নির্বিশেষ রূপকেই পরমতত্ত্ব বলে মনে করে, তাদের পক্ষে দিব্যদৃষ্টি লাভ করা কখনই সম্ভব নয়। শ্রীকৃষ্ণের নিন্দা করা এবং সেই সঙ্গে দিব্য দৃষ্টিসম্পন্ন হওয়া কখনই সম্ভব নয়। দৈ গুণাবলীতে বিভূষিত না হলে কখনই দিব্যদৃষ্টি লাভ করা সম্ভব নয়। পক্ষান্তরে বলা যায়, যাঁরা দিব্য দৃষ্টিসম্পন্ন, তাঁরাও অর্জুনের মতো দর্শন করতে পারেন। ভগবদ্গীতায় ভগবানের বিশ্বরূপের বর্ণনা করা হয়েছে। যদিও অর্জুনের পূর্বে এই বিবরণ সকলের কাছে অজ্ঞাত ছিল, এখন এই ঘটনার পরে ভগবানের বিশ্বরূপ সম্পর্কে আমরা কিছুটা ধারণা করতে পারি। যারা যথার্থ দৈবগুণ সম্পন্ন, তাঁরা ভগবানের বিশ্বরূপ দর্শন করতে পারেন। কিন্তু ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শুদ্ধ ভক্ত না হলে কেউই দিব্য পদবাচ্য হতে পারেন না। ভগবদ্ভক্ত, যাঁরা যথার্থ দিব্য প্রকৃতিতে অধিষ্ঠিত এবং যাঁদের দিব্যদৃষ্টি আছে, তাঁরা কিন্তু ভগবানের বিশ্বরূপ দর্শনের জন্য উৎসুক নন। পূর্ববর্তী শ্লোকে যে কথা বলা হয়েছে, অর্জুন শ্রীকৃষ্ণের চতুর্ভুজ বিষ্ণুরূপ দর্শন করতে চেয়েছিলেন এবং ভগবনের বিশ্বরূপ দর্শনে তিনি প্রকৃতপক্ষে ভীত হয়েছিলেন।
এই শ্লোকে বেদযজ্ঞাধ্যয়নৈঃ কথাগুলি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ, যা বৈদিক সাহিত্য অধ্যয়ন এবং যজ্ঞবিধির বিষয়বস্তুকে উল্লেখ করে।
বেদ বলতে সব রকমের বৈদিক শাস্ত্রকে বোঝার, ফোন- চতুর্বেদ (ঋক্, সাম, যজুঃ ও অথর্ব), অষ্টাদশ পুরাণ, উপনিষৎ ও বেদান্তসূত্র। এই সমস্ত শাস্ত্র গৃহে অথবা অন্য কোথাও পাঠ করা যায়। তেমনই, বৈদিক যজ্ঞবিধির অনুশীলন করবার জন্য কল্পসূত্র ও মীমাংসাসূত্র রয়েছে। দানৈঃ শব্দে যোগ্য পাত্রে দান করার কথা বলা হয়েছে, যেমন ভক্তিভরে ভগবানের সেবায় নিযুক্ত ব্রাহ্মণ ও বৈষ্ণবদের দান করা। তেমনই, ‘পুণ্যকর্ম’ বলতে অগ্নিহোত্র ও বর্ণাশ্রম ধর্মকে উল্লেখ করে। আর ইচ্ছাকৃত দৈহিক ক্লেশ স্বীকার করাকে বলা হয় তপস্যা। সুতরাং, সকলেই এই সমস্ত আচরণ করতে পারেন— দৈহিক ক্লেশ স্বীকার করতে পারেন, দান করতে পারেন, বেদ পাঠ করতে পারেন—কিন্তু যতক্ষণ না তিনি অর্জুনের মতো ভগবত্তক্তে পরিণত হচ্ছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত তাঁর পক্ষে ভগবানের বিশ্বরূপ দর্শন করা সম্ভব নয়। যাঁরা নির্বিশেষবাদী, তাঁরাও কল্পনা করছেন যে, তাঁরা ভগবানের বিশ্বরূপ দর্শন করছেন। কিন্তু ভগবদ্গীতা থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, নির্বিশেষবাদীরা ভগবদ্ভক্ত নয়। তাই, তাদের পক্ষে তগবানের বিশ্বরূপ দর্শন করা কখনই সম্ভব নয়।
অনেক মানুষ আছে যারা অবতার তৈরি করে। তারা ভ্রান্তভাবে কোন সাধারণ মানুষকে ভগবানের অবতার বলে অপপ্রচার করে। কিন্তু এগুলি হচ্ছে নিতান্তই মূর্খতা। আমাদের ভগবদ্গীতার তত্ত্ব গ্রহণ করতে হবে। তা না হলে পূর্ণরূপে দিব্যজ্ঞান লাভ করা সম্ভব হবে না। যদিও ভগবদ্গীতাকে ভগবৎ-তত্ত্ববিজ্ঞানের প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা বলে মনে করা হয়, তবুও এটি এতই নিখুঁত যে, তাঁর মাধ্যমে আমরা কোটা কি সেই বিষয়ে যথার্থ জ্ঞান লাভ করতে পারি। কোন নকল অবতারের চেলাও বলতে পারে যে, তারাও ভগবানের দিব্য অবতার বা বিশ্বরূপ দর্শন করেছে, কিন্তু তাঁদের সেই দাবি গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ এখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, শ্রীকৃষ্ণের ভক্ত না হলে ভগবানের বিশ্বরূপ দর্শন করা সম্ভব নয়। সুতরাং সর্বপ্রথমে তাকে শুদ্ধ কৃষ্ণভক্ত হতে হবে; তার পরে তিনি দাবি করতে পারেন যে, বিশ্বরূপ বা অন্য যে রূপ তিনি দর্শন করেছেন, তা তিনি অন্যদের দেখখতে পারেন। কৃষ্ণভক্ত কখনই মেকি অবতার ও তাদের চেলাদের মেনে নিতে পারেন না।