শ্লোকঃ ২৬-৩০
অমী চ ত্বাং ধৃতরাষ্ট্রস্য পুত্রাঃ
সর্বে সহৈবাবনিপালসঙ্ঘৈঃ।
ভীষ্মো, দ্রোণঃ সূতপুত্রস্তথাসৌ
সহাস্মদীয়ৈরপি যোধমুখ্যৈঃ ॥ ২৬ ৷।
বক্ত্রাণি তে ত্বরমাণা বিশন্তি
দৎস্ট্রাকরালানি ভয়ানকানি।
কেচিদ্ বিলগ্না দশনান্তরেষু
সংদৃশ্যন্তে চূর্ণিতৈরুত্তমাঙ্গৈঃ ॥ ২৭ ॥
যথা নদীনাং বহুবোহম্বুসুবেগাঃ
সমুদ্রমেবাভিমুখা দ্রবন্তি ।
তথা তবামী নরলোকবীরা
বিশন্তি বক্ত্রাণ্যবিভিজ্বলন্তি ॥ ২৮ ॥
যথা প্রদীপ্তং জ্বলনং পতঙ্গা
বিশন্তি নাশায় সমৃদ্ধৰেগাঃ।
তথৈব নাশায় বিশন্তি লোকা-
স্তবাপি বক্ত্রাণি সমৃদ্ধবেগাঃ ॥ ২৯ ॥
লেলিহাসে গ্রসমানঃ সমন্তা-
ল্লোকান্ সমগ্রান্ বদনৈজ্বলদ্ভিঃ ।
তেজোভিরাপূর্য জগৎ সমগ্রং
ভাসস্তবোগ্রাঃ প্রতপন্তি বিষ্ণো ৷। ৩০ ॥
অমী—এই সমস্ত; চ—–ও; ত্বাম্ – তোমার, ধৃতরাষ্ট্রস্য—ধৃতরাষ্ট্রের; পুত্রাঃ—পুত্রগণ সর্বে— সমস্ত সহ — সহ; এর — বাস্তবিকপক্ষে; অবনিপাল — নৃপতিগণ; স.- দলবদ্ধভাবে; ভীষ্মঃ—ভীষ্মদেব; দ্রোণঃ- দ্রোণাচার্য; সূতপুত্রঃ—কর্ণ; তথা—ও; অসৌ— সেই; সহ — সহ; অম্মদীয়ৈঃ – আমাদের; অপি – ও যোধমুগৈঃ প্রमान যোদ্ধাগণ, বক্ত্রাণি — মুখসমূহের মধ্যে তে— তোমার; ত্বরমাণাঃ – দ্রুতবেগে: বিশন্তি—প্রবেশ করছে; দংষ্ট্রা— দণ্ডবিশিষ্ট; করালানি — করাল; ভয়ানকানি অত্যন্ত ভয়ঙ্কর; কেচিং–কেউ কেউ, বিষণ্ণাঃ — বিলগ্ন হয়ে; দর্শনান্তরেষু দত্ত মধ্যে; সংদৃশ্যন্তে— দেখা যাচ্ছে; চূর্ণিতেঃ – চূর্ণিত: উত্তমাঙ্গৈঃ — মস্তক দ্বারা, যথা — যেমন; নদীনাম্—নদীসমূহের, বহবঃ বহু, অসুবেগাঃ — জলপ্রবাহ; সমুদ্রম্—সমুদ্র; এব— অবশ্যই, অভিমুখাঃ—অভিমুখী হয়ে; দ্রবন্তি — প্রবেশ করে; তথা — তেমনই, ভব— তোমার; অমী—এই সকল; নরলোকবীরাঃ নরলোকের বীরগণ, বিশত্তি — প্রবেশ করছে, বক্ত্রাণি — মুখসমূহে, অভিবিজ্বলত্তি – জ্বলন্ত; যথা — যেমন; প্রদীপ্তম্ – প্রজ্বলিত; জ্বলনম্—অগ্নি, পতঙ্গাঃ — পতঙ্গগণ; বিশন্তি — প্রবেশ করে; নাশায়- মরণের জন্য; সমৃদ্ধবেগাঃ– প্রবল বেগে; তথা এব—তেমনই; নাশায়—মরণের জন্য; বিশন্তি—প্রবেশ করছে, লোকাঃ— সমস্ত মানুষ; তব — তোমার; অপি—ও; বজ্রাণি—মুখসমূহের মধ্যে; সমৃদ্ধকোাঃ — অতি বেগে; লেলিহাসে— লেহন করছ; গ্রসমানঃ— গ্রাস করছ; সমস্তাৎ- চারি দিকে, লোকান্― লোকসমূহকে, সমগ্রান্— সমগ্র; বদনৈঃ—মুখসমূহের দ্বারা; জলভিঃ প্রদীপ্ত, তেজোভিঃ – তেজোরাশির দ্বারা; আপূর্য – আবৃত করে; জগৎ— জগৎ, সমগ্র— সমগ্র, ভাসঃ দীপ্তিসমূহ; তব তোমার; উগ্রাঃ—ভয়ংকর; প্রতপত্তি—সত্তপ্ত করছ; বিষ্ণো – হে সৰ্বব্যাপ্ত ভগবান।
গীতার গান
ধৃতরাষ্ট্র পুত্র যত, তারা সব অবিরত,
সঙ্গে লয়ে যত দিক্পাল।
ভীষ্ম দ্রোণ আর কৰ্ণ, আমাদের যত সৈন্য,
পিষ্ট তব দত্তেতে করাল।।
সবাই প্রবেশ করে, ভয়ানক দত্ত স্তরে,
চূর্ণ হয়ে থাকে সে লাগিয়া ।
ভাবি সে দেখিয়া মনে, নদীস্রোত ধাবমানে,
গেল বুঝি সমুদ্রে মিশিয়া ।।
যত নর লোকবীর, জ্বলে গেল হল স্থির,
তোমার মুখের যে গহ্বরে ।
যেমন পতঙ্গ জ্বলে, অগ্নিতে প্রবেশ কালে,
ধ্বংস হয় নিজের বেগেতে ।।
তুমি ত করিছ গ্রাস, যত লোক ইতিহাস,
জ্বলিত তোমার এই মুখে ৷
সে তেজেতে ভাসমান, জগতের নাহি ত্রাণ,
হে বিষ্ণু সবাই মরে দুঃখে ।।
অনুবাদঃ ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রেরা, তাদের মিত্র সমস্ত রাজন্যবর্গ এবং ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ এবং আমাদের পক্ষের সমস্ত সৈন্যেরা তোমার করাল দন্তবিশিষ্ট মুখের মধ্যে দ্রুতবেগে প্রবেশ করছে এবং সেই দন্তমধ্যে বিলগ্ন হয়ে তাদের মস্তক চূর্ণিত হচ্ছে। নদীসমূহ যেমন সমুদ্রাভিমুখে প্রবাহিত হয়ে সমুদ্রে প্রবেশ করে, তেমনই নরলোকের বীরগণ তোমার জ্বলন্ত মুখবিবরে প্রবেশ করছে। পতঙ্গগণ যেমন দ্রুত গতিতে ধাবিত হয়ে মরণের জন্য জ্বলন্ত অগ্নিতে প্রবেশ করে, তেমনই এই লোকেরাও মৃত্যুর জন্য অতি বেগে তোমার মুখবিবরে প্রবেশ করছে। হে বিষ্ণু ! তুমি তোমার জ্বলন্ত মুখসমূহের দ্বারা সকল লোককে গ্রাস করছ এবং তোমার তেজোরাশির দ্বারা সমগ্র জগৎকে আবৃত করে সত্তপ্ত করছ।
তাৎপর্যঃ পূর্ববর্তী শ্লোকে ভগবান প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, তিনি অর্জুনকে অত্যন্ত কৌতূহল উদ্দীপক কিছু দেখাবেন। এখন অর্জুন দেখছেন যে, তাঁর বিপক্ষ দলের সমস্ত নেতারা (ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ ও ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রেরা) এবং তাদের সৈন্যেরা এবং অর্জুনের নিজের সৈন্যেরা সকলেই বিনাশ প্রাপ্ত হতে চলেছে। এর থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, কুরুক্ষেত্রে সমবেত প্রায় সকলেরই মৃত্যুর পর অর্জুনের জয় অবশ্যম্ভাবী। এখানে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, অপরাজেয় ভীষ্মও বিনাশ প্রাপ্ত হবেন। তেমনই কর্ণও বিনাশ প্রাপ্ত হবেন। ভীষ্ম আদি বিপক্ষের মহারথীরাই কেবল বিনাশ প্রাপ্ত হবেন না, অর্জুনের স্বপক্ষের অনেক রথী-মহারথীরাও বিনাশ প্রাপ্ত হবেন।
শ্লোকঃ ৩১
আখ্যাহি মে কো ভবানুগ্ররূপো
নমোহস্তু তে দেববর প্রসীদ ।
বিজ্ঞাতুমিচ্ছামি ভবন্তমাদ্যং
ন হি প্রজানামি তব প্রবৃত্তিম্ ॥ ৩১ ॥
আখ্যাহি—দয়া করে বল; মে – আমাকে; কঃ – কে; ভবান্ –তুমি, উগ্ররূপঃ— উগ্রমূর্তি; নমঃ অন্তু—নমস্কার করি; তে— তোমাকে; দেববর – হে দেবশ্রেষ্ঠ; প্রসীদ—প্রসন্ন হও; বিজ্ঞাভুম্ — বিশেষভাবে জানতে ইচ্ছামি — ইচ্ছা করি; ভবন্তম— তোমাকে; আদ্যম্—আদিপুরুষ; ন–না; হি—অবশ্যই: প্রজানামি — জানতে পারছি; তব — তোমার; প্রবৃত্তিম্—প্রচেষ্টা।
গীতার গান
কৃপা করি কহ প্রভু মোরে, কেবা তুমি উগ্রঘোরে,
প্রণমি প্রসাদ তুমি প্রভু।
কি কারণ এ অদ্ভুত, পরিচাজ বিশ্বরূপ,
দেখি নাই বুঝি নাই কভু ॥
কিবা সে প্রবৃত্তি তব, জিজ্ঞাসি তোমারে সব,
ইচ্ছা হয় জানিবার তরে ।
যদি কৃপা তব হয়, বিবরণ সে নিশ্চয়,
কৃপা করি কহ প্রভু মোরে ॥
অনুবাদঃ উগ্রমূর্তি তুমি কে, কৃপা করে আমাকে বল। হে দেবশ্রেষ্ঠ! তোমাকে নমস্কার করি, তুমি প্রসন্ন হও। তুমি হচ্ছ আদিপুরুষ। আমি তোমার প্রবৃত্তি অবগত নই, আমি তোমাকে বিশেষভাবে জানতে ইচ্ছা করি।
শ্লোকঃ ৩২
শ্রীভগবানুবাচ
কালোঽম্মি লোকক্ষয়কৃৎ প্রবৃদ্ধো
লোকান্ সমাহর্তুমিহঃ প্রবৃত্তঃ।
ঋতেঽপি ত্বাং ন ভবিষ্যন্তি সর্বে
যেহবস্থিতাঃ প্রত্যনীকেষু যোধাঃ ॥ ৩২ ৷৷
শ্রীভগবান্ উবাচ—পরমেশ্বর ভগবান বললেন, কালঃ – কাল; অস্মি হই, লোক লোক; ক্ষয়কৃৎ—ধ্বংসকারী; প্রবৃদ্ধঃ— বৃদ্ধিপ্রাপ্ত, লোকান্ লোকসমূহকে; সমাহর্তম—সংহার করতে; ইহ—এক্ষণে; প্রবৃত্তঃ – প্রবৃত্ত হয়েছি; ঋতে — ব্যতীত; অপি—ও: জাম্—তোমাকে; ননা ভবিষ্যন্তি থাকবে; সর্বে—সকলে; যে- যে; অবস্থিতাঃ —অবস্থিত আছে; প্রত্যনীকেষু — বিপক্ষ দলে, যোধাঃ — যোদ্ধাগণ।
গীতার গান
শ্রীভগবান কহিলেনঃ
মহাকাল আমি সেই, প্রবৃদ্ধ ইচ্ছায় হই,
যত লোক গ্রাস করিবারে ।
প্রবৃত্ত হয়েছি আমি, আমি সেই অন্তর্যামী,
লোকক্ষয় অন্তরে অন্তরে ৷।
অনুবাদঃ শ্রীভগবান বললেন—আমি লোকক্ষয়কারী প্রবৃদ্ধ কাল এবং এই সমস্ত লোক সংহার করতে এক্ষণে প্রবৃত্ত হয়েছি। তোমরা (পাণ্ডবেরা) ছাড়া উভয়-পক্ষীয় সমস্ত যোদ্ধারাই নিহত হবে।
তাৎপর্যঃ অর্জুন যদিও জানতেন যে, শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন তাঁর বন্ধু এবং পরম পুরুষোত্তম ভগবান, কিন্তু তবুও তাঁর বিবিধ রূপ দর্শনে তিনি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। তাই তিনি জানতে চাইলেন, এই ভয়ংকর ধ্বংস সাধনকারী শক্তির প্রকৃত উদ্দেশ্য কি। বেদে বলা হয়েছে যে, পরমতত্ত্ব ভগবান সব কিছুই বিনাশ করেন, এমন কি ব্রাহ্মণদেরও। কঠ উপনিষদে (১/২/২৫) বলা হয়েছে—
যস্য ব্ৰহ্ম চ ক্ষত্ৰং চ উভে ভবত ওদনঃ ।
মৃত্যুর্যস্যোপসেচনং ক ইত্থা বেদ যত্ৰ সঃ ॥
কালক্রমে সমস্ত ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় এবং অন্য সকলকেই পরমেশ্বর ভগবান গ্রাস করবেন। পরমেশ্বর ভগবানের এই রূপ সর্বগ্রাসী দানবের মতো এবং এখানে তিনি সর্বগ্রাসী কালরূপে নিজেকে প্রকাশ করেছেন। কয়েকজন পাণ্ডব ব্যতীত এই যুদ্ধক্ষেত্রে সমবেত সকলকেই ভগবান গ্রাস করবেন।
অর্জুন যুদ্ধ করতে চাইছিলেন না। তিনি মনে করেছিলেন যে, যুদ্ধ না করাই ভাল হবে। তা হলে কোন রকম নৈরাশ্য বা বিষাদের সূচনা হবে না। তার উত্তরে ভগবান বললেন যে, তিনি যদি যুদ্ধ নাও করেন, তবুও সকলেরই বিনাশ হবে। কারণ সেটিই হচ্ছে তাঁর পরিকল্পনা। অর্জুন যদি যুদ্ধ থেকে বিরত হন, তা হলে অন্য কোনভাবে তাদের মৃত্যু হবে। মৃত্যুকে রোধ করা যাবে না। এমন কি অর্জুন যদি যুদ্ধ না করেন, তবুও মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। প্রকৃতপক্ষে, তাদের সকলেরই মৃত্যু হয়ে গিয়েছিল। সময় সর্বগ্রাসী, সংহারক। পরমেশ্বর ভগবানের ইচ্ছার প্রভাবে সব কিছুই বিনাশ প্রাপ্ত হয়। সেটিই হচ্ছে প্রকৃতির নিয়ম।