শ্লোকঃ ১৪
ততঃ স বিস্ময়াবিষ্টো হৃষ্টরোমা ধনঞ্জয়ঃ
প্রণম্য শিরসা দেবং কৃতাঞ্জলিরভাষত ॥ ১৪ ॥
ততঃ — তারপর; সঃ তিনি; বিস্ময়াবিষ্টঃ — বিস্ময়ান্বিত, হৃষ্টরোমা – রোমাঞ্চিত হয়ে; ধনঞ্জয়ঃ- অর্জুন; প্রণম্য প্রণাম করে, শিরসা — মস্তক দ্বারা, দেবম্ পরমেশ্বর ভগবানকে; কৃতাঞ্জলিঃ – করজোড়ে; অভাষত – বললেন।
গীতার গান
ধনঞ্জয় হৃষ্টরাম দেখিয়া বিস্মিত ।
শিরসা প্রণাম করে কৃতাঞ্জলিপুটে ॥
কহিতে লাগিল সেই সম্ভ্রমসিত।
দেবতার কাছে যথা যাচে নিজ হিত ॥
অনুবাদঃ তারপর সেই অর্জুন বিস্মিত ও রোমাঞ্চিত হয়ে এবং অবনত মস্তকে ভগবানকে প্রণাম করে করজোড়ে বলতে লাগলেন।
তাৎপর্যঃ এই দিবা দর্শনের প্রভাবে শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুনের সম্পর্কের আকস্মিক পরিবর্তন হয়। পূর্বে শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুনের সম্পর্ক সখাভাবের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল, কিন্তু এখন, বিশ্বরূপ দর্শনের পর অর্জুন গভীর শ্রদ্ধা সহকারে প্রণাম করে করজোড়ে শ্রীকৃষ্ণের প্রতি স্তব করছেন। তিনি বিশ্বরূপের প্রশংসা করছেন। এভাবেই ভগবানের প্রতি অর্জুনের সম্পর্ক সখ্যের পরিবর্তে অদ্ভুতে পরিণত হয়। মহাভাগবতেরা শ্রীকৃষ্ণকে সমস্ত সম্পর্কের আধাররূপে দর্শন করেন। শাস্ত্রাদিতে বারোটি বিভিন্ন রসের কথা বলা হয়েছে এবং সব কয়টি শ্রীকৃষ্ণের মধ্যে বর্তমান। শাস্ত্রে বলা হয়েছে, জীবের মধ্যে দেবতাদের মধ্যে এবং ভগবানের সঙ্গে তাঁর ভক্তদের মধ্যে যে রসের আদান প্রদান হয়, শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন সেই সমস্ত রসের সমুদ্র-স্বরূপ।
এখানে অর্জুন অদ্ভুত রসের সম্পর্কের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। স্বভাবতই অর্জুন যদিও ছিলেন খুব ধীর, স্থির ও শান্ত, তবুও এই অদ্ভুত রসের প্রভাবে তিনি আত্মহারা হয়ে পড়েন। তাঁর শরীর রোমাঞ্চিত হয় এবং কৃতাঞ্জলিপুটে তিনি বারবার ভগবানকে প্রণাম করতে থাকেন। অবশ্য তিনি ভীত হননি। তিনি পরমেশ্বর ভগবানের অত্যাশ্চর্য ঐশ্বর্য দর্শনে বিস্ময়ান্বিত হয়েছিলেন। ভগবানের প্রতি তাঁর স্বাভাবিক সখ্যভাব বিস্ময়ের দ্বারা আচ্ছাদিত হয়ে পড়ে এবং তাই তিনি এই রকম আচরণ করতে শুরু করেন।
শ্লোকঃ ১৫
অর্জুন উবাচ
পশ্যামি দেবাংস্তব দেব দেহে
সর্বাংস্তথা ভূতবিশেষসঙ্ঘান।
ব্রহ্মাণমীশং কমলাসনস্থম্
ঋষীংশ্চ সর্বানুরগাংশ্চ দিব্যান্ ॥ ১৫ ॥
অর্জুনঃ উবাচ—অর্জুন বললেন; পশ্যামি — দেখছি; দেবান্—সমস্ত দেবতাদেরকে; তব –তোমার, দেব—হে দেব; দেহে— দেহে; সর্বান্ — সমস্ত; তথা —ও; ভূত— প্রাণীদেরকে; বিশেষসম্বান্ – বিশেষভাবে সমবেত, ব্রহ্মাণম্—ব্রহ্মাকে, ঈশম্ শিবকে; কমলাসনস্থম্—কমলাসনে স্থিত, ঋষীন্—মহর্ষিদেরকে: চ—ও; সর্বান- উরগান—সর্পদেরকে; চ—ও; দিব্যান্—দিব্য ।
গীতার গান
অর্জুন কহিলেনঃ
হে দেব শরীরে তব, দেখিতেছি যে বৈভব,
নহে বাক্য মনের গোচর ।
সকল ভূতের সঙ্ঘ, সে এক বিশাল রঙ্গ,
একত্রিত সব চরাচর।।
ব্রহ্ম যে কমলাসন, সকল উরগগণ,
অন্তর্যামী ভগবান ঈশ ৷
যত ঋষিগণ হয়, কেহ সেথা বাকী নয়,
দিবি দেব যত জগদীশ ৷।
অনুবাদঃ অর্জুন বললেন- হে দেব। তোমার দেহে দেবতাদের, বিবিধ প্রাণীদের, কমলাসনে স্থিত ব্রহ্মা, শিব, ঋষিদের ও দিব্য সর্পদেরকে দেখছি।
তাৎপর্যঃ তাই তিনি ব্রহ্মাকে দর্শন করলেন, তিনি দিব্য সর্গকে দর্শন করলেন, ব্রহ্মাণ্ডের সব কিছুই অর্জুন দর্শন করলেন। যিনি হচ্ছেন এই ব্রহ্মাণ্ডের প্রথম সৃষ্ট জীব। ব্রহ্মাণ্ডের নিম্নদেশে যার উপর গর্ভোদকশায়ী বিষ্ণু শয়ন করেন। এই সর্পশয্যাকে বলা হয় ৰাসুকী । বাসুকী নামক অন্য সর্পও আছে। এভাবেই অর্জুন গর্ভোদকশায়ী বিষ্ণু থেকে শুরু করে এই ব্রহ্মাণ্ডের সর্বোচ্চ শিখরে কমলাসনে স্থিত ব্রহ্মাকে দর্শন করলেন। অর্থাৎ, তাঁর রথের উপর বসেই অর্জুন আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত সব কিছুই দর্শন করলেন। পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কৃপার প্রভাবেই কেবল তা সম্ভব হয়েছিল।
শ্লোকঃ ১৬
অনেকবাহুদরবক্তুনেত্রং
পশ্যামি ত্বাং সর্বতোহনন্তরূপম্ ৷
নান্তং ন মধ্যং ন পুনস্তবাদিং
পশ্যামি বিশ্বেশ্বর বিশ্বরূপ ।। ১৬ ৷।
অনেক—অনেক; বাহু – বাহু; উদর উদর; বক্তৃ—মুখ, নেত্রম্— চক্ষু, পশ্যামি দেখছি; ত্বাম্—তোমাকে; সর্বতঃ—সর্বত্র; অনন্তরূপম্ – অনন্ত রূপ; ন অস্তম্— অন্তহীন; ন মধ্যম্—মধ্যহীন; ন–না; পুনঃপুনরায়; তব— তোমার; আদিম্ আদি, পশ্যামি দেখছি, বিশ্বেশ্বর — হে জগদীশ্বর, বিশ্বরূপ – হে বিশ্বরূপ ।
গীতার গান
অনেক বাহু উদর, অনেক নয়ন বক্ত্র,
দেখিতেছি অনন্ত সে রূপ ৷
আদি অন্ত নাহি তার, বিশ্বেশ্বর যে অপার
অদ্ভুত যে দেখি বিশ্বরূপ।।
অনুবাদঃ হে বিশ্বেশ্বর। হে বিশ্বরূপ। তোমার দেহে অনেক বাহু, উদর, মুখ এবং সর্বত্র অনন্ত রূপ দেখছি। আমি তোমার আদি, মধ্য ও অন্ত কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।
তাৎপর্যঃ শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরম পুরুষোত্তম ভগবান এবং তিনি হচ্ছেন অসীম অনন্ত। তাই, তাঁর মধ্যে সব কিছুই দর্শন করা যায়।