শ্লোকঃ ১০-১১
অনেকবক্ত্রনয়নমনেকাদ্ভুতদর্শনম্ ।
অনেকদিব্যাভরণং দিব্যানেকোদ্যতায়ুধম্ ॥ ১০॥
দিব্যমাল্যাম্বরধরং দিব্যগন্ধ্যানুলেপনম ।
সর্বাশ্চর্যময়ং দেবমনন্তং বিশ্বতোমুখম্ ॥ ১১॥
অনেক – বহু, বন্ধু——মুখ; নয়নম্— চক্ষু অনেক বহু অদ্ভুত অদ্ভুত দর্শন- দর্শনীয় বস্তু; অনেক—বহু; দিব্য – দিবা; আভরণম্ অলদার, দিবা- দিবা; অনেক—অনেক; উদ্যত — উদ্যত; আয়ুধম্ — অস্ত্র, দিব্য – দিবা; মাল্য – মালা; অম্বরধরম্— বস্ত্র শোভিত, দিব্য – দিবা, গন্ধ — গন্ধ; অনুলেপনম্—অনুলিপ্ত; সর্ব— সমস্ত: আশ্চর্যময়ম্—আশ্চর্যজনক; দেবম্ — দ্যুতিময়, অনন্তম্—অন্তহীন: বিশ্বতোমুখম্—সর্বত্র পরিব্যাপ্ত।
গীতার গান
অনেক নয়ন বজ অদ্ভুত দর্শন ৷
অনেক সে অস্ত্র আর দিব্য আবরণ ॥
দিব্য মালা গন্ধ আর চন্দন লেপন ৷
সবই আশ্চর্য রূপ বিশ্বের সৃজন ॥
অনুবাদঃ অর্জুন সেই বিশ্বরূপে অনেক মুখ, অনেক নেত্র ও অনেক অদ্ভুত দর্শনীয় বস্তু দেখলেন। সেই রূপ অসংখ্য দিব্য অলঙ্কারে সজ্জিত ছিল এবং অনেক উদাত দিব্য অস্ত্র ধারণ করেছিল। সেই বিশ্বরূপ দিব্য মালা ও দিব্য বস্ত্রে ভূষিত ছিল। এবং তাঁর শরীর দিব্য গন্ধ দ্বারা অনুলিপ্ত ছিল। সবই ছিল অত্যন্ত আশ্চর্যজনক, জ্যোতিময়, অনন্ত ও সর্বব্যাপী।
তাৎপর্যঃ এই শ্লোক দুটিতে অনেক শব্দটির বহুবার ব্যবহারের দ্বারা বুঝতে পারা যায় যে, ভগবানের যে সব হস্ত, পদ, মুখ এবং অন্যান্য রূপের অভিপ্রকাশ অর্জুন দেখছিলেন, সেগুলির সংখ্যার কোন সীমা ছিল না। ভগবানের এই প্রকাশগুলি সারা ব্রহ্মাণ্ড জুড়ে পরিব্যাপ্ত ছিল। কিন্তু ভগবানের কৃপায় অর্জুন এক জায়গায় বসে তা দর্শন করতে পেরেছিলেন। শ্রীকৃষ্ণের অচিন্ত্য শক্তির প্রভাবেই তা সম্ভব হয়েছিল।
শ্লোকঃ ১২
দিব্যি সূর্যসহস্রস্য ভবেদযুগপদুত্থিতা ।
যদি ভাঃ সদৃশী সা স্যাদ ভাসন্তস্য মহাত্মনঃ ॥ ১২ ৷৷
দিবি—আকাশে; সূর্য—সূর্যের, সহস্রস্য – সহস্র, ভবেৎ হয়, যুগপৎ একসঙ্গে উত্থিতা—সমুদিত; যদি — যদি; ডাঃ – প্রভা; সদৃশী — তুলা; সা—তা; স্যাৎ হতে পারে; ভাগঃ- প্রভা; তস্য—সেই; মহাত্মনঃ- মহাত্মা বিশ্বরূপের।
গীতার গান
যদি সূর্য দিনে উঠে সহস্ৰ সহস্ৰ ৷
একত্রে কিরণ বুঝ অনন্ত অজস্র ৷।
তাহা হলে কিছু তার অংশ অনুমান ।
অন্যথা সে দিব্য তেজ নহেত প্ৰমাণ ।।
অনুবাদঃ যদি আকাশে সহস্র সূর্যের প্রভা যুগপৎ উদিত হয়, তা হলে সেই মহাত্মা বিশ্বরূপের প্রভার কিঞ্চিৎ তুল্য হতে পারে।
তাৎপর্যঃ অর্জুন যা দর্শন করেছিলেন তা ছিল অবর্ণনীয়, তবুও সঞ্জয় সেই মহান অভিপ্রকাশের মানসিক চিন্তাপ্রসূত ভাবচিত্রটি ধৃতরাষ্ট্রকে দেবার চেষ্টা করছেন। সঞ্জয় বা ধৃতরাষ্ট্র কেউই সেখানে উপস্থিত ছিলেন না, কিন্তু ব্যাসদেবের কৃপার প্রভাবে সঞ্জয় দেখতে পাচ্ছিলেন সেখানে কি হচ্ছিল। ভগবানের এই রূপ দর্শন করার ক্ষমতা যাদের নেই, তাদের বোধগম্য করাবার জন্য সঞ্জয় তা একটি কাল্পনিক অবস্থার সঙ্গে তুলনা করছেন (যেমন, সহস্র সহস্র সূর্য )।
শ্লোকঃ ১৩
তত্রৈকস্থং জগৎ কৃৎস্নং প্রবিভক্তমনেকধা ।
অপশ্যদ্দেবদেবস্য শরীরে পাণ্ডবস্তদা ॥ ১৩॥
তন্ত্র—সেখানে; একস্থম্—এক স্থানে অবস্থিত; জগৎ—বিশ্ব; কৃৎ-সম প্রবিভক্তম্—বিভক্ত; অনেকধা – বহু প্রকার; অপশাৎ দেখলেন, দেবদেবস্য- পরমেশ্বর ভগবানের; শরীরে — বিশ্বরূপে; পাণ্ডবঃ – অর্জুন: তদা তখন।
গীতার গান
অর্জুন দেখিল তবে কৃষ্ণের শরীরে ।
একত্রে সে অবস্থান অনন্ত বিশ্বের ।।
এক এক সে বিভক্ত যথা যথা স্থান ।
সেই তেজ জ্যোতি মধ্যে বিধির বিধান ।।
অনুবাদঃ তখন অর্জুন পরমেশ্বর ভগবানের বিশ্বরূপে নানাভাবে বিভক্ত সমগ্র জগৎ একত্রে অবস্থিত দেখলেন।
তাৎপর্যঃ তত্র (‘সেখানে’) কথাটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এর দ্বারা বোঝানো হয়েছে যে, অর্জুন যখন বিশ্বরূপ দর্শন করেন, তখন অর্জুন ও শ্রীকৃষ্ণ উভয়েই রথের উপর উপবিষ্ট ছিলেন। সেই যুদ্ধক্ষেত্রে অন্য আর কেউ শ্রীকৃষ্ণের এই রূপ দর্শন করতে পারেননি, কারণ শ্রীকৃষ্ণ কেবল অর্জুনকেই দিব্যদৃষ্টি নান করেছিলেন। শ্রীকৃষ্ণের শরীরে অর্জুন হাজার হাজার গ্রহলোক দর্শন করলেন। বৈদিক শাস্ত্র থেকে আমরা জানতে পারি যে, অসংখ্য গ্রহ-নক্ষত্র সমন্বিত অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড রয়েছে। তাদের মধ্যে কোনটি মাটি দিয়ে তৈরি, কোনটি সোনা দিয়ে তৈরি, কোনটি মণি-মাণিক্য দিয়ে তৈরি, কোনটি বিশাল, কোনটি আবার তত বিশাল নয়। রখে বসে অর্জুন সমস্ত কিছুই দর্শন করলেন। কিন্তু অর্জুন ও শ্রীকৃষ্ণের মধ্যে তখন যে কি হচ্ছিল, তা কেউ বুঝতে পারেনি।