শ্লোকঃ ৭
ইহৈকস্থং জগৎ কৃৎস্নং পশ্যাদ্য সচরাচরম্ ।
মম দেহে গুড়াকেশ যচ্চান্যদ্ দ্রষ্টুমিচ্ছসি ॥ ৭॥
ইহ—এই; একস্সুম একত্রে অবস্থিত, জগৎ— বিশ্ব; কৃৎস্নম্ — সমগ্র; পশ্য—দেখ; অদ্য—এক্ষণে; স-সহ চর-জঙ্গম, অচরম্ স্থাবর; মম— আমার, দেহে- শরীরে; গুড়াকেশ—হে অর্জুন, যৎ – যা কিছু, চ-৩; অনাৎ- অন্য দ্রম- দেখতে ইচ্ছসি — ইচ্ছা কর।
গীতার গান
চরাচর বিশ্বরূপ আমার ভিতর।
দেখ আজ একস্থানে সব পরাপর ।।
গুড়াকেশ আমি কৃষ্ণ পরাৎপরতত্ত্ব ।
দেখ তুমি ভাল করি আমার মহত্ত্ব ।।
অনুবাদঃ হে অর্জুন ! আমার এই বিরাট শরীরে একত্রে অবস্থিত সমগ্র স্থাবর-জঙ্গমাত্মক বিশ্ব এবং অন্য যা কিছু দেখতে ইচ্ছা কর, তা এক্ষণে দর্শন কর।
তাৎপর্যঃ এক জায়গায় বসে সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড দর্শন করা কারও পক্ষে সম্ভব নয়। এমন কি সর্বশ্রেষ্ঠ উন্নত বৈজ্ঞানিকেরাও এই ব্রহ্মাণ্ডের অন্যান্য অংশে কোথায় কি হচ্ছে তা দেখতে পারেন না। কিন্তু অর্জুনের মতো ভক্ত বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের যে কোনও অংশে যা কিছু বিদ্যমান সবই দেখতে পান। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে সব কিছু যাতে দেখতে পারেন, সেই জন্য শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে শক্তি প্রদান করেছেন। এভাবেই শ্রীকৃষ্ণের কৃপার ফলে অর্জুন সব কিছু দেখতে সমর্থ হয়েছিলেন।
শ্লোকঃ ৮
ন তু মাং শক্যসে দ্রষ্টুমনেনৈব স্বচক্ষুষা ।
দিব্যং দদামি তে চক্ষুঃ পশ্য মে যোগমৈশ্বরম্ ॥ ৮ ॥
–না, ভূ– কিন্তু; মাস্—আমাকে; শকাসে— সক্ষম হবে; দ্রষ্টুম্— দেখতে অনেন—এই: এব—অবশ্যই, স্বচক্ষুয়া — তোমার নিজের চক্ষুর দ্বারা; দিব্যম্ — দিব্য ; দদামি—প্রদান করছি; তে – তোমাকে; চক্ষুঃ—চক্ষু, পশ্য – দেখ; মে— আমার যোগমৈশ্বরম্—অচিন্ত্য যোগশক্তি।
গীতার গান
তুমি শুদ্ধ ভক্ত মোর নহে প্রাকৃত দর্শন ।
অতএব দিব্যচক্ষু করি তোমারে অর্পণ ॥
দিব্যচক্ষু সোপাধিক কিন্তু স্থূল নহে ৷
অপরোক্ষ অনুভূতি সকলে সে কহে ॥
অনুবাদঃ কিন্তু তুমি তোমার বর্তমান চক্ষুর দ্বারা আমাকে দর্শন করতে সক্ষম হবে না। তাই, আমি তোমাকে দিব্যচক্ষু প্রদান করছি। তুমি আমার অচিন্ত্য যোগৈশ্বর্য দর্শন কর !
তাৎপর্যঃ শ্রীকৃষ্ণের দ্বিভুজ শ্যামসুন্দর রূপ ছাড়া আর অন্য কোন রাপ ভগবানের শুদ্ধ ভক্ত দর্শন করতে চান না। ভগবানের কৃপার প্রভাবেই তাঁর বিশ্বরূপ দর্শন করতে হয় এবং ভক্ত তাঁর মনের দ্বারা দর্শন করেন না, করেন দিব্য দৃষ্টির মাধ্যমে। ভগবানের বিশ্বরূপ দর্শন করার জন্য অর্জুনকে তাঁর মনোবৃত্তি পরিবর্তন করার কথা বলা হয়নি, তাঁর দৃষ্টির পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে। শ্রীকৃষ্ণের বিশ্বরূপ তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়; সেই কথা পরবর্তী শ্লোকে স্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হবে। তবুও অর্জুন যেহেতু তা দেখতে চেয়েছিলেন, তাই ভগবান তাঁর সেই রূপ দর্শনের জন্য যে দিব্য চক্ষুর প্রয়োজন, তা তাকে দান করেছিলেন।
যে সমস্ত ভগবদ্ভক্ত শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে অপ্রকৃত সম্পর্কে যুক্ত হয়েছেন, তাঁরা ভগবানের ঐশ্বর্যের দ্বারা আকৃষ্ট না হয়ে ভগবানের প্রেমময় মাধুর্য দ্বারা আকৃষ্ট হন। শ্রীকৃষ্ণের সমস্ত সখা, বান্ধবী, পিতা-মাতা, তাঁরা কেউই শ্রীকৃষ্ণকে তাঁর ঐশ্বর্য প্রদর্শন করতে বলেন না। তাঁরা শুদ্ধ ভগবৎ-প্রেমে এতই মগ্ন যে, শ্রীকৃষ্ণ যে পরম পুরুষোত্তম ভগবান, তাও তাঁরা জানেন না। মাধুর্যমণ্ডিত প্রেমের বিনিময়ের ফলে তাঁরা ভুলে যান যে, শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান। শ্রীমদ্ভাগবতে বর্ণনা করা হয়েছে যে, যে সমস্ত বালকেরা শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে খেলা করেন, তাঁরা সকলেই অত্যন্ত পুণ্যবান আত্মা এবং বহু জন্ম-জন্মান্তরের তপস্যার ফলে তাঁরা ভগবানের সঙ্গে খেলা করার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন। এই সমস্ত বালবো জানেন না যে, শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরম পুরুষোত্তম ভগবান। তাঁরা শ্রীকৃষ্ণকে তাদের খেলার সাথী এক অতি অন্তরঙ্গ বন্ধু বলে মনে করেন। তাই, শুকদের গোস্বামী এই শ্লোকটি বর্ণনা করেছেন—
ইত্থং সত্যং ব্রহ্মসুবানুভূত্যা
দাস্য গতানাং পবদৈবতেন ।
মায়াশ্রিতানাং নরদারকেণ
সাকং বিজহঃ কৃতপুণ্যপুঞ্জঃ।।
“ইনিই হচ্ছেন পরম পুরুষ, যাঁকে মহান মুনি-ঋষিরা নির্বিশেষ ব্রহ্মরূপে জানেন, ভগবানের ভক্তেরা ভগবানরূপে জানেন এবং সাধারণ মানুষেরা জড়া প্রকৃতির সৃষ্টি বলেই মনে করেন। এখন এই বালকেরা তাঁদের পূর্বজন্মে বহু পুণ্যকর্নের ফলে পরম পুরুষোত্তম ভগবানের সঙ্গে খেলা করছেন।” (শ্রীমদ্ভাগবত ১০/১২/১৬) আসল কথা হচ্ছে যে, ভক্ত কখনও ভগবানের বিশ্বরূপ দর্শন করবার আকাঙ্ক্ষা করেন না। কিন্তু অর্জুন ভগবানের সেই বিশ্বরূপ দর্শন করতে চেয়েছিলেন যাতে আগামী দিনের মানুষেরা বুঝতে পারে যে, শ্রীকৃষ্ণ কেবল তত্ত্ব কথার মাধ্যমে তাঁর পরম ভগবত্তা প্রতিপন্ন করেননি, তিনি অর্জুনকে তাঁর সেই রূপও দেখিয়েছিলেন, যাতে কারও মনে আর কোন সংশয় না থাকে। অর্জুনকে এই সত্য প্রতিপন্ন করতেই হবে, কারণ তিনি এখন পরম্পরার সূচনা করছেন। যাঁরা পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে জানবার জন্য ঐকান্তিকভাবে আগ্রহী এবং সেই জন্য যাঁরা অর্জুনের পদাঙ্ক অনুসরণ করছেন, তাঁদের জানা উচিত যে, শ্রীকৃষ্ণ কেবল তত্ত্বগতভাবে তাঁর পরমেশ্বরত্ব প্রমাণ করেননি, তিনি যে পরমেশ্বর তা তিনি বাস্তবিকই দেখিয়েছেন।
ভগবান তাঁর বিশ্বরূপ দর্শন করার শক্তি অর্জুনকে দান করেছিলেন। কারণ তিনি জানতেন, অর্জুন তাঁর সেই বিশ্বরূপ দর্শনে তেমন আগ্রহী ছিলেন না- সেই কথা পূর্বেই ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
শ্লোকঃ ৯
সঞ্জয় উবাচ
এবমুক্তা ততো রাজন্ মহাযোগেশ্বরো হরিঃ ।
দর্শয়ামাস পার্থায় পরমং রূপমৈশ্বরম্ ॥৯॥
সঞ্জয়ঃ উবাচ—সঞ্জয় বললেন, এবম্ এভাবে, উল্কা বলে, ততঃ——তারপর, রাজন—হে রাজন; মহাযোগেশ্বরঃ— মহান যোগেশ্বর, হরিঃ – পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, দর্শয়ামাস— দেখালেন, পার্থায়— অর্জনকে, পরমম্ – পরম রূপম্ ঐশ্বরম্—বিশ্বরূপ।
গীতার গান
সঞ্জয় কহিলেনঃ
অতঃপর শুন রাজা যোগেশ্বর হরি ।
পার্থকে ঐশ্বর্যরূপ দেখান শ্রীহরি ॥
অনুবাদঃ সঞ্জয় বললেন – হে রাজন ! এভাবেই বলে, মহান যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে তাঁর বিশ্বরূপ দেখালেন।