শ্লোকঃ ৪

মন্যসে যদি তচ্ছক্যং ময়া দ্রষ্টুমিতি প্রভো ৷

যোগেশ্বর ততো মে ত্বং দর্শয়াত্মানমব্যয়ম্ ॥ ৪॥

মন্যসে—মনে কর; যদি — যদি; তৎ―তা; শক্যম্—সমর্থ; ময়া— আমার দ্বারা; দ্রষ্টুম—দেখতে; ইতি—এভাবে; প্রভো – হে প্রভু, যোগেশ্বর – হে যোগেশ্বর; ততঃ—তারপর; মে—আমাকে ত্বম্—তুমি, দর্শয়— দেখাও, আত্মানম্ – তোমার স্বরূপ; অব্যয়ম্—নিত্য।

গীতার গান

অতএব তুমি যদি যোগ্য মনে কর ।

দেখিবারে বিশ্বরূপ তোমার বিস্তর ॥

যোগেশ্বর তাহা তুমি দেখাও আমারে ।

নিবেদন এই মোর কহিনু তোমারে ॥

অনুবাদঃ হে প্রভু ! তুমি যদি মনে কর যে, আমি তোমার এই বিশ্বরূপ দর্শন করার যোগ্য, তা হলে হে যোগেশ্বর। আমাকে তোমার সেই নিত্যস্বরূপ দেখাও।

তাৎপর্যঃ আমাদের জানা উচিত যে, জড় ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে দেখা যায় না, তাঁর কথা শোনা যায় না, তাঁকে জানা যায় না অথবা তাকে উপলব্ধি করা যায় না। কিন্তু প্রথম থেকেই প্রেমভক্তি সহকারে ভগবানের অপ্রাকৃত সেবায় নিয়োজিত হলে, তবেই ভগবানকে দর্শন করবার দিব্য দৃষ্টি আমরা লাভ করতে পারি। প্রতিটি জীবই হচ্ছে কেবলমাত্র চিন্ময় স্ফুলিঙ্গ; তাই তার পক্ষে পরমেশ্বর ভগবানকে দর্শন করা বা উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। অর্জুন ছিলেন ভগবদ্ভক্ত। তিনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পরমেশ্বরত্ব সম্বন্ধে সম্পূর্ণভাবে অবগত ছিলেন। তাই, তিনি ভগবানকে উপলব্ধি করার ব্যাপারে তাঁর কল্পনা শক্তির উপর নির্ভর না করে, ভগবানের কাছে জীবরূপে নিজের অক্ষমতা স্বীকার করেছেন। অর্জুন জানতেন যে, সীমিত জীবের পক্ষে অনন্ত-অসীম ভগবানকে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। অসীম যখন কৃপা করে নিজেকে প্রকাশ করেন, তখনই কেবল অসীমের বৈশিষ্ট্য উপলব্ধি করা যায়। যোগেশ্বর শব্দটিও এখানে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ ভগবান অচিন্ত্য শক্তির অধীশ্বর। যদিও তিনি অসীম-অনন্ত, তবুও তাঁর অহেতুকী কৃপার প্রভাবে তিনি নিজেকে প্রকাশ করতে পারেন। তাই, অর্জুন এখানে ভগবানের অহৈতুকী কৃপা প্রার্থনা করছেন। তিনি শ্রীকৃষ্ণকে আদেশ দিচ্ছেন না। অনন্য ভক্তি সহকারে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেবা করার মাধ্যমে নিজেকে সর্বতোভাবে শ্রীকৃষ্ণের চরণে সমর্পণ না করলে শ্রীকৃষ্ণ কখনই নিজেকে প্রকাশ করেন না। এভাবেই যাঁরা নিজেদের মানসিক চিন্তাশক্তির উপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে আছেন, তাঁদের পক্ষে শ্রীকৃষ্ণকে দর্শন করা কখনই সম্ভব নয়।

শ্লোকঃ ৫

পশ্য মে পার্থ রূপাণি শতশোহথ সহস্রশঃ ।

নানাবিধানি দিব্যানি নানাবর্ণাকৃতীনি চ ॥ ৫ ৷।

শ্রীভগবান্ উবাচ—পরমেশ্বর ভগবান বললেন; পশ্য—দেখ, মে–আমার, পার্থ— হে পৃথাপুত্র; রূপাণি—রূপসকল, শতশঃ—শত শত, অথ—ও: সহস্রশঃ—সহস্র সহস্র; নানাবিধানি—নানাবিধ দিব্যানি – দিব্য; নানা – বিভিন্ন; বর্ণ – বর্ণ; আকৃতীনি—আকৃতি, চ–ও |

গীতার গান

শ্রীভগবান কহিলেনঃ

হে পার্থ আমার রূপ সহস্র সে শত।

এই দেখ নানাবিধ দিব্য ভাল মত ৷ ।

অনেক আকৃতি বর্ণ করহ প্রত্যক্ষ।

সকল আমার সেই হয় যোগৈশ্বর্য ।।

অনুবাদঃ শ্রীভগবান বললেন—হে পার্থ ! নানা বর্ণ ও নানা আকৃতি-বিশিষ্ট শত শত ও সহস্র সহস্র আমার বিভিন্ন দিব্য রূপসমূহ দর্শন কর।

তাৎপর্যঃ অর্জুন শ্রীকৃষ্ণের বিশ্বরূপ দর্শন করতে চেয়েছিলেন। ভগবানের এই রূপ যদিও দিব্য, তবুও তাঁর প্রকাশ হয় এই জড় জগতের পরিপ্রেক্ষিতে এবং তাই তা এই জড় জগতের কালের উপর নির্ভরশীল। জড়া প্রকৃতির যেমন প্রকট হয় এবং অপ্রকট হয়, তেমনই শ্রীকৃষ্ণের এই বিশ্বরূপেরও প্রকট হয় এবং অপ্রকট হয়। শ্রীকৃষ্ণের অন্যান্য প্রকাশের মতো তাঁর এই রূপ পরা প্রকৃতিতে নিত্য বিরাজমান নয়। ভগবানের ভক্তেরা বিশ্বরূপ দর্শনে উৎসাহী নন। কিন্তু অর্জুন যেহেতু শ্রীকৃষ্ণকে এই রূপে দেখতে চেয়েছিলেন, তাই শ্রীকৃষ্ণ সেই রূপে নিজেকে প্রকাশিত করেন। কোন সাধারণ মানুষের পক্ষে ভগবানের বিশ্বরূপ দর্শন করা সম্ভব নয়। শ্রীকৃষ্ণ যখন এই বিশ্বরূপ দর্শন করবার শক্তি দেন, তখনই কেবল তার এই রূপ দর্শন করা যায়।

শ্লোকঃ ৬

পশ্যাদিত্যান্ বসূন্ রুদ্রানশ্বিনৌ মরুতস্তথা ৷

বহুন্যদৃষ্টপূর্বাণি পশ্যাশ্চর্যাণি ভারত ৷। ৬ ৷।

পশ্য— দেখ; আদিত্যান্—অদিতির দ্বাদশ পুত্র, বসুন্—ডাষ্টবসু, রুদ্রান্—একাদশ রুদ্র; অশ্বিনৌ—অশ্বিনীকুমারদ্বয়; মরুতঃ – ঊনপঞ্চাশ মরুত (বায়ুর দেবতা); তথা—এবং, বহুনি—বহু, অদৃষ্ট—যা তুমি দেখনি, পূর্বাণি – পূর্বে, পশ্য – দেখ আশ্চর্যাণি—আশ্চর্য; ভারত— হে ভারতশ্রেষ্ঠ।

গীতার গান

আদিত্যাদি বসু রুদ্র অশ্বিনী মরুত ৷

অদৃষ্ট অপূর্ব সব আশ্চর্য ভারত ॥

অনুবাদঃ হে ভারত ! দ্বাদশ আদিত্য, অষ্টবসু, একাদশ রুদ্র, অশ্বিনীকুমারদ্বয়, ঊনপঞ্চাশ মরুত এবং অনেক অদৃষ্টপূর্ব আশ্চর্য রূপ দেখ।

তাৎপর্যঃ এমন কি যদিও অর্জুন ছিলেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অন্তরঙ্গ বন্ধু এবং বিশেষ জ্ঞানী পুরুষ, তবুও তাঁর পক্ষে শ্রীকৃষ্ণ সম্বন্ধে সব কিছু জানা সম্ভব ছিল না। এখানে বলা হয়েছে যে, মানুষেরা ভগবানের এই রূপ এবং প্রকাশ সম্বন্ধে আগে কখনও শোনেনি অথবা জানেনি। এখন শ্রীকৃষ্ণ তাঁর সেই বিস্ময়কর রূপসমূহ প্রকাশ করেছেন।

error: Content is protected !!