শ্লোকঃ ৫২
শ্রীভগবানুবাচ
সুদুর্দর্শমিদং রূপং দৃষ্টবানসি যন্মম
দেবা অপ্যস্য রূপস্য নিত্যং দৰ্শনকাঙ্ক্ষিণঃ ॥ ৫॥
শ্রীভগবান্ উবাচ – পরমেশ্বর ভগবান বললেন, সুদুর্দশ—অতি দুর্লভ দর্শন, ই এই; রূপম্—রূপ; দৃষ্টবান্ অসি দেখলে; যৎ- যে; মম – আমার, দেবাঃ- দেবতারা; অপি—ও; অস্য – এই; রূপস্য রূপের; নিত্যম—সর্বদা দর্শনকা —দর্শনাকাঙ্ক্ষী।
গীতার গান
শ্রীভগবান কহিলেনঃ
আমার দ্বিভুজ রূপ দুর্লভ দর্শন ৷
তুমি যা হেরিছ আজ হয়ে একমন |
ব্ৰহ্মা শিব আদি দেব সে আকাঙ্ক্ষা করে ।
শুদ্ধ ভক্ত হয় যারা বুঝিবারে পারে ॥
অনুবাদঃ পরমেশ্বর ভগবান বললেন— তুমি আমার যে রূপ এখন দেখছ তা অত্যন্ত দুর্ল দর্শন। দেবতারাও এই রূপের সর্বদা দর্শনাকাঙ্ক্ষী।
তাৎপর্যঃ এই অধ্যায়ের অষ্টচত্বারিংশতি শ্লোকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর বিশ্বরূপ প্রকাশ করে উপসংহারে অর্জুনকে বললেন যে, তাঁর সেই রূপ বহু পুণ্যকর্ম, বেদ অধ্যয়ন, তা কিংবা দানের মাধ্যমে দর্শন করা সম্ভব নয়। এখানে সুদুর্দশম কথাটির মাধ্যমে বুঝানো হচ্ছে যে, শ্রীকৃষ্ণের দ্বিভুজ রূপটি আরও গোপনীয়। বেদ অধ্যয়ন, আন, তপশ্চর্যা আদি বিবিধ ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে একটু ভক্তিযোগ মিশিয়ে নিলে ে বিশ্বরূপ দর্শন করা যেতে পারে। তা সম্ভব হলেও হতে পারে, কিন্তু ভক্তির সংযোগ না থাকলে তা কোন মতেই সম্ভব নয়। সেই কথা আগেই ব্যাখ্যা করা হয়েছে। কিন্তু এই বিশ্বরূপের ঊর্ধ্বে শ্রীকৃষ্ণের যে দ্বিভুজ শ্যামসুন্দর রূপ তা দর্শন করা ব্রহ্মা, শিব আদি দেবতাদের পক্ষেও দুর্লভ। তাঁরাও তাঁকে দর্শন করতে চান এবং শ্রীমদ্ভাগবতে বর্ণনা করা হয়েছে যে, তিনি যখন তাঁর মাতা দেবকীর গর্ভে অবস্থান-লীলা করছিলেন, তখন তাঁর বিস্ময়কর লীলা দর্শন করবার জন্য স্বর্গের সমস্ত দেব-দেবীরা এসে উপস্থিত হয়েছিলেন এবং তাঁরা ভগবানের উদ্দেশ্যে মনোরম স্তবস্তুতি নিবেদন করছিলেন, যদিও তিনি তখনও তাদের সম্মুখে দৃশ্যমান হননি। এমন কি তাঁর দর্শন লাভ করার জন্য তাঁরা প্রতীক্ষা করেছিলেন। মূর্খ লোকেরা তাঁকে সাধারণ মানুষ মনে করে অবজ্ঞা করতে পারে এবং শ্রীকৃষ্ণকে বাদ দিয়ে তার অন্তরস্থিত নির্বিশেষ কোনও কিছু কাল্পনিক সত্তাকে শ্রদ্ধা জানাতে পারে, কিন্তু সেই সবই নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক। ব্রহ্মা, শিব আদি মহান দেবতারাও শ্রীকৃষ্ণের দ্বিভুজ শ্যামসুন্দর রূপ দর্শন করবার জন্য আকুল হয়ে আছেন।
ভগবদ্গীতাতে (৯/১১) এই কথাও প্রতিপন্ন হয়েছে, অবজানতি মাং মূঢ়া মানুষী। অনুমাশ্রিতম্—যারা তাঁকে অবজ্ঞা করে, সেই সমস্ত মূঢ় ব্যক্তির কাছে তিনি দৃষ্টিগোচর হন না। শ্রীকৃষ্ণের দেহ সম্পূর্ণরূপে চিন্নয়, আনন্দমর ও নিত্য এবং সেই কথা ব্রহ্মসংহিতাতে প্রতিপন্ন হয়েছে এবং ভগবদ্গীতাতে শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং প্রতিপন্ন করেছেন, তাঁর দেহ কখনই জড় দেহের মতো নয়। কিন্তু যারা ভগবদ্গীতা অথবা অনুরূপ বৈদিক শাস্ত্র পাঠ করে বুদ্ধির মাধ্যমে শ্রীকৃষ্ণকে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করে, তাদের কাছে শ্রীকৃষ্ণ একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। কারণ, তারা যখন জড় দৃষ্টিভঙ্গির পরিপ্রেক্ষিতে শ্রীকৃষ্ণকে দর্শন করতে চেষ্টা করে, তখন তাদের কাছে শ্রীকৃষ্ণ একজন বিখ্যাত ঐতিহাসিক পুরুষ এবং মস্ত বড় দার্শনিক পণ্ডিতরূপে প্রতীত হয়। কিন্তু তিনি কোন সাধারণ মানুষ নন। তবুও কিছু মানুষ মনে করে যে, যদিও তিনি অত্যন্ত শক্তিশালী পুরুষ ছিলেন, তবুও তাঁকে জড় দেহ ধারণ করতে হয়েছিল। পরিণামে তারা মনে করে যে, পরমতত্ত্ব হচ্ছেন নির্বিশেষ, নিরাকার। তাই তারা মনে করে যে, সেই নিরাকার রূপ থেকে এই জড় জগতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি সবিশেষ রূপ তাঁকে গ্রহণ করতে হয়েছিল। পরমেশ্বর ভগবান সম্বন্ধে এটি একটি জড়-জাগতিক বিচার-বিবেচনা। আর একটি বিচার-বিবেচনা হচ্ছে কল্পনাপ্রসূত। যারা ভবনের অন্বেষণ করছে, তারাও শ্রীকৃষ্ণ সম্বন্ধে নানা রকম কল্পনা করে এবং তারা শ্রীকৃষ্ণকে তাঁর বিশ্বরূপের থেকেও কম গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে। এভাবেই অনেকে মনে করে, অর্জুনকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যে বিশ্বরূপ দেখিয়েছিলেন, তা তাঁর স্বরূপ থেকেও অধিক গুরুত্বপূর্ণ। তাদের মতে, পরমেশ্বরের সাকার রূপ কল্পনা মাত্র। তারা বিশ্বাস করে যে, চরম স্তরে পরমতত্ত্ব কোন পুরুষ নন। কিন্তু ভগবদ্গীতার চতুর্থ অধ্যায়ে অপ্রাকৃত তত্ত্ব লাভের পন্থা যথার্থ তত্ত্বজ্ঞানীর কাছে কৃষ্ণ সম্বন্ধে শ্রবণ করাকেই বলে বর্ণনা করা হয়েছে। সেটিই হচ্ছে যথার্থ বৈদিক পন্থা এবং যাঁরা যথাযথভাবে সেই বৈদিক ধারার অনুসরণ করেছেন, তাঁরা ভগবৎ-তত্ত্বজ্ঞানীর কাছে কৃষ্ণ সম্বন্ধে শ্রবণ করেন এবং বারবার তাঁর কথা শুনতে শুনতে তাঁদের চিত্তে শ্রীকৃষ্ণের প্রতি আসক্তি জন্মায়। আমরা পূর্বে কয়েকবার আলোচনা করেছি যে, শ্রীকৃষ্ণ তাঁর যোগমায়া শক্তির দ্বারা আবৃত থাকেন। তিনি যার-তার কাছে নিজেকে প্রকাশ করেন না। যার কাছে তিনি নিজেকে প্রকাশ করেন, তিনিই কেবল তাঁকে দেখতে পান। বৈদিক শাস্ত্রে সেই কথা প্রতিপন্ন করা হয়েছে। যিনি নিজেকে সর্বতোভাবে ভগবানের চরণে সমর্পণ করেছেন, তিনিই প্রকৃতপক্ষে পরমতত্ত্বকে উপলব্ধি করতে পারেন। নিরন্তর শ্রীকৃষ্ণ-চিন্তায় মগ্ন থেকে এবং ভক্তিযোগে কৃষ্ণসেবা করার ফলে সাধকের দিব্যচক্ষু উন্মীলিত হয় এবং তিনি তখন শ্রীকৃষ্ণকে দর্শন করতে পারেন। এই ধরনের দিব্য দর্শন স্বর্গের দেব-দেবীদের পক্ষেও সচরাচর সম্ভব হয় না। তাই, কৃষ্ণতর উপলব্ধি করা এমন কি দেব- ব-দেবীদের পক্ষেও দুষ্কর এবং উন্নত স্তরের দেবতারা শ্রীকৃষ্ণের দ্বিভুজ রূপ দর্শন করবার জন্য সর্বদাই উৎসুক হয়ে থাকেন। এর সিদ্ধান্ত হচ্ছে যে, শ্রীকৃষ্ণের বিশ্বরূপ দর্শন করা খুবই দুস্কর এবং সাধারণ মানুষের পক্ষে অসম্ভব, কিন্তু তাঁর শ্যামসুন্দর রূপ দর্শন করা তাঁর থেকে অনেক অনেক বেশি দুষ্কর।
শ্লোকঃ ৫৩
নাহং বেদৈর্ন তপসা ন দানেন ন চেজ্যয়া ।
শক্য এবংবিধো দ্রষ্টুং দৃষ্টবানসি মাং যথা ॥ ৫৩ ॥
ন—না, অহম্ — আমি: বেদৈঃ- বেদ অধ্যয়নের দ্বারা ননা, তপসা – তপসারে দ্বারা; ন-না; দানেন—পানের দ্বারা; ন না; চ—ও; ইজায়া পূজার দ্বারা শক্যঃ -সমর্থ হয়, এবংবিধঃ – এই প্রকার, দ্রষ্টুম্—দর্শন করতে, দৃষ্টবান—দেখছ, অসি — তুমি; মাম্——আমার; যথা—যেরূপ।
গীতার গান
বেদ নিষ্ঠা জপ তপ কিংবা দান পুণ্য ৷
পূজাপাঠ যত কিছু ধর্মপথ অন্য ৷৷
কোনটাই নহে যোগ্য এ রূপ দেখিতে ৷
যদ্যপি সে অবতীর্ণ আমি পৃথিবীতে ৷৷
অনুবাদঃ তুমি তোমার দিব্য চক্ষুর দ্বারা আমার যেরূপ দর্শন করছ, সেই প্রকার আমাকে বেদ অধ্যয়ন, তপস্যা, দান ও পূজার দ্বারা কেউই দর্শন করতে সমর্থ হয় না।
তাৎপর্যঃ শ্রীকৃষ্ণ প্রথমে তাঁর মাতা দেবকী ও পিতা বসুদেবের সামনে চতুর্ভুজ রূপ নিয়ে আবির্ভূত হন এবং তার পরে তিনি তাঁর দ্বিভুজ রূপে রূপান্তরিত হন। যারা ভগবৎ- বিদ্বেষী নাস্তিক অথবা ভক্তিবিহীন, তাদের পক্ষে এই রহস্যের মর্ম উপলব্ধি করা অতন্ত দুঘর। যে সমস্ত পণ্ডিতেরা ব্যাকরণের জ্ঞানের দ্বারা অথবা পুঁথিগত বিদ্যার দ্বারা বৈদিক শাস্ত্র পাঠ করেছেন, তাঁদের পক্ষে শ্রীকৃষ্ণকে জানা অত্যন্ত দুষ্কর। এমন কি যাঁরা কেবল নামে মাত্র মন্দিরে গিয়ে পূজা অর্চনা করেন, তাঁদের পক্ষেও ভগবানকে জানা সম্ভব নয়। তাঁরা কেবল মন্দিরেই যান, কিন্তু তাঁরা শ্রীকৃষ্ণকে তাঁর স্বরূপে জানতে পারেন না। কেবল মাত্র ভক্তিযোগের মাধ্যমেই শ্রীকৃষ্ণকে জানতে পারা যায়। সেই কথা শ্রীকৃষ্ণ নিজেই পরবর্তী শ্লোকে ব্যাখ্যা করেছেন।
শ্লোকঃ ৫৪
ভক্ত্যা ত্বনন্যয়া শক্য অহমেবংবিধোহর্জুন ।
জ্ঞাতুং দ্রষ্টুং চ তত্ত্বেন প্রবেষ্টুং চ পরন্তপ ।। ৫৪ ৷।
ভক্ত্যা—ভুক্তির দ্বারা; ভু—কিন্তু; অনন্যয়া—কর্ম ও জ্ঞানের আবরণ থেকে মুক্ত; শকাঃ—সমর্থ; অহম্—আমি; এবং বিধঃ— এই প্রকার; অর্জুন – হে অর্জুন, ভ্রাতুম্—জানতে, প্রষ্টুম্—দেখতে; চ—ও; তত্ত্বেন—তত্ত্বত; প্রবেষ্টুন — প্রবেশ করতে; চও, পরস্তুপ—হে পরন্তপ।
গীতার গান
অনন্য ভক্তি যে হয় একমাত্র কাম ।
হে অর্জুন দেখিবারে যোগ্য মোর ধাম।।
সেই সে বুঝিতে পারে তত্ত্বে দেখিবারে ।
নিত্য লীলাতে মোর সে প্রবেশ করে।।
অনুবাদঃ হে অর্জুন ! হে পরন্তপ ! অনন্য ভক্তির দ্বারাই কিন্তু এই প্রকার আমাকে তত্ত্বত জানতে প্রত্যক্ষ করতে এবং আমার চিন্ময় ধামে প্রবেশ করতে সমর্থ হয়।
তাৎপর্যঃ অনন্য ভক্তির মাধ্যমেই কেবল ঐকৃষ্ণকে জানতে পারা যায়। এই শ্লোকে ভগবান নিজেই স্পষ্টভাবে সেই কথার বিশ্লেষণ করেছেন, যাতে তত্ত্বজ্ঞান-বর্জিত ভাষ্যকারেরা, যারা মনোধর্ম-প্রসূত জল্পনা-কল্পনার মাধ্যমে ভগবদ্গীতার তত্ত্ব জানবার চেষ্টা করেন, তাঁরা বুঝতে পারেন যে, ভগবদ্গীতার ভ্রান্ত ব্যাখ্যা করে তাঁরা কেবল তাঁদের সময়েরই অপচয় করছেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যে কে, তা কেউই জানতে পারে না। কেউই বুঝতে পারে না কিভাবে তিনি তাঁর চতুর্ভূজা রূপ নিয়ে তাঁর জনক-জননীর সামনে আবির্ভূত হলেন এবং তার পরেই তাঁর ত্রিভুজ রূপে রূপান্তরিত হলেন। বেদ অধ্যয়ন করে কিংবা দার্শনিক জল্পনা-কল্পনা করে এই সব ব্যাপার বুঝতে পারা খুবই কঠিন। এখানে তাই স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, কেউই তাঁকে দেখতে পায় না কিংবা এই সব তত্ত্ব-উপলব্ধিতে প্রবেশ করতে পারে না। কিন্তু যারা বৈদিক শাস্ত্রের অভিজ্ঞ ছাত্র, তাঁরাই কেবল বৈদিক শাস্ত্রের মাধ্যমে নানাভাবে তাঁকে জানতে পারেন। বৈদিক শাস্ত্রে নানা রকম বিধি-নিষেধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং যদি কেউ শ্রীকৃষ্ণকে জানতে চায়, তা হলে তাকে শাস্ত্রের এই সমস্ত নির্দেশগুলি মানতে হবে। শাস্ত্রের নির্দেশ অনুসারে কৃচ্ছ্রসাধন করা যায়। দৃষ্টান্তস্বরূপ, কঠোর কৃচ্ছ্রসাধন করতে হলে আমরা শ্রীকৃষ্ণের জন্মদিন উপলক্ষ্যে জন্মাষ্টমীতে এবং প্রতি মাসে দুটি একাদশীতে উপবাস ব্রত পালন করতে পারি। দান সম্বন্ধে বলা হয়েছে যে, দান তাঁদেরকেই করতে হবে, যাঁরা সারা বিশ্ব জুড়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মহিমা প্রচারে রত। কৃষ্ণভাবনামৃত হচ্ছে মানব-সমাজের প্রতি ভগবানের আশীর্বাদ। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুকে শ্রীল রূপ গোস্বামীপাদ মহাবদান্য অবতার বলে সম্ভাষণ করেছেন, কারণ ব্রহ্মার দুর্লভ যে কৃষ্ণপ্রেম তা তিনি অকাতরে সকলকে বিতরণ করেছেন। সুতরাং, কেউ যদি তাঁর রোজগারের কিছু অংশ শ্রীকৃষ্ণের বাণী প্রচারে রত ভক্তদের দান করেন এবং সেই দান যদি কৃষ্ণভাবনামৃত বিস্তারের জন্য নিয়োজিত হয়, তবে সেটি হবে পৃথিবীর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ দান। আর কেউ যদি মন্দিরের বিধিবিধান অনুযায়ী আরাধনা করেন (ভারতবর্ষের মন্দিরগুলিতে সাধারণত শ্রীবিষ্ণুর বা শ্রীকৃষ্ণের বিগ্রহ বিরাজ করেন, তা হলে পরমেশ্বর ভগবানকে পূজা ও সম্মান নিবেদন করার দ্বারা উন্নতি সাধনের এটি একটি বিরাট সুযোগ। কনিষ্ঠ অধিকারী অর্থাৎ ভক্তিমার্গে যারা নবীন, তাদের পক্ষে মন্দিরে ভগবানের শ্রীবিগ্রহের পূজা অর্চন করা আবশ্যক। বৈদিক শাস্ত্রে (শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ ৬/২৩) সেই কথা প্রতিপন্ন হয়েছে-
যস্য দেবে পরা ভক্তির্যথা দেবে তথ্য গুরৌ ।
তস্যৈতে কথিতা হার্থাঃ প্রকাশন্তে মহাত্মনঃ ।।
ভগবানের প্রতি যিনি অপ্রতিহতা ভক্তিসম্পন্ন এবং ভগবানের প্রতি যেই রকম গুরুদেবের প্রতিও সেই রকম ভক্তিসম্পন্ন, তিনি পরম পুরুষোত্তম ভগবানকে দর্শন করতে পারেন। কেবল মাত্র মানসিক জল্পনা-কল্পনার মাধ্যমে শ্রীকৃষ্ণকে বুঝা যায় না। যে সদ্গুরুর তত্ত্বাবধানে ভগবদ্ভক্তির শিক্ষা লাভ করেনি, তার পক্ষে শ্রীকৃষ্ণ সম্বন্ধে জানা অসম্ভব। এখানে তু শব্দটি বিশেষভাবে ব্যবহার করে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, শ্রীকৃষ্ণকে উপলব্ধি করার ক্ষেত্রে অন্য কোনও পন্থা ব্যবহার করা যাবে না, অনুমোদন করতে পারা যাবে না, কিংবা সফল হবে না।
শ্রীকৃষ্ণের সবিশেষ ত্রিভুজ ও চতুর্ভূজ রূপ অৰ্জ্জুনকে প্রদর্শিত বিশ্বরূপ থেকে সম্পূর্ণরূপে ভিন্ন। চতুর্ভুজধারী নারায়ণ রূপ এবং দ্বিভুজধারী শ্রীকৃষ্ণরূপ হচ্ছেন নিত্য ও অপ্রাকৃত, কিন্তু অর্জুনকে যে বিশ্বরূপ দেখানো হয়েছিল তা হচ্ছে অনিতা। সুদুদর্শম্ শব্দটির অর্থ ‘দর্শন করা অত্যন্ত দুষ্কর। অর্থাৎ তাঁর সেই বিশ্বরূপ কেউই দর্শন করেননি। ভগবান এখানে এটিও বুঝিয়ে দিচ্ছেন যে, তাঁর ভক্তকে তাঁর সেই রূপ দেখাবার কোন প্রয়োজনও হয় না। অর্জুনের অনুরোধে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সেই রূপ দেখিয়েছিলেন, যাতে ভবিষ্যতে কেউ যদি ভগবানের অবতার বলে নিজেকে প্রতিপন্ন করতে চান, তা হলে তিনি সত্যি সত্যি ভগবানের অবতার কি না তা জানবার জন্য মানুষ তাঁকে তাঁর বিশ্বরূপ দেখানোর কথা বলতে পারে। পূর্ববর্তী শ্লোকটিতে ন শব্দটি বারে বারে ব্যবহার করা হয়েছে যাতে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, বৈদিক শাস্ত্রে পুঁথিগত শিক্ষা লাভের প্রশংসা অর্জনের প্রতি বেশি গর্বিত হওয়া কারও পক্ষে উচিত নয়। শ্রীকৃষ্ণের প্রতি প্রেমভক্তি অনুশীলনেই নির্দিষ্ট থাকা প্রয়োজন। কেবল মাত্র তবেই ভগবদ্গীতার ভাষ্য রচনায় প্রচেষ্টা করা যেতে পারে ।
শ্রীকৃষ্ণ তাঁর বিশ্বরূপ থেকে চতুর্ভুজ নারায়ণ রূপে রূপান্তরিত হলেন এবং তার পরে তাঁর প্রকৃত স্বরূপ বিভুজ শ্যামসুন্দরে রূপান্তরিত হলেন। এর থেকে বুঝা যায় যে, বৈদিক শাস্ত্রে তাঁর যে চতুর্ভুজ এবং অন্যান্য রূপের কথা বর্ণনা করা হয়েছে, তা সবই শ্রীকৃষ্ণের দ্বিভুজা রূপ থেকে প্রকাশিত হয়েছেন। দ্বিভুজ শ্যামসুন্দর মুরলীধর শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন সব কিছুর উৎস। নির্বিশেষ ব্রহ্মের কথা তো দূরে থাক, তাঁর এই সমস্ত রূপ থেকেও শ্রীকৃষ্ণ স্বতন্ত্র। শ্রীকৃষ্ণের চতুর্ভুজ রূপ সম্বন্ধে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, তাঁর অভিন্ন চতুর্ভুজ প্রকাশ (যাকে মহাবিষ্ণু নামে সম্বোধন করা হয়, যিনি কারণ সমুদ্রে শয়ন করে আছেন এবং যাঁর শাস প্রশ্বাসের ফলে অগণিত ব্রহ্মাণ্ডের প্রকাশ হচ্ছে এবং লয় হচ্ছে), তিনিও পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অংশ-প্রকাশ। তাই ব্রহ্মসংহিতায় (৫/৪৮) বলা হয়েছে–
যস্যৈকনিশ্বসিতকালমথাবলম্ব্য
জীবন্তি লোমবিলোজা জগদগুনাথাঃ ।
বিষ্ণুমর্হাণ স ইহ যস্য কলাবিশেষো
গোবিন্দমাদিপুরুষং তমহং ভজামি ।।
“মহাবিষ্ণু, যার মধ্যে অসংখ্য ব্রহ্মাণ্ড প্রবেশ করছে এবং কেবল মাত্র যাঁর শ্বাস- প্রশ্বাসের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সেগুলি আবার তাঁর মধ্য থেকে প্রকাশিত হচ্ছে, তিনিও হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণের অংশ প্রকাশ।” তাই পরম পুরুষোত্তম ভগবানের সবিশেষ রূপ শ্যামসুন্দর শ্রীকৃষ্ণই হাচ্ছেন পরম আরাধ্য এবং তিনি হচ্ছেন সৎ, চিৎ ও আনন্দময়। তিনিই হচ্ছেন শ্রীবিষ্ণুর সমস্ত রূপের উৎস, তিনি হচ্ছেন সমস্ত অবতারের রূপের উৎস এবং তিনি হচ্ছেন আদিপুরুষ। সেই তত্ত্ব ভগবদ্গীতায় সর্বতোভাবে প্রতিপন্ন হয়েছে।
বৈদিক শাস্ত্রে (গোপালতাপনী উপনিষদ ১/১) উল্লেখ আছে—
সচ্চিদানন্দরূপায় কৃষ্ণয়াক্লিষ্টকারিণে ।
নমো বেদান্তবেদ্যায় গুরবে বুদ্ধিসাক্ষিণে ।।
“আমি শ্রীকৃষ্ণের প্রতি আমার সশ্রদ্ধ প্রণতি জ্ঞাপন করছি, যাঁর অপ্রাকৃত রূপ হচ্ছে সৎ, চিৎ ও আনন্দময়। আমি তাঁকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি, কারণ তাঁকে জানার অর্থ সমগ্র বেদকে জানা এবং সেই কারণেই তিনি হচ্ছেন পরম গুরু।” তার পরে বলা হয়েছে, কৃষ্ণো বৈ পরমং দৈবতম্ — “শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরম পুরুষোত্তম ভগবান।” (গোপালতাপনী ১/৩) একো বশী সর্বগঃ কৃষ্ণ ডাঃ –“সেই একমাত্র শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন পরম পুরুষোত্তম ভগবান এবং তিনিই আরাধ্য।” একোঽপি সন্ বহুবা যোহবভাতি—“শ্রীকৃষ্ণ এক, কিন্তু তিনি অনন্ত রূপ ও অবতারের মাধ্যমে প্রকাশিত হন।” (গোপালতাপনী ১/২১) ব্রহ্মসংহিতায় (৫/১) বলা হয়েছে—
ঈশ্বরঃ পরমঃ কৃষ্ণঃ সচ্চিদানন্দবিগ্রহঃ ।
অনাদিরাদির্গোবিন্দঃ সর্বকারণকারণম্ ॥
“পরম পুরুষোত্তম ভগবান হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণ এবং তাঁর নিত্য, জ্ঞানময় ও আনন্দময় একটি শরীর আছে। তাঁর কোনও আদি নেই, কেন না তিনি সব কিছুরই উৎস। তিনি হচ্ছেন সকল কারণের কারণ।”
অন্যত্র বলা হয়েছে, যত্রাবতীর্ণং কৃষ্ণাখাং পরং ব্রহ্ম নরাকৃতি – “সেই পরমতত্ত্ব হচ্ছেন সবিশেষ পুরুষ, তাঁর নাম শ্রীকৃষ্ণ এবং তিনি কখনও কখনও এই জগতে অবতরণ করেন।” তেমনই, শ্রীমদ্ভাগবতে পরম পুরুষোত্তম ভগবানের সমস্ত অবতারের বর্ণনা করা হয়েছে এবং সেই তালিকায় শ্রীকৃষ্ণের নামও আছে। কিন্তু তারপর সেখানে বলা হয়েছে যে, এই শ্রীকৃষ্ণ ভগবানের অবতার নন, তিনি হচ্ছেন স্বয়ং পরম পুরুষোত্তম ভগবান ( এতে চাংশকলাঃ পুংসঃ কৃষ্ণস্তু ভগবান্ ) । তেমনই, ভগবদ্গীতায় ভগবান বলছেন, মত্তঃ পরতরং নানাৎ – “আমার পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণ রূপের থেকে উত্তম আর কিছুই নেই।” ভগবদ্গীতায় তিনি আরও বলেছেন, অহমাদিহি দেবানাম্ – “সমস্ত দেবতাদের আদি উৎস হচ্ছি আমি।” ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কাছ থেকে ভগবৎ-তত্ত্ব অবগত হওয়ার ফলে অর্জুনও, সেই সম্বন্ধে বলছেন, পরং ব্রহ্ম পরং ধাম পবিত্রং পরমং ভবান— “এখন আমি সম্পূর্ণভাবে বুঝতে পেরেছি যে, তুমি হচ্ছ পরম পুরুষোত্তম ভগবান, পরমতত্ত্ব এবং তুমি হচ্ছ সকলের পরম আশ্রয়।” তাই শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে যে বিশ্বরূপ দেখিয়েছিলেন, তা ভগবানের আদি স্বরূপ নয়। তাঁর আদি স্বরূপে তিনি হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণ। সহস্ৰ সহস্ৰ হস্ত ও পদবিশিষ্ট তাঁর যে বিশ্বরূপ, তা কেবল তাদেরকেই আকৃষ্ট করবার জন্য যাদের ভগবানের প্রতি প্রেমভক্তি নেই। এটি ভগবানের আদি স্বরূপ নয়।
যাঁরা ভগবানের শুদ্ধ ভক্ত, যাঁরা ভগবানের সঙ্গে অপ্রাকৃত রসে প্রেমভক্তিতে যুক্ত, বিশ্বরূপ তাঁদের আকৃষ্ট করে না। শ্রীকৃষ্ণ-স্বরূপে ভগবান তাঁর ভক্তদের সঙ্গে অপ্রাকৃত প্রেম বিনিময় করেন। তাই অর্জুন, যিনি সখ্যরসে শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে অত্যন্ত অন্তরঙ্গভাবে যুক্ত ছিলেন, তাঁর কাছে এই বিশ্বরূপের প্রকাশ মোটেই আনন্দদায়ক ছিল না। বরং, তা ভয়ংকর হয়ে উঠেছিল। অর্জুন, যিনি হচ্ছেন ভগবানের নিত্য সহচর, অবশ্যই দিব্য দৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন। তিনি কোন সাধারণ মানুষ ছিলেন না। তাই, তিনি বিশ্বরূপের দ্বারা আকৃষ্ট হননি। যারা সকাম কর্মের দ্বারা নিজেদের উন্নীত করতে চান, তাদের কাছে এই রূপ অতি আশ্চর্যজনক বলে মনে হতে পারে, কিন্তু যাঁরা ভক্তিযোগে ভগবানের সেবায় রত, তাদের কাছে শ্রীকৃষ্ণের দ্বিভুজ রূপই হচ্ছে সবচেয়ে প্রিয়।