শ্লোকঃ ৪৯

মা তে ব্যথা মা চ বিমূঢ়ভাবো

দৃষ্টাং রূপং ঘোরমীদৃঙ মমেদম্ ।

ব্যপেতভীঃ প্রীতমনাঃ পুনস্ত্বং

তদেব মে রূপমিদং প্রপশ্য ॥ ৪৯ ॥

মা—না হোক, তে—তোমার, ব্যথা — কষ্ট, যা না হোক; চ, বিভা: মোহাচ্ছন্নতা; দৃষ্ট্বা—দেখে; রূপম্ —রূপ; ঘোরম্— ভয়ংকর, ঈক্; মম — আমার; ইদম্—এই, ব্যপেতভীঃ— সমস্ত ভয় থেকে মুক্ত হয়ে, প্রীতমনাঃ —প্রসন্নচিত্তে: পুনঃ—পুনরায়; ত্বম্—তুমি; তৎ—তা; এব—এভাবে মে আমার রূপম্—রূপ; ইদম্——এই প্রপশ্য—দর্শন কর।

গীতার গান

দিব না তোমাকে ব্যথা     বিভ্রম হয়েছে যথা

দেখি মোর এই ঘোর রূপ।

ছাড় ভয় প্রীত হও     পুনঃ শান্তি প্রাপ্ত হও

দেখ মোর যে নিত্য স্বরূপ ৷।

অনুবাদঃ আমার এই প্রকার ভয়ঙ্কর বিশ্বরূপ দেখে তুমি ব্যথিত ও মোহাচ্ছন্ন হয় না। সমস্ত ভয় থেকে মুক্ত হয়ে এবং প্রসন্ন চিত্তে তুমি পুনরায় আমার এই চতুর্ভূজ রূপ দর্শন কর।

তাৎপর্যঃ ভগবদ্গীতার প্রারম্ভে অর্জুন তাঁর পরম পূজ্য পিতামহ ভীষ্মদেব ও গুরুদেব দ্রোণাচার্যকে হত্যা করার কথা চিন্তা করে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে বললেন যে, তাঁর পিতামহকে হত্যা করার ব্যাপারে তাঁর আতঙ্কিত হওয়া উচিত নয়। কৌরবদের রাজসভায় যখন ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রগণ দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ করছিল, তখন ভীষ্ম ও দ্রোণ নীরব ছিলেন। ধর্ম আচরণে এই অবহেলার জন্য তাঁদের হত্যা করাই উচিত। শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে তাঁর বিশ্বরূপ দেখালেন, কেবল তাঁকে এটি বুঝিয়ে দেবার জন্য যে, তাঁদের অনৈতিক আচরণের ফলে তাঁরা ইতিমধ্যেই হত হয়েছেন। অর্জুনকে এই দৃশ্য দেখানো হয়েছিল কারণ ভক্তেরা সর্বদাই শান্তিপ্রিয় এবং তাঁরা এই ধরনের বীভৎস কাজ করতে পারেন না। সেই উদ্দেশ্যে তাকে বিশ্বরূপ দেখানো হয়েছিল। এখন অর্জুন ভগবানের চতুর্ভুজ রূপ দেখতে চাইলেন এবং শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে তাও দেখালেন। ভক্ত ভগবানের বিশ্বরূপ দর্শনে তেমন আগ্রহী নন, কেন না এই রূপের সঙ্গে প্রেমানুভূতির আদান-প্রদানের কোন সম্ভাবনা থাকে না। ভক্ত সর্বদাই শ্রদ্ধাবনত চিত্তে ভগবানকে তার হৃদয়ের ভক্তির অর্থ নিবেদন করতে চান। তাই, তিনি বিভুজধারী শ্রীকৃষ্ণের রূপ দর্শন করতে চান, যাতে পরম পুরুষোত্তম ভগবানের সঙ্গে তিনি তাঁর প্রেমভক্তি বিনিময় করতে পারেন।

শ্লোকঃ ৫০

সঞ্জয় উবাচ

ইত্যর্জুনং বাসুদেবস্তথোক্তা

স্বকং রূপং দর্শয়ামাস ভূয়ঃ ।

আশ্বাসয়ামাস চ ভীতমেনং

ভূত্বা পুনঃ সৌম্যবপুর্মহাত্মা ॥ ৫০ ॥

সঞ্জয়ঃ উবাচ—সঞ্জয় বললেন; ইতি—এভাবে; অর্জুনম্— অর্জুনকে; বাসুদেবঃ- কৃষ্ণ, তথা— সেভাবে; উড়া—বলে; স্বকম্—তাঁর নিজের; রূপম্ —রূপ; দর্শয়ামাস — দেখালেন; ভূয়ঃ—পুনরায়: আশ্বাসয়ামাস — আশ্বস্ত করলেন; চ–ও, ভীতম্——ভীত, এনম্—তাঁকে; ভূত্বা – হয়ে; পুনঃপুনর্বার; সৌম্যবপুঃ প্রসন্নমূর্তি; মহাত্মা—মহাত্মা।

গীতার গান

সঞ্জয় কহিলেনঃ

সে কথা বলিয়া হরি     অর্জুনকে লক্ষ্য করি

বাসুদেব ভগবান পুনঃ।

নিজ চতুর্ভুজ রূপ     দেখাইছ অপরূপ

পূৰ্ণ ব্ৰহ্ম অপ্রাকৃত গুণ ॥

তারপর নিত্যরূপ     শ্রীকৃষ্ণের সেই রূপ

দ্বিভুজ মূরতি আবির্ভাব ।

পুনর্বার হল সৌম     স্বরূপের যে মাহাত্মা

আশ্বাসনে ফিরিল স্বভাব ৷৷

অনুবাদঃ সঞ্জয় ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন – মহাত্মা বাসুদেব অর্জুনকে এভাবেই বলে তার চতু রূপ দেখালেন এবং পুনরায় দ্বিভুজ সৌম্যমূর্তি ধারণ করে ভীত অর্জুনকে আশ্বস্ত করলেন।

তাৎপর্যঃ শ্রীকৃষ্ণ যখন বসুদেব ও দেবকীর পুত্ররূপে আবির্ভূত হন, তখন তিনি সর্বপ্রথমে চতুর্ভুজ নারায়ণ রূপে প্রকাশিত হন, কিন্তু তাঁর পিতা-মাতা যখন তাকে অনুরোধ করলেন, তখন তিনি নিজেকে একটি সাধারণ শিশুতে রূপান্তরিত করেন। তেমনই শ্রীকৃষ্ণ জানতেন যে, অর্জুন তার চতুর্ভূজ রূপ দর্শনে আগ্রহী নন। কিন্তু যেহেতু তিনি তাঁর চতুর্ভুজ রূপ দর্শন করতে চেয়েছিলেন, তাই তিনি তাকে আবার সেই রূপ দেখালেন এবং তার পরে তার দ্বিভুজ রূপ দেখালেন। এখানে সমা কথাটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। সৌমাবপুঃ কথাটির অর্থ হচ্ছে অত্যন্ত সুন্দর । ভগবানের দ্বিভুজ শ্যামসুন্দর রূপ হচ্ছে তাঁর সবচেয়ে সুন্দর রূপ। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যখন এই জগতে প্রকট ছিলেন, তখন সকলেই তাঁর রূপে আকৃষ্ট হতেন। যেহেতু শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন সমগ্র বিশ্বচরাচরের নিয়ন্তা, তাই তিনি তাঁর ভক্ত অর্জুনের সমস্ত ভয় বিদূরিত করলেন এবং তাঁকে আবার তাঁর দ্বিভূজ শ্যামসুন্দর রূপ দেখালেন। ব্রহ্মসংহিতায় (৫/৩৮) বলা হয়েছে, প্রেমাঞ্জনচ্ছুরিতভক্তি বিলোচনেন প্রেমাজনের দ্বারা রঞ্জিত ভক্তি নয়নেই কেবল শ্রীকৃষ্ণের শ্যামসুন্দর রূপ দর্শন করা যায়।

শ্লোকঃ ৫১

অর্জুন উবাচ

দৃষ্টেদং মানুষং রূপং তব সৌম্যং জনার্দন ।

ইদানীমস্মি সংবৃত্তঃ সচেতাঃ প্রকৃতিং গতঃ ॥ ৫১ ৷৷

অর্জুনঃ উবাচ—অর্জুন বললেন; দৃষ্টা— দেখে; ইদম্—এই; মানুষম — মানুষ : রূপম্—রূপ; তব—তোমার; সৌন্যন্—সৌম্য; জনার্দন—হে জনার্দন; ইদানীম্‌— এখন; অস্মি—হই; সংবৃত্ত:–স্থির হল; সচেতাঃ—চিত্র; প্রকৃতিম্—প্রকৃতিস্থ; গতঃ—হলাম।

গীতার গান

অর্জুন কহিলেনঃ

দেখিয়া তোমার এই মনুষ্য-স্বরূপ ।

হে জনার্দন পেয়েছি ফিরি মোর রূপ।।

সংবৃত্ত হয়েছি আমি সচেতা প্রকৃতি ৷

ইদানীং সে চিত্ত স্থির স্বাভাবিক গতি ॥

অনুবাদঃ অর্জুন বললেন –হে জনার্দন! তোমার এই সৌম্য মানুষমূর্তি দর্শন করে এখন আমার চিত্ত স্থির হল এবং আমি প্রকৃতিস্থ হলাম।

তাৎপর্যঃ এখানে মানুষং রূপম্ কথাটির মাধ্যমে স্পষ্টভাবে বোঝানো হচ্ছে যে, পরম পুরুষোত্তম ভগবানের আদি স্বরূপ হচ্ছে দ্বিভুজ। যারা শ্রীকৃষ্ণকে একজন সাধারণ মানুষ বলে মনে করে তাঁকে অবজ্ঞা করে, এখানে স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে, তারা তাঁর দিবা প্রকৃতি সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। শ্রীকৃষ্ণ যদি একজন সাধারণ মানুষ হতেন, তা হলে তাঁর পক্ষে বিশ্বরূপ এবং তারপর চতুর্ভুজ নারায়ণ রূপ দেখানো কি করে সম্ভব হত? ভগবদ্গীতাতে তাই স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, শ্রীকৃষ্ণকে সাধারণ মানুষ বলে মনে করে যারা নির্বোধের মতো প্রচার করে যে, শ্রীকৃষ্ণের অন্তরে নির্বিশেষ যে ব্রহ্ম, তিনিই শ্রীকৃষ্ণের মাধ্যমে কথা বলছেন, তারা অত্যন্ত অন্যায় করছে। শ্রীকৃষ্ণ প্রকৃতপক্ষে তাঁর বিশ্বরূপ ও তাঁর চতুর্ভুজ বিষ্ণুরূপ দেখিয়েছেন। তা হলে শ্রীকৃষ্ণ কি করে একজন সাধারণ মানুষ হতে পারেন? ভগবদ্‌গীতার ভ্রান্ত ব্যাখ্যার দ্বারা শুদ্ধ ভক্তেরা কখনই বিভ্রান্ত হন না, কারণ তাঁরা জানেন কোটি কি। ভগবদ্গীতার মূল শ্লোকগুলি সূর্যের মতো উজ্জ্বল। তাই, তা দর্শন করবার জন্য মূর্খ ভাষ্যকারদের ভাষ্যরূপ মশালের আলোর প্রয়োজন হয় না ।

error: Content is protected !!