শ্লোকঃ ৪৩

পিতাসি লোকস্য চরাচরস্য

ত্বমস্য পূজ্যশ্চ গুরুর্গরীয়ান ।

ন ত্বৎসমোহস্ত্যভ্যধিকঃ কুতোহন্যো

লোকত্ৰয়েহ প্যপ্রতিমপ্রভাব ।। ৪৩ ।।

পিতা পিতা; অসি হও লোকস্য – জগতের, চরাচরস্য— স্থাবর ও জঙ্গমের; ত্বম্—তুমি; অস্য—এই পূজাঃ— পূজনীয়; চ–3; গুরুঃ – গুরু গরীয়ান্— গুরুশ্রেষ্ঠ; ন–না; ত্বৎসমঃ— তোমার সমকক্ষ, অস্তি— আছে; অভ্যধিকঃ—মহত্তর; কুতঃ– কিভাবে সম্ভব; অন্যঃ – অনা; লোকত্ৰয়ে— ত্রিলোকে; অপি – ; অপ্রতিম —অপ্রমেয় প্রভাব — প্রভাব ।

গীতার গান

যত লোক চরাচর     তুমি পিতা সে সবার

তুমি পূজ্য শুরু সে প্রধান।

সমান অধিক তব     অন্য কেহ অসম্ভব

অপ্রতিম তোমার প্রভাব ৷।

অনুবাদঃ হে অমিত প্রভাব ! তুমি এই চরাচর জগতের পিতা, পূজ্য, গুরু ও গুরুশ্রেষ্ঠ। ত্রিভুবনে তোমার সমান আর কেউ নেই, অতএব তোমার থেকে শ্রেষ্ঠ অন্য কে হতে পারে?

তাৎপর্যঃ পুত্রের কাছে পিতা যেমন পূজনীয়, তেমনই পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আমাদের সকলেরই পুজনীয়। তিনি সকলের গুরু, কারণ তিনি সর্বপ্রথম ব্রহ্মাকে বৈদিক জ্ঞান দান করেন এবং এখানে তিনি অর্জুনকে ভগবদ্‌গীতার তত্ত্বজ্ঞান দান করছেন। তাই তিনি হচ্ছেন আদিগুরু। সদগুরু হচ্ছেন তিনি, যিনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণ প্রবর্তিত পরম্পরায় অপ্রাকৃত তত্ত্বজ্ঞান লাভ করেছেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতিনিধি না হলে, কেউই অপ্রাকৃত তত্ত্বজ্ঞান দানকারী গুরুপদবাচ্য হতে পারেন না।

ভগবানকে সর্বতোভাবে প্রণাম নিবেদন করা হয়েছে। ভগবানের মহত্ত্ব অপরিমেয়। পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের থেকে শ্রেষ্ঠ আর কেউ নেই। কারণ, প্রাকৃত ও অপ্রাকৃত উভয় জগতে এমন কেউ নেই যিনি ভগবানের সমকক্ষ অথবা ভগবানের চেয়ে শ্রেয়। সবাই ভগবানের অধস্তন। কেউই ভগবানকে অতিক্রম করতে পারে না। এই কথা শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে (৬/৮) বলা হয়েছে–

ন তস্য কার্যং করণং চ বিদ্যতে ।

ন তৎ সমশ্চাভ্যধিক‍শ্চ দৃশ্যতে ॥

পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ইন্দ্রিয় ও দেহ একজন সাধারণ মানুষেরই মতো, কিন্তু ভগবানের ইন্দ্রিয়, দেহ, মন এবং ভগবান স্বয়ং অভিন্ন। যে সমস্ত মূর্খ মানুষ ভগবান সম্বন্ধে যথাযথ জ্ঞান প্রাপ্ত হয়নি, তারা বলে যে, শ্রীকৃষ্ণের আত্মা, হৃদয়, মন ও সব কিছুই শ্রীকৃষ্ণ থেকে ভিন্ন। শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরমতত্ত্ব, তাই তার ক্রিয়াকলাপ ও শক্তি পরম শ্রেষ্ঠ। শাস্ত্রে বলা হয়েছে যে, যদিও তাঁর ইন্দ্রিয় আমাদের মতো নয়, তবুও তাঁর প্রতিটি অঙ্গই সমস্ত ইন্দ্রিয়ের কাজ করতে পারে। তাই, তাঁর ইন্দ্রিয় অপূর্ণ অথবা সীমিত নয়। কেউই তাঁর থেকে মহত্তর হতে পারে না। কেউই তাঁর সমকক্ষ হতে পারে না। তাই সকলেই তার থেকে নিম্নতর স্তরে অবস্থিত।

পরম পুরুষোত্তমের জ্ঞান, শক্তি ও ক্রিয়াকলাপ সবই অপ্রাকৃত। ভগবদগীতায় (৪/৯) বলা হয়েছে—

জন্ম কর্ম চ মে দিবামেবং যো বেত্তি তত্ত্বতঃ ।

ত্যক্তা দেহং পুনর্জন্ম নৈতি মামেতি সোহঅর্জুন।।

যাঁরা জানেন যে, শ্রীকৃষ্ণের দেহ চিন্ময় এবং তাঁর ক্রিয়াকলাপ দিবা, তাঁরা মৃত্যুর পর ভগবৎ-ধামে শ্রীকৃষ্ণের কাছে ফিরে যান এবং তাদের আর এই দুঃখ জগতে ফিরে আসতে হয় না। তাই আমাদের জানতে হবে এ কার্যকলাপ অন্য সকলের কার্যকলাপের থেকে ভিন্ন। শ্রীকৃষ্ণের নির্দেশ অনুসারে জীবন যাপন করাই শ্রেষ্ঠ পন্থা। এভাবেই জীবন যাপন করার ফলে আমরা আমাদের জীবন সার্থক করে তুলতে পারি। শাস্ত্রে আরও বলা হয়েছে, এমন কেউ নেই যিনি শ্রীকৃষ্ণের প্রভু। সকালেই তাঁর ভৃত্য। শ্রীচৈতন্য চরিতামৃত (আদি ৫/১৪২) বলা হয়েছে, একলে ঈশ্বর কৃষ্ণ, আর সব ভৃত্য শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন ভগবান এবং আর সকলেই তাঁর ভৃত্য। সকলেই তাঁর আদেশ পালন করে চলেছে। এমন কেউ নেই যিনি শ্রীকৃষ্ণের উপদেশ অমান্য করতে পারে। তাঁর অধ্যক্ষতায়, তাঁরই পরিচালনায় সকলে পরিচালিত হচ্ছে। ব্রহ্মসংহিতাতে বলা হয়েছে—তিনি হচ্ছেন সর্ব কারণের পরম কারণ।

শ্লোকঃ ৪৪

তস্মাৎ প্রণম্য প্রণিধায় কায়‍ং

প্রসাদয়ে ত্বামহমীশমীড্যম ।

পিতেব পুত্রস্য সখেব সখ্যুঃ

প্রিয়ঃ প্রিয়ায়ার্হসি দেব সোঢুম্ ॥ ৪৪ ॥

তস্মাৎ—অতএব, প্রণম্য — প্রণাম করে; প্রণিধায় — দণ্ডবৎ পতিত হয়ে, কায়ম- দেহ; প্রসাদয়ে—কৃপাভিক্ষা করছি; ত্বাম্ — তোমার কাছে; অহম্ – আমি, ঈশম — পরমেশ্বর ভগবান; ঈভ্যস্— পরমপূজা; পিতা ইব– পিতা যেমন; পুত্রস্য পুত্রের সখা ‘ইব-সখা যেমন; সখ্যঃ—সখার; প্রিয়ঃ- প্রেমিক; প্রিয়ায়াঃ- প্রিয়ার: আইসি সমর্থ, দেব হে দেব; সোচুম্ ক্ষমা করতে।

গীতার গান

দণ্ডবৎ নমস্কার     করি আমি বার বার

হে ঈশ, হে পূজ্য জগতে সবার ।

কৃপা তব ভিক্ষা চাই     অন্যথা সে গতি নাই

পিতা পুত্রে যথা ব্যবহার।।

অথবা সখার সাথে     প্রিয় আর সে প্রিয়াতে

দোষ ক্ষমা হয় সে সর্বদা ৷

অনুবাদঃ তুমি সমস্ত জীবের পরমপূজ্য পরমেশ্বর ভগবান। তাই, আমি তোমাকে দণ্ডবৎ প্রণাম করে তোমার কৃপাভিক্ষা করছি। হে দেব ! পিতা যেমন পুত্রের, সখা যেমন সখার, প্রেমিক যেমন প্রিয়ার অপরাধ ক্ষমা করেন, তুমিও সেভাবেই আমার অপরাধ ক্ষমা করতে সমর্থ।

তাৎপর্যঃ শ্রীকৃষ্ণের ভক্ত শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে নানা রকম সম্বন্ধের দ্বারা সম্পর্কিত। কেউ শ্রীকৃষ্ণকে তাঁর পুত্র বলে মনে করেন, কেউ তাঁকে তাঁর পতি বলে মনে করেন। কেউ আবার তাকে সখা অথবা প্রভু বলে মনে করেন। শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুন বন্ধুত্বের দ্বারা সম্পর্কিত। পিতা যেমন সহ্য করেন এবং পতি অথবা প্রভু যেমন সহ্য করেন, তেমনই শ্রীকৃষ্ণও সহ্য করেন।

শ্লোকঃ ৪৫

অদৃষ্টপূর্বং হৃষিতোহস্মি দৃষ্টা

ভয়েন চ প্রব্যথিতং মনো মে ।

তদেব মে দর্শয় দেব রূপং

প্রসীদ দেবেশ জগন্নিবাস ॥ ৪৫ ॥

অদৃষ্টপূর্বা—অদৃষ্টপূর্ব; হৃতিঃ – আনন্দিত; অস্মি— হয়েছি; দৃষ্টা দেখে। জে- ভায়ে; চ—ও; প্রব্যথিতম্ — ব্যথিত হয়েছে; মনঃ- মন; মে— আমার ত‍ সেই এর—অবশ্যই; মে—আমাকে, দর্শয়— দেখাও, দেব—হে দেব, রাগ প্রসীদ—প্রসন্ন হও, দেবেশ – হে দেবেশ; জগন্নিবাস – হে জগন্নিবাস।

গীতার গান

হে দেবেশ জগন্নাথ     সে সমৃদ্ধ মোর সাথ

তুষ্ট হও তথা হে ভূরীদা ॥

অনুবাদঃ তোমার এই বিশ্বরূপ, যা পূর্বে কখনও দেখিনি, তা দর্শন করে আমি আনন্দিত হয়েছি, কিন্তু সেই সঙ্গে আমার মন ভয়ে ব্যথিত হয়েছে। তাই হে দোলেশ। হে জগন্নিবাস! আমার প্রতি প্রসন্ন হও এবং পুনরায় তোমার সেই রূপই আমাকে দেখাও।

তাৎপর্যঃ অর্জুন শ্রীকৃষ্ণের নিত্য বিশ্বস্ত, কারণ তিনি তাঁর অন্তরঙ্গ প্রিয়সখা। প্রিয় সখা যেমন তার সখার বৈভব দর্শনে অত্যন্ত আনন্দিত হয়, অর্জুনও তেমন আনন্দিত হন, যখন তিনি দেখলেন তাঁর প্রিয় সখা শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরম পুরুষোত্তম ভগবান, যিনি তাঁর অমন বিস্ময়কর বিশ্বরূপ প্রদর্শন করতে পারেন। কিন্তু তখন আবার সেই বিশ্বরূপ দর্শন করে তাঁর মনে ভয় হয়, কারণ শ্রীকৃষ্ণের প্রতি তাঁর বিশুদ্ধ বন্ধুত্বের ফ না জানি কত অপরাধ তিনি করেছেন। এভাবেই ভীত হয়ে তাঁর মন চঞ্চল হয়ে উঠে, যদিও ভয় পাবার তাঁর কোন কারণ ছিল না। অর্জুন তাই শ্রীকৃষ্ণকে অনুরোধ করছেন তাঁর চতুর্ভুজ নারায়ণ রূপ দেখাবার জন্য। কারণ তিনি তাঁর ইচ্ছা অনুসারে যে কোন রূপ ধারণ করতে পারেন। শ্রীকৃষ্ণের এই বিশ্বরূপ এই জগতের মতো জড় ও অনিত্য। কিন্তু বৈকুণ্ঠলোকে তাঁর যে দিবা রূপ তা হচ্ছে চতুর্ভুজ নারায়ণ রূপ। চিদাকাশে অসংখ্য গ্রহ রয়েছে এবং সেই প্রতিটি গ্রহে শ্রীকৃষ্ণ তাঁর অংশ-প্রকাশ রূপে ভিন্ন ভিন্ন নামে বিরাজ করেন। তাই, অর্জুন বেকুণ্ঠে যে সমস্ত রূপ প্রকাশিত তাঁর একটি রূপ দেখতে চাইলেন। যদিও প্রত্যেকটি বৈকুণ্ঠলোকে ভগবানের নারায়ণ রূপ চতুর্ভুজ, তবে তাঁর সেই চার হাতে বিভিন্নভাবে তিনি শঙ্খ, চক্র, গদা ও পদ্ম প্রতীক চিহ্নগুলি ধারণ করেন। এই চারটি প্রতীক কোন হাতে কিভাবে তিনি ধারণ করে আছেন, সেই অনুসারে নারায়ণ ভিন্ন ভিন্ন নামে অভিহিত হন। এই সমস্ত রূপগুলি শ্রীকৃষ্ণের থেকে অভিন্ন। তাই, অর্জুন তাঁর সেই চতুর্ভুজ রূপ দর্শন করার আকাঙ্ক্ষা করছেন।

error: Content is protected !!