শ্লোকঃ ৩৯

বায়ুর্যমোহগ্নির্বরূণঃ শশাঙ্কঃ

প্রজাপতিস্ত্বং প্রপিতামহশ্চ ।

নমো নমস্তেহস্ত সহস্ৰকৃত্বঃ

পুনশ্চ ভূয়োঽপি নমো নমস্তে ॥ ৩৯ ॥

বায়ুঃ—বায়ু; যমঃ— যম, অগ্নিঃ—অগ্নি; বরুণঃ — বরুণ, শশাঙ্কঃ – চন্দ্ৰ প্রজাপতিঃ- ব্রহ্মা; ত্বম্—তুমি; প্রপিতামহঃ – প্রপিতামহ; চ–ও; নমঃ নমস্কার, নমস্তে— তোমাকে নমস্কার করি; অস্ত্র— হোক; সহস্ৰকৃত্বঃ – সহস্রবার; পুনঃ চ— এবং পুনরায়; ভূয়ঃ—বারবার, অপি—ও; নমঃ নমস্কার; নমস্তে—তোমাকে নমস্কার করি।

গীতার গান

বায়ু যম বহ্নি চন্দ্ৰ,     সকলের তুমি কেন্দ্র

বরুণ যে তুমি হও সব।

তুমি হও প্রজাপতি,     প্রপিতামহ সে অতি

যাহা হয় তোমার বৈভব।।

সহস্র সে নমস্কার,     করি প্রভু বার বার

তোমার চরণে আমি ধরি ।

পুনঃ পুনঃ নমস্কার,     ভূয় ভূয় বার বার

কৃপা দৃষ্টি কর হে শ্রীহরি ।।

অনুবাদঃ তুমিই বায়ু, যম, অগ্নি, বরুণ, চন্দ্র, প্রজাপতি ব্রহ্মা ও প্রপিতামহ। অতএব, তোমাকে আমি সহস্রবার প্রণাম করি, পুনরায় নমস্কার করি এবং বারবার নমস্কার করি।

তাৎপর্যঃ ভগবানকে এখানে বায়ুরূপে সম্বোধন করা হয়েছে। কারণ বায়ু হচ্ছে সর্বব্যাপ্ত, তাই তা দেব-দেবীদের এক অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধি। অর্জুনও শ্রীকৃষ্ণকে প্রপিতামহ বলে সম্বোধন করছেন, কারণ তিনি ব্রহ্মাণ্ডের প্রথম সৃষ্ট জীব ব্রহ্মার পিতা।

শ্লোকঃ ৪০

নমো পুরস্তাদথ পৃষ্ঠতস্তে

নমহস্তু তে সর্বত এব সর্ব।

অনন্তবীর্যামিতবিক্রমস্তং

সর্বং সমাপ্নোষি ততোহসি সর্বঃ ॥ ৪০ ॥

নমঃ নমস্কার; পুরস্তাৎ সম্মুখে ; অথ ও পৃষ্ঠতঃ– পশ্চাতে, তে—তোমাকে; নমঃ অন্ত—নমস্কার করি; তে– তোমাকে, সর্বতঃ—সব দিক থেকে; এর বস্তুত, সর্ব—হে সর্বাত্মা; অনন্তবীর্য — অন্তহীন শক্তি; অমিতবিক্রম: — অসীম বিক্রমশালী; ত্বম্—তুমি; সর্বম্ — সমগ্র জগতে, সমাপ্লোষি – পরিব্যাপ্ত আছ, ততঃ– সেই হেতু; অসি—তুমি হও সর্বঃ- সব কিছু।

গীতার গান

সম্মুখে পশ্চাতে তব,     সর্বতো প্রণামে রব

নমস্কার তব পাদপদ্মে ।

অন্তর্যামী উরুক্রম,     তুমি বিনা সব ভ্রম

প্রকাশিত তুমি নিজ ছদ্ম।।

অনুবাদঃ হে সর্বাত্মা ! তোমাকে সম্মুখে পশ্চাতে ও সমস্ত দিক থেকেই নমস্কার করছি। হে অনন্তবীর্য। তুমি অসীম বিক্রমশালী। তুমি সমগ্র জগতে ব্যাপ্ত, অতএব তুমিই সর্ব-স্বরূপ।

তাৎপর্যঃ ভগবৎ-প্রেমানন্দে বিহ্বল হয়ে অর্জুন তাঁর বন্ধু শ্রীকৃষ্ণকে সব দিক থেকে প্রণাম নিবেদন করছেন। অর্জুন বুঝতে পেরেছেন যে, শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন সমস্ত শক্তির প্রভু, তিনি অনন্ত বীর্য, তিনি উরুক্রম। সেই যুদ্ধক্ষেত্রে সমবেত সমস্ত রথী- মহারথীদের শক্তির থেকে তার শক্তি অনেক অনেক গুণ বেশি। বিষ্ণু পুরাণে (১/৯/৬১) বলা হয়েছে–

যোহয়ং তবাগতো দেব সমীপং দেবতাগণঃ।

স তুমের জগৎস্রষ্টা যতঃ সর্বগতো ভবান্ ॥

“হে পরম পুরুষোত্তম ভগবান। যে-ই তোমার সামনে আসুক, তা সে দেবতাই হোক, সে তোমারই সৃষ্ট।”

শ্লোক ৪১-৪২

সখেতি মত্বা প্রসভং যদুক্তং

হে কৃষ্ণ হে যাদব হে সখেতি ।

অজানতা মহিমানং তবেদং

ময়া প্রমাদাৎ প্রণয়েন বাপি ।। ৪১ ।।

যচ্চাবহাসার্থমসৎকৃতোহসি

বিহারশয্যাসনভোজনেষু।

একোহথবাপ্যচ্যুত তৎসমক্ষং

তৎ ক্ষাময়ে ত্বামহমপ্রমেয়ম ।। ৪২ ।।

সখা —সখা; ইতি—এভাবে; মত্ত্বা—মনে করে; প্রসভম্—প্রগলভভাবে; যত্—যা কিছু, উক্তম্—বলা হয়েছে, হে কৃষ্ণ – হে কৃষ্ণ, হে যাদব – হে যাদব, হে সখে- হে সখা; ইতি—এভাবেই; অজানতা—না জেনে; মহিমানম্ — মহিমা তব — তোমার ইদম্-এই; ময়া—আমার দ্বারা; প্রেমাদাৎ অজ্ঞতাবশত, প্রণয়েন—প্রণয়বশত; বা অপি – অথবা, য—যা কিছু, চও: অবহাসার্থম্ — পরিহাস হলে; অসংস্কৃতঃ — অসম্মান; অসি—করা হয়েছে, বিহার — বিহার; শয্যা — শয়ন; আসন — উপবেশন ভোজনেষু—অথবা একত্রে আহার করার সময়, একঃ—একাকী, অথবা অথবা অপি—ও; অচ্যুত—হে অচ্যুত, তৎসমক্ষম্—তাদের সামনে; তৎ—সেই সব ক্ষাময়ে—ক্ষমা প্রার্থনা করছি; স্বাম্ — তোমার কাছে, অহম্ –আমি; অপ্রমেয়ম্— অপরিমেয়।

গীতার গান

মানিয়া তোমাকে সখা,     প্রগলভ করেছি বৃথা

হে কৃষ্ণ হে যাদব কত বলেছি।

না যানি এই মহিমা,     আশ্চর্য সে নাহি সীমা

সামান্যত তোমাকে ভেবেছি ॥

না জানি এই মহিমা,     আশ্চর্য সে নাহি সীমা

সামান্যত তোমাকে ভেবেছি।।

পরিহাস করি সখা,     অসৎকার যথাতথা

সে প্রমাদ যা কিছু বলেছি ৷

বিহার শয্যা আসনে,     পরোক্ষ বা সামনে

ক্ষম অপরাধ যা করেছি।।

অনুবাদঃ তোমার মহিমা না জেনে, সথা মনে করে তোমাকে আমি প্রগলভভাবে “হে কৃষ্ণ”, “হে যাদব,” “হে সখা, ” বলে সম্বোধন করেছি। প্রমাদবশত অথবা প্রণয়বশত আমি যা কিছু করেছি ডা তুমি দয়া করে ক্ষমা কর। বিহার, উপবেশন ও ভোজনের সময় কখন একাকী এবং কখন বন্ধুদের সমক্ষে আমি যে তোমাকে অসম্মান করেছি, হে অচ্যুত! আমার সে সমস্ত অপরাধের জন্য তোমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।

তাৎপর্যঃ শ্রীকৃষ্ণ যদিও অর্জুনের সামনে তাঁর বিশ্বরূপ প্রকাশ করেছেন, তবুও ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্বের কথা অর্জুনের মনে পড়ে যায় এবং বন্ধুে

হয়ে তিনি যে ভগবানকে রীতিবিরুদ্ধ অঙ্গভঙ্গি প্রকাশ করে কত যে অসম্মান করেছেন, সেই জন্য তিনি তাঁর কাছে ক্ষমা চাইছেন। তিনি স্বীকার করছেন যে, তিনি পূর্বে জানতেন না যে, শ্রীকৃষ্ণ এই প্রকার বিশ্বরূপ ধারণ করতে সমর্থ, যদিও অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে তিনি সেই কথা পূর্বেই তাঁকে বলেছেন। অর্জুন মনে করতে পারছেন না, কতবার তিনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অনন্ত বৈভবের কথা বিস্মৃত হয়ে তাঁকে “হে কৃষ্ণ”, “হে বন্ধু”, “হে যাদব” আদি সম্বোধন করে তাকে অশ্রদ্ধা করেছেন। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ এতই করুণাময় যে, এই প্রকার ঐশ্বর্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও তিনি অর্জুনের সঙ্গে বন্ধুর মতো খেলা করেছেন। এমনভাবেই ভগবানের সঙ্গে তাঁর ভক্তের অপ্রাকৃত প্রেমের বিনিময় হয়ে থাকে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে জীবের যে সম্পর্ক তা নিত্য, শাশ্বত। তা কখনই বিস্মৃত হওয়া যায় না, যেমন আমরা শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে অর্জুনের ব্যবহারের মাধ্যমে উপলব্ধি করতে পারি। ভগবানের বিশ্বরূপের বৈভব দর্শন করা সত্ত্বেও অর্জুন ভগবানের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্বের কথা ভুলে যাননি।

error: Content is protected !!