শ্লোকঃ ৩৬
অর্জুন উবাচ
স্থানে হৃষীকেশ তব প্ৰকীৰ্ত্যা
জগৎ প্রহৃয্যভ্যনুরজ্যতে চ ।
রক্ষাংসি ভীতানি দিশো দ্রবন্তি
সর্বে নমস্যন্তি চ সিদ্ধসঙ্ঘাঃ ॥ ৩৬ ॥
অর্জুনঃ উবাচ—অর্জুন বললেন; স্থানে—যুক্তিযুক্ত; হৃষীকেশ – হে হৃষীকেশ; তব— তোমার প্রকীর্ত্যা— মহিমা কীর্তন দ্বারা, জগৎ—সমগ্র বিশ্ব; প্রহৃয্যতি — হৃষ্ট হচ্ছে: অনুরজাতে—অনুরক্ত হচ্ছে: চ—এবং; রক্ষাংসি — রাক্ষসেরা; ভীতানি—ভীত হয়ে; দিশঃ- নিকসমূহে; দ্রবন্তি পলায়ন করছে, সর্বে— সমস্ত: নমস্যন্তি – নমস্কার করছে; চ—ও, সিদ্ধসম্পাঃ সিদ্ধগণ।
গীতার গান
অর্জুন কহিলেনঃ
তব কীর্তি হৃষীকেশ, শুনিয়াছে যে অশেষ,
জগতের যেবা যেথা আছে ৷
আনন্দিত হয়ে তারা, অনুগত হয় যারা,
পাগল হইয়া ধায় পাছে।।
রাক্ষসাদি ভয়ে ভীত, যদি চাহে নিজ হিত,
পলায় সে দিগ্-দিগন্তরে ।
যারা হয় সিদ্ধ জন, সদা প্রণমিত মন,
যুক্ত হয় সে কার্য তাদেরে।।
অনুবাদঃ অর্জুন বললেন-হে হৃষীকেশ ! তোমার মহিমা কীর্তনে সমস্ত জগৎ প্রহৃষ্ট হয়ে তোমার প্রতি অনুরক্ত হচ্ছে। রাক্ষসেরা ভীত হয়ে নানা দিকে পলায়ন করছে এবং সিদ্ধরা তোমাকে নমস্কার করছে। এই সমস্তই যুক্তিযুক্ত।
তাৎপর্যঃ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কাছে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পরিণতি সম্বন্ধে অবাত হওয়ার ফলে অর্জুন ভগবানের অনন্য ভক্তে পরিণত হলেন। পরম পুরুষোত্তম ভগবানের মহান ভক্ত ও সখারূপে তিনি স্বীকার করলেন যে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যা করেন তা আমাদের মঙ্গলের জন্যই করেন। অর্জুন প্রতিপন্ন করলেন যে, শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন সমস্ত বিশ্বচরাচরের পালনকর্তা, তিনি হচ্ছেন তাঁর ভক্তদের আরাধ্য ভগবান এবং তিনি হচ্ছেন অবাঞ্ছিতদের বিনাশকর্তা। তিনি যাই করেন তা সকলের মঙ্গলের জনাই করেন। অর্জুন এখানে বুঝতে পারছেন যে, কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধের সময় আকাশ মার্গের উচ্চতর গ্রহলোকের অনেক দেব-দেবী, সিদ্ধ ও মহাত্মারা সেই যুদ্ধ দর্শন করতে এসেছিলেন, কারণ শ্রীকৃষ্ণ সেখানে উপস্থিত ছিলেন। অর্জুন যখন ভগবানের বিশ্বরূপ দর্শন করলেন, তখন দেব-দেবীরা প্রীতি লাভ করেছিলেন। কিন্তু অনোরা, যারা ছিলেন আসুরিক ভাবাপন্ন রাক্ষস ও ভগবৎ-বিদ্বেষী দৈত্য-দানব, তারা ভগবানের সেই মহিমা সহ্য করতে পারল না। পরম পুরুষোত্তম ভগবানের ধ্বংস সাধনকারী ভয়ঙ্কর এই রূপ দর্শন করে, তারা তাদের স্বাভাবিক ভায়ের বশবর্তী হয়ে পলায়ন করতে শুরু করেছিল। ভগবান তাঁর ভক্ত ও অভক্তের সঙ্গে যেভাবে আচরণ করেন, অর্জুন তার প্রশংসা করছেন। সর্ব অবস্থাতেই ভক্ত ভগবানের মহিমা কীর্তন করেন। কারণ তিনি জানেন যে, ভগবান যা করেন তা সকলের মঙ্গলের জনাই করেন।
শ্লোকঃ ৩৭
কস্মাচ্চ তে ন নমেরন্মহাত্মন
গরীয়সে ব্রহ্মণোহ প্যাদিকত্রে ।
অনন্ত দেবেশ জগন্নিবাস
ত্বক্ষরং সদসত্তৎপরং যৎ ।। ৩৭ ।।
কস্মাৎ—কেন; চ–ও; তে— তোমাকে, ন-না, নমেরণ-নমস্কার করিবেন; মহাত্মন—হে মহাত্মা; গরীয়সে গরীয়ান, ব্রহ্মণঃ — ব্রহ্মা অপেক্ষা, অপি—যদিও। আদিকৰ্ত্তে—আদিকর্তা; অনন্ত – হে অনন্ত, দেবেশ — হে দেবেশ; জগন্নিবাস – হে জগদাতায়, দম্–তুমি; অক্ষরণ — এমা; সদসৎ- কারণ ও কার্য, তৎ পরম্—উভয়ের অতীত; মৎ- যে।
গীতার গান
কেন না হে মহাত্মন, নাহি নবে সে শরণ,
তুমি হও সর্ব গরীয়সী ।
ব্রহ্মার আদি কর্তা, তুমি হও তার ভর্তা,
তব কীর্তি অতি মহীয়সী ॥
হে অনন্ত দেব ঈশ, তুমি হও জগদীশ,
সদসদ পরে যে অক্ষর।
তুমি হও সেই তত্ত্ব, কে বুঝিবে সে মহত্ত্ব,
নহ তুমি ভৌতিক বা জড় ৷৷
অনুবাদঃ হে মহাত্মন্ ! তুমি এমন কি ব্রহ্মা থেকেও শ্রেষ্ঠ এবং আদি সৃষ্টিকর্তা। সকলে তোমাকে কেন নমস্কার করবেন না? হে অনন্ত ! হে দেবেশ ! হে জগন্নিবাস ! তুমি সৎ ও অসৎ উভয়ের অতীত অক্ষরতত্ত্ব ব্ৰহ্ম।
তাৎপর্যঃ এভাবেই প্রণাম করার মাধ্যমে অর্জুন বুঝিয়ে দিচ্ছেন যে, শ্রীকৃষ্ণ সকলের পূজনীয়। তিনি সর্বব্যাপ্ত এবং তিনি সকল আত্মার পরম আত্মা। অর্জুন এখানে শ্রীকৃষ্ণকে মহাত্মা বলে সম্বোধন করছেন, যার অর্থ হচ্ছে তিনি সবচেয়ে মহৎ এবং তিনি অসীম। অনন্ত বলতে বোঝাচ্ছে যে, এমন কিছুই নেই যা পরমেশ্বর ভগবানের শক্তির ও প্রভাবের দ্বারা আচ্ছাদিত নয়। দেবেশ কথাটির অর্থ হচ্ছে তিনি হচ্ছেন সমস্ত দেবতাদের নিয়ন্তা এবং তাদের সকলের ঊর্ধ্বে। তিনি হচ্ছেন সম বিশ্বচরাচরের আশ্রয়। অর্জুন এটিও বুঝতে পেরেছিলেন যে, সমস্ত সিন্ধ মহাপুরুষ এবং অত্যন্ত শক্তিশালী দেব-দেবীরা যে ভগবানকে তাঁদের সশ্রদ্ধ প্রণাম নিবেদন করছিলেন, তা খুবই স্বাভাবিক। কারণ তাঁর চেয়ে বড় আর কেউ নেই। অর্জুন বিশেষভাবে উল্লেখ করছেন যে, শ্রীকৃষ্ণ ব্রহ্মার চেয়েও বড়। কারণ ব্রহ্মা তাঁর সৃষ্ট। ব্রহ্মার জন্ম হয় গর্ভোদকশায়ী বিষ্ণুর নাভিপদ্ম থেকে উদ্গত কমলের মধ্যে এবং গর্ভোদকশায়ী বিষ্ণু হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণেরই অংশ প্রকাশ। তাই ব্রহ্মা ও শিব, যিনি ব্রহ্মা থেকে উদ্ভূত হয়েছেন এবং সমগ্র দেব-দেবীরা শ্রদ্ধাবনত চিত্তে ভগবানকে অবশ্যই প্রণাম জানাবেন। শ্রীমদ্ভাগবতে বলা হয়েছে যে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ব্রহ্মা, শিব আদি সমস্ত দেব-দেবীদের পূজনীয়। এখানে অক্ষরম্ কথাটি খুব তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ এই জড় জগতের বিনাশ অবশ্যম্ভাবী, কিন্তু ভগবান এই জড়া সৃষ্টির অতীত। তিনি হচ্ছেন সর্ব কারণের পরম কারণ। তাই, তিনি এই জগতের সমস্ত বদ্ধ জীব, এমন কি এই জড় সৃষ্টির থেকেও গরীয়ান। তাই তিনি পরমেশ্বর ভগবান।
শ্লোকঃ ৩৮
ত্বমাদিদেবঃ পুরুষঃ পুরাণ-
স্তমস্য বিশ্বস্য পরং নিধানম্ ।
বেত্তাসি বেদ্যং চ পরং চ ধাম
ত্বয়া ততং বিশ্বমনন্তরূপ ॥ ৩৮ ॥
ত্বম্—তুমি আদিদেবঃ – আদি পরমেশ্বর ভগবান পুরুষঃ পুরুষ; পুরাণঃ—পুরাতন; ত্বম্—তুমি; অস্য—এই; বিশ্বস্য— বিশ্বের পরম — পরম; নিধানম্ — আশ্রয়; বেত্তা—জ্ঞাতা; অসি—হও; বেদ্যম্ চ–এবং জ্ঞেয়; পরং চ ধাম—এবং পরম ধাম; ত্বয়া—তোমার দ্বারা; ততম্-ব্যাপ্ত; বিশ্বম্ — জগৎ; অনন্তরূপ — হে অনন্ত- রূপ ।
গীতার গান
তুমি আদি দেব হও, সকলের সাধ্য নও,
পুরাণ পুরুষ সবা হতে।
জগতের যাহা কিছু, সম্ভব হয়েছে পিছু,
স্থির এই জগৎ তোমাতে।।
তুমি জান সব প্রভু, সনাতন তুমি বিভু
তুমি হও পরম নিধান।
এ বিশ্ব তোমার দ্বারা, ব্যাপ্ত হয়েছে সারা,
অনন্ত সে তোমার বিধান ।।
অনুবাদঃ তুমি আদি দেব, পুরাণ পুরুষ এবং এই বিশ্বের পরম আশ্রয়। তুমি সব কিছুর জ্ঞাতা, তুমিই য়ে এবং তুমিই গুণাতীত পরম ধামস্বরূপ। হে অনন্তরূপ ! এই জগৎ তোমার দ্বারা পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে।
তাৎপর্যঃ সব কিছুই পরম পুরুষোত্তম ভগবানকে আশ্রয় করে বর্তমান। তাই ভগবান হচ্ছেন পরম আশ্রয়। নিধানম্ মানে হচ্ছে—সব কিছু, এমন কি ব্রহ্মজ্যোতিও পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আশ্রিত। এই জগতে যা ঘটছে সব কিছুরই জ্ঞাতা হচ্ছেন তিনি এবং জ্ঞানের যদি কোন অন্ত থাকে, তবে তিনিই সমস্ত জ্ঞানের অস্ত। তাই, তিনি হচ্ছেন জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়। সমস্ত জ্ঞানের বিষয়বস্তু হচ্ছেন তিনি, কারণ তিনি সর্বব্যাপ্ত। যেহেতু তিনি চিৎ-জগতেরও পরম কারণ, তাই তিনি অপ্রাকৃত। অপ্রাকৃত জগতেও তিনি হচ্ছেন পরম পুরুষ।