শ্লোকঃ ৩৩
তস্মাত্নমুত্তিষ্ঠ যশো লভস্ব
জিত্বা শত্রুন ভুক্ষু রাজ্যং সমৃদ্ধম ।
ময়ৈবৈতে নিহতাঃ পূর্বমেব
নিমিত্তমাত্রং ভব সব্যসাচিন ।। ৩৩ ।।
তস্মাৎ—অতএব, ত্বম্ — তুমি; উত্তিষ্ঠ— উঠ; যশঃ— যশ, নভম্ব লাভ কর; জিত্বা—জয় করে, শত্রুন— শত্রুদের ভু— ভোগ কর; রাজ্য—রাজ্য; সমৃদ্ধন্— সমৃদ্ধশালী; ময়া-আমার দ্বারা: এর অবশ্যই। এতে এই সমস্ত; নিহতাঃ — নিহত হয়েছে, পূর্বনের—পূর্বেই নিমিত্তমাত্রম্—নির্মিত মাত্র; ভব— হও, সব্যসাচি – হে সব্যসাচী।
গীতার গান
অতএব যারা হেথা, যুদ্ধ লাগি সমবেতা,
তুমি বিনা সকলে মরিবে ।
যত যোদ্ধা আসিয়াছে, সম্মুখে দাঁড়াইয়াছে,
কেহ নাহি জীবিত সে রবে ॥
অতএব কর যুদ্ধ, যশলাভ হবে শুদ্ধ,
শত্রু জিনি সুখে রাজ্য কর ।
আমি সেই প্রথমেতে, মারিয়া রেখেছি এতে,
নিমিত্তমাত্র সে তুমি যুদ্ধ কর ।।
অনুবাদঃ অতএব, তুমি যুদ্ধ করার জন্য উত্থিত হও, যশ লাভ কর এবং শত্রুদের পরাজিত করে সমৃদ্ধিশালী রাজ্য ভোগ কর। আমার দ্বারা এরা পূর্বেই নিহত হয়েছে। হে সব্যসাচী। তুমি নিমিত্ত মাত্র হও।
তাৎপর্যঃ সব্যসাচিন্ তাকেই বলা হয়, যিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে যুদ্ধক্ষেত্রে তীর ছুঁড়তে পারেন। এভাবেই অর্জুনকে সুদক্ষ যোদ্ধারূপে সম্বোধন করা হয়েছে, যিনি তীর ছুঁড়ে শব্দ সংহার করতে সমর্থ। ‘নিমিত্ত মাত্র হও’ – নিমিত্তমাত্রম্ । এই কথাটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এই জগতে সব কিছুই সাধিত হচ্ছে পরমেশ্বর ভগবানের ইচ্ছানুসারে। যারা মূর্খ, যাদের জ্ঞান নেই, তারা মনে করে যে, কোনও পরিকল্পনার দ্বারা চালিত না হয়েই প্রকৃতিতে সব কিছু ঘটে চলেছে এবং এই প্রকৃতিতে সব কিছুই যেন আকস্মিক ঘটনাচক্রে উদ্ভূত হয়েছে। আধুনিক যুগে তথাকথিত বৈজ্ঞানিকেরা বলে যে, হয়ত এটি এই রকম ছিল অথবা এই রকম হলেও হতে পারে, কিন্তু আসলে ‘হয়ত’ বা ‘হতে পারে’ -এই রকম কোন প্রশ্নই উঠে না। এই জড় জগতে একটি নির্দিষ্ট পরিকল্পনা কাজ করছে। এই পরিকল্পনাটি কি? জড় জগতে বদ্ধ জীবাত্মারা ভগবানের কাছে ফিরে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের দাম্ভিক মনোভাব থাকে, যার প্রভাবে তারা জড় জগতের উপর আধিপত্য করতে চায়, ততক্ষণ তারা বদ্ধ। কিন্তু কেউ যখন পরমেশ্বর ভগবানের পরিকল্পনা উপলব্ধি করতে পারেন এবং কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত হয়ে ভগবানের সেবায় প্রবৃত্ত হন, তখন তিনিই হচ্ছেন যথার্থ বুদ্ধিমান। এই জগতের সৃষ্টিকার্য ও বিনাশকার্য সাধিত হয় ভগবানের নিখুঁত পরিচালনায়। এভাবেই ভগবানের পরিকল্পনা অনুসারে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের আয়োজন হয়েছিল। অর্জুন যুদ্ধ করতে চাইছিলেন না। কিন্তু তাঁকে বলা হয়েছিল যে, পরমেশ্বর ভগবানের ইচ্ছা অনুসারে তাঁর যুদ্ধ করা উচিত। তা হলেই তিনি সুখী হবেন। কেউ যখন সম্পূর্ণভাবে কৃষ্ণভাবনার অমৃত লাভ করেন এবং ভগবানের অপ্রাকৃত সেবায় তাঁর জীবনকে সর্বতোভাবে উৎসর্গ করেন, তিনিই সার্থকতা লাভ করেন।
শ্লোকঃ ৩৪
দ্রোণং চ ভীষ্মং চ জয়দ্রথং চ
কর্ণং তথান্যানপি যোধবীরান।
ময়া হতাংস্ত্বং জহি মা ব্যথিষ্ঠা
যুধ্যস্ব জেতাসি রণে সপত্নান্ ॥ ৩৪ ॥
দ্রোণম্ চ— দ্রোণাচার্যও, ভীষ্মম্ চ— ভীষ্মদেবও; জয়দ্রথম্ চ—জয়দ্রথত: কর্ণম কর্ণ, তথা–এবং; অন্যান্—অন্যান্য; অপি – অবশ্যই, যোধবীরান—যুদ্ধনীর গণ; ময়া—আমার দ্বারা; হতান নিহত হয়েছে; ত্রম্ — তুমি: জহি—বধ কর; মা – না, ব্যথিষ্ঠাঃ — বিচলিত হয়ো; যুধ্যস্ব— যুদ্ধ কর; জেতাসিজার করাবে রণে—যুদ্ধে; সপত্নান—শত্রুদের।
গীতার গান
দ্রোণ আর ভীষ্ম কর্ণ, জয়দ্রথ তথা অন্য,
যত যোদ্ধা বীর আসিয়াছে ।
মরিয়াছে জান তারা, আমার ইচ্ছার দ্বারা,
কিবা দুঃখ করিবার আছে ।।
সঞ্জয়ঃ উবাচ— সঞ্জয় বললেন, এতং—এই শ্রুত্বা শুনে; বচনমবাণী, কেশবস্য – কেশবের; কৃতাঞ্জলিঃ – হাত জোড় করে; বেপমানঃ—কম্পিত কলেবরে; কিরীটী—অর্জুন; নমস্কৃত্বা—নমস্কার করে; ভূয়ঃ—পুনরায়; এব—ও; আহ – বললেন; কৃষ্ণম্ — শ্ৰীকৃষ্ণকে, সগদ্গদম্ — গদ্গদভাবে, ভীতভীতঃ— ভীতচিত্তে, প্রণম্য – প্রণাম করে।
অনুবাদঃ ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ, জয়দ্রথ এবং অন্যান্য যুদ্ধ বীরগণ পূর্বেই আমার দ্বারা নিহত হয়েছে। সুতরাং, তুমি তাদেরই বধ কর এবং বিচলিত হয়ো না। তুমি যুদ্ধে শত্রুদের নিশ্চয়ই জয় করবে, অতএব যুদ্ধ কর।
তাৎপর্যঃ পরম পুরুষোত্তম ভগবানের ইচ্ছা অনুসারেই সমস্ত পরিকল্পনা সাধিত হয়। কিন্তু তাঁর ভক্তদের প্রতি তিনি এতই করুণাময় যে, তাঁর ইচ্ছা অনুসারে তাঁর ভক্তেরা যখন তাঁর পরিকল্পনার রূপদান করেন, তখন তিনি তাঁর সমস্ত কৃতিত্ব তাঁর ভক্তদেরই দিতে চান। অতএব জীবনকে এমনভাবে পরিচালিত করা উচিত যে, প্রতিটি মানুষই যেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেবায় নিযুক্ত হতে পারেন এবং সদগুরুর মাধ্যমে পরম পুরুষোত্তম ভগবানকে হৃদয়ঙ্গম করতে পারেন। পরম পুরুষোত্তম ভগবানের পরিকল্পনাগুলি তাঁর কৃপার দ্বারাই কেবল বুঝতে পারা যায়। ভগবানের পরিকল্পনা ও ভগবদ্ভক্তের পরিকল্পনার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই এবং এই পরিকল্পনা অনুসরণ করলেই জীবন-সংগ্রামে জয়ী হওয়া যায়।
শ্লোকঃ ৩৫
সঞ্জয় উবাচ
এতচ্ছ্রত্বা বচনং কেশবস্য
কৃতাঞ্জলির্বেপমানঃ কিরীটী ।
নমস্কৃত্বা ভূয় এবাহ কৃষ্ণং
সগদ্গদং ভীতভীতঃ প্রণম্য ॥ ৩৫ ॥
সঞ্জয় উবাচ- সঞ্জয় বললেন; এতৎ- এই; শ্রুত্বা- শুনে; বচনম- বাণী; কেশবস্য- কেশবের; কৃতাঞ্জলিঃ- হাত জোড় করে; বেপমানঃ- কম্পিত কলেবরে; কিরীটী- অর্জুন; নমস্কৃত্বা- নমস্কার করে; ভূয়ঃ পুনরায়; এব- ও; আহ- বললেন; কৃষ্ণম- শ্রীকৃষ্ণকে; সগদগদম- গদ্গদভাবে; ভিতভীতঃ- ভীতচিত্তে; প্রণম্য- প্রণাম করে।
গীতার গান
সঞ্জয় কহিলেনঃ
অর্জুন শুনিয়া তাহা, কৃতাঞ্জলিপুটে ইহা,
কম্পিত শরীর পুনঃ পুনঃ।
নমস্কার করে ভূমে, ভয়ভীত সসম্ভ্রমে,
যে কহিল বলি তাহা শুন।।
অনুবাদঃ সঞ্জয় ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন- হে রাজন! ভগবান শ্রীকৃষ্ণের এই বাণী শ্রবণ করে অর্জুন অত্যন্ত ভীত হয়ে কম্পিত কলেবরে কৃতাঞ্জলিপুটে প্রণাম করে গদ্গদ বাক্যে শ্রীকৃষ্ণকে বললেন।
তাৎপর্যঃ আমরা আগেই বিশ্লেষণ করেছি, পরম পুরুষোত্তম ভগবানের বিশ্বরূপের প্রভাবে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তাতে অর্জুন বিস্ময়ে মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। তাই, তিনি কৃতাঞ্জলিপুটে বারবার শ্রীকৃষ্ণকে প্রণাম করতে থাকেন এবং গদ্গদ স্বরে তাঁর স্তব করতে থাকেন। শ্রীকৃষ্ণের প্রতি অর্জুনের এই ব্যবহার সখ্য-রসের অভিব্যক্তি নয়, তা হচ্ছে ভক্তের অদ্ভুত রসের ব্যবহার।