একাদশ অধ্যায়

বিশ্বরূপ-দর্শন-যোগ

শ্লোকঃ ১

অর্জুন উবাচ

মদনুগ্রহায় পরমং গুহ্যমধ্যাত্মসংজ্ঞিতম্ ।

যত্ত্বয়োত্তং বচস্তেন মোহোহয়ং বিগতো মম ।৷ ১ ৷৷

অর্জুনঃ উবাচ—অর্জুন বললেন, মদনুগ্রহায় – আমার প্রতি অনুগ্রহ করে, পরমম্ পরম; ওহাম্—গোপনীয়; অধ্যাত্ম – অধ্যাত্ম, সংজ্ঞিতম — বিষয়ক: য—যে; তয়া— তোমার দ্বারা; উক্ত—উক্ত হয়েছে; বচ: বাক্য; তেন—তার দ্বারা; মোহঃ- মোহ; অয়ম্—এই বিগতঃ দূর হয়েছে, মম – আমার।

গীতার গান

অর্জুন কহিলেনঃ

অনুগ্রহ করি মোরে শুনাইলে যাহা ।

মোহ নষ্ট হইয়াছে শুনি তত্ত্ব তাহা ।।

সেই সে অধ্যাত্ম তত্ত্ব অতি গুহ্যতম ৷

বিগত সন্দেহ হল যত ছিল মম ।।

অনুবাদঃ অর্জুন বললেন—আমার প্রতি অনুগ্রহ করে তুমি যে অধ্যাত্মতত্ত্ব সম্বন্ধীয় পরম গুহ্য উপদেশ আমাকে দিয়েছ, তার দ্বারা আমার এই মোহ দূর হয়েছে।

তাৎপর্যঃ শ্রীকৃষ্ণ যে সর্ব কারণের পরম কারণ, তা এই অধ্যায়ে বর্ণনা করা হয়েছে। সমগ্র জড় জগতের প্রকাশ হয় মহাবিষ্ণু থেকে এবং শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন সেই মহাবিষ্ণুর ও উৎস। শ্রীকৃষ্ণ অবতার নন, তিনি হচ্ছেন সমস্ত অবতারের অবতারী। সেই কথা পূর্ববর্তী অধ্যায়ে পূর্ণরূপে বর্ণনা করা হয়েছে।

এখানে অর্জুন বলেছেন, তাঁর মোহ নিরসন হয়েছে। অর্থাৎ, অর্জুন শ্রীকৃষ্ণকে একজন সাধারণ মানুষ বলে মনে করছেন না, তাঁর বন্ধু বলেও মনে করছেন না; তিনি তাঁকে সমস্ত কিছুর পরম উৎসরূপে দর্শন করছেন। অর্জুন পূর্ণ জ্ঞান প্রাপ্ত হয়েছেন এবং পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে যে তিনি বন্ধুরূপে পেয়েছেন, তা উপলব্ধি করে পরম আনন্দ আস্বাদন করছেন। কিন্তু সেই সঙ্গে সঙ্গে তিনি এটিও ভাবছেন যে, তিনি তো শ্রীকৃষ্ণকে পরমেশ্বর ভগবান, সর্ব কারণের কারণরূপে জানতে পারলেন, কিন্তু অন্যেরা তো তাঁকে সেভাবে গ্রহণ নাও করতে পারে। তাই শ্রীকৃষ্ণের পরমেশ্বরত্ব প্রতিপন্ন করবার জন্য, সকলকেই শ্রীকৃষ্ণের ভগবত্তা সম্বন্ধে জানাবার জন্য এই অধ্যায়ে তিনি শ্রীকৃষ্ণকে অনুরোধ করছেন যাতে তিনি তার বিশ্বরূপ প্রদর্শন করেন। প্রকৃতপক্ষে শ্রীকৃষ্ণের বিশ্বরূপ অতি ভয়ংকর এবং সেই রূপ দর্শনে সকলেই ভীত হয়— যেমন অর্জুন হয়েছিলেন। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ এতই দয়াময় যে, সেই ভয়ংকর বিশ্বরূপ প্রদর্শন করার পর তিনি আবার তাঁর আদিরূপ — দ্বিভুজ শ্যামসুন্দর রূপে নিজেকে প্রকাশিত করলেন। শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে যে তত্ত্বজ্ঞান দান করলেন, অর্জুন তা শাশ্বত সত্যরূপে গ্রহণ করলেন। অর্জুনের মঙ্গলের জন্যই শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে সব কিছু শোনালেন এবং অর্জুনও তা শ্রীকৃষ্ণের কৃপারূপে গ্রহণ করলেন। তাঁর মনে আর কোন সংশয় রইল না যে, শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন সর্ব কারণের পরম কারণ এবং পরমাত্মা রূপে তিনি সকলের হৃদয়ে বিরাজমান।

শ্লোকঃ ২

ভবাপ্যয়ৌ হি ভূতানাং শ্রুতৌ বিস্তরশো ময়া ৷

ত্বত্তঃ কমলপত্রাক্ষ মাহাত্ম্যমপি চাব্যয়ম্ ॥ ২ ॥

ভব—উৎপত্তি; অপায়ৌ—লয়; হি—অবশ্যই; ভূতানাম্ — সমস্ত জীবের তৌ শ্রুত হয়েছে; বিস্তরণঃ– বিস্তারিতভাবে: মা— আমার দ্বারা; ত্বত্তঃ- তোমার থেকে, কমলপত্রাক্ষ—হে পদ্মপলাশলোচন; মাহাত্ম্যম্ — মাহাত্ম্য; অপিচ এবং অব্যয়ম্—অব্যয়।

গীতার গান

দুই তত্ত্ব শুনিলাম কমল পত্রাক্ষ ৷

সৃষ্টি, স্থিতি, লয় আর নিত্য তত্ত্ব ।।

এই সৃষ্টিমধ্যে যথা তুমি হে পরমেশ্বর ।

নিজ রূপ প্রকটিয়া প্রকাশ বিস্তর ।।

অনুবাদঃ হে পদ্মপলাশলোচন! সর্বভূতের উৎপত্তি ও প্রলয় তোমার থেকেই হয় এবং তোমার কাছ থেকেই আমি তোমার অব্যয় মাহাত্ম্য অবগত হলাম।

তাৎপর্যঃ পূর্ববর্তী একটি অধ্যায়ে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে নিশ্চিতভাবে জানিয়েছেন যে, অহং কৃৎসা জগতঃ প্রভবঃ প্রলয়তথা — “আমি এই সমগ্র জড়-জাগতিক প্রকাশের সৃষ্টির ও লয়ের উৎস, তাই আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে অর্জুন শ্রীকৃষ্ণকে কমলপত্রাক্ষ বলে সম্বোধন করেছেন (কারণ শ্রীকৃষ্ণের চোখ দুটি পদ্মফুলের পাপড়ির মতো)। পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মুখপদ্ম থেকে অর্জুন সেই সম্বন্ধে বিস্তারিতভাবে শ্রবণ করেছেন। অর্জুন আরও জানতে পারেন যে, এই বিশ্বচরাচরের সব কিছুরই প্রকাশ এবং লয়ের পরম কারণ হওয়া সত্ত্বেও ভগবান সব কিছু থেকে পৃথক । নবম অধ্যায়ে ভগবান বলেছেন, যদিও তিনি সর্বব্যাপক, কিন্তু তবুও তিনি ব্যক্তিগতভাবে সর্বত্রই বিরাজমান থাকেন না। সেটিই হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণের অচিন্ত্য যোগেশ্বর্য, যা অর্জুন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছেন বলে স্বীকার করেছেন।

শ্লোকঃ ৩

এবমেতদ্ যথাত্থ ত্বমাত্মানং পরমেশ্বর ।

দ্রষ্টুমিচ্ছামি তে রূপমৈশ্বরং পুরুষোত্তম ॥ ৩॥

এব—এরূপ; এবং–এই; যথা — যথাযথ, আখ বলেছ; ত্বম্ — ভুমি; আত্মানম্ নিজেকে পরমেশ্বর— হে পরমেশ্বর ভগবান; দুষ্টুম্—দেখতে; ইচ্ছামি — ইচ্ছা করি; তে— তোমার; রূপম্—রূপ; ঐশ্বরম্ -ঐশর্যময়; পুরুষোত্তম – হে পুরুষোত্তম।

গীতার গান

পুরুষোত্তম সে যদি দেখাও আমাকে ।

ইচ্ছা মোর দেখিবার যদি শক্তি থাকে ৷।

অনুবাদঃ হে পরমেশ্বর ! তোমার সম্বন্ধে যেরূপ বলেছ, যদিও আমার সম্মুখে তোমাকে সেই রূপেই দেখতে পাচ্ছি, তবুও হে পুরুষোত্তম। তুমি যেভাবে এই বিশ্বে প্রবেশ করেছ, আমি তোমার সেই ঐশ্বর্যময় রূপ দেখতে ইচ্ছা করি।

তাৎপর্যঃ ভগবান বলছেন যে, এই জড় জগতে তিনি স্বাংশ প্রকাশরূপে প্রবিষ্ট হয়েছেন বলেই এই জগতের সৃষ্টি সম্ভব হয়েছে এবং তা বিদ্যমান রয়েছে। শ্রীকৃষ্ণের এই কথা শুনে অর্জুন অনুপ্রাণিত হয়েছেন। কিন্তু অর্জুনের মনে সংশয় দেখা দিল যে, আগামী দিনের মানুষেরা হয়ত শ্রীকৃষ্ণকে একজন সাধারণ মানুষ বলে মনে করতে পারে, তাই তাদের হৃদয়ে শ্রীকৃষ্ণের ভগবত্তা সম্বন্ধে দৃঢ় প্রত্যয় উৎপাদন করবার জন্য তিনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বিশ্বরূপ দেখতে চাইলেন। তিনি দেখতে চাইলেন, এই জগৎ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন হওয়া সত্ত্বেও শ্রীকৃষ্ণ কিভাবে এই জগতের অভ্যন্তরে সমস্ত কর্ম পরিচালনা করছেন। এখানে অর্জুন যে পরমেশ্বর ভগবানকে পুরুষোত্তম বলে সম্বোধন করেছেন, সেটিও তাৎপর্যপূর্ণ। যেহেতু শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরম পুরুষোত্তম ভগবান, তাই তিনি অর্জুনের অন্তরেও বিরাজমান। সুতরাং, অর্জুনের হৃদয়ের সমস্ত বাসনার কথা তিনি জানতেন এবং তিনি এটিও জানতেন যে, তাঁর বিশ্বরূপ দর্শন করার কোন বিশেষ বাসনা অর্জুনের ছিল না। কারণ, তাঁর দ্বিভুজ শ্যামসুন্দর রূপ দর্শন করেই অর্জুন পূর্ণমাত্রায় তৃপ্ত ছিলেন। কিন্তু তিনি জানতেন যে, অন্যদের হৃদয়ে বিশ্বাস উৎপাদন করবার জন্যই অর্জুন তাঁর বিশ্বরূপ দর্শন করতে চাইছিলেন। ভগবানের ভগবত্তা সম্বন্ধে অর্জুনের আর কোন রকম সন্দেহ ছিল না। তাই, তাঁর নিজের মনের সন্দেহ নিরসন করার জন্য তিনি ভগবানের বিশ্বরূপ দর্শন করতে চাননি। শ্রীকৃষ্ণ আরও জানতেন যে, অর্জুন তাঁর বিশ্বরূপ দর্শন করতে চাইছিলেন একটি নীতির প্রতিষ্ঠা করবার জন্য। কারণ, পরবর্তীকালে বহু ভঙ নিজেদেরকে ভগবানের অবতার বলে প্রতিপন্ন করবার চেষ্টা করবে। সুতরা, মানুষকে সাবধান করতে হবে। তাই অর্জুন শিক্ষা দিয়ে গেলেন, কেউ যদি নিজেদেরকে ভগবান বলে প্রতিপন্ন করতে চায়, তা হলে সেই দাবির যথার্থতা সুষ্ঠুভাবে প্রতিপন্ন করবার জন্য তাকে বিশ্বরূপ দেখাতে হবে।

error: Content is protected !!