আমরা বিশশতকের অধিবাসী। আর একটি দশক কেটে গেলে আমরা পৌছোবো একুশশতকে। বাঙলা সাহিত্যের শুরু হয়েছিলো আজ থেকে হাজার বছরেরও বেশি আগে। শুরুর দিকে ছিলেন কাহ্নপাদ-লুইপাদেরা; আমরা আছি এ-প্রান্তে। তবে শেষ প্রান্তে নয়। আরো অনেক শতক টিকে থাকবে বাঙলা ভাষা ও সাহিত্য। রূপ নেবে নতুন নতুন, হয়তো এমন রূপ নেবে, এমন হবে তার শোভা, যা আজ ভাবতেও পারছি না। গত এক হাজার বছরেও নিয়েছে নতুন নতুন রূপ। ছড়িয়েছে অভাবিত শোভা আর সৌন্দর্য। এক হাজার বছরের দীর্ঘ যাত্রায় কতো রকমের পথ তৈরি করেছে, বাঁক নিয়েছে নানা ধরনের। উনিশশতকে বাঙলা সাহিত্য হয়ে উঠেছিলো একধরনের আধুনিক। উনিশশতকি আধুনিক। বিশশতকে বাঙলা সাহিত্য হয়ে ওঠে নতুন ধরনের আলোতে উজ্জ্বল। হয়ে ওঠে বিশশতকি আধুনিক। আধুনিকতা বলতে এখন আমরা বিশশতকের আধুনিকতাকেই বুঝে থাকি। কবিতা, উপন্যাস, গল্প, নাটক সব এলাকায়ই বিশশতকে দেখা দেয় নতুন চেতনা, নতুন সৌন্দর্য। বিশশতকের বাঙলা সাহিত্য থেকে বিচ্ছুরিত হয় দুরূহ জটিল অভিনব আলো।
প্রতিটি শতক বা শতাব্দীর থাকে নিজস্ব চেতনা। উনিশশতকের নিজস্ব ভালো লাগা মন্দ লাগা ছিলো, নিজস্ব আবেগঅনুভূতি, স্বপ্ন, চেতনা ছিলো। তার প্রকাশ ঘটেছে ওই শতকের সাহিত্যে। একটি শতক কেটে গিয়ে যখন আসে আরেকটি শতক, তখন নববর্ষের মতো রাতারাতি নতুন চেতনার উন্মেষ-বিকাশ ঘটে না। নতুন শতকের এক বা দু-দশক। ধরে জীবনে ও সাহিত্যে রাজত্ব করতে থাকে পুরোনো শতকেরই চেতনা। তারপর এক সময় প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় তার বিরুদ্ধে। হয়তোবা দেশে বা বিশ্বে ঘটে কোনো বড়ো ঘটনা, যা প্রবলভাবে আলোড়িত করে জীবনকে। তখন সাহিত্য ও শিল্পকলায় নতুন চেতনা অভিনব রূপ ধরে দেখা দেয়। ইউরোপে উনিশশতকের শেষ দিকেই উনিশশতকি চেতনার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিলো। কিন্তু আমাদের দেশ প্রথাগত; পুরোনোকে আঁকড়ে থাকতেই আমরা ভালোবাসি। নতুনকে আমরা খুব ভয় করি। তাই প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে সময় লাগে। এ-কারণেই বিশশতক আসার পরও দু-দশক ধরে বাঙলা সাহিত্যে উনিশশতকের চেতনাই প্রকাশ পেতে থাকে। কারণ রবীন্দ্রনাথ তখন লিখে চলছিলেন তাঁর অসামান্য কবিতাগুলো। তখনো ওই কবিতার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়ার সময় আসে নি।
বিশশতকের দ্বিতীয় দশকে, ১৯১৪-১৯১৮তে, ঘটে মানুষের ইতিহাসের প্রথম সবচেয়ে বড় সংকট। ওই সংকটের নাম প্রথম মহাযুদ্ধ। ওই মহাযুদ্ধে আমাদের দেশ পশ্চিমের মতো জড়িয়ে পড়ে নি; কিন্তু তার উত্তাপ থেকে দূরেও থাকতে পারে নি আমাদের দেশ, জীবন ও সাহিত্য। প্রথম মহাযুদ্ধ ইউরোপকে বদলে দেয়। বদল ঘটে ইউরোপীয় চেতনার। অবিশ্বাস, ক্লান্তি, অমানবিকতা, নৈরাশ্য প্রভৃতি ইউরোপীয় সাহিত্যে নানাভাবে প্রকাশ পেয়ে সৃষ্টি করে নতুন সাহিত্য। আধুনিক সাহিত্য। বাঙলা সাহিত্যেও তার প্রভাব পড়ে; এবং বিকশিত হয় বিশশতকের আধুনিক সাহিত্য। তবে তার জন্যে আমাদের প্রায় আড়াই দশক অপেক্ষা করতে হয়েছিলো। বলা যায়, বাঙলা সাহিত্যে বিশশতক এসেছিলো বিশশতকের তৃতীয় দশকের মাঝামাঝি। প্রথমে এসেছিলো কবিতায়, যাকে বলি আধুনিক কবিতা। ওই আধুনিক কবিতাই বিশশতকের বাঙলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সম্পদ, উজ্জ্বলতম আলোকমালা।
বিশশতকের প্রথম দু-দশকে রবীন্দ্রনাথ লিখে চলছিলেন তাঁর চল্লিশোর বয়সের আশ্চর্য কবিতাবলি। তাঁর কবিতার রোম্যান্টিক বন্যায় তখন প্লাবিত পাঠকের চিত্ত। এ-সময় বের হয় তাঁর নৈবেদ্য (১৯০১), খেয়া (১৯০৬), শিশু (১৯০৯), গীতাঞ্জলি (১৯১০), বলাকা (১৯১৬)। তখন বাঙলা কবিতায় রবীন্দ্র-যুগ চলছে। তাঁর কবিতা অসামান্য কিন্তু চেতনায় তা উনিশশতকেরই। জীবনের প্রথমার্ধে যে-সব বোধবিশ্বাসআবেগ অঙ্কুরিত হয়েছিলো তার মনোলোকে, এ-সময়ে তাই পুষ্পিত হয়ে উঠছিলো তাঁর কবিতায়। ওই সব পুষ্পের মূল ছিলো উনিশশতকে। তখন দেখা দিয়েছিলেন একগোত্র তরুণ কবি, যাঁরা ছিলেন পুরোপুরি রবীন্দ্রানুসারী। ওই কবিদের কেউকেউ কিছুকিছু চমৎকার কবিতা লিখেছেন, কিন্তু তাতে বিশশতককে পাওয়া যায় না। তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত (১৮৮২-১৯২২)। তিনি প্রচুর লিখেছিলেন, হালকা ছন্দের যাদু সৃষ্টি করে ছন্দের যাদুকর’ উপাধিও পেয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর কবিতার মূল্য কম। তিনি বেশিদিন বাঁচেন নি; বাঁচলেও যে খুব বড় কবি হয়ে উঠতেন, এমন মনে হয় না। তাঁর কয়েকটি কাব্য বেণু ও বীণা (১৯০৬), হোমশিখা (১৯০৭), কুহু ও কেকা (১৯১২), অভ্র-আবীর (১৯১৬)। এ-সময়ে যতীন্দ্রমোহন বাগচী (১৮৭৮-১৯৪৮] লিখেছিলেন গুটিকয় মনোরম কবিতা। কাজলা-দিদি’ নামের একটি বেদনাকাতর কবিতার জন্যে তিনি প্রিয় হয়ে আছেন। তাঁর কাব্য হচ্ছে রেখা (১৯১০), অপরাজিতা (১৯১৩), নাগকেশর (১৯১৭)। কুমুদরঞ্জন মল্লিক (১৮৮২-১৯৭০) লিখেছিলেন পল্লীপ্রেমের কবিতা। তাঁর কাব্য উজানী (১৯১১), বনতুলসী (১৯১১), বনমল্লিকা (১৯১৮), রজনীগন্ধা (১৯২১)। তাঁরা ছিলেন রবীন্দ্রপ্রভাবিত। বুদ্ধদেব বসু তাঁদের সম্বন্ধে বলেছেন যে তাঁদের পক্ষে অনিবার্য ছিলো রবীন্দ্রনাথের অনুকরণ, এবং অসম্ভব ছিলো রবীন্দ্রনাথের অনুকরণ। তাঁরা কবিতায় এমন কিছু করতে পারেন নি যাকে বলা যায় গুরুত্বপূর্ণ। বিশশতকের চেতনা তাঁদের কবিতায় নেই। এ-কবিরা পুড়েছেন রবীন্দ্রআগুনে।
ওই সময়ে রবীন্দ্রপ্রভাব থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন ছিলো। বেরিয়ে যে আসতে হবে, তাই মনে পড়ে নি অধিকাংশের। কারোকারো মনে পড়ছিলো; এবং খুঁজছিলেন নতুন কবিতার পথ। কিন্তু তাঁরা রবীন্দ্রনাথ থেকে কিছুটা বেরিয়ে এলেও সত্যিকারভাবে নতুন, আধুনিক কবিতার ধারা সৃষ্টি করতে পারেন নি। তাঁরা মোহিতলাল মজুমদার [১৮৮৮-১৯৫২], যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত [১৮৮৭-১৯৫৪], ও কাজী নজরুল ইসলাম [১৮৯৯-১৯৭৬]। মোহিতলালের কাব্যগ্রন্থ হচ্ছে স্বপন-পসারী (১৯২২), বিস্মরণী (১৯২৭), স্মর-গরল (১৯৩৬)। যতীন্দ্রনাথের কাব্য হচ্ছে মরীচিকা (১৯২৩), মরুশিখা (১৯২৭), মরুমায়া (১৯৩০)।
কবি হিশেবে কাজী নজরুল ইসলাম অত্যন্ত বিখ্যাত। বিদ্রোহী কবি’ উপাধিটি তাঁর নামের সাথে জড়িয়ে গেছে। তবে তিনি শুধু বিদ্রোহী ছিলেন না। বিদ্রোহের বিপরীত আবেগও রয়েছে তাঁর কবিতায়। তাঁর কবিতায় তারুণ্যের আবেগ প্রকাশ পেয়েছে খুব; আর প্রেমের কবিতায় প্রকাশ পেয়েছে কৈশোরিক কাতরতা। তাঁর খ্যাতির মূলে সামাজিকরাজনীতিক কারণ রয়েছে প্রবলভবে। তাঁর কাব্য হচ্ছে অগ্নিবীণা (১৯২২), দোলনচাঁপা (১৩৩০), ভাঙ্গার গান (১৩৩১), পুবের হাওয়া (১৩৩২), বিষের বাঁশী (১৩৩১), ছায়ানট (১৩৩০)। নজরুল একজন মহাপদ্যকার।
জসীমউদদীনও (১৯০৩-১৯৭৬) ভিন্ন ধরনের কবিতা লিখেছিলেন। পল্লীর জীবন ও কিংবদন্তি অবলম্বন করে কবিতা লিখে বিখ্যাত হয়েছিলেন তিনি পল্লীকবি’ নামে। কুমুদরঞ্জন মল্লিকের প্রভাব আছে তার ওপর। তাঁর কাব্য হচ্ছে রাখালী (১৯২৭), নকসী কাথার মাঠ (১৩৩৬), বালুচর (১৩৩৭), সোজনবাদিয়ার ঘাট (১৯৩৩)।
বিশশতকের তৃতীয় দশকের মাঝামাঝি দেখা দেয় আধুনিক কবিতা। এ-কবিতার মধ্যদিয়েই বিশশতক প্রবেশ করে বাঙলা সাহিত্যে। রবীন্দ্রনাথের কবিতার পর আধুনিক কবিতায়ই প্রকৃত অভিনব সৃষ্টি বাঙলা সাহিত্যে। মূল্যবানও বটে। এরচেয়ে মূল্যবান আর কিছু সৃষ্টি হয় নি বিশশতকের বাঙলা সাহিত্যে। আধুনিক কবিতা ও এর আগের কবিতার মধ্যে দুস্তর ব্যবধান। এ-কবিতায় বদলে যায় বাঙালির চেতনা। দেখা দেয় নতুন জটিল বিস্ময়কর শোভা। বিশশতকের প্রাণ ধরা পড়েছে এ-কবিতায়। এর আগের কবিতা পড়ে বুঝতে, অন্তত তার অর্থ বুঝে উঠতে পারে যে-কোনো সাধারণ শিক্ষিত বাঙালি। কিন্তু একবিতা তাঁদের কাছে মনে হবে দুরূহ-দুর্বোধ্য। এর আগের কবিতা প্রধানত রোম্যান্টিক কারণ তখন প্রাধান্য বিস্তার করে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ওই কবিতায় শব্দগুলো কঠিন নয়, ভাবও দুরূহ নয়। অধিকাংশ কবিতায়ই প্রকাশ পেয়েছে এমন বক্তব্য, যার মোটামুটি সারাংশ করা কঠিন নয়। ওই সমস্ত কবিতায় বাঙালির প্রথাগত আবেগ, স্বপ্ন, সুখদুঃখ, কাতরতা ও বিশ্বাস প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু আধুনিক কবিতা তার পুরোপুরি বিপরীত। একবিতায় বদলে যায় ভাব, বদলে যায় ভাষা। বিশ্বাস, শান্তি, সুন্দর, কল্যাণ প্রভৃতির কথা বাঙলা কবিতায় বড়ো বেশি বলা হয়েছে। আধুনিক কবিরা বাদ দেন সে-সব জিনিশ। আগের কবিতার বাঙলা ছিলো পল্লীবাঙলা। আধুনিক কবিরা বেছে নেন নগরকে; রচনা করেন তার সুন্দর-অসুন্দর চিত্র। তাঁরা ক্লান্তির কথা বলেন, অবিশ্বাসের কথা বলেন, নিরাশার কথা বলেন। তাঁরা বলেন ব্যক্তিগত যন্ত্রণা ও নৈঃসঙ্গের কথা, প্রকাশ করেন বিভিন্ন রকমের কামনাবাসনা। এসব কথা বলেন এক ভিন্ন ধরনের বাঙলা ভাষায়। সে-ভাষা জটিল, দুরূহ। ছন্দ বদলে দেন এবং ছন্দের বদলে কবিতা লেখেন গদ্যে। কবিতায় তারা খচিত করেন মননশীলতা। বাঙলা ভাষার আগের কবিরা আবেগকেই কবিতা ভাবতেন। আধুনিক কবিরা আবেগকে শশাধিত করেন মননশীলতা দিয়ে। তাঁরা সবাই অসামান্য শিক্ষিত কবি। নতুন কবিতা সৃষ্টির জন্যে তাঁরা ছুটেছেন বিদেশি কবিতা থেকে কবিতায়। ইংরেজি, ফরাশি, জর্মন কবিতা থেকে তাঁরা সংগ্রহ করেছেন প্রেরণা; এবং জ্ঞানের বিভিন্ন শাখা থেকে শিখেছেন তাঁরা অনেক কিছু। স্বাভাবিক প্রতিভা ও অধীত জ্ঞানের মিলনে সৃষ্টি হয়েছে তাদের কবিতা।
বাঙলা ভাষায় যাঁরা আধুনিক কবিতা সৃষ্টি করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে পাঁচজন প্রধান। রবীন্দ্রনাথের পর তাঁরাই বাঙলা ভাষার প্রধান কবি। তাঁরা হচ্ছেন বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-১৯৭৪), জীবনানন্দ দাশ [১৯৯৯-১৯৫৪), সুধীন্দ্রনাথ দত্ত (১৯০১-১৯৬০], বিষ্ণু দে [১৯০৯-১৯৮২) ও অমিয় চক্রবর্তী (১৯০১-১৯৮৬]। এ-পাঁচজন কবি মিলে সৃষ্টি করেন বাঙলা ভাষায় আধুনিক কবিতা। প্রেমেন্দ্র মিত্রও (১৯০৪-১৯৮৭) সাহায্য করেছিলেন আধুনিক কবিতার বিকাশে; কিন্তু তিনি চেতনার দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়েন। তাই পুরোপুরি আধুনিক ও গুরুত্বপূর্ণ কবি হয়ে উঠতে পারেন নি। আধুনিক কবিতার উদ্ভবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলো কয়েকটি সাহিত্যপত্রিকা। এর মাঝে দুটি – কল্লোল (১৯২৩), ও কালি-কলম (১৯২৬), বেরোতে কলকাতা থেকে; এবং একটি – প্রগতি (১৯২৭)—বেরোত ঢাকা থেকে। আধুনিক কবিতার বিকাশে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলো একটি কবিতাপত্রিকা। নাম কবিতা (১৯৩৫)। বুদ্ধদেব বসু ছিলেন কবিতার সম্পাদক। আধুনিক কবিতা কিন্তু শুরুতেই সাদর অভ্যর্থনা পায় নি; বরং বিরূপতার মুখখামুখি হয়েছিলো বেশ। এমনকি রবীন্দ্রনাথও ছিলেন আধুনিকদের বিরোধী। কারণ আধুনিকেরা ছিলেন রবীন্দ্রবিরোধী। আধুনিকেরা এমন কবিতা সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন, যা রবীন্দ্রনাথের কবিতার সম্পূর্ণ বিপরীত। তাঁরা ছেড়ে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের বিশ্বাস ও আবেগ; ত্যাগ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের ভাষা ও ছন্দ। নতুনের বিকাশ হয় পুরোনো প্রধানের সাথে সংঘর্ষে। আগের রাজাকে হটাতে না পারলে সিংহাসন অধিকার করা যায় না। আধুনিকেরা বাঙলা কবিতার সিংহাসন অধিকার করেছিলেন রবীন্দ্রনাথকে সিংহাসনচ্যুত করে। আধুনিক কবিতার সূচনা-বছর হিশেবে ১৯২৫কে চিহ্নিত করা যায়। বিশের দশকের দ্বিতীয়ার্ধে হয়েছে আধুনিক বাঙলা কবিতার সূচনা; আর ত্রিশের দশকে ঘটেছে তার বিকাশ ও প্রতিষ্ঠা।
বুদ্ধদেব বসুর কথা ভাবলে রবীন্দ্রনাথকে মনে পড়ে। প্রতিভার বিচিত্রমুখিতায় রবীন্দ্রনাথই তাঁর তুলনা। তিনি কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার, অনুবাদক, সমালোচক, ও সম্পাদক। সব এলাকায়ই গুরুত্বপূর্ণ। আধুনিক কবিদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ নন তিনি, তবে প্রধান পুরোহিত। কবিতা সম্পাদনা করে, আধুনিক কবি ও কবিতার পক্ষে প্রবন্ধ লিখে, বিশ্বের আধুনিক কবিতা অনুবাদ করে তিনি আমাদের আধুনিকতার শিক্ষক হয়ে আছেন। তিনি আধুনিক কবিদের মধ্যে সবচেয়ে গীতিময় ও আবেগপ্রবণ; এবং তীব্রভাবে সংরক্ত। কামনাবাসনার রঙিন প্রকাশ ঘটেছে তাঁর কবিতায়। তাঁর কাব্যগ্রন্থ হচ্ছে বন্দীর বন্দনা ও অন্যান্য কবিতা (১৯৩০), একটি কথা (১৯৩২), কঙ্কাবতী ও অন্যান্য কবিতা (১৯৩৭), দয়মন্তী (১৯৪৩), শীতের প্রার্থনা : বসন্তের উত্তর (১৯৫৫), যে-আঁধার আলোর অধিক (১৯৫৮), মরচে-পড়া পেরেকের গান (১৯৬৬), স্বাগতবিদায় ও অন্যান্য কবিতা (১৯৭১)। অনুবাদ করেছিলেন তিনি বোদলেয়ার, হ্যেল্ডার্লিন, রাইনের মারিয়া রিলকে ও আরো কয়েকজন কবির কবিতা। শার্ল বোদলেয়ার : তাঁর কবিতা (১৯৬১), অনুবাদ হিশেবে অসামান্য। এটি পরবর্তী আধুনিক কবিদের প্রভাবিত করেছে নানাভাবে। তপস্বী ও তরঙ্গিনী (১৯৬৬) অতুলনীয় নাটক। তাঁর প্রবন্ধগ্রন্থ কালের পুতুল (১৯৪৬) ও সাহিত্যচর্চা (১৩৬১) আধুনিক কবিতার চমৎকার ভাষ্য। বুদ্ধদেব বসু সাহিত্যকে, বিশেষ করে কবিতাকে, করে তুলেছিলেন নিজের জীবন। বুদ্ধদেব বসুর কবিতার একটি স্তবক :
দুঃখ আমাদের মুখরা ননদিনী, মৃত্যু আমাদের পূজ্য ব্রাহ্মণ,
তবু তো কিছু ভালো মেনেছি সংসারে, জেনেছি দেবতারা বন্ধু–
যেহেতু ফলে ওঠে সোনালি ধান আর সোনার সন্তান মায়ের কোলে,
এবং অগ্নি ও জলের মিতালিতে অমৃতস্বাদ পায় অন্ন।
বল তো, বোন, কবে আবার মধুমতী গাভীর বাঁট হবে উচ্ছল?
টেকির গম্ভীর শব্দ দিয়ে তাল জাগবে হাতে-পায় ভঙ্গি?
ব্যাঙের ছাতা কবে সাজাবে পৃথিবীরে? ডাকবে উল্লাসে দর্দুর?
শিশিরবিন্দুর আদরে ভরপুর ঝুলবে আঙিনায় কুমড়ো?
স্তবক দুটি নেয়া হয়েছে ‘গাঁয়ের মেয়েরা কবিতা থেকে। কবিতাটি আছে তপস্বী ও তরঙ্গিনী নাটকে।
আধুনিকদের মধ্যে এখন জীবনানন্দ দাশ সবচেয়ে জনপ্রিয়; এবং অনেকের মতে-শ্রেষ্ঠ। রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবিতাকে বলেছিলেন চিত্ররূপময়’; এবং বুদ্ধদেব বসু তাঁকে বলেছিলেন নির্জনতম কবি’। রবীন্দ্রনাথের ‘চিত্ররূপময়’ কথাটি খুব প্রশংসার ছিলো না; কারণ চিত্রের মতো সুন্দর হওয়া রোম্যান্টিক দৃষ্টিতে খুব ভালো ব্যাপার নয়। তবে আজকাল রবীন্দ্রনাথের কথাটিকে প্রশংসা হিশেবেই ধরা হয়ে থাকে। আসলে জীবনানন্দের কবিতা চিত্রকল্পময়। আধুনিকদের মধ্যে ব্যক্তিগত জীবনে সবচেয়ে ব্যর্থ ছিলেন জীবনানন্দ। মৃত্যুও হয়েছিলো তার দুর্ঘটনায় ট্রামের নিচে পড়ে লোকান্তরিত হয়েছিলেন জীবনানন্দ। হয়তো আত্মহত্যা করেছিলেন। করুণ, বিন্ন, স্বপ্নময়, আর আশ্চর্য শোভাময় তাঁর কবিতা। ক্লান্তি, বিষাদ, হতাশা প্রভৃতি তাঁর কবিতায় সোনার টুকরোর মতো সুন্দর হয়ে আছে। তাঁর কবিতা অন্তর্গত আলোড়নের কবিতা। বাঙলার অতীত ও বর্তমান প্রাকৃতিক শোভা তাঁর কবিতায়ই অপরূপ হয়ে ফুটে উঠেছে। কোমলতা তাঁর কবিতার বড়ো বৈশিষ্ট্য; তবে শেষদিকে তাঁর কবিতা হয়ে উঠেছিলো কিছুটা কর্কশ। আধুনিক কালের অধিকাংশ শ্রেষ্ঠ উপমা রচনা করেছিলেন জীবনানন্দ দাশ। একসময় তাঁকে শুধু কবি, এবং শুধু কবিই ভাবা হততা। কিন্তু সম্প্রতি তাঁর কয়েকটি অপ্রকাশিত ও অজ্ঞাত উপন্যাস পাওয়া গেছে। ওইগুলোও রচনা হিশেবে অসামান্য। ত্রিশের দশকে এগুলো বেরোলে তিনি একজন প্রধান ঔপন্যাসিকের মর্যাদাও পেতেন। কিন্তু যখন বেঁচেছিলেন, তখন বেশি কিছু পান নি। জীবনানন্দ। এখন পাচ্ছেন শ্রেষ্ঠ আধুনিকের মর্যাদা। তাঁর কাব্যগ্রন্থ হচ্ছে ঝরাপালক (১৩৩৪), ধূসর পাণ্ডুলিপি (১৩৪৩), বনলতা সেন (১৩৪৯), মহাপৃথিবী (১৩৫১), সাতটি তারার তিমির (১৩৫৫), রূপসী বাংলা (১৯৫৭), বেলা অবেলা কালবেলা (১৯৬১)। তাঁর প্রবন্ধগ্রন্থের নাম কবিতার কথা, উপন্যাসের নাম মাল্যবান। জীবনানন্দের রূপভারাতুর একটি কবিতার অংশ :
চারিদিকে নুয়ে পড়ে ফলেছে ফসল,
তাদের স্তনের থেকে ফোঁটা-ফোটা পড়িতেছে শিশিরের জল;
প্রচুর শস্যের গন্ধ থেকে-থেকে আসিতেছে ভেসে
পেঁচা আর ইদুরের ঘ্রাণে ভরা আমাদের ভাঁড়ারের দেশে!
শরীর এলায়ে আসে এইখানে ফলন্ত ধানের মতো করে
যেই রোদ একবার এসে শুধু চলে যায় তাহার ঠোটের চুমো ধরে
আহ্লাদের অবসাদে ভরে আসে আমার শরীর,
চারিদিকে ছায়া-রোদ-খুদ-কুঁড়ো-কার্তিকের ভিড়;
চোখের সকল ক্ষুধা মিটে যায় এইখানে, এখানে হতেছে স্নিগ্ধ কান,
পাড়াগাঁর গায় আজ লেগে আছে রূপশালি-ধানভানা রূপসীর শরীরের ঘ্রাণ।
কবিতাটির নাম ‘অবসরের গান’। কবিতাটি আছে ধূসর পাণ্ডুলিপিতে। এটি একটি বিস্ময়কর কবিতা; কবিতাটি পড়ার সময় মনে হয় পৃথিবীতে এক পরম কাব্যিক সময় এসেছিলো, এবং সে-সময়টির খোঁজ পেয়ে জীবননান্দ তার সদ্ব্যবহার করেছিলেন প্রাণ ভরে।
সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, কারো কারো মতে, আধুনিক কবিদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। আবেগ ও মননশীলতার এক অসামান্য মিশ্রণ তাঁর কবিতা। আপাতদৃষ্টিতে সুধীন্দ্রনাথ আধুনিকদের মধ্যে সবচেয়ে দুরূহ কবি। অভিধান থেকে তিনি প্রচুর অপ্রচলিত শব্দ বেছে নিয়েছেন, এবং সেগুলোতে সঞ্চার করেছেন বিশশতকের উত্তাপ। সাধারণ পাঠকের পক্ষে অধিকাংশ শব্দের অর্থ বুঝে ওঠাই কঠিন তাঁর কবিতার; এবং সেগুলোতে তিনি প্রকাশ করেছেন যে-ভাব, তা বোঝাও সহজ নয়। দর্শন থেকে দর্শনে ফিরেছেন সুধীন্দ্রনাথ। তিনি বিশ্বাস করতে চেয়েছেন, কিন্তু অবিশ্বাসে তাঁর সমস্ত সত্তা ভরে গেছে। কিন্তু আবেগের মুহূর্তে তিনি দুলে উঠতে পারেন তীব্রভাবে। আধুনিক বাঙলা কবিতার কয়েকটি শ্রেষ্ঠ আবেগউদ্বেল প্রেমের কবিতা তিনিই লিখেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন শব্দই কবিতা; আর তিনি অবিশ্বাস করতেন অনুপ্রেরণায়। বাঙলার অধিকাংশ কবি সাধারণত স্বভাবকবি, সুধীন্দ্রনাথ পরিহার করেছিলেন স্বভাবকরিত্ব। তাই তাঁর কবিতা দুরূহ বলে মনে হয়। কবিতা ছাড়া তাঁর দুটি প্রবন্ধের বইও রয়েছে। তাঁর গদ্যও বাঙলা ভাষায় দুরূহতম। সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কাব্যগ্রন্থ হচ্ছে তন্বী (১৩৩৭), অর্কেস্ট্রা (১৯৩৫), ক্রন্দসী (১৩৪৪), উত্তরফাল্গনী (১৩৪৭), সংবর্ত (১৩৬০)। তাঁর অনূদিত কবিতাগ্রন্থের নাম প্রতিধ্বনি (১৩৬১)। তাঁর প্রবন্ধগ্রন্থ হচ্ছে স্বাগত (১৩৪৫), ও কুলায় ও কালপুরুষ (১৩৬৪)। তাঁর সমগ্র কবিতা এখন একসাথে পাওয়া যায় সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কাব্যসংগ্রহ -এ (১৯৬২); এবং সমস্ত প্রবন্ধ একসাথে পাওয়া যায় সুধীন্দ্রনাথ দত্তের প্রবন্ধসংগ্রহ -এ (১৩৯০)। তাঁর একটি আবেগস্পন্দিত কবিতার অংশ :
একদা এমনই বাদলশেষের রাতে–
মনে হয় যেন শতজনমের আগে—
সে এসে, সহসা হাত রেখেছিল হাতে,
চেয়েছিল মুখে সহজিয়া অনুরাগে।
সে-দিনও এমনই ফসলবিলাসী হাওয়া
মেতেছিল তার চিকুরের পাকা ধানে;
অনাদি যুগের যত চাওয়া, যত পাওয়া
খুঁজেছিল তার আনত দিঠির মানে।
একটি কথার দ্বিধাথরথর চুড়ে
ভর করেছিল সাতটি অমরাবতী;
একটি নিমেষ দাঁড়াল সরণী জুড়ে,
থামিল কালের চিরচঞ্চল গতি;
একটি পণের অমিত প্রগল্ভতা
মর্ত্যে আনিল ধ্রুবতারকারে ধরে;
একটি স্মৃতির মানুষী দুর্বলতা
প্রলয়ের পথ ছেড়ে দিল অকাতরে।
কবিতাটির নাম শাশ্বতী’, রয়েছে অর্কেস্ট্রা কাব্যগ্রন্থে।
অমিয় চক্রবর্তীকে আধুনিকদের মধ্যে সবচেয়ে শান্ত, স্নিগ্ধ, ধ্যানী বলে মনে হয়। বিশ্বাসী বলেও মনে হয়। সরল বলেও মনে হয়। কিন্তু তাঁর কবিতায়ও রয়েছে গভীর অবিশ্বাস, জটিলতা। মানসভ্ৰমণ চলেছে তাঁর দেশেদেশে, ঘুরেছেন তিনি দর্শন থেকে দর্শনে। তাঁর কবিতার স্বাদ পাওয়ার জন্যে বাইরের তীব্র জগৎকে ভুলে ঢুকতে হয় ভেতরে নমিতভাবে। কবিতার সাথে কিছু প্রবন্ধও লিখেছেন অমিয় চক্রবর্তী। অমিয় চক্রবর্তীর কাব্যগ্রন্থ হচ্ছে খসড়া (১৩৪৫), একমুঠো (১৩৪৬), মাটির দেয়াল (১৩৪৯), অভিজ্ঞানবসন্ত (১৩৫০), দূরযানী (১৩৫১), পারাপার (১৩৬০), ঘরে ফেরার দিন, হারানো অর্কিড। তাঁর প্রবন্ধগ্রন্থ হচ্ছে সাম্প্রতিক। যে-কবিতাটির জন্যে তিনি বিশ্বাসী বলে বিখ্যাত, তার অংশ :
মেলাবেন তিনি ঝোড়ো হাওয়া আর
পোভড়া বাড়িটার
ঐ ভাঙা দরজাটা
মেলাবেন।
পাগল ঝাপটে দেবে না গায়েতে কাঁটা।
আকালে আগুনে তৃষ্ণায় মাঠ ফাটা,
মারী-কুকুরের জিভ দিয়ে খেত চাটা,–
বন্যার জল, তবু ঝরে জল,
প্রলয় কাঁদনে ভাসে ধরাতল–
মেলাবেন।
আধুনিকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কবিতা লিখেছেন বিষ্ণু দে। তাঁর কবিতা কখনো আবেগঘন, কখনো তীব্র; কখনো মননশীলতায় গভীর, ও দুরূহ-জটিল। কবিতার পংক্তি থেকে পংক্তিতে, স্তবক থেকে স্তবকে এগোনোর সময় তিনি অনেক সময় যুক্তিকে করেছেন অস্বীকার, এবং রচনা করেছেন পাঠকের জন্যে বিহ্বলকর কবিতা। তবে যে-তিনজন কবি আধুনিক কালের অধিকাংশ শ্রেষ্ঠ কবিতা লিখেছেন, বিষ্ণু দে তাঁদের একজন। অন্য দুজন হচ্ছেন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ও জীবনানন্দ দাশ। আধুনিকদের মধ্যে একমাত্র তারই একটি স্পষ্ট রাজনীতিক দর্শন ছিলো, তা হচ্ছে সাম্যবাদ। রাজনীতিক আদর্শে বিশ্বাসী কবিরা সাধারণত হয়ে থাকেন সরল, উচ্চকণ্ঠ, আবেগপ্রবণ ও বাগ্মী; কিন্তু বিষ্ণু দে তাঁর বিপরীত। প্রচুর কবিতা লিখেছেন তিনি, প্রবন্ধও লিখেছেন বেশকিছু। তাঁর কাব্যগ্রন্থ হচ্ছে উর্বশী ও আর্টেমিস (১৯৩২), চোরাবালি (১৯৩৮), পূর্বলেখ (১৯৪১), সন্দ্বীপের চর (১৯৪৭), সাত ভাই চম্পা (১৯৪১-৪৪), অন্বিষ্ট (১৯৫০), নাম রেখেছি কোমল গান্ধার (১৯৫০), তুমি শুধু পঁচিশে বৈশাখ (১৯৫৮), স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যৎ (১৯৬৩), সেই অন্ধকার চাই (১৩৭৩) ইতিহাসে ট্র্যাজিক উল্লাসে (১৩৭৭), উত্তরে থাকো মৌন (১৯৭৭), আমার হৃদয়ে বাঁচো (১৯৮২)। তার প্রবন্ধের বই হচ্ছে সাহিত্যের ভবিষ্যৎ (১৯৫২), এলোমেলো জীবন। শিল্পসাহিত্য (১৯৬৮), রবীন্দ্রনাথ ও শিল্পসাহিত্যের আধুনিকতার সমস্যা (১৯৬৬)। তাঁর অনুদিত গ্রন্থের নাম এলিঅটের কবিতা (১৯৫০)। তাঁর কবিতার কয়েকটি স্তবক :
সোনালি হাসির ঝরনা তোমার ওষ্ঠাধরে।
প্রাণকুরঙ্গ অঙ্গে ছড়ায় চপল মায়া।
মুখর সে-গান ভেঙে গেলো। আজ শুদ্ধ তমাল।
হালকা হাসির জীবনে কি এলো ফসলের কাল?
এই তবে ভোরবেলা
হে ভূমিশায়িনী শিউলি! আর কি
কোনো সান্ত্বনা নেই?
রজনীগন্ধা দিয়েছিলে সেই রাতে,
আজো তো সে ফোটে দেখি–
মদির অধীর রাতের তন্বী ফুল–
রজনীগন্ধা, বিরাগ জানে না সে কি?
এ-স্তবকগুচ্ছ নেয়া হয়েছে চোরাবালি কাব্যের ‘ক্রেসিডা’ নামক কবিতা থেকে। এটি এক অতুলনীয় জটিল-সুন্দর কবিতা।
আধুনিক কবিতার সূচনার পর কেটে গেছে ছ-দশক। প্রথম মহান আধুনিকদের পর দেখা দিয়েছেন দশকে দশকে নতুন নতুন আধুনিকেরা; এবং বাঙলা আধুনিক কবিতাকে করে তুলেছেন গভীর, ব্যাপক, বিচিত্র। প্রথম আধুনিকদের পরেই যিনি গুরুত্বপূর্ণ আধুনিক কবি, তাঁর নাম সমর সেন (১৯১৬-১৯৮৭)। তিনি লিখেছেন কম, কিন্তু কিছু গুরুত্বপূর্ণ কবিতা লিখেছেন তিনি। তাঁর কাব্যগ্রন্থ কয়েকটি কবিতা (১৯৩৭), গ্রহণ ও অন্যান্য কবিতা (১৯৪০), তিনপুরুষ (১৯৪৪)। সমর সেনের কবিতা নামক একটি সংগ্রহে তার প্রায় সব কবিতা পাওয়া যায়। আরেকজন কবির নাম বলা দরকার, তবে তিনি ঠিক আধুনিক নন। তাঁর নাম সুকান্ত ভট্টাচার্য (১৯২৬-১৯৪৭]। মাত্র একুশ বছর বয়সে লোকান্তরিত হয়েছিলেন সুকান্ত। বাঙলার অকালমৃত কবিদের মধ্যে তিনি সবচেয়ে প্রতিভাবান। বাঙলা ভাষায় মার্কসীয় ধারার শ্রেষ্ঠ কবি সুকান্ত। তাঁর কাব্যগ্রন্থ ছাড়পত্র (১৩৫৫), পূর্বাভাস (১৩৫৫), ঘুম নেই (১৩৫৫)। আধুনিক কবিতার এখন শেষ পর্যায় চলছে। এখন অনেক কবিই আবার হয়ে উঠছেন অনাধুনিক।
বিশশতকের কথাসাহিত্য-গল্প ও উপন্যাস-যে নতুন হবে, বিশশতকের বাস্তব ও স্বপ্নকে প্রকাশ করবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এ-শতকে ঔপন্যাসিকেরা, গল্পকারেরা নতুন নতুন প্রশ্ন তুলেছেন, জীবনকে দেখার চেষ্টা করেছেন নতুন চোখে। উপন্যাস তাই চলে গেছে রূঢ় অশীল বাস্তবে; আবার প্রবেশ করেছে অবচেতনে। ধরা পড়েছে বিচিত্র কামনা বাসনা; এবং অনেক নিষিদ্ধ কথা প্রকাশ করেছে অবলীলায়। বাঙলা উপন্যাসে ছজন শ্রেষ্ঠ পুরুষের মধ্যে রয়েছেন দু-জন চট্টোপাধ্যায় (বঙ্কিমচন্দ্র (১৮৩৮-১৮৯৪), শরৎচন্দ্র (১৮৭৬-১৯৩৮), তিনজন বন্দ্যোপাধ্যায় (তারাশঙ্কর (১৮৯৮-১৯৭১), বিভূতিভূষণ (১৮৯৪-১৯৫০), মানিক [১৯০৮-১৯৫৬) ও একজন ঠাকুর (রবীন্দ্রনাথ (১৮৬১-১৯৪১)। তাদের পাঁচজনই বিশশতকের। তাঁরা ছাড়াও রয়েছেন কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার। তারা সবাই মিলে বিশশতকের কথাসাহিত্যকে জীবনের মতো ব্যাপক করে তুলেছেন। ওপরের কয়েকজন ছাড়া উল্লেখযোগ্য যাদের নাম, তারা হচ্ছেন প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় (১৮৭৩-১৯৩২), নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত (১৮৮২-১৯৬৪), জগদীশচন্দ্র গুপ্ত (১৮৮৬-১৯৫৭), প্রেমেন্দ্র মিত্র (১৯০৪-১৯৮৭], বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-১৯৭৪), অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত (১৯০৩-১৯০৬), ধূর্জটিপ্রসাদ মুখখাপাধ্যায় (১৮৯৪-১৯৬১), বনফুল (১৮৯৯-১৯৭৯), সতীনাথ ভাদুড়ী (১৯০৬-১৯৬৫), সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ (১৯২২-১৯৭১)।
আমাদের শ্রেষ্ঠতম কবি রবীন্দ্রনাথ একজন শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিকও। ছোটগল্পে তো তিনি শ্রেষ্ঠতম। জীবনসম্ভারে ও শিল্পনিপুণতায় তাঁর ছোটগল্পের কোনো তুলনা নেই বাঙলায়। উপন্যাসেও তাঁর অসামান্যতা বিস্ময়কর। তিনি আমাদের জীবন ও চেতনার একটি বড় অংশ গভীরভাবে চিত্রিত করেছেন তাঁর উপন্যাসে। তাঁর উপন্যাসের ভাষাও অনবদ্য। তিনি জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক নন, পাঠকের চিত্তবিনোদনের জন্যে তিনি উপন্যাস রচনা করেন নি। তিনি দিয়েছেন জীবন ও চেতনার ভাষ্য। উপন্যাস লেখা শুরু করেছিলেন তিনি অনেকটা বঙ্কিমচন্দ্রের ধরনে। তার পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর প্রথম পর্যায়ের উপন্যাস বৌঠাকুরাণীর হাট (১৮৮৩), রাজর্ষিতে (১৮৮৭)। নৌকাড়ুবি (১৯০৬) নামে তাঁর একটি উপন্যাস রয়েছে, তাতেও ঠিক রবীন্দ্রনাথকে পাওয়া যায় না। ঔপন্যাসিক রবীন্দ্রনাথ বলতে যাকে বুঝি, তাঁর সূচনা হয় চোখের বালি (১৯০৩) উপন্যাসে। এ-উপন্যাসটিতেই সূচিত হয় বাঙলা উপন্যাসের আধুনিক যুগ। কয়েকটি নতুন জিনিশ দেখা দেয় এ-উপন্যাসে। বাস্তবের চিত্রণে রবীন্দ্রনাথ এ-উপন্যাসে গ্রহণ করেন আধুনিক ভঙ্গি। বিশ্লেষণ করেন পাত্রপাত্রীদের মনস্তত্ত্ব। পরিত্যাগ করেন প্রথাগত নীতিবোধ। এসব কারণে চোখের বালিকে বিশশতকি বাঙলা উপন্যাসের সূচনাগ্রন্থ হিশেবে গণ্য করা হয়। এরপর আরো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস রচনা করেন রবীন্দ্রনাথ। সেগুলো হচ্ছে গোরা (১৯১০), ঘরে বাইরে (১৯১৬), চতুরঙ্গ (১৯১৬), যোগাযোগ (১৯২৯), শেষের কবিতা (১৯২৯), দুইবোন (১৯৩৩), মালঞ্চ (১৯৩৪), চার অধ্যায় (১৯৩৪)। বাঙলার জীবন, রাজনীতি, ব্যক্তিমানুষের কামনাবাসনার অসামান্য চিত্রণ যেমন পাওয়া যায় তাঁর উপন্যাসে, তেমনি পাওয়া যায় বাঙলা গদ্যের অপূর্ব বিকাশ। আর কারো উপন্যাসে ভাষা এমন উজ্জ্বলতা লাভ করে নি।
রবীন্দ্রনাথের পর সাড়া জাগিয়ে দেখা দেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তিনি জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক ছিলেন, জনপ্রিয়তায় তাকে আর কেউ ছাড়িয়ে যেতে পারেন নি। ঔপন্যাসিক হিসেবে কয়েক দশক আগে তিনি যে-মর্যাদা পেতেন, এখন আর তাঁকে তা দেয়া হয় না; তবে তিনি আবার মর্যাদা পাবেন। তিনি শস্তা জনপ্রিয় ছিলেন না। তিনি বাঙলা ভাষার প্রধান ঔপন্যাসিকদের একজন। তিনি বাঙালির আবেগস্রোতকে খুলে দিয়েছিলেন; এবং আবেগে ভেসে গিয়েছিলো পাঠকেরা। তিনি সবকিছু দেখতেন হৃদয়ের যুক্তির সাহায্যে, মস্তিষ্কের সাহায্যে নয়। তিনি সামাজিকভাবে নিষিদ্ধ কিছু ব্যাপারকে নিয়ে এসেছিলেন সামনে, সেগুলোকে দিয়েছিলেন মহিমা। দাঁড়িয়েছিলেন সামাজিক অনেক রীতিনীতির বিরুদ্ধে। তাই তিনি ছিলেন একধরনের বিদ্রোহী। বাঙালির আবেগ ও ভাবাবেগের মুক্তিদাতা হিশেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন শরৎচন্দ্র। বহু উপন্যাস লিখেছিলেন তিনি, যেগুলো একসময় বাঙালির প্রাত্যহিক পাঠ্যপুস্তকে পরিণত হয়েছিলো। তাঁর প্রধান উপন্যাসগুলো হচ্ছে পল্লীসমাজ (১৯১৬), দেবদাস (১৯১৭), চরিত্রহীন (১৯১৭), শ্রীকান্ত (চারপর্ব, ১৯১৭, ১৯১৮, ১৯২৭, ১৯৩৩), দত্তা (১৯১৮), গৃহদাহ (১৯২০), পথের দাবী (১৯২৬)। এছাড়া আছে পরিণীতা (১৯১৪), বিরাজ বৌ (১৯১৪), চন্দ্রনাথ (১৯১৬), দেনা-পাওনা (১৯২৩), বিপ্রদাস (১৯৩৫), শেষ প্রশ্ন (১৯৩১)। শরৎচন্দ্রের থেকে বয়সে কম হলেও তাঁর এক দশক আগে থেকেই উপন্যাস-গল্প লিখে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়। তাঁর উপন্যাস ও গল্পগ্রন্থ ষোড়শী (১৯০৬), রমাসুন্দরী (১৯০৮), নবীন সন্ন্যাসী (১৯১২), গল্পাঞ্জলি (১৯১৩), রত্নদ্বীপ (১৯১৫), সিঁদুর-কৌটা (১৯১৯) প্রভৃতি।
সাহিত্যে রক্ষণশীল আর প্রগতিশীলদের মধ্যে মাঝেমাঝেই দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। রক্ষণশীলেরা সাধারণত হয়ে থাকে প্রতিভাহীন, ও একগুয়ে, এবং বেশ ভণ্ড। প্রগতিশীলেরা হয় সত্যসন্ধানী, প্রতিভাবান। তরুণ প্রগতিশীল প্রতিভা আক্রান্ত হয় বৃদ্ধ রক্ষণশীলদের দ্বারা। বাঙলা সাহিত্যে এটা ঘটেছে মাঝেমাঝেই। এ-শতকের দ্বিতীয় দশকের মাঝামাঝি দেখা দেয় প্রগতিশীলতা ও রক্ষণশীলতার বিবাদ। উপন্যাসের বিষয় সার্বিক জীবন। তার ভালো ও মন্দ, সুন্দর ও অসুন্দর, শ্লীল ও অশ্লীল, সিদ্ধ ও নিষিদ্ধ সবকিছুই উপন্যাসে স্থান পাওয়ার যোগ্য। উনিশশতকের ঔপন্যাসিকেরা সবকিছুকে স্থান দিতেন না উপন্যাসে। জীবনের ভালো দিকটাকেই তাঁরা তুলে ধরতেন। তাঁদের উপন্যাসে কোনো চরিত্র যদি সমাজঅসম্মত কাজ করতো, তাহলে তাদের দেয়া হতো মৃত্যুর মতো শাস্তি। এর বিখ্যাত উদাহরণ বঙ্কিমচন্দ্রের কৃষ্ণকান্তের উইল-এর বিধবা রূপসী রোহিণী। রোহিণী বাল্যবিধবা। তাঁর স্বপ্নের জীবন শুরু হওয়ার আগেই সে বিধবা হয়ে গেছে। জীবনে তার কোনো অধিকার নেই। সমাজ তার সমস্ত স্বপ্ন ও বাসনাকে নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু সে জীবন উপভোগে ব্যগ্র। তাই বঙ্কিম তাকে শাস্তি দেন; বন্দুকের গুলিতে মরতে হয় রোহিণীকে। রোহিণীকে মেরে শান্তি পান বঙ্কিম ও স্থির থাকে হিন্দু সমাজ। কিন্তু আধুনিকেরা এটা মেনে নিতে পারেন নি। যেমন রবীন্দ্রনাথের চোখের বালির বিনোদিনীও বিধবা, ও জীবনের জন্যে ব্যাকুল। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তাকে কোনো শাস্তি দেন নি; বরং তার কামনাকে চিত্রিত করেছেন সহানুভূতির সাথে। শরৎচন্দ্রের উপন্যাসে তো দেখি নিষিদ্ধ কামনার জয়জয়কার। এতে বিচলিত হয়েছিলেন রক্ষণশীলেরা। যতীন্দ্রমোহন সিংহ নামে একজন রক্ষণশীল লেখক সাহিত্যে স্বাস্থ্যরক্ষা (১৯২২) নামে একটি বই লেখেন। আরো কেউ কেউ আধুনিক সাহিত্যকে বেশ অশালীন ভাষায় তিরস্কার করেন।
এ-শতকের তৃতীয় দশকে সাহিত্যে বাস্তবতার স্থান আর সীমা নিয়ে কলহ ঘন হয়ে দেখা দেয়। তাতে জড়িয়ে পড়েন রবীন্দ্রনাথও। এ-সময়ে তরুণ লেখকেরা চাইছিলেন নতুন সাহিত্য, নতুন বাস্তবতা, যা নেই আগের উপন্যাসে। ওই বাস্তবতা বেশ নির্মম, বেশ অশালীন, ও শিউরে ওঠার মতো। উনিশশতকের শেষদিকে এমন বাস্তবের ছবি এঁকেছিলেন ইউরোপের অনেক ঔপন্যাসিক; এবং বিশশতকেও তারা জীবনের তলদেশ খুঁড়েখুঁড়ে উদঘাটন করছিলেন অনেক নির্মম, পীড়াদায়ক ব্যাপার। তৃতীয় দশকের বাঙালি লেখকেরাও তাই করতে চাইলেন। তাঁরা সুন্দর জীবন থেকে চলে যেতে চাইলেন বস্তিতে, তাঁরা উঁচু জীবন থেকে ঢুকতে চাইলেন নিচু জীবনে। জীবনের পাতালে, যেখানে জমে আছে জীবনের সমস্ত নোংরা। রবীন্দ্রনাথও শিউরে উঠলেন এতে। এর ফলে শুরু হলো বাস্তবতা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ও তরুণ লেখকদের কলহ। রবীন্দ্রনাথেরও সীমাবদ্ধতা ছিলো। এতে উপকৃত হয় বাঙলা উপন্যাস। নতুন ধারার ঔপন্যাসিক ও উপন্যাসে ঋদ্ধ হয়ে ওঠে বাঙলা সাহিত্য।
যেমন আধুনিক কবিতা সৃষ্টিতে, তেমনি আধুনিক উপন্যাস সৃষ্টিতে তীব্র ভূমিকা নিয়েছিলো কয়েকটি পত্রিকা। প্রথম নাম করতে হয় কল্লোল-এর (১৯২৩)। এ-পত্রিকাটি আধুনিক বাঙলা সাহিত্যের জননীর মতো। এর নাম অনুসারে একটি যুগকে এখন কল্লোল যুগই বলা হয়। আধুনিকতার পক্ষে ছিলো আরো দুটি পত্রিকা : ঢাকার প্রগতি (১৯২৭), আর কলকাতার কালি-কলম (১৯২৬)। এ-পত্রিকাগুলো, বিশেষ করে কল্লোল ছিলো বিদ্রোহী। তরুণ লেখকেরা এসব পত্রিকায় প্রকাশ করতে লাগলেন নতুন অভিজ্ঞতা। ওই অভিজ্ঞতা পুরোনোদের কাছে মর্মান্তিক। বস্তির সত্য তাঁরা প্রকাশ করতে শুরু করলেন, যখন পুরোনোরা ব্যস্ত গৃহের সাজানো সত্য নিয়ে। লেখকদের অভিজ্ঞতা এ-সাহিত্য সৃষ্টিতে সাহায্য করেছিলো সন্দেহ নেই। কিন্তু তারা অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন পশ্চিম থেকে। পশ্চিমে ফ্রয়েড-এর তত্ত্ব মানুষকে দেখছে নতুনভাবে। জোলা, গোর্কি, হামসুন, বোয়ার, আরো অনেক ঔপন্যাসিক উদঘাটন করেছেন জীবনের অবস্তর। সে-স্তর সুন্দর নয়, শোভন নয়, স্বস্তিকর নয়। আমাদের তরুণ ঔপন্যাসিকেরাও সাধনা শুরু করলেন অবস্তর উপস্থাপনের। বদলে গেলো উপন্যাস।
নতুনদের পুরোধা হয়ে দেখা দেন নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত। তিনি ছিলেন এক সাড়াজাগানো মানুষ। যে-দিকেই গেছেন, সে-দিকেই ভূমিকম্প দেখা দিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক ছিলেন, ডক্টরেট উপাধি ছিলো; কিন্তু প্রথাগত ছিলেন না তিনি। ছিলেন প্রথাবিরোধী। আজকাল তিনি অনেকটা বিস্মৃত। তিনি কামনা ও অপরাধকে তাঁর উপন্যাসের প্রধান বিষয় করে তুলেছিলেন। তাঁর উপন্যাস হচ্ছে শুভা (১৯২০), অগ্নিসংস্কার (১৯২০), শান্তি (১৯২১), সর্বহারা (১৯২৯), অভয়ের বিয়ে (১৯৩১), বিপর্যয়। শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় (১৯০০-১৯৭৬) সাড়া জাগিয়েছিলেন তাঁর উপন্যাসে, বিশেষ করে গল্পে, অবস্তরের জীবনের ছবি এঁকে। কয়লাকুঠির জীবনের নির্মম চিত্র পাওয়া যায় তাঁর গল্পে। লেখক হিশেবে তিনি অত্যন্ত গৌণ; তবে বাঙলা গল্পের বাস্তবতার সীমাকে তিনি বাড়িয়ে দিয়েছিলেন বলে স্মরণীয়। তাঁর উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে ঝড়ো হাওয়া (১৩৩০), ষোলআনা (১৩৩২), মহাযুদ্ধের ইতিহাস (১৩৩৩), পূর্ণচ্ছেদ (১৩৩৬)। বাস্তবের নির্মম-নির্মোহ চিত্রণের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে আছেন জগদীশ গুপ্ত। তাঁর উপন্যাসে মানুষ ইতরপ্রাণীমাত্র। তাঁর উপন্যাস অসাধু সিদ্ধার্থ (১৯২৯), লঘুগুরু (১৯৩১), গতিহারা জাহ্নবী (১৯৩৫), দুলালের দোলা (১৯৩১)।
বিশশতকের বিখ্যাত ঔপন্যাসিকদের একজন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি যেনো পল্লীবাঙলার গদ্য-মহাকাব্যরচয়িতা। পথের পাঁচালী তাঁকে অমরত্ব এনে দিয়েছে। মানুষ ও নিসর্গ তাঁর উপন্যাসে পরস্পরের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী হয়ে আছে। তাঁর উপন্যাস হচ্ছে পথের পাঁচালী (১৯২৯), অপরাজিত (১৯৩২), আরণ্যক (১৩৪৫), বিপিনের সংসার (১৩৪৮), আদর্শ হিন্দু হোটেল (১৩৪৭), দেবযান (১৩৫১)। অনেকের মতে আধুনিক ঔপন্যাসিকদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। বীরভূমের সাধারণ জীবন ও ক্ষয়িষ্ণু জমিদারেরা স্থান পেয়েছে তাঁর উপন্যাসে। তাঁর উপন্যাসেও চোখে পড়ে মহাকাব্যিক বিস্তৃতি। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস হচ্ছে ধাত্রীদেবতা (১৯৩৯), গণদেবতা (১৯৪২), পঞ্চগ্রাম (১৯৪৩), হাসুলী বাঁকের উপকথা (১৯৪৭), কবি (১৯৪৭), নাগিনীকন্যার কাহিনী (১৯৫১)। আমাদের অতি-প্রশংসিত ঔপন্যাসিকদের একজন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর আসল নাম প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। বিভিন্ন রকম তত্ত্ব অবলম্বন করেছেন তিনি উপন্যাসে। তাই তাঁর উপন্যাস অন্যান্যের থেকে কিছুটা জটিলও। মনের গোপন কামনাবাসনা থেকে শ্রেণীসংগ্রাম রূপ পেয়েছে তাঁর উপন্যাসে। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস হচ্ছে দিবারাত্রির কাব্য (১৯৩৫), পুতুলনাচের ইতিকথা (১৯৩৬), পদ্মানদীর মাঝি (১৯৩৬), শহরতলী (১৯৪০), চতুষ্কোণ (১৯৪৮)।
আধুনিক গুরুত্বপূর্ণ ঔপন্যাসিকদের মধ্যে দু-জন কবি। একজন প্রেমেন্দ্র মিত্র, অন্যজন বুদ্ধদেব বসু। প্রেমেন্দ্র মিত্র বস্তির জীবনের কাহিনী লিখে সাড়া জাগিয়েছিলেন। পাক (১৯২৬) তাঁর সাড়াজাগানো উপন্যাস। তার আরো উপন্যাস হচ্ছে মিছিল (১৯৩৩), উপনয়ন (১৯৩৩), আগামীকাল (১৩৪১) কুয়াশা (১৯৪৬)। কবি ও ঔপন্যাসিক হিশেবে অনেক বড়ো বুদ্ধদেব বসু প্রেমেন্দ্র মিত্রের থেকে। বুদ্ধদেব বসু উপন্যাসে বাহ্যিক ঘটনার থেকে বেশি জোর দিয়েছেন মনোঘটনার ওপর। তিনি অন্তর্জগতের ঔপন্যাসিক। তাঁর উপন্যাস হচ্ছে সাড়া (১৯৩০), যেদিন ফুটল কমল (১৯৩৩), ধূসর গোধূলি (১৯৩৩), তিথিডোর (১৯৪৯), মৌলিনাথ (১৯৫২), রাতভর বৃষ্টি (১৯৬১)। বনফুল ছিলেন শেষপ্রবণ। তাঁর উপন্যাস হচ্ছে মৃগয়া (১৯৪০), জঙ্গম (১৩৫০), স্থাবর (১৩৫৮)। ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাস আন্তর চেতনার। তাঁর উপন্যাস হচ্ছে অন্তঃশীলা (১৯৩৫), আবর্ত (১৯৩৭), মোহনা (১৯৩৭)। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত প্রচুর লিখেছেন। যতোটা সাড়া জাগিয়েছিলেন তিনি, ততোটা গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস অবশ্য তিনি লিখতে পারেন নি। তাঁর উপন্যাস হচ্ছে বিবাহের চেয়ে বড়ো (১৯৩১), বেদে (১৩৩৫), আকস্মিক (১৯৩০), নবনীতা (১৩৪৩), প্রথম কদম ফুল (১৯৬৩)।
এ-শতকে ফলেছে ছোটগল্পের অসাধারণ শস্য। বাঙলা ভাষায় ছোটগল্পের সূচনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তিনিই ঘটিয়েছিলেন এর বিকাশ। মানুষের জীবন ও প্রকৃতি নিয়ে একরাশ অসামান্য গল্প রচনা করেন তিনি। তাঁর গল্পে ঘটে জীবন ও শিল্পের বিস্ময়কর সমন্বয়। উনিশশতকের শেষ দশকে প্রাণ ভরে গল্প লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, এবং তাতে ভরে ওঠে পাঠকদের প্রাণ। রবীন্দ্রনাথের গল্প সংগৃহীত হয়েছে গল্পগুচ্ছ-এর (১৯২৬) তিনটি খণ্ডে। বিশশতকের প্রধান ঔপন্যাসিকেরাও জীবনের বিচিত্র দিক নিয়ে লিখেছেন গল্প। এসব গল্পে টুকরোটুকরো হয়ে ধরা পড়েছে আমাদের জীবন। সম্ভবত বাঙলা উপন্যাসের চেয়ে বাঙলা ছোটগল্প অনেক বেশি শিল্পসফল। বাঙলি প্রতিভা উপন্যাসের বিশালতায় যতোটা বিচ্ছুরিত হয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি বিচ্ছুরিত হয়েছে ছোটগল্পে। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সাহিত্যজগতে প্রবেশ করেছিলেন ছোটগল্প নিয়ে। তাঁর প্রথম গল্প মন্দির’ সেকালের একটি গল্প-প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার পেয়েছিলো। পুরস্কারটির নাম কুন্তলীন-পুরস্কার। মন্দির’ বেরিয়েছিলো ১৯০৩-এ। তারপর বহু গল্প লিখেছেন শরৎচন্দ্র। তার গল্প ছোটগল্পের সংজ্ঞাটিকে ঠিক মেনে চলে নি; তবে আলোড়িত করার মতো উপাখ্যান উপহার দিয়েছে। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় প্রচুর গল্প লিখেছেন। তাঁর গল্পগ্রন্থ হচ্ছে সোড়শী (১৯০৬), গল্পাঞ্জলি (১৯১৩), গল্পবীথি (১৯১৬), জামাতা বাবাজী (১৯৩১)। নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত লিখেছেন প্রচুর গল্প। তাঁর প্রথম গল্পের নাম ঠানদিদি (১৯১৮)। শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের খ্যাতির মূলে রয়েছে তাঁর ছোটগল্প। ১৩২৯-এ ‘রেজিং রিপোর্ট’ নামে তার একটি গল্প বেরোয়; এবং তীব্র সাড়া জাগায়। তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র ও বুদ্ধদেব বসু লিখেছেন কিছু অসামান্য অবিনাশী গল্প। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পগ্রন্থ হচ্ছে জলসাঘর (১৯৩৭), রসকলি (১৯৩৮), বেদেনী (১৯৪০), নারী ও নাগিনী, ইমারত। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পগ্রন্থ অতসী মামী (১৯৩৫), প্রাগৈতিহাসিক (১৯৩৭), সরীসৃপ (১৯৩৯), আজ কাল পরশুর গল্প (১৯৪৬), ছোটবকুলপুরের যাত্রী (১৯৪৯)। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পগ্রন্থ মেঘমল্লার (১৩৩৮), মৌরীফুল (১৩৩৯), কিন্নর দল (১৩৪৫)। বুদ্ধদেব বসুর গল্পগ্রন্থ হচ্ছে অভিনয় অভিনয় নয় ও অন্যান্য গল্প (১৯৩০), এরা ওরা এবং আরো অনেকে (১৯৩২), ঘরেতে ভ্রমর এলো (১৯৩৫)। তাঁর গল্পের একটি চমৎকার সংকলনের নাম ভাসো আমার ভেলা। প্রেমেন্দ্র মিত্রের গল্পগ্রন্থ পঞ্চশর (১৩৩৬), বেনামী বন্দর (১৩৩৭), মৃত্তিকা (১৯৩২)।
বিশশতকের দুজন অতুলনীয় গদ্যশিল্পীর কথা মনে পড়ে। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৭১-১৯৫১) ও প্রমথ চৌধুরী (১৮৬৮-১৯৪৬)। দুজনই রবীন্দ্রনাথের আত্মীয়; এবং বিশশতকের দুই প্রধান বাঙালি, ও প্রতিভা। তাঁরা কবিতা বা গল্প বা উপন্যাস সৃষ্টি করে প্রধান হন নি। তাঁরা গল্প লিখেছেন, প্রবন্ধ লিখেছেন। কিন্তু তাঁরা অমর হয়ে আছেন তাঁদের অনন্য গদ্যশিল্পের জন্যে। অবনীন্দ্রনাথ মানে গদ্য, প্রমথ চৌধুরী মানে গদ্য। বিস্ময়কর গদ্য। অবনীন্দ্রনাথ আধুনিক কালের একজন প্রধান চিত্রকর। ছবি আঁকতে আঁকতে তিনি প্রবেশ করেছিলেন সাহিত্যে; এবং সাহিত্যে একে গেছেন চিত্রের পর চিত্র। তাঁর গল্প, বক্তব্য ইত্যাদির প্রাণ যেনো তার ভাষা। ১৮৯৫-এ বেরোয় অবনীন্দ্রনাথের ক্ষীরের পুতুল ও শকুন্তলা। রূপকথার রূপে ভরে আছে বই দুটি। তাঁর অন্যান্য বই বাংলার ব্রত (১৯০৯), রাজকাহিনী (১৯০৯), ভূতপেত্নীর দেশ (১৩২২), খাতাঞ্চির খাতা (১৩২৩), আলোর ফুলকি (১৯৪৭), বুড়ো আংলা (১৩৪১), বাগেশ্বরী শিল্পপ্রবন্ধাবলী (১৯৪১), ঘরোয়া (১৩৪৮), জোড়াসাঁকোর ধারে (১৩৫১), আপন কথা (১৩৫৩)। বিস্ময়কর এসব বই। কৈশোরেই এগুলোর অধিকাংশ পড়ে ফেললে জীবন সোনায় ভরে উঠতে পারে। প্রমথ চৌধুরী বিখ্যাত হয়ে আছেন চলতি রীতির প্রধান প্রবক্তা হিশেবে। তার ছদ্মনাম ছিলো বীরবল। সবুজপত্র নামে একটি প্রভাবশালী পত্রিকা সম্পাদনা শুরু করেন তিনি ১৯১৪ অব্দে। এটিতে তিনি চলতি ভাষাকে সাহিত্যের বাহন হিশেবে ব্যবহারের আন্দোলন শুরু করেন। সফল হন। তবে শুধু চলতিরীতির প্রবক্তা হিশেবে নয়, অনন্য গদ্যরীতির জন্যে অবিস্মরণীয় প্রমথ চৌধুরী। তিনি গল্প লিখেছেন, কবিতাও লিখেছেন; কিন্তু বাঙলা সাহিত্যে তাঁর অমূল্য অবদান তাঁর প্রবন্ধাবলি। সনেট-পঞ্চাশৎ(১৯১৩), ও পদ-চারণ (১৯১৯) তাঁর কাব্যগ্রন্থ। চার ইয়ারী কথা (১৯১৬) তাঁর গল্পগ্রন্থ। প্রবন্ধসংগ্রহ নামে দু-খণ্ডে সংগৃহীত হয়েছে তাঁর প্রবন্ধ। অনন্য তাঁর গদ্য।
নাটকে বাঙলা সাহিত্য গরিব। উনিশশতকের দ্বিতীয় অংশে বেশ কয়েকজন বেশ বড়ো নাট্যকার দেখা দিয়েছিলেন। বিশশতকে কি তেমন দেখা দিয়েছে? মনে হয় দেয় নি। মধুসূদন অলীক কুনাট্যের কথা বলেছিলেন। রাঢ়ের বঙ্গে এখনো লোকজন তাতে মজে। বাঙলার জীবনে বোধহয় নাট্যগুণ নেই, নাটকীয়তা থাকলেও। নাটক রচিত হয় মঞ্চস্থ হওয়ার জন্যে। মঞ্চে সফল হওয়া নাটকের একটা বড়ো গুণ। তবে মঞ্চে সফল হলেই নাটক উৎকৃষ্ট হয় না। বরং মঞ্চে সফল হতে গিয়েই ব্যর্থ হয় বাঙলার অধিকাংশ নাটক। বাঙলা ভাষায় লেখা অধিকাংশ মঞ্চসফল নাটক সাহিত্য হিশেবে নিকৃষ্ট। বিশশতকে নাটকের ক্ষেত্রে খুব বড়ো প্রতিভা বেশি চোখে পড়ে না। বিশশতকে রবীন্দ্রনাথই শ্রেষ্ঠ নাট্যকার। তাঁর নাটক অবশ্য জীবনচিত্রণ নয়, ভাবচিত্ৰণ। কিন্তু তাঁর নাটক সাহিত্যসৃষ্টি হিশেবে অসামান্য ব’লে উৎকৃষ্ট নাটক হিশেবে গণ্য। বেশ পরে বুদ্ধদেব বসু এমন উন্নত সাহিত্যিক নাটক লিখেছেন। এ ছাড়া সাহিত্যিক গুণে আর কারো নাটক বিশেষ সমৃদ্ধ নয়। ‘ রবীন্দ্রনাথ প্রচুর নাটক, কাব্যনাট্য ও নাট্যকাব্য লিখেছেন। এগুলোর সবই কবির হাতের লেখা। গীতিনাট্য, কাব্যনাট্য, সাংকেতিক-রূপক নাটকে তিনি অনন্য। তাঁর নাট্যসাহিত্যে রয়েছে বাল্মীকিপ্রতিভা (১২৮৭), কালমৃগয়া (১২৮৯), প্রকৃতির প্রতিশোধ (১২৯১), মায়ার খেলা (১২৯৫), বিসর্জন (১২৯৬), মালিনী (১৩০৩), রাজা (১৩১৭), অচলায়তন (১৩১৮), ডাকঘর (১৩১৮), মুক্তধারা (১৩২৯), রক্তকরবী (১৩৩১), চিরকুমার সভা (১৩৩২), বসন্ত (১৩৩৩), নটীর পূজা (১৩৩৩), কালের যাত্রা (১৩৩৯), তাসের দেশ (১৩৪০), চণ্ডালিকা (১৩৪০), বাঁশরী (১৩৪০), চিত্রাঙ্গদা (১৩৪২)। বিশশতকে আরো অনেকে নাটক লিখেছেন; কিন্তু তাঁদের বড়ো নাট্যকার বলা যায় না। তবে দু-একজনের দু-একটি নাটক উল্লেখযোগ্য। যেমন, মন্মথ রায়ের কারাগার, বিজন ভট্টাচার্যের নবান্ন (১৯৪৪)। ষাটের দশকে বুদ্ধদেব বসু লেখেন কয়েকটি অতুলনীয় কাব্যনাটক। তাঁর তপস্বী ও তরঙ্গিনী, কলকাতার ইলেকট্রা কাব্যগুণে অসামান্য।
বিশশতক কেটে যাওয়ার আর বাকি নেই। বিশশতকের সাহিত্যের কথা বললাম খুব সংক্ষেপে। বলেছি শুধু বিশশতকের প্রথম অর্ধেকের কথা। দ্বিতীয় ভাগের কথা কিছুই বলিনি। এ-সময়েও জন্ম নিয়েছেন অনেক বড়ো কবি ও ঔপন্যাসিক। তবে এ-শতকের তৃতীয় দশকের মাঝামাঝি যে-আধুনিক সাহিত্যের উদ্ভব হয়েছিলো, তাই এ-শতকের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। দ্বিতীয় ভাগে অতো বড়ো কেউ জন্মান নি। তাঁদের প্রতিভা ছিলো; কালের আনুকূল্যও পেয়েছিলেন তাঁরা। তাই সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন এমন সাহিত্য, যা ধারণ করেছে আধুনিক কালের চেতনা। ওই চেতনা ভিন্ন উনিশশতকের চেতনার থেকে। আগামী শতকে দেখা দেবে নতুন চেতনা। হয়তো তার আভাস দেখা দেবে বিশশতকের শেষ দশকেই। তা হয়তো বহুবর্ণের দীপাবলি হয়ে দেখা দেবে একুশশতকের প্রথম বা দ্বিতীয় বা তৃতীয় দশকে। চিরকাল জ্বলবে বাঙলা সাহিত্যের লাল নীল দীপাবলি।
“লাল নীল দীপাবলী বা বাঙলা সাহিত্যের জীবনী” উপন্যাস বা প্রবন্ধ সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ
♦ প্রদীপ জ্বললো আবারঃ মঙ্গলকাব্য
♦ কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী
♦ উজ্জ্বলতম আলোঃ বৈষ্ণব পদাবলি
♦ দেবতার মতো দুজন এবং কয়েকজন অনুবাদক
♦ গদ্যের জনক ও প্রধান পুরুষেরা