সব সময় যে এমন কিছু স্থূল কার্য-কারণ সম্পর্কের ওপর নির্ভর করে বিভ্রম ঘটে, এমনটা নয়। অনেক সময় মানসিক কারণে ইন্দ্রিয়-বিভ্রম হতে পারে।

এক প্রতিষ্ঠিত, শ্রদ্ধেয়, শক্তিমান কবি নিজের ঘরে বসেই শুনতে পান রাইটার্সে বসে মুখ্যমন্ত্রী কী বলছেন। শুনতে পান একশো গজ দূরের এক ফ্ল্যাটবাসিনী বিবাহিতা রমণীর কথোপকথন। রমণী রাত দুপুরে তাঁর বরকে বলেন, “তুমি আমার দেহ পেতে পারো, কিন্তু আমার মন পাবে না। আমার মন দিয়েছি……।” কবি যখন শোনেন তাঁকেই রমণী মন দিয়ে বসে আছেন, তখন আপ্লুত হন।

এই বিভ্রম কবির মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষের বিশৃঙ্খলার ফল। এই বিশৃঙ্খলার পিছনে কারণ নিশ্চয়ই আছে। একটা বড় অর্থমূল্যের সাহিত্য পুরস্কার পাচ্ছেন—এমনটাই খবর ছিল তাঁর কাছে। পেলেই তিন মাসের মধ্যে বিয়েটা হৈ-হৈ করে করার পরিকল্পনা ছিল পাক্কা। পুরস্কার পেলেন অন্য কেউ। বিয়েটা আর হল না। বছর ঘোরার আগে মেয়েটি বিয়ে করলেন আর একজনকে। পুরস্কার না পাওয়ার পিছনে কয়েকজন সাহিত্যিক ও সাংবাদিকের হাত আছে বলে গভীর ভাবে বিশ্বাস করে ফেললেন। এক সময় তাঁদের ষড়যন্ত্রের নানা খবরাখবর পেতে লাগলেন। অন্যের চিন্তাকে ধরার শক্তি হঠাৎ করেই নাকি তিনি একদিন পেয়ে গিয়েছিলেন। তারপর যার কথাই মন দিয়ে ভাবছেন, তারই কথোপকথন স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছেন। Auditary hallucination-এর রোগী এই ধরনের অলীক কথা-বার্তা শুনতে পান। Hallucination মানে অলীক কিছুর অস্তিত্বে বিশ্বাস।

হেরোইন, আফিং, চরস, এল এস ডি ইত্যাদি মাদক শরীরে গ্রহণ করলেও অনেক সময় তুরীয় আনন্দ, আধ্যাত্মিক আনন্দ, দেবদর্শন, দেববাণী শোনা যায়। এইসব মাদক অনেক সময় hallucination তৈরি করে।

বছরের পর বছর ধরে গড়ে ওঠা বদ্ধমূল ভুল ধারণা বা অন্ধ-বিশ্বাস অনেক সময় আমাদের এক বা একাধিক ইন্দ্রিয়কে বিভ্রান্ত করে।

আমাদের যুক্তিবাদী সমিতিতে একটি যুবক আসতেন। চুপ-চাপ বসে আলোচনা শুনতেন। এক সময় আমার ফ্ল্যাটেও মাঝে-মাঝে আসতে লাগলেন। তারপর একদিন জানালেন ওঁর সমস্যার কথা। ‘প্লেটোনিক লভ’-এ বিশ্বাস করেন কৈশোর থেকে। শ্রীদেবীর সঙ্গে এমনই এক দেহাতীত প্রেমে গভীরভাবে জড়িয়ে পড়েছেন। শোবার ঘরে শ্রীদেবীর কয়েকটা ছবি আছে। বিভিন্ন সময়ে শ্রীদেবীর আত্মা ওইসব ছবিতে চলে আসেন। কথা বলেন। গান শোনান। ছবি থেকে বেরিয়ে এসে নাচও দেখান। এ’সব কথা বিশ্বাস করতে চান না তাঁর আত্মীয়-বন্ধুরা। বলেন—“মাথা খারাপ হয়েছে। ডাক্তার দেখা।”

যুবকটি আমাকে প্রশ্ন করলেন, রামকৃষ্ণ থেকে রামপ্রসাদ কালীর সঙ্গে

কথা বললে, কালীর গান শুনলে অবতার হয়ে যান। আর

আমি শ্রীদেবীর সঙ্গে কথা বললে, পাগল !

সত্যিই কি আমি পাগল?

ভয়ংকর প্রশ্ন। ধীরে ধীরে ধাপে-ধাপে বেশ কিছুদিন সিটিং বা আলোচনার মধ্য দিয়ে তরুণটিকে বোঝাতে পেরেছিলাম, দীর্ঘ দিনের বদ্ধমূল ধারণা থেকে ও এইসব অলীক কিছু দেখেছে, অলীক কিছু শুনছে। অন্ধ-বিশ্বাস বা বদ্ধমূল ধারণা থেকে যখন আমাদের ইন্দ্রিয়ের অনুভূতিগুলো ভুল করে, তখন সেই মানসিক অবস্থাকে মনস্তত্ত্বের ভাষায় বলে delusion, যা আসলে এক ধরনের মানসিক রোগ। যাঁরা ঈশ্বর দেখেন, ঈশ্বরের সঙ্গে কথা বলেন, তাঁরা অবশ্যই মানসিক রোগী। আমাদের সামাজিক পরিবেশটাই এমন কুসংস্কারে আচ্ছন্ন যে, কেউ মানুষের ছবির সঙ্গে কথা বললে পাগল, আর ঈশ্বরের ছবির সঙ্গে বললে অবতার ।

গন্ধ, স্পর্শ, স্বাদ—এই তিন ইন্দ্রিয় যে বিভ্রান্ত হয়, সেটা বোঝাতে তিনটি ঘটনার উল্লেখ করছি।

১১ ডিসেম্বর ১৯৮৮। এক সাংবাদিক সম্মেলনে আসার কথা ছিল ডাইনি সম্রাজ্ঞী ইপ্সিতা, শিক্ষা আশ্রম ইন্টারন্যাশনাল-এর সাঁই শিষ্য উপাচার্য ও জ্যোতিষী নরেন্দ্রনাথ মাহাতোর। এঁরা তিনজন নিজেদের ক্ষমতা প্রমাণের চেষ্টা করবেন। আমরা চেষ্টা করবো, ওঁদের ক্ষমতার দাবি যে বুজরুকি— তা প্রমাণ করতে। সাংবাদিক সম্মেলনে কলকাতার বাইরের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার প্রতিনিধিরাও এসেছেন। শেষ পর্যন্ত এলেন না তিনজনই। না এলেও ‘কুছ পরোয়া নেই’। কিছু কিংবদন্তি ‘অলৌকিক’ ঘটনা ঘটিয়ে সেগুলোর পিছনের কারণ ব্যাখ্যা করছিলাম আমরা। এক সময় আমি কয়েকজন সাংবাদিককে এক টুকরো করে কাগজ দিয়ে তাতে নিজের পছন্দ মত ফুলের গন্ধ, সেন্টের গন্ধ বা পাউডারের গন্ধের নাম লিখতে বলেছিলাম। তাঁরা লিখলেন। তাঁদের ভাবতে অনুরোধ করলাম, আপনারা এক মনে ভাবতে থাকুন আপনার লেখা গন্ধ কাগজে চলে আসুক। মিনিট তিন-চারেক চললো তাঁদের ভাবার পর্ব। বললাম, এ’বার কাগজের টুকরো নাকের কাছে নিয়ে এসে দেখুন তো গন্ধ পাচ্ছেন কি না? প্রত্যেকেই তাঁর তাঁর লেখা গন্ধই কাগজে পেয়েছিলেন। আর প্রথম যিনি পেয়েছিলেন, তিনি হলেন ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ পত্রিকার স্বনামধন্য সাংবাদিক পথিক গুহ।

দু’বছর আগের ঘটনা। সল্টলেকে গিয়েছি ‘নন্দন’ মাসিক পত্রিকার সহযোগী সম্পাদক সুমিত সেনগুপ্তের আমন্ত্রণে। দুর্গাপুজো উপলক্ষে নানা ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। আমরা পরিবেশন করবো ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’ শিরোনামে কুসংস্কার বিরোধী অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে অনেক বিখ্যাত তথাকথিত অলৌকিক ঘটনা ঘটিয়ে দেখানো হচ্ছিল ও এসবের পিছনের কারণগুলো ব্যাখ্যা করা হচ্ছিল। তিনজন দর্শককে ডাকলাম মঞ্চে। তিনটি চেয়ারে তাঁদের বসালাম। আমার অনুরোধ মতো তাঁরা চোখ বুজে এক মনে আমার কথা শুনছিলেন। আমি বলছিলাম, “আপনারা এক মনে ভাবতে থাকুন আপনাদের ডান কাধ থেকে হাতের আঙুল পর্যন্ত অবশ হয়ে যাচ্ছে। অবশ হয়ে যাচ্ছে।” এই ধরনের কথাকে মনোবিজ্ঞানের ভাষায় বলে suggestion বা ‘ধারণা সঞ্চার’। দু-তিন মিনিট এই

ধরনের কথা বলে তিনজনের মস্তিষ্ক-স্নায়ুকোষে ডান হাত অবশ হওয়ার ধারণা সঞ্চারিত করলাম। তারপর তিনজনের ডান হাতে ইঞ্জেকশনের তিনটে সিরিঞ্জ নিল পুরো ঢুকিয়ে দিলাম। ঘুমের মধ্যে আমাদের মশা কামড়ালে আমরা বুঝতে পারি। হাতের তালু সেখানে গিয়ে পড়ে মশা মারার অভিলাষে। আর এখানে ‘নিড্‌ল’ পুরো ঢুকে যাওয়া সত্ত্বেও তাঁদের চোখ পর্যন্ত সামান্য কুঁচকালো না। চোখ খোলার পর তিনজনই জানালেন, ছুঁচ ফোটার ব্যথা তো দূরের কথা, কিছু বুঝতেই পারেননি। এরপর দু’জনে তাঁদের হাতে ফোটানো সিরিঞ্জ নির্ভুল বের করে কয়েকবার নিজেদের ডান হাতে ঢোকালেন, বললেন কোনও ব্যথা অনুভব করছেন না।

এই ধরনের স্পর্শানুভূতির বিভ্রান্তি ঘটিয়েছি এই ঘটনার পরেও অদ্ভুত একশোবার। দর্শক ইংলিশবাজারের আধিবাসী থেকে আই আই টি খড়্গপুরের ছাত্র- অধ্যাপক সকলেই ।

‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’ অনুষ্ঠানে মঞ্চে আসতে বলেছি তিনজন দর্শককে। তাঁদের চেয়ারে বসিয়েছি। গভীরভাবে আমার কথা শুনতে অনুরোধ করেছি। তারপর তিনজনের কানের কাছে ধীরে ধীরে টানা টানা সুরে খুব নিচু স্বরে Suggestion দিয়েছি বা একটা ধারণাকে তাঁদের মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষে সঞ্চারিত করতে চেয়েছি। ধারণাটা হল, এই Suggestion শেষে ‘হিপনটিক ঘুম’ ভাঙানোর পর তাঁরা তিনজন সিগারেটের স্বাদ পাবেন যথাক্রমে টক, ঝাল, মিষ্টি। সাজেশন শেষে তিনজন সিগারেট ধরিয়েছেন, টেনেছেন এবং জানিয়েছেন, সিগারেটের স্বাদ গেছে পাল্টে। হয়ে গেছে যথাক্রমে টক, ঝাল ও মিষ্টি।

এতক্ষণ যা বললাম, তার সারমর্ম, ইন্দ্রিয়কে বিভ্রান্ত করা যায়, ইন্দ্রিয় বিভ্রান্ত হয়। যুক্তিবাদের সেই বক্তব্যের সঙ্গে এ’বার আমরা সহমত পোষণ করতে পারি যে, ইন্দ্রিয় আমাদের জ্ঞানার্জনে সাহায্য করে, এ’কথা যেমন সত্য, তেমন-ই সত্য ইন্দ্রিয় অনেক সময় আমাদের প্রতারিত করে। অবশ্য এই প্রতারণার পিছনেও রয়েছে যুক্তি। যে যুক্তিকে বুঝতে মনোবিজ্ঞান ও মস্তিষ্ক বিজ্ঞান সাহায্য করতে পারে।

 

যুক্তির রূপ রস পাল্টে দেয় সময়, সমাজ

কল্লোল আর পল্লবী হনিমুনে চলেছেন। শিলিগুড়ি থেকে একটা মারুতি ভাড়া নিয়েছেন। যাত্রা শেষ হবে গ্যাংটকে। পাহাড় ঘুরে ঘুরে গাড়ি উঠছে। চারদিকে শুধু সবুজ পাহাড়। কখনও ডাইনে, কখনও বাঁয়ে রুপোলি তিস্তা। পল্লবী গলা ছেড়ে গাইছেন, “আমার সকল নিয়ে বসে আছি / সর্বনাশের আশায় / আমি তার লাগি পথ চেয়ে থাকি / পথে যে জন ভাসায় …

কল্লোল জানেন না ঈশ্বর আছেন, কি নেই? জানতে চান না, স্বর্গ-নরক সত্যি কি না? কিন্তু আজ এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে, স্বর্গ যদি কোথাও থাকে, তা এখানে। প্রকৃতিই স্বর্গ। পাহাড় যে এত সুন্দর, এত স্বর্গীয়, এখানে এলে অনুভব করা যায়।

চার দিন পরে। কল্লোল ফিরছেন গ্যাংটক থেকে শিলিগুড়ি। আজও মারুতিতে। তবে আজ শুধু একা। পল্লবী নেই। কাল বিকেলে ওর দেহ দাহ করা হয়েছে। ফুল তুলতে গিয়ে পা পিছলে কুড়ি ফুট তলার রাস্তায়। হাসপাতালে যখন নিয়ে যাওয়া হল, তখন পল্লবী মৃত। এতো হাসি-খুসি, ছটফটে, রোমান্টিক পল্লবী আর নেই। গোটা ব্যাপারটাই কেমন যেন অলীক স্বপ্নের মত। পাহাড়ের প্রতিটি ইঞ্চিতে মৃত্যুফাঁদ পাতা। চোখ বুজে আছেন কল্লোল। চোখ খুললেই দু’পাশে শুধু ভয়ংকর মৃত্যুর হাতছানি । বীভৎস পাহাড়গুলোর দিকে তাকানো যাচ্ছে না। ওঃ! তলায় তিস্তার দিকে চোখ পড়তেই মনে হল, মৃত্যু-পরোয়ানা নিয়ে কিলবিল করে চলেছে একটা সাপ। এই নরক-দর্শন কখন শেষ হবে? দু’হাতে চুল খামচে ধরে চোখ বোজে কল্লোল ৷

এটা একটা গল্প ভাবলে গল্প। গল্প তো জীবন থেকেই উঠে আসে। সময়ে কল্লোলের চেতনায় যে পাহাড় ছিল স্বর্গীয়, সময়ে তা-ই নরক। কী অদ্ভুত কৌতুক !

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই যে আবেগের, চেতনার পথ পরিবর্তন—এর পেছনেও যুক্তি আছে। রোমান্টিকতার ছোঁয়ায় পথ ছিল রূপে-রসে-গন্ধে টইটম্বুর। ফেরার পথে প্রেমিকা হারানোর অসহ্য যন্ত্রণা সব পুড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছিল। প্রেমিকাকে ছিনিয়ে নিয়েছে যে পাহাড়, সেই পাহাড়ের বীভৎস ঘোরাটোপ থেকে পালাতে চাইছিল মন। এই দুটো মন-ই বাস্তব সত্য। শুধু সময় মনকে দু-রকম করেছে।

রবার্ট ঈগল বিবিসি’র প্রোডিউসর ইনচার্য। ভারতে এসেছিলেন যুক্তিবাদী আন্দোলনের ওপর একটা তথ্যচিত্র তুলতে। বেশ কিছু দিন ওঁর টিমের সঙ্গে গ্রাম থেকে শহর চষে বেড়াতে হচ্ছিল। একদিন মিস্টার ঈগল আমাকে বলেই ফেললেন, “তোমাদের দেশের ছেলেরা ছেলেদের সঙ্গে ঘুরে বেড়ায় আড্ডা মারে মেয়েরা মেয়েদের সঙ্গেই গল্প-গুজব করে। অদ্ভুত লাগে! এটাই কিন্তু তোমাদের সমাজের মূল স্রোত। তোমার কি মনে হয় না যে, এটা খুবই অস্বাস্থ্যকর মানসিক ব্যাপার ?

বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণের সহজাত প্রবৃত্তিকে খারাপ বলে মনে করে তোমাদের সমাজ। ছেলে-মেয়েদের বন্ধুত্বকে স্বাভাবিক বলে গ্রহণ করতে পারনি তোমরা। এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিণতি সমাজের পক্ষে খারাপ হতে বাধ্য। আমার মেয়ের অনেক বন্ধু, অনেক বান্ধবী। যদি দেখতাম ওর শুধু বান্ধবী আছে, বন্ধু নেই, তবে ওকে অবশ্যই নিয়ে যেতাম কোনও মনোবিদের কাছে। কারণ এটা স্বাভাবিক আচরণ নয়।”

মিস্টার ঈগলকে বলেছিলাম, “স্থান, কাল পাত্র অনুসারে অনেক কিছুই পাল্টে যায়। পাল্টে যায় যুক্তিবোধ, মূল্যবোধ। হ্যাঁ এটা ঠিক যে, এখনও আমাদের দেশের বেশিরভাগ পুরুষ মনে করেন—মেয়েরা থাকবেন তাঁদের অধীন। আর মেয়েরাও যুগ যুগ ধরে পুরুষদের অধীনতা মেনে আসছেন ।

এখনও বিবাহিত নারী-পুরুষের সম্পর্ক বোঝাতে আমরা স্ত্রী ও স্বামী

বলে থাকি। এদেশের শিক্ষিতারাও ‘স্বামী’ শব্দটি ব্যবহার

করেন। ‘স্বামী’ অর্থাৎ প্রভু। ‘প্রভু’ কখনই বন্ধু হয় না।

এখনও স্ত্রী স্বামীকে প্রণাম করেন। স্বামী কেন তবে স্ত্রীকে প্রণাম করবেন না? এমন প্রশ্ন তোলা সহ্য করবেন না এই সমাজের প্রায় সব নারী-পুরুষরাই।

“এখনও মেয়েকে বিয়ের সময় বাবা দান করে দেন পাত্র’র কাছে। আমাদের সমাজে মেয়েরা এখনও বস্তু, দানসামগ্রী। এখনও এমন বাবার সংখ্যাই বেশি, যাঁরা গর্বের সঙ্গে বলেন—আমার মেয়ে খুব-ই ভালো। কোনও ছেলে বন্ধু নেই।

‘ভালো মেয়ে’ আর ‘খারাপ মেয়ে’র সংজ্ঞা তোমার দেশে আর আমার দেশে আশমান-জমিনের ফারাক। তোমাদের সমাজটা ইউনাইটেড কিংডমের। আমাদের সমাজটা হাজার হাজার মাইল দূরের ভারতের। স্থান বা দেশ অনুসারেও সাংস্কৃতিক চেতনা, মূল্যবোধ, যুক্তিবোধ পাল্টায়, যেমন পাল্টায় সময় অনুসারে।

“জানো আমাদের দেশে এক সময় পুরুষদের বহু বিবাহ গর্বের ও গৌরবের ছিল। রক্ষিতা রাখা, পতিতাপল্লীতে যাওয়া আভিজাত্যের লক্ষণ ছিল। মৃত স্বামীর চিতায় স্ত্রীকে পুড়িয়ে মারা এবং সেই নিষ্ঠুর হত্যা-দৃশ্য দেখাও পুণ্য কাজ বলে বিবেচিত হত।

“আমাদের সমাজের এগিয়ে থাকা মানুষদের মধ্যে নারী-পুরুষ সম্পর্কের ধারণা আম-জনতার ধারণার সঙ্গে মেলে না। না মেলাটাই স্বাভাবিক। সংস্কৃতিগত ভাবে এগিয়ে থাকা মানুষের যুক্তিবোধ সাধারণ মানুষের থেকে অন্য রকম হবে—এটাই স্বাভাবিক। আমাদের দেশের এগিয়ে থাকা সংস্কৃতির পরিবারের ছেলে-মেয়েরা একে অন্যকে ‘মানুষ’ বলে স্বীকৃতি দিতে শিখেছে, বন্ধু বলে ভাবতে শিখেছে। এমন পরিবেশের মধ্যে বেড়ে ওঠা ছেলে-মেয়েদের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক সুন্দর ও স্বাভাবিক।

সাধারণভাবে স্বাভাবিক ও স্বতস্ফূর্ত। এর সঙ্গে সমকামিতার সম্পর্ক নেই। এটাই আমাদের সংস্কৃতি।”

অসমে গিয়েছিলাম গত বছর। শিলচর থেকে গুয়াহাটি বেশ কয়েকটা কুসংস্কার বিরোধী আলোচনাচক্রে অংশ নিতে হয়েছিল। গুয়াহাটিতে রাতে আমরা অনেকে হৈ হৈ করে আড্ডা দিচ্ছি। প্রায় সকলেই স্থানীয় তরুণ-তরুণী। এরই মধ্যে এক তরুণ চিত্র-সাংবাদিক পটাপট ছবি তোলা শুরু করলেন। একটি তরুণী, নামটা ঠিক মনে নেই, হঠাৎ আমারে উরুর ওপর বসে পড়লেন। একটুও অস্বস্তিতে নেই তরুণীটি বা স্থানীয় তরুণ-তরুণীরা। অস্বস্তি আকাশ ভেঙে আমার মাথায়। মেয়েটিকে বললাম, “আচ্ছা পাগল তো? আমার কোল থেকে ওঠো মা।”

মেয়েটি সহজ-সরল ভাবে বললেন, “তুমি তো আমার বাবার মতো। তোমার কোলে বসলে কী হয়েছে?”

কোল থেকে ওঠার নামটি না করে আমাকে জড়িয়ে ধরেই ছবি তুললেন। আমি জানি, বাবা-মায়ের এই ধরনের আদরের সম্পর্কের মধ্যে কোনও অস্বাভাবিকতা বা কদর্যতা দেখে না অসমের একটা বড় অংশের সংস্কৃতি। এ’সব জানার পরও পশ্চিমবাংলার জল-হাওয়ায় বড় হয়ে ওঠা আমি প্রতিবেশী অসমের সংস্কৃতিকে মানতে পারলাম কই ?

error: Content is protected !!