শ্লোকঃ ২৪

পুরোধসাং চ মুখ্যং মাং বিদ্ধি পার্থ বৃহস্পতিম্ ।

সেনানীনামহং স্কন্দঃ সরসামস্মি সাগরঃ ॥ ২৪ ॥

 পুরোধসাম্—পুরোহিতদের মধ্যে চ–ও; মুখাম — প্রধান: মাম্—আমাকে; বিদ্ধি— জানবে; পার্থ—হে পৃথাপুত্র; বৃহস্পতি — বৃহস্পতি, সেনানীনাম্ — সেনাপতিদের মধ্যে; অহম্ –আমি, স্কন্দঃ – কার্তিকেয়; সরসাম্— সমস্ত জলাশয়ের মধ্যে অস্থি- হই; সাগরঃ— সাগর।

গীতার গান

পুরোহিতগণ মধ্যে এই বৃহস্পতি ।

সেনানীর মধ্যে স্কন্দ সাগর জলেতি ॥

অনুবাদঃ হে পার্থ। পুরোহিতদের মধ্যে আমি প্রধান বৃহস্পতি, সেনাপতিদের মধ্যে আমি কার্তিক এবং জলাশয়ের মধ্যে আমি সাগর।

তাৎপর্যঃ স্বর্গরাজ্যের প্রধান দেবতা হচ্ছেন ইন্দ্র এবং তাঁকে স্বর্গের রাজা বলা হয়। তাঁর শাসনাধীন গ্রহলোককে ইন্দ্রলোক বলা হয়। বৃহস্পতি হচ্ছেন ইন্দ্রের পুরোহিত এবং ইন্দ্র যেহেতু সমস্ত রাজাদের মধ্যে প্রধান, সেই জন্য বৃহস্পতি হচ্ছেন সমস্ত পুরোহিতদের মধ্যে প্রধান। আর ইন্দ্র যেমন সমস্ত রাজাদের মধ্যে প্রধান, তেমনই শিব-পার্বতীর পুত্র স্কন্দও সমগ্র সেনাবর্গের মধ্যে প্রধান। আর সমস্ত জলাশয়ের মধ্যে সমুদ্রই হচ্ছে প্রধান। শ্রীকৃষ্ণের এই অভিব্যক্তিগুলি তাঁর মাহাত্ম্যকেই ইঙ্গিত করে।

শ্লোকঃ ২৫

মহর্ষীণাং ভৃগুরহং গিরামস্ম্যেকমক্ষরম্ ।

যজ্ঞানাং জপযজ্ঞোঽস্মি স্থাবরাণাং হিমালয়ঃ ॥ ২৫ ॥

মহর্ষীণাম্ — মহর্ষিদের মধ্যে, ভৃগুঃ – ভৃগু, অহম্ — আমি, গিরাম — বাকাসমূহের মধ্যে; অস্মি— হই; একম্ অক্ষরম্—এক অক্ষর প্রণব; যজ্ঞানাম্ — যজ্ঞসমূহের মধ্যে জপযজ্ঞঃ— জপযজ্ঞ, অগ্নি হই; স্থাবরাণাম্ স্থাবর বস্তুসমূহের মধ্যে হিমালয়:—হিমালয় পর্বত।

গীতার গান

মহর্ষিগণের মধ্যে ভৃগু আমি হই ৷

ওঙ্কার প্রণব আমি একাক্ষর সেই ॥

যজ্ঞ যত হয় তার মধ্যে আমি জপ ৷

অচলেতে হিমালয় স্থাবর যে সব ॥

অনুবাদঃ মহর্ষিদের মধ্যে আমি ভৃগু, বাক্যসমূহের মধ্যে আমি ওঁকার। যজ্ঞসমূহের মধ্যে আমি জপযজ্ঞ এবং স্থাবর বস্তুসমূহের মধ্যে আমি হিমালয়।

এই ব্রহ্মাণ্ডের প্রথম জীব ব্রহ্মা বিভিন্ন ধরনের প্রজাতি সৃষ্টির জন্য করো কজন সন্তান সৃষ্টি করেন। তাঁর সেই সন্তানদের মাধ্যে সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী সন্তান হচ্ছেন মহান ঋষি ভৃগু। সমস্ত অপ্রাকৃত শব্দের মধ্যে ওঁ (ওঁকার) শব্দরূপে ভগবানের প্রতিনিধিত্ব করে। সমস্ত যজ্ঞের মধ্যে হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে। হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে জপ করাই হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ যজ্ঞ, কারণ এই মহামন্ত্র হচ্ছে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সবচেয়ে পবিত্র প্রতীক। যজ্ঞ অনুষ্ঠানে কখনও কখনও পশুবলির নির্দেশ দেওয়া হয়, কিন্তু হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ করার মাধ্যমে যে মহাযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়, তাতে হিংসার কোন স্থান নেই। এটি সবচেয়ে সরল ও পবিত্রতম যজ্ঞানুষ্ঠান। জগতে যা কিছু পরম মহিমান্বিত, তা সবই শ্রীকৃষ্ণেরই প্রতীক। তাই, এই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পর্বত হিমালয় তারই প্রতীক। পূর্ববর্তী শ্লোকে মেরু পর্বতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু মেরু পর্বত কখনও কখনও এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গমন করে, কিন্তু হিমালয় অচল। এভাবেই হিমালয়ের মাহাত্ম্য মেরুর চেয়েও শ্রেষ্ঠ।

শ্লোকঃ ২৬

অশ্বত্থঃ সর্ববৃক্ষাণাং দেবর্ষীণাং চ নারদঃ।

গন্ধর্বাণাং চিত্ররথঃ সিদ্ধানাং কপিলো মুনিঃ ॥ ২৬ ॥

অশ্বত্থঃ—অশ্বত্থ বৃক্ষ; সর্ববৃক্ষাণাম্ — সমস্ত বৃক্ষের মধ্যে; দেবর্ষীণাম্—দেবর্ষিদের মধ্যে; চ–এবং, নারদঃ – নারদ মুনি; গন্ধর্বাণাম্ — গন্ধর্বদের মধ্যে, চিত্ররথঃ- চিত্ররথ; সিদ্ধানাম— সিদ্ধদের মধ্যে কপিলঃ মুনিঃ — কপিল মুনি ।

গীতার গান

সর্ব বৃক্ষ মধ্যে হই অশ্বত্থ বিশাল ৷

দেবর্ষির মধ্যে নাম নারদ আমার ॥

গন্ধর্বের চিত্ররথ সিদ্ধের কপিল ৷

মুনিগণের মধ্যে সে সর্বত জটিল ॥

অনুবাদঃ সমস্ত বৃক্ষের মধ্যে আমি অশ্বত্থ, দেবর্ষিদের মধ্যে আমি নারদ। গন্ধর্বদের মধ্যে আমি চিত্ররথ এবং সিদ্ধদের মধ্যে আমি কপিল মুনি ।

তাৎপর্যঃ অশ্বত্থ বৃক্ষ হচ্ছে গাছের মধ্যে সবচেয়ে বিশাল ও সবচেয়ে সুন্দর। ভারতবাসীরা প্রতিদিন সকালে অশ্বথ বৃক্ষের পূজা করে থাকেন। দেবতাদের মধ্যে দেবর্ষি নারদকেও তাঁরা পূজা করে থাকেন এবং তাঁকে এই জগতে ভগবানের শ্রেষ্ঠ ভক্ত বলে গণ্য করা হয়। এভাবেই নারদ হচ্ছেন ভগবানের ভক্তরূপী প্রকাশ। গন্ধর্বলোকের অধিবাসীরা সঙ্গীত-বিদ্যায় পারদর্শী এবং তাঁদের মধ্যে চিত্ররথ হচ্ছেন শ্রেষ্ঠ সঙ্গীতজ্ঞ। সিদ্ধদের মধ্যে দেবশ্রুতিনন্দন কপিলদের হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণের প্রতিনিধি। তাঁকে শ্রীকৃষ্ণের একজন অবতার বলা হয় এবং শ্রীমদ্ভাগবতে তাঁর দর্শনের উল্লেখ আছে। পরবর্তীকালে আর একজন কপিল খুব প্রসিদ্ধি লাভ করেন, তবে তাঁর প্রবর্তিত দর্শন নাস্তিক মতবাদ প্রসূত। তাই ভগবৎ অবতার কপিল এবং এই নাস্তিক কপিলের মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাত।

error: Content is protected !!