শ্লোকঃ ১৮

বিস্তরেণাত্মনো যোগং বিভূতিং চ জনার্দন ।

ভূয়ঃ কথয় তৃপ্তির্হি শৃণ্বতো নাস্তি মেহমৃতম্ ॥ ১৮ ॥

বিস্তরেণ — বিস্তারিতভাবে; আত্মনঃ – তোমার, যোগম্ — যোগ, বিভূতিম্—বিভূতি; চ—ও; জনার্দন—হে জনার্দন; ভূয়ঃ—পুনরায়, কথয় বল; তৃপ্তিঃ তৃপ্তি; হি—অবশ্যই; শৃণ্বতঃ—শ্রবণ করে; ন অস্তি— হচ্ছে না; মে – আমার, অমৃতম্ উপদেশামৃত ।

গীতার গান

হে জনার্দন তোমার যোগ বা বিভূতি ।

বিস্তার শুনিতে মন হয়েছে সে অতি ॥

পুনঃ পুনঃ বল যদি তবু তৃপ্ত নয় ৷

অমৃত তোমার কথা মৃতত্ত্ব না ক্ষয় ॥

অনুবাদঃ হে জনার্দন ! তোমার যোগ ও বিভূতি বিস্তারিতভাবে পুনরায় আমাকে বল। কারণ তোমার উপদেশামৃত শ্রবণ করে আমার পরিতৃপ্তি হচ্ছে না; আমি আরও শ্রবণ করতে ইচ্ছা করি।

তাৎপর্যঃ অনেকটা এই ধরনের কথা, শৌনক মুনির নেতৃত্বে নৈমিষারণ্যের ঋষিরা সূত গোস্বামীকে বলেছিলেন। সেই বিবৃতিটি হচ্ছে—

বয়ং তু ন বিতৃপাম উত্তমশোক বিক্রমে ।

যাচ্ছণ্ণতাং রসজ্ঞানাং স্বাদু স্বাদু পদে পদে।।

“উত্তমশ্লোকের দ্বারা বন্দিত শ্রীকৃষ্ণের অপ্রাকৃত লীলা নিরন্তর ভাবণ করলেও কখনও তৃপ্তি লাভ হয় না। ভগবানের সঙ্গে অপ্রাকৃত সম্পর্কে যারা যুক্ত হয়েছেন, তাঁরা পদে পদে তাঁর অপ্রাকৃত লীলারস আস্বাদন করেন।” (শ্রীমদ্ভাগবত ১/5/19) এভাবেই অর্জুনও ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সম্বন্ধে, বিশেষ করে কিভাবে তিনি সর্বব্যাপ্ত ভগবানরূপে বিরাজমান, তা জানতে ঐকান্তিকভাবে আগ্রহী।

এখন অমৃত সম্বন্ধে বলতে গেলে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সম্বন্ধে যে কোন বর্ণনা অমৃতময় এবং ব্যবহারিক অভিজ্ঞতার মাধ্যমে এই অমৃত আস্বাদন করা যায়। আধুনিক গল্প, উপন্যাস ও ইতিহাস ভগবানের অপ্রাকৃত লীলা থেকে ভিন্ন। জাগতিক গল্প-উপন্যাস একবার পড়ার পরেই মানুষ অবসাদ বোধ করে, কিন্তু ভগবান শ্রীকৃষ্ণের লীলা শ্রবণে কখনই ক্লান্তি আসে না। সেই জনাই সমগ্ৰ বিশ্ব- ব্রহ্মাণ্ডের ইতিহাস ভগবানের অবতারসমূহের লীলাকাহিনীর বর্ণনায় পরিপূর্ণ। যেমন, পুরাণ হচ্ছে অতীতের ইতিহাস, যাতে রয়েছে ভগবানের বিভিন্ন অবতারের লীলাবর্ণনা। এভাবেই ভগবানের এই সমস্ত লীলাকাহিনী বার বার পাঠ করলেও নিত্য নব নব রসের আস্বাদন লাভ করা যায়।

শ্লোকঃ ১৯

শ্রীভগবানুবাচ

হন্ত তে কথয়িষ্যামি দিব্যা হ্যাত্মবিভূতয়ঃ ।

প্রাধান্যতঃ কুরুশ্রেষ্ঠ নাস্ত্যন্তো বিস্তরসা মে ॥ ১৯ ॥

শ্রীভগবান্ উবাচ—পরমেশ্বর ভগবান বললেন: হস্ত-হ্যাঁ, তে– তোমাকে; কথয়িষ্যামি — আমি বলব, দিব্যাঃ— দিব্য; হি— অবশ্যই: আত্মবিস্তৃতয়ঃ—আমার বিভূতিসমূহ; প্রাধান্যতঃ– যেগুলি প্রধান; কুরুশ্রেষ্ঠ — হে কুরুণশ্রেষ্ঠ; নাত্তি নেই; অন্তঃ—অন্ত; বিস্তরস্য – বিভূতি বিস্তারের; মে – আমার ।

গীতার গান

শ্রীভগবান কহিলেনঃ

হে অর্জুন বলি শুন বিভূতি আমার ।

যাহার নাহিক অন্ত অনন্ত অপার ৷।

প্রধানত বলি কিছু শুন মন দিয়া ৷

কুরুশ্রেষ্ঠ নিজ শ্রেষ্ঠ বুঝ সে শুনিয়া।।

অনুবাদঃ পরমেশ্বর ভগবান বললেন – হে অর্জুন, আমার দিব্য প্রধান প্রধান বিভূতিসমূহ তোমাকে বলব, কিন্তু আমার বিভূতিসমূহের অন্ত নেই।

তাৎপর্যঃ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মহত্ত্ব ও তার বিভূতি উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। স্বতন্ত্র জীবাত্মার ইন্দ্রিয়গুলি সীমিত এবং তা দিয়ে কৃষ্ণ বিষয়ক তত্ত্ব পূর্ণরূপে জানা অসম্ভব। তবুও ভক্তেরা শ্রীকৃষ্ণকে জানতে চেষ্টা করেন, কিন্তু তাঁদের সেই প্রয়াস এই রকম নয় যে, কোন বিশেষ সময়ে অথবা জীবনের কোন বিশেষ স্তরে তারা শ্রীকৃষ্ণকে পূর্ণরূপে উপলব্ধি করতে সক্ষম। পক্ষান্তরে, শ্রীকৃষ্ণ সম্বন্ধীয় সমস্ত আলোচনা এতই আস্বাদনীয় যে, তা ভক্তদের কাছে অমৃতবৎ প্রতিভাত হয়। এভাবেই ভক্তেরা তা উপভোগ করেন। শ্রীকৃষ্ণের বিভূতি ও তাঁর বিভিন্ন শক্তির কথা আলোচনা করে শুদ্ধ ভক্তেরা দিব্য আনন্দ অনুভব করেন। তাই, তাঁরা নিরন্তর তা শ্রবণ ও কীর্তন করতে চান। শ্রীকৃষ্ণ জানেন যে, জীবেরা তার বিভূতির কূল-কিনারা পায় না। তাই, তিনি তাঁর বিভিন্ন শক্তির মুখ প্রকাশগুলি কেবল বর্ণনা করতে সম্মত হয়েছেন। প্রাধান্যতঃ (‘প্রধান’) কথাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ আমরা কেবল ভগবানের শক্তির কয়েকটি মুখ্য প্রকাশই কেবল অনুভব করতে পারি, কেন না তাঁর শক্তিবৈচিত্র্য অনন্ত। সেই অনন্ত শক্তিকে পরিপূর্ণভাবে উপলব্ধি করা আমাদের পক্ষে কখনই সম্ভব নয়। এই শ্লোকে ব্যবহৃত বিস্তৃতি কাতে উল্লেখ করা হয়েছে যার দ্বারা তিনি সমগ্র সৃষ্টিকে নিয়ন্ত্রণ করেন। অমরকোষ অভিধানে বিভূতি শব্দের অর্থে বলা হয়েছে ‘অসাধারণ ঐশ্বর্য’।

নির্বিশেষবাদীরা অথবা সর্বেশ্বরবাদীরা পরমেশ্বর ভগবানের অসাধারণ বিভূতি ও তাঁর দিব্য শক্তির প্রকাশ উপলব্ধি করতে পারে না। জড় ও চিন্ময় উভয় জগতেই ভগবানের শক্তি ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশের মাধ্যমে ব্যক্ত হয়েছে। এখানে শ্রীকৃষ্ণ বর্ণনা করেছেন, একজন সাধারণ মানুষও কিভাবে তা অনুভব করতে এভাবেই ভগবান তাঁর অনন্ত শক্তিকে কেবল আংশিকভাবে বর্ণনা  করেছেন।

শ্লোকঃ ২০

অহমাত্মা গুড়াকেশ সর্বভূতাশয়স্থিতঃ ।

অহমাদিশ্চ মধ্যং চ ভূতানামন্ত এব চ ॥ ২০ ॥

অহম্–আমি; আত্মা— আত্মা গুড়াকেশ- হে অর্জুন, সর্বভূত— সমস্ত জীবের আশয়স্থিতঃ—হৃদয়ে অবস্থিত; অহম্ — আমি; আদিঃ – আদি; চ–ও মধ্যম্ – মধ্য চাও; ভূতানাম্ — সমস্ত জীবের, অন্তঃ- অন্ত; এর— অবশ্যই; চ–এবং ।

গীতার গান

সর্বভূত আশ্রয় সে আমি গুড়াকেশ ।

আমি আদি আমি মধ্য আমি সেই শেষ ৷৷

অনুবাদঃ হে গুড়াকেশ। আমিই সমস্ত জীবের হৃদয়ে অবস্থিত পরমাত্মা। আমিই সর্বভূতের আদি, মধ্য ও অন্ত।

তাৎপর্যঃ এই শ্লোকে অর্জুনকে গুড়াকেশ বলে সম্বোধন করা হয়েছে, অর্থাৎ ‘যিনি নিদ্রারূপী তামসকে জয় করেছেন। যারা অজ্ঞানতার অন্ধকারে নিদ্রিত, তারা কখনই জানতে পারে না, পরমেশ্বর ভগবান কিভাবে বিবিধ প্রকারে জড় ও চিন্ময় জগতে নিজেকে প্রকাশ করেন। তাই, অর্জুনকে শ্রীকৃষ্ণের এভাবে সম্বোধন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অর্জুন যেহেতু এই তামসের অতীত, তাই পরমেশ্বর ভগবান তাঁকে বিভিন্ন বিভূতির কথা শোনাতে সম্মত হয়েছেন।

শ্রীকৃষ্ণ প্রথমে অর্জুনকে জ্ঞাপন করেছেন যে, তাঁর মুখা বিস্তারের মাধ্যমে তিনিই হচ্ছেন সমস্ত বিশ্বচরাচরের আত্মা। সৃষ্টির পূর্বে পরমেশ্বর ভগবান নিজেকে স্বাংশ পুরুষ অবতার রূপে প্রকাশিত করেন এবং তাঁর থেকেই সব কিছুর সৃষ্টি হয়। তাই, তিনি হচ্ছেন মহৎ-তত্ত্ব বা ব্রহ্মাণ্ডের উপাদানগুলির আত্মা। জড় শক্তি সৃষ্টির কারণ নয়, প্রকৃতপক্ষে মহাবিষ্ণু মহৎ-তত্ত্ব বা সমগ্র জড় শক্তিতে প্রবেশ করেন। তিনি হচ্ছেন আত্মা। মহাবিষ্ণু যখন প্রকটিত ব্ৰহ্মাণ্ডগুলির মধ্যে প্রবেশ করেন, তখন তিনি আবার প্রতিটি সত্তার অন্তরে পরমাত্মারূপে নিজেকে প্রকাশিত করেন। আমরা উপলব্ধি করতে পারি যে, চিন্ময় স্ফুলিঙ্গের উপস্থিতির ফলেই জীবের এই জড় দেহ সক্রিয় হয়। এই চিন্ময় স্ফুলিঙ্গ ব্যতীত দেহের কোন রকম বিকাশ হতে পারে না। তেমনই, পরম আত্মা শ্রীকৃষ্ণ প্রবেশ না করা পর্যন্ত জড় জগতের কোন রকম বিকাশ হতে পারে না। সুবল উপনিষদে বর্ণনা দেওয়া আছে, প্রকৃত্যাদিসর্বভূতান্তর্যামী সর্বশেষী চ নারায়ণঃ “পরম পুরুষোত্তম ভগবান পরমাত্মা রূপে সব কয়টি প্রকটিত ব্রহ্মাণ্ডেই বিরাজমান। “

শ্রীমদ্ভাগবতে তিনটি পুরুষ অবতারের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। সেগুলি আবার সাত্বত-তন্ত্রেও বর্ণিত আছে। বিফোর ত্রীণি রূপাণি পুরুষাখ্যানথো বিদুঃ “পরম পুরুষোত্তম ভগবান এই জড় জগতে কারণোদকশায়ী বিষ্ণু, গর্ভোদকশায়ী বিষ্ণু ও ক্ষীরোদকশায়ী বিষ্ণু—এই তিন রূপে নিজেকে প্রকটিত করেন।” ব্রহ্মাসংহিতায় (৫/৪৭) মহাবিষ্ণু বা কারণোদকশায়ী বিষ্ণুর বর্ণনা আছে। যঃ কারণার্ণবজলে ভজতি স্ম যোগনিদ্রাম—সর্ব কারণের পরম কারণ পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ মহাবিষ্ণু রূপে কারণ-সমুদ্রে শায়িত থাকেন। সুতরাং পরম পুরুষোত্তম ভগবান হচ্ছেন এই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের মূলতত্ত্ব, প্রকটিত বিচরাচরের পালনকর্তা এবং সমগ্র শক্তির সংহারকর্তা।

error: Content is protected !!