শ্লোকঃ ১৫

স্বয়মেবাত্মনাত্মানং বেত্থ ত্বং পুরুষোত্তম

ভূতভাবন ভূতেশ দেবদেব জগৎপতে ৷৷ ১৫ ॥

স্বাম্—স্বয়ং। এব—অবশ্যই, আত্মনা — নিজেই, আত্মানম্ — নিজেকে, বেথ — জান; ত্বম্—তুমি; পুরুষোত্তম হে পুরুষোত্তম; ভূতভাবন – হে সর্বভূতের উৎস; ভূতেশ — হে সর্বভূতের ঈশ্বর; দেবদেব-দেবতাদেরও দেবতা; জগৎপতে— হে বিশ্বপালক।

গীতার গান

হে পুরুষোত্তম, তুমি জান তোমার তোমাকে।

ভূতভাবন ভূতেশ দেবদেব জগৎপতে ৷।

তোমার বিভূতি যোগ দিব্য সে অশেষ ৷

যদি কৃপা করি বল বিস্তারি বিশেষ ।।

অনুবাদঃ হে পুরুষোত্তম! হে ভূতভাবন! হে ভূতেশ ! হে দেবদেব! হে জগৎপতে । তুমি নিজেই তোমার চিৎশক্তির দ্বারা তোমার ব্যক্তিত্ব অবগত আছ।

তাৎপর্যঃ অর্জুন ও অর্জুনের অনুগামীদের মতো যাঁরা ভক্তির মাধ্যমে ভগবানের সঙ্গে যুক্ত, তাঁরাই কেবল পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে জানতে পারেন। নাস্তিক ও আসুরিক ভাবাপন্ন মানুষেরা কখনই শ্রীকৃষ্ণকে জানতে পারে না। মনোধর্ম-প্রসূত জল্পনা- কল্পনা যা ভগবানের থেকে মানুষকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়, তা একটি অত্যন্ত গর্হিত পাপ। সুতরাং যারা ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে জানে না, তাদের কখনই ভগবদ্গীতার ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা উচিত নয়। ভগবদ্গীতা হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণের বাণী এবং যেহেতু তা কৃষ্ণতত্ত্ব-বিজ্ঞান, তা আমাদের শ্রীকৃষ্ণের কাছ থেকে বুঝতে চেষ্টা করা উচিত, ঠিক যেভাবে অর্জুন তা বুঝেছিলেন। নাস্তিকের কাছ থেকে কখনই ভগবদ্গীতা শোনা উচিত নয়। শ্রীমদ্ভাগবতে (১/২/১১) বলা হয়েছে-

বদন্তি তত্তত্ত্ববিদস্তত্ত্বং যজ্ঞানমদ্বয়ম্ ।

ব্রহ্মেতি পরমাত্মেতি ভগবানিতি শব্দ্যতে।।

পরমতত্ত্বকে তিন রূপে উপলব্ধি করা যায়— নির্বিশেষ ব্রহ্ম, সর্বভূতে বিরাজমান পরমাত্মা এবং সবশেষে পরম পুরুষোত্তম ভগবানরূপে। সুতরাং পরম তত্ত্বের চরম উপলব্ধির স্তরেই কেবল পরম পুরুষোত্তম ভগবানের সান্নিধ্যে আসতে পারা যায়। মুক্ত পুরুষ, এমন কি সাধারণ মানুষেরা নির্বিশেষ ব্রহ্ম অথবা সর্বভূতে বিরাজমান পরমাত্মাকে উপলব্ধি করতে পারে, কিন্তু তবুও তারা ভগবদ্গীতার শ্লোকের মাধ্যমে এই গীতার বক্তা সবিশেষ ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে নাও বুঝতে পারে। নির্বিশেষবাদীরা কখনও কখনও শ্রীকৃষ্ণকে ভগবান বলে স্বীকার করেন অথবা তাঁর প্রামাণিকতা স্বীকার করেন। তবুও বহু মুক্ত পুরুষ শ্রীকৃষ্ণকে পুরুষোত্তম বা পরম পুরুষ বলে বুঝতে পারেন না। তাই, অর্জুন তাঁকে পুরুষোত্তম বলে সম্বোধন করেছেন। তবুও অনেকে এখনও নাও জানতে পারে যে, কৃষ্ণ হচ্ছেন সমস্ত জীবের পিতা। তাই, অর্জুন তাঁকে ভূতভাবন বলে সম্বোধন করেছেন। আর তাঁকে সর্বজীবের পরম পিতা বলে জানলেও অনেকে তাঁকে পরম নিয়তারূপে নাও জানতে পারে; তাই এখানে তাঁকে ভূতেশ অর্থাৎ সর্বভূতের পরম নিয়ন্তা বলে সম্বোধন করা হয়েছে। আর এমন কি কৃষ্ণাকে সর্বভূতের পরম নিয়ন্তা বলে জানলেও, অনেকে তাকে সমস্ত দেব-দেবীর উৎস বলে নাও জানতে পারে, তাই তাঁকে এখানে দেবদেব অর্থাৎ সমস্ত দেবতাদের আরাধ্য দেবতা বলে সম্বোধন করা হয়েছে। আর এমন কি তাঁকে সমস্ত দেবতাদের আরাধ্য দেবতা বলে জানলেও অনেকে তাঁকে সমস্ত জগতের পতিরূপে নাও জানতে পারেন; তাই তাকে জগৎপতে বলে সম্বোধন করা হয়েছে। এভাবেই অর্জুনের উপলব্ধির মাধ্যমে এই শ্লোকটিতে কৃষ্ণতত্ত্ব বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমাদের কর্তব্য হচ্ছে, অর্জুনের পদাঙ্ক অনুসরণ করে যথাযথভাবে শ্রীকৃষ্ণকে জানতে চেষ্টা করা।

শ্লোকঃ ১৬

বক্তুমর্হস্যশেষেণ দিব্যা হ্যাত্মবিভূতয়ঃ।

যাভির্বিভূতিভির্লোকানিমাংস্ত্বং ব্যাপ্য তিষ্ঠসি ॥ ১৬ ॥

বক্তৃম্—বলতে, আইসি — সক্ষম; অশেষেণ – বিস্তারিতভাবে; দিব্যাঃ— দিবা: হি- অবশ্যই, আত্ম— স্বীয়; বিভূতয়ঃ — বিভূতিসকল; যাভিঃ- যে সমস্ত: বিভূতিভিঃ- বিভূতি দ্বারা লোকান্—লোকসমূহ; ইমান্—এই সমস্ত ম্—তুমি, ব্যাপ্য ব্যাপ্ত হয়ে; তিষ্ঠসি — অবস্থান করছ।

গীতার গান

যে যে বিভূতি বলে ভুবন চতুৰ্দশ ৷

ব্যাপিয়া রয়েছ তুমি সর্বত্র সে যশ ।।

কিভাবে করিয়া চিন্তা তোমার মহিমা ।

হে যোগী তোমাকে জানি তাহা সে কহিবা ।।

অনুবাদঃ তুমি যে সমস্ত বিভৃতির দ্বারা এই লোকসমূহে পরিব্যাপ্ত হয়ে আছ, সেই সমস্ত তোমার দিব্য বিভূতি সকল তুমিই কেবল বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করতে সমর্থ।

তাৎপর্যঃ এই শ্লোকটি পড়ে প্রতীয়মান হয় যে, অর্জুন যেন পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ভগবত্তা সম্বন্ধে ইতিমধ্যেই নিঃসন্দেহ হয়েছেন। শ্রীকৃষ্ণের কৃপায় অর্জুন ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, বুদ্ধি ও জ্ঞান অর্জন করেছেন এবং এগুলির মাধ্যমে মানুষ আর যা কিছু অর্জন করতে পারে, সেই সবের দ্বারাই তিনি শ্রীকৃষ্ণকে পরম পুরুষোত্তম ভগবান বলে উপলব্ধি করতে পেরেছেন। ভগবান সম্বন্ধে তাঁর মনে আর কোন সংশয় নেই, তবু তিনি শ্রীকৃষ্ণকে অনুরোধ করেছেন তাঁর সর্বব্যাপ্ত বিভূতির কথা সবিস্তারে বর্ণনা করতে। সাধারণ লোকেরা এবং বিশেষ করে নির্বিশেষবাদীরা প্রধানত পরম-তত্ত্বের সর্বব্যাপ্ত রূপের প্রতিই আগ্রহী। তাই অর্জুন শ্রীকৃষ্ণকে জিজ্ঞাসা করছেন, তাঁর বিবিধ শক্তির মাধ্যমে তাঁর সর্বব্যাপ্ত রূপে তিনি কিভাবে বিরাজ করেন। এখানে আমাদের বোঝা উচিত যে, অর্জুন শ্রীকৃষ্ণকে এই প্রশ্নগুলি করেছেন সাধারণ মানুষের হয়ে, তাদের সন্দেহ দূর করার জন্য।

শ্লোকঃ ১৭

কথং বিদ্যানহং যোগিংস্তাং সদা পরিচিন্তয়ন।

কেষু কেষু চ ভাবেষু চিন্ত্যোঽসি ভগবন্ময়া ॥ ১৭ ॥

কথা—কিভাবে; বিদ্যাম্ অহম্ — আমি জানব, যোগিন — হে যোগেশ্বর; স্বাম্- তোমাকে, সদা-সর্বদা; পরিচিস্তায়— চিন্তা করে; কে— কোন্; কেষু— কোন্ চ—ও; ভাবে ভাবে, চিন্তাঃ অসি – চিন্তনীয় হও; ভগবন্ – হে পরমেশ্বর ভগবান; ময়া—আমার দ্বারা।

গীতার গান

কিভাবে বুঝিব আমি তোমার সে বৈভব ৷

কৃপা করি তুমি মোরে কহ সে ভাব ৷।

অনুবাদঃ হে যোগেশ্বর! কিভাবে সর্বদা তোমার চিন্তা করলে আমি তোমাকে জানতে পারব? হে ভগবন্! কোন্ কোন্ বিবিধ আকৃতির মাধ্যমে আমি তোমাকে চিন্তা করব?

তাৎপর্যঃ পূর্ববর্তী অধ্যায়ে বর্ণনা করা হয়েছে যে, পরম পুরুষোত্তম ভগবান তাঁর যোগমায়ার দ্বারা আবৃত থাকেন। যে সকল ভক্ত তাঁর চরণে সর্বতোভাবে আত্মসমর্পণ করেছেন, তাঁরাই কেবল তাঁকে দেখতে পারেন। এখন অর্জুনের মনে আর কোন সংশয় নেই যে, তাঁর বন্ধু শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান, কিন্তু তিনি জানতে চান কিভাবে সাধারণ মানুষ সর্বব্যাপক পরমেশ্বর ভগবানকে জানতে পারে। কোন সাধারণ মানুষ, নাস্তিক ও অসুরেরা শ্রীকৃষ্ণকে জানতে পারে না, কারণ শ্রীকৃষ্ণ তাঁর যোগমায়ার শক্তি দ্বারা আচ্ছাদিত থাকেন। কিন্তু তবুও অর্জুন আবার এই প্রশ্নগুলি করেছেন তাদেরই মঙ্গলের জন্য। উত্তম ভক্ত কেবল নিজের জানার জন্যই শুধু উৎসাহী নন, সমগ্র মানবজাতি যাতে জানতে পারে সেদিকে তাঁর লক্ষ্য। সুতরাং, যেহেতু অর্জুন হচ্ছেন ভগবদ্ভক্ত বৈষ্ণব, তাই অহৈতুকী কৃপার বশবর্তী হয়ে তিনি ভগবানের সর্বব্যাপকতার নিগূঢ় রহস্যের আবরণ জনসাধারণের কাছে উন্মোচিত করেছেন। তিনি শ্রীকৃষ্ণকে বিশেষত যোগী বলে সম্বোধন করেছেন, কারণ শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন যোগমায়া শক্তির অধীশ্বর। এই যোগমায়ার দ্বারা তিনি সাধারণ মানুষের কাছে নিজেকে আচ্ছাদিত করে রাখেন অথবা প্রকাশিত করেন। শ্রীকৃষ্ণের প্রতি যে মানুষের ভক্তি নেই, সে শ্রীকৃষ্ণের কথা সব সময়ে চিন্তা করতে পারে না। তাই তাকে জড়-জাগতিক পদ্ধতিতেই চিন্তা করতে হয়। অর্জুন এই জড় জগতের বিষয়াসক্ত মানুষের কথা বিবেচনা করেছেন। কেষু কেষু চ ভাবেষু কথাটি জড়া প্রকৃতিকে উল্লেখ করে (ভাব শব্দটির অর্থ ‘জড় বস্তু’)। যেহেতু বিষয়াসক্ত মানুষেরা শ্রীকৃষ্ণের অপ্রাকৃত স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারে না, তাই এখানে তাদের নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে জড় বিষয়ে মনকে নির্বিষ্ট করে এবং তার মধ্যে দিয়ে কিভাবে শ্রীকৃষ্ণ সর্বত্রই নিজেকে প্রকাশিত করছেন, তা দেখবার চেষ্টা করতে।

error: Content is protected !!