শ্লোকঃ ৮

অহং সর্বস্য প্রভবো মত্তঃ সর্বং প্রবর্ততে ।

ইতি মত্বা ভজন্তে মাং বুধা ভাবসমন্বিতাঃ ॥ ৮॥

অহম্ — আমি; সর্বস্য— সকলের, প্রভবঃ — উৎপত্তির হেতু; মত্তঃ – আমার থেকে, সর্বা— সব কিছু; প্রবর্ততে— প্রবর্তিত হয়; ইতি— এভাবে; মত্বা— জেনে; ভজন্তে- ভজন করেন; মাম্—আমাকে; বুধাঃ — পণ্ডিতগণ ; ভাবসমন্বিতাঃ – ভাবযুক্ত হয়ে।

গীতার গান

প্রাকৃতাপ্রাকৃত সব আমা হতে হয় ৷

বুদ্ধিমান ব্যক্তি জানি আমাকে ভজয় ৷৷

আমার যে ভাব তাহা ভক্তির লক্ষণ ।

অপণ্ডিত নাহি জানে জানে পণ্ডিতগণ ॥

অনুবাদঃ আমি জড় ও চেতন জগতের সব কিছুর উৎস। সব কিছু আমার থেকেই প্রবর্তিত হয়। সেই তত্ত্ব অবগত হয়ে পণ্ডিতগণ শুদ্ধ ভক্তি সহকারে আমার ভজনা করেন।

তাৎপর্যঃ যে সমস্ত পণ্ডিত শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর মতো নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে যথার্থ বৈদিক জ্ঞান লাভ করেছেন এবং সেই শিক্ষা কিভাবে কাজে লাগাতে হয় তা বুঝেছেন, তাঁরা জানেন যে, প্রাকৃত ও অপ্রাকৃত উভয় জগতের সব কিছু শ্রীকৃষ্ণ থেকে উদ্ভূত এবং সেই তত্ত্বজ্ঞান লাভ করার ফলে তাঁরা অনন্য ভক্তি সহকারে ভগবানের সেবায় নিযুক্ত হন। তাঁরা কখনই অপসিদ্ধান্ত বা মূর্খ মানুষের অপপ্রচারের দ্বারা প্রভাবিত হন না। সমস্ত বৈদিক শাস্ত্ৰ এক বাক্যে স্বীকার করে যে, শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন ব্রহ্মা, শিব আদি সমস্ত দেব-দেবীর উৎস। অথর্ব বেদে (গোপালতাপনী উপনিষদ ১/২৪) বলা হয়েছে, যো ব্রহ্মাণং বিদধাতি পূর্বং যো বৈ বেদাংশ্চ গাপয়তি স্ম কৃষ্ণঃ—”ব্রহ্মা, যিনি পূর্বকালে বৈদিক জ্ঞান প্রদান করেন, তিনি সেই জ্ঞান সৃষ্টির আদিতে শ্রীকৃষ্ণের কাছ থেকে প্রাপ্ত হন।” তারপর পুনরায় নারায়ণ উপনিষদে (১) বলা হয়েছে, “অথ পুরুষো হ বৈ নারায়ণোহ কাময়ত প্রজাঃ সৃজেয়েতি— “তারপর পরমেশ্বর ভগবান নারায়ণ প্রাণী সৃষ্টির ইচ্ছা করেন।” উপনিষদে আরও বলা হয়েছে, নারায়ণাদ ব্রহ্মা জায়তে, নারায়ণাদ প্রজাপতিঃ প্রজায়তে, নারায়ণাদ ইন্দ্রো জায়তে, নারায়ণাদ অষ্টো বলবো জায়তে, নারায়দাদ একাদশ রুদ্রো জায়ত্তে, নারায়ণাদ দ্বাদশাদিত্যাঃ- “নারায়ণ হতে ব্রহ্মার জন্ম হয়, নারায়ণ হতে, প্রজাপতিদের জন্ম হয়, নারায়ণ হতে ইন্দ্রের জন্ম হয়, নারায়ণ হতে অষ্টবসুর জন্ম হয়, নারায়ণ থেকে একাদশ রুদ্রের জন্ম হয় এবং নারায়ণ থেকে দ্বাদশ আদিত্যের জন্ম হয়।” এই নারায়ণ হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণের স্বাংশ প্রকাশ।

সেই একই বেদে আরও বলা হয়েছে, ব্রহ্মাণ্যো দেবকীপুত্রঃ—“দেবকীপুত্র শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান”। (নারায়ণ উপনিষদ ৪) তারপর বলা হয়েছে, একো বৈ নারায়ণ আসীন্ ন ব্রহ্মা ন ঈশানো নাপো নাগ্নি-সমৌ নেমে দ্যাবাপৃথিবী ন নক্ষত্রাণি ন সূর্যঃ – “সৃষ্টির আদিতে কেবল পরম পুরুষ নারায়ণ ছিলেন। ব্রহ্মা ছিল না, শিব ছিল না, অগ্নি ছিল না, চন্দ্র ছিল না, আকাশে নক্ষত্র ছিল না এবং সূর্য ছিল না।” (মহা উপনিষদ ১) মহা উপনিষদে আরও বলা হয়েছে যে, শিবের জন্ম হয় পরমেশ্বর ভগবানের ভ্রূযুগলের মধ্য থেকে। এভাবেই বেদে বলা হয়েছে যে, ব্রহ্মা ও শিবের যিনি সৃষ্টিকর্তা, সেই পরমেশ্বর ভগবানই হচ্ছেন সকলের আরাধ্য।

মোক্ষধর্মে শ্রীকৃষ্ণও বলেছেন—

প্রজাপতিং চ রুদ্রং চাপাহমের সৃজামি বৈ

তৌ হি মাং ন বিজানীতো মম মায়াবিমোহিতৌ ॥

“প্রজাপতিগণ, রুদ্র ও অন্য সকলকে আমি সৃষ্টি করেছি, যদিও তাঁরা তা জানেন না। কারণ, তাঁরা আমার মায়াশক্তির দ্বারা বিমোহিত।” বরাহ পুরাণেও বলা হয়েছে—

নারায়ণঃ পরো দেবস্তস্মজ্জাতশ্চতুর্মুখঃ ।

তস্মাদ রুদ্রোহভবদ্ দেবঃ স চ সর্বজ্ঞাতাং গতঃ ।।

“নারায়ণ হচ্ছেন পরম পুরুষোত্তম ভগবান আর তাঁর থেকে ব্রহ্মার জন্ম হয়, তাঁর থেকে শিবের জন্ম হয়।”

শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন সমস্ত সৃষ্টির উৎস এবং তাঁকে বলা হয় সব কিছুর নিমিত্ত কারণ। তিনি বলেছেন, “যেহেতু সব কিছু আমার থেকে সৃষ্টি হয়েছে, তাই আমিই সব কিছুর আদি উৎস। সব কিছুই আমার অধীন। আমার উপরে কেউ নেই।” শ্রীকৃষ্ণ ছাড়া পরম নিয়ন্তা আর কেউ নেই। সদগুরু ও বৈদিক শাস্ত্র থেকে শ্রীকৃষ্ণ সম্বন্ধে যিনি এই জ্ঞান লাভ করেন, তিনি তাঁর সমস্ত শক্তি কৃষ্ণভাবনার নিয়োজিত করেন এবং তিনিই হচ্ছেন যথার্থ জ্ঞানী। তাঁর তুলনায় অন্য সকলে যারা কৃষ্ণ- তত্ত্বজ্ঞান যথাযথভাবে লাভ করেনি, তারা নিতান্তই মূর্খ। মূর্খেরাই কেবল শ্রীকৃষ্ণকে • একজন সাধারণ মানুষ বলে মনে করে। মূর্খদের প্রলাপের দ্বারা কৃষ্ণভক্তের কখনই বিচলিত হওয়া উচিত নয়; ভগবদ্‌গীতার সমস্ত অপ্রামাণিক ভাষ্য ও ব্যাখ্যায় কর্ণপাত না করে দৃঢ় প্রত্যয় ও গভীর নিষ্ঠার সঙ্গে ভক্তির অনুশীলন করা উচিত।

শ্লোকঃ ৯

মচ্চিত্তা মদ্‌গতপ্রাণা বোধয়ন্তঃ পরস্পরম্ ।

কথয়ন্তশ্চ’ মাং নিত্যং তুষ্যন্তি চ রমন্তি চ ॥ ৯ ॥

মচ্চিত্তা: — যাঁদের চিত্ত সম্পূর্ণরূপে আমাতে সমর্পিত, ‘ মদ্‌গতপ্রাণাঃ—তাঁদের প্রাণ আমাতে সমর্পিত, বোধয়ন্তঃ—বুঝিয়ে; পরস্পর পরস্পরকে কথান্তঃ- আলোচনা করে, চ—ও, মাম্—আামার সম্বন্ধেই; নিত্যম্—সর্বদা; তুষান্তি—তুষ্ট হন; চ—ও; রমন্তি — অপ্রাকৃত আনন্দ লাভ করেন; চ–ও ।

গীতার গান

আমার অনন্য ভক্ত মচিত্ত মন্ত্রাণ ।

পরস্পর বুঝে পড়ে আনন্দে মগন ।।

আমার সে কথা নিত্য বলিয়া শুনিয়া ।

ভোষণ রমণ করে ভক্তিতে মজিয়া ।।

অনুবাদঃ যাঁদের চিত্ত ও প্রাণ সম্পূর্ণরূপে আমাতে সমর্পিত, তাঁরা পরস্পরের মধ্যে আমার কথা সর্বদাই আলোচনা করে এবং আমার সম্বন্ধে পরস্পরকে বুঝিয়ে পরম সন্তোষ ও অপ্রাকৃত আনন্দ লাভ করেন।

তাৎপর্যঃ শুদ্ধ ভক্ত, যাঁদের বৈশিষ্ট্যের কথা এখানে বলা হয়েছে, তাঁরা সর্বদাই পূর্ণরূপে ভগবানের অপ্রাকৃত প্রেমভক্তিতে যুক্ত থাকেন। তাঁদের মন কখনই শ্রীকৃষ্ণের চরণারবিন্দ থেকে বিক্ষিপ্ত হয় না। তাঁরা সর্বদাই অপ্রাকৃত বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা করেন। ভগবানের শুদ্ধ ভক্তের লক্ষণ এই শ্লোকে বিশেষভাবে বর্ণিত হয়েছে। ভগবদ্ভক্ত দিনের চব্বিশ ঘণ্টাই ভগবানের লীলাসমূহ কীর্তনে মগ্ন থাকেন। তাঁদের মনপ্রাণ সর্বদাই শ্রীকৃষ্ণের চরণারবিন্দে নিমগ্ন থাকে এবং অন্যান্য ভক্তের সঙ্গে তিনি ভগবানের কথা আলোচনা করে গভীর আনন্দ উপভোগ করেন।

ভগবদ্ভক্তির প্রাথমিক স্তরে ভক্ত ভগবানের সেবার মাধ্যমেই অপ্রাকৃত আনন্দ উপভোগ করেন এবং পরিপক্ক অবস্থায় তাঁরা ভগবৎ-প্রেমে প্রকৃতই মগ্ন থাকেন। একবার অপ্রাকৃত স্তরে অধিষ্ঠিত হলে, তখন তাঁরা পূর্ণতম রস আস্বাদন করতে পারেন, যা ভগবান তাঁর ধামে প্রদর্শন করে থাকেন। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু ভগবদ্ভক্তিকে জীবের হৃদয়ে বীজ বপন করার সঙ্গে তুলনা করেছেন। ব্রহ্মাণ্ডে বিভিন্ন গ্রহে অসংখ্য জীব ভ্রমণ করে বেড়াচ্ছে। তাদের মধ্যে কোন ভাগ্যবান জীব শুদ্ধ ভক্তের সংস্পর্শে আসার ফলে ভগবদ্ভক্তির নিগূঢ় রহস্যের কথা অবগত হতে সক্ষম হন। এই ভগবদ্ভক্তি ঠিক একটি বীজের মতো এবং তা যদি জীবের হৃদয়ে বপন করা হয় এবং হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে। হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে—এই মহামন্ত্র শ্রবণ ও কীর্তনরূপ জল সিঞ্চন করা হয়, তা হলে সেই বীজ অঙ্কুরিত হয়। ঠিক যেমন, নিয়মিত জল সিঞ্চনের ফলে একটি গাছের বীজ অঙ্কুরিত হয়। এই অপ্রাকৃত ভক্তিলতা ক্রমে ক্রমে বর্ধিত হয়ে জড় ব্রহ্মাণ্ডের আবরণ ভেদ করে চিৎ-আকাশের ব্রহ্মজ্যোতিতে প্রবেশ করে। চিৎ-আকাশেও এই লতা বর্ধিত হতে থাকে এবং অবশেষে সর্বোচ্চ আলয় শ্রীকৃষ্ণের পরম গ্রহলোক গোলোক বৃন্দাবনে প্রবেশ করে। পরিশেষে, এই লতা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চরণকমলে আশ্রয় গ্রহণ করে এবং সেখানে বিশ্রাম লাভ করে। একটি লতা যেমন ক্রমশ ফল-ফুল উৎপাদন করে, সেই ভক্তিলতাও সেখানে ফল উৎপাদন করতে থাকে এবং সেই সঙ্গে শ্রবণ ও কীর্তনরূপ জল সিঞ্চনের পন্থা চলতে থাকে। শ্রীচৈতন্য-চরিতামৃতে (মধ্যলীলা ঊনবিংশতি অধ্যায়ে) এই ভক্তিলতার পূর্ণ বিবরণ দেওয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে যে, এই ভক্তিলতা যখন সম্পূর্ণভাবে ভগবানের চরণ কমলে আশ্রয় গ্রহণ করে, ভক্ত তখন ভগবৎ- প্রেমে নিমগ্ন হন। তখন তিনি এক মুহূর্তের জন্যও ভগবানের সংস্পর্শ ব্যতীত থাকতে পারেন না—ঠিক যেমন একটা মাছ জল ছাড়া বেঁচে থাকতে পারে না। এই অবস্থায়, পরমেশ্বর ভগবানের সংস্পর্শে আসার ফলে ভক্ত সমস্ত দিব্যগুণে গুণান্বিত হন।

শ্রীমদ্ভাগবতও ভক্তের সঙ্গে ভগবানের এই রকম দিব্য সম্পর্কের বর্ণনায় পরিপূর্ণ। তাই, শ্রীমদ্ভাগবত ভক্তদের অতি প্রিয় এবং সেই কথা ভাগবতেই (১২/১৩/১৮) বর্ণিত আছে। শ্রীমদ্ভাগবতং পুরাণমমলং যদ্বৈষ্ণবানাং প্রিয়ম্। এই বর্ণনায় কোন রকম জড়-জাগতিক কর্মের, ইন্দ্রিয়-তৃপ্তির অথবা মুক্তির উল্লেখ নেই। শ্রীমদ্ভাগবতই হচ্ছে একমাত্র গ্রন্থ, যেখানে ভগবান ও তার ভক্তের অপ্রাকৃত লীলাসমূহ পূর্ণরূপে বর্ণিত হয়েছে। এভাবেই কৃষ্ণভাবনাময় শুদ্ধ ভক্তেরা অপ্রাকৃত সাহিত্য শ্রীমদ্ভাগবত শ্রবণ করার মাধ্যমে নিরবচ্ছিন্ন আনন্দ উপভোগ করেন, ঠিক যেমন, কোন যুবক-যুবতী পরস্পরের সঙ্গ লাভের ফলে আনন্দ উপভোগ করে থাকে।

শ্লোকঃ ১০

তেষাং সততযুক্তানাং ভজতাং প্রীতিপূর্বকম্ ।

দদামি বুদ্ধিযোগং তং যেন মামুপযান্তি তে ৷৷ ১০ ॥

তেষাম্—তাদের; সততযুক্তানাম্ — নিত্যযুক্ত; ভজতাম্ — ভক্তিযুক্ত সেবাপরায়ণ হয়ে; প্রীতিপূর্বকম্—প্রীতিপূর্বক; দদামি—দান করি; বুদ্ধিযোগম্ — বুদ্ধিযোগ; তম্ – সেই; যেন—যার দ্বারা: মাম্—আমাকে উপযাস্তি — প্রাপ্ত হন; তে—তাঁরা।

গীতার গান

সেই নিত্যযুক্ত যারা ভজনে কুশল ।

প্রীতির সহিত তারা ধরে ভক্তিবল ॥

আমি দিই ভক্তিযোগ তাদের অন্তরে।

আমার পরম ধাম তারা লাভ করে ৷।

অনুবাদঃ যাঁরা ভক্তিযোগ দ্বারা প্রীতিপূর্বক আমার ভজনা করে নিত্যযুক্ত, আমি তাঁদের শুদ্ধ জ্ঞানজনিত বুদ্ধিযোগ দান করি, যার দ্বারা তাঁরা আমার কাছে ফিরে আসতে পারেন ।

তাৎপর্যঃ এই শ্লোকে বুদ্ধিযোগম্ কথাটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এই সম্পর্কে দ্বিতীয় অধ্যায়ে ভগবান অর্জুনকে যে উপদেশ দিয়েছেন, তা আমরা স্মরণ করতে পারি। সেখানে ভগবান অর্জুনকে বলেছেন যে, তিনি তাঁকে বুদ্ধিযোগ সম্বন্ধে উপদেশ দেবেন। এখানে সেই বুদ্ধিযোগের ব্যাখ্যা করা হয়েছে। বুদ্ধিযোগের অর্থ হচ্ছে কৃষ্ণভাবনাময় কর্ম। সেটিই হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ বুদ্ধিবৃত্তি। বুদ্ধির অর্থ হচ্ছে বোধশক্তি এবং যোগের অর্থ হচ্ছে অতীন্দ্রিয় কার্যকলাপ অথবা যোগারূঢ়। কেউ যখন তাঁর প্রকৃত আলয় ভগবৎ-ধামে ফিরে যেতে চান এবং সেই উদ্দেশ্যে কৃষ্ণভাবনাময় ভগবৎ-সেবায় সমাকভাবে নিযুক্ত হন, তখন তাঁর সেই কার্যকলাপকে বলা হয় বুদ্ধিযোগ। পক্ষান্তরে, বুদ্ধিযোগ হচ্ছে সেই পন্থা, যার ফলে জড় জগতের বন্ধন থেকে মুক্তি লাভ করা যায়। সাধনার পরম লক্ষ্য হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণ। সাধারণ মানুষ সেই কথা জানে না। তাই, ভগবদ্ভক্ত ও সদ্গুরুর সঙ্গ অতি আবশ্যক। আমাদের সকলেরই জানা উচিত যে, পরম লক্ষ্য হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণ এবং সেই লক্ষ্য সম্বন্ধে অবগত হলে, ধীরস্থির গতিতে সেই লক্ষ্যের দিকে ধীরে ধীরে অথচ ক্রমোন্নতির পর্যায়ক্রমে অগ্রসর হওয়া যায় এবং অবশেষে সেই পরম লক্ষ্যে উপনীত হওয়া যায়।

কেউ যখন মানব-জীবনের লক্ষ্য সম্বন্ধে অবগত হওয়া সত্ত্বেও কর্মফল ভোগের প্রতি আসক্ত হয়ে থাকে, তখন সেই স্তরে সাধিত কর্মকে বলা হয় কর্মযোগ। কেউ যখন জানতে পারে যে, পরম লক্ষ্য হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণ এবং শ্রীকৃষ্ণকে জানবার জন্য মনোধর্ম-প্রসূত জ্ঞানের আশ্রয় গ্রহণ করে, তাকে বলা হয় জ্ঞানযোগ এবং কেউ যখন পরম লক্ষ্য সম্বন্ধে অবগত হয়ে ভক্তি সহকারে শ্রীকৃষ্ণের সেবা করেন, তখন তাকে বলা হয় ভক্তিযোগ বা বুদ্ধিযোগ এবং সেটিই হচ্ছে যোগের পরন পূর্ণতা। যোগের এই পূর্ণতাই হচ্ছে জীবনের সর্বোচ্চ সিদ্ধির স্তর।

কেউ সদ্গুরুর আশ্রয় প্রাপ্ত হয়ে কোন পারমার্থিক সংস্থার সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারেন, কিন্তু পারমার্থিক উন্নতি সাধনের জন্য যথার্থ বুদ্ধি যদি তাঁর না থাকে, তা হলে শ্রীকৃষ্ণ অন্তস্তল থেকে তাঁকে যথাযথভাবে নির্দেশ প্রদান করেন, যার ফলে তিনি অনায়াসে তাঁর কাছে ফিরে যেতে পারেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের এই কৃপা লাভ করার একমাত্র যোগ্যতা হচ্ছে যে, কৃষ্ণভাবনাময় হয়ে প্রীতি ও ভক্তি সহকারে সর্বক্ষণ সর্বপ্রকারে শ্রীকৃষ্ণেরই সেবা করা। শ্রীকৃষ্ণের জন্য তাঁকে কোন একটি কর্ম করতে হবে এবং সেই কর্ম প্রীতির সঙ্গে সাধন করতে হবে। ভক্ত যদি আত্ম-উপলব্ধির বিকাশ সাধনে যথার্থ বুদ্ধিমান না হন, কিন্তু ভক্তিযোগ সাধনে ঐকান্তিকভাবে আগ্রহী হন, তা হলে ভগবান তাঁকে সুযোগ প্রদান করেন, যার ফলে তিনি ক্রমশ উন্নতি সাধন করেন এবং অবশেষে তাঁর কাছে ফিরে যেতে পারেন।

error: Content is protected !!