শ্লোক ৪-৫
বুদ্ধিজ্ঞানমসংমোহঃ ক্ষমা সত্যং দমঃ শমঃ ।
সুখং দুঃখং ভবোঽভাবো ভয়ং চাভয়মেব চ ॥ ৪॥
অহিংসা সমতা তুষ্টিস্তপো দানং যশোহযশঃ
ভবন্তি ভাবা ভূতানাং মত্ত এব পৃথগবিধাঃ ।। ৫ ।।
বুদ্ধিঃ- -বুদ্ধি; জ্ঞানম্—জ্ঞান; অসংমোহঃ – সংশয়মুক্তি; ক্ষমা — ক্ষমা; সত্যম্- সত্যবাদিতা, দমঃ — ইন্দ্রিয় সংযম, শমঃ — মনঃসংযম, সুখম্ — সুখ, দুঃখম্ দুঃখ; ভবঃ— জন্ম; অভাবঃ– মৃত্যু; ভয়ম্ — ভয়; চ— ও অভয়ম্ — অভয়; এব— ও; চ― এবং; অহিংসা — অহিংসা, সমতা – সমতা; তুষ্টিঃ— সন্তুষ্টি, তপঃ— তপশ্চর্যা; দানম্—দান; যশঃ – যশ, অযশঃ – অযশ; ভবন্তি — উৎপন্ন হয়, ভাবাঃ — ভাব; ভূতানাম্—প্রাণীদের; মত্তঃ – আমার থেকে, এর— অবশ্যই; পৃথবিধাঃ—নানা প্রকার ।
গীতার গান
সূক্ষ্মার্থ নির্ণয় যোগ্য বুদ্ধি যাহা হয় ।
আত্ম যে অনাত্ম তাহা জ্ঞানের বিষয় ॥
সত্য, দম, শম, ক্ষমা, সুখ, দুঃখ, ভয় ।
অভয়, ভবাভব আর অহিংসা যা হয় ॥
সমতাদিতুষ্টিযশ অবশ বা দান ৷
সকল ভূতের ভাব যাহা কিছু আন ॥
আমি তার সৃষ্টিকর্তা পৃথক পৃথক।
বুদ্ধিমান যেবা হয় বুঝয়ে নিছক ॥
অনুবাদঃ বুদ্ধি, জ্ঞান, সংশয় ও মোহ থেকে মুক্তি, ক্ষমা, সত্যবাদিতা, ইন্দ্রিয় সংযম, মনঃসংযম, সুখ, দুঃখ, জন্ম, মৃত্যু, ভয়, অভয়, অহিংসা, সমতা, সন্তোষ, তপস্যা, দান, যশ ও অযশ — প্রাণীদের এই সমস্ত নানা প্রকার ভাব আমার থেকেই উৎপন্ন হয়।
তাৎপর্যঃ জীবের সব রকম গুণাবলী — ভালই হোক অথবা মন্দই হোক, তা সবই শ্রীকৃষ্ণেরই সৃষ্ট এবং সেই সম্বন্ধে এখানে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
যথাযথভাবে বিষয়-বস্তুর বিশ্লেষণ করার ক্ষমতাকে বলা হয় বুদ্ধি এবং জড় ও চেতনের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করার বোধকে বলা হয় জ্ঞান। জড় বস্তু সম্বন্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা লাভের ফলে যে জ্ঞান প্রাপ্ত হওয়া যায় তা সাধারণ জ্ঞান এবং তাকে এখানে জ্ঞান বলে স্বীকার করা হচ্ছে না। জ্ঞানের অর্থ হচ্ছে জড় ও চেতনের মধ্যে পার্থক্য উপলব্ধি করা। আধুনিক যুগের শিক্ষায় চেতন সম্বন্ধে কোন রকম জ্ঞানই প্রাপ্ত হওয়া যায় না। সেগুলি কেবল জড় উপাদান ও জড় দেহের প্রয়োজনের ভিত্তিতেই প্রতিষ্ঠিত। তাই এই কেতাবি বিদ্যা অসম্পূর্ণ।
অসংমোহ, অর্থাৎ সংশয় ও মোহ থেকে মুক্তি তখন লাভ করা সম্ভব, যখন কারও অপ্রাকৃত দর্শনতত্ত্ব উপলব্ধি লাভ করার ফলে দ্বিধা মোচন হয়। ধীরে ধীরে কিন্তু নিশ্চিতভাবে সে তখন মোহ থেকে মুক্ত হয়। অন্ধভাবে কোন কিছুই গ্রহণ করা উচিত নয়, সব কিছু গ্রহণ করা উচিত সতর্কতা ও যত্নের সঙ্গে। ক্ষম অনুশীলন করা উচিত; সহিষ্ণু হওয়া উচিত এবং অপরের ক্ষুদ্র ভুল-ত্রুটিগুলি মার্জনা করে দেওয়া উচিত। সত্যম্ অর্থাৎ প্রকৃত তথ্য অপরের সুবিধার জন্য যথাযথভাবে প্রদান করা উচিত। সত্যকে কখনই বিকৃত করা উচিত নয়। সামাজিক রীতি অনুসারে বলা হয় যে, সত্য কথা কেবল তখনই বলা যেতে পারে, যদি তা অপরের রুচিকর হয়। কিন্তু সেটি সত্যবাদিতা নয়। দৃঢ়তা ও সপ্রতিভতার সঙ্গে অকপটভাবে সত্য বলা উচিত, যাতে যথার্থ তত্ত্ব সম্বন্ধে যথাযথভাবে সকলে অবগত হতে পারে। কোন মানুষ যদি চোর হয় এবং অপরকে যদি সেই সম্বন্ধে সাবধান করে দেওয়া হয়, তবে সেটি সত্য, যদিও সত্য কখনও কখনও অপ্রিয় হতে পারে, কিন্তু তার থেকে নিরস্ত হওয়া কখনই উচিত নয়। সত্য আমাদের কাছে দাবি করে যে, অপরের সুবিধার জন্য প্রকৃত ঘটনা যথাযথভাবে প্রদান করা হোক। সেটিই হচ্ছে সত্যের সংজ্ঞা।
ইন্দ্রিয়-সংযমের অর্থ হচ্ছে নিরর্থক আত্মতৃপ্তির জন্য ইন্দ্রিয়গুলিকে ব্যবহার না করা। ইন্দ্রিয়ের যথার্থ প্রয়োজনগুলি মেটাবার জন্য কোন রকম নিষেধ নেই, কিন্তু অযথা ইন্দ্রিয়তৃপ্তি পারমার্থিক উন্নতির প্রতিবন্ধক-স্বরূপ। তাই ইন্দ্রিয়গুলির অনর্থক ব্যবহার দমন করা উচিত। তেমনই মনকেও অনাবশ্যক চিন্তা থেকে বিরত রাখা উচিত। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় শম। অর্থ উপার্জনের চিন্তায় সময় নষ্ট করা উচিত নয়। সেটি কেবল চিন্তাশক্তির অপচয় মাত্র। মানব-জীবনের পরম প্রয়োজন উপলব্ধি করার জন্যই মনের ব্যবহার করা উচিত এবং তা শাস্ত্রসম্মত যথাযথভাবে করা উচিত। শাস্ত্রজ্ঞ পুরুষ, সাধু, সদগুরু ও উন্নতমনা পুরুষের সাহচর্যে চিন্তাশক্তির বিকাশ সাধন করা উচিত। সুখম্, শুধুমাত্র কৃষ্ণভাবনাময় ভগবদ্ভক্তির দিব্যজ্ঞান লাভের পক্ষে যা অনুকূল, তার মাধ্যমেই প্রাপ্ত হওয়া উচিত। আর তেমনই, ভগবদ্ভক্তির অনুশীলনে যা প্রতিকূল তা দুঃখজনক। কৃষ্ণভক্তি বিকাশের পক্ষে যা অনুকূল তা গ্রহণীয় এবং যা প্রতিকূল তা বর্ণনীয়।
ভব অর্থাৎ জন্ম, দেহ সম্পর্কিত বলেই জানা উচিত। আত্মার জন্ম হয় না, মৃত্যু হয় না; সেই কথা ভগবদ্গীতার প্রারম্ভেই আলোচনা করা হয়েছে। জন্ম ও মৃত্যু জড় জগতে দেহ ধারণ করার পরিপ্রেক্ষিতেই কেবল সম্বন্ধযুক্ত। ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে উদ্বেগের ফলেই ভয়ের উদয় হয়। কৃষ্ণভাবনাময় ভক্ত সর্বদাই নিৰ্ভীক, কারণ তিনি নিশ্চিতভাবে জানেন যে, তাঁর কার্যকলাপের ফলে তিনি তাঁর প্রকৃত আলয়, চিন্ময় জগতে ভগবানের কাছে ফিরে যাবেন। তাই তাঁর ভবিষ্যৎ অতি উজ্জ্বল। অন্যেরা কিন্তু তাদের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। পরবর্তী জীবনে তাদের ভাগ্যে কি আছে, সেই সম্বন্ধে তাদের কোন ধারণাই নেই। তাই, তারা সর্বক্ষণ গভীর উৎকণ্ঠায় কালাতিপাত করে। আমরা যদি উৎকণ্ঠা থেকে মুক্ত হতে চাই, তবে শ্রেষ্ঠ উপায় হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণ সম্বন্ধে অবগত হয়ে কৃষ্ণভাবনায় অধিষ্ঠিত হওয়া। সেভাবেই আমরা সব রকম ভয়ের হাত থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত হতে পারব। শ্রীমদ্ভাগবতে ( ১১/২/৩৭) বলা হয়েছে যে, ভয়ং দ্বিতীয়া- ভিনিবেশতঃ স্যাৎ—মায়াতে মোহাচ্ছন্ন হয়ে থাকার ফলেই ভয়ের উদয় হয়। কিন্তু যাঁরা মায়াশক্তি থেকে মুক্ত, যাঁরা স্থির নিশ্চিতভাবে জানেন যে, তাঁদের স্বরূপ তাঁদের জড় দেহটি নয়, তাঁরা হচ্ছেন পরম পুরুষোত্তম ভগবানের চিন্ময় অংশ, তাই তাঁরা সর্বক্ষণ ভগবানের অপ্রাকৃত সেবার যুক্ত এবং সর্বতোভাবে ভয় থেকে মুক্ত। তাদের ভবিষ্যৎ অত্যন্ত উজ্জ্বল। যাঁরা কৃষ্ণভাবনামৃত লাভ করেনি, তারাই কেবল আশঙ্কাগ্রস্ত। অভয়ম্, অর্থাৎ ভয়শূন্য কেবল তিনিই হতে পারেন, যিনি কৃষ্ণভাবনাময় কৃষ্ণভক্ত ।
অহিংসা হচ্ছে অপরের অনিষ্ট সাধন না করা বা অপরকে বিভ্রান্ত না করা। রাজনীতিবিদ, সমাজসেবক, লোকহিতৈষী ব্যক্তিরা যে সমস্ত জড় কর্মের প্রতিশ্রুতি দেয়, তার ফলে কারওই তেমন কোন মঙ্গল সাধিত হয় না। কারণ, রাজনীতিবিদ বা লোকহিতৈষী ব্যক্তিদের দিব্য দৃষ্টি নেই। মানব-সমাজের যথার্থ মঙ্গল কিভাবে সাধিত হতে পারে, সেই সম্বন্ধে তাদের কোন জ্ঞান নেই। অহিংসা শব্দটির অর্থ হচ্ছে মানব দেহের যথার্থ সদ্ব্যবহার করার শিক্ষা দেওয়া। মানব দেহের যথার্থ উদ্দেশ্য হচ্ছে পারমার্থিক জ্ঞান উপলব্ধি করা। সুতরাং যে সংস্থা বা যে আন্দোলন এই উদ্দেশ্যে মানুষকে পরিচালিত করে না, তা মনুষ্য-শরীরের প্রতি হিংসাত্মক আচরণ করে। যে প্রচেষ্টা সমগ্র জনসাধারণকে ভাবী দিবা আনন্দ প্রাপ্তির পথে এগিয়ে নিয়ে চলে, তাই হচ্ছে যথার্থ অহিংসা।
সমতা বলতে বোঝায় আসক্তি ও বিরক্তিতে নিস্পৃহ। অত্যধিক আসক্তি ও অত্যধিক বিরক্তি ভাল নয়। আসক্তি অথবা বিরক্তি রহিত হয়ে জড় জগৎকে গ্রহণ করা উচিত। কৃষ্ণভক্তি সাধনে যা অনুকূল তা গ্রহণ করা উচিত, যা প্রতিকূল তা বর্জন করা উচিত। তাকেই বলা হয় সমতা। কৃষ্ণভাবনাময় ভগবদ্ভক্ত শ্রীকৃষ্ণের সেবা আনুকুল্য ব্যতীত কোন কিছুই গ্রহণ করেন না বা বর্জন করেন না।
তুষ্টি বলতে বোঝায় অনর্থক কর্মের মাধ্যমে অধিক থেকে অধিকতর জড় সম্পত্তি সঞ্চয় না করা। ভগবানের কৃপার প্রভাবে যা পাওয়া যায় তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকা উচিত। তাকেই বলা হয় তুষ্টি। তপঃ কথাটির অর্থ হচ্ছে তপস্যা বা কৃচ্ছ্রসাধন। এই সম্বন্ধে বেদে নানা রকম নিয়ম-নিষ্ঠার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যেমন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে স্নান করা। কখনও কখনও খুব সকালে ঘুম থেকে উঠতে খুব কষ্ট হয়, কিন্তু স্বেচ্ছাকৃতভাবে এই ধরনের কষ্ট স্বীকার করাকে বলা হয় তপস্যা। তেমনই, মাসের কতগুলি নির্দিষ্ট দিনে উপবাস করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই ধরনের উপবাস করতে আমাদের ইচ্ছা নাও হতে পারে, কিন্তু আমরা যদি কৃষ্ণভাবনাময় ভগবদ্ভক্তির পথে উন্নতি সাধন করতে চাই, ভা হলে শাস্ত্রের নির্দেশ অনুসারে এই ধরনের দৈহিক ক্লেশ স্বীকার করতে হবে। কিন্তু তা বলে বৈদিক নির্দেশ অনুসরণ না করে নিজের ইচ্ছামতো অনাবশ্যক উপবাস করা উচিত নয়। কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য উপবাস করা উচিত নয়। ভগবদ্গীতাতে এই ধরনের উপবাস করাকে তামসিক উপবাস বলা হয়েছে এবং তম অথবা রজোগুণে কৃতকর্ম আমাদের পারমার্থিক উদ্দেশ্য সাধনের সহায়ক হয় না। সত্ত্বগুণে কৃত কর্মই কেবল পারমার্থিক উন্নতি সাধন করে। বৈদিক নির্দেশ অনুসারে উপবাস করার ফলে পারমার্থিক জ্ঞান বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়।
দান সম্বন্ধে বলা হয়েছে, উপার্জিত অর্থের অর্ধাংশ কোন সৎকর্ম দান করা উচিত। সৎকর্ম বলতে কি বোঝায়? কৃষ্ণভাবনার উদ্দেশ্যে সাধিত কহি হচ্ছে সৎকর্ম। তা কেবল সৎকর্মই নয়, তা হচ্ছে শ্রেষ্ঠ কর্ম। শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন সং তাই তাঁর উদ্দেশ্যে যে কর্ম সাধিত হয় তাও সং। তাই, যে মানুষ শ্রীকৃষ্ণের সেবায় নিজেকে সম্পূর্ণভাবে উৎসর্গ করেছেন, তাঁকেই দান করা উচিত। বৈদিক শাস্ত্রে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, ব্রাহ্মণকে দান করা উচিত। বৈদিক নির্দেশ অনুসারে যথাযথভাবে সাধিত না হলেও, সেই রীতি আজও চলে আসছে। তবুও নির্দেশ হচ্ছে যে, ব্রাহ্মণকে দান করা। কেন? কারণ ব্রাহ্মণেরা সর্বদা পারমার্থিক জ্ঞানের উচ্চতর অনুশীলনে মগ্ন থাকেন। ব্রাহ্মণের জীবনের উদ্দেশ্য হচ্ছে ব্রহ্মজ্ঞান লাভের উদ্দেশ্যে নিজেকে সর্বতোভাবে নিয়োজিত করা। ব্রহ্ম জানাতীতি ব্রাহ্মণঃ —যিনি ব্রহ্মাকে জানেন তিনিই ব্রাহ্মণ। এভাবেই দান ব্রাহ্মণদের নিবেদন করা হয়, কারণ উচ্চতর পারমার্থিক প্রয়াসে নিবিষ্ট থাকার ফলে তারা জীবিকা অর্জনের কোন অবসর পান না। বৈদিক শাস্ত্রে আরও বলা হয়েছে, সন্ন্যাসীদেরও দান করা উচিত। সন্ন্যাসীরা দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করেন অর্থ উপার্জন করার জন্য নয়— প্রচারের জন্য। এভাবেই তাঁরা ঘরে ঘরে গিয়ে গৃহস্থদের অজ্ঞানতার সুষুপ্তি থেকে জেগে ওঠার জন্য আবেদন করেন। কারণ, গৃহস্থেরা গৃহসংক্রান্ত কর্মে এতই মগ্ন হয়ে পড়ে যে, তারা তাদের জীবনের আসল উদ্দেশ ——কৃষ্ণভাবনা জাগরিত করার কথা সম্পূর্ণভাবে ভুলে যায়। তাই, সন্ন্যাসীদের কর্তব্য হচ্ছে গৃহস্থদের দ্বারে দ্বারে গিয়ে তাদের কৃষ্ণভাবনায় অনুপ্রাণিত করা। বেদে বলা হয়েছে, জেগে ওঠ এবং মানব-জীবনের যথার্থ উদ্দেশ্য লাভ কর। সন্ন্যাসীরা এই জ্ঞান ও পন্থা প্রদান করেন। তাই দান সন্ন্যাসী, ব্রাহ্মণ ও সেই ধরনের উদ্দেশ্যেই প্রদান করা উচিত, নিজের খেয়ালখুশি মতো দান করা উচিত নয়।
যশ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর মতানুসারে হওয়া উচিত। মহাপ্রভু বলেছেন যে, একজন মানুষ তখনই যশ লাভের অধিকারী হন, যখন তিনি ভগবানের মহান ভক্তরূপে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। সেটিই হচ্ছে প্রকৃত যশ। যদি জানা যায় যে, কোন মানুষ কৃষ্ণভাবনায় উন্নতি লাভ করেছেন, তখন তিনি প্রকৃত যশস্বী হন। আর এই রকম যশ যার নেই, সে কখনই যশস্বী নয়।
এই গুণগুলি ব্রহ্মাণ্ডে মানব ও দেবতা সকল সমাজেই বর্তমান। অন্যান্য গ্রহলোকেও বিভিন্ন আকৃতিসম্পন্ন মনুষ্যজাতি রয়েছে এবং এই গুণগুলি সেখানেও বর্তমান। এখন, কেউ যদি কৃষ্ণভাবনায় উন্নতি সাধন করতে চান, কৃষ্ণ তখন তাঁর জন্য এই সমস্ত গুণগুলি সৃষ্টি করেন, কিন্তু সেই ব্যক্তি নিজে সেগুলিকে অন্তরে বিকাশ সাধন করেন। যিনি পরমেশ্বর ভগবানের সেবায় নিরন্তর নিযুক্ত থাকেন, তিনি ভগবানের ব্যবস্থাপনায় সমস্ত সদ্গুণের বিকাশ সাধন করেন। ভাল বা মন্দ, যাই আমরা দেখি না কেন, তার মূল উৎস হচ্ছেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। এই জড় জগতে কোন কিছুই প্রকাশিত হতে পারে না, যা শ্রীকৃষ্ণের মধ্যে নেই। সেটিই হচ্ছে প্রকৃত জ্ঞান। যদিও আমরা জানি যে, প্রতিটি বস্তুই ভিন্ন ভিন্ন রূপে অবস্থিত, কিন্তু আমাদের এটি উপলব্ধি করা উচিত যে, সব কিছু সৃষ্টির মূলেই আছেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ।
শ্লোকঃ ৬
মহর্ষয়ঃ সপ্ত পূর্বে চত্বারো মনস্তথা ।
মদভাবা মানসা জাতা যেষাং লোক ইমাঃ প্রজাঃ ।৷ ৬ ।৷
মহৰ্ষয়ঃ — মহর্ষিগণ, সপ্ত— সাত; পূর্বে পূর্বে, চত্বারঃ— সনকাদি চারজন, মনবঃ- চতুর্দশ মনু, তথা — ও, মদভাবাঃ- আমার থেকে জন্মগ্রহণ করেছে; মাসাঃ- ৪— মন থেকে; জাতাঃ —উৎপন্ন; যেযাম্— যাঁদের, লোকে— এই জগতে; ইমাঃ—এই সমস্ত; প্রজাঃ— প্রজাসমূহ।
গীতার গান
মরীচ্যাদি সপ্তঋষি চারি সনকাদি ।
চতুর্দশ মন পূর্ব হিরণ্যগর্ভাদি।।
তাদের এ প্রজা সব যত লোকে আছে ৷
আমা হতে জন্ম সব মানসাদি পাছে ৷।
অনুবাদঃ সপ্ত মহর্ষি, তাঁদের পূর্বজাত সনকাদি চার কুমার ও চতুর্দশ মনু, সকলেই আমার মন থেকে উৎপন্ন হয়ে আমা হতে জন্মগ্রহণ করেছে এবং এই ভাগতের স্থাবর- জঙ্গম আদি সমস্ত প্রজা তাঁরাই সৃষ্টি করেছেন।
তাৎপর্যঃ পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এখানে এই ব্রহ্মাণ্ডের অধিবাসীদের সংক্ষিপ্ত বংশানুক্রমিক বিবরণ দান করেছেন। সৃষ্টির আদিতে পরমেশ্বর ভগবানের হিরণ্যগর্ভ নামক শক্তি থেকে প্রথম জীব ব্রহ্মার সৃষ্টি হয়। ব্রহ্মা থেকে সপ্ত ঋষি এবং তাঁদের আগে চারজন মহর্ষি—সনক, সনন্দ, সনাতন ও সনৎকুমার এবং তারপর চতুর্দশ মনুর সৃষ্টি হয়। এই পঁচিশজন মহর্ষিরা হচ্ছেন সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডের জীবসমূহের পিতৃকুল । এই জগতে অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড রয়েছে এবং প্রতিটি ব্রহ্মাণ্ডে অগণিত গ্রহলোক রয়েছে এবং প্রতিটি গ্রহলোক নানা রকম প্রাণী দ্বারা অধ্যুষিত। তারা সকলেই এই পঁচিশজন পিতৃপুরুষের দ্বারা জাত। ব্রহ্মা দেবতাদের সময়ের হিসাব অনুসারে এক সহস্র বৎসর কঠোর তপস্যা করার পর জানতে পারেন কিভাবে জগৎ সৃষ্টি করতে হবে। তারপর ব্রহ্মা থেকে সনক, সনন্দ, সনাতন ও সনৎকুমারের আবির্ভাব হয়। তার পরে রুদ্র ও সপ্ত ঋষি এবং এভাবেই সমস্ত ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়েরা পরম পুরুষোত্তম ভগবানের শক্তি থেকে জন্মগ্রহণ করেন। ব্রহ্মাকে বলা হয় পিতামহ এবং শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন প্রপিতামহ। কারণ, তিনি পিতামহ ব্রহ্মারও পিতা। ভগবদ্গীতার একাদশ অধ্যায়ে ( ১১/৩৯) এই বিষয়ে বর্ণনা করা হয়েছে।
শ্লোকঃ ৭
এতাং বিভূতিং যোগং চ মম যো বেত্তি তত্ত্বতঃ ।
সোহবিকল্পেন যোগেন যুজ্যতে নাত্র সংশয়ঃ ॥ ৭ ॥
এতাম—এই সমস্ত; বিভূতিম্ — বিভূতি, যোগম্ — যোগ; চ – ৩, মম – আমার; ঃ- – যিনি; বেত্তি— জানেন, তত্ত্বতঃ – যথার্থরূপে; সঃ— -তিনি; অবিকল্পেন- অবিচলিত; যোগেন— ভক্তিযোগ দ্বারা; যুজ্যতে—যুক্ত হন; ন– না; অত্র — এই বিষয়ে সংশয়ঃ- সন্দেহ।
গীতার গান
আমার স্বরূপজ্ঞান শক্তি বা বিভূতি ৷
সমস্ত ক্রিয়াদি যোগ শ্রেষ্ঠ সে ভকতি ॥
এই সব তত্ত্ব যারা নিশ্চিত জানিল ।
ভক্তিযোগ সাধিবারে যোগা সে হইল ।।
অনুবাদঃ যিনি আমার এই বিভূতি ও যোগ যথার্থরূপে জানেন, তিনি অবিচলিতভাবে ভক্তিযোগে যুক্ত হন। সেই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।
তাৎপর্যঃ পারমার্থিক সিদ্ধির সর্বোচ্চ সীমা হচ্ছে পরম পুরুষোত্তম ভগবানকে জানা। যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা ভগবানের অনন্ত বিস্তৃতি সম্বন্ধে সম্পূর্ণভাবে অবগত না হচ্ছি, ততক্ষণ আমরা ভক্তিযোগে ভগবানের সেবায় নিয়োজিত হতে পারি না। সাধারণত সকলেই জানে যে, ভগবান মহান। কিন্তু ভগবান কেন মহান, তা তারা বিশদভাবে অবগত নয়। এখানে তার বিশদ বর্ণনা করা হচ্ছে। আমরা যখন ভগবানের মহত্ত্ব সম্বন্ধে যথাযথভাবে জানতে পারি, তখন আমরা স্বাভাবিকভাবে তাঁর চরণে আত্মসমর্পণ করে ভক্তিযোগে তাঁর সেবায় প্রবৃত্ত হই। যখন আমরা বাস্তবিকপক্ষে ভগবানের বিস্তৃতি সম্বন্ধে অবগত হই, তখন ভগবানের চরণে আত্ম-সমর্পণ করা ছাড়া বিকল্প কোন উপায় থাকে না। এই তত্ত্বজ্ঞান শ্রীমদ্ভাগবত, ভগবদ্গীতা আদি শাস্ত্রগ্রন্থের বর্ণনার মাধ্যমে জানতে পারা যায়।
এই ব্রহ্মাণ্ডের পরিচালনায় বহু দেব-দেবীরা বিভিন্ন গ্রহলোকে নিযুক্ত আছেন এবং তাঁদের প্রধান হচ্ছেন ব্রহ্মা, শিব, চতুঃস্বন ও প্রজাপতিগণ । ব্রহ্মাণ্ডের অধিবাসীরা বহু প্রজাপতি থেকে উদ্ভূত হয়েছে এবং এই সমস্ত প্রজাপতিরা সকলেই পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ থেকে জন্মগ্রহণ করেছেন। পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন সমস্ত প্রজাপতিদের আদিপুরুষ।
এই সমস্ত ভগবানের অনন্ত বৈভবের কয়েকটির প্রকাশ। এই সম্বন্ধে আমাদের চিত্তে যখন দৃঢ় বিশ্বাসের উদয় হয়, তখন আমরা গভীর শ্রদ্ধা সহকারে ও নিঃসন্দেহে শ্রীকৃষ্ণকে গ্রহণ করতে পারি এবং তখন আমরা তাঁর সেবায় প্রবৃত্ত হই। প্রেমভক্তি সহকারে ভগবানের সেবার আকাঙ্ক্ষা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করার জন্য ভগবৎ-তত্ত্ব সম্বন্ধীয় এই জ্ঞান অত্যন্ত আবশ্যক। শ্রীকৃষ্ণ যে কত বড় মহান তা পূর্ণরূপে জানার জন্য আমাদের কখনও অবহেলা করা উচিত নয়, কেন না শ্রীকৃষ্ণের মহত্ত্ব সম্বন্ধে অবগত হওয়ার ফলে আমরা ঐকান্তিক ভক্তি সহকারে তাঁর সেবায় নিযুক্ত হতে পারি।