শ্লোকঃ ৪০

নান্তোঽস্তি মম দিব্যানাং বিভূতীনাং পরন্তপ ।

এয তুদ্দেশতঃ প্রোক্তো বিভূতের্বিস্তরো ময়া ॥ ৪০ ॥

ন— না; অন্তঃ—সীনা; অস্তি— হয়; মম – আমার; দিব্যানাম্ — দিব্য; বিভূতীনাম্ বিভূতি-সমূহের, পরন্তপ – হে পরন্তপ; এবঃ —এই সমস্ত; তু—কিন্তু; উদ্দেশতঃ —সংক্ষেপে, প্রোক্তঃ—বলা হল; বিভৃতেঃ– বিভূতির; বিস্তরঃ — বিস্তার; ময়া— আমার দ্বারা।

গীতার গান

আমার বিভূতি দিব্য নাহি তার অন্ত ৷

সংক্ষেপে বলিনু সব শুন হে তপন্ত ৷।

অনুবাদঃ হে পরন্তপ ! আমার দিব্য বিভূতি-সমূহের অন্ত নেই। আমি এই সমস্ত বিভূতির বিস্তার সংক্ষেপে বললাম ।

তাৎপর্যঃ বৈদিক শাস্ত্রে বলা হয়েছে, যদিও ভগবানের বিভূতি ও শক্তি নানাভাবে উপলব্ধি করা যায়, তবুও তাঁর বিভূতির কোন অন্ত নেই; তাই ভগবানের সমস্ত বিস্তৃতি ও শক্তি বর্ণনা করা যায় না। অর্জুনের কৌতূহল নিবারণ করবার জন্য শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে তাঁর অনন্ত বৈভবের কয়েকটি মাত্র উদাহরণ দিলেন।

শ্লোকঃ ৪১

যদযদ্বিভূতিমৎ সত্ত্বং শ্রীমদূর্জুতমেব বা।

তত্তদেবাবগচ্ছ ত্বং মম তেজোহংশসম্ভবম্ ।। ৪১ ।।

যৎ যৎ- যে যে; বিভূতিমৎ — ঐশ্বর্যযুক্ত; সত্ত্বম্ — অস্তিত্ব, শ্রীমৎ—সুন্দর, ঊর্জিতম্—মহিমান্বিত, এর – অবশ্যই, বা অথবা তৎ তৎ— সেই সমস্ত; এর অবশ্যই; অবগচ্ছ—অবগত হও, তুম্ — তুমি: মম – আমার; তেজঃ — তেজের; অংশ—অংশ; সম্ভবম্—সম্ভূত।

গীতার গান

যেখানে বিভূতি সত্তা ঐশ্বর্যাদি বল ৷

সে সব আমার কৃপা জানিবে সকল ।।

আমার তেজাংশ দ্বারা হয় সে সম্ভব।

সেখানে আমার সত্তা কর অনুভব ৷।

অনুবাদঃ ঐশ্বর্যযুক্ত, শ্রী সম্পন্ন ও বল-প্রভাবাদির আধিক্যযুক্ত যত বস্তু আছে, সে সবই আমার তেজাংশসম্ভূত বলে জানবে।

তাৎপর্যঃ এই জড় জগতেই হোক বা অপ্রাকৃত জগতেই হোক, যা কিছু মহিমান্বিত বা সুন্দর তা সবই শ্রীকৃষ্ণের বিভূতির নিতান্তই আংশিক প্রকাশ মাত্র। যা কিছুই অস্বাভাবিক ঐশ্বর্যমণ্ডিত, তা শ্রীকৃষ্ণের বিভূতির প্রতীক বলে বুঝতে হবে।

শ্লোকঃ ৪২

অথবা বহুনৈতেন কিং জ্ঞাতেন তবার্জুন ৷

বিষ্টভ্যাহমিদং কৃৎস্নমেকাংশেন স্থিতো জগৎ॥

অথবা—অথবা; বহুনা—বহু এতেন— এই প্রকার; কিম্― কি, জ্ঞাতেন— জ্ঞান দ্বারা, তব — তোমার, অর্জুন— হে অর্জুন, বিষ্টভা— ব্যাপ্ত হয়ে, অহম্ — আমি, ইদম— এই কৃৎস্নম্—সমগ্র; এক-এক; অংশেন— অংশের দ্বারা; স্থিতঃ– অবস্থিত, জগৎ— জগৎ।

গীতার গান

অধিক কি বলি অর্জুন সংক্ষেপে শুন ।

আমি সে প্রবিষ্ট হই সর্বশক্তি গুণ ॥

জগতে সর্বত্র থাকি আমার একাংশে ।

সত্যবৎ জড় মায়া তাই সে প্রকাশে ॥

অনুবাদঃ হে অর্জুন ! অথবা এই প্রকার বহু জ্ঞানের দ্বারা তোমার কি প্রয়োজন ? আমি আমার এক অংশের দ্বারা সমগ্র জগতে ব্যাপ্ত হয়ে অবস্থিত আছি।

তাৎপর্যঃ পরমেশ্বর ভগবান সর্বভূতে পরমাত্মারূপে প্রবিষ্ট হয়ে এই জড় জগতের সর্বত্র বিরাজমান। ভগবান এখানে অর্জুনকে বলেছেন যে, এই জগতের কোন কিছুরই নিজস্ব কোন ঐশ্বর্য নেই, তাই তার পরিপ্রেক্ষিতে তাদের সম্বন্ধে অবগত হয়ে কোন লাভ নেই। আমাদের জানতে হবে যে, সব কিছুরই অস্তিত্ব সম্ভব হয়েছে, কারণ শ্রীকৃষ্ণ পরমাত্মারূপে সেগুলির মধ্যে প্রবিষ্ট হয়েছেন। মহত্তম জীব ব্রহ্মা থেকে শুরু করে একটি ক্ষুদ্র পিঁপড়ে পর্যন্ত সকলেরই অস্তিত্ব সম্ভব হয়েছে, কারণ ভগবান তাদের সকলের অন্তরে বিরাজমান এবং তিনিই তাদের প্রতিপালন করছেন।

অনেকে প্রচার করে থাকে যে, যে-কোন দেব-দেবীর আরাধনা করে পরমেশ্বর ভগবানের কাছে বা পরম লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে। কিন্তু এখানে দেব-দেবীদের পূজা করতে সম্পূর্ণরূপে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে, কারণ ব্রহ্মা ও শিবের মতো শ্রেষ্ঠ দেবতারাও হচ্ছেন ভগবানের অনন্ত বিভূতির অংশ মাত্র। ভগবানই হচ্ছেন সকলের উৎস এবং তাঁর থেকে আর কেউ শ্রেষ্ঠ নয়। তাঁর সমান অথবা তাঁর থেকে বড় আর কেউ নেই। পদ্ম পুরাণে বলা হয়েছে যে, যদি কেউ পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে দেব-দেবীর সমান বলে মনে করে- এমন কি ভগবানকে যদি ব্রহ্ম।, শিব, দুর্গা, কালী আদি শ্রেষ্ঠ দেব-দেবীদের সমান বলে মনে করে, তা হলে তখনই সে ভগবৎ-বিদ্বেষী নাস্তিকে পরিণত হয়। কিন্তু, যদি আমরা শ্রীকৃষ্ণের শক্তির বিস্তার ও বিভূতির বর্ণনা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অধ্যয়ন করি, তা হলে আমরা নিঃসন্দেহে শ্রীকৃষ্ণের পরমেশ্বরত্ব উপলব্ধি করতে পারি এবং তার ফলে অনন্য ভক্তি সহকারে তাঁর সেবায় মনকে আমরা স্থির করতে পারি। তাঁর অংশ-প্রকাশরূপে সর্বভূতে বিরাজমান পরমাত্মার বিস্তারের দ্বারা ভগবান সর্বব্যাপ্ত। শুদ্ধ ভক্তেরা তাই সর্বতোভাবে ভগবৎ-সেবার মাধ্যমে তাঁদের মনকে কৃষ্ণচেতনায় কেন্দ্রীভূত করেন। তাই, তাঁরা সর্বদাই অপ্রাকৃত স্তরে অধিষ্ঠিত থাকেন। ভক্তিযোগে শ্রীকৃষ্ণের আরাধনা সম্বন্ধে এই অধ্যায়ের অষ্টম থেকে একাদশ শ্লোকে বিশদভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। এটিই হচ্ছে শুদ্ধ ভগবদ্ভক্তির পদ্ধতি। পরম পুরুষোত্তম ভগবানের সঙ্গলাভ করে ভক্তিযোগের পূর্ণতা কিভাবে প্রাপ্ত হওয়া যায়, তা বিশদভাবে এই অধ্যায়ে বর্ণনা করা হয়েছে। শ্রীকৃষ্ণ থেকে শুরু-পরম্পরা ধারায় অধিষ্ঠিত একজন মহান আচার্য শ্রীল বলদের বিদ্যাভূষণ এই অধ্যায়ের তাৎপর্যের উপসংহারে বলেছেন-

যচ্ছক্তিলেশাৎ সূর্যাদ্যা ভবস্ত্যত্যুপ্রতেজসঃ ।

যদংশেন ধৃতং বিশ্বং স কৃষ্ণো দশমেহার্চ্যতে।।

ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বলবান শক্তি থেকে এমন কি শক্তিশালী সূর্য তার শক্তি লাভ করে এবং শ্রীকৃষ্ণের অংশ প্রকাশের দ্বারা সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ড প্রতিপালিত হয়। সেই কারণে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন আরাধ্য।

ভক্তিবেদান্ত কহে শ্রীগীতার গান ।

শুনে যদি শুদ্ধ ভক্ত কৃষ্ণগত প্ৰাণ ॥

ইতি—পরব্রহ্মোর ঐশ্বর্য বিষয়ক ‘বিভূতি-যোগ’ নামক শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার দশম অধ্যায়ের ভক্তিবেদান্ত তাৎপর্য সমাপ্ত।

error: Content is protected !!