শ্লোকঃ ৩৭

বৃষ্ণীনাং বাসুদেবোঽস্মি পান্ডবানাং ধনঞ্জয়ঃ ।

মুনীনামপ্যহং ব্যাসঃ কবীনামুশনাঃ কবিঃ ॥ ৩৭ ॥

কৃষ্ণীনাম্ — বৃষ্ণিদের মধ্যে; বাসুদেবঃ দ্বারকাধীশ শ্রীকৃষ্ণ; অস্মি— হই, পাণ্ডৰানাম্‌—পাণ্ডবদের মধ্যে, ধনঞ্জয়ঃ – অর্জুন, মুনীনাম্ —মুনীদের মধ্যে; অপি—ও; অহম্—আমি; ব্যাসঃ — ব্যাসদেব; কবীনাম্ — মহান চিন্তাশীল ব্যক্তিদের মধ্যে; উশনাঃ—শুক্র: কবিঃ কবি ।

গীতার গান

বৃষ্ণিদের মধ্যে আমি বাসুদেব হই ৷

পাণ্ডবের মধ্যে আমি জান ধনঞ্জয় ।।

মুনিদের মধ্যে ব্যাস কবি শুক্রাচার্য ।

সকলের মধ্যে শ্রেষ্ঠ আমি সেই আৰ্য ৷।

অনুবাদঃ বৃষ্ণিদের মধ্যে আমি বাসুদেব এবং পাণ্ডবদের মধ্যে আমি অর্জুন। মুনিদের মধ্যে আমি ব্যাস এবং কবিদের মধ্যে আমি শুক্রাচার্য।

তাৎপর্যঃ শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন আদি পরম পুরুষোত্তম ভগবান এবং তার সাক্ষাৎ কায়্যুত হচ্ছেন বাসুদেব। বাসুদেবের অর্থ হচ্ছে বসুদেবের সন্তান। শ্রীকৃষ্ণ ও বলদের উভয়োই বসুদেবের সন্তানরূপে অবতরণ করেন।

পাণ্ডুপুত্রদের মধ্যে অর্জুন ধনঞ্জয়রূপে বিখ্যাত। তিনি হচ্ছেন নরশ্রেষ্ঠ, তাই তিনি শ্রীকৃষ্ণের প্রতিনিধি। বৈদিক জ্ঞানে পারদর্শী মুনি অথবা পণ্ডিত ব্যক্তিদের মধ্যে শ্রীল ব্যাসদেব হচ্ছেন সর্বশ্রেষ্ঠ, কারণ কলিযুগের জনসাধারণকে বৈদিক জ্ঞান দান করার মানসে তিনি বেদকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। ব্যাসদেব আবার শ্রীকৃষ্ণের অবতার, তাই তিনি শ্রীকৃষ্ণের প্রতিনিধি। কবি তাদের বলা হয়, যাঁরা যে কোন বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে চিন্তা করতে সক্ষম। কবিদের মধ্যে দৈতাদের কুলগুরু উশনা বা শুক্রাচার্য হচ্ছেন শ্রেষ্ঠ। ইনি অত্যন্ত বুদ্ধিমান এবং দূরদৃষ্টিস রাজনীতিজ্ঞ। এভাবেই শুক্রাচার্য হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণের বিভূতির আর এক প্রতিনিধি।

শ্লোকঃ ৩৮

দণ্ডো দময়তামস্মি নীতিরশ্মি জিগীষতাম্ ।

মৌনং চৈবাস্মি গুহ্যানাং জ্ঞানং জ্ঞানবতামহম্ ॥ ৩৮ ॥

দণ্ডঃ—দণ্ড, দময়তাম্—দমনকারীদের মধ্যে; অস্মি — হই; নীতিঃ —নীতি; অস্মি— হই; জিগীতাম্—জয় অভিলাষকারীদের মৌনম্—মৌন; চ–এবং; এব—ও; অস্মি—হই; ওহ্যানাম্ — গোপনীয় বিষয় সমূহের মধ্যে জ্ঞানম্—জ্ঞান; জ্ঞানবতাম্—জ্ঞানবানদের মধ্যে; অহম্—আমি।

গীতার গান

শাসনকর্তার সেই আমি হই দণ্ড ৷

ন্যায়াধীশগণ মধ্যে আমি সেই ন্যায্য ।।

গুপ্ত যে বিষয় হয় তার মধ্যে মৌন ৷

জ্ঞানীদের আমি জ্ঞান আর সব গৌণ ।।

অনুবাদঃ দমনকারীদের মধ্যে আমি দণ্ড এবং জয় অভিলাষীদের মধ্যে আমি নীতি। গুহা ধর্মের মধ্যে আমি মৌন এবং জ্ঞানবানদের মধ্যে আমিই রে।

তাৎপর্যঃ শাসন করার যে দণ্ড তা শ্রীকৃষ্ণের প্রতীক। মানুষ ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে বিজয় লাভের প্রচেষ্টা করে, তাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ বিজয় হচ্ছে নৈতিকতা। শ্রবণ, মনন ও ধ্যান আদি গুপ্ত কার্যকলাপের মধ্যে মৌনতাই হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ মৌনতার মাধ্যমে অতি শীঘ্রই পারমার্থিক উন্নতি লাভ করা যায়। জ্ঞানী তাঁকে বলা হয়, যিনি জড় ও চেতনের পার্থক্য নিরূপণ করতে পারেন অর্থাৎ যিনি ভগবানের উৎকৃষ্টা ও নিকৃষ্টা প্রকৃতির পার্থক্য নিরূপণ করতে পারেন। এই জ্ঞান হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং।

 

শ্লোকঃ ৩৯

ঘচ্চাপি সর্বভূতানাং বীজং তদহমর্জুন।

ন তদস্তি বিনা যৎ স্যান্ময়া ভূতং চরাচরম্ ॥ ৩৯ ॥

যৎ—যা; চ–ও; অপি— হতে পারে; সর্বভূতানাম্ — সর্বভূতের, বীজম্ — বীজ; ত—তা: অহম্ —আমি; অর্জুন – হে অর্জুন, ন- না, তৎ – তা, অস্তি- হয়, বিনা—ব্যতীত; যং—যা; স্যাৎ— অস্তিত্ব, ময়া—আমাকে; ভূতম্ বস্তু; চরাচরম্—স্থাবর ও জঙ্গম ।

গীতার গান

সর্বভূতপ্রবাহ বীজ আমি সে অর্জুন ।

আমি বিনা চরাচর সকল অগুণ ।।

অনুবাদঃ হে অর্জুন । যা সর্বভূতের বীজস্বরূপ তাও আমি, যেহেতু আমাকে ছাড়া স্থাবর ও জঙ্গম কোন বস্তুরই অস্তিত্ব থাকতে পারে না।

তাৎপর্যঃ সব কিছুরই একটি কারণ আছে এবং সেই কারণ বা প্রকাশের বীজ হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণ। শ্রীকৃষ্ণের শক্তি বিনা কোন কিছুই অস্তিত্ব থাকতে পারে না, তাই তাঁকে বলা হয় সর্বশক্তিমান। তাঁর শক্তি বিনা স্থাবর ও জঙ্গম কোন কিছুরই অস্তিত্ব থাকতে পারে না। শ্রীকৃষ্ণের শক্তিতে যা স্থিত নয়, তাকে বলা হয় মায়া, অর্থাৎ ‘যা নয়’।

error: Content is protected !!