শ্লোকঃ ৩৪
মৃত্যুঃ সর্বহরশ্চাহমুদ্ভবশ্চ ভবিষ্যতাম।
কীর্তিঃ শ্রীর্বাক্ চ নরীণাং স্মৃতির্মেধা ধৃতিঃ ক্ষমা ৷৷ ৩৪ ॥
মৃত্যুঃ– মৃত্যু: সর্বহর:- :– সমস্ত হরণকারীদের মধ্যে, চ–ও; অহম্ — আমি, উদ্ভবঃ —উদ্ভব; চ—ও; ভবিষ্যতাম — ভবিষ্যতের: কীর্তিঃ —কীর্তি, শ্রীঃ – ঐশ্বর্য অথবা সৌন্দর্য; বাক্—বাণী; চ–ও; নারীণাম্ —নারীদের মধ্যে স্মৃতিঃ – স্মৃতি, মেধা- মেধা: ধৃতিঃ – ধৃতি; ক্ষমা — ক্ষমা।
গীতার গান
হরণের মধ্যে আমি মৃত্যু সর্বহর ৷
ভবিষ্য যে হয় আমি উদ্ভব আকর ।।
নারীদের মধ্যে আমি শ্ৰী বাণী স্মৃতি ৷
কীর্তি, মেধা, ক্ষমা মূর্তি অথবা সে ধৃতি ।।
অনুবাদঃ সমস্ত হরণকারীদের মধ্যে আমি সর্বগ্রাসী মৃত্যু, ভাবীকালের বস্তুসমূহের মধ্যে আমি উদ্ভব। নারীদের মধ্যে আমি কীর্তি, শ্রী, বাণী, স্মৃতি, মেধা, ধৃতি ও ক্ষমা।
তাৎপর্যঃ জন্মের পর থেকে প্রতি মুহুর্তেই মানুষের মৃত্যু হতে থাকে। এভাবেই মৃত্যু প্রতি মুহুর্তে প্রতিটি প্রাণীকে গ্রাস করে চলেছে, কিন্তু তার শেষ আঘাতকে মৃত্যু বলে সম্বোধন করা হয়। এই মৃত্যু হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণ। প্রতিটি প্রাণীকেই ছয়টি মুখ্য পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। তাদের জন্ম হয়, তাদের বৃদ্ধি হয়, কিছু কালের জন্য তারা স্থায়ী হয়, তারা প্রজনন করে, তাদের হ্রাস হয় এবং অবশেষে তাদের বিনাশ হয়। এই সমস্ত পরিবর্তনের মধ্যে প্রথম হচ্ছে গর্ভ থেকে সন্তানের প্রসব এবং তা হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণেরই শক্তি। এই উদ্ভবই হচ্ছে ভবিষ্যতের সমস্ত কার্যকলাপের আদি উৎস।
এখানে যে কীর্তি, শ্রী, বাণী, স্মৃতি, মেধা, ধৃতি ও ক্ষমা—এই সাতটি ঐশ্বর্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে তা সবই স্ত্রীলিঙ্গ বাচক। কোন ব্যক্তি যখন এই ঐশ্বর্যগুলির মধ্যে সব কয়টি বা কয়েকটি ধারণ করেন, তখন তিনি মহিমান্বিতা হন। কোন মানুষ যখন ধার্মিক ব্যক্তিরূপে বিখ্যাত হন, তখন সেটি তাঁকে মহিমান্বিত করে। সংস্কৃত হচ্ছে পূর্ণাঙ্গ শ্রেষ্ঠ ভাষা, তাই তা অতি মহিমান্বিত। কোন কিছু পাঠ করার পরেই কেউ যখন তা মনে রাখতে পারে, সেই বিশেষ গুণকে বলা হয় স্মৃতি। আর যে সামর্থ্যের দ্বারা বিভিন্ন বিষয়ের উপর বহু গ্রন্থ কেবল অধ্যয়ন করাই নয়, সেই সঙ্গে সেগুলিকে হৃদয়ঙ্গম করা এবং প্রয়োজনে প্রয়োগ করা, তাকে বলা হয় মেধা এবং এটিও একটি বিভূতি। যে সামর্থ্যের দ্বারা অস্থিরতাকে দমন করা যায়, তাকে বলা হয় ধৃতি। আর কেউ যখন সম্পূর্ণ যোগ্যতাসম্পন্ন, তবুও বিনয়ী ও ভদ্র এবং কেউ যখন সুখ ও দুঃখ উভয় সময়ে ভারসাম্যতা রক্ষা করতে সক্ষম, তাঁর সেই ঐশ্বর্যকে বলা হয় ক্ষমা।
শ্লোকঃ ৩৫
বৃহৎসাম তথা সান্মাং গায়ত্রী ছন্দসামহম্ ।
মাসানাং মার্গশীর্ষোঽহমৃতূনাং কুসুমাকরঃ ॥ ৩৫ ॥
বৃহৎসান — বৃহৎসাম; তথা — শু; সান্নাম্— সামবেদের মধ্যে, গায়ত্রী — গায়ত্ৰী মন্ত্ৰ ছন্দসাম্—ছন্দসমূহের মধ্যে; অহম্ — আমি: মাসানাম— মাসসমূহের মধ্যে মার্গশীর্ষঃ —অগ্রহায়ণ; অহম্—আমি; ঋতৃনাম্—সমস্ত ঋতুর মধ্যে কুসুমাকরঃ—বসন্ত।
গীতার গান
সামবেদ মধ্যে আমি বৃহৎ সে সাম ।
ছন্দ যত তার মধ্যে গায়ত্রী সে নাম ।।
মাসগণে আমি হই সে অগ্রহায়ণ ।
বসন্ত নাম মোর মধ্যে ঋতুগণ ।।
অনুবাদঃ সামবেদের মধ্যে আমি বৃহৎসাম এবং ছন্দসমূহের মধ্যে আমি গায়ত্রী। মাসসমূহের মধ্যে আমি অগ্রহায়ণ এবং ঋতুদের মধ্যে আমি বসন্ত ।
তাৎপর্যঃ ভগবান পূর্বেই বলেছেন যে, সমস্ত বেদের মধ্যে তিনি হচ্ছেন সামবেদ। সামবেদ বিভিন্ন দেবতাদের দ্বারা গীত অপূর্ব সুন্দর সঙ্গীতসমূহের দ্বারা সমৃদ্ধ। এই সঙ্গীতগুলির একটিকে বলা হয় বৃহৎসাম, যার সুর অপূর্ব মাধুর্যমণ্ডিত এবং মধ্যরাত্রে গীত হওয়ার রীতি।
সংস্কৃত ভাষায় কবিতাকে হলোবদ্ধ করার কতকগুলি বিশেষ নিয়ম আছে। ছন্দ ও মাত্রা আধুনিক কবিতার মতো খামখেয়ালীভাবে লেখা হয় না। সুসংবদ্ধ কবিতার মধ্যে গায়ত্রী মন্ত্র হচ্ছে শ্রেষ্ঠ, যা সুযোগ্য ব্রাহ্মণেরা গেয়ে থাকেন। শ্রীমদ্ভাগবতে গায়ত্রী মন্ত্রের উল্লেখ করা হয়েছে। যেহেতু গায়ত্রী মন্ত্রের মাধ্যমে ভগবানকে উপলব্ধি করা যায়, তাই তা হচ্ছে ভগবানের প্রতীক। অধ্যাত্মমার্গে বিশেষভাবে উন্নত মানুষদের জন্যই গায়ত্রী মন্ত্র এবং কেউ যদি এই মন্ত্রে সিদ্ধি লাভ করেন, তবে তিনি ভগবৎ-ধামে প্রবেশ করতে পারেন। গায়ত্রী মন্ত্র উচ্চারণ করতে হলে, প্রথমে জড়া প্রকৃতির সত্ত্বগুণে অধিষ্ঠিত ব্যক্তির গুণ অর্জন করা প্রয়োজন। বৈদিক সভ্যতায় গায়ত্রী মন্ত্র অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং তাঁকে ব্রহ্মের শব্দ অবতার বলে গণ্য করা হয়। ব্রহ্মা হচ্ছেন এর প্রবর্তক এবং এই মন্ত্র গুরু-শিষ্য পরম্পরায় তাঁর থেকে নেমে এসেছে।
সমস্ত মাসের মধ্যে অগ্রহায়ণ মাসকে বছরের শ্রেষ্ঠ সময় বলে গণ্য করা হয়। কারণ, ভারতবর্ষে এই সময়ে ক্ষেতের ফসল সংগ্রহ করা হয় এবং তাই জনসাধারণ সকলেই এই সময় গভীর সুখে মগ্ন থাকে। অবশ্যই বসন্ত এমনই একটি ঋতু যে, সকলেই তা পছন্দ করে, কারণ বসন্ত ঋতু নাতিশীতোষ্ণ এবং এই সময় গাছপালা ফুলে-ফলে শোভিত হয়। বসন্তকালে শ্রীকৃষ্ণের লীলাসমূহকে স্মরণ করে অনেক মহোৎসব উদযাপিত হয়; তাই বসন্ত ঋতুকে সর্বাপেক্ষা আনন্দোচ্ছ্বল ঋতু বলে গণ্য করা হয় এবং এই ঋতুরাজ বসন্ত হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণের প্রতিনিধি ।
শ্লোকঃ ৩৬
দ্যূতং ছলয়তামস্মি তেজস্তেজস্বিনামহম্ ।
জয়োঽস্মি ব্যবসায়োঽস্মি সত্ত্বং সত্ত্ববতামহম্ ॥ ৩৬ ॥
দ্যূতম্—দ্যূতক্রীড়া; ছলয়তাম — বঞ্চনাকারীদের মধ্যে; অস্মি — হই; তেজঃ– তেজ; তেজস্বিনাম্—তেজস্বীদের মধ্যে, অহম্ — আমি; জয়ঃ– জয়; অস্মি— হই; ব্যবসায়াঃ —উদ্যম; অস্মি—হই; সত্ত্বম্—বল; সত্ত্বতাম্—বলবানদের মধ্যে; অহম — আমি ।
গীতার গান
বঞ্চনার মধ্যে আমি হই দ্যূতক্রীড়া ৷
তেজস্বীগণের মধ্যে আমি তেজবীরা ।।
উদ্যমের মধ্যে হই আমি সে বিজয় ৷
তার মধ্যে শ্রেষ্ঠ আমি হই ব্যবসায় ।।
বলবান মধ্যে আমি হয়ে থাকি বল ৷
আমার বিভূতি এই বুঝহ সকল ।।
অনুবাদঃ সমস্ত বঞ্চনাকারীদের মধ্যে আমি দ্যূতক্রীড়া এবং তেজস্বীদের মধ্যে আমি তেজ। আমি বিজয়, আমি উদ্যম এবং বলবানদের মধ্যে আমি বল।
তাৎপর্যঃ সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডে নানা রকম প্রবঞ্চনাকারী আছে। সব রকম প্রবঞ্চনার মধ্যে দ্যূতক্রীড়া হচ্ছে শ্রেষ্ঠ, তাই তা শ্রীকৃষ্ণের প্রতীক। পরমেশ্বর রূপে শ্রীকৃষ্ণ যে কোন মানুষের থেকেও অনেক বড় প্রবঞ্চক হাতে পারেন। শ্রীকৃষ্ণ যদি কাউকে প্রতারণা করতে চান, তা হলে কেউই তাঁকে এড়াতে পারেন না। ভগবান সব ব্যাপারেই শ্রেষ্ঠ, এমন কি প্রতারণাতেও।
বিজয়ীদের মধ্যে তিনি হচ্ছেন জয়। তিনি হচ্ছেন তেজস্বীর তেজ। উদ্যমী ও অধ্যবসায়ীদের মধ্যে তিনিই হচ্ছেন সর্বোৎকৃষ্ট উদ্যমী ও অধ্যবসায়ী। দুঃসাহসীদের মধ্যে তিনিই হচ্ছেন শ্রেষ্ঠ দুঃসাহসী এবং বলবানের মধ্যে তিনিই হচ্ছেন শ্রেষ্ঠ বলশালী। শ্রীকৃষ্ণ যখন এই জগতে প্রকট ছিলেন, তখন তাঁর মতো শক্তিশালী কেউই ছিল না। এমন কি তাঁর শৈশবেই তিনি গিরি-গোবর্ধন তুলেছিলেন। তাঁর মতো প্রবঞ্চক কেউ ছিল না, তাঁর মতো তেজস্বী কেউ ছিল না, তাঁর মতো বিজয়ী কেউ ছিল না, তাঁর মতো উদ্যমী কেউ ছিল না এবং তাঁর মতো বলবানও কেউ ছিল না।