শ্লোকঃ ২৭

উচ্চৈঃশ্রবসমশ্বানাং বিদ্ধি মামমৃতোদভবম্ ।

ঐরাবতং গজেন্দ্রাণাং নরাণাং চ নরাধিপম্ ॥ ২৭ ॥

উচ্চৈঃশ্রবসম্—উচ্চেঃশ্রবা; অশ্বানাম্ — অশ্বদের মধ্যে; বিদ্ধি — জানবে; মাস্‌— আমাকে, অমৃতোদ্ভবম্ — সমুদ্র মন্থনের সময় উদ্ভূত, ঐরাবতম — ঐরাবত, গজেন্দ্রাণাম্—শ্ৰেষ্ঠ হস্তীদের মধ্যে; নরাণাম্ — মানুষদের মধ্যে, চ–এবং; নরাধিপম্ রাজা।

গীতার গান

অশ্বদের মধ্যে হই উচ্চৈঃশ্রবা নাম ।

সমুদ্র মন্থনে সে হয় মোর ধান ॥

গজেন্দ্রগণের মধ্যে ঐরাবত হই ।

সম্রাটগণের মধ্যে মনুষ্যেতে সেই ॥

অনুবাদঃ অশ্বদের মধ্যে আমাকে সমুদ্র মন্থনের সময় উদ্ভুত উচ্চৈঃশ্রবা বলে জানবে। শ্রেষ্ঠ হস্তীদের মধ্যে আমি ঐরাবত এবং মনুষ্যদের মধ্যে আমি সম্রাট।

তাৎপর্যঃ একবার ভগবদ্ভক্ত দেবতা ও ভগবৎ-বিদ্বেষী অসুরেরা সমুদ্র মন্থনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এই মন্থনের ফলে অমৃত ও বিষ উত্থিত হয়েছিল এবং দেবাদিদেব মহাদেব সেই বিষ পান করে জগৎকে রক্ষা করেছিলেন। অমৃতের থেকে অনেক জীব উৎপন্ন হয়েছিল। উচ্চৈঃশ্রবা নামক অশ্ন ও ঐরাবত নামক হস্তী এই অমৃত থেকে উদ্ভূত হয়েছিল। যেহেতু এই দুটি পশু অমৃত থেকে উদ্ভূত হয়েছিল, তাই তাঁদের বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে এবং সেই জন্য তাঁরা হচ্ছেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতিনিধি ।

মনুষ্যদের মধ্যে রাজা হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণের প্রতিনিধি, কারণ শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন এই জগতের পালনকর্তা এবং দৈব গুণাবলীতে গুণান্বিত হওয়ার ফলে রাজারা তাঁদের রাজ্যের পালনকর্তা রূপে নিযুক্ত হয়েছেন। শ্রীরামচন্দ্র, মহারাজ যুধিষ্ঠির, মহারাজ পরীক্ষিতের মতো নরপতিরা ছিলেন অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ। তাঁরা সর্বক্ষণ তাঁদের প্রজাদের মঙ্গলের কথা চিন্তা করতেন। বৈদিক শাস্ত্রে রাজাকে ভগবানের প্রতিনিধিরূপে বর্ণনা করা হয়েছে। আধুনিক যুগে, ধর্মনীতি কলুষিত হয়ে যাওয়ার ফলে রাজতন্ত্র ধীরে ধীরে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে অবশেষে সম্পূর্ণরূপে লুপ্ত হয়ে গেছে। এটি অনস্বীকার্য যে, পুরাকালে ধর্মপরায়ণ রাজার তত্ত্বাবধানে প্রজারা অত্যন্ত সুখে বসবাস করত।

শ্লোকঃ ২৮-২৯

আয়ুধানামহং বজ্রং ধেনুনামস্মি কামধুক ৷

প্রজনশ্চাস্মি কন্দর্পঃ সর্পাণামস্মি বাসুকিঃ ॥ ২৮ ॥

অনন্তশ্চাস্মি নাগানাং বরুণো যাদসামহম্ ।

পিতৃণামর্যমা চাস্মি যমঃ সংযমতামহম্ ॥ ২৯ ॥

আয়ুধানাম্ — সমস্ত অস্ত্রের মধ্যে; অহম্ — আমি; বজ্রম্ব; ধেনুনাম— গাভীদের মধ্যে, অম্মি — হই; কামধুক্‌ — কামধেনু, প্রজনঃ সন্তান উৎপাদনের কারণ; চ এবং অস্মি হই; কন্দৰ্প:-কামদেব, সর্গাণাম—সর্পদের মধ্যে অস্মি হই: বাসুকি – বাসুকি, অনন্তঃ – অনন্ত; চ–এ, অস্মি — হই, নাগানাম্ নাগদের মধ্যে, বরুণঃ—বরুণদেব; যাদসাম্ — সমস্ত জলচরের মধ্যে, অহম — আমি; পিতৃণাম- পিতৃদের মধ্যে, অর্যমা – অর্যমা, চ–ও অস্মি – হই, যমঃ – যমরাজ, সংযমতাম — দণ্ডদাতাদের মধ্যে; অহম্ — আমি।

গীতার গান

অস্ত্রের মধ্যেতে বজ্র ধেনু কামধেনু।

উৎপত্তির কন্দর্প হই কামতনু ৷।

সর্পগণের মধ্যেতে আমি সে বাসুকি ।

অনন্ত সে নাগগণে বরুণ যাদসি ॥

পিতৃদেব মধ্যে আমি হই সে অর্যমা।

যমরাজ আমি সেই মধ্যেতে সংযমা ।।

অনুবাদঃ সমস্ত অস্ত্রের মধ্যে আমি বজ্র, গাভীদের মধ্যে আমি কামধেনু। সন্তান উৎপাদনের কারণ আমিই কামদেব এবং সর্পদের মধ্যে আমি বাসুকি । সমস্ত নাগদের মধ্যে আমি অনন্ত এবং জলচরদের মধ্যে আমি বরুণ। পিতৃদের মধ্যে আমি অর্যমা এবং দণ্ডদাতাদের মধ্যে আমি যম।

তাৎপর্যঃ বাস্তবিকই অসীম শক্তিশালী অস্ত্র বস্ত্র শ্রীকৃষ্ণের শক্তির প্রতিনিধিত্ব করে। চিন্ময় জগতে কৃষ্ণলোকে গাভীদের যে কোন সময় দোহন করলেই যত পরিমাণ ইচ্ছা তত পরিমাণ দুধ পাওয়া যায়। জড় জগতে অবশ্য এই ধরনের গাভী দেখা যায় না। শ্রীকৃষ্ণের এই প্রকার বহু গাভী রয়েছে এবং এই সমস্ত গাভীদের বলা হয় সুরভী। বর্ণিত আছে যে, গোচারণে ভগবান নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। কাপ হচ্ছেন কামদেব, যাঁর প্রভাবে সুসন্তান উৎপন্ন হয়। তাই কন্দর্প হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণের প্রতিনিধি। ইন্দ্রিয়-তৃপ্তির জন্য যে কাম তা কখনই শ্রীকৃষ্ণের প্রতিনিধিত্ব করে না। কিন্তু সুসন্তান উৎপাদনের জন্য যে কাম, তাই হচ্ছেন কন্দর্প এবং তিনি শ্রীকৃষ্ণের প্রতিনিধিত্ব করেন।

বহু ফণাধারী নাগদের মধ্যে অনন্ত হচ্ছেন শ্রেষ্ঠ এবং জলচরদের মধ্যে বরুণ হচ্ছেন শ্রেষ্ঠ। তারা উভয়েই শ্রীকৃষ্ণের প্রতীক। পিতৃ বা পূর্বপুরুষদেরও একটি গ্রহলোক আছে এবং সেই গ্রহের অধিষ্ঠাতা দেবতা হচ্ছেন অর্যমা, যিনি আর প্রতিনিধি। পাপীদের যাঁরা দণ্ড দেন, তাঁদের মধ্যে প্রধান হচ্ছেন । এ পৃথিবীর নিকটেই যমালয় অবস্থিত। মৃত্যুর পর পাপীদের সেখানে নি गा হয় এবং যমরাজ তাদের নানাভাবে শাস্তি দেন।

শ্লোকঃ ৩০

প্রহ্লাদশ্চাস্মি দৈত্যানাং কালঃ কলয়তামহম্ ।

মৃগাণাং মৃগেন্দ্রোহহং বৈনতেয়শ্চ পক্ষিণাম্ ॥ ৩০ ॥

প্রহ্লাদঃ- প্রহ্লাদ, চ; অস্মি— হই: দৈত্যানাম্ — দৈত্যদের মধ্যে কালঃ কাল কলয়তাম—বশীকারীদের মধ্যে অহম্ — আমি; মৃগাণাম্‌ — সমস্ত পতদের মধ্যে। চ—এবং মৃগেন্দ্রঃ— সিংহ, অহম্ — আমি; বৈনতেয়ঃ– গরুড়, চ–ও, পক্ষি- পক্ষীদের মধ্যে।

গীতার গান

দৈত্যদের প্রহ্লাদ সে ভক্তির পিপাসী ।

বশীদের মধ্যে আমি কাল মহাবশী ॥

মৃগদের মধ্যে সিংহ আমি হয়ে থাকি ৷

পক্ষীদের মধ্যে আমি গরুড় সে পক্ষী ॥

অনুবাদঃ দৈত্যদের মধ্যে আমি প্রহ্লাদ, বশীকারীদের মধ্যে আমি কাল, পশুদের মধ্যে আমি সিংহ এবং পক্ষীদের মধ্যে আমি গরুড়।

তাৎপর্যঃ দিতি ও অদিতি দুই ভগ্নী। অদিতির পুত্রদের বলা হয় আদিত্য এবং দিতির বলা হয় দৈত্য। সমস্ত আদিত্যেরা ভগবানের ভক্ত, আর সমস্ত দৈত্যেরা নাস্তিক। যদিও প্রহ্লাদ দৈত্যকুলে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও শৈশব থেকে তিনি ছিলেন মহান ভগবন্তক্ত। তাঁর ভক্তি ও দৈব গুণাবলীর জন্য তাকে শ্রী প্রতিনিধিরূপে গণ্য করা হয়। নানা ধরনের বশীভূতকরণ নিয়ম আছে, কিন্তু কাল এই জড় ব্রহ্মাণ্ডের সব কিছুকেই পরাস্ত করে এবং তাই কাল হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণের প্রতীক। জন্তুদের মধ্যে সিংহ হচ্ছে সবচেয়ে শক্তিশালী ও হিংস্র। সমগ্র পক্ষীকুলের মধ্যে শ্রীবিষ্ণুর বাহক গরুড় হচ্ছেন সর্বশ্রেষ্ঠ।

error: Content is protected !!