শ্লোকঃ ১১
তেষামেবানুকম্পার্থমহমজ্ঞানজং তমঃ ৷
নাশয়াম্যাত্মভাবস্থো জ্ঞানদীপেন ভাস্বতা ॥ ১১ ৷৷
তেষাম্—তাঁদের; এব—অবশ্যই, অনুকম্পার্থম্ — অনুগ্রহ করার জন্য; অহম্ — আমি অজ্ঞানজম্—অজ্ঞান-জনিত; তমঃ — অন্ধকার; নাশয়ামি নাশ করি; আত্মভাবস্থঃ — হৃদয়ে অবস্থিত হয়ে; জ্ঞান—জ্ঞানের দীপেন—প্রদীপের দ্বারা, ভাস্বতা— উজ্জ্বল।
গীতার গান
সেই সে অনন্য ভক্ত নহেত অজ্ঞানী ৷
আমি তার হৃদয়েতে জ্ঞানদীপ আনি ৷।
অন্ধকার তমোনাশ করি সে অশনি ৷
জ্ঞানদীপ জ্বালাইয়া করি তারে জ্ঞানী ।।
অনুবাদঃ তাঁদের প্রতি অনুগ্রহ করার জন্য আমি তাঁদের হৃদয়ে অবস্থিত হয়ে, উজ্জ্বল জ্ঞান- প্রদীপের দ্বারা অজ্ঞানজনিত অন্ধকার নাশ করি।
তাৎপর্যঃ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু যখন বারাণসীতে হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে / হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে কীর্তন করে প্রচার করছিলেন, তখন হাজার হাজার লোক তাঁর অনুগামী হয়েছিল। বারাণসীর অত্যন্ত প্রভাবশালী পণ্ডিত প্রকাশানন্দ সরস্বতী তখন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুকে ভাবুক বলে উপহাস করেছিলেন। দার্শনিক পণ্ডিতেরা কখনও কখনও ভগবদ্ভক্তের সমালোচনা করে, কারণ তারা মনে করে যে, অধিকাংশ ভক্তেরাই অজ্ঞানতার অন্ধকারে আচ্ছন্ন এবং তত্ত্বদর্শনে অনভিজ্ঞ ভাবুক। প্রকৃতপক্ষে তা সত্য নয়। অনেক বড় বড় পণ্ডিতেরা ভক্তিতত্ত্বের মাহাত্মা কীর্তন করে ভক্তিযোগের শ্রেষ্ঠত্ব প্রচার করে গেছেন। কিন্তু এমন কি কোন ভক্ত যদি এই সমস্ত শাস্ত্রগ্রস্থ অথবা সদগুরুর সাহায্য গ্রহণ না- ও করেন, কিন্তু তিনি যদি ঐকান্তিক ভক্তিযোগে ভগবানের সেবা করেন, তা হলেও শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে অন্তর থেকে সাহায্য করেন। সুতরাং, কৃষ্ণভাবনায় নিযুক্ত নিষ্ঠাবান ভক্ত কখনই তত্ত্বজ্ঞানবিহীন নন। তাঁর একমাত্র যোগ্যতা হচ্ছে সম্পূর্ণভাবে কৃষ্ণভাবনাময় হয়ে শ্রীকৃষ্ণের সেবা করা।
আধুনিক যুগের দার্শনিকেরা মনে করেন যে, পার্থক্য বিচার না করে কেউ শুদ্ধ জ্ঞান লাভ করতে পারে না। তার উত্তরে পরমেশ্বর ভগবান এখানে বলেছেন যে, যারা শুদ্ধ ভক্তি সহকারে তাঁর সেবা করেন, তাঁরা যদি অশিক্ষিত এবং পর্যাপ্ত বৈদিক জ্ঞানবিহীনও হন, তবুও তিনি তাঁদের হৃদয়ে দিব্য জ্ঞানের দীপ জ্বালিয়ে তাঁদের সাহায্য করেন, যা এই শ্লোকটিতে বলা হয়েছে।
ভগবান অর্জুনকে বলেছেন যে, মূলত মনোধর্ম-প্রসূত জ্ঞানের মাধ্যমে কখনই পরম সত্য বা পরমতত্ত্ব পরম পুরুষোত্তম ভগবানকে জানতে পারা যায় না, কেন না পরম সত্য এতই বৃহৎ যে, কেবল কোন রকম মানসিক প্রচেষ্টার দ্বারা তাঁকে হৃদয়ঙ্গম করা অথবা তাঁকে লাভ করা সম্ভব নয়। মানুষ লক্ষ লক্ষ বছর ধরে নানা রকম জল্পনা-কল্পনা ও অনুমান করে যেতে পারে, কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত তার চিত্তে পরমেশ্বর ভগবানের প্রতি ভক্তি না জাগছে, পরম সত্যের প্রতি প্রীতির উদয় না হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত সে কোন মতেই শ্রীকৃষ্ণকে বা পরম সত্যকে জানতে পারে না। ভক্তিযোগে ভগবানের সেবা করার মাধ্যমেই পরম সত্য শ্ৰীকৃষ্ণকে পরিতুষ্ট করা যায় এবং তাঁর অচিন্তা শক্তির প্রভাবে তিনি তাঁর শুদ্ধ ভক্তের হৃদয়ে নিজেকে প্রকাশিত করেন। শ্রীকৃষ্ণ সর্বদাই তাঁর শুদ্ধ ভক্তের হৃদয়ে বিরাজমান এবং সূর্যসম শ্রীকৃষ্ণের সান্নিধ্যের ফলে অজ্ঞানতার সমস্ত অন্ধকার তৎক্ষণাৎ বিদূরিত হয়। শুদ্ধ ভক্তের প্রতি শ্রীকৃষ্ণের এটি একটি বিশেষ কৃপা।
লক্ষ লক্ষ জন্ম-জন্মান্তরে বৈষয়িক সংসর্গের কলুষতার ফলে জড়বাদের ধুলির দ্বারা আমাদের হৃদয় আচ্ছন্ন হয়ে আছে। কিন্তু আমরা যখন ভক্তিযোগে ভগবৎ- সেবায় যুক্ত হয়ে নিরন্তর হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ করতে থাকি, তখন অতি শীঘ্রই হৃদয়ের সমস্ত আবর্জনা বিদূরিত হয় এবং আমরা শুদ্ধ জ্ঞানের পর্যায়ে উন্নতি লাভ করি। পরম লক্ষ্য শ্রীকৃষ্ণকে কেবলমাত্র এভাবেই কীর্তন ও সেবার মাধ্যমে প্রাপ্ত হওয়া যায়, মনোধর্ম-প্রসুত কল্পনা অথবা যুক্তিতর্কের মাধ্যমে নয়। জীবন ধারণের আবশ্যকতাগুলির জন্য শুদ্ধ ভক্ত কোন রকম উদ্বেগগ্রস্ত হন না। তাঁর উদ্বিগ্ন হবার প্রয়োজন নেই, কারণ তাঁর হৃদয় থেকে অজ্ঞানতার অন্ধকার দূর হয়ে যাওয়ার ফলে পরমেশ্বর ভগবান আপনা থেকেই তার সমস্ত প্রয়োজন মিটিয়ে দেন, কারণ ভক্তের ভক্তিযুক্ত সেবায় ভগবান অত্যন্ত প্রীত হন। এটিই হচ্ছে ভগবদ্গীতার শিক্ষার সারমর্ম। ভগবদ্গীতা অধ্যয়ন করার মাধ্যমে আমরা সর্বতোভাবে ভগবানের চরণে আত্মসমর্পণ করে শুদ্ধ ভক্তিযোগে তাঁর সেবায় নিযুক্ত হতে পারি। ভগবান যখন আমাদের দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন আমরা সব রকম জাগতিক প্রচেষ্টা থেকে মুক্ত হই।
শ্লোকঃ ১২-১৩
অর্জুন উবাচ
পরং ব্রহ্ম পরং ধাম পবিত্রং পরমং ভবান্ ।
পুরুষং শাশ্বতং দিব্যমাদিদেবমজং বিভুম্ ॥ ১২ ॥
আহুত্ত্বামৃষয়ঃ সর্বে দেবর্ষিনারদস্তথা ।
অসিতো দেবলো ব্যাসঃ স্বয়ং চৈব ব্রবীষি মে ॥ ১৩॥
অর্জুনঃ উবাচ—অর্জুন বললেন, পরম্ – পরম ব্রহ্ম – সত্য; পরম্পরম; ধাম- ধাম; পবিত্রম্—পবিত্র; পরমম্ পরম; ভবান্ –তুমি; পুরুষম্—পুরুষ; শাশ্বতম্— সনাতন, দিব্যম্—দিব্য; আদিদেবম্ — আদিদেব, অজম্—জন্মরহিত, বিভুম্— সর্বশ্রেষ্ঠ; আহুঃ – বলেন; জ্বাম্ — তোমাকে; ঋষয়ঃ – ঋষিগণ, সর্বে— সমস্ত; দেবর্ষিঃ – দেবর্ষি নারদঃ-নারদ; তথা – ৩; অসিতঃ — অসিত দেবলঃ-দেবল ব্যাসঃ- ব্যাসদেব: স্বয়ম্—তুমি নিজে; চ—ও; এব— অবশ্যই; নে—আমাকে।
গীতার গান
পরম ব্রহ্ম পরম ধাম পবিত্র পরম ।
তুমি কৃষ্ণ হও নিত্য এই মোর জ্ঞান ৷৷
শাশ্বত পুরুষ তুমি অজ, আদি বিভু ।
অপ্রাকৃত দেহ তব সকলের প্রভু ॥
দেবর্ষি নারদ আর যত ঋষি আছে ৷
অসিত দেবল ব্যাস সেই গাহিয়াছে ৷৷
তোমার এই শ্রীমূর্তি ওহে ভগবান ।
না জানে দেবতা কিংবা যারা দানবান ।।
অনুবাদঃ অর্জুন বললেন –তুমি পরম ব্রহ্ম, পরম ধাম, পরম পবিত্র ও পরম পুরুষ। তুমি নিত্য, দিব্য, আদি দেব, অজ ও বিভূ। দেবর্ষি নারদ, অসিত, দেবল, ব্যাস আদি ঋষিরা তোমাকে সেভাবেই বর্ণনা করেছেন এবং তুমি নিজেও এখন আমাকে তা বলছ।
তাৎপর্যঃ এই দুটি শ্লোকের মাধ্যমে পরমেশ্বর ভগবান আধুনিক যুগের তথাকথিত দার্শনিকদের তাঁর সম্বদ্ধে যথাযথভাবে অবগত হওয়ার সুযোগ দান করেছেন। কারণ এখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, স্বতন্ত্র জীবাত্মা থেকে পরমতত্ত্ব ভিন্ন। এই অধ্যায়ে ভগবদ্গীতার সারমূলক চারটি মুখ্য শ্লোক শোনার পর অর্জুন সন্দেহ থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত হয়েছিলেন এবং শ্রীকৃষ্ণকে পরমেশ্বর ভগবানরূপে স্বীকা করেছিলেন। তিনি তৎক্ষণাৎ স্পষ্টভাবে ঘোষণা করলেন, “তুমি হচ্ছ পরং ব্রহ্ম অর্থাৎ পরম পুরুষোত্তম ভগবান।” পূর্বে শ্রীকৃষ্ণ নিজেই বলেছেন যে, তিনি সকলের ও সব কিছুর আদি। প্রতিটি মানুষ, এমন কি স্বর্গের দেব-দেবীরাও তাঁর উপর নির্ভরশীল। অজ্ঞানতার বশবর্তী হয়ে মানুষ ও দেবতারা মনে করেন যে, তারা পূর্ণ এবং পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মতো সম্পূর্ণভাবে স্বাধীন। ভক্তিযোগ সাধন করার ফলে এই অজ্ঞানতার অন্ধকার সম্পূর্ণভাবে বিদূরিত হয়। সেই কথা পূর্ববর্তী শ্লোকে ভগবান নিজেই ব্যাখ্যা করেছেন। এখন, ভগবানের কৃপার ফলে অর্জুন শ্রীকৃষ্ণকে পরম সত্য বলে স্বীকার করেছেন এবং সেই কথা বেদেও স্বীকার করা হয়েছে। এমন নয় যে, শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের অন্তরঙ্গ বন্ধু বলে অর্জুন তাঁকে পরমেশ্বর ভগবান বা পরমতত্ত্ব বলে তোষামোদ করেছেন। এই শ্লোক দুটিতে অর্জুন যা বলেছেন, তা সবই বৈদিক শাস্ত্রসম্মত। বেদে বলা হয়েছে যে, ভক্তির মাধ্যমেই কেবল ভগবানকে উপলব্ধি করা যায়। এ ছাড়া আর কোনভাবেই তাঁকে জানতে পারা সম্ভব নয়। এখানে অর্জুন যা বলেছেন, তাঁর প্রতিটি কথা বেদের নির্দেশ অনুসারে অক্ষরে অক্ষরে সত্য।
কেন উপনিষদে বলা হয়েছে যে, পরমব্রহ্ম হচ্ছেন সব কিছুর আশ্রয়। শ্রীকৃষ্ণ এখানে বর্ণনা করেছেন যে, তিনিই হচ্ছেন সব কিছুরই পরম আশ্রয় । মুক্তক উপনিষদে প্রতিপন্ন করা হয়েছে যে, পরমেশ্বর ভগবান, যিনি সব কিছুর আশ্রয়, নিরন্তর তাঁর চিন্তা করার মাধ্যমেই কেবল তাকে উপলব্ধি করা যায়। শ্রীকৃষ্ণ সম্বন্ধে এই নিরন্তর চিন্তাকে বলা হয় স্মরণম্, তা ভগবদ্ভক্তির একটি অঙ্গ। কৃষ্ণভক্তির ফলেই কেবল আমরা আমাদের স্বরূপ সম্বন্ধে অবগত হয়ে এই জড় দেহের বন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারি।
বেদে পরমেশ্বর ভগবানকে পরম পবিত্র বলে স্বীকার করা হয়েছে। শ্রীকৃষ্ণকে যিনি পরম পবিত্র বলে উপলব্ধি করতে পারেন, তিনি সব রকম পাপকর্ম থেকে মুক্ত হয়ে পবিত্র হন। পরমেশ্বর ভগবানের চরণে আত্মসমর্পণ না করলে পাপকর্ম থেকে মুক্ত হওয়া যায় না। শ্রীকৃষ্ণকে অর্জুন পরম পবিত্র বলে ঘোষণা করেছেন, তা বৈদিক নির্দেশেরই পুনরাবৃত্তি। এই সত্য সমস্ত মুনি-ঋষিরাও স্বীকার করেছেন, যাঁদের মধ্যে নারদ মুনি হচ্ছেন শ্রেষ্ঠ।
শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরম পুরুষোত্তম ভগবান এবং তাঁর ধ্যানে মগ্ন থেকে আমরা তাঁর সঙ্গে আমাদের অপ্রাকৃত সম্পর্কের আনন্দ উপলব্ধি করতে পারি। তিনিই হচ্ছেন শাশ্বত অস্তিত্ব। তিনি সব রকম দৈহিক প্রয়োজন, জন্ম ও মৃত্যু থেকে মুক্ত। সেই কথা যে কেবল অর্জুনই বলেছেন, তা নয়, সমস্ত বৈদিক সাহিত্য, পুরাণ ও ইতিহাস যুগ-যুগান্তর ধরে সেই কথা ঘোষণা করে আসছে। সমস্ত বৈদিক সাহিত্যে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে এভাবেই বর্ণনা করা হয়েছে এবং চতুর্থ অধ্যায়ে শ্রীকৃষ্ণ নিজেই তার পুনরাবৃত্তি করে বলেছেন, “যদিও আমি অঙ্গ, তবুও এই পৃথিবীতে আমি ধর্ম সংস্থাপন করবার জন্য অবতরণ করি।” তিনি পরম উৎস; তাঁর কোন কারণ নেই, কেন না তিনিই হচ্ছেন সর্ব কারণের কারণ এবং তাঁর থেকেই সব কিছুর প্রকাশ হয়। ভগবানের কৃপার প্রভাবেই কেবল এই দিব্যজ্ঞান লাভ করা যায়।
ভগবানের কৃপার প্রভাবেই কেবল অর্জুন তাঁর এই উপলব্ধির কথা বর্ণনা করতে সক্ষম হয়েছেন। আমরা যদি ভগবদ্গীতাকে যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে চাই, তা হলে এই শ্লোক দুটিতে ভগবান সম্বন্ধে যা বলা হয়েছে, তা সম্পূর্ণভাবে মেনে নিতে হবে। একে বলা হয় পরম্পরা ধারা অর্থাৎ গুরুশিষ্য পারম্পর্যে পরম তত্ত্বজ্ঞান লাভ করা। পরম্পরা ধারায় অধিষ্ঠিত না হলে ভগবদ্গীতার যথার্থ জ্ঞান লাভ করা যায় না। কেতাবি বিদ্যার দ্বারা ভগবদ্গীতার জ্ঞান লাভ করা কখনই সম্ভব নয়। বৈদিক শাস্ত্রে অজস্র প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও, দুর্ভাগ্যবশত আধুনিক যুগের তথাকথিত দাম্ভিক পণ্ডিতেরা তাদের কেতাবি বিদ্যার অহঙ্কারে মত্ত হয়ে গোঁয়ার্তুমি করে বলে যে, শ্রীকৃষ্ণ একজন সাধারণ মানুষ।
শ্লোকঃ ১৪
সর্বমেতদ্ ঋতং মন্যে যন্মাং বদসি কেশব ৷
ন হি তে ভগবন্ ব্যক্তিং বিদুদেবা ন দানবাঃ ॥ ১৪॥
সর্বম্—সমস্ত; এতং—এই ঋতম্——সত্য; মনো—মনে করি; যৎ-যা, মাস্ আমাকে, বদসি বলেছ, কেশব – হে কৃষ্ণ, ন–না; হি— অবশ্যই: তে— তোমার; ভগবন্ — হে পরমেশ্বর ভগবান; ব্যক্তিম্ — তত্ত্ব; বিদুঃ—জানতে পারে; দেবাঃ- দেবতারা; ন-না; দানবাঃ – দানবেরা ।
গীতার গান
হে কেশব তোমার এ গীত বাণী যত।
সর্ব সত্য মানি আমি সে বেদসম্মত ৷।
তোমার মহিমা তুমি জান ভাল মতে ।
অনন্ত পারে না গাহিতে অনন্ত জিহ্বাতে ॥
অনুবাদঃ হে কেশব ! তুমি আমাকে যা বলেছ, তা আমি সত্য বলে মনে করি। হে ভগবান! দেবতা অথবা দানবেরা কেউই তোমার তত্ত্ব যথাযথভাবে অবগত নন।
তাৎপর্যঃ অর্জুন এখানে দৃঢ়ভাবে প্রতিপন্ন করছেন যে, নাস্তিক ও আসুরিক ভাবাপন্ন মানুষেরা কখনই ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে জানতে পারে না। এমন কি দেব-দেবীরা পর্যন্ত তাকে জানতে পারেন না, সুতরাং আধুনিক যুগের তথাকথিত পণ্ডিতদের সম্বন্ধে কি আর বলার আছে? ভগবানের কৃপায় অর্জুন উপলব্ধি করতে পেরেছেন যে, শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন পরমতত্ত্ব এবং তিনি পূর্ণ শুদ্ধ। তাই, আমাদের অর্জুনের পদাঙ্ক অনুসরণ করা উচিত। কারণ, ভগবদ্গীতাকে তিনিই যথাযথভাবে গ্রহণ করেছিলেন। চতুর্থ অধ্যায়ে যে কথা বলা হয়েছে, পরম্পরা নষ্ট হয়ে যাওয়ার ফলে ভগবদ্গীতার জ্ঞান মানুষ হারিয়ে ফেলে। তাই, অর্জুনের মাধ্যমে ভগবান সেই পরম্পরা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করলেন, কারণ অর্জুন হচ্ছেন তাঁর সখা ও পরম ভক্ত। সুতরাং, গীতোপনিষদ ভগবদ্গীতার প্রস্তাবনায় আমরা বলেছি যে, গুরু-শিষ্য পরম্পরার মাধ্যমে ভগবদ্গীতার জ্ঞান আহরণ করা উচিত। পরম্পরা নষ্ট হয়েছিল বলেই অর্জুনের মাধ্যমে তা পুনরুজ্জীবিত করা হয়। শ্রীকৃষ্ণের সমস্ত নির্দেশগুলি অর্জুন সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করেছিলেন। ভগবদ্গীতার যথাযথ অর্থ যদি আমরা উপলব্ধি করতে চাই, তা হলে আমাদেরও অর্জুনেরই মতো ভগবানের সব কয়টি নির্দেশ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে গ্রহণ করতে হবে। তা হলেই কেবল আমরা শ্রীকৃষ্ণকে পরম পুরুষোত্তম ভগবান বলে জানতে পারব।