প্রাকৃতিক নির্বাচন এবং সমকামিতা
এ অধ্যায়ে আমরা আবারো যৌনপ্রজ এবং অযৌনপ্রজদের গল্পে ফিরে যাব। বিবর্তনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে যৌনপ্রজদের যাবতীয় কাজ-কর্ম যে বিধ্বংসী রকমের অপচয়ী তা আগেই উল্লেখ করেছি (প্রথম অধ্যায় দ্রঃ)। বিখ্যাত জীববিজ্ঞানী প্রফেসর রিচার্ড ডকিন্স এই অপচয়ী প্রক্রিয়ার ‘তাণ্ডব’ দেখে এক সময় মন্তব্য করেছিলেন, কোনো প্রজাতি যদি একবার কোনোভাবে যৌনপ্রজ থেকে অযৌনপ্রজয় রূপান্তরিত হয়ে যায়, তবে সে প্রজাতিতে আর মনে হয় না সেক্স আবার কখনো ফেরৎ আসবে- ‘স্ট্যাটিস্টিকালি ইম্প্রোবাবেল’ । ফরাসি ফসিলবিদ লুইস ডোল্লোর অনুকল্প যদি সঠিক হয়ে থাকে (বিবর্তনের কোনো ধারা যদি একবার ভেঙ্গে যায়, তা আর নতুন করে কখনো গজাবে না), তবে অপচয়বপ্রবণ সেক্সের আবার সেই প্রজাতিতে ফেরৎ না আসারই কথা। এখন, যৌনপ্রজদের যৌনতার ব্যাপারটা যদি এত নিকৃষ্ট এবং অপচয়প্রবনই হয়ে থাকে তবে তারা এত ঢালাওভাবে প্রকৃতিতে টিকে আছে কি করে? যৌনপ্রজদের নামে এত গীবৎ গাওয়ার আর অযৌনপ্রজদের এত গুণগান করার পরও দেখা যাচ্ছে প্রকৃতির উচ্চশ্রেণীর জীবজগতের শতকরা নিরানব্বই ভাগই ‘অযৌন প্ৰজ’ নয়, বরং ‘যৌনপ্রজ’ । কেন এমন হলো? ব্যাপারটা জীববিজ্ঞানীদের কাছে অনেকটা ধাঁধার মতো। ধাঁধার উত্তর বহু গবেষক অনেকভাবে দিতে সচেষ্ট হয়েছেন। কেউ বলেছেন, নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তির ক্ষেত্রে খারাপ দেখালেও হয়ত যৌনতার ব্যাপারটা দলগতভাবে সেরকম খারাপ নয়, বরং টিকে থাকার ক্ষেত্রে এটি কোনো বাড়তি সুবিধা দেয়। অনেক বিজ্ঞানীর মতে, সেক্স জিনিসটা জীবজগতে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে জেনেটিক প্রকারণ (Variation) বা ভিন্নতা তৈরি করে, যা বিবর্তনের অন্যতম চালিকাশক্তি। কথাটার মাঝে যে কিছুটা হলেও সত্যতা নেই তা নয়। এটা ঠিক পার্থেনোজেনেসিস নামধারী অযৌনপ্রজদের প্রাকৃতিক ক্লোনিং প্রক্রিয়ায় কোনো রকম বংশগত ভিন্নতা বা বৈচিত্র থাকে না, কারণ, এরা কেবলমাত্র মায়ের একই জেনেটিক বৈশিষ্ট নিয়েই জন্মায়। যার ফলে জন্মানো সবাই – ছেলে, নাতি, পুতি, জ্ঞাতিগোষ্ঠী – বংশগতভাবে একই হয়, যতক্ষণ পর্যন্ত সেখানে কোনো মিউটেশন না ঘটে এবং তা বংশ পরপম্পরায় চালিত না হয়। বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন, জেনেটিক প্রকারণ না থাকায়, হঠাৎ করে পরিবেশে কোনো পরিবর্তন ঘটলে তারা এর সাথে সহজে খাপ খাওয়াতে পারে না। ফলে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে যেমন খাদ্যাভাব বা রোগবালাইয়ের আগমনে এরা নিজেদের সহজে রক্ষা করতে নাও পারতে পারে যা হতে পারে প্রজাতির বিলুপ্তির কারণ। বিলুপ্তির কারণ। আবার, কখনো কোনো কারণে এদের বংশধারার মধ্যে একবার কোনো ক্ষতিকর মিউটেশনের জন্ম হলে, (জেনেটিক প্রকারণ না থাকায়) তারা এই ক্ষতিকর মিউটেশনটি বহন করে যাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে । কিন্তু তারপরও শুধুমাত্র ‘জেনেটিক ভ্যারিয়েশনের’ ধুয়া তুলে নিতান্ত অপচয়ী এই মাধ্যমের টিকে থাকার ব্যাপারটাকে ব্যাখ্যা করাকে আনেক গবেষকই মেনে নিতে পারেননি। সাসেক্স ইউনিভার্সিটির জীববিজ্ঞানের অধ্যাপক জন মায়নার্ড স্মিথ, সেই ১৯৭৮ সালে একটি বই লিখেছিলেন — ইভল্যুশন অব সেক্স’ ” নামে। সেখানে তিনি সেক্স বা যৌনতার ব্যাপারে জীববিজ্ঞানের চিরায়ত ব্যাখ্যাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন এই বলে যে, শুধু জেনেটিক প্রকারণ যৌনতার টিকে জন্য উপযুক্ত ব্যাখ্যা হতে পারে না। মায়নার্ড স্মিথের মতো ইউনিভার্সিটি অব অ্যারিজোনার বিবর্তনীয় জীববিদ্যার অধ্যাপক রিচার্ড মিকন্ডও মনে করেন, শুধু জেনিটিক প্রকারণ দিয়ে সেক্সকে ব্যাখ্যা করার সনাতন প্রচেষ্টা সঠিক নয়”। তাহলে সেক্সের উদ্দেশ্য কী? হোয়াট ইজ দ্য পারপাস অব সেক্স? সত্যি বলতে কি ব্যাপারটি এখনো জীববিজ্ঞানীদের কাছে ধাঁধা হয়েই রয়েছে, কিন্তু সেখানে যাবার আগে সেক্স বা যৌনতার অপচয়ী মনোবৃত্তির নমুনাটা আমরা আরেকবার দেখি, এবার একটু অন্যভাবে।
মানুষের কথাই ধরা যাক। একটি সুস্থ ‘যৌনপ্রজ’ দম্পতি তাদের দীর্ঘ জীবনে গড়ে প্রতি সপ্তাহে একবার করে তিরিশ-চল্লিশ বছর ধরে সঙ্গম করে থাকে। কিন্তু সে হিসেবে তাদের বাচ্চা কাচ্চার সংখ্যা থাকে নিতান্তই নগন্য – দুইটি কি তিনটি। উন্নত বিশ্বে এখন এমন দম্পতিও আছে যারা বাচ্চা কাচ্চা একেবারেই নেয় না। সে সব বহু দেশেই জন্মহার এখন পড়তির দিকে। বুঝলাম, আজকাল কৃত্রিম জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির মাধ্যমে সন্তানের সংখ্যা কমিয়ে আনা হয়েছে। কিন্তু পঞ্চাশ বা একশ বছর আগের উদাহরণ দেখলেও দেখা যায় যে, কোনো জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ছাড়া ও কোনো মানব দম্পতির খুব বেশি হলে ১২-১৪টা ছেলেমেয়ে হতো। তাদের মধ্যে অনেকেই আবার বড় হওয়ার আগেই বিভিন্ন রোগে মৃত্যুবরণ করতো।
John Maynard Smith, The Evolution of Sex, Cambridge University Press; 1978।
Richard E. Michod, Eros and Evolution: A Natural Philosophy of Sex, Perseus Books, 1996
কাজেই যৌনতার ‘একমাত্র’ উদ্দেশ্য যদি কেবল পরবর্তী প্রজন্মে ‘জিন সঞ্চালন’ হয়ে থাকে, তবে বলতেই হয় এই আনাড়ি পদ্ধতিটি নিসন্দেহে একটি ‘অকর্মার ধাড়ি’ । শুধু মানুষ নয়, হাতি, গরিলা, শূকর, ঘোড়াদের ক্ষেত্রেও লক্ষ করলে দেখা যাবে, তারা যৌন সংসর্গে যে পরিমাণে সময় ও শক্তি ব্যয় করে সে তুলনায় ভবিষ্যত প্রজন্ম তৈরি করতে পারে একদমই কম। বিজ্ঞানীরা বলেন, সারা জীবনের নব্বইভাগ যৌনসংসর্গেই কোনো ধরনের অযাচিত গর্ভধারণের ভয় থাকে না। আর সমকামিতার উদাহরণ হাজির করলে তো সেক্সের মূল উদ্দেশ্যকেই প্রশ্নবিদ্ধ করতে হয়। সেক্সের একমাত্র উদ্দেশ্য যদি কেবল ভবিষ্যত প্রজন্ম টিকিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে ‘জিন সঞ্চালন’ হয়ে থাকে, তবে সমকামীরা নিঃসন্দেহে “বায়োলজিকাল ডেড এন্ড”-এ। আর অনেক বিবর্তনবাদীরাই সেজন্য খুব যান্ত্রিকভাবে ডারউইনবাদকে সমকামিতার বিরুদ্ধে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন। আর এমন ‘যুক্তি’ উপস্থাপন করা শুরু করেন যখন মনে হয় তাদের জায়গা ওই ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের সাথে একই জায়গায় ! অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ওই ‘যান্ত্রিক’ ডারউইনবাদীরা সেক্সুয়াল সিলেকশন বা যৌন-নির্বাচনের ধুঁয়া তুলে সমকামিতাকে অস্বীকার করেন, কিংবা বলার চেষ্টা করেন এরা প্রকৃতির এক ধরনের বিচ্যুতি (Aberration)। ভাবখানা যেন, ওই দু’ চারটা সমকামীদের নিয়ে অতটা চিন্তা আমাদের না করলেও চলবে!
কিন্তু সত্যই কি তাই? তারা সমকামীদের সংখ্যা ‘দু-চারটি’ বলে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিলেও বাস্তবতা কিন্তু ভিন্ন। ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানী আলফ্রেড কিন্সের রিপোর্ট অনুযায়ী প্রতি দশ জন ব্যক্তির একজন সমকামী”। অর্থাৎ, জনসংখ্যার শতকরা প্রায় দশভাগই ওই যান্ত্রিক ডারউইনবাদীদের আভিলাসে ছাই দিয়ে অর্থাৎ জিন সঞ্চালনের ‘মহৎ’ প্রবৃত্তিকে অস্বীকার করে টিকে আছে। কিন্সের গবেষণা ছিল সেই চল্লিশের দশকে। সাম্প্রতিককালে (১৯৯০) ম্যাকহটার, স্টেফানি স্যান্ডার্স এবং জুন ম্যাকহোভারের গবেষণা থেকে জানা যায়, পৃথিবীতে শতকরা প্রায় চোদ্দ ভাগের মতো সমকামী রয়েছে”। ১৯৯৩ সালের ‘জেনাস রিপোর্ট অন সেক্সুয়াল বিহেভিয়ার’ থেকে জানা যায়, পুরুষদের মধ্যে প্রায় শতকরা নয় ভাগ এবং নারীদের মধ্যে শতকরা ৪ ভাগ সমকামী রয়েছে”।
Wardell B. Pomeroy, Clyde E. Martin, Alfred C. Kinsey Paul H. Gebhard, Sexual Behavior in the Human Female, AND Sexual Behavior in the Human Male, W. B. Saunders Company, 1953
David P. McWhirter, Stephanie A. Sanders and June Machover Reinisch, Homosexuality/Heterosexuality: Concepts of Sexual Orientation, Oxford University Press, USA, 1990
কাজেই সংখ্যা হিসেবে সমকামীদের সংখ্যাটা কিন্তু এ পৃথিবীতে খুব একটা কম নয়। সায়েন্টিফিক আমেরিকান মাইণ্ড-এর ২০০৬ এর একটি ইস্যুতে সমকামীদের সংখ্যা সমগ্র জনসংখ্যার ৩ থেকে ৭ ভাগ উল্লেখ করা হয়েছে”। কিন্তু এ কথা বলতেই হবে, পরিসংখ্যানগুলোর পরিসীমা একে অন্যের খুব কাছাকাছি (মোটামুটি ৫-১৫ ভাগ) হলেও কোনোটাই হয়ত প্রকৃত অবস্থা নির্দেশ করছে না। কারণ সামাজিক একটা চাপ সবসময়ই থেকে যায় সমকামিতাকে নিরুৎসাহিত করে বিষমকামিতাকে উৎসাহিত করার। রক্ষণশীল সমাজে এই চাপ আরো প্রবল। ফলে অনেক সময়ই দেখা যায় সমাজের চাপে একজন প্রকৃত সমকামী বিষমকামী হয়ে জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন। স্বামী কিংবা বউ বাচ্চা নিয়ে সংসার করছেন। এদের বলা হয় নিভৃত সমকামী (closet gay)। বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত মানবাধিকারকর্মীর কথা জানি যিনি নিভৃত সমকামী হয়ে তাঁর স্ত্রীর সাথে বিবাহিত জীবন যাপন করছেন।
আরেকজন ‘বিবাহিত সমকামীর’ কথা পড়েছিলাম একটি কেস স্টাডিতে। উনি দিল্লিতে বসবাসরত দন্ত চিকিৎসক। নাম রমেশ মণ্ডল। নিজে সমকামী। কিন্তু পারিবারিক চাপে পড়ে তাঁকে একসময় বিয়ে করতে হয়। কিন্তু স্ত্রীর সাথে তাঁর সম্পর্ক স্রেফ যান্ত্রিক। তিনি তাঁর যৌনচাহিদা নিরসন করেন গোপনে তাঁর এক সমকামী বন্ধুর সাথে। কখন জব্বলপুর, কোলাপুরেও চলে যান। তাঁর স্ত্রী আজও এ ব্যাপারটি জানেন না। সম্পূর্ণ মিথ্যার উপরে দাঁড়িয়ে আছে রমেশের দাম্পত্য জীবন। আরেক সমকামী ভদ্রলোক নীতিন দেশাই স্ত্রীকে ফাঁকি দিয়ে প্রায়ই চলে যান মুম্বই-এর চৌপাট্টির সমুদ্র সৈকতে। কারণ সহজেই অনুমেয়।
Samuel S. Janus and Cynthia L. Janus, The Janus Report on Sexual Behavior, Wiley, March 1994.
Robert Epstein, Do Gays Have a Choice? Science offers a clear and surprising answer to a controversial question, Scientific American Mind, February 2006
অনেক পাঠক হয়ত পাকিস্তানি সমকামী কবি ইফতি নাসিমের” ব্যক্তিগত জীবনের সমপ্রেমের মর্মন্তুদ কাহিনী জানেন। কবি নাসিম ছোটবেলা থেকেই তাঁর সমবয়সী একটি ছেলের সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। তারপর দুই কিশোর কৈশোরকাল অতিক্রম করে বড় হলো। পড়াশুনার পাঠ চুকিয়ে তারা তখন প্রতিষ্ঠিত হবার পথে। তখন স্বাভাবিকভাবেই বাসা থেকে এলো বিয়ের চাপ। এমন কি ইফতির বন্ধুটির বাসার লোকজন মেয়ে দেখে তাঁর বিয়ে পর্যন্ত ঠিক করে ফেলল। ইফতির বন্ধু সেদিন তাঁর সমকামী মানসিকতার কথা বাসায় খুলে বলতে পারেননি। আর তাছাড়া পাকিস্তানি গোড়া মুসলিম সমাজে বড় হবার কারণে কোরানের সমকামীদের প্রতি ঘৃণা- উদ্রেককারী আয়াতগুলোর কথাও তাঁর ভালোই জানা ছিল। ফলে যা হবার তাই হলো। বেশ ধূম ধাম করে বিয়ে হলো ওই বন্ধুর। সে বিয়েতে ইফতিও আমন্ত্রিত হয়েছিলেন এবং হাজিরও ছিলেন। ফুল শয্যার রাতে বন্ধুর বাড়িতে ইফতি ছিলেন। যে মানুষটির সাথে তাঁর এতদিনের প্রেমের সম্পর্ক, সে মানুষটি সমাজের চাপে পড়ে এক অচেনা নারীর বাহুলগ্ন হবেন, এ চিন্তা তাকে ক্ষত বিক্ষত করে ফেলল – ‘ আজকে রাতে তুমি অন্যের হবে, ভাবতেই চোখ জলে ভিজে যায়’! সারা রাত তিনি ঘুমাতে পারলেন না। এপাশ ওপাশ করে কাটালেন। শেষ রাতে হঠাৎ দরজায় ধাক্কা। হুড়মুড় করে বিছানায় উঠে বসলেন ইফতি। দরজা খুলে ইফতি দেখলেন- অসহায়ভাবে বাইরে তাঁর বন্ধু দাঁড়িয়ে আছে। দু’ জনেই নির্বাক।
নাসের আকবর নামে আরেকজন বাংলাদেশী ভদ্রলোকের কথা জানি। উনি আমেরিকার একটি নামী বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট। আমেরিকায় সাফল্যের সাথে আইটিতে কাজ করেছেন প্রায় পনর-বিশ বছর। আমেরিকায় থাকাকালীন সময় প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে প্রকাশ্যে গে ম্যারেজ করে সংবাদের শিরোনাম হন। বিয়ে করেন পল গুস্তাভসন নামের এক মিউজিশিয়ানকে। তাদের এই বিয়ে এবং দাম্পত্য জীবনকে ফিচার করে এলেন লিউয়িন একটি গ্রন্থ রচনা করেন ‘Recognizing Ourselves’ নামে। আমাদের “জনপ্রিয় কথাশিল্পী’ হুমায়ূন আহমেদ ‘হোটেল গ্রেভার ইন’-এ ঐ ভদ্রলোকের উদাহরণ হাজির করে কটাক্ষ করে লিখে দিলেন- হুমম, ‘বাংলাদেশীরা ভালোই এগুচ্ছে বটে! সমকামী বিয়ে করা আর প্লে বয় ম্যাগাজিনের মডেল হওয়া ছাড়া বাংলাদেশ আর বিদেশে গিয়ে করতে পেরেছে কী!’
হারুণ নামে (আসল নাম নয়) আমাদের খুব কাছের একজন মুক্তমনা সদস্য সমকামী।
পাকিস্তানী কবি, নরমানসহ অন্যান্য কাব্যপুস্তক প্রণেতা। এই বইয়ের নবম অধ্যায়ে ইফতি নাসিমের কবিতা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। ছাড়া দেখুন, http://www.glhalloffame.org/index.pl?todo=view_item&item=91
খুব ছোটবেলায় পাড়ার এক সমকামী হুজুরের পাল্লায় পড়েন। কিছুদিন পরে সে সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে এলেও পরে কৈশোরোত্তীর্ণ যুবক বয়সে তাঁর খুব কাছের এক বন্ধুর সাথে সমকামিতার সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। কিন্তু বাংলাদেশের পরিবেশ পরিস্থিতি এবং সামাজিক আইন কানুনের কথা বিবেচনা করে তাঁরা এক সাথে থাকতে পারেননি। সেই বন্ধু তারপর তাঁর বোনকে বিয়ে করেন। বিয়ের কারণ হিসেবে বন্ধুটি হারুণকে বোঝান যে, এর ফলে তারা ‘বৈধভাবেই’ সম্পর্ক তৈরি করে বাসায় থাকতে পারবেন। স্বাভাবিকভাবেই সেই সম্পর্কও টেকেনি। বন্ধুটি তারপর থেকেই হয়ে ওঠেন চরম প্রতিহিংসাপরায়ণ। হারুণ হয়ে ওঠেন প্রতিহিংসার প্রধানতম টার্গেট। খুনের হুমকি, সম্পত্তি দখলসহ নানা জিঘাংসার স্বীকার হন তিনি। শেষ পর্যন্ত দেশত্যাগ। আজকে তিনি ইউরোপের একটি দেশে বসবাস করছেন তাঁর এক সমকামী সাথীর সাথে।
শুধু বাংলাদেশ, ভারত বা পাকিস্তানে কেন, খোদ আমেরিকাতেও একই অবস্থা। অনেক পাঠকই হয়ত ২০০৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘মিল্ক’ ছবিটি দেখেছেন। ছবিটি আমেরিকার প্রথম নির্বাচিত সমকামী রাজনীতিবিদ হার্ভে মিল্কের (১৯৩০-১৯৭৮) জীবনের উপর ভিত্তি করে রচিত। এ ছবিটি দেখলে বোঝা যায়, কত প্রতিকূল অবস্থা অতিক্রম করে মিল্ককে সে সময় নির্বাচিত হতে হয়েছিল; কিন্তু নির্বাচিত হতে গিয়ে তিনি আপোস করেননি, সমকামিতাকে ‘নিভৃত কক্ষে’ আটকে রাখেননি, বরং মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে একে আন্দোলনের এক হাতিয়ারে পরিণত করেছেন”। ‘মিল্ক’ চরিত্রে অভিনয় করে শন পেন শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে অস্কার পেয়েছেন। সমাজে ইফতি নাসিম বা মিল্কের মতো লোকদের ‘কামিং আউট অব ক্লোসেট’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
মানুষের কথা বাদ দেই, প্রাণিজগতেও কিন্তু সমকামীদের সংখ্যা নেহাৎ মন্দ নয়। গবেষকরা অনেকদিন ধরেই এ নিয়ে গবেষণা করছেন। প্রসঙ্গত লু হুজি, কর্ণেল লক, জিউনার, জুরের, হাবাক, উইলিয়ামস, শের জং, জেন গুডোয়ল প্রমুখ বিজ্ঞানীদের অক্লান্ত পরিশ্রমলব্ধ গবেষণার কথা উল্লেখ করা যায়”। এদের গবেষণার মধ্য দিয়ে উঠে আসতে থাকে প্রাণিজগতের নানা অজানা তথ্য। আবার অন্যদিকে অ্যালেন, প্রেনটিস, অ্যালেন লিস, জেমসন, মারফি প্রমুখ বিজ্ঞানীরা প্রাণিজগতের যৌনতা বিষয়ে ব্যাপক গবেষণা চালিয়েছেন। তাদের গবেষণায় প্রাণিজগতে সমকামিতার সুস্পষ্ট নিদর্শন ধরা পরে।
হার্ভে মিল্ক সম্প্রতি (২০০৯ সালে) মরণোত্তর প্রেসিডেনশিয়াল মেডেল অব ফ্রিডমে ভূষিত হয়েছেন।
অজয় মজুমদার ও নিলয় বসু, সমপ্রেম, পূর্বোক্ত।
সে নিদর্শনগুলোর নমুনা জানতে চাইলে পাঠকেরা জীববিজ্ঞানী ব্রুস ব্যাগমিলের লেখা ‘ বায়োলজিকাল এক্সুবারেন্স : এনিমেল হোমোসেক্সুয়ালিটি এন্ড ন্যাচারাল ডাইভার্সিটি ” বইটি পড়ে দেখতে পারেন । বইটিতে ব্রুস ব্যাগমিল প্রকৃতিতে যে সমস্ত প্রজাতিতে সমকামিতা এবং রূপান্তরকামিতার অস্তিত্ব সনাক্ত করেছেন, সেগুলো নীচে দেওয়া হলোঃ
সারণী ৪.১ প্রকৃতিজগতের সমকামী এবং রূপান্তরকামী প্রজাতির আংশিক তালিকা
Bruce Bagemihl, Biological Exuberance: Animal Homosexuality and Natural Diversity, Stonewall Inn Editions, 2000
ভেড়ার জীবন যাত্রা খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করে বিজ্ঞানীরা সমকামী প্রবণতার প্রচুর উদাহরণ পেয়েছেন। তবে মেষপালকেরা ভেড়ার এই প্রবণতার কথা অনেক আগে থেকেই জানতেন। এই ধরনের ভেড়ার পাল সবসময়ই মেষপালকদের জন্য হতাশা বয়ে আনে। কারণ এরা বংশবিস্তারে কোনো সাহায্য করে না। তারা প্রথম থেকেই ভেড়ীদের প্রতি থাকে একেবারেই অনাগ্রহী। এদের আগ্রহের পুরোটা জুড়েই কে আরেকটি পুরুষ ভেড়া বা মেষ। অরেগন হেলথ এন্ড সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের চার্লস রসেলির মতে শতকরা ৮ ভাগ ভেড়া এরকম সমকামী প্রবৃত্তিসম্পন্ন হয়ে থাকে”। এই ধরনের সমকামী ভেড়া সঙ্গমের সময় আরেকটি পুরুষ ভেড়ার দিকে অগ্রসর হয় তাদের আদর সোহাগ জানাতে থাকে আর যৌনাঙ্গ শুঁকতে থাকে। অবশেষে পেছন দিক থেকে ভেড়ার উপর আরোহন করে ভেড়ার উলের উপর বীর্য নিক্ষেপ করে (এরা কখনোই পায়ুকামে প্রবৃত্ত হয় না)। চার্লস রসেলি এ সমস্ত ভেড়ার মস্তিষ্ক বিশ্লেষণ করে দেখান যে এদের মস্তিষ্কের কিছু অংশের আকার ‘স্বাভাবিক’ ভেড়াদের থেকে অনেকাংশেই ভিন্ন। তিনি ‘সেক্সুয়ালি ডাইমরফিক নিউক্লিয়াস’ বলে মাথার হাইপোথ্যালমাসের একটা অংশে উল্লেখ করার মতো পার্থক্য পান”। একই ধরনের পার্থক্য আরেক গবেষক সিমন লেভি লক্ষ করেছেন সমকামী মানুষের মস্তিষ্কেও (সিমন লেভির গবেষণা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে এই বইয়ের ষষ্ঠ অধ্যায়ে)।
ভেড়া ছাড়াও সমকামী আচরণ লক্ষ্য করা গেছে বিভিন্ন স্তন্যপায়ী জীবের ক্ষেত্রেও। এদের মধ্যে হাতি, সিংহ, চিতাবাঘ, হায়না, ক্যাঙ্গারু, হরিণ, জিরাফ, আমেরিকা, ইউরোপ ও আফ্রিকার মোষ, জেব্রা উল্লেখযোগ্য। পাখিদের মধ্যে পেঙ্গুইন, ধুসর পাতিহাঁস, কানাডা পাতিহাঁস, কালো রজহাঁস, বরফী পাতিহাঁস, মিউট রাজহাঁস, শকুন সহ অনেক প্রাণীর মধ্যে সমকামিতার সুস্পষ্ট উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। সরীসৃপের মধ্যে সমকামিতার আলামত আছে কমন অ্যামিভা, অ্যানোল, গিরগিটি, স্কিনক, গেকো মাউরিং, কচ্ছপ, রাটেল স্নেক প্রভৃতিতে। সমকামিতার অস্তিত্ব আছে বিভিন্ন প্রজাতির ব্যাঙ, স্যালাম্যান্ডারের মতো উভচর এবং বিভিন্ন মাছেও।
বিজ্ঞানীরা দেখেছেন প্রাইমেট বর্গের মধ্যে সাধারণ শিম্পাঞ্জিদের মধ্যে প্রজননহীন যৌনতা (non-reproductive sex) খুবই প্রকট। মানুষের মতোই তারা কেবল ‘জিন সঞ্চালনের’ জন্য সঙ্গম করে না, সঙ্গম করে আনন্দের জন্যও। কাজেই তাদের মধ্যে মুখ-মৈথুন, পায়ু মৈথুন থেকে শুরু করে চুম্বন, দংশন সব কিছুই প্রবলভাবে লক্ষ্যনীয়। তারা খুব সচেতনভাবেই সমকাম, উভকাম এবং বিষমকামে লিপ্ত হয়। শিম্পাঞ্জীদের আরেকটি প্রজাতি বনোবো শিম্পাঞ্জী (প্রচলিত নাম পিগমী শিম্পাঞ্জী)দের মধ্যে সমকামী প্রবণতা এতই বেশি যে, ব্যাগমিল বলেন, এই প্রজাতিটির ক্ষেত্রে ‘সমকামী যৌনসংসর্গ, বিষমকামিতার মতোই স্বাভাবিক। একেকটি গোত্রে এমনকি শতকরা ৩০ ভাগ সদস্য সমকামিতা এবং উভকামিতার সাথে যুক্ত থাকে এবং দেখা গেছে ৭৫ ভাগ যৌনসংসর্গই প্রজননহীন।
John Schwartz, Of Gay Sheep, Modern Science and Bad Publicity, NY Times, January 25, 2007
Roselli C, Stadelman H, Reeve R, Bishop C, Stormshak F (2007). “The ovine sexually dimorphic nucleus of the medial preoptic area is organized prenatally by testosterone”. Endocrinology 148 (9): 4450–4457; এছাড়া দেখুন, Faye Flam, The Score: How The Quest For Sex Has Shaped The Modern Man, Avery, 2008
এদের মধ্যে প্রবলভাবে আছে নারী সমকামিতাও। এমনকি শিশুদেরও তারা রেহাই দেয় না”। কেউ যদি এ ধরনের সমকামে অনীহা প্রকাশ করে তবে, তাহলে বনোবো সমাজে সে ‘অচ্ছুৎ’ বলে পরিগণিত হয়, অন্যান্য সদস্যরা তাকে এড়িয়ে চলে। বিভিন্ন রকমের সমকামী এবং উভকামী প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে গরিলা, ওরাং-ওটান, গিবন, সিয়ামাং, লঙ্গুর হনুমান, নীলগিরি লঙ্গুর, স্বর্ণ হনুমান, প্রবোসিক্স মাঙ্কি, সাভানা বেবুন ইত্যাদি প্রাইমেটদের মধ্যেও।
১৯৭২ সালে লিন্ডা উলফি নামের এর তরুণ গবেষক ল্যাবরেটরিতে জাপানি ম্যাকুয়ি নামের একধরনের প্রাইমেট নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে দেখেন, তাদের মধ্যে নারী সমকামিতার ব্যাপারটি প্রকটভাবে দৃশ্যমান। লিন্ডা ভাবলেন নিশ্চয়ই ল্যাবরেটরির বন্দি পরিবেশে থাকার ফলে তাদের যৌনতার পরিবর্তন ঘটেছে (জেলখানায় থাকার ফলে আসামীদের মধ্যে যে ধরনের সমকামী মনোবৃত্তি জেগে উঠে অনেকটা সেরকম)। তিনি আসল ব্যাপারটি বুঝতে জাপানে গিয়ে বন্য পরিবেশে ম্যাকুয়ি পর্যবেক্ষণ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। গিয়ে তিনি কী দেখলেন? সেখানেও নারী সমকামিতা রাজত্ব করে চলেছে। শুধু লিন্ডা উলফি নয় পল ভ্যাসি নামে আরেক গবেষকও জাপানি ম্যাকুয়িদের উপর দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন। তিনিও ম্যাকুয়িদের মধ্যকার সমকামী প্রবণতা অত্যন্ত কাছ থেকে দেখেছেন এবং বিস্তৃতভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন। অনেক গবেষক আগে ভেবেছিলেন, ম্যাকুয়ি সমাজে নারীতে- নারীতে প্রেম আসলে পুরুষদের আকর্ষণের জন্য। নিশ্চয়ই চোখের সামনে এই ‘লেসবিয়ন পর্ন’ দেখে পুরুষ ম্যাকুয়িরা উত্তেজিত হয়ে ওঠে এবং নারী ম্যাকুয়িদের সাথে সঙ্গমে লিপ্ত হয়।
Frans de Waal, author of Bonobo: The Forgotten Ape, calls the bonobo species a “make love, not war” primate.
Faye Flam, পূর্বোক্ত
কিন্তু পল ভ্যাসি তাঁর গবেষণায় পরিষ্কার ভাবেই দেখালেন নারী ম্যাকুয়িরা যখন সমকামে মত্ত থাকে তখন তারা কোনো পুরুষ ম্যাকুয়ির প্রতি কোনো রকম আগ্রহই দেখায় না। তাদের জন্য সমকামিতার ব্যাপারটি ‘হট বাথ’ নেওয়ার মতন কেবলই আনন্দের।
যৌনতার মাধ্যমে বংশবৃদ্ধির ব্যাপারটি যেহেতু বিবর্তনের মূল চালিকা শক্তি, সেহেতু বহু বিজ্ঞানীই প্রাণিজগতের মাঝে বিদ্যমান সমকামিতাকে প্রথমদিকে তেমন গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেননি। তারা যে প্রকৃতিতে সমকামিতা দেখেননি তা নয়, অনেকবারই দেখেছেন – কিন্তু অবধারিতভাবে ভেবে নিয়েছিলেন এটি বিবর্তনের বিচ্যুতি, এ নিয়ে গবেষণার কোনো দরকার নেই। যেমন, ল্যারিএস গিস্ট নামের এক বিজ্ঞানী ক্যানাডিয়ান রকি পর্বতমালায় পাহাড়ি মেষদের মধ্যকার সমকামিতা পর্যবেক্ষণ করেও সেটা গুরুত্ব দিয়ে গবেষণায় লিপিবদ্ধ করেননি। আজ তিনি সেই ‘ব্যর্থতার’ জন্য প্রকাশ্যেই দুঃখ প্রকাশ করেন। আসলে কিন্তু ব্রুস ব্যাগমিলের ‘বায়োলজিকাল এক্সবেরেন্স’ বইটি প্রকাশিত হবার পর বিজ্ঞানীদের চিন্তাভাবনা অনেকটাই বদলে গেছে। তারা সমকামিতাকে গুরুত্ব দিয়েই জীববিজ্ঞানে গবেষণার দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করেন। ব্রুস ব্যাগমিলের গবেষণার পর অন্যান্য গবেষকেরাও বিষয়টি নিয়ে গবেষণা চালিয়ে গেছেন । বিজ্ঞানীরা এখন মনে করেন, পৃথিবীতে এমন কোনো প্রজাতি নেই যেখানে সমকামিতা দেখা যায় না। এ প্রসঙ্গে জীববিজ্ঞানী পিটার বকম্যানের উক্তিটি প্রণিধানযোগ্য-
“No species has been found in which homosexual behaviour has not been shown to exist, with the exception of species that never have sex at all, such as sea urchins and aphids. Moreover, a part of the animal kingdom is hermaphroditic, truly bisexual. For them, homosexuality is not an issue.”
২০০৬ সালের হিসেব অনুযায়ী বিজ্ঞানীরা প্রাণিজগতে ১৫০০’রও বেশি প্রজাতিতে সমকামিতার সন্ধান পেয়েছেন। আর মেরুদণ্ডী প্রাণীর তিনশ’রও বেশি প্রজাতিতে সমকামিতার অস্তিত্ব খুব ভালোভাবেই নথিবদ্ধ। সংখ্যাগুলো কিন্তু প্রতিদিনই বাড়ছে।
হট বাথের ব্যাপারটি কিন্তু উপমা বা রূপক নয়। এই ম্যাকুয়িগুলো উষ্ণ প্রস্রবণে গা ডুবিয়ে আরাম করতে বড়ই পছন্দ করে।
a b c News-medical.net (2006)
1500 animal species practice homosexuality, www.news-medical.net/news/2006/10/23/20718.aspx
Joan Roughgarden, The Genial Gene: Deconstructing Darwinian Selfishness, University of California Press, 2009
ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেলে সম্প্রতি ‘Out in Nature: Homosexual Behavior in the Animal Kingdom’ নামের একটি ডকুমেন্ট্রিতে প্রাণিজগতের অসংখ্য সমকামিতার উদাহরণ তুলে ধরা হয়” । ব্রুস ব্যাগমিল এবং জোয়ান রাফগার্ডেনের কাজের উপর ভিত্তি করে অসলোর ন্যাচারাল হিস্ট্রি যাদুঘরে ‘এগেইনস্ট নেচার?” নামে একটি প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। প্রদর্শনীটি ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে শুরু হয়ে আগস্টের ২০০৭ সাল পর্যন্ত চলে। এতে জীবজগতের সমকামিতা, উভকামিতা সহ প্রকৃতির নানা ধরনের বৈচিত্র্যময় উদাহরণ হাজির করে ব্যাতিক্রমধর্মী উপস্থাপনার ব্যবস্থা করা হয়। প্রদর্শনীটি সাড়া বছর জুড়ে দেশ বিদেশের অসংখ্য দর্শকের আগ্রহ এবং মনোযোগ আকর্ষণে সমর্থ হয়।
এত কিছুর পরও সমকামিতার পুরো ব্যাপারটিকে ‘প্রাকৃতিক’ বলে মেনে নিতে অনেকেরই প্রবল অনীহা আছে। প্রানীজগতের অসংখ্য উদাহরণ হাজির করা হলেও মানুষকে এগুলো থেকে আলাদা রাখতেই পছন্দ করেন সবাই। কিন্তু যতই আলাদা করে রাখি না কেন, আমরা ‘সৃষ্টির সেরা জীব’ বলে কথিত গর্বিত মানুষেরাও কিন্তু ঘুরে ফিরে সেই প্রকৃতিরই (আরো ভালোভাবে বললে প্রাইমেটদের) অংশ। ইংল্যান্ডের লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রবিন ডানবার এ প্রসঙ্গে বলেন –
সব কথার শেষ কথা হলো, অন্যান্য প্রাইমেটদের মধ্যে বিশেষতঃ এপদের মধ্যে কোনো কিছু ঘটলে, এর একটা বিবর্তনীয় ধারাবাহিকতা হয়ত মানুষের মধ্যেও থাকবে বলে ভেবে নিলে হয়ত সেটা অযৌক্তিক হবে না।
এই বইয়ের পরিশিষ্টে উইকিপেডিয়া থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত দেয়া তালিকা লিপিবদ্ধ করা আছে।
ইউটিউবে পুরো ফিল্মটি ছয় পর্বে রাখা আছে। http://www.youtube.com/watch?v=LFeXwKnCUNI
Oslo gay animal show draws crowds, BBC News, Thursday, 19 October 2006.
আমরা বনোবো শিম্পাঞ্জী কিংবা জাপানি ম্যাকাকুয়ি প্রজাতিতে সমকামিতার প্রকাশ দেখেছি। বিবর্তনের চোখ দিয়ে দেখতে শুরু করলে মানুষের অবস্থানও কিন্তু হবে এদের খুব কাছেপিঠেই। তাহলে মানুষের মধ্যে বিদ্যমান সমকামিতার কি ব্যাখ্যা? ওয়েল – হয়ত আসলে কোনো গূঢ় কারণ নেই। ম্যাকুয়ি প্রাইমেটদের কাছে ব্যাপারটা যেমন স্রেফ আনন্দের’ মানুষদের মধ্যেও তা যে সেরকম কিছু নয়, তা কে বলবে? আর আনন্দের ব্যাপারটা অনেকাংশেই মুখ্য বলেই মানব সমাজেও প্রজননহীন যৌনতা খুব ভালোভাবেই দৃশ্যমান। অবাঞ্ছিত গর্ভকে দূরে রাখতে মানুষ জন্মনিয়ন্ত্রণেরও কৃত্রিম নানা পন্থা আবিস্কার করে নিয়েছে, কিন্তু যৌনতার আনন্দ উপভোগ করাকে কখনোই বাদ দেয়নি। সমকামিতা হয়ত কারো কারো মধ্যে সেই আনন্দ প্রকাশ এবং উদযাপনেরই একটি উদগ্র রূপ বই কিছু নয়। কিন্তু তারপরেও আমাদের ডারউইনীয় পটভূমিকায় ব্যাখ্যা করতে হবে যে, এই হারে প্রজননহীন যৌনতা সম্পন্ন সমকামীরা পৃথিবীতে টিকে থাকল কি করে।
ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব কি সমকামিতাকে ব্যাখ্যা করতে পারে?
ডারউইনীয় বিবর্তনের দিক থেকে চিন্তা করলে সমকামিতার ব্যাপারটি জীববিজ্ঞানীদের জন্য সব সময়ই একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ। কারণ ‘ওটা বায়োলজিকাল ডেড এন্ড’ – অন্তত এভাবেই ভাবা হতো কিছুদিন আগেও। বিবর্তনের কথা ভাবলে প্রথমেই প্রজননের মাধ্যমে বংশ বিস্তারের কথাটিই মাথায় সবার আগে চলে আসে। সে দিক দিয়ে চিন্তা করলে সমকামিতার লক্ষ্য যে বংশবিস্তার নয় – তা যে কেউ বুঝবে। তাহলে জৈববৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে সমকামিতার উদ্দেশ্য কি? আগে এমনকি জীববিজ্ঞানীদের মধ্যেও সমকামিতাকে ঢালাওভাবে ‘অস্বাভাবিকতা’ কিংবা ‘ব্যতিক্রম’ ভেবে নেওয়াটাই ছিল স্বাভাবিক,তবে সাম্প্রতিক সময়ে এই ধ্যান ধারণা অনেকটা বদলেছে।
প্রথম কথা হচ্ছে, সমকামিতার ব্যাপারটি কিন্তু নিখাঁদ বাস্তবতা। শুধু মানুষের ক্ষেত্রে নয়, পুরো প্রাণিজগতের ক্ষেত্রেই। জীববিজ্ঞানী ব্রুস ব্যাগমিল তাঁর ‘বায়োলজিকাল এক্সুবারেন্সঃ এনিমেল হোমোসেক্সুয়ালিটি এন্ড ন্যাচারাল ডাইভার্সিটি’ বইয়ে প্রায় পাঁচশ প্রজাতিতে সমকামিতার অস্তিত্বের উদাহরণ লিপিবদ্ধ করেছেন।
According to Paul Vasey,” Japanese macaques ‘re engaging in the behavior because it’s gratifying sexually or it’s sexually pleasurable,” he says. “They just like it. It doesn’t have any sort of adaptive payoff”.
Matthew Grober, biology professor at Georgia State University, agrees, saying, “If [sex] wasn’t fun, we wouldn’t have any kids around. So I think that maybe Japanese macaques have taken the fun aspect of sex and really run with it.”
Jared Diamond, Why Is Sex Fun? : The Evolution Of Human Sexuality, Basic Books, 1998
সামগ্রিকভাবে জীবজগতে ১৫০০-রও বেশি প্রজাতিতে সমকামিতার অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। মানুষের মধ্যে শতকরা প্রায় ৫ ভাগ থেকে ১২ ভাগ সমকামিতার সাথে যুক্ত বলে পরিসংখ্যানে পাওয়া গেছে। কাজেই সমকামিতার এই বাস্তবতাকে অস্বীকার করার চেষ্টা বোকামি। এখন মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন হলো, সমকামিতাকে ব্যাখ্যা করার সঠিক বৈজ্ঞানিক মডেল জীববিজ্ঞানে আছে কিনা, নাকি কেবল ‘সমাকামিতা অস্বাভাবিক” কিংবা ‘ব্যতিক্রম’ ইত্যাদি বলেই ছেড়ে দেয়া হবে? এ প্রসঙ্গে জীববিজ্ঞানী অধ্যাপক জোয়ান রাফগার্ডেনের উক্তিটি খুবই প্রাসঙ্গিক –
‘My discipline teaches that homosexuality is some sort of anomaly. But if the purpose of sexual contact is just reproduction, then why do all these gay people exist? A lot of biologists assume that they are somehow defective, that some development error or environment influence has misdirected their sexual orientation. If so, gay and lesbian people are mistake that should have been corrected a long time ago (thru Natural selection), but this hasn’t happened. That’s when I had my epiphany. When a scientific theory says something wrong with so many people, perhaps the theory is wrong, not the people’.
সমকামিতাকে যদি বাস্তবতা হিসেবে মেনে নেয়া হয়, তবে আমাদের বের করতে হবে – ডারউইনীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এর উপযোগিতা কী। ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে কঠিন। তবে কঠিন বলে কেউ হাত-পা গুটিয়ে বসে নেই। বিজ্ঞানীরা এ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন প্রতিদিনই। কিছু যোগসুত্র পাওয়া গেছে প্রাণিজগতে ‘স্টেরাইল ওয়ার্কার’ বা ‘বন্ধ্যা সৈন্যের’ -এর উদাহরণ থেকে। পিঁপড়ে, মৌমাছি, উইপোকা কিংবা বোলতার মতো প্রজাতিতে এই ধরনের ‘বন্ধ্যা সৈন্যের’ উপস্থিতি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। এরা বংশবৃদ্ধিতে কোনো ভূমিকা রাখে না। কিন্তু নিজেদের গোত্রকে বহিঃশত্রুর হাত থেকে রক্ষা করে জনপুঞ্জ টিকিয়ে রাখে। মানুষের জন্যও কি এটা খাটে? বিবর্তনীয় মনোবিদ্যার আলোকে একটু চিন্তা করা যাক। এমন কি হতে পারে যে, সমকামী পুরুষেরা আমাদের পূর্বপুরুষদের সেই আদিম শিকারি-সংগ্রাহক সমাজে (hunter gatherer societies) বাচ্চা লালন পালনে কোনো বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল? নিজেদের মধ্যে মারামারি না করে যখন একাধিক পুরুষ দলবদ্ধ হয়ে গোত্রের দায়িত্ব নিতো আর শিকারের সন্ধান করত, সেই গোত্র হয়ত অনেক বেশি খাবারের যোগান পেত, কিংবা হয়ত বহিঃশত্রু র হাত থেকেও রক্ষা পেতো অন্যদের চেয়ে বেশি। ফলে টিকে থাকার প্রেরণাতেই হয়ত কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরুষে পুরুষে সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল –যা গোত্রে এনে দিয়েছিল বাড়তি নিরাপত্তা। কিংবা হয়ত এমনও হতে পারে – যখন শক্তিশালী পুরুষ শিকারে যেত, হয়ত সেই গোত্রের কোনো ‘গে চাচা’ রক্ষা করার দায়িত্ব নিতো ছোট ছোট ছেলেপিলেদের।
আর পুরুষটিও শিকারে বের হয়ে স্ত্রীর ‘পরকীয়া’র আশঙ্কায় ভাবিত থাকতো না! ইতিহাসের পাতা খুললে দেখা যায়, বহু রাজা বাদশাহরা তাদের হারেম সুরক্ষিত রাখতে ‘খোঁজা প্রহরী’ দের নিয়োগ দিতো। আরো সমীক্ষায় দেখা গেছে পশ্চিমে মেয়েরা অফিসে সমকামী পুরুষদের সাথে কাজ করতে অনেক নিরাপত্তা অনুভব করে। এটার কারণও অবোধ্য নয়। হয়ত জিন সঞ্চালন ছাড়াও অন্যান্য কিছু ক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করে আমাদের প্রজাতিটিকে টিকিয়ে রাখতে সমকামী সদস্যদের একটা ভূমিকা ছিল। সেজন্য এডয়ার্ড ও উইলসন ‘কিন সিলেকশন’ -এর মাধ্যমে হোমোসেক্সুয়ালিটিকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছিলেন সেই ১৯৭৮ সালেই”।
আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ দিক চিন্তা করা যেতে পারে। সমকামী প্রবৃত্তিটি হয়ত বিবর্তন প্রক্রিয়ার উপজাত বা সাইড ইফেক্ট। বিবর্তনের অনেক কিছুর কথাই আমরা জানি যেগুলো কোনো বাড়তি উপযোগিতা তৈরি করে না। কিন্তু এগুলো উৎপন্ন হয়েছে বিবর্তনের উপজাত হিসেবে। এই বৈশিষ্টগুলো যদি টিকে থাকার ক্ষেত্রে বাড়তি কোনো অসুবিধা তৈরি না করে তাহলে তারা উপজাত হিসেবে রয়ে যেতে পারে বংশ পরম্পরায়। বিজ্ঞানী স্টিফেন যে গুল্ড এটি বোঝাতে আমাদের বাড়ির উদাহরণ হাজির করতেন। যে কোনো বড় বাড়ি কিংবা ইমারতের দিকে দেখলে দেখা যাবে – এর ধনুকাকৃতির দু’ টি খিলানের মাঝে স্থান করে নিয়েছে ইংরেজি ‘ভি’আকৃতির স্প্যান্ড্রেল বা মাঝখানের একটা খোলা জায়গা। বাড়ির ইমারত বানাতে খিলান থাকা অত্যাবশক, কিন্তু খিলান বানাতে গেলে বাড়তি উপজাত হিসেবে স্প্যান্ড্রেল এমনিতেই তৈরি হয়ে যায়, যা ইমারতটির ভিত্তির জন্য অত্যাবশকীয় কোনো কিছু হয়ত নয়, কিন্তু এটি এড়িয়ে যাওয়াও সম্ভব নয়। এ প্রসঙ্গে আমাদের শরীরের হাড্ডির সাদা রঙের কথা ধরা যেতে পারে। এই সাদা রঙ বিবর্তনে কোনো বাড়তি উপযোগিতা দেয় না। এই সাদা রঙ তৈরি হয়েছে হাড়ে ক্যালসিয়াম থাকার উপজাত হিসেবে। তেমনি কারো কারো চোখের নীল কিংবা বাদামী রঙও হয়ত আমাদের কোনো বাড়তি উপযোগিতা দেয়া না – এটা প্রকৃতিতে আছে বিবর্তনের সাইড ইফেক্ট হিসেবে। সমকামিতাও বিবর্তনের সেরকম কোনো উপজাত হতে পারে”।
ইতালির একটি সমীক্ষায় (২০০৪) দেখা গেছে, যে পরিবারে সমকামী পুরুষ আছে সে সমস্ত পরিবারে মেয়েদের উর্বরতা (fertility) বিষমকামী পরিবারের চেয়ে বেশি থাকে।
Michael Abrams, The Real Story on Gay Genes, Discover Magazine, June, 2007
যেমন, ইংল্যান্ডের লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক রবিন ডানবার মনে করেন, মানুষের মধ্যে সম্ভবত বিবর্তনের বাই-প্রোডাক্ট। তিনি বলেন, ‘homosexuality doesn’t necessarily have to have a function. It could be a spin-off or by-product of something else and in itself carries no evolutionary weight’
আন্দ্রিয়া ক্যাম্পেরিও-সিয়ানির ওই গবেষণা” থেকে জানা যায়, বিষমকামী পরিবারে যেখানে গড় সন্তান সংখ্যা ২.৩ সেখানে গে সন্তানবিশিষ্ট পরিবারে সন্তানের সংখ্যা ২.৭। তাঁর মানে যে জেনেটিক প্রভাব মেয়েদের উর্বরা শক্তি বাড়ায় – সেই একই জিন আবার হয়ত ছেলেদের মধ্যে সমকামী প্রবণতা ছড়িয়ে দেয় – বিবর্তনের উপজাত হিসেবে। সেজন্যই ডঃ ক্যাম্পেরিও ক্যানি বলেন ”
“We have finally solved the paradox … the same factor that influence sexual orientation in males promotes higher fecundity in females’
বিজ্ঞানী ডীন হ্যামারও প্রায় একই কথা বলেছেন একটু অন্যভাবে
‘The answer is remarkably simple: the same gene that causes men to like men, also causes women to like men, and as a result to have more children’
বিবর্তন তত্ত্বের প্রেক্ষাপটে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হতে পারে সামাজিক নির্বাচন। আমরা দেখেছি প্রাণিজগতে সমকামিতার প্রবৃত্তি একটি বাস্তবতা। শুধু মানুষের ক্ষেত্রে সমকামিতা নেই, ছড়িয়ে আছে প্রাণিজগতের সকল প্রজাতির মধ্যেই। আসলে প্রকৃতিতে সবসময়ই খুব ছোট হলেও একটা অংশ ছিল এবং থাকবে যারা যৌনপ্রবৃত্তিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের চেয়ে ভিন্ন। কিন্তু কেন এই ভিন্নতা? এর একটি উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেছেন স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবর্তনীয় ইকোলজিস্ট জোয়ান রাফগার্ডেন রোথসবর্গ তাঁর “Evolution’s Rainbow : Diversity, Gender and Sexuality in Nature and People.” বইয়ে” । তিনি বলেন, যৌনতার উদ্দেশ্য সনাতনভাবে যে কেবল ‘জিন সঞ্চালন করে বংশ টিকিয়ে রাখা” বলে ভাবা হয়, তা ঠিক নয়। যৌনতার উদ্দেশ্য হতে পারে যোগাযোগ এবং সামাজিকীকরণ। বলেনঃ
‘যদি আপনি সেক্স বা যৌনতাকে যোগাযোগের একটি কার্যকর মাধ্যম হিসেবে দেখেন, তাহলে আপানার কাছে অনেক কিছুই পরিষ্কার হয়ে যাবে, যেমন সমকামিতার মতো ব্যাপারগুলো— যা জীব বিজ্ঞানীদের বছরের পর বছর ধরে বিভ্রান্ত করে রেখেছিল। বনোবো শিম্পাঞ্জীদের মধ্যে সমকামী সংশ্রব বিষমকামীদের মতোই দেদারসে ঘটতে দেখা যায়। আর বনোবোরা কিন্তু প্রকটভাবেই যৌনাভিলাসী। তাদের কাছে যৌনসংযোগের (Genital contact) ব্যাপারটা আমাদের ‘হ্যালো” বলার মতোই সাধারণ। এভাবেই তারা পরস্পরের সাথে যোগাযোগ করে থাকে। এটি শুধু দলগতভাবে তাদের নিরাপত্তাই দেয় না, সেই সাথে বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য আহরণ এবং সন্তানদের লালন পালনও সহজ করে তুলে’।
Corna, F., A. Camperio-Ciani and C. Capiluppi, 2004. Evidence for maternally inherited factors favouring male homosexuality and promoting female fecundity. Proceedings: Biological Sciences 271: 2217-2221.
How Sex Works: Why We Look, Smell, Taste, Feel, and Act the Way We Do, Sharon Moalem, Harper, First Edition, April 28, 2009
পূর্বোক্ত।
Joan Roughgarden, Evolution’s Rainbow : Diversity, Gender, and Sexuality in Nature and People, University of California Press, May 17, 20041
শুধু বনোবো শিম্পাঞ্জীদের কথাই বা বলি কেন, বাংলাদেশেই আমরা যেভাবে বড় হয়েছি সেখানে ছেলেদের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব হলে একজন আরেকজনকে স্পর্শ করে, হাতে হাত ধরে কিংবা ঘারে হাত দিয়ে ঘোরাঘুরি করে। ঝগড়া-ঝাটি হলে বুকে জড়িয়ে ধরে আস্থা পুনপ্রতিষ্ঠিত করে। মেয়েরাও তাই। এই আচরণ একটু প্যাসিভ তবে এ ধরনের প্রেরণা কিন্তু মনের ভেতর থেকেই আসে। বলা বাহুল্য, এই প্রেরণার মধ্যে কোনো জিন সঞ্চালনজনিত কোনো উদ্দেশ্য নেই, পুরোটাই যোগাযোগ সামাজিকীকরণের প্রকাশ।
যোগাযোগ আর সামাজিকীকরণের কথা মাথায় রেখেই জোয়ান রাফগার্ডেন তাঁর বিবর্তনবিদ্যা সংক্রান্ত ‘ইভ্যলুশনস রেইনবো’ (পূর্বে উল্লিখিত) বইয়ে — যৌনতার নির্বাচন’ (sexual selection)-এর বদলে ‘সামাজিক নির্বাচন’ (social selection) – এর প্রচলন ঘটানোর প্রস্তাব করেছেন। তিনি বলেন, প্রাণিজগতের সাংগঠনিক ভিত্তি দাঁড়িয়ে আছে তাদের খাবার, সঙ্গী প্রভৃতির সঠিক নির্বাচনের উপর। প্রাণিজগতের এই নির্বাচনই কখনো রূপ নেয় সহযোগিতায়, কখনো বা প্রতিযোগিতায়। এবং এটাই শেষ পর্যন্ত সমস্ত পারিবারিক বিবিধ সম্পর্কের ভিত্তি তৈরি করে। কোনো কোনো বিশেষ পরিস্থিতিতে সেই সম্পর্ক একগামিতা বা মনোগামিতে রূপ নিতে পারে (মানুষ ছাড়াও কিছু রাজহাঁস, খেঁকশিয়াল, কিছু পাখির মধ্যে একগামী সম্পর্ক আছে), কখনো বা রূপ নেয় বহু(স্ত্রী)গামিতা বা পলিগামিতা (সিংহ, বহু প্রজাতির বনের মধ্যে এরকম হারেম তৈরি করে ঘোরার প্রবণতা আছে), কখনোবা বহু(পুরুষ)গামিতা বা পলিঅ্যান্ড্রি (কিছু সিংহ, হরিণ এবং প্রাইমেটদের মধ্যে)তে। এমনকি অনেকসময় দলে একাধিক ‘জেন্ডারের’ মধ্যেও সম্পর্ক স্থাপিত হয়। যেমন, ব্লু গ্রীন সানফিশ নামের একপ্রজাতির মাছ আছে যেখানে এক একটি ঝাঁকে দুই পুরুষ মাছের মধ্যে সমধর্মীযৌনতার বন্ধন (same-sex courtship) গড়ে উঠে। এখানে মুখ্য পুরুষ মাছটি (এদের ‘আলফা মেল’বলা হয়) একটি বৃহৎ সাম্রাজ্য গড়ে তুলে আর তারপর অপর পুরুষ মাছটিকে সাথে নিয়ে তাদের যৌথ সাম্রাজ্যে স্ত্রীমাছগুলোকে ডিম পাড়তে আমন্ত্রণ জানায়। অনেকসময় দ্বিতীয় পুরুষ মাছটি স্ত্রী মাছের অনুকরণ করে স্ত্রী মাছের ঝাকের সাথে মিশে যায়- যা অনেকটা আমাদের সমাজে বিদ্যমান ক্রস-জেন্ডার প্রতিনিধিদের মতোই। রাফগার্ডেনের মতে, যৌন-প্রকারণ এবং সমধর্মী যৌনতা এভাবে প্রকৃতিতে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক সম্পর্ক তৈরি করে, যা অনেক সময়ই মোটাদাগে কেবল শুক্রাণুর স্থানান্তর নয়। সামাজিক নির্বাচন হচ্ছে সেই বিবর্তন যা সামাজিক সম্পর্কগুলোকে টিকিয়ে রাখে। ড. রাফগার্ডেনের মতো সামাজিক নির্বাচনের ধারণাকে সমর্থন করেন ব্রুস ব্যাগমিল এবং পল ভ্যাসিসহ অনেক বিজ্ঞানীই।
তবে বেশিরভাগ জীববিজ্ঞানীই এখনই ‘যৌনতার নির্বাচনকে’ সরিয়ে দিয়ে ‘সামাজিক নির্বাচন’ কে গ্রহণ করার পক্ষপাতি নন, কারণ প্রকৃতিজগতের বেশিরভাগ ঘটনাকেই ‘যৌনতার নির্বাচন’ দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবর্তনবাদী জীববিদ জেরি কয়েন রাফগার্ডেনের সমালোচনা করে বলেনঃ
‘She ignores the much larger number of species that do conform to sexual selection theory, focusing entirely on the exceptions. It is as if she denies the generalization that Americans are profligate in their use of petrol by describing my few diehard countrymen who bicycle to work.’
নেচার পত্রিকায় রাফগার্ডেনের বইটির ভূয়সী প্রশংসা করার পরও তাঁর ‘সামাজিক নির্বাচন’ তত্ত্বের সমালোচনা করে নৃতত্ত্ববিদ সারাহ হর্ডি বলেন” – ‘(তাঁর) এ (উদাহরণ) গুলো যৌনতার নির্বাচনকে প্রত্যাখ্যান করার জন্য উপযুক্ত কারণ নয়, বরং এগুলো হতে পারে জীব-বৈচিত্রকে (সামাজিকভাবে) গ্রহণযোগ্য করার অনুপ্রেরণা” । এর কারণ আছে। অনেক বিজ্ঞানীই মনে করেন, যৌনতার নির্বাচনের মাধ্যমেই হোমসেক্সুয়ালিটিকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। সমকামিতার জিন (যদি থেকে থাকে) যোগাযোগ ও সামাজিকতার উন্নয়নের ক্ষেত্রে যে উপযোগী তা বনোবো শিম্পাঞ্জীদের ক্ষেত্রে প্রমাণিত হয়েছে। মানুষের ক্ষেত্রেও এটি সত্য হতেই পারে । আবার এমনো হতে পারে মানুষের মধ্যে ‘ গে জিন’ -এর ভূমিকা পুরুষ এবং স্ত্রীতে ভিন্ন হয়। ইতালির একটি সমীক্ষার (২০০৪) কথা আমরা আগেই জেনেছি – যা থেকে বেরিয়ে এসেছে, যে ব্যাপারটি পুরুষদের মধ্যে সমকামিতা ছড়ায় সেটাই হয়ত মেয়েদের ক্ষেত্রে উর্বরাশক্তি বাড়ায়।
A Review by Jerry Coyne, http://www.powells.com/review/2004_08_15.html
Sarah Blaffer Hrdy, Sexual diversity and the gender agenda, Nature 429, pp 19 – 21, 06 May 2004
The evolution of human homosexual behavior. Current Anthropololgy 39(1): 385-413.
এছাড়া ‘কিন সিলেকশন’-তত্ত্বের সাহায্যেও সমকামিতাকে বিবর্তনীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব বলে অনেক বিজ্ঞানীই মনে করেন। ইন্টারনেটের বহুল-প্রচারিত টক-অরিজিনের” একটি লিঙ্কেও100 বিবর্তনের আধুনিক তত্ত্বের মাধ্যমে সমকামিতার সম্ভাব্য ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। কাজেই যে কারনণই সমাজে হোমোসেক্সুয়ালিটির অস্তিত্ব থাকুক না কেন, এবং সেগুলোকে উপস্থাপনের সঠিক মডেল নিয়ে বিবর্তনবাদীদের মধ্যে যত বিতর্কই থাকুক না কেন (বলা বাহুল্য, বিজ্ঞানে এধরনের বিতর্ক খুবই স্বাভাবিক), এটি এখন মোটামুটি সবাই স্বীকার করে নিয়েছেন যে, সমকামিতার মতো যৌন- প্রবৃত্তিগুলো ‘অস্বাভাবিক’ বা ‘প্রকৃতিবিরুদ্ধ’ নয়, বরং বৈজ্ঞানিক উপাত্ত ও তত্ত্বের সাহায্যেই এই ধরনের যৌন-প্রবৃত্তিগুলোকে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে; জীববিজ্ঞানের আধুনিক গবেষণা কিন্তু সেদিকেই ইঙ্গিত করছে। আজ আমি যখন এ বইটি লিখতে বসেছি তখন সারা পৃথিবী জুড়ে চারশ’রও বেশি গবেষণা প্রতিষ্ঠানে ‘গে জিন’ নিয়ে গবেষণা হচ্ছে। কাজেই সমকামিতার ব্যাপারটি জীববিজ্ঞানীদের জন্য গবেষণার সজীব একটি বিষয়-এ যে কোনো সম্ভাবনার এক অবারিত দুয়ার!
Talk.Origins is a moderated Internet discussion forum concerning the origins of life and evolution. The group includes detailed and reasoned rebuttals to creationist claims. There is an expectation that any claim is to be backed up by actual evidence, preferably in the form of a peer- reviewed publication in a reputable journal.
Index to Creationist Claims Claim CB403: Evolution does not explain homosexuality: Response: http://www.talkorigins.org/indexcc/CB/CB403.html
♦ রূপান্তরকামীতা আর উভকামিতার জগৎ
♦ গবেষণার রুদ্ধ দুয়ার খুললেন যারা
♦ গে মস্তিষ্ক এবং গে জিনের খোঁজে
♦ সমকামিতা কি কোনো জেনেটিক রোগ?
“সমকামিতা” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ