আগের পর্বে আমরা সহিংসতা নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। সহিংসতার একটি নৃতাত্ত্বিক এবং সামাজিক বিশ্লেষণ হাজির করার চেষ্টা ছিল আধুনিক বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের পটভূমিকায়। এই পর্বে আমরা দেখব সহিংসতার বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে গিয়েই কীভাবে একসময় পরার্থিতা, নৈতিকতা এবং মূল্যবোধের উদ্ভব ঘটেছিল মানবসমাজে।
সহিংসতা আর নৈতিকতা দুটি বৈশিষ্ট্যকে সাদা চোখে দুই বিপরীত মেরুর বাসিন্দা মনে হবে। কিন্তু বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন সহিংসতা আর নৈতিকতার মধ্যে একধরনের অলিখিত সম্পর্ক আছে। গবেষক স্যামুয়েল বাওয়েল তার একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখিয়েছেন আদিম শিকারি সংগ্রাহক সমাজে বিদ্যমান নৃশংস সহিংসতা থেকেই শেষ পর্যন্ত সহযোগিতা আর সহমর্মিতার উদ্ভব হয়েছিল[২৭১]। ব্যাপারটা মোটেই অস্বাভাবিক নয়। আমরা জানি আমাদের ২৫ লক্ষ বছরের বিবর্তনের ইতিহাসে শতকরা প্রায় ৯৯ ভাগ সময়ই আমরা শিকারি-সংগ্রাহক হিসেবে কাটিয়েছি। শিকারি সংগ্রাহক সমাজের শতকরা ৯০ ভাগ গোত্রই হানাহানি মারামারিতে লিপ্ত থাকত, আর ১৫ থেকে ৬০ ভাগ ক্ষেত্রে সম্ভাবনা থাকত যুদ্ধ কিংবা খুনোখুনিতে মানুষের মারা যাওয়ার। বাওয়েল তার গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, আদিম শিকারি সংগ্রাহকদের এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে যে গোত্রের সদস্যরা অনেক বেশি নিজেদের মধ্যে সাহায্য সহযোগিতা করেছে, স্বার্থত্যাগ করে সদস্যদের জীবন রক্ষায় কাজ করতে পেরেছে, তারাই প্রাকৃতিক নির্বাচনের ছাকুনিতে তারাই টিকতে পেরেছে অন্যদের চেয়ে বেশি। অর্থাৎ, সোজা বাংলায় বললে, মূঢ় সহিংসতা থেকেই একসময় জন্ম হয়েছে মূঢ় পরার্থিতার, নীচের কার্টুনটিতে তার একটি আলামত তুলে ধরা হয়েছে–
কিন্তু কীভাবে স্বার্থপরতা কিংবা সহিংসতার মতো বদখত ব্যাপার-স্যাপার থেকে নৈতিকতার মতো একটি ‘আপাত বিপরীতমুখী’ গুণাবলির জন্ম হতে পারে? আসুন ব্যাপারটি একটু বৈজ্ঞানিকভাবে বোঝার চেষ্টা করি। তবে এ ব্যাপারটি বুঝতে আগে হলে আমাদের চোখ মেলে প্রকৃতির দিকে তাকাতে হবে, তাকাতে হবে প্রাণিজগতের দিকেও। আমাদের জানতে হবে নৈতিকতার ব্যাপারটি কি কেবল মানবসমাজেরই একচেটিয়া নাকি অপরাপর প্রাণিজগতেও এর হদিস মেলে?
প্রাণিজগতে পরার্থিতা এবং নৈতিকতা
১৯৯৬ সালের আগস্ট মাসের ১৬ তারিখ। শিকাগোর ব্রুকফিল্ড চিড়িয়াখানা। বিন্তি জুয়া (Binti Jua) নামে এক মেয়ে গরিলা খাঁচার ভিতর পায়চারি করছিল। হঠাৎ, খাঁচার বাইরে দর্শকদের মধ্য থেকে একটি তিন বছরের শিশু দেয়ালের উপর বসে গরিলাকে দেখতে গিয়ে খাঁচার ভিতরে প্রায় বিশ ফুট নীচে কংক্রিটের মেঝেতে আছরে পড়ে। পড়েই জ্ঞান হারায় ছেলেটি। বিন্তি পায়চারি বাদ দিয়ে ছেলেটির দিকে এগিয়ে যায়। ১৬০ পাউন্ডের দীর্ঘদেহী গরিলাটিকে ছেলেটির দিকে এগিয়ে যেতে দেখে দর্শকদের মধ্যে মুহূর্তেই চিৎকার চ্যাঁচামেচি শুরু হয়ে যায়। বিন্তি কাছে গিয়ে অনেক মনোযোগ দিয়ে ছেলেটিকে দেখতে লাগল। তারপর এক সময় দুই হাতে শিশুটিকে বগলদাবা করে ফেলল। দর্শকদের মধ্যে তখন আতংক চরম মাত্রায় পৌঁছে গিয়েছে। অনেকেই ভাবছিলেন, এবারে নিশ্চয়ই বাচ্চাটাকে ছিঁড়ে খুড়ে খেয়ে ফেলবে ঐ পাষণ্ড গরিলা। কিন্তু তারপরে যা ঘটল, তার জন্য কেউই প্রস্তুত ছিল না। এ কাহিনি কেবল আমরা রূপকথাতে কিংবা কল্পকাহিনিতেই শুনেছি। বিন্তি শিশুটিকে নিয়ে বিশফুট দেয়াল পার হয়ে খাঁচার এক প্রান্তের একটি প্রবেশ দ্বারে এসে দাঁড়িয়ে থাকলো যাতে নিরাপত্তাকর্মীরা তার কাছ থেকে এসে নিয়ে যেতে পারে। নিরাপত্তাকর্মীরা বিন্তির কাছ থেকে বাচ্চাটি নিয়েই সোজা হাসপাতালের দিকে ছুটলেন। শিশুটি পরিপূর্ণভাবে সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ত্যাগ করল দিন কয়েকের মধ্যেই। এভাবেই ব্রুকফিল্ড চিরিয়াখানার বিন্তি নামের গরিলাটি বাঁচিয়ে দিয়েছিল একটি ছোট্ট শিশুর জীবন।
এ ধরনের পরার্থিতামূলক কাজ যে কেবল বিন্তিই করেছে তা কিন্তু নয়। ১৯৮৬ সালে জার্সি চিড়িয়াখানায় জাম্বো নামে আরেকটি গরিলাও ঠিক এমনিভাবে আরেকটি মানব শিশুর জীবন বাঁচিয়েছিল। সেখানেও শিশুটি খাঁচার ভিতরে পড়ে গিয়েছিল, আর জাম্বো বিন্তির মতো শিশুটিকে কোলে করে নিরাপত্তাকর্মীদের হাতে তুলে না দিলেও বহুক্ষণ ধরে শিশুটির কাছে দাঁড়িয়ে তাকে রক্ষা করেছিল, যাতে অন্য গরিলারা আক্রমণ করতে না পারে। এতদিন মানবিকতা, সহিষ্ণুতা, পরার্থিতা, সহযোগিতা, নৈতিকতা প্রভৃতি শব্দগুলোকে মানুষের একচেটিয়া সম্পত্তি হিসেবে চিহ্নিত করার যে রেওয়াজ ছিল, বিন্তি কিংবা জাম্বোর প্রয়াস সে সব স্বতঃসিদ্ধ ধারণার প্রতি শক্তিশালী চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিল যেন। বিজ্ঞানীরা বলেন, শুধু গরিলা নয় শিম্পাঞ্জি, ওরাংওটাং, কিংবা বনোবোদের মধ্যে এ ধরনের পরার্থিতার সন্ধান খোঁজ করলেই পাওয়া যায়, তারা একে বলেন সহমর্মিতা (empathy)। সহমর্মিতা মানুষ শুধু নয়, অন্যান্য অনেক প্রাণীর মধ্যেও দৃশ্যমান (animal empathy)। আর সহমর্মিতার সাথে নৈতিকতার একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। বিজ্ঞানী ফ্রান্স ডি ওয়াল তার ‘আওয়ার ইনার এপ’ গ্রন্থে বিন্তির ঘটনাটি বিশ্লেষণ করে অভিমত দিয়েছেন যে, নৈতিকতার ব্যাপারগুলোকে কেবল মানবসমাজের সাংস্কৃতিক অংগ বলে ভেবে নেওয়া হতো তা মোটেও ঠিক নয়; আসলে মানবসমাজে নৈতিকতার উদ্ভবের উৎস লুকিয়ে আছে আমাদের বিবর্তনীয় যাত্রাপথে[২৭২]। ছয় মিলিয়ন বছর আগে আমরা আমাদের শিম্পাঞ্জি জাতীয় পূর্বপুরুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছিলাম। বিজ্ঞানী ফ্রান্স ডি ওয়াল তার সাম্প্রতিক ‘প্রাইমেটস এন্ড ফিলোসফারস[২৭৩] গ্রন্থে বেশ কিছু আকর্ষণীয়। উদাহরণ হাজির করে দেখিয়েছেন যে শিম্পাঞ্জি এবং বনমানুষেরাও অনেকটা মানুষের মতো করেই ব্যথা-বেদনায় আক্রান্ত হয়, এমনকি গোত্রে যুদ্ধে পরাজিত হলে পরাজিত শিম্পাঞ্জিকে অন্য একটি শিম্পাঞ্জি সান্ত্বনা জানানোর উদাহরণও তিনি বইয়ে লিপিবদ্ধ করেছেন। কাজেই শিম্পাঞ্জি, গরিলা, বনোবো সহ আমাদের খুব কাছাকাছি প্রজাতিগুলোর আবেগানুভূতি বা সহমর্মিতা বিশ্লেষণের মাধ্যমেই মানবসমাজে নৈতিকতার প্রকৃত উৎস বৈজ্ঞানিকভাবে জানা সম্ভব বলে বিজ্ঞানীরা আজ মনে করেন।
নৈতিকতার ব্যাপারটি মানুষ, গরিলা কিংবা কিংবা অন্য প্রাইমেটদেরই আছে তা কিন্তু নয়। ছোট স্কেলে তথাকথিত অনেক ‘ইতর প্রাণীর মধ্যেও কিন্তু এটি দেখা যায়। ভ্যাম্পায়ার বাদুড়েরা নিজেদের মধ্যে খাদ্য ভাগাভাগি করে, বানর এবং গরিলারা তাদের দলের কোনো সদস্য মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকলে তাকে সহায়তা করার জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা করে, এমনকি ‘দশে মিলে কাজ করে তার জন্য খাবার পর্যন্ত নিয়ে আসে। ডলফিনেরা অসুস্থ অপর সহযাত্রীকে ধাক্কা দিয়ে সৈকতের দিকে নিয়ে যায়, যার ফলে অসুস্থ ডলফিনটির পর্যাপ্ত আলো বাতাস পেতে সুবিধা হয়, তিমি মাছেরা তাদের দলের অপর কোনো আহত তিমি মাছকে দ্রুত সারিয়ে তুলতে চেষ্টা করে। হাতিরা তাদের পরিবারের অসুস্থ বা আহত সদস্যকে বাঁচানোর জন্য সোর্চ ত্যাগ স্বীকার করেই[২৭৪]। এ ধরনের দুষ্টান্ত বিরল নয়। অনেক সময় পরার্থিতার ব্যাপারটি কেবল নিজেদের প্রজাতিতেই সীমাবদ্ধ থাকে না, বহু ক্ষেত্রেই অতিক্রম করে প্রজাতির আঙ্গিনা। যেমন, ডলফিনেরা হাঙ্গরের আক্রমণ থেকে বিপন্ন মানুষজনকে বাঁচিয়েছে এমন বেশ কিছু নথিবদ্ধ ঘটনার উল্লেখ আছে বিজ্ঞানীদের গবেষণায়[২৭৫,২৭৬,২৭৭]।
স্বার্থপরতা থেকে সহযোগিতা
প্রকৃতিতে প্রতিযোগিতা আছে, আছে নিষ্ঠুরতা-এ কথা বোধ হয় আমরা সবাই জানি। কিন্তু কতটুকু নিষ্ঠুরতা? প্রকৃতি যে আসলে ঠিক কী পরিমাণ নিষ্ঠুর তা বোধ হয় অনেক সময় আমাদের চিন্তাতেও আসে না। হোরাস সম্প্রতি প্রাণিজগতে নিষ্ঠুরতার বেশকিছু নমুনা মুক্তমনা ব্লগে হাজির করেছেন[২৭৮]। সেই লেখাটি থেকেই কিছু উদাহরণ হাজির করা যাক। মায়ের গর্ভে থাকা অবস্থাতেই শিশু হাঙরেরা একজন আরেকজনকে আক্রমণ করে হত্যা করে এবং তাদের খেয়ে ফেলে যা তাদের পুষ্টি জোগায়। শুরুতে ২০টির মতো শিশু হাঙর মায়ের গর্ভে বড় হতে শুরু করলেও ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগে একটি মাত্র স্যান্ড শার্কের শিশু বেঁচে থাকে। মার কাছে রাখা কোলের শিশু অরক্ষিত হয়ে পড়লে পুরুষ সিফাকা লিমারেরা শিশু লিমারটিকে মায়ের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে পেট দুভাগ করে মাটিতে ফেলে দেয়।
তারপর ধরুন পাখিদের মধ্যে বিদ্যমান নিষ্ঠুরতার উদাহরণগুলো। কোকিলের নিষ্ঠুরতার উদাহরণ তো আমাদের সবারই জানা। একে তো কোকিল প্রতারণা করে অন্য পাখির রাসায় ডিম পাড়ে। শুধু তাতেই সীমাবদ্ধ থাকলে নাহয় কথাছিল। কোকিল শিশু ডিম থেকে ফুটে বের হওয়ার সাথে সাথেই যে কাজটি করে তা হলো অন্য ডিমগুলোকে বাসা থেকে ফেলে দেয়া, এমনকি আশে পাশের ডিম ফুটে সদ্য জন্ম নেওয়া বাচ্চাকেও। শিশু কোকিলের পিঠে বিশেষ ধরনের একটি খাঁজের মতো থাকে যেটা দিয়ে সে ডিমগুলোকে পাখির বাসার বাইরে ফেলে দিতে সাহায্য করে। বলা বাহুল্য, কোকিল শিশুরা এই কাজটি সহজাত প্রবৃত্তির বশেই করে থাকে। আবার, ব্লু ফুটেড বুবিস নামক পাখিরা খাদ্যস্বল্পতার সময় (যখন বাচ্চাদের ওজন স্বাভাবিকের চাইতে ২০ ভাগের বেশি কমে যায়), বড় বাচ্চাটি তখন অন্য সহোদরদের ঠোকর দিয়ে মেরে ফেলে অথবা বাসা থেকে বের করে দেয়। ফলশ্রুতিতে ছোট বাচ্চাটি খাদ্যের অভাবে কিংবা অন্য প্রাণীদের আক্রমণের শিকার হয়ে মারা যায়।
কীটপতঙ্গের ক্ষেত্রেও নিষ্ঠুরতা প্রবল। মৌমাছিদের কথাই ধরা যাক। রানি মৌমাছি যখন লার্ভা থেকে পিউপাতে পরিণত হয়, তখন প্রথম মৌমাছিটা সাথে সাথেই সে অন্যান্য সকল প্রতিদ্বন্দী সহোদরাদের হুল ফুটিয়ে মেরে ফেলে। তার বোনদের একজনও তার হাত থেকে নিস্তার পায় না। তবে প্রকৃতির সম্ভবত সবচেয়ে চরম নিষ্ঠুরতার উদাহরণ পেয়েছিলাম যখন আমাদের মুক্তমনা সদস্য পৃথিবী একবার ইমেইল করে আমাকে ইকনিউমেন (Ichneumon) প্রজাতির একধরনের প্যারাসিটোয়েড বোলতার কথা জানিয়েছিলেন। এরা একটি শুয়োপোকাকে হুল ফুটিয়ে প্যারালাইজড করে ফেলে এবং সেটার দেহে ডিম পাড়ে। অর্থাৎ, শিকারকে সরাসরি হত্যা না করে দৈহিকভাবে অবশ করে দিয়ে সেই শিকারের দেহের ভেতরে ডিম পাড়ে। এই ডিম ফুটে যে শূককীট (larva) বের হয়, তা শিকারের দেহের ভেতরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ খেয়ে ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে। স্ত্রী বোলতাগুলো তার শিকারের প্রত্যেকটি স্নায়ুগ্রন্থি সতর্কতার সাথে নষ্ট করে দেয় যাতে তাদের শিকার পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
প্রকৃতির নিষ্ঠুরতার এই নির্বিচারী উন্মাদনা দেখে সময় সময় বিচলিত হয়েছেন আস্তিক, নাস্তিক, অজ্ঞেয়বাদী, প্রকৃতিবাদী, মানবতাবাদী, সংশয়বাদী– সকলেই। বিজ্ঞানী রিচার্ড ডকিন্স এই ইকনিউমেন প্রজাতির বোলতার উদাহরণটিকে তার গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ বইয়ে উল্লেখ করেছেন। তিনি রবিন উইলিয়ামসের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, এই প্যারাসিটোয়েড বোলতাগুলোর নিষ্ঠুরতা দেখলেই বোঝা যায় যে পরম করুণাময় ঈশ্বরের মতো কোনো পরিকল্পনাকারী দ্বারা এই মহাবিশ্ব তৈরি হলে তিনি একজন স্যাডিস্টিক বাস্টার্ড ছাড়া আর কিছু হবেন না[২৭৯]।
প্রকৃতির এই ঢালাও নিষ্ঠুরতা দেখে এক সময় বিচলিত হয়েছিলেন ডারউইনও। তিনি প্যারাসিটোয়েড বোলতাগুলোর বীভৎসতা দেখে পরম করুণাময় ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়েই সন্দিহান হয়ে পড়েন; তিনি মন্তব্য করতে বাধ্য হয়েছিলেন[২৮০]–
আমি ভাবতেই পারি না, একজন পরম করুণাময় এবং সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী কোনো ঈশ্বর এইভাবে ডিজাইন করে তার সৃষ্টি তৈরি করেছেন যে, ইকনিউমেনগুলোর খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার জন্য একটি জীবন্ত কিন্তু প্যারালাইজড শুয়োপোকার প্রয়োজন হয়।
ঈশ্বরের ‘ভুল ডিজাইনের’ কথা না হয় বাদ থাকুক। আমরা বরং বৈজ্ঞানিকভাবেই খুঁজে দেখার চেষ্টা করি কেন প্রকৃতিতে এই ঢালাও নিষ্ঠুরতা এমনিভাবে টিকে আছে! বলা বাহুল্য, এই প্রশ্নের একটি সর্বজনগ্রাহ্য বিজ্ঞানভিত্তিক উত্তর খুঁজে পেয়েছিলেন চার্লস ডারউইনই, ১৮৫৯ সালে প্রস্তাবিত বিবর্তন তত্ত্বের মাধ্যমে। ডারউইন বুঝেছিলেন যে, প্রকৃতিতে প্রতিটি জীবের বংশবৃদ্ধির ক্ষমতা যত, সে পরিমাণ খাদ্যের যোগান প্রকৃতিতে কখনোই থাকে না। শুধু খাদ্য নয়, আশ্রয়, নাসস্থান এমনকি প্রজনন সঙ্গীরও ঘাটতি থাকে। এ সব নিয়ে প্রতিনিয়ত অন্তঃপ্রজাতি (intra-species) এবং আন্তঃপ্রজাতি (inter-species) প্রতিযোগিতা চলে। জীবজগতে সবাইকেই বেঁচে থাকার, অধঃবংশ রেখে যাওয়ার অর্থাৎ এক কথায় টিকে থাকার জন্য সংগ্রাম চলে। তিনি এর নাম দেন জীবনের জন্য সংগ্রাম বা জীবন-সংগ্রাম (struggle of existence)। ডারউইন বুঝতে পেরেছিলেন– জীবন সংগ্রামের কারণেই প্রকৃতির জীবজগৎকে কিছু ক্ষেত্রে চরম নিষ্ঠুর হতে হয়েছে।
এখন ডারউইন প্রস্তাবিত বিবর্তনীয় পটভুমিকায় প্যারাসিটোয়েড বোলতার নিষ্ঠুরতার ব্যাপারটা আরেকবার চিন্তা করা যাক। উত্তর খুঁজে পাওয়া খুব একটা কঠিন হবে না। শুয়োপোকার জীবন্ত দেহ নিঃসন্দেহে শূককীটের জন্য খুব ভালো আশ্রয় এবং নিরাপদ খাদ্যের যোগান। কাজেই বিবর্তনের দীর্ঘ পথপরিক্রমায় এমন কোনো জীব খুঁজে পেলে নিশ্চয় আমরা অবাক হব না যে কি না খাদ্যের চালান এবং আশ্রয় বজায় রাখার জন্য শুয়োপোকাকে নিস্তেজ করে তার দেহকে ব্যবহার করার সুযোগ নিতে চাইবে। প্যারাসিটোয়েড বোলতাগুলো সেই সুযোগেরই সফল সদ্ব্যবহারকারী মাত্র।
ডারউইইন যখন বিবর্তন তত্ত্ব প্রস্তাব করেছিলেন তখন তিনি জিনের ব্যাপার স্যাপারগুলো মোটেই জানতেন না। জানবেনই বা কী করে? জেনেটিক্সের তখন জন্মই হয়নি। এমনকি মেন্ডেলের সমসাময়িক হওয়া সত্ত্বেও মেন্ডেলের জিন নিয়ে প্রাথমিক কাজগুলো তার দৃষ্টির অগোচরে থেকে গিয়েছিল। শুধু ডারউইনই নন, সেসময়কার সমসাময়িক কোনো বিজ্ঞানীই মেন্ডেলের কাজের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারেন নি, তার কাজ মূলত হারিয়েই গিয়েছিল বিস্মৃতির অন্তরালে। মেন্ডেলের মৃত্যুর ১৬ বছর পরে সেগুলো পুনরাবিস্কৃত হয় ইউগো দ্য ফ্রিস, কার্ল করেন্স এবং এরিখ ফন শেরমাখ–সেসেনাগ প্রমুখ বিজ্ঞানীদের দ্বারা। তারপর থেকে বিশেষত আধুনিক বংশগতিবিদ্যার উন্মেষের পর থেকে আমরা জিন সম্বন্ধে সম্যক ধারণা অর্জন করেছি। চল্লিশের দশকে জনপুঞ্জ বংশগতিবিদ্যার অভ্যুদয়ের পর প্রাকৃতিক নির্বাচনের সাথে বংশগতির সম্মিলন ঘটে। জনপুঞ্জে জিন কীভাবে বংশাণুসৃত হয়, তা ব্যাখ্যা করেছিলেন গণিতবিদ জি এইচ হার্ডি এবং জার্মান চিকিৎসক ভিলহেল্ম ওয়েইনবার্গ। পরে পরিসংখ্যানবিদ ইউল দেখিয়েছিলেন যে ডারউইনের অবিচ্ছিন্ন পরিবৃত্তি যে মেন্ডেলবাদের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ, পরিসংখ্যান দিয়ে তা প্রমাণ করা যায়। জীববিদ নিলসনের গবেষণায় ইউলের প্রকল্পের প্রমাণ পাওয়া যায়। তবে সর্বাধিক ইনফ্লুয়েনশিয়াল ছিল ১৯৩৭ সালে ডবজাবস্কির ‘জেনেটিক্স এন্ড অরিজিন অব স্পিশিজ’ নামক বইটির প্রকাশ। এই বইয়ের মাধ্যমেই আসলে আধুনিক বংশগতিবিদ্যার সাথে ডারউইনবাদের সমন্বয় ঘটে। রঙ্গমঞ্চে আসে বিবর্তনের সংশ্লেষণী তত্ত্ব তথা আধুনিক বিবর্তনের তত্ত্ব, যা এখনও বিবর্তনের স্বীকৃত তত্ত্ব হিসেবে জীববিজ্ঞানের পরিমণ্ডলে রাজত্ব করে চলেছে।
সেই আধুনিক বিবর্তন তত্ত্ব আমাদের খুব ভালোভাবে দেখিয়েছে জিনগত স্তরে এক ধরনের স্বার্থপরতাকাজ করে[২৮১]। আমরা সবাই অবগত যে, মানুষসহ যে কোনো প্রাণীর মধ্যেই সন্তানদের প্রতি অপত্য স্নেহ প্রদর্শন কিংবা সন্তানদের রক্ষাকরার জন্য মাবাবারা সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে। অর্থাৎ, নিজের দেহকে বিনষ্ট করে হলেও পরবর্তী জিনকে রক্ষা করে চলতে সচেষ্ট হয় জীবজগতের প্রায় সকল সদস্যরাই। কারণ, ‘পরবর্তী জিন’ রক্ষা না পেলে নিজের দেহ সুন্দর, কিংবা সুরক্ষিত হোক না কেন, বিবর্তনের দিক থেকে কোনো অভিযোজিত মূল্য নেই। সেজন্যই নেকড়ে যখন আক্রমণ করে, গোত্রের ছোট বাচ্চাদের রক্ষা করার জন্য বুনো মোষেরা বাচ্চাদের চারিদিকে ঘিরে শিং উচিয়ে নেকড়ের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে, নিজেদের জীবনকে বিপন্ন করে হলেও। এভাবেই জীব নিজেকে বিবর্তনের পথ ধরে এমনভাবে নিয়ে চলে যাতে তার জিন-বিস্তারে কিংবা ভবিষ্যত প্রজন্মকে রক্ষায় উদ্যোগী হয়, টিকে থাকার প্রয়োজনেই। আসলে যার সাথে সে বেশি জিন বিনিময় করবে, যত ঘনিষ্ঠতা বাড়াবে, তত বাড়বে নিজের জিন বিস্তারের সম্ভাবনা, সেজন্যই, জীব নির্বিশেষে সন্তানের প্রতি, পরিবারের প্রতি, নিকটাত্মীয়ের প্রতি এবং গোত্রের প্রতি একধরনের জৈবিক টান উপলব্ধি করে, এবং তাদেরকে রক্ষার চেষ্টা করে। কাজেই জিনের উদ্দেশ্য যদি কেউ বলেন কেবল স্বার্থপরভাবে প্রতিলিপি করা আর ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করা তাহলে সেটা অত্যুক্তি হবে না মোটেই। সেজন্যই স্বনামখ্যাত বিজ্ঞানী রিচার্ড ডকিন্স তার ‘সেলফিশ জিন’ গ্রন্থে অনুপম কাব্যিক ভঙ্গিমায় বলেন[২৮২]–
আমরা সবাই একেকটি টিকে থাকার যন্ত্র (survival machine)- অন্ধভাবে প্রোগ্রাম করা একটি নিয়ন্ত্রিত যান্ত্রিক বাহন মাত্র যার উদ্দেশ্য কেবল স্বার্থপরভাবে এক ধরনের জৈবঅণুকে সংরক্ষণ করা। … তারা আমার ভেতরে আছে, তারা রয়েছে আপনার ভেতরেও; তারাই আমাদের সৃষ্টি করেছে, আমাদের দেহ আর আমাদের মন; আর। তাদের সংরক্ষণশীলতাই আমাদের অস্তিত্বের চূড়ান্ত মৌলিকত্ব। ওই অনুলিপিকারকেরা এক দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছে। এখন তাদেরকে জিন বলে ডাকা হয়, আর আমরা হলাম তাদের উত্তরজীবীতার যন্ত্র।
কাজেই জৈব যন্ত্র যে স্বার্থপর তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। জিনগত স্তরে স্বার্থপরতা থাকার কারণেই অনেকটা ‘টিকে থাকার যন্ত্র’ হিসেবে কাজ করে যায়। কিন্তু বিস্ময়কর যে ব্যাপারটি গবেষণায় বেরিয়ে এল তা হলো–জিনের এই স্বার্থপরতা থেকেই পরার্থিতার মতো এক ধরনের বিপরীতমুখি অভিব্যক্তির উদ্ভব ঘটতে পারে। ‘দ্য অ্যান্ট এন্ড দ্য পিকক’ গ্রন্থের লেখিকা জীববিজ্ঞানী হেলেনা নিন তার ‘দ্য বেটেল অব সেক্সেস রিভিসিটেড’ নামের প্রবন্ধে বলেন?[২৮৩]–
Among genes all is selfishness, every gene out for its own replication. But from conflict can come forth harmony; the very selfishness of genes can give rise to cooperation. For among the potential resources, that genes can exploit is the potential for cooperation with other genes. And if it pays to cooperate, natural selection will favor genes that do so.
স্বার্থপর প্রতিযোগিতার মাধ্যমে পরার্থিতার উদ্ভবের ব্যাপারটি শিক্ষায়তনে গবেষণার মাধ্যমে প্রথমবারের মতো তুলে ধরেন বিজ্ঞানী জর্জ উইলিয়ামস এবং উইলিয়াম হ্যামিলটন[২৮৪]। পরবর্তীতে ধারণাটিকে জনপ্রিয় করে তোলেন রিচার্ড ডকিন্স তার উপরে উল্লিখিত ‘সেলফিশ জিন’ বইয়ের মাধ্যমে[২৮৫]। তারা দেখালেন, স্বার্থপর জিন যেমন আত্মত্যাগ কিংবা পরার্থিতা তৈরি করে, ঠিক তেমনি আবার প্রতিযোগিতামূলক জীবন সংগ্রাম থেকেই জীবজগতে তৈরি হয় বিভিন্ন ধরনের পারস্পরিক সহযোগিতা, মিথোজীবীতা কিংবা সহ-বিবর্তন। টিকে থাকার প্রয়োজনেই কিন্তু এগুলো ঘটে।
এমনি একটি চমৎকার উদাহরণ হচ্ছে ‘কালারফুল ক্লাউন’ মাছের সাথে এনিমোনের সহবিবর্তন। এ ধরনের মাছ তার গাঢ় রঙের কারণে সহজেই অন্যের শিকারে পরিণত হতে পারে, আত্মরক্ষার জন্য গাঢ় রঙের সামুদ্রিক এনিমোনের শুড়ের ভিতর প্রায়শই আত্মগোপন করে। এভাবে ক্লাউন মাছগুলো শিকারি মাছের দৃষ্টি এড়িয়ে যেতে সমর্থ হয়। আবার অন্যদিকে এনিমোনগুলোও ক্লাউন মাছের কারণে উপকৃত হয়। কারণ ক্লাউন মাছগুলো এনিমোনভোগী ছোট মাছকে তাড়িয়ে দেয়। এনিমোন এবং ক্লাউন মাছের সহবিবর্তনের ফলে উপকৃত হচ্ছে দুই প্রজাতিই। নিঃস্বার্থ ভাবে একে অপরের সেবা করার জন্য তাদের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে উঠেনি, বরং বন্ধুর প্রকৃতিতে আত্মরক্ষা আর টিকে থাকার প্রয়োজনেই তাদের মধ্যে গড়ে উঠেছে তাদের মধ্যে সহযোগিতার সম্পর্ক। এ ধরনের অনেক সম্পর্কই প্রকৃতিতে আছে। হামিং বার্ডের সাথে অর্নিথোপথিলাস ফুলের সহবিবর্তন, এরাকোয়িড অর্কিডের সাথে আফ্রিকান মথের সহবিবর্তন এগুলোর প্রত্যক্ষ উদাহরণ। অত্যন্ত স্বার্থপর কারণেই তাদের মধ্যে সহমর্মিতার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে; আর সেই নিতান্ত স্বার্থপর কারণটি হলো সফলভাবে টিকে থাকার ইচ্ছে। স্বার্থপরতার কারণেই কীভাবে সহযোগিতার গুণাবলি প্রকৃতিতে বেড়ে উঠে সেটি বিশ্লেষণ করতে গিয়েই বিজ্ঞান লেখক ম্যাট রিডলী তার ‘নৈতিকতার উৎস’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন—উই কোঅপারেট ইন অর্ডার তু কম্পিট বেটার। ব্যাপারটা খুব নির্জলাভাবে সত্য।
আমরা ছোটবেলায় কামিনী রায়ের অনেক পরার্থিতামূলক কবিতা পড়েছি–
পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি, এ জীবন মন সকলই দাও
তার মতো সুখ কোথাও কি আছে? আপনার কথা ভুলিয়া যাও।…
কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ‘আপনার কথা ভুলিয়া পরের কারণে স্বার্থ বিলিয়ে দেয়ার মতো করে প্রকৃতিতে জীবজগৎ কাজ করে না। ডারউইন অনেক আগেই ধারণা করেছিলেন যে, তার বিবর্তন তত্ত্ব সত্যি হলে, প্রকৃতিতে এমন কোনো জীব পাওয়া যাবে না যে শুধু নিঃস্বার্থভাবে অন্য প্রজাতির সেবা করার জন্য বেঁচে থাকে, প্রাকৃতিক নির্বাচনের নিয়মেই সে বিলুপ্ত হয়ে যেতে বাধ্য। ডারউইন তার “অরিজিন অব স্পিশিজ’ বইতে তার পাঠকদেরকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন এ ধরনের একটা প্রজাতি খুঁজে বের করার জন্য, এবং স্বাভাবিক কারণেই আজ পর্যন্ত কেউ সে চ্যালেঞ্জের উত্তর দিতে পারেনি। এই সহজ ব্যাপারটা আমরা প্রায়ই ভুলে যাই। আমাদের দেহের ভিতরেই অসংখ্য উপকারী ব্যকটেরিয়া বাস করে, এগুলো আমাদের দেহে থাকার ফলে আমরা যেমন তাদের দিয়ে উপকৃত হচ্ছি, তেমনি আবার ব্যাকটেরিয়াগুলোও বেঁচে থাকার নানা রসদ খুঁজে পাচ্ছে আমাদের দেহে। এমন কিন্তু নয় যে, আমরা ব্যাকটেরিয়াগুলোকে সেবা করার পশরা সাজিয়ে বসে আছি তাদের উপকার করার জন্য। কিংবা উল্টোভাবে ব্যাক্টেরিয়াগুলো সাহায্যের দোকান খুলে বসে আছে মানবসমাজকে নিঃস্বার্থ সেবা দেয়ার লক্ষ্যে। বরং দুইপক্ষের স্বার্থসিদ্ধি হচ্ছে বলেই এই সহযোগিতার সম্পর্কগুলো টিকে রয়েছে। অর্থাৎ, পরার্থিতা কিংবা সহযোগিতা যাই বলি না কেন এর মূলে কিন্তু রয়ে যাচ্ছে সেই মোটা দাগে লোভাতুর স্বার্থপরতাই। বিজ্ঞানী জর্জ উইলিয়ামস সেজন্য খুব চাঁছাছোলাভাবেই বলেছেন[২৮৬]–
যখন একজন জীববিজ্ঞানী দেখেন কোনো প্রাণী অন্য কারো উপকার করে চলেছে, তিনি সহজাত নিয়মেই ধরে নেন যে, প্রাণীটিকে উপকারের নামে আসলে তাকে
কাজে লাগানো হচ্ছে, কিংবা এর পেছনে রয়েছে কোনো প্রচ্ছন্ন স্বার্থপরতা। একই ব্যাপার চোখে পড়েছিল বিজ্ঞানী হ্যামিলটানেরও। তিনি পিঁপড়ে, মৌমাছি সহ বিভিন্ন সামাজিক কীট-পতঙ্গের কাজ এবং আচারব্যবহার বহুদিন ধরে পর্যবেক্ষণ করে সিদ্ধান্তে আসেন যে, তাদের পরার্থিতামূলক কাজগুলো আসলে ঢালাওভাবে পরার্থিতামূলক নয়, বরং তাদের বিভিন্ন কাজের পেছনে আসল অভিসন্ধি হচ্ছে খুব স্বার্থপরভাবে জিনের রক্ষা আর বহুপ্রতিলিপি রেখে যাওয়ার পথ সুগম করা। পিঁপড়েরা একসাথে খাদ্যের অন্বেষণ করে, সঙ্ঘবদ্ধভাবে বিরাট কলোনি গড়ে তুলে। মৌমাছিরাও তাই। তাদের মধ্যে আছে এমনকি বন্ধ্যা সৈন্যের (sterile worker) উপস্থিতিও, যারা পুরো জীবন বয্য করে দেয় রানির সেবা যত্নে, নয়তো গোত্রকে রক্ষা করে শত্রুর আক্রমণ থেকে। জৈবিকভাবে চিন্তা করলে এরা তো পরার্থিতার চূড়ান্ত! কারণ নপুংসক এই বন্ধ্যা সৈন্যদের কখনো কোনো সন্তান হয় না। তারা কেবল খোঁজা প্রহরীর মতো হেরেম পাহারা দেয়! সাদা চোখে দেখলে জৈবিকভাবে এদের নিজের জিন রক্ষার তাগিদ একেবারে শূন্য। তাহলে? কলুর বলদের মতো বেগার খাটা এই সৈন্যরা বিদ্রোহ করছে না কেন?
এই ধাঁধাই সমাধান করলেন ব্রিটিশ জীববিজ্ঞানী উইলিয়াম ডোনাল্ড হ্যামিলটন। তিনি তার গবেষণায় দেখালেন যে মৌমাছি কিংবা পিঁপড়েদের সমাজ খুব জটিল। সেখানে রানি মৌমাছির সাথে কর্মী মৌমাছির (যার অধিকাংশই নিজের সন্তান) সম্পর্কের এক জটিল টানাপোড়েন চলে প্রতিনিয়ত। দেখা গেছে, রানি মৌমাছি দিনে প্রায় আড়াই হাজার ডিম পাড়ে। ফলে কয়েকদিনের মধ্যেই কলোনিতে ডিমের সংখ্যা তিন লক্ষ ছাড়িয়ে যায়। সেই ডিমের কিছু অংশকে রানি নিষেক ঘটায় পুরুষ মৌমাছির শুক্রাণু দিয়ে, আবার বহুসংখ্যক ডিম নিষেক ছাড়াই পড়ে থাকে। নিষেক ঘটানো ডিমগুলো থেকে জন্ম হয় কেবল নারী মৌমাছির। এরা ডিপ্লয়েড। এদের ক্রোমজোম থাকে যুগল বন্ধন। এই যুগল সেটটির অর্ধেক আসে বাবার কাছ থেকে আর অর্ধেক মায়ের। কিন্তু অন্যদিকে পুরুষ মৌমাছিরা হ্যাপ্লয়েড, তাদের জন্ম হয় অনিষিক্ত ডিম থেকে জন্ম। এদের কেবল একটিই ক্রোমোজম থাকে, যা সরাসরি তাদের মায়ের কাছ থেকে পাওয়া। ফলে কর্মী নারী মৌমাছিরা তাদের বোনদের সাথে এমনকি শতকরা ৭৫ ভাগ সদৃশ জিনের অংশ বিনিময় করে, যেখানে তার মার সাথে কিংবা তার নিজের সন্তানের সাথে জিনের সাদৃশ্য তাকে শতকরা ৫০ ভাগ, এবং তার ভাইদের সাথে মাত্র ২৫ ভাগ। অর্থাৎ, একটি কর্মী মৌমাছি যদি নিজের বংশ রক্ষার চেয়ে যদি তার সহোদর বোনদের প্রজননে পরোক্ষভাবে সুবিধা করে দেয়, কিংবা তার রানি মৌমাছির সন্তানদের রক্ষা করায় সচেষ্ট হয়, তবেই তার অধিকতর জেনেটিক সাফল্য থাকবে। হিসেব কষলে কিন্তু তাই পাওয়া যাচ্ছে। পিঁপড়া, মৌমাছি কিংবা উইপোকা যাদের এ ধরনের জটিল সামাজিক সম্পর্ক রয়েছে, তাদের সবার মধ্যেই এ ধরনের জটিল সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কিন্তু এই সহযোগিতা পরের কারণে স্বার্থ দিয়ে বলি’ টাইপের সহযোগিতা নয়, বরং এই সহযোগিতার মূলে থাকে সেই একই স্বার্থপরতাই জিনের আত্মপরায়ণতা। সেজন্যই ম্যাট রিডলী তার ‘দ্য অরিজিন অব ভার্চু’ বইয়ে বলেন[২৮৭]—
In the world of biology, an ant slaves away celibate on behalf of its sisters not out of goodness of its little heart, but out of the selfishness of genes.
কীভাবে পরার্থিতামূলক অভিব্যক্তি গড়ে উঠে তা নির্ণয়ের জন্য হ্যামিলটন একটি নিয়ম প্রস্তাব করেন, যা জীববিজ্ঞানে এখন হ্যামিলটনের সূত্র হিসেবে পরিচিত। সূত্রটির গাণিতিক সংজ্ঞায়ন এরকম[২৮৮]—
B > c/r
যেখানে,
c হচ্ছে পরার্থিতার ব্যয় (cost of altruism)
bহচ্ছে গ্রাহকের পাওয়া উপযোগিতা (benefit received by recipient)
r হচ্ছে সম্পর্কের গুণাঙ্ক (coefficient of relationship)
অর্থাৎ, সোজা বাংলায়, যখন কোনো প্রজাতির মধ্যে সহযোগিতার উপযোগিতা তার ব্যয়কে অতিক্রম করে যায় তখনই পরার্থিতা উদ্ভূত হবে। হ্যামিলটনের এই নীতিটিকেই বিখ্যাত জীববিজ্ঞানী মায়নার্ড স্মিথ নামকরণ করেছিলেন স্বজাতি নির্বাচন (kin selection) হিসেবে। স্বজাতি নির্বাচনের মোদ্দা কথা হলো, জিনের নৈকট্য (অর্থাৎ হ্যামিলটনের সূত্রে এর মান) যত বেশি হবে, তত বেশি হবে পরার্থিতাসূচক মনোভাব। সেজন্যই দেখা যায় সবাই নিজের সন্তান এবং পরিবারের প্রতি সবার আগে পরার্থিতা প্রদর্শন করে। পরিবারের কেউ বিপদে পড়লে সবার আগে চিন্তিত হয় সবচেয়ে কাছের জেনেটিক সদস্যরাই, তারপরে একটু দূরের আত্মীয়-স্বজন, পরে পাড়া-পড়শী, বন্ধুবান্ধব। সেজন্যই সন্তানের প্রতি বাবা মার আত্মত্যাগের ব্যাপারটি সব সংস্কৃতিতেই পাওয়া যায়, আসলে যা কি না জীববিজ্ঞানীদের চোখে স্বজাতি নির্বাচনের মাধ্যমে জিনপুল রক্ষার প্রয়াস। একইভাবে ছোট ভাইকে ছিনতাইকারীর হাত থেকে বাঁচাতে গিয়ে বড়ভাইয়ের আত্মত্যাগের নানা ঘটনাও বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকাগুলোতে পাওয়া যায়।
‘স্বজাতি নির্বাচন’ প্রকৃতিতে খুব চমৎকারভাবে কাজ করে বলেই আমরা দেখি কোনো হিংস্র শিকারি পাখি যখন কোনো ছোট পাখিকে লক্ষ্য করে আক্রমণ করে, তখন অনেক সময় দেখা যায় যে, গোত্রের অন্য পাখি চিৎকার করে ডেকে উঠে তাকে সতর্ক করে দেয়। এর ফলশ্রুতিতে সেই শিকারি পাখি আর তার আদি লক্ষ্যকে তাড়া না করে ওই চিষ্কার করা পাখিটিকে আক্রমণ শুরু করে। এই ধরনের পরার্থিতা এবং আত্মত্যাগ কিন্তু প্রকৃতিতে খুব স্বাভাবিকভাবেই দেখা যায়। এই ব্যাপারগুলো স্বজাতি নির্বাচনের মাধ্যমেই উদ্ভূত হয়েছে। হ্যামিলটন বা মায়নার্ড স্মিথের গবেষণার অনেক আগে থেকেই জীববিজ্ঞানীরা ‘কমন সেন্স’ হিসেবে জানতেন। যেমন ১৯৩০ সালে একবার বিজ্ঞানী জে বি এস হালডেনকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, তিনি তার ভাইয়ের জন্য জীবন বিপন্ন করবেন কি না। তিনি রসিকতা করে উত্তর দিয়েছিলেন, না একটিমাত্র ভাইয়ের জন্য নয়; কিন্তু দুটি ভাই কিংবা আটটি কাজিনের জন্য হলে আমি আছি’। বলা বাহুল্য, হালডেন মনে মনে স্বজাতির নৈকট্য হিসেব করেই তার এই বিখ্যাত উক্তিটি করেছিলেন।
এবারে আরেকটু গভীরে ঢুকি। হ্যামিলটন-স্মিথের প্রস্তাবিত স্বজাতি নির্বাচনের ব্যাপারটা না হয় বোঝা গেল। কিন্তু আমাদের ব্যাখ্যা করতে হবে স্বজাতি নির্বাচন ব্যাপারটা সার্বিকভাবে জীবজগতে কাজ করে কীভাবে। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, স্বজাতি নির্বাচনের মাধ্যমে পরার্থিতা এমনি-এমনি কোথাও কাজ করে না, এটি মূলত কাজ করে হয় বিবর্তনের ক্রীড়াতত্ত্ব বা গেম থিওরির মাধ্যমে ঘটা স্থিতিশীল কৌশল রাজত্ব করার কারণে।
ক্রীড়াতত্ত্ব বা গেম থিওরির যাত্রা শুরু হয়েছিল হাঙ্গেরির প্রতিভাধর গণিতবিদ জন ফন নিউম্যানের হাত দিয়ে ১৯৪৪ সালের দিকে। পরে ১৯৫১ সালের দিকে আরও শক্ত গাঁথুনি দেন প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতবিদ জন ন্যাশ[২৮৯], তৈরি করেন ন্যাশ স্থিতাবস্থার মডেল (Nash Equilibrium)। প্রথমদিকে অর্থনীতির ভিন্ন। স্ট্র্যাটিজির ব্যাখ্যায় গেম তত্ত্ব ব্যবহৃত হলেও পরে দেখা গেল জীববিজ্ঞানেও এটি সমানভাবে কার্যকরী। জন মায়নার্ড স্মিথসহ অন্যান্য বিজ্ঞানীই গেম তত্ত্বের সাহায্যে দেখিয়েছেন যে, শুধু প্রতিযোগিতা কিংবা স্বার্থপরতা দেখালে জিনপুলকে সর্বোচ্চ দক্ষতায় বাঁচিয়ে রাখা যায় না, সাথে আনতে হয় সহযোগিতা এবং পরার্থিতার কৌশলও।
কিন্তু কথা হচ্ছে, কতকগুলো ভারি ভারি কথা বলে দিলেই তো হলো না। কীভাবে বিবর্তনের গেম থিওরি জীবজগতের উপর কাজ করে সেটা পরিষ্কারভাবে বোঝা চাই। এটি বুঝতে হলে আমাদের সবার প্রথমে তাকাতে হবে জেলখানায় বন্দি আসামিদের উভয়-সংকটের দিকে।
আসামির সংকট
গাণিতিকভাবে গেম থিওরির ব্যুৎপত্তি না ঘটলেও এই ধরনের স্ট্র্যাটিজিক সমস্যাগুলো প্রাচীনকালে দার্শনিক আর রাজনীতিবিদদেরও আকৃষ্ট করেছিল। পুরোমাত্রায়। প্রাচীন কালে রাজাবাদশাহরা নিজেদের সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখতে নানা ধরনের ‘গেম প্ল্যান করতেন। কখন কোন্ রাজার সাথে ভালো সম্পর্ক রাখতে হবে, কখন পাশের রাজ্য আক্রমণ করতে হবে, আর কখন বা আবার আক্রমণ ভুলে দেশ রক্ষায় মনোনিবেশ করতে হবে এগুলো নিয়ে তারা চিন্তিত থাকতেন অহর্নিশি। যারা এ ব্যাপারে ভালো কূটবুদ্ধি দিয়ে রাজাদের সাহায্য করতে পারতেন, তাদেরকে রাজসভায় আপ্যায়ন করে নিয়োগ দেয়া হতো। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের কথা আমরা সবাই জানি কূটবুদ্ধির জাল বুনে কীভাবে রাজাকে সহায়তা করা যায় তার শক্তিশালী দলিল এটি। রাজনীতি আর অর্থনীতির নানা প্যাঁচঘোচ খুঁজে প্রজাদের রোষ থেকে রাজার গদি রক্ষার তল্পিবাহক হিসেবে কৌটিল্যকে এখন অভিযুক্ত করা হলেও কৌটিল্যই সম্ভবত ছিলেন মানবেতিহাসের প্রথম অর্থনীতিবিদ যিনি গেম থিওরির মতো স্ট্র্যাটিজিক প্রক্রিয়ায় রাজনীতির বিদ্যমান সমস্যাগুলোর এক ধরনের যৌক্তিক সমাধান খোঁজার চেষ্টা করেছিলেন। শুধু রাজনীতিবিদেরাই নন, অর্থনীতিবিদ, গণিতবিদ কিংবা দার্শনিক থেকে শুরু করে যে কোনো সাধারণ মানুষই বিভিন্ন স্ট্র্যাটিজি পর্যালোচনা করেই জীবনের নানা সিদ্ধান্ত নেন। হাতে একাধিক ভালো চাকরির অফার থাকলে আমরা নতুন চাকরির বেতন, চাকরির স্টেবিলিটি কিংবা চাপ, সেখানকার পরিবেশ, তেলের খরচ, বাড়ি থেকে যাত্রাপথের দূরত্ব কিংবা সময় প্রভৃতি বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেই কোন চাকরিতে যোগ দিব। সামাজিকভাবে বন্ধুত্ব কিংবা মেলামিশির ক্ষেত্রেও আগাপাশতলা সব কিছু বিবেচনা করেই নেওয়া হয় কার সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তোলা হবে, আর প্রতি থেকে যাওয়া হবে নিরপেক্ষ। ফেসবুকে বন্ধু নির্বাচনের ক্ষেত্রে কিংবা বিভিন্ন ব্লগে লেখালেখির ক্ষেত্রেও অনেকে নানা স্ট্রেটেজির আশ্রয় নেন–কাকে সমালোচনা করা হবে, আর কার প্রতি যোগাতে হবে প্রচ্ছন্ন সমর্থন। আসলে আমরা নিজেদের অজান্তেই খেলি ক্রীড়াতত্ত্বের জটিল খেলা। প্রাচীনকালে যখন রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা এখনকার মতো ছিল না, পরিস্থিতি ছিল যুদ্ধংদেহী, তখন প্রাচীন কালের মানুষদের মধ্যে ব্যাপারগুলো আরও স্পষ্ট ছিল। তারা বুঝতে পেরেছিল যে, এমন অনেক পরিস্থিতিই জীবনে আসে যখন নিজের একতরফা জয়লাভ করতে যাওয়ার চেয়ে ভালো কোনো স্ট্র্যাটিজি করে প্রতিপক্ষকে দীর্ঘক্ষণ ঘায়েল করে রাখতে পারলে সুবিধা বেশি। কিংবা কখনো সরাসরি প্রতিযোগিতায় না নেমে তৃতীয় পক্ষের সাথে ঝামেলা তৈরি করে দিতে পারলে বেশি সুফল পাওয়া যেতে পারে। কখনো আবার এগুলো কোনোটাতেই না গিয়ে স্রেফ জনসমর্থন বাড়িয়ে কিংবা কিংবা সাময়িক সহযোগিতার মাধ্যমেও সর্বোচ্চ সুফল আদায় করে নেওয়া সম্ভব।
স্ট্র্যাটিজির ব্যাপারগুলো বোঝার জন্য এবার একটি পরিচিত ধাঁধা নিয়ে আলোচনা করা যাক। গেম থিওরির প্রয়োেগ সংক্রান্ত অত্যন্ত সহজ সরল কিন্তু শক্তিশালী এই ধাঁধাটির নাম দেয়া হয়েছে আসামির সংকট (Prisoner’s dilemma)। মুক্তমনায় অপার্থিব ‘বিবর্তনের দৃষ্টিতে নৈতিকতার উদ্ভব’ নামের একটি চমৎকার লেখায় আসামির সঙ্কট নিয়ে আলোচনা করেছিলেন[২৯০]। ব্যাপারটা অনেকটা এরকমের–
ধরা যাক একজন পুলিশ একটি হত্যা মামলায় দুজন আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে। কিন্তু সাক্ষ্যপ্রমাণ খুবই অপ্রতুল। ফলে পুলিশ কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারছে না। এখন আসামিদের দুজন সত্যই অপরাধ করেছে কি না কিংবা কে আসল অপরাধী তা নির্ধারণ করতে নীচের শর্তগুলো আসামিদের সামনে হাজির করা হলো–
১. একজন আসামি যদি দাবি করে (বিশ্বাসঘাতকতা) যে, অপর জন অপরাধী আর অপর জন যদি নিশ্চুপ থাকে (সহযোগিতা), তাহলে প্রথম জন মুক্তি পাবে এবং দ্বিতীয়জন ৫ বছরের কারাদণ্ড পাবে।
২. উভয়েই যদি নিশ্চুপ থাকে (দুজনের মধ্যে সহযোগিতা) তাহলে উভয়েরই ২ বছরের কারাদণ্ড হবে।
৩. উভয়েই যদি একে অপরকে দোষারোপ করে অপরাধী বানানোর চেষ্টা করে (দুইজনের মধ্যে বিশ্বাসঘাতকতা), তবে তাদের প্রত্যেকের ৪ বছরের কারাদণ্ড হবে।
এখন তাহলে আসামিদ্বয় কী করবে? তারা উত্তর খুঁজতে চেষ্টা করবে, কী করে নিজের সর্বোচ্চ লাভ হবে কিংবা নিজের সর্বোচ্চ ক্ষতি এড়ানো যাবে। প্রথমে হয়তো এক আসামি ভাববে, আমি যদি অপরকে দোষী বানাতে পারি, তাহলে আমি মুক্তি পাব। সুতরাং সে অপরজনকে দোষারোপ করবে। এখন দ্বিতীয়জন যদি নিশ্চুপ। থাকত তাহলে প্রথমজন মুক্তি পেয়ে সর্বোচ্চ লাভ অর্জন করে ফেলতো। কিন্তু মুশকিলটা হলো দ্বিতীয় আসামি যে নিশ্চুপ থাকবে তার তো কোনো গ্যারান্টি নেই। দ্বিতীয়জনও যদি প্রথমজনের মতোই অপরকে দোষারোপের কৌশল নেয়, তাহলেই হবে সমস্যা। দুইজনেরই সর্বোচ্চ ৪ বছর করে কারাদণ্ড হয়ে যাচ্ছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, দুজন দুজনকে দোষারোপ করতে গিয়ে নিজেরাই সর্বোচ্চ ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে, তারচেয়ে বরং দুইজনই যদি নিশ্চুপ থাকত, তখন হয়তো শাস্তিমাত্রা কমে আসত। এই পুরো খেলাটা একাধিকবার পরিচালনা করা হলে হয়তো কারাবন্দিদের মধ্যে একটা সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে উঠবে, ফলে তারা নিজেদের মধ্যে বোঝাপরা করে গেম থিওরির মাধ্যমে ঘটা স্থিতিশীল কৌশল আয়ত্ব করে নেবে। বাস্তবেও তাই হয়। সেজন্যই আমরা দেখি দাগি ভয়ংকর সব আসামিদের মধ্যেও কিংবা মাফিয়া চক্রের মধ্যেও এক ধরনের সহযোগিতার সম্পর্ক থাকে। তারা পারতপক্ষে একে অপরকে ধরিয়ে দেয় না।
ট্রপিকাল রেইন ফরেস্টের দীর্ঘকায়া গাছগুলো আসামির সংকটের বাস্তব উদাহরণ। সেখানে গাছগুলোকে কেবল বংশবৃদ্ধির ব্যাপারটিই কেবল দেখতে হয় না, পাশাপাশি বাড়াতে হয় নিজেদের উচ্চতাকেও। সেই ঘন বনভূমিগুলোতে সূর্যের আলো নীচ পর্যন্ত পৌঁছয় না। কাজেই উচ্চতায় খাটো হলে থেকে যায় সূর্যের আলো না পেয়ে মারা যাওয়ার সম্ভাবনা। কাজেই অন্য জায়গার গাছেদের মতো উচ্চতা বাদ দিয়ে কেবল বংশবৃদ্ধি করা কোনো অপশনই নয় তাদের জন্য। তাই রেইন ফরেস্টের গাছের জন্য কখন বংশবৃদ্ধি করতে হবে, আর কখন উচ্চতা বাড়াতে হবে–এ নিয়ে সবসময় চলে ক্রীড়াতত্ত্বের জটিল এক খেলা। ক্রীড়াতত্ত্বের ব্যবহারিক প্রয়োগ লক্ষ করা যায় জমিতে কৃষকদের কীটনাশক প্রদানের ক্ষেত্রেও। কৃষকেরা দেখেছেন যে একটি কীটনাশক ব্যবহার করে কোনো একটি ক্ষতিকর কীট ধ্বংস করলে অনেক সময় হিতে বিপরীত হয় দেখা যায় সেই কীট মরলেও তার প্রতিযোগী অন্য কোনো ক্ষতিকর কীটের সুবিধা করে দেবার ঘটনা ঘটছে; যার নীট ফলাফল ফসলের জন্য ক্ষতি। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকেই কৃষকেরা সিদ্ধান্ত নেন। কখন কীটনাশক প্রয়োগ করবেন, কখন ছাড় দেবেন, আর প্রয়োগ করলে কোনো কোনো কীটের জন্য ওষুধ প্রয়োগ করবেন ইত্যাদি। আসলে কৃষকের মনে চলতে থাকে আসামির সংকটের মতোই গেম তত্ত্বের নিরন্তর খেলা। জীবজগতের বিবর্তন ভারসাম্যও কিন্তু অনেকটা এভাবেই কাজ করে। লক্ষ লক্ষ বছর ধরে চলমান প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিবর্তন আদিমকালের মানুষের মধ্যে বহু সংঘর্ষ, সহাবস্থান, পারস্পরিক যোগাযোগ, প্রতিযোগিতা এবং সামাজিক লাভ ক্ষতির হিসেবে থেকে এক ধরনের নৈতিক চেতনার উদ্ভব ও বিকাশ ঘটিয়েছে। কীভাবে সেটা সম্ভব তা বুঝতে হলে আমাদের রিচার্ড ডকিন্সের স্বার্থপর জিন তত্ত্বের মাধ্যমে ঘটা ‘বিবর্তনীয় স্থিতিশীল কৌশল সম্বন্ধে একটু জানতে হবে।
স্বার্থপর জিন এবং বিবর্তনীয় স্থিতিশীল কৌশল
রিচার্ড ডকিন্সের সেলফিশ জিন বইটির কথা আমরা আগেও বলেছি। ডকিন্স বইটি লেখেন ১৯৭৬ সালে। এটি রিচার্ড ডকিন্সের প্রথম বই এবং তার শ্রেষ্ঠ কীর্তিগুলোর একটি। এই বইয়ের মাধ্যমেই ডকিন্স সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করলেন যে, বিবর্তন কাজ করে জিনের উপর, একক কোনো জীবের উপর নয়। আমাদের দেহ যাই করুক শেষ পর্যন্ত ‘অত্যন্ত স্বার্থপর’ভাবে জিনকে রক্ষা করা আর জিনকে পরবর্তী প্রজন্মে পৌঁছে দেয়াতেই উদ্দেশ্য খুঁজে নিতে বাধ্য করে, বিবর্তনীয় দৃষ্টিকোণ থেকে জীবনের কোনো ‘উদ্দেশ্য যদি থেকে থাকে তবে সেটাই সে উদ্দেশ্য। বইটির নাম ‘সেলফিশ জিন’ হলেও বইটির মূল লক্ষ্য ছিল ঠিক বিপরীত। জিনগত স্বার্থপরতা থেকেই ক্রমান্বয়ে কীভাবে উদ্ভব হয় পরার্থিতার মতো একটি বিপরীতমুখী অভিব্যক্তির–তা ব্যাখ্যা করাই ছিল বইয়ের মূল উদ্দেশ্য। ডকিন্স কিন্তু নতুন কিছু লেখেননি, বরং জর্জ উইলিয়ামস এবং উইলিয়াম হ্যামিলটনের কাজগুলোকেই জনপ্রিয় বিজ্ঞানের মোড়কে মলাটবন্দি করেছেন। তথ্যে নতুনত্ব না থাকলেও নিঃসন্দেহে নতুনত্ব আর অভিনবত্ব ছিল উপস্থাপনায়। উইলিয়ামস এবং হ্যামিলটনের কাজ ছিল একেবারেই কাঠখোট্টা একাডেমিক লেভেলে। ডকিন্স তাদের কাজকেই সাধারণ মানুষের দরবারে নিয়ে গেলেন একাডেমিক জার্গন সরিয়ে। আসলে এমনকি একাডেমিক স্তরেও ডকিন্সের বইটি প্রকাশের আগে এত ব্যাপকভাবে উইলিয়ামস এবং হ্যামিলটনের কাজ সম্বন্ধে কারও এতো জানাশোনা কিংবা গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। এই বইয়ের মাধ্যমেই আসলে জীববিজ্ঞানীরা সমাজ এবং জীবনকে ভিন্নভাবে দেখা শুরু করলেন। পরার্থিতা, আত্মত্যাগের মতো যে বিষয়গুলো আগে বিজ্ঞানীরা পরিষ্কার করে ব্যাখ্যা করতে পারতেন না, সেগুলো আরও বলিষ্ঠভাবে জীববিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করতে পারলেন তারা। ডকিন্সের বইটি প্রকাশের আগে জীববিজ্ঞানীরা পরার্থিতা এবং আত্মত্যাগকে ব্যাখ্যা করতেন গ্রুপ সিলেকশন বা দলগত নির্বাচনের মাধ্যমে। অর্থাৎ, আত্মত্যাগ ব্যাপারটি ব্যক্তির জন্য খারাপ হলেও পুরো দলের জন্য ভালো–এটাই ছিল আত্মত্যাগের মতো প্রবৃত্তিগুলো টিকে থাকার কারণ–এভাবেই ভাবতেন জীববিজ্ঞানীরা। কিন্তু ডকিন্সের সেলফিশ জিন বইটি এসে দাবার ছক একেবারেই উলটে দিল। ডকিন্স দেখালেন যে, দলের কথা মাথায় রেখে বিবর্তন কখনোই কাজ করে না। আসলে দলগত নির্বাচন ব্যাপারটাই বিবর্তনের পরিভাষা থেকে উঠিয়ে দেয়া উচিত। যে ব্যাপারগুলোকে আপাতঃভাবে দলগত নির্বাচনের সাহায্যে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে, তার সবগুলোকেই আসলে স্বার্থপর জিন তত্ত্বের মাধ্যমে আরও অনেক ভালোভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। কারণ, নির্বাচন হয় জিন লেভেলে, গ্রুপ লেভেলে নয়। প্রতিটি ক্ষেত্রেই জীববিজ্ঞানীরা লক্ষ করেছেন নিজের জিনকে রক্ষা কিংবা যাদের সাথে জিনের নৈকট্য বেশি থাকে, তাদেরকেই রক্ষার তাগিদ প্রকৃতিতে পাওয়া যায়। আর তা থেকেই ঘটে বৃহৎ স্কেলে পরার্থিতার সূত্রপাত। পিঁপড়া, মৌমাছি, উইপোকা থেকে শুরু করে বানর, শিম্পাঞ্জি কিংবা মানুষ সব ক্ষেত্রেই দেখা গেছে জিনগত স্বার্থপরতা থেকেই উদ্ভব ঘটে পরার্থিতার, যা এতোদিন ভুল ভাবে ব্যাখ্যা করা হতো দলগত নির্বাচনের মাধ্যমে। জীববিজ্ঞানে এ এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি। মানবসমাজের বিভিন্ন সামাজিক প্যাটার্ন ব্যখ্যা করার নতুন এক দুয়ার খুলে দিল ডকিন্সের স্বার্থপর জিন তত্ত্ব। স্বার্থপর জিনতত্ত্বই দলগত নির্বাচনকে সার্থকভাবে প্রতিস্থাপন করল উইলিয়ামস- হ্যামিলটন-স্মিথের প্রস্তাবিত স্বজাতি নির্বাচন (Kin selection) দিয়ে।
ডকিন্স তার বইয়ে দেখিয়েছেন স্বার্থপর জিন তত্ত্বের মাধ্যমে খুব সফলভাবে জীবজগতে পরার্থিতার উদ্ভবকে ব্যাখ্যা করা যায়। শুধু তাই নয়, জীবজগতে সবসময়ই স্বার্থপরতা আর পরার্থিতার মধ্যে এক ধরনের ‘দড়ি টানাটানির’ খেলা চলতে থাকে। সেই টানাটানি থেকেই শেষপর্যন্ত নির্ধারিত হয় বিবর্তনীয় স্থিতিশীল কৌশল (Evolutionary Stable Strategy)। কীভাবে স্থিতিশীল কৌশল জীবজগতে রাজত্ব করে, তা বাংলায় একটি চমৎকার প্রবন্ধের মাধ্যমে তুলে ধরেছিলেন মুক্তমনা ব্লগার দিগন্ত সরকার[২৯১]। দিগন্ত লেখা শুরু করেছিলেন একটি মজার উদাহরণ দিয়–
ধরা যাক মুক্তমনায় অপার্থিব আর বন্যা আমার প্রতিযোগী দুই সদস্য। এটা ভাবা খুবই স্বাভাবিক যে আমি এখন অপার্থিবের মুখোমুখি হলেই তাকে মেরে ফেলতে উদ্যত হব। কিন্তু, এমন যদি হয় যে অপার্থিব আবার বন্যারও প্রতিযোগী, তাহলে অপার্থিবকে মারলে আদপে বন্যার সুবিধাই হয়ে যাবে। বরং, বন্যা আর অপার্থিবের মধ্যে প্রতিযোগিতা তীব্র হলেই আমার লাভ বেশি। তাই, প্রতিযোগিতার জটিল ঘূর্ণাবর্তে প্রতিযোগীদের নির্বিচারে হত্যা করাটা নির্বাচিত হবার জন্য খুব একটা ভালো কৌশল নাও হতে পারে।
অর্থাৎ কেবল মারমার কাট-কাট করলেই লাভ হবে না। কারণ ‘মারমার কাট-কাট’ স্ট্র্যাটিজি অনেক সময়ই টিকে থাকার জন্য কোনো ভালো স্ট্র্যাটিজি নয়। মারামারির। পাশাপাশি রপ্ত করতে হবে সহযোগিতার কৌশলও। ব্যাপারটা গাণিতিকভাবেই সহজে প্রমাণ করা যায়। দিগন্ত তার লেখায় এই আকর্ষণীয় বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন ডকিন্সের বইয়ের একটি চমৎকার উদাহরণ হাজির করে। আমি কিছুটা পরিবর্তিত আকারে উদাহরণটি পাঠকদের সামনে তুলে ধরছি। বলা বাহুল্য, এই উদাহরণটি মূলত মায়নার্ড স্মিথের দেয়া কাল্পনিক ‘Hawk and Dove’ এর ঈষৎ পরিবর্তিত উদাহরণ[২৯২]।
ধরা যাক, একটি জীবগোষ্ঠীর মধ্যে দুই ধরনের পরস্পরবিরোধী কৌশল অবলম্বনকারী জীব রয়েছে। প্রথমটি আগ্রাসী নীতি (আনী), আরেকটি ধান্দাবাজ বিবাদ নীতি (ধানী)। আনীরা হচ্ছে আগ্রাসী, এরা মার মার কাট কাট। তারা সবসময় শেষ রক্তবিন্দু অবধি লড়াই করে, মৃতপ্রায় না হলে রণক্ষেত্র থেকে পলায়ন করে না। অপরদিকে ধানীরাও বিবাদী, কিন্তু একটু ধান্দাবাজ টাইপের। এরা মারামারি না করে অন্য উপায়ে লড়াই করে। এরা ঝগড়া করে, রক্তচক্ষু দেখায়, আক্রমণের ভাব করে কিন্তু রক্তপাত করে না। কিন্তু তারপরেও দুই ধানীতে লড়াই বাধলে শেষপর্যন্ত একজন জিতে আরেকজন হারে। এদের পার্থক্যটা অনেকটা অনেকটা ডিপ্লোম্যাট আর আর্মির পার্থক্যের মতো। আনীর সাথে ধানীর লড়াই হয় না, কারণ ধানী পালিয়ে যায়। কিন্তু দুই আনীর লড়াইতে সর্বদা কোনো না কোনো একজন মারা যায় (বা গুরুতর আহত হয়)।
এবারে লড়াইয়ের কৌশলটি গাণিতিকভাবে হিসেব করা যাক। হিসাবের সুবিধার্থে আমরা ধরে নিব, কোনো জীবই জীবদ্দশায় তার কৌশল বদলায় না, এবং এমনকি প্রতিযোগিতার শুরুতে একে অন্যের কৌশল সম্বন্ধেও অবগত থাকে না। আমাদের এই মডেলের কাল্পনিক পয়েন্ট সিস্টেমে ধরা যাক :
প্রতিযোগিতায় জিতলে ৫০ পয়েন্ট, প্রতিযোগিতায় হারলে ০ পয়েন্ট, সময় নষ্টের জন্য ১০, গুরুতর আহত হলে ১০০ পয়েন্ট বরাদ্দ করা হলো।
— জিনের নির্বাচনের সম্ভাবনার সাথে মিল রেখেই এরকম পয়েন্ট সিস্টেম।
আমরা হিসাব করতে চাই যে এদের মধ্যে কোন্ কৌশলটি (বা এদের কোনো সংমিশ্রণ) স্থিতিশীল হয়ে উঠবে।
মনে করা যাক, জীবগোষ্ঠীর সব জীবই প্রথমে ধানী (ধান্দাবাজ বিবাদী নীতি)। ছিল। তাহলে তাদের মধ্যে প্রতিটি প্রতিযোগিতায়, একজন জেতে (+৫০), একজন হারে (০); আর দুজনেই সময় নষ্ট করে (-১০x২ =–২০), কিন্তু কেউই আহত হয় না। সমষ্টিগতভাবে লাভ হয় ৩০ পয়েন্ট, প্রত্যেকের ভাগে যায় ১৫ পয়েন্ট করে। এবার ধরা যাক একটা আনী (আগ্রাসী নীতি) জীব হঠাৎ এসে হাজির হলো এই গোষ্ঠীতে। সে ধানীদের সহজেই লড়াইতে হারিয়ে দেবে, প্রতি যুদ্ধে +৫০ পয়েন্ট হাসিল করবে। তার ফলে তার আগ্রাসী জিন খুব সহজেই জীবগোষ্ঠীতে বিস্তার লাভ করবে। বিস্তার লাভ করতে করতে, ধরা যাক, একটা সময় পরে জীবগোষ্ঠীতে ধানীদের সংখ্যা একেবারেই কমে যাবে আর গোষ্ঠীর প্রায় সবাই আনী হয়ে যাবে। এখন স্বভাবতই দুই আনীতে লড়াই বাধবে। দুটি আগ্রাসী জীবের লড়াইয়ে প্রত্যেকে গড়ে–২৫ পয়েন্ট পায় (জেতায় +৫০, আর গুরুতর আহত হওয়ায়–১০০)। একটি বিবাদী সেই দলে থাকলে সে সব লড়াইতে হারে, কিন্তু গড়ে সে ০ পয়েন্ট পায় (আগের গণনা থেকে)।-২৫ পয়েন্ট এর চেয়ে ০ পয়েন্ট অনেক ভালো। +৩৫ পয়েন্টের সুবিধা থাকায় সহজেই ধানী কৌশল নিয়ন্ত্রক জিন জনপুঞ্জে বিস্তার লাভ করতে থাকবে।
এতদূর পর্যন্ত গল্পটা শুনে মনে হতে পারে যে জীবগোষ্ঠীতে সবসময় এই দুই কৌশলের জীবদের মধ্যে একটা বাড়াকমা চলবে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা অঙ্ক কষে দেখেছেন যে ধানী আর আনীদের অনুপাত ৫:৭ অনুপাতে পৌছলে সমাজ স্থিতিশীলতা লাভ করবে! মানে, ওই অনুপাতে পৌঁছনর পরে প্রতিটি আগ্রাসী (আনী) আর প্রতিটি ধান্দাবাজ বিবাদী (ধানী)র গড়পড়তা লাভ-ক্ষতির তুলনামূলক হিসাব মিলে যায়। অর্থাৎ ধানী : আনী = ৫:৭ হয়ে গেলে নির্বাচনে আর কেউই অন্যের তুলনায় সুবিধা পায় না। এই অনুপাতই এক্ষেত্রে বিবর্তনীয় স্থিতিশীল কৌশল।
স্থিতিশীল কৌশল কেবল আনী-ধানীর ক্ষেত্রেই নয়, চমৎকারভাবে কাজ করে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন মানবসমাজে নারী পুরুষের অনুপাত থাকে ১০০ : ১০৫ অনুপাতে। ক্রীড়াতত্ত্বের সাম্যাবস্থার জন্যই এটি ঘটে। রিচার্ড ডকিন্স তার সেলফিশ জিন বইয়ের ‘ব্যাটেল অব সেক্স’ অধ্যায়ে উপরের আনী ধানীর মতোই নারীপুরুষের মধ্যে প্রতারণা এবং বিশ্বস্ততা নিয়েও একটি সরল ‘গেম থিওরির অবতারণা করে দেখিয়েছেন যে, সেখানেও দড়ি টানাটানির একটা খেলা চলে, ফলে পূর্ণ বিশ্বস্ত নারী-পুরুষে ভর্তি সমাজ যেমন আমরা পাই না, তেমনি পাই না এমন সমাজও যেখানে সবাই অবিশ্বস্ত। বরং সমাজে দেখা যাবে বিশ্বস্ততা এবং প্রতারণা রাজত্ব করে একটি নির্দিষ্ট অনুপাতে যা শেষ পর্যন্ত বিবর্তনীয় স্থিতিশীল কৌশল বা Evolutionary stable strategy তৈরি করে।
একই ধরনের মডেল তৈরি করা যায় সত্যবাদী আর মিথ্যাবাদীদের মিথস্ক্রিয়ার মধ্যেও। বিবর্তনীয় স্থিতিশীল কৌশলের কারণেই পরিপূর্ণ সত্যবাদী সমাজ যেমন আমরা পাই না, ঠিক তেমনি এমন সমাজও আমরা পাব না যেখানে সবাই মিথ্যা কথা বলছে। এমনকি একই মানুষের মধ্যেও দেখা যাবে কারো পক্ষেই জীবনের সবসময় সত্য কথা বলা যেমন সম্ভব নয়, ঠিক তেমনি সম্ভব নয় সর্বদা মিথ্যে কথা বলাও। পদার্থবিদ হাইন্য পেগে তাঁর “যুক্তির স্বপ্ন” বইয়ে এজন্যই বলেছেন[২৯৩]–
জটিলতার নতুন বিজ্ঞান আর কম্পিউটারের প্রতিরূপ (মডেল) তৈরির মাধ্যমে আমরা মূল্যবোধ সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য জানতে পেরেছি, যা আগে কখনোই সম্ভব ছিল না। নৈতিকতা নিয়ে বিতর্কের সুরাহা করতে না পারুক, বিজ্ঞান অন্তত মডেলের সাহায্যে ব্যাপারগুলোর একটা যৌক্তিক কাঠামো তৈরি করতে পারে। একটা উদাহরণ নেওয়া যাক। যেমন মিথ্যা বলা। আমরা সত্য বলাকে একটা পুণ্য বলে মনে করি আর মিথ্যা বলাকে পাপ হিসেবে গণ্য করি। এখন একটি সমাজ কল্পনা করি–যেখানে সবাই সর্বদা সত্য কথা বলছে। এখন সেই সমাজে কোন এক মিথ্যেবাদী এসে হাজির হলো (অনেকটা উপরের ধানী সমাজে আনীর আগমনের মতো)। এখন সত্যবাদী সমাজে এরকম একজন মিথ্যা বললে তার বিপুলভাবে লাভবান হবার সম্ভাবনা দেখা দেয়। কিন্তু এই সম্ভাবনা সামাজিক স্থিতবস্থা রক্ষার জন্য সহায়ক নয়। অপরদিকে যে সমাজে সবাই সর্বদা মিথ্যা বলে, সেই সমাজও বেশিদিন স্থিতাবস্থায় থাকতে পারে না এবং একসময় ভেঙে পড়তে বাধ্য। সবচেয়ে স্থিতাবস্থার দশা হলো যখন সবাই অধিকাংশ সময় সত্য বলে কিন্তু মাঝে মধ্যে মিথ্যা বলে, যা বাস্তব জগতে দেখা যায়। এক অর্থে বলা যায় যে আমাদের মধ্যে যারা মিথ্যাবাদী তারাই আমাদের বাকি সবাইকে সত্যবাদী ও সতর্ক থাকতে সহায়তা বা বাধ্য করে। মিথ্যাকথনের এই বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ আমরা কেন মিথ্যা বলি সেটা বুঝতে আমাদের সাহায্য করতে পারে।
ক্রীড়াতত্ত্ব এইরকম বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণকে সমর্থন দেয়, শুধু জীববিজ্ঞানে নয়, বিজ্ঞানের নানা শাখাতেই। যেমন অর্থনীতি নিয়ে যারা পড়াশুনা করেছেন তারা জানেন দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ তথা বাজার নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে, গেম থিওরি প্রচ্ছন্নভাবে কাজ করে। প্রথমে কোনো দ্রব্যের মনোপলি বাজার থাকলে দ্রব্য প্রস্তুতকারীর একচেটিয়া মুনাফা থাকে। দ্রব্যের দামও হয়তো বসাতে পারে ইচ্ছেমতো। কিন্তু একটা সময়। পরে অন্য প্রতিযোগীরাও একই দ্রব্য তৈরিতে নেমে পড়লে কারো একতরফা মুনাফা থাকে না। দ্রব্যের মূল্য নির্ধারিত হয় গেম থিওরির মাধ্যমে বোঝাঁপড়ার নিরিখে। আবার কোনো ব্যবসায়ী একই দ্রব্য কমদামে বিক্রি শুরু করলে তার সাময়িকভাবে লাভ হয় বটে, কিন্তু তার অন্য প্রতিযোগীরাও সাথে সাথেই দাম কমিয়ে ফেললে তার আখেরে অনেক লোকসানই হবে। তাই শেষমেষ নিজেদের মধ্যে এক ধরনের বোঝাঁপড়ার মাধ্যমে বাজারে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রিত হওয়া শুরু করে। স্বার্থপরতা আর পরার্থিতাও ঠিক একইভাবে কাজ করে। তারা মিলেমিশে এক হয়ে থাকে। ক্রীড়াতত্ত্বের দড়ি টানাটানির মাঝখানে। চীনের অধিবাসীদের অনেকেই ইন এবং অ্যান (Yin and yang) নামক দুই পরস্পরবিরোধী শক্তিতে বিশ্বাস করে। তারা মনে। করে মানুষসহ সবকিছুই আসলে ইন এবং অ্যান-এর সুষম মিশ্রণ। শুধু চীনারা কেন, আমরাও ছোটবেলায় স্কুলে ভাব সম্প্রসারণ করতে গিয়ে শিখেছিলাম–”শুভ’র জন্যই অশুভ’র দরকার”, কিংবা “আলোর জন্যই অন্ধকারের প্রয়োজন”। নিরঙ্কুশ সত্যবাদী সমাজ তৈরির মতো প্রদীপ জ্বেলে আঁধার দূর করার চেষ্টা হলেও দেখা যায়–প্রদীপের নীচেই থেকে যাচ্ছে গাঢ় অন্ধকার। ঠিক একইভাবে বলা যায়, আমরা পরার্থিতার যতই বিজয় কেতন উড়াই না কেন, স্বার্থপরতাকে বাদ দিয়ে তা সম্ভব নয়। প্রদীপের অন্ধকারের মতোই তা নীচের স্তরে থেকে যাবে। কারণ বিজ্ঞানীরা দেখেছেন পরার্থিতার মূল উৎস আসলে স্বার্থপর জিনের উপস্থিতির কারণেই। ক্রীড়াতত্ত্বের আধুনিক মডেলগুলো যেন তারই বাস্তব প্রতিধ্বনি। সেজন্যই ম্যাট রিডলী তার নৈতিকতার উদ্ভব’ বইয়ে বলেন[২৯৪]–
Cooperation was first used, not for virtuous reasons, but as a tool to achieve selfish results. And if we are to celebrate the unusually cooperative result of the societies, we must first recognize the base metal from which it was forged.
এই স্বার্থপরতার উপস্থিতির কারণেই কীভাবে পরার্থিতার উদ্ভব ঘটে তা আরও স্পষ্ট হবে নীচের কিছু উদাহরণে।
ইট-পাটকেল এবং পিঠ চুলকোচুলকির খেলা
জীবজগতে গেম থিওরি এবং বিবর্তনীয় স্থিতিশীল তত্ত্ব কীভাবে কাজ করে তা না হয় জানা গেল। কিন্তু একটি জীব কী করে বুঝবে কখন তাকে স্বার্থপর হতে হবে, আর কখন পরার্থ? কীভাবে বুঝবে কখন সত্যবাদী যুধিষ্ঠির সাজতে হবে, আর কখন হতে হবে বিশ্বাসঘাতক বিভীষণ? এর উত্তর পাওয়া গেছে দুই প্রতিভাবান বিজ্ঞানী রবার্ট এক্সেলরড (Robert Axelrod) এবং রবার্ট ট্রাইভার্স (Robert Trivers)-এর পৃথক দুটি গবেষণায়। দুজন বিজ্ঞানী আলাদা দুটি তত্ত্ব দিয়েছেন। নামে আলাদা হলেও তত্ত্বের বিষয়বস্তু মোটামুটি একই। তুমি আমার পিঠটি চুলকালে আমিও এক সময় তোমার পিঠটি চুলকে দিব। আর তুমি ইট মারলে আমিও দেব পাটকেলটি মেরে। কাজেই বাপু যা করবে বুঝে করো। এই হলো তত্ত্ব দুটির মোদ্দা কথা।
ইটটি মারলে পাটকেলটি খেতে হবে–এই তত্ত্বের ইংরেজি ‘টিট ফর ট্যাট’ (Tit for tat)। এটি দিয়েছেন এক্সেলরড। আর রবার্ট ট্রাইভার্সের ‘পিঠ চুলকোচুলকি’ সংক্রান্ত তত্ত্বের নাম বিনিময়ী পরার্থিতা (Reciprocal Altruism)। দুটি তত্ত্বই ইঙ্গিত করছে–অতীতে আমার প্রতি তুমি কী আচরণ করেছ সেটা মনে করে আমি তোমার প্রতি আচরণ করব। ভালো আচরণ করে থাকলে আমার থেকেও ভালো আচরণ পাবে, আর ঝামেলা করে থাকলে আমার দিক থেকেও তাই পাবে। কাজ কর্মে এক হলেও তত্ত্ব দুটিতে সূক্ষ্ম কিছু পার্থক্য থেকে গেছে। টিট ফর ট্যাট ঘটে একই প্রজাতিতে। এক ভার্ভেট বানর ক্ষিদার সময় আরেক বানরকে কলা দিলে, সেই বানরও পরবর্তীতে কলা দিয়ে প্রথম বানরকে সাহায্য করবে। শিকারিদের দ্বারা। আক্রান্ত হবার মুহূর্তে কোনো পরোপকারী বানর বন্ধু যদি চিৎকার করে সতর্ক করে দেয়, তবে পরোপকারী বানরটি কখনো বিপদে পড়লেও ঠিক একইভাবে সেই আক্রান্ত বানরটি চিৎকার করে তাকে বিপদে সাহায্য করবে। টিট ফর ট্যাটবিদ্যমান থাকে একই প্রজাতির মধ্যে। বানর কেবল চিৎকার করে সতর্ক করবে আরেকটি বানর বিপদে পড়লেই, কোনো খরগোশ বিপদে পড়লে নয়। আর তাদের সাহায্যের ধরনও একই ধরনের হবে। কলার বিনিময়ে কলা, কিংবা চীৎকারের বিনিময়ে চিৎকার। অন্য কিছু নয়। কিন্তু অন্য দিকে রেসিপ্রোকাল অলট্রইজম বা বিনিময়ী পরার্থিতার ক্ষেত্রে পরার্থিতা প্রজাতির স্তর অতিক্রম করে যায়। এক প্রজাতি অন্য প্রজাতিকে সহায়তা করে। আমরা আগে আমরা আগে ক্লাউন মাছ আর এনিমোন, হামিং বার্ডের সাথে অর্নিথোপথিলাস ফুলের, কিংবা এংরাকোয়িড অর্কিডের সাথে আফ্রিকান মাদার সহবিবর্তনের উদাহরণের সাথে পরিচিত হয়েছি যেগুলো প্রজাতির স্তর অতিক্রম করে পরার্থিতার বিকাশ ঘটিয়েছে। সাহায্যের ধরনও ভিন্ন হতে পারে। আমি পূজা উপলক্ষ্যে প্রতিবেশীকে পায়েশ পাঠালে, প্রতিবেশীও যে পায়েশই পাঠাবে তা নয়, হয়তো ঈদের দিন পাঠাবে কোরমা–এই ধরনের!
ইট-পাটকেল তথা টিট ফর ট্যাট তত্ত্বের উদ্ভবটা বেশ মজার। আশির দশকের প্রথমভাগে কম্পিউটারের শক্তি বাড়তে শুরু করেছে হু-হুঁ করে। পার্সোনাল কম্পিউটারও বাজারে আসতে শুরু করেছে। এই সময় রবার্ট এক্সেলরড নামের এক তরুণ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর শখ হলো কম্পিউটারের সাহায্যে আসামির সঙ্কটের একটা সিমুলেশন পরীক্ষা করবেন। তিনি একটি মজার প্রতিযোগিতার আয়োজন করলেন যেখানে প্রতিযোগীরা আসামির সংকট সমাধানের জন্য একটা ভালো এলগরিদম সাবমিট করবে। প্রায় দুশবার একে অপরের মধ্যে ক্রমান্বয়ে খেলা চলবে। এর মধ্যে যার পয়েন্ট সবচেয়ে বেশি হবে সেই এলগোরিদমই বিবেচিত হবে শ্রেষ্ঠ হিসেবে। চৌদ্দজন প্রতিযোগী সেই প্রোগ্রামিংয়ের খেলায় অংশ নেন–তারা সহজ সরল থেকে শুরু করে বিভিন্ন জটিল জটিল এলগোরিদম সাবমিট করলেন। এনাতল র্যাপোর্ট (Anatol Rapoport) নামে এক তরুণ প্রোগ্রামারের এলগোরিদম সর্বোচ্চ পয়েন্ট পেয়ে জয়লাভ করল–আর সেই প্রোগ্রামের স্ট্র্যাটিজি ছিল সবচেয়ে সরল-সেই টিট ফর ট্যাট। প্রথমে সহযোগিতা করে সে খেলা শুরু করবে, আর মনে রাখবে তার প্রতিপক্ষ ঠিক কি করেছিল তার সাথে সহযোগিতা নাকি বিরোধিতা। প্রতিপক্ষ সহযোগিতা করে থাকলে সেও সহযোগিতা করবে, আর বিরোধিতা করলে সেও করবে বিরোধিতা। এভাবেই এগুতে থাকবে। এভাবেই সে সবচেয়ে বেশি পয়েন্ট অর্জন করে প্রথম স্থানে পৌঁছে গেল। এই প্রতিযোগিতার মাধ্যমেই বেরিয়ে এল যে, টিট ফর ট্যাট বা ইটটি মারলে পাটকেলটি খেতে হয়–এটিই আসামির সংকট মোকাবেলার জন্য সর্বোত্তম সমাধান।
কয়েক বছর পরে রবার্ট এক্সেলরড আবারো আরেকটি টুর্নামেন্টের আয়োজন করলেন টিট ফর ট্যাট আলগোরিদমকে কেউ হারাতে পারে কি না সেটা পুনর্বার পরীক্ষা করার জন্য। এবারেও শীর্ষস্থান অধিকার করে বসে রইলো সেই আদি অকৃত্রিম টিট ফর ট্যাট! তিনি ১৯৮১ সালে বিষয়টি ফোকাস করে হ্যামিলটনের সাথে মিলে সায়েন্স পত্রিকায় একটি নিবন্ধ লেখেন ‘দ্য ইভোলুশন অব কোঅপারেশন’ নামে[২৯৫], এবং বছরখানেক পরে একটি বই লেখেন সেই একই শিরোনামে[২৯৬]। এভাবেই টিট ফর ট্যাট অ্যালগরিদম বিবর্তনীয় গেম থিওরির এক রাজকীয় স্থান অধিকার করে নিল।
রক্তচোষা বাদুড়দের কথা
খাতায় কলমে আর কম্পিউটার সিমুলেশনে না হয় ইট-পাটকেল তথা টিট ফর ট্যাট এক বাস্তব সমাধান হিসেবে হাজির হলো, কিন্তু কথা হচ্ছে প্রকৃতিতে কি আসলেই ইট-পাটকেল কিংবা বিনিময়ী পরার্থিতার প্রয়োগ দেখা যায়, নাকি এগুলো কেবলই কিছু আঁতেলেকচুয়াল বিজ্ঞানীদের অলস মস্তিষ্কের প্যাঁচপ্যাচানি?
এর উত্তর পাওয়া গেল ১৯৮৩ সালে ভ্যাম্পায়ার বাদুড় নিয়ে জীববিজ্ঞানী গেরাল্ড উইলকিনসনের (Gerald Wilkinson) একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণায়। ভদ্রলোক। কোস্টারিকায় এই বাদুড়দের নিয়ে অনেকদিন ধরেই রিসার্চ করছিলেন। এই সমস্ত বাদুড়েরা খুবই অদ্ভুত। বাদুড়দের অন্য প্রজাতিদের মতো এদের ফলমূলে কোনো রুচি নেই। এদের আহার হলো কেবল তাজা রক্ত। এরা গাছের ডালে ঝুলে থাকে আর অপেক্ষা করে থাকে কোনো ঘুমন্তস্তন্যপায়ীজীবের গা থেকে রক্তপানের জন্য। তারপর গভীর রাত্রিতে বের হয় শিকারের সন্ধানে। নিঃসন্দেহে এভাবে খাদ্য সংগ্রহের ব্যাপারটি বাদুড়দের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। আর বহুসময়ই তারা পর্যাপ্ত আহার যোগাড় করতে পারে না। কারণটি বোঝা কঠিন কিছু নয়। খাবার মানে রক্ত সংগ্রহের জন্য শিকারকে জায়গা মতো পেতে তো হবে, আর যার দেহ থেকে রক্ত যোগাড় করতে যাচ্ছে, সেই বা রাজি থাকবে কেন। টের পেয়ে বাধা দিলে তো আর রক্ত খাবার উপায় নেই। জান নিয়ে পালানোটাই তখন বুদ্ধিমানের কাজ। সেজন্য দেখা যায় এই বাদুড়েরা অনেক সময়ই দুই তিন দিন পর্যন্ত অভুক্ত থেকে যায় কোনো কিছু যোগাড় না করতে পেরে। পঞ্চাশ-ষাট ঘণ্টা না খেয়ে থাকার পর তাদের বাদুড়দের কী অবস্থা হয় তা বোধহয় সহজেই অনুমেয়।
সৌভাগ্যক্রমে এই দুরবস্থা থেকে পরিত্রাণের একটা রাস্তা তারা নিজেরাই বাতলে নিয়েছে। তারা যখন খাবার পায় তখন তারা প্রয়োজনের অতিরিক্ত খেয়ে নেয়। রক্ত খেয়ে একেবারে পেট ফুলিয়ে বসে থাকে। কিন্তু পেট ফুলায় এমনি এমনি না। তারা গোত্রের অভুক্ত বাদুড়দের রক্ত খাইয়ে সাহায্য করে। তারা পরার্থতা প্রদর্শন করে সমগোত্রীয়দের প্রতি। তারা এই পরার্থপরায়ণ সামাজিক আচরণের মাধ্যমেই সফলভাবে টিকে থাকে।
মজার ব্যাপার হলো বাদুড়দের সবাই যে নিঃস্বার্থ তা কিন্তু নয়। তাদের মধ্যে অনেকে পেট ফুলিয়ে রক্ত খাওয়ার পরেও এমন ভান করে যে সে খায়নি। পরার্থপরায়ণ এই বাদুড় সমাজে কোনো বাদুড়কে যদি বিপদের সময় কাউকে রক্তপান না করাতে হয়, কিন্তু নিজে বিপদে পড়লে যদি কেউ না কেউ তাকে খেতে দেয়, তাহলে সে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে। আবার অন্যদিকে এমন যদি হয় যে কোনো বাদুড় কারো বিপদের সময় অন্যকে রক্ত খাইয়ে সাহায্য করছে, কিন্তু নিজের বিপদে কেউ তাকে খাওয়াতে এগিয়ে আসছে না–তা হলে সে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এই ডাইনামিক্স এর ধরনটা আসামির সংকটের আলোকে বুঝার চেষ্টা করা যাক। নিঃসন্দেহে কোনো বাদুড়ই চাইবে না ক্ষতির বোঝা বাড়াতে, বরং বাদুড় সমাজে ‘অতি চালাক’ এমন কেউ না কেউ থাকবে যে ধোঁকাবাজি করে সবচেয়ে বেশি লাভবান থাকতে চাইবে। অর্থাৎ এ সমস্ত বাদুড়েরা রক্ত খেয়ে এসে মুখ টুখ মুছে এমনভাবে চলাফেরা করবে যে তারা রক্ত খায়নি; ফলে অন্য কাউকে তার রক্ত খাওয়াতে হবে না। সত্যই এরকম কিছু বাদুড় দেখা যায় গোত্রে। যারা চালাকি করে প্রতারণার পথ নেয়। কিন্তু অতি চালাকের গলায় দড়ি পড়তে সময় লাগে না। তার ফোলা পেটের ধরন দেখেই অন্য অভিজ্ঞ বাদুড় সদস্যদের কেউ কেউ বুঝে ফেলে ব্যাটা ‘সাধু বেশে পাকা চোর অতিশয়। ফলে তাকে একঘরে করে ফেলা হয়, কেউ তাকে তার বিপদের সময় রক্ত খেতে দিয়ে সাহায্য করে না। মূলত বাদুড়েরা তাদের নিজেদের মধ্যে খেলতে থাকে ‘ইট-পাটকেল’ বা ‘টিট-ফর ট্যাট’-এর মায়াবি খেলা–কেউ তাকে রক্ত খেতে দিলে সেও তার বিপদে নিজের ভাগের রক্ত খেতে দেয়। কিন্তু কেউ প্রত্যাখ্যান করলে সেও প্রত্যাখ্যান করে। এভাবেই ইট-পাটকেল এবং বিনিময়ী পরার্থিতা নীতি বাদুড় সমাজে রাজত্ব করে চলে অত্যন্ত সফলভাবে[২৯৭]।
এই সমস্ত রক্তচোষা বাদুড়দের মতো আফ্রিকান ভার্ভেট বানরদের মধ্যেও কিন্তু বিনিময়ী পরার্থতা দেখতে পাওয়া যায়। সেখানেও বানর সদস্যরা টিট ফর ট্যাটের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেয় অপর বানরকে সাহায্য করা হবে নাকি প্রতাখ্যান করা হবে। যদি অতীতে সাহায্য পেয়ে থাকে কারো কাছ থেকে, বিপদের সময় তাকে সাহায্য করে। আর যদি উল্টোভাবে সাহায্য চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়, তবে বিপদের সময় তাকেও কাঁচকলা দেখিয়ে দেয়া হয়। এই ইট-পাটকেলের পাশাপাশি স্বজাতি নির্বাচনও খুব জোড়ালোভাবে কাজ করে ভার্ভেট বানরদের মধ্যে। শুধু জোড়ালো বললে ভুল হবে, স্বজাতি নির্বাচনের সম্পর্ক অনেক সময় ছাপিয়ে যায় ইট-পাটকেল এবং বিনিময়ী পরার্থপরায়ণতাকেও। যেমন, বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, দুই বানরের মধ্যে যদি রক্তের সম্পর্ক থাকে তাহলে অতীতে সাহায্য পাক না পাক, তার বিপদে অন্য সদস্য সাহায্য করে। অর্থাৎ রক্তের সম্পর্ক ছাড়িয়ে যায় ইট-পাটকেলের খেলাকে। মা বানর তার শিশু বিপদে পড়লে এমনিতেই সাহায্য করে, কোনো কিছুর বিনিময়ের দাবিতে নয়। ঠিক একই ব্যাপার ঘটে ভাই বোনদের মধ্যেও। কিন্তু রক্তের সম্পর্কের বাইরে কাউকে সাহায্য সহযোগিতার প্রশ্ন আসলে সেই ইট-পাটকেলেরই শরণাপন্ন হয় সবাই। সাধে কি আর বলে–Blood is thicker than water!
ভ্যাম্পায়ার বাদুড় আর ভার্ভেট বানরের ক্ষেত্রে যা দেখা গেল সেরকম ব্যাপার তো মানুষের জন্যও খাটে, তাই না? বিপদের সময় কারো কাছ থেকে সাহায্য পেয়ে থাকলে আমরাও প্রাণপণে সেটা শোধ করে দিতে চেষ্টা করি। আর বিশ্বাসঘাতক কিংবা কৃতঘ্ন লোকজনকে এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করি। এ ধরনের লোককে অনেকসময় সামাজিকভাবেও একঘরে করে ফেলা হয়। এটা কিন্তু ঘুরেফিরে উপরের টিট ফর ট্যাট আর রেসিপ্রোকাল অইজমেরই প্রতিফলন। আবার, ভার্ভেট বানরদের মতো মানবসমাজেও দেখা যায় এই টিট ফর ট্যাট নীতিকে বহু সময়ই অতিক্রম করে যায় স্বজাতি নির্বাচন তথা রক্তের সম্পর্ক। ছেলে মেয়ে বিপদে পড়লে ‘রক্তের টান’ই মুখ্য হয়ে উঠে ইট-পাটকেলের চেয়ে। বিপদ থেকে সন্তানকে রক্ষার চিন্তাই প্রাধান্য পায় তখন। অর্থাৎ, বিজ্ঞানীরা মনে করেন, ভার্ভেট বানরের মধ্যে স্বজাতি নির্বাচনের সম্পর্ক যেভাবে অনেক সময় ছাপিয়ে যায় ইট-পাটকেল এবং বিনিময়ী পরার্থপরায়ণতাকে, ঠিক সে ধরনের প্যাটার্ন কাজ করে মানবসমাজেও।
বিজ্ঞানীরা আরও দেখেছেন, ইট-পাটকেল আর বিনিময়ী পরার্থতার খেলা ভালো জমে যদি সদস্যরা খুব ক্লোজড কমিউনিটি’তে বাস করে। ভাভেট বানরেরা আর ভ্যাম্পায়ার বাদুড়েরা দীর্ঘদিন ধরে একই জায়গায় বাস করে একই সম্প্রদায়ের মধ্যে। তাই তাদের মধ্যে সহজাতভাবেই এক ধরনের সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে উঠে। ব্যাপারটা মানবসমাজের জন্যও ঠিক একইভাবে প্রযোজ্য। আমরা প্রায় সময়ই অনেকের মুখেই বলতে শুনি যে, শহরের লোকেরা অনেক বাটপার, তার তুলনায় গ্রামের লোকেরা অনেক ভালো সহজ-সরল। আসলে এটার কারণ হলো, গ্রামের লোকেরা একটা ক্লোজড কমিউনিটিতে বাস করে। সেখানে সবাই সবাইকে চেনে, আর প্রায়ই হাটে-মাঠে একে অপরের সাথে দেখা হয়ে যায়। ফলে কারো পক্ষে বাটপারি কিংবা চুরিচামারি করে খুব বেশি সুবিধা সেখানে পাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু ঢাকা শহরের মতো জায়গায় যেখানে লক্ষ লোকের বাস, সেখানে একজন বাটপার জানে যে, আজকে বাসে একটি অপরিচিত লোকের পকেট মেরে দিলে পরের দিন তার সাথে দেখা হবার সম্ভাবনা একেবারেই কম। তাই গ্রামের চেয়ে শহরে ছিনতাইকারী, পকেটমার, চোর ছ্যাচর বেশি দেখা যায়, মানুষ আক্রান্তও হয় তুলনামুলক বেশি। এটাও ক্রীড়াতত্ত্বের সিমুলেশনেরই একটি বাস্তব ফলাফল।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রবার্ট এক্সেলরড তার সহযোগিতার বিবর্তন’ বইয়ে টিট ফর ট্যাটের একটি বাস্তব উদাহরণ হাজির করছেন। ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান সৈন্যরা বেলজিয়াম দখল করে নেয়। স্বভাবতই পশ্চিমা শক্তি (western front) আর মধ্যশক্তির (Central Powers) মধ্যে শুরু হয় তুমুল সংঘর্ষ আর সংঘাত। কিন্তু অবাক ব্যাপার হলো, এই সংঘাতময় পরিস্থিতিতেও একটা সময় পরে দেখা গেল, রেলজিয়ামের একটি পরিখার দুই পাশে জার্মান সৈন্য আর পশ্চিমা শক্তির (ফ্রান্স এবং বেলজিয়াম) কিছু ট্রপের মধ্যে এক ধরনের সমঝোতার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। আমরা আগের কিছু উদাহরণে দেখেছি যে, দীর্ঘদিন ধরে একই জায়গায় বাস করতে থাকলে সম্প্রদায়ের মধ্যে সহিংসতার পাশাপাশি সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে উঠে। আসামির সংকট থেকে উদ্ভূত টিট ফর ট্যাটের কারণেই এটি ঘটে। রবার্ট এক্সেলর্ডের মতে, ঠিক একই কারণে বেলজিয়ামের একটি পরিখার দুই পাশে অবস্থিত দুই বিরোধীপক্ষের সৈন্যদের মধ্যে এক ধরনের সহমর্মিতার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। কারণ একই জায়গায় দুই দলের সৈন্যদের একই ট্রুপকে বেশ কয়েকবার একে অপরের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। প্রাথমিক সময়গুলোতে সংঘাত আর সংঘর্ষ চললেও একটা সময় পরে গেম থিওরির নিয়মেই আসামির সংকটের মতো পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে। তারা পারতপক্ষে শত্রুদের লক্ষ্য করে গুলি চালাতো না, অতর্কিতে পেছন থেকে আক্রমণ করে জয়লাভের চেষ্টা করত না, কিংবা যত কম। হত্যাকাণ্ডের মধ্যে নিজেদের নিয়োজিত রাখা যায়, তার সর্বাত্মক চেষ্টা করত। বিনিময়ে তারা প্রত্যাশা করত যে শত্রুপক্ষও প্রতিদানে তাদের প্রতি অনুরূপ ব্যবহার করবে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছিল যে প্রত্যাশা পূরণ হয়েছিল। এমনি শত্রুপক্ষ খুব সহজ নিশানায় কাউকে পাওয়ার পরেও গুলি করেনি কিংবা ভুল দিকে গুলি ছুঁড়েছে–এমন দৃষ্টান্তও আছে। টনি এশওয়ার্থ সহ অনেক ইতিহাসবিদই ব্যতিক্রমী ব্যপারটি উল্লেখ করে বই লিখেছেন। স্বার্থের কারণে ঘোর শত্রুদের মধ্যে আপাত সমঝোতার ব্যাপার কিন্তু রণক্ষেত্রের ইতিহাসে অনেক পাওয়া যায়। এমনি একটি উদাহরণ ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ঘটা ‘মলোটোভ-রিবেল্টোপ’ চুক্তি (কমিউনাৎসি চুক্তি হিসেবে কুখ্যাত), যার ফলশ্রুতিতে হিটলারের নাৎসি জার্মানি আর স্ট্যালিনিস্ট রাশিয়ার মধ্যে একধরনের সমঝোতা স্থাপিত হয়। এই সমঝোতার ফলশ্রুতিতে নাৎসি জার্মান সৈন্যরা পোল্যান্ডের একাংশ নিরাপদে অধিকার করে নেয়, আর অন্য অংশ স্ট্যালিনিস্ট রাশিয়া দ্বারা অধিকৃত হয়। পিসা, নারেভ, ভিস্টুলা আর সান নদীর অববাহিকার কিয়দংশ রাশিয়ার ভাগে পড়ে, আর পশ্চিমাংশ থাকে জার্মানির পদতলে। জার্মানি ফ্রান্স অধিকার করে নেয়, লিথুনিয়া এবং পশ্চিম প্রুসিয়ায় সাম্রাজ্য বিস্তার করতে থাকে, আর অন্যদিকে সোভিয়েত রাশিয়া থাবা বসায় পূর্ব ফিনিল্যান্ড, এস্টোনিয়া আর লাটভিয়ার উপর। নিঃসন্দেহে মানবেতিহাসের প্রেক্ষাপটে স্বার্থপর সহযোগিতার (কিংবা সঠিকভাবে বললে দুই স্বার্থপর রাষ্ট্রনায়কদের মধ্যকার সহযোগিতা) নির্জলা সত্য এটি। মানুষের জন্য ‘স্বার্থপর সহযোগিতার’ ব্যাপারটি আমাদের অনেকের মধ্যেই অস্বস্তি তৈরি করলেও জীবজগতে এ ধরনের সহযোগিতার উদাহরণই দৃশ্যমান। বেবুনদের মধ্যে গবেষণা চালিয়ে বিজ্ঞানীরা দেখেছেন যে, দুই পুরুষ বেলুনের মধ্যে সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে উঠে নারী বেবুনের দখল নিতে গিয়ে অপর কোনো শক্তিশালী বেবুনকে বিতাড়িত করতে[২৯৮]। এই সহযোগিতার চুক্তি অনেকটা ‘মলোটোভ-রিবেট্রোপ’ চুক্তির মতোই হয় সাময়িক[২৯৯]। হিটলার যেমন চুক্তি ভেঙে এক সময় সোভিয়েত রাশিয়া আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, ঠিক তেমনি বেবুন সমাজেও শক্তিশালী বেবুনটি বিতারিত হবার পরে চুক্তি ভেঙে শুরু হয় সহযোগী দুই বেবুনের মধ্যে প্রতিযোগিতা-কে সবার আগে নারী বেবুনটির দখল নিতে পারে! একই ধরনের স্ট্র্যাটিজি বিজ্ঞানীরা প্রবলভাবেই প্রত্যক্ষ করেছেন বটলনেক ডলফিনদের মধ্যেও[৩০০]। চুক্তির কথা না হয় বাদ দেই, আমরা যে সহবিবর্তন এবং মিথোজীবীতার উদাহরণগুলো জানি যেমন, শিকারি মাছদের থেকে বাঁচার জন্য ক্লাউন মাছদের সাথে এনিমোনের সহবিবর্তন, হামিং বার্ডের সাথে অর্নিথোপথিলাস ফুলের সহবিবর্তন, এংরাকোয়িড অর্কিডের সাথে আফ্রিকান মথের সহবিবর্তন সেগুলো কিন্তু সবই প্রকারন্তরে স্বার্থপর সহযোগিতারই উদাহরণ। আসলে এ ব্যাপারগুলো প্রকৃতিতে এতোই স্পষ্ট যে অধ্যাপক রিচার্ড ডকিন্স তার আনউইভিং দ্য রেইনবো’বইয়ের নবম অধ্যায়ের শিরোনামই দিয়েছেন–স্বার্থপর সহযোগী (The selfish cooperator)। তিনি পুরো ব্যাপারটিকে দেখেছেন অনেকটা এভাবে[৩০১]—
আমি বরাবরই মনে করেছি যে, জীবজগতের প্রকৃতি বহুলাংশেই পরার্থপরায়ণ, সহযোগিতাপ্রবণ, এমনি অনেক-সময় আবেগপ্রবণও। এগুলো কিন্তু তাদের স্বার্থপর জেনেটিক স্তর থেকেই উদ্ভূত হয়। প্রাণীরা কখনো খুব ভালো (পরার্থ), আবার কখনো খুবই খারাপ (স্বার্থপর)আচরণ করে, আর কখন কোনটা করবে তা নির্ধারিত হয় জেনেটিক স্তরে সর্বোচ্চ হিস্যা আদায়ের নিরিখে। …প্রাণিজগতে পরার্থতা আসলে একটি সুচারু মাধ্যম যার ফলশ্রুতিতে অতলস্পর্শী জিনগুলো নিজ নিজ স্বার্থ সর্বোত্তম উপায়ে চরিতার্থ করতে পারে।
যৌনতা, যৌনতার নির্বাচন এবং পরার্থিতা
আমাদের বিবর্তনীয় যাত্রাপথের খুব কাছের আত্মীয় শিম্পাঞ্জিদের নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে এক অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ করলেন গবেষকেরা। তারা দেখলেন শিম্পাঞ্জিদের মধ্যেও সহযোগিতা দৃশ্যমান, কিন্তু সেটার পেছনে কাজ করে এক ধরনের যৌনাভিলাস। শিম্পাঞ্জিরা শিকার করে, কিন্তু অনেক সময়ই সেই শিকার নিজেদের বা গোত্রের পুষ্টির জন্য নয়, বরং নারীদের আকর্ষণ করে যৌনসঙ্গমে প্রবৃত্ত করার জন্য।
ধরা যাক একদল শিম্পাঞ্জি জঙ্গলে ঘুরতে ফিরতে গিয়ে কলোবাস বানরদের একটা দলের দেখা পেলো। অনেক সময় তারা কলোবাসদের আক্রমণ করে, কখনো বা আবার করে না। আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত অনেক সময়ই নির্ভর করে দলে নারী শিম্পাঞ্জিদের উপস্থিতি এবং আধিক্যের উপর। দলে কোনো যৌনান্মুখ শিম্পাঞ্জি (swollen female chimp) থাকলে নির্ঘাত আক্রমণের সূচনা ঘটে। দক্ষ শিকারিরা সফল অভিযানের পর সাথে করে মাংস নিয়ে আসে সেই সব যৌনান্মুখ নারী শিম্পাঞ্জির জন্য। দেখা গেছে নারী শিম্পাঞ্জিরা সেই সব পুরুষদের প্রতিই থাকে উদার যারা মাংসের ব্যাপারে কোনো কৃপণতা করে না।
ব্যাপারটা কি মানবসমাজের জন্যও প্রযোজ্য? বলা মুশকিল। মাংসের জন্য না হলেও অর্থের বিনিময়ে যৌনতা বিক্রির পেশা যে মানবসমাজে আছে, তা সবারই জানা। শিম্পাঞ্জিদের সমাজে যৌনতার বিপননের মাধ্যম মাংস, মানবসমাজে অর্থ কড়ি। এখন, আদিম মানবসমাজে নৈতিকতার উদ্ভবের পেছনে এ ধরনের কোনো ধরনের যৌনাভিলাস কাজ করেছিল কি না সেটা পরীক্ষার জন্য বিজ্ঞানীরা কিছু আদিম ট্রাইবে গবেষণাকাজ চালিয়েছেন। তাঞ্জানিয়ার অদূরে হাডজা (Hadza) নামে একটি ট্রাইবে গবেষণা চালিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। এই হাডজা মানুষেরা এখনও শিকারি-সংগ্রাহক হিসেবে জীবনযাপন করে। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন সেখানে যে সব পুরুষেরা শিকারে অধিকতর দক্ষ হয়, তারা আবার একই সাথে বহু নারীর প্রণয় অর্জনে সক্ষম হয়।
মনোবিজ্ঞানী জিওফ্রি মিলার তার ‘সঙ্গমী মন’ বইয়ে[৩০২] এবং একটি গবেষণাপত্রে[৩০৩] সম্প্রতি প্রস্তাব করেছেন যে নৈতিকতা এবং মূল্যবোধের মতো গুণাবলিগুলো আসলে যৌনতার নির্বাচনের মাধ্যমে মানবসমাজে বিকশিত হয়েছিল। ব্যাপারগুলো ঘটা অসম্ভব কিছু নয়। সততা, দয়া, মমতা এবং সহমর্মিতার মতো গুণগুলো জাতি, লিঙ্গ এবং সংস্কৃতি নির্বিশেষে মানুষের কাছে আদৃত। আমরা বইয়ের পঞ্চম অধ্যায়ে ডেভিড বাসের বিখ্যাত গবেষণার কথ জেনেছি। সঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে ৩৭ টি দেশের ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতিতে ছেলে এবং মেয়েদের পছন্দের উপর জরিপ চালিয়েছিলেন তিনি[৩০৪]। সেই গবেষণায় নারী-পুরুষ দুই লিঙ্গের কাছেই যে বৈশিষ্ট্যটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে আবির্ভূত হয়েছে তা হলো দয়া। অর্থাৎ, পছন্দের তালিকায় দয়ার স্থান বুদ্ধিমত্তা, সৌন্দর্যসহ অন্যান্য সব কিছুর উপরে। এটা হতেই পারে যে, আমাদের পূর্বপুরুষদের মধ্যে যাদের এই দয়া, মমতা, বিশ্বস্ততার মতো গুণগুলো ছিল তারাই খুব বেশি করে বিপরীত লিঙ্গের মনোযোগ এবং দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছিল, এবং তারাই অধিক হারে এ পৃথিবীতে সন্তানসন্ততি রেখে গেছে। সেজন্যই এখনও যে কোনো সমাজেই দেখা যাবে ভালো মানুষের সংখ্যাই বেশি যারা অন্য মানুষের দুঃখ দুর্দশার প্রতি সংবেদনশীল এবং সহানুভূতিশীল; চোরছ্যাচোড়, গুণ্ডা, বদমায়েশ এবং স্বার্থপরদের সংখ্যাই সমাজে তুলনামূলকভাবে কম থাকে, এবং এ ধরনের লোকজনকে সাধারণত কেউই সঙ্গী হিসেবে নির্বাচন করতে চায় না।
মরাল ল্যান্ডস্কেপ
একটা সময়ে ধর্মবাদীরা একচেটিয়াভাবে নৈতিকতার উৎসের জন্য ধর্ম এবং ঈশ্বরকে সাক্ষীগোপাল হিসেবে উপস্থাপন করতেন। তারা বহুঁকাল ধরেই নৈতিকতার পুরো ব্যাপারটাকে ঈশ্বরিক প্রলেপ লাগিয়ে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছেন এবং দাবি করেছেন এবং এখনও অনেকে করেন) যে, জৈববৈজ্ঞানিকভাবে নৈতিকতা এবং মূল্যবোধের উদ্ভবের মতো ব্যাপারগুলো ব্যাখ্যা করা যাবে না। এগুলোর কোনো জৈবিক ব্যাখ্যা নেই। এগুলোর ব্যাখ্যা একমাত্র ঈশ্বর। কিন্তু তাদের প্রচেষ্টা বৈজ্ঞানিক মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ হয়নি মোটেই, বরং জৈবিক উৎস তথা বিবর্তন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কীভাবে পরার্থিতা কিংবা সহযোগিতার মতো ব্যাপারগুলো প্রাণিজগতে উদ্ভূত হয়েছে এটা যখন থেকে বিজ্ঞানীরা বুঝতে শুরু করেছেন, তখন থেকেই ব্যাপারগুলো বরং অনেক বিজ্ঞানভিত্তিক হয়ে উঠেছে।
শুধু ধার্মিকেরাই নয়, অনেক প্রগতিশীল ব্যক্তিরাও ধার্মিকদের মতো একই ফাঁদে পা দিয়ে বলেন, মানবসমাজের নৈতিকতা ভিন্ন। বিবর্তন দিয়ে এটিকে ব্যাখ্যার কোনো প্রয়োজন নেই। এরাও আসলে ধার্মিকদের মতোই অবচেতন মনে ধরে নেন যে, মানুষ আসলে অন্যান্য প্রাণিজগৎ থেকে আলাদা, যেন স্বর্গীয় কোনো সৃষ্টি! কিন্তু এটি তো ঠিক নয়। মানুষ তো শেষ বিচারে এই জীবজগতেরই অংশ। অন্য প্রাণীতে পরার্থিতা আর নৈতিকতা যে জৈবিক নিয়মে উদ্ভূত হয়েছে, মানুষের মধ্যেও সেই একই উৎসই কাজ করছে, তা এখন শুনতে যতই অস্বাভাবিক লাগুক না কেন। তবে এটা অনস্বীকার্য যে, মানবসমাজ অনেক জটিল। কিন্তু সেই জটিলতা ব্যাখ্যার জন্য জীববিজ্ঞানকে বাদ দেয়ার দরকার নেই। পিঁপড়ে, মৌমাছি কিংবা ডলফিনদের সমাজও জটিল। জটিল শিম্পাঞ্জিদের সমাজও। তাদেরও ভিন্ন ভিন্ন। জটিল সোশাল স্ট্রাকচার আছে। সেগুলো বিজ্ঞানীরা জৈববৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়াতেই বিশ্লেষণ করে চলেছেন। মানবসমাজের বিবিধ জটিলতার উৎসের কারণে নৈতিকতার স্তরে যে পার্থক্যগুলো আছে তা বিভিন্নভাবেই ব্যাখ্যা করা যায় স্বর্গীয় উৎস সরিয়ে রেখে। সম্প্রতি (২০১০ সালে প্রকাশিত) স্যাম হ্যারিস একটি চমৎকার বই লিখেছেন ‘দ্য মরাল ল্যান্ডস্কেপ’ শিরোনামে[৩০৫]। বইটিতে হ্যারিস দাবি করেছেন যে, নৈতিকতা নিয়ে সাম্প্রতিক গবেষণাগুলো আসলে বিজ্ঞানের একটি ‘অবিকশিত শাখা’ (undeveloped branch of science)-এর অংশ। তাই নৈতিকতার ঔচিত্য কিংবা অনুচিত্য নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার এখন বিজ্ঞানের কাঁধেই থাকা উচিত, অশিক্ষিত মোল্লা-পাদ্রী-পুরুতদের কাঁধে নয়। তিনি বলেন,
বিজ্ঞানের কল্যাণে আমরা প্রতিদিনই জানতে পারছি কোনটা সঠিক কোনটা বেঠিক, কোনটা মানবিক, কোনটা অমানবিক, কোনটা পরিবেশ সম্মত কিংবা কোনটা স্বাস্থ্যসম্মত। শতাব্দীপ্রাচীন ধর্মগ্রন্থে লেখা ভুল ভালো বাণী থেকে উঠে আসা মূল্যবোধের চেয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে পাওয়া নৈতিকতাই অধিকতর নির্ভরযোগ্য। পৃথিবীতে যেমন খ্রীষ্টান পদার্থবিদ্যা কিংবা মুসলিম বীজগণিত বলে কিছু নেই ঠিক তেমনি মুসলিম নৈতিকতা কিংবা খ্ৰীষ্টান নৈতিকতা বলাটাও হাস্যকর। আমি দাবি করব, নৈতিকতার গবেষণা বিজ্ঞানেরই অংশ, বিজ্ঞানের এক অবিকশিত শাখা এটি।
সাম্প্রতিক সময়গুলোতে জীববিজ্ঞান, সাংস্কৃতিক এবং বিবর্তনীয় উৎসের সন্ধান করে বহু বৈজ্ঞানিক গ্রন্থ এবং গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে[৩০৬]। এমনকি ডারউইন নিজেও সে সময় জেনেটিক্সের কোনো জ্ঞান ছাড়াই কেবল জীবজগৎ পর্যবেক্ষণ করে সহযোগিতা এবং পরার্থতার বিবর্তনীয় উপযোগিতা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। আধুনিক বিজ্ঞানী, দার্শনিক এবং চিন্তাবিদেরা বহুভাবে দেখিয়েছেন যে এই ডারউইনীয় পদ্ধতিতে প্রাকৃতিকভাবেই পরার্থপ্রায়ণতা, সহযোগিতা, নৈতিকতা আর মূল্যবোধের মতো অভিব্যক্তিগুলো জীবজগতে উদ্ভূত হতে পারে, যা বিবর্তনের পথ ধরে মানবসমাজে এসে আরও বিবর্ধিত আর বিকশিত হয়েছে। গবেষক এলিয়ট সোবার তার একটি সাম্প্রতিক গবেষণাপত্রে উল্লেখ করেছেন[৩০৭],
যদি আমরা বিবর্তনীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও নৈতিকতার ব্যাপারগুলো চিন্তা করি, তারপরেও এটা মনে করার কোনো কারণ নেই যে বিবর্তন মানুষকে কেবল স্বার্থপর এবং অহঙ্কারী হিসেবে গড়ে তুলবে। বরং উল্টোভাবে এটা বরং খুবই সম্ভব যে, প্রাকৃতিক নির্বাচন তাদেরকেই বাড়তি উপযোগিতা দিয়েছিল যারা আত্মম্ভরী কিংবা স্বার্থপর না হয়ে গোত্রের মধ্যে সহযোগিতামূলক ব্যবহার প্রদর্শন করেছিল।
আমরা অধ্যায়ের শুরুতে স্যামুয়েল বাওয়েলের বিবর্তন মনোবিজ্ঞান নিয়ে একটি মজার কিন্তু গুরুত্বপুর্ণ গবেষণার উল্লেখ করেছিলাম। সেখানে আবারো ফিরে যেতে হচ্ছে। বাওয়েলের গবেষণায় বেরিয়ে এসেছিল যে, মূঢ় সহিংসতা থেকেই সম্ভবত একসময় জন্ম হয়েছে মূঢ় পরার্থিতার। এলিয়ট সোবারের মতো স্যামুয়েল বাওয়েলও মনে করেন, প্রতিকূল পরিস্থিতিতে যে গোত্রের সদস্যরা অনেক বেশি নিজেদের মধ্যে সাহায্য সহযোগিতা করেছে, তারাই প্রাকৃতিক নির্বাচনের ছাঁকুনিতে তারাই টিকতে পেরেছে অন্যদের চেয়ে বেশি। কাজেই পরার্থিতার মতো অভিব্যক্তিগুলো সমাজে এক সময় না একসময় উদ্ভূত না হবার কোনো কারণ নেই। মানবসমাজে এটির উদ্ভবের পরে সেটার বিকাশ এবং বৃদ্ধি তো স্রেফ সময়ের ব্যাপার। সমাজে সুগুণের প্রাতিষ্ঠানিক চর্চা, দুর্বলদের রক্ষার জন্য এক সময় রাষ্ট্রের উদ্ভব, গণতান্ত্রিক আইনের প্রয়োগ, শিক্ষার প্রসার, নারী অধিকার, সাংস্কৃতিক অগ্রসরতা প্রভৃতি মানব নৈতিকতাকে ভিন্ন একটি মাত্রায় নিয়ে গেছে নিঃসন্দেহে। আমাদের আধুনিক মূল্যবোধগুলো যে প্রতিদিনের সামাজিক মিথস্ক্রিয়া থেকেই উদ্ভূত এবং উৎসারিত, দার্শনিক পল কার্জের ‘নিষিদ্ধ ফল :মানবিকতার মূল্যবোধ গ্রন্থে এই মতের সুস্পষ্ট সমর্থন মেলে[৩০৮]।
প্রখ্যাত মনোবিদ, বিজ্ঞানের দার্শনিক এবং স্কেপটিক ম্যাগাজিনের প্রতিষ্ঠাতা মাইকেল শারমার মানবসমাজে মুল্যবোধ এবং নৈতিকতার অভিব্যক্তি নিয়ে আলাদা করে ভেবেছেন এবং এ নিয়ে লিখেছেন। তিনি তার ‘দ্য সায়েন্স অব গুড এন্ড এভিল’ গ্রন্থে ব্যাখ্যা করেছেন সমাজ বিকাশের প্রয়োজনেই মানুষ কিছু নীতিকে থম থেকে ‘গোল্ডেন রুল’ হিসেবে গ্রহণ করেছিল[৩০৯]–
Do unto others, as you would have them do unto you. (অন্যদের প্রতি সেরকম ব্যবহারই করো যা তুমি তাদের থেকে পেতে চাও)
কারণ এই নীতির অনুশীলন ছাড়া কোনো সমাজ ব্যবস্থা টিকে থাকবে না। মাইকেল শারমার তার গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, মানব বিবর্তনের ধারাতেই পারস্পরিক প্রতিযোগিতার পাশাপাশি আবার নৈতিকতা, মূল্যবোধ, সহনশীলতা, উদারতা, স্বার্থত্যাগ, সহানুভূতি, সমবেদনা প্রভৃতি গুণাবলির চর্চা হয়েছে। সভ্যতার প্রতিনিয়ত সংঘাত ও সংঘর্ষেই গড়ে উঠেছে মানবীয় প্রোভিশনাল এথিক্স’, যা মানুষকে প্রকৃতিতে টিকে থাকতে সহায়তা করেছে। আমরা এখনও মানবিকতার কষ্টিপাথরে নিজেদের মূল্যবোধ প্রতিনিয়ত বাড়িয়ে চলেছি। বিগত কয়েক শতকের সামাজিক বিবর্তন পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে আমরা আমাদের মানবিক মূল্যবোধগুলোকে বাড়িয়ে নিতে পেরেছি বহুক্ষেত্রেই। এখন আর কালো মানুষদের দেখলে ‘নিগ্রো শব্দটি উচ্চারণ করি না, বাংলাদেশে ‘উপজাতি’র বদলে লিখি ‘পাহাড়ি জনগোষ্ঠি। আমরা জীর্ণশীর্ণ পুরাতন মূল্যবোধগুলোকে প্রতিনিয়ত প্রশ্নবিদ্ধ করে সেগুলোর সংস্কার করতে পেরেছি। সাড়া বিশ্বজুড়েই নারীবাদী আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে জেন্ডার সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে, বুদ্ধি পেয়েছে বৃদ্ধ কিংবা শিশু অধিকারের প্রতি দায়দায়িত্বও। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকার-সচেতনতা, সমকামী এবং রূপান্তরকামীদের প্রতি সহমর্মিতাসহ অনেক মূল্যবোধই আজকে খুব ভালোভাবে চোখে পড়ে, যেগুলো কয়েক দশক আগেও ছিল একেবারেই অনুপস্থিত। রিচার্ড ডকিন্স তার ‘গড ডিলুশন’ গ্রন্থের চতুর্থ অধ্যায়ে ‘Natural Selection as a consciousness Raiser অংশে মতামত ব্যক্ত করেছেন যে, আসলে ডারউইনীয় সিলেকশনের মতোই এক ধরনের নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমরা আমাদের মূল্যবোধগুলোকে ক্রমশ বাড়িয়ে তুলছি, ঠিক যেভাবে প্রাকৃতিক নির্বাচন নামের ডারউইনীয় সিলেকশন প্রক্রিয়ায় সরল জীব থেকে উদ্ভূত হয়েছে জটিল জীবজগতের[৩১০]। নৈতিকতা এবং মূল্যবোধের ক্রমিক চর্চার মাধ্যমে জৈববৈজ্ঞানিক পথে আমরা প্রতিদিনই নিজেদের অগ্রসর করছি, জাগিয়ে তুলছি আমাদের সুপ্ত মানবতাবোধকে।
“ভালোবাসা কারে কয়” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ