বোম্বের হাসপাতালে বহু বিদেশী ডিগ্রীধারী এক প্রতিভাবান ডাক্তার রয়েছেন, রমাকান্ত কোনি। তিনি বৃদ্ধ-অবস্থায় যে কোন ধরনের রোগ নিবারণে বিশেষজ্ঞ। প্রথম জীবনে অ্যালোপ্যাথি পদ্ধতিতেই চিকিৎসা শুরু করেছেন। ডাঃ রমাকান্ত কোনি সারস্বত ব্রাহ্মণ হলেও বিবাহ করেছেন অন্ধ্রের প্রসিদ্ধ অভিনেত্রী রম্ভাকে, যিনি ছিলেন গৌড়-ব্রাহ্মণ।

১৯৭২ সনে ডাঃ কোনি কোমরের স্পনডিলোসিস-এ আক্রান্ত হয়ে অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে পড়েন। মেরুদন্ডের অসহ্য ব্যথার দরুন তিনি শয্যাগত হন। ভাবলেন, বাঁকি জীবনটা বোধহয় বিছানায় শুয়েই কাটাতে হবে। সে সময় তাঁর জনৈক বয়স্ক বন্ধু তাঁকে হ্যারি এডওয়ার্ডের কাছে আরোগ্য কামনা করে চিঠি লেখার জন্য উৎসাহিত করলেন। আধুনিক মনোভাবাপন্ন এবং সুশিক্ষিত হওয়ার দরুন তিনি এ বিষয়টি প্রথমে বিন্দুমাত্র বিশ্বাসযোগ্য মনে করতে পারেন নি। কিন্তু বন্ধুর কথা রাখবার জন্য তিনি তাঁকে চিঠি লিখলেন। নিজের এবং অন্যান্য দাক্তারদের এ বিষয় আশ্চর্য ভাবান্তর দেখা দিল এবং তিনি খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠলেন।

 

বিচিত্র ঘটনা

১৯৭২ সনে একটি বিচিত্র ঘটনা ঘটে। এতে ডাক্তার রমাকান্ত কোনির জীবনে নতুন এক অধ্যায় শুরু হয়। এ অবস্থায় তাঁর একটি ‘সিয়ানস’ দেখার সুযোগ হল। ঘর অল্প অন্ধকার ছিল। লোকেরা চেয়ারে গোল হয়ে বসে ছিলেন। মধ্যস্থলে যে মিডিয়াম,

ডাঃ রমাকান্ত কোনি

সে ঘুরে ঘুরে এক একটি লোকের কাছে এসে তাঁদের মৃত আত্মীয়স্বজনদের সম্বন্ধে সংবাদ দিয়ে যাচ্ছিলেন। এক সময় ঘুরে এসে ডাঃ কোনির সামনে দাঁড়ালেন। এবং বললেন ‘আমার বিদেহী মার্গদর্শক জানাচ্ছেন যে আপনাকে রোগ উপশম করার প্রতিনিধি (যন্ত্র) সাব্যস্ত করা হয়েছে, যাতে আপনার মাধ্যমে বিদেহী ডাক্তার দ্বারা রোগীর রোগ উপশম করা যায়। বারবার তাঁকে এ কথা বলা হল। তিনি বললেন ‘আপনি নিজের মন হতে সাব্যস্ত সন্দেহ, শঙ্কা ও দ্বন্দ্ব দূর করে ফেলুন।‘

এই বৈঠকের পর আমার মনে এক অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া হল। মনে হল কেউ যেন আমার অন্তরে অফুরন্ত শক্তি জুগিয়ে দিয়েছে। আমি যেন মাইলের পর মাইল দৌড়ে চলে যেতে পারি। আমার পিঠে যেন দুটো ডানা লাগান হয়েছে। আমার মনের এই বিচিত্র আত্মবিশ্বাস ও আনন্দ উপলব্ধি করে আমি প্রায় উন্মাদ হয়ে উঠলাম। আমার হাতের ছোঁয়া মাত্র রোগী নীরোগ হয়ে উঠবে বলে মনে হতে লাগল। করতল উষ্ণ হয়ে উঠল। আঙ্গুলের প্রান্তগুলোতে যেন তরঙ্গ বয়ে যেতে লাগল। চোখ বুজতেই জ্যোতিময় বিশ্ব ব্রহ্মান্ডতে স্ফুলিঙ্গের ছটা দেখা দিতে লাগল। এই বিচিতে অনুভূতির কথা তিনি তাঁর নিজের লেখা বই ‘সাইকো হিলিং’ –এ বর্ণনা করেছেন। এরপর তিনি বোম্বের একজন সুবিখ্যাত মিডিয়ামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন। তাঁর সহযোগিতায় নিজের বিদেহী মার্গদর্শক সম্বন্ধে অনেক আলোচনা করলেন। সূক্ষ্মলোক নিবাসী তিনি দুশো বৎসর আগে এ লোকে থাকাকালীন অবস্থায় সার্জারি ও ডাক্তারি করে গেছেন এবং এখনও তিনি পরলোক অবস্থান করে নানা প্রকার অনুসন্ধান করে চলেছেন। তিনি এরূপ ক্ষমতাসম্পন্ন যশস্বী ডাক্তার ছিলেন যে জটিল রোগাক্রান্ত ব্যক্তিকে স্পর্শ করা মাত্র বুঝতে পারতেন রোগী কোন রোগে আক্রান্ত হয়েছে। ডাক্তার কোনিকে মাধ্যম হিসেবে উপযোগী করে তাঁর ক্ষমতার সদ্ব্যবহার করে তিনি রোগ উপশম করেন। ডাঃ কোনি যখন রোগীর স্পর্শ করেন তাঁর আঙ্গুলগুলো রোগীর রোগাক্রান্ত স্থানটির প্রতি আকর্ষণ অনুভব করে এবং তিনি খুব তাড়াতাড়ি রোগ নির্ণয় করে ফেলেন। ওষুধ লেখাবার সময়ও তিনি অনুভব করেন যেন কেউ তাঁর হাত ধরে ওষুধগুলোর নাম লিখিয়ে নিচ্ছেন যেমন ‘অটোমেটিক রাইটিং’ –এ লেখা হয়। অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন ও অ্যালোপ্যাথি ডিগ্রী বিভূষিত এই আধুনিক ডাক্তার ভদ্রলোক না জানি কত দুরুহ রোগীর রোগ নিরাময় করে তাদের সুস্থ সবল করেছেন। অনেক কঠিন রোগ নিরাময় করার সম্বন্ধে বর্ণনা তাঁর ফাইলে লিপিবদ্ধ রয়েছে। মাত্র অ্যাবসেন্ট হিলিং দ্বারাই তিনি ১৯৮১ সন পর্যন্ত ২৭০০ রোগীর রোগ উপশম করেছেন। ভারতে শুধু বোম্বের হাসপাতালেই এই স্পিরিচুয়াল হিলিং-এর ব্যবস্থা রয়েছে।

 

কনট্যাক্ট হিলিং

যে সব রোগী নানা পদ্ধতিতে নিজেদের চিকিৎসা করিয়ে শ্রান্ত ও নিরাশ হয়ে পড়েন তাঁরাই অবশেষে ডাঃ কোনির কাছে আসেন বিদেহী চিকিৎসার জন্য। বিশ্বাসের অভাব তো রয়েছেই তাদের মনে, তবু তাঁরা শঙ্কিত হৃদয়ে এই চিকিৎসা পদ্ধতিটিকেও যাচাই করে নিতে চান। অন্যান্য চিকিৎসা ক্ষেত্রে তাঁরা ধৈর্য সহকারে সুস্থ হওয়ার আশা রাখেন। তবে বিদেহী আত্মার দ্বারা চিকিৎসা করাতে এসে মনে করেন যেন তাঁদের অসুস্থতা জাদুমন্ত্রে উড়ে যাবে এবং সম্পূর্ণ নীরোগ হয়ে খুব তাড়াতাড়ি হাসপাতাল হতে বেড়িয়ে আসবেন। কিন্তু এ ব্যবস্থায় যে কোন রোগ যতদিনকারই হোক সারার কথা, তাতে ধৈর্য হারালে চলে না।

 

প্রতিবেদন প্রসঙ্গে কিছু কথা

প্রতিবেদনটির শুরুতে প্রতিবেদক মৃত্যুর পর আত্মা বাস্তবিকই কি করে- বলতে গিয়ে যা বলেছেন তা একান্তভাবেই প্রতিবেদকের নিজস্ব বিশ্বাসের কথা। তাঁর এই বিশ্বাসের পিছনে কোনও পরীক্ষা, পর্যবেক্ষণ কাজ করেনি। যুক্তি বা বিজ্ঞান সিদ্ধান্তে পৌঁছায় পরীক্ষা, পর্যবেক্ষণের পথ ধরে। বিশ্বাস চলে আপন খেয়াল-খুশিতে। কখনো বহু লোকে বিশ্বাস করে, বিখ্যাত ব্যক্তিরা বিশ্বাস করেন, এই কু-যুক্তিতে মানুষ অন্ধভাবে কোনও কিছুতে বিশ্বাস স্থাপন করেন। কখনো শাস্ত্রবাক্য, গুরুবাক্য ইত্যাদিকে অভ্রান্ত বলে ধরে নেওয়া থেকে সৃষ্টি হয় অন্ধ বিশ্বাস। বিশ্বাসের সঙ্গে যুক্তির লড়াই জন্মলগ্ন থেকেই। কারও একান্ত ব্যক্তি বিশ্বাস কখনোই বিজ্ঞানের সত্য হয়ে উঠতে পারে না, তা সেই বিশ্বাস আইনস্টাইন, রবীন্দ্রনাথ বা সত্যজিৎ রায় যারই হোক না কেন। যুক্তির সত্য, বিজ্ঞানের সত্য প্রতিটি ক্ষেত্রেই আসবে পরীক্ষা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমেই।

এই প্রসঙ্গে একটি ঘটনা মনে পড়ে গেল। কলিকাতা পুস্তকমেলা ৯০-এ আমাদের সমিতিও আসর জাঁকিয়ে বসেছিল এক রঙ্গিন ছাতার তলায়। প্রতিদিনই আমরা নানা অনুষ্ঠান ও প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে জনসাধারণের কাছে পৌঁছতে চেষ্টা করছিলাম। এক সন্ধ্যায় এক বিশপ আমাদের সামনে কিছু প্রশ্ন তুলেছিলেন। এই ধরনের প্রশ্ন আরও বহু ভাববাদীদের কাছ থেকে আসার সম্ভাবনা আছে বলেই প্রসঙ্গটির অবতারণা করছি।

বিশপ আমাকে বলেছিলেন, “কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিশ্বাস রাখতেই হয়, এমনই একটি ক্ষেত্র ঈশ্বর। ঈশ্বরকে বিশ্বাসের পাওয়া যায় যুক্তিতে নয়। যুক্তিতে সব কিছু প্রমাণ করা যায় না। আপনার বাবারই যে আপনি ছেলে তা কি আপনি প্রমাণ করতে পারেন? পারেন না। এখানে আপনাকে বিশ্বাসের উপরই নির্ভর করতে হয়।“

বলেছিলাম, গর্ভধারণ যিনি করেছেন তিনিই আমার মা। এবং তাঁর স্বামীকেই আইনত আমি ও সমাজ বাবা বলে স্বীকার করে নিয়েছে। নিশ্চয়ই যুক্তির দিক থেকে যে কোনও সন্তানেরই জন্ম হতে পারে সাধারণত সক্ষম নারী-পুরুষের মিলনে। সেই মিলন বিবাহিত স্বামীর সঙ্গে না হতেও পারে। এই সম্ভাবনা আপনার আমার সবার ক্ষেত্রেই থাকতে পারে। কিন্তু আমরা আমাদের জন্মদাতা নন, আমাদের পিতাকেই নির্দেশ করি পরিচয়দানের ক্ষেত্রে। আর পিতা সব সময় মায়ের বিবাহিত স্বামী। আমার জন্মদাতা আমারই পিতা কি না এই ধরনের চিন্তার দ্বারা বা অনুসন্ধানে নেমে সত্যকে আবিষ্কার করতে পারা বা না পারার মধ্যে কি আসে যায়?

ডাঃ রমাকান্ত কোনি প্রসঙ্গে বরং এবার আসা যাক। ডাঃ কোনির দাবির সমর্থনে প্রমাণ চেয়ে ৮৪-র ২৪ ফেব্রুয়ারী, ২৮ মার্চ দুটি চিঠি দিই। প্রথম চিঠিটি এখানে তুলে দিচ্ছি।

ডাঃ রমাকান্ত কোনি                              প্রবীর ঘোষ

বোম্বে হাসপাতাল                                  ৭২/৮, দেবীনিবাস রোড

মেডিকেল রিসার্চ সেন্টার                      কলকাতা-৭০০ ০৭৪

৩য় তল, বোম্বে-৪০০ ০২০

 

প্রিয় ডাঃ কোনি,

সম্প্রতি আপনি ভারতবর্ষের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রচুর পাওয়া এক ‘ফেইথ হিলার’। আপনিও ফিলিপিনো ফেইথ হিলারদের মতই দাবি করেন অলৌকিক ক্ষমতার দ্বারা বিদেহী ডাক্তারদের সাহায্যে রোগীদের রোগমুক্ত করেন।

আমার ধারণা, যে সব রোগীদের Placebo চিকিৎসার দ্বারা অর্থাৎ বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে রোগমুক্ত করা সম্ভব আপনি কেবলমাত্র তাঁদেরই বিনা ওষুধে রোগমুক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন এবং হবেন। অথবা ‘বিদেহী ডাক্তার রোগীর প্রয়োজনীয় ওষুধের নাম লিখেছে’, দাবি করলেও বাস্তবে চিকিৎসা বিষয়ক জ্ঞানকে কাজে লাগিয়েই আপনি ব্যবস্থাপত্র লিখছেন। যে ব্যবস্থাপত্র অনুসারে চিকিৎসা করিয়ে রোগীরা রোগমুক্ত হচ্ছেন।

আপনি কি বাস্তবিকই দাবি করেন- বিদেহী ডাক্তারের আত্মাকে কাজে লাগিয়ে যে কোনও রোগীকে রোগমুক্ত করতে আপনি সক্ষম?

আমি অলৌকিক ক্ষমতা বিষয়ে জানতে আগ্রহী সত্যানুসন্ধানী। তথাকথিত অলৌকিকতার পিছনে লৌকিক রহস্য কি, এই বিষয়ে কিছু পত্র-পত্রিকায় লিখেও থাকি। দীর্ঘদিন ধরে বহু অনুসন্ধান চালিয়েও আজ পর্যন্ত একজন অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারীর সন্ধান পাইনি। প্রতিটি ক্ষেত্রেই দেখেছি ওইসব তথাকথিত অলৌকিক ক্ষমতার দাবিদারদের প্রত্যেকেরই ক্ষমতার পিছনে কোনও অলৌকিকত্ব ছিল না, ছিল লৌকিক কৌশল।

আমার এই ধরনের সত্যকে জানার সদিচ্ছা ও শ্রমকে নিশ্চয়ই আপনি একজন সৎ মানুষ হিসেবে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বাগত জানাবেন। আপনার অলৌকিক চিকিৎসা ক্ষমতার বিষয়ে আমি একটি অনুসন্ধান চালাতে চাই। আশা রাখি সত্য প্রকাশের স্বার্থে আপনি আমার সঙ্গে আন্তরিকতার সঙ্গে সহযোগিতা করবেন।

আমি আপনার কাছে তিনজন রোগীকে হাজির করতে চাই। আপনার অলৌকিক ক্ষমতায় ওই তিনজনকে ছয় মাসের মধ্যে রোগমুক্ত করতে সক্ষম হলে আপনার অলৌকিক ক্ষমতাকে স্বীকার করে নিয়ে আপনাকে দেব দশ হাজার টাকা।

আপনি আমার সঙ্গে সহযোগিতা না করলে বা চিঠি পাঠাবার এক মাসের মধ্যে আমার সঙ্গে যোগাযোগ না করলে অবশ্যই ধরে নেব, আপনার দাবি একান্তই মিথ্যা। আপনি লৌকিক উপায়েই কিছু কিছু রোগীর রোগমুক্তি ঘটিয়ে থাকেন মাত্র।

শুভেচ্ছাসহ

প্রবীর ঘোষ

কোনি তাঁর অলৌকিক ক্ষমতার বিষয়ে সত্যানুসন্ধানে সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসেননি। কারণ এগিয়ে এসে পরাজিত হওয়ার চেয়ে এড়িয়ে যাওয়াকেই শ্রেয় মনে করেছিলেন, যেমন আরও অনেক ‘ক্ষমতাধরেরাই’ করেন।

error: Content is protected !!
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x