শ্লোকঃ ২৫
নাহং প্রকাশঃ সর্বস্য যোগমায়াসমাবৃতঃ ৷
মূঢ়োহয়ং নাভিজানাতি লোকো মামজমব্যয়ম্ ॥ ২৫ ॥
ন—না; অহম্—আমি; প্রকাশঃ – প্রকাশিত সর্বসা – সকলের কাছে, যোগমায়া- অন্তরঙ্গা শক্তির দ্বারা; সমাবৃতঃ – আবৃত; মূঢ়ঃ- মূঢ়: অয়ম্—এই ন-না; অভিজানাতি- – জানতে পারে; লোকঃ ব্যক্তিরা, মাম্ আমাকে; অজম্— জন্মরহিত; অব্যয়ম্—অব্যয়।
গীতার গান
উপরোক্ত মূঢ় লোক নাহি দেখে মোরে ।
আমি যে অব্যয় আত্মা অজর অমরে ॥
অনুবাদঃ আমি মূঢ় ও বুদ্ধিহীন ব্যক্তিদের কাছে কখনও প্রকাশিত হই না। তাদের কাছে আমি আমার অন্তরঙ্গা শক্তি যোগমায়ার দ্বারা আবৃত থাকি। তাই, তাঁরা আমার অজ ও অব্যয় স্বরূপকে জানতে পারে না।
তাৎপর্যঃ অনেক সময় অনেকে মুক্তি দেখায় যে, শ্রীকৃষ্ণ যখন এ পৃথিবীতে ছিলেন, তখন তিনি সকলেরই গোচরীভূত ছিলেন, তা হলে এখন তিনি সবার সামনে প্রকট হন না কেন? কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনি সকলের কাছে প্রকাশিত হননি। শ্রীকৃষ্ণ যখন এই বসুন্ধরায় অবতরণ করেছিলেন, তখন কয়েকজন দুর্লভ মহাত্মাই কেবল তাঁকে পরমেশ্বর ভগবান বলে জানতে পেরেছিলেন। কৌরব সভায়, যখন শিশুপাল সভার অধ্যক্ষরূপে শ্রীকৃষ্ণকে নির্বাচিত করণের বিরোধিতা করেন, তখন ভীষ্মদেব শ্রীকৃষ্ণকে সমর্থন করে তাঁকে পরমেশ্বর ভগবান বলে ঘোষণা করেন। সেই রকম পঞ্চপাণ্ডব তাদি কিছু সংখ্যক মহাত্মাই কেবল তাঁকে পরমেশ্বর ভগবানরূপে জানতে পেরেছিলেন, সকালে পারেনি। অভক্ত ও সাধারণ মানুষের কাছে তিনি প্রকাশিত হননি। তাই ভগবদ্গীতাতে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন যে, তাঁর শুদ্ধ ভক্ত ছাড়া আর সকলেই তাকে তাদেরই মতো একজন বলে মনে করে। তিনি কেবল তাঁর ভক্তদেরই কাছে সমস্ত আনন্দের উৎসরূপে নিজেকে প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু অল্প-বুদ্ধিসম্পন্ন অভক্তদের কাছে তিনি নিজেকে যোগমায়ার দ্বারা আবৃত করে। রেখেছিলেন।
শ্রীমদ্ভাগবতে (১/৮/১৯) কুন্তীদেবী তাঁর প্রার্থনায় বলেছেন যে, ভগবান যোগমায়ার যবনিকার দ্বারা নিজেকে আবৃত করে রাখেন, তাই সাধারণ মানুষ তাঁকে জানতে পারে না। যোগমায়ার আবরণ সম্পর্কে শ্রীঈশোপনিষদেও (মাত্র ১৫) প্রতিপন্ন করা হয়েছে, যেখানে ভক্ত প্রার্থনা করছেন—
হিরণয়েন পাত্রেণ সতাস্যাণিহিত্য মুখম্ ।
তং তং পুপাবৃণু সত্যধর্মায় দৃষ্টায় ॥
“হে ভগবান! ভুমিই সমস্ত ব্রহ্মাণ্ডের প্রতিপালক। তোমাকে ভক্তি করাই হচ্ছে পরম ধর্ম। তাই, আমি তোমার কাছে প্রার্থনা করি যেন তুমি আমাকেও পালন কর। তোমার অপ্রাকৃত রূপ যোগমায়ার দ্বারা আচ্ছাদিত। ব্রহ্মজ্যোতিই তোমার অন্তরঙ্গা শক্তির আবরণ। কৃপা করে তুমি তোমার এই জ্যোতির্ময় আবরণকে উন্মোচিত করে তোমার সচ্চিদানন্দ বিগ্রহের দর্শন দান কর।” ভগবানের সচ্চিদানন্দ বিগ্রহ তাঁর চিন্ময়-শক্তি ব্রহ্মজ্যোতির দ্বারা আচ্ছাদিত এবং এই কারণেই অল্প- বুদ্ধিসম্পন্ন নির্বিশেষবাদীরা ভগবানকে দেখতে পায় না।
শ্রীমদ্ভাগবতেও (১০/১৪/৭) ব্রহ্মা তাঁর প্রার্থনায় বলেছেন, “হে পরম পুরষোত্তম ভগবান। হে পরমাত্মন। হে সমস্ত রহস্যের স্বামীন। এই জগতে আপনার শক্তি ও নীলা কে হিসাব করতে পারে। আপনি সর্বদাই আপনার অন্তরঙ্গা শক্তির বিস্তার করছেন, তাই কেউই আপনাকে বুঝতে পারে না। বিদ্বান বৈজ্ঞানিকেরা ও পন্ডিতেরা এই পৃথিবীর ও অন্যান্য গ্রহের সমস্ত অণু-পরমাণুর হিসাব করতে পারলেও, কিন্তু তবুও তারা কখনই তোমার অনন্ত শক্তির হিসাব করতে পারে না, যদিও তুমি সকলের সামনে বিদ্যমান।” পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কেবল অজই নন, তিনি অব্যয়ও। তাঁর শ্রীবিগ্রহ সচ্চিদানন্দময় এবং তাঁর সমস্ত শক্তি অক্ষয় অব্যয়।
শ্লোকঃ ২৬
বেদাহং সমতীতানি বর্তমানানি চার্জুন ।
ভবিষ্যাণি চ ভূতানি মাং তু বেদ ন কশ্চন ৷৷ ২৬ ॥
বেদ—জানি; অহম্—আমি; সমতীতানি—সম্পূর্ণরূপে অতীত; বর্তমানানি—বর্তমান; চ—এবং অর্জুন—হে অর্জুন, ভবিষ্যাণি – ভবিষ্যৎ, চ–ও ভূতানি — জীবসমূহ; নাম্—আমাকে, তু—কিন্তু বেদ — জানে; ন–না; কশ্চন—কেউই।
গীতার গান
আমার আনন্দরূপ নিত্য অবস্থিতি ৷
সে কারণে হে অর্জুন ত্রিকালবিধিতি ॥
বর্তমান ভবিষ্যৎ অথবা অতীত ।
সমস্ত কালের গতি আমাতে বিদিত ॥
কিন্তু মূঢ় লোক যারা নাহি জানে মোরে ।
ঈশ্বর পরম কৃষ্ণ বিদিত সংসারে ॥
অনুবাদঃ হে অর্জুন। পরমেশ্বর ভগবানরূপে আমি অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে সম্পূর্ণরূপে অবগত। আমি সমস্ত জীব সম্বন্ধে জানি, কিন্তু আমাকে কেউ জানে না।
তাৎপর্যঃ ভগবানের রূপ নির্বিশেষ না সবিশেষ, সেই সম্বন্ধে এখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। নির্বিশেষবাদীদের ধারণা অনুযায়ী শ্রীকৃষ্ণের রূপ যদি মায়া হত তা হলে আর সমস্ত জীবের মতো তারও দেহান্তর হত এবং তার ফলে তিনি তাঁর পূর্বজীবনের সব কথা ভুলে যেতেন। জড় শরীর-বিশিষ্ট কেউই তাঁর পূর্বজন্মের কথা মনে রাখতে পারে না এবং তার ভবিষ্যৎ জন্ম সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে না, তা ছাড়া তার বর্তমান জীবনের পরিণাম সম্পর্কেও পূর্বাভাস দিতে অক্ষম। অতএব সে তার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে অজ্ঞ। জড় জগতের কলুষ থেকে মুক্ত না হতে পারলে কেউই অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে অবগত হতে পারে না।
সাধারণ মানুষের সঙ্গে যাঁর তুলনা হয় না, সেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ স্পষ্টভাবে বলেছেন যে, তিনি পূর্ণরূপে জানেন অতীতে কি হয়েছিল, বর্তমানে কি হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও কি হবে। চতুর্থ অধ্যায়ে আমরা দেখেছি যে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কোটি কোটি বছর আগে সূর্যদেব বিবস্বানকে যে উপদেশ দিয়েছিলেন, তা সম্পূর্ণরূপে তাঁর মনে আছে। শ্রীকৃষ্ণ প্রতিটি জীব সম্বন্ধেই জানেন, কারণ তিনি পরমাত্মারূপে প্রতিটি জীবেরই অন্তরে বিরাজ করছেন। কিন্তু যদিও তিনি পরমাত্মারূপে প্রতিটি জীবের অন্তরে এবং এই জগতের অতীত ভগ্নবং-ধামে ভগবৎ-স্বরূপে বিরাজ করছেন, তবুও অন্ন-বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরা তাঁকে নির্বিশেষ ব্রহ্মরূপে উপলব্ধি করতে পারলেও, পরমেশ্বর ভগবান বলে চিনতে পারে না। ভগবানের দিব্য শ্রীবিগ্রহ অবিনশ্বর ও নিতা। ভগবান হচ্ছেন ঠিক সূর্যের মতো এবং মায়া একটি মেঘের মতো। জড় আকাশে আমরা দেখতে পাই যে, সূর্য আছে, মেঘ আছে ও গ্রহ- নক্ষত্র আছে। আমাদের সীমিত দৃষ্টির জন্যই আমরা মনে করি যে, সূর্য, চন্দ্র আদিকে মেঘ ঢেকে ফেলে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সূর্য, চন্দ্র ও নক্ষত্র কখনই আচ্ছাদিত হয় না। তেমনই, মায়াও কখনই পরমেশ্বর ভগবানকে আচ্ছাদিত করতে পারে না। ভগবান তাঁর অন্তরঙ্গা শক্তির প্রভাবে অল্প-বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের কাছে নিজেকে প্রকাশ করেন না। এই অধ্যায়ের তৃতীয় শ্লোকে ভগবান বলেছেন যে, কোটি কোটি মানুষের মধ্যে কয়েকজন দুর্লভ ব্যক্তি এই মানবজন্মে সিদ্ধি লাভের প্রয়াসী হয় এবং এই রকম হাজার হাজার সিদ্ধ-পুরুষের মধ্যে কোন একজন কেবল ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণকে তত্ত্বত জানতে সক্ষম হন। এমন কি যদিও কেউ নির্বিশেষ ব্রহ্ম অথবা হৃদয়াভান্তরে অবস্থিত পরমাত্মাকে উপলব্ধি করতে পারে, কিন্তু কৃষ্ণভাবনামৃত ব্যতীত পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে কখনই জানতে পারা যায় না।
শ্লোকঃ ২৭
ইচ্ছাদ্বেষসমুত্থেন দ্বন্দমোহেন ভারত ৷
সর্বভূতানি সম্মোহং সর্গে যান্তি পরন্তপ ॥ ২৭ ॥
ইচ্ছা—বাসনা; দ্বেষ— দ্বেষ, সমুখেন— উদ্ভূত, দ্বন্দু দ্বন্দু, মোহেন মোহের দ্বারা, ভারত – হে ভারত; সর্ব— সমস্ত ভূতানি — জীবসমূহ, সম্মোহন – মোহাচ্ছন সর্গে—সৃষ্টির সময়ে; যান্তি — প্রাপ্ত হয়; পরন্তপ – হে শত্রু নিপাতকারী।
গীতার গান
দুর্ভাগা যে লোক সেই দ্বন্দুেতে মোহিত ।
ইচ্ছা দেয় দ্বারা তারা সংসারে চালিত ॥
অতএব হে ভারত তারা জন্মকালে ।
পূর্বাপূর্ব সংস্কারের সর্বদা কবলে ।৷
অনুবাদঃ হে ভারত। হে পরন্তপ। ইচ্ছা ও দ্বেষ থেকে উদ্ভূত দ্বন্দ্বের দ্বারা বিভ্রান্ত হয়ে সমস্ত জীব মোহাচ্ছন্ন হয়ে জন্মগ্রহণ করে।
তাৎপর্যঃ জীবের যথার্থ স্বরূপ হচ্ছে যে, সে শুদ্ধ জ্ঞানময় ভগবানের নিত্য দাস। কেউ যখন মোহাচ্ছন্ন হয়ে এই শুদ্ধ জ্ঞান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, তখন সে মায়ার কবলিত হয় এবং পরমেশ্বর ভগবানকে জানতে পারে না। মায়ার অভিব্যক্তি হয় ইচ্ছা, দ্বেষ আদি দ্বন্দ্বের মাধ্যমে। ইচ্ছা ও দ্বেষের প্রভাবেই অজ্ঞানী মানুষ ভগবানের সঙ্গে এক হয়ে যেতে চায় এবং পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে হিংসা করতে শুরু করে। যাঁরা ইচ্ছা ও দেষের মোহ অথবা কলুষ থেকে মুক্ত, ভগবানের সেই শুদ্ধ ভক্তেরা বুঝতে পারেন যে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর অন্তরঙ্গা শক্তির প্রভাবে এই জড় জগতে অবতীর্ণ হন, কিন্তু যারা দ্বন্দ্ব ও অজ্ঞানতার দ্বারা (মোহাচ্ছন্ন, তারা মনে করে যে, জড়া শক্তি থেকেই পরম পুরুষোত্তম ভগবানের সৃষ্টি হয়। এটি তাদের দুর্ভাগা। এ ধরনের মোহাচ্ছন্ন মানুষেরা মান-অপমান, সুখ-দুঃখ, স্ত্রী-পুরুষ, ভাল-মন্দ আদির দ্বন্দ্বে প্রভাবান্বিত হয়ে মনে করে, “এই আমার স্ত্রী, এটি আমার বাড়ি, আমি এই বাড়ির মালিক। আমি এই স্ত্রীর স্বামী।” এটিই হচ্ছে মোহের দ্বন্দ্ব। যারা এভাবেই দ্বন্দ্বের দ্বারা মোহিত, তারা সম্পূর্ণ অজ্ঞ, তাই তারা পরম পুরুষোত্তম ভগবানকে জানতে পারে না।