শ্লোকঃ ২২

স তয়া শ্রদ্ধয়া যুক্তস্তস্যারাধনমীহতে ৷

লভতে চ ততঃ কামান্ময়ৈব বিহিতান্ হি তান্ ॥ ২২ ৷।

সঃ—তিনি; তয়া—সেই; শ্রদ্ধয়া — শ্রদ্ধা সহকারে; যুক্তঃ —যুক্ত হয়ে; তসা— তাঁর; আরাধনম্ — আরাধনা, ঈহতে — প্রয়াস করেন; লভতে লাভ করেন; চ—এবং; ততঃ—তার থেকে; কামান্—কামনাসমূহ; ময়া—আমার দ্বারা; এর—কেবল; বিহিতান্—বিহিত, হি—অবশ্যই; তান্—সেই।

গীতার গান

সে তখন শ্রদ্ধাযুক্ত দেব আরাধন ।

করিয়া সে ফল পায় আমার কারণ।।

কিন্তু সেই সেই ফল অনিত্য সকল ৷

স্বল্প মেধা চাহে তাই সাধন বিফল ।।

অনুবাদঃ সেই ব্যক্তি শ্রদ্ধাযুক্ত হয়ে সেই দেবতার আরাধনা করেন এবং সেই দেবতার কাছ থেকে আমারহ দ্বারা বিহিত কাম্য বস্তু অবশ্যই লাভ করেন।

তাৎপর্যঃ ভগবানের অনুমতি ছাড়া দেব-দেবীরা তাঁদের ভক্তদের কোন রকম বর দান করে পুরস্কৃত করতে পারেন না। সব কিছুই যে পরমেশ্বর ভগবানের সম্পত্তি, সেই কথা জীব ভুলে যেতে পারে, কিন্তু দেবতারা তা ভোলেন না। তাই, বিভিন্ন দেব- দেবীর পূজা করে কামনা-বাসনা চরিতার্থ করা পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণেরই ব্যবস্থা অনুসারে সাধিত হয়। এই ব্যাপারে দেব-দেবীরা হচ্ছেন উপলক্ষ্য মাত্র। অল্প বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরা সেই কথা জানে না, তাই তারা কিছু সুবিধা লাভের জন্য নির্বোধের মতো বিভিন্ন দেব-দেবীর শরণাপন্ন হয়। কিন্তু শুদ্ধ ভগবদ্ভক্তের যখন কোন কিছুর প্রয়োজন হয়, তখন তিনি কেবল পরমেশ্বর ভগবানের কাছে সেই জন্য প্রার্থনা করেন। জড়-জাগতিক সুযোগ-সুবিধা প্রার্থনা করা যদিও শুদ্ধ ভক্তের লক্ষণ নয়। কিন্তু জীব মাত্রই দেবতাদের শরণাপন্ন হয়, কারণ তারা কামনা চরিতার্থ করার জন্য মত্ত হয়ে থাকে। এটি তখনই হয়, যখন সে কোন ভ্রান্ত অনর্থ কামনা করে, যার পূর্তি ভগবান নিজে করেন না। শ্রীচৈতন্য-চরিতামৃত গ্রন্থে বলা হয়েছে যে, যদি কেউ ভগবানের আরাধনা করে সেই সঙ্গে জড় সুখ কামনা করে, তবে তা পরস্পর বিরোধী ও অসঙ্গত। পরমেশ্বর ভগবানের সেবা আর দেব-দেবীদের উপাসনা একই পর্যায়ে হতে পারে না, কারণ দেবোপাসনা হচ্ছে প্রাকৃত, আর ভগবদ্ভক্তি হচ্ছে সম্পূর্ণরূপে অপ্রাকৃত।

যে জীব তার যথার্থ আলয় ভগবৎ-ধামে ফিরে যেতে চায়, তার কাছে জাগতিক কামনা-বাসনাগুলি হচ্ছে এক একটি প্রতিবন্ধক। তাই শুদ্ধ ভক্তকে ভগবান জাগতিক সুখস্বাচ্ছন্দ্য ও ভোগেশ্বর্য দান করেন না, যা অল্প-বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরা আবার সেগুলিই লাভ করবার জন্য দেবোপাসনায় তৎপর হয়।

শ্লোকঃ ২৩

অন্তবস্তু ফলং তেষাং তদ্ ভবত্যল্পমেধসাম্ ।

দেবান্ দেবযজো যান্তি মদ্ভক্তা যান্তি মামপি ॥ ২৩ ॥

অন্তবৎ— সীমিত ও অস্থায়ী: তু-কিন্তু, লম্—ফল, তেষাম্—তাদের; তৎ- সেই; ভবতি হয়, অল্পমেধসাম্ — অল্পবুদ্ধি বাক্তিদের, দেবান্― দেবতাগণকে দেবযজঃ– দেবোপাসকগণ যান্তি – প্রাপ্ত হন, মৎ- আমার ভক্তাঃ— ভক্তগণ; যান্তি—প্রাপ্ত হন: মাম—আমাকে; অপি – অবশ্যই।

গীতার গান

তারা দেবলোকে যায় অনিত্য সে ধাম

মোর ভক্ত মোর ধামে নিত্য পূর্ণকাম ।৷

স্বল্পবুদ্ধি যার হয় সে বলে নিরাকার ৷

জানে না তাহারা চিদ বিগ্রহ আমার ৷।

অনুবাদঃ অল্পবুদ্ধি ব্যক্তিদের আরাধনা লব্ধ সেই ফল অস্থায়ী। দেবোপাসকগণ দেবলোক প্রাপ্ত হন, কিন্তু আমার ভক্তেরা আমার পরম ধাম প্রাপ্ত হন ।

তাৎপর্যঃ ভগবদ্গীতার কোন কোন ভাষ্যকার বলেন যে, কোন দেব-দেবীর উপাসনা যে করে, সে-ও ভগবানের কাছে যেতে পারে, কিন্তু এখানে স্পষ্টভাবে বলা হচ্ছে যে, দেবোপাসকেরা সেই সমস্ত গ্রহলোকে যায়, যেখানে তাদের উপাসিত দেব- দেবীরা অধিষ্ঠিত। যেমন, সূর্যের উপাসকেরা সূর্যালোকে যায়, চন্দ্রের উপাসকেরা চন্দ্রলোকে যায়। তেমনই, কেউ যদি ইন্দের মতো দেবতার উপাসনা করে, তা হলে সে সেই বিশেষ দেবতার লোকে যেতে পারে। এমন নয় যে, যে-কোন দেব-দেবীর পূজা করলেই পরম পুরুষোত্তম ভগবানের কাছে পৌঁছানো যায়। এখানে সেই কথা অস্বীকার করা হয়েছে। ভগবান এখানে স্পষ্টভাবে বলেছেন যে, বিভিন্ন দেব-দেবীর উপাসকেরা এই জড় জগতের ভিন্ন ভিন্ন গ্রহলোক প্রাপ্ত হয়, কিন্তু পরমেশ্বর ভগবানের ভক্ত সরাসরিভাবে পরম পুরুষোত্তম ভগবানের ধামে এমন করেন।

এখানে কেউ কেউ প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারে যে, দেব-দেবীরা যদি ভগবানের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হন, তা হলে তাদের পূজা করার মাধ্যমেও একই উদ্দেশ্য সাধিত হওয়া উচিত। কিন্তু আসল কথা হচ্ছে, দেখ-দেবীর উপাসকেরা অল্প- বুদ্ধিসম্পন্ন, তাই তারা জানে না দেহের কোন অংশে খাদ্য দিতে হয়। তাদের মধ্যে কেউ কেউ আবার এত বোকা যে, তারা দাবি করে, ভিন্ন ভিন্ন অংশে ভিন্ন ভিন্নভাবে খাবার দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু এই চিন্তাধারা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। কেউ কি কান দিয়ে কিংবা চোখ দিয়ে দেহকে খাওয়াতে পারে? তারা জানে না যে, বিভিন্ন দেব-দেবীরা হচ্ছেন ভগবানের বিশ্বরূপের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এবং তাদের অজ্ঞতার ফলে তারা বিশ্বাস করে যে, ভিন্ন ভিন্ন দেব-দেবীরা হচ্ছেন এক একজন ভগবান এবং তাঁরা সকলেই ভগবানের প্রতিদ্বন্দী।

দেব-দেবীরাই কেবল ভগবানের অংশ নন, সাধারণ জীবেরাও ভগবানের অংশ-বিশেষ। শ্রীমদ্ভাগবতে বর্ণনা করা হয়েছে যে, ব্রাহ্মণেরা হচ্ছে ভগবানের মস্তক, ক্ষত্রিয়েরা হচ্ছে তাঁর বাহু, বৈশ্যেরা তাঁর উদর, শূদ্রেরা হচ্ছে তাঁর পদ এবং তারা সকলেই এক-একটি বিশেষ কর্তব্য সম্পাদন করছে। মানুষ যে স্তরেই থাক না কেন, যদি সে বুঝতে পারে যে, দেব-দেবীরা ও সে নিজে ভগবানের অংশ-বিশেষ, তা হলে তার জ্ঞান পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়। আর এটি না বুঝতে পেরে সে যদি কোন বিশেষ দেবতার পূজা করে, তা হলে সে সেই দেবলোকে গমন করে। এটি সেই একই গন্তব্যস্থল নয়, যেখানে ভক্তেরা পৌঁছয়।

দেব-দেবীদের তুষ্ট করার ফলে যে বর লাভ হয়, তা ক্ষণস্থায়ী, কারণ এই জড় জগতের অন্তর্ভুক্ত সমস্ত দেব-দেবীরা, তাঁদের ধাম ও তাঁদের উপাসক সব কিছুই বিনাশশীল। তাই, এই শ্লোকে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, দেব-দেবীর পূজা করে যে ফল লাভ হয়, তা বিনাশশীল এবং অল্প-বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরাই কেবল এই সমস্ত দেব-দেবীর পূজা করে থাকে। ভগবানের শুদ্ধ ভক্ত কিন্তু কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত হয়ে ভগবানের সেবা করার ফলে সচ্চিদানন্দময় জীবন প্রাপ্ত হন। তিনি যা প্রাপ্ত হন, তা দেবোপাসকদের প্রাপ্তি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। পরমেশ্বর ভগবান অসীম, তাঁর অনুগ্রহ অসীম এবং তার করুণাও অসীম। তাই তাঁর শুদ্ধ ভক্তের উপর তাঁর যে করুণা বর্ষিত হয়, তা অসীম।

শ্লোকঃ ২৪

অব্যক্তং ব্যক্তিমাপন্নং মন্যন্তে মামবুদ্ধয়ঃ ।

পরং ভাবমজানন্তো মমাব্যয়মনুত্তমম্ ॥ ২৪ ॥

অব্যক্তম্ — অব্যক্ত ব্যক্তিম্ – ব্যক্তিত্ব, আপাম — প্রাপ্ত; মন্যন্তে — মনে করে; মাম্—আমাকে; অবুদ্ধয়ঃ— বুদ্ধিহীন ব্যক্তিগণ, পরম্পরম; ভাবম্ — ভাব; অজানন্তঃ না জেনে; ময় — আমার; অব্যয়ম্ — অব্যয়, অনুত্তমম্ — সর্বোত্তম ।

গীতার গান

সর্বোত্তম শ্রেষ্ঠ হয় আমার শরীর ।

অব্যয় সচ্চিদানন্দ যাহা জানে সব ধীর ।।

আমি সূর্য সম নিত্য সনাতন ধাম ৷

সবার নিকটে নহি দৃশ্য আত্মারাম ॥

অনুবাদঃ বুদ্ধিহীন মানুষেরা যারা আমাকে জানে না, মনে করে যে, আমি পূর্বে অব্যক্ত নির্বিশেষ ছিলাম, এখন ব্যক্তিত্ব পরিগ্রহ করেছি। তাদের অজ্ঞতার ফলে তারা আমার অব্যয় ও সর্বোত্তম পরম ভাব সম্বন্ধে অবগত নয় ।

তাৎপর্যঃ পূর্ববর্তী শ্লোকে দেবোপাসকদের অল্প বুদ্ধিসম্পন্ন বলে বর্ণনা করা হয়েছে এবং এখানে নির্বিশেষবাদীদেরও সেই রকম বুদ্ধিহীন বলে বর্ণনা করা হচ্ছে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর স্বরূপে অর্জুনের সঙ্গে এখানে কথা বলছেন, অথচ নির্বিশেষবাদীরা এতই মূর্খ যে, অন্তিমে ভগবানের কোন রূপ নেই বলে তারা তর্ক করে। শ্রীরামানুজাচার্যের পরম্পরায় মহিমাময় ভগবদ্ভক্ত শ্রীযামুনাচার্য এই সম্পর্কে একটি অতি সমীচীন শ্লোক রচনা করেছেন। তিনি বলেছেন—

ত্বাং শীলরূপচরিতেঃ পরমপ্রকৃষ্টৈঃ

সত্বেন সাত্ত্বিকতয়া প্ৰবলৈশ শাস্ত্রেঃ ।

প্রখ্যাতদের পরমার্থবিদাং মতৈ

নৈবাসুর প্রকৃতয়ঃ প্রভবন্তি বোন্ধুম ।।

“হে ভগবান! মহামুনি ব্যাসদেব, নারদ আদি ভক্তের তোমাকে পরমেশ্বর ভগবান এলে জানেন। বিভিন্ন বৈদিক শাস্ত্র উপলব্ধির মাধ্যমে তোমার গুণ, রূপ, লীলা আদি সম্বন্ধে অবগত হওয়া যায় এবং জানতে পারা যায় যে, তুমিই পরমেশ্বর ভগবান। কিন্তু রজ ও তমোগুণের দ্বারা আচ্ছাদিত অভক্ত অসুরেরা কখনই তোমাকে জানতে পারে না, কারণ তোমার তত্ত্ব হৃদয়সম করতে তারা সম্পূ অসমর্থ। এই ধরনের অভক্তেরা বেদান্ত, উপনিষদ আদি বৈদিক শাস্ত্রে অত্যন্ত পারদর্শী হতে পারে, কিন্তু তাদের পক্ষে পুরুষোত্তম ভগবানকে জানতে পারা সম্ভব নয়।” ( স্তোত্ররত্ন ১২)

ব্রহ্মসংহিতাতে বলা হয়েছে যে, কেবল বেদান্ত শাস্ত্র অধ্যয়ন করার মাধ্যমে পরমেশ্বর ভগবানকে জানতে পারা যায় না। ভগবানের কৃপার ফলেই কেবল তিনি যে পরম পুরুষোত্তম, সেই সম্বন্ধে অবগত হওয়া যায়। তাই, এই শ্লোকে “পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, দেব-দেবীর উপাসকেরাই কেবল অম্ল-বুদ্ধিসম্পন্ন নয়, যে সমস্ত অভক্ত বেদান্ত ও বৈদিক শাস্ত্র সম্বন্ধে তাদের কল্পনাপ্রসূত মতবাদ পোষণ করে এবং যাদের অন্তরে কৃষ্ণভাবনামৃতের লেশমাত্র নেই, তারাও অল্প-বুদ্ধিসম্পন্ন এবং তাদের পক্ষে ভগবানের সবিশেষ রূপ অবগত হওয়া অসম্ভব। যারা মনে করে যে, পরমেশ্বর ভগবান নিরাকার, তাদের অবুদ্ধয়ঃ বলা হয়েছে অর্থাৎ এরা পরম তত্ত্বের পরম রূপকে জানে না। শ্রীমদ্ভাগবতে বলা হয়েছে যে, অদ্বয়-জ্ঞানের সূচনা হয় নির্বিশেষ ব্রহ্ম থেকে, তারপর তা পরমাত্মার স্তরে উন্নীত হয়, কিন্তু পরম তত্ত্বের শেষ কথা হচ্ছে পরম পুরুষোত্তম ভগবান। আধুনিক যুগের নির্বিশেষবাদীরা বিশেষভাবে মূর্খ, কারণ তারা এমন কি তাদের পূর্বতন মহান আচার্য শঙ্করাচার্যের শিক্ষাও অনুসরণ করে না, যিনি বিশেষভাবে নির্দেশ দিয়ে গেছেন যে,

কৃষ্ণই হচ্ছেন পরম পুরুষোত্তম ভগবান। নির্বিশেষবাদীরা তাই পরমতত্ত্ব সম্পর্কে অবগত না হয়ে মনে করে যে, শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন দেবকী ও বসুদেবের সন্তান মাত্র, অথবা একজন রাজকুমার, অথবা একজন অত্যন্ত শক্তিশালী জীব মাত্র । ভগবদগীতায় (৯/১১) ভগবান এই ভ্রান্ত ধারণার নিপা করে বলেছেন, অবজ্ঞানন্তি মাং মুঢ়া মানুষীং অনুযাশ্রিতম্— “অত্যন্ত মূঢ় লোকগুলিই কেবল আমাকে একজন সাধারণ মানুষ বলে মনে করে আমাকে অবজ্ঞা করে।”

প্রকৃতপক্ষে, ভক্তি সহকারে ভগবানের সেবা করে কৃষ্ণভাবনা অর্জন না করলে বাই শ্রীকৃষ্ণকে উপলব্ধি করতে পারা যায় না। শ্রীমদ্ভাগবতে (১০/১৪/ ২৯ ) এই কথা প্রতিপন্ন করে বলা হয়েছে-

অথাপি তে দেব পদাম্বুজদয়

প্রসাদনেশানুগৃহীত এর হি !

জানাতি তত্ত্বং ভগবাহিমো

ন চানা একোঽপি চিরং বিচিন্তন ॥

“হে ভগবান! আপনার শ্রীচরণকমলের কণামাত্রও কৃপা যে লাভ করতে পারে, সে আপনার মহান পুরুষত্বের উপলব্ধি অর্জন করতে পারে। কিন্তু যারা পরম পুরুষোত্তম ভগবানকে উপলব্ধির উদ্দেশ্যে কেবলই জল্পনা-কল্পনা করে, তারা বহু বছর ধরে বেদ অধ্যয়ন করতে থাকলেও আপনাকে জানতে সক্ষম হয় না।” কেবলমাত্র জল্পনা-কল্পনা আর বৈদিক শাস্ত্রের আলোচনার মাধ্যমে পরম পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণের নাম-রূপ লীলা আদি জানতে পারা যায় না। তাঁকে জানতে হলে অবশ্যই ভক্তিযোগের পন্থা অবলম্বন করতে হয়। কেউ যখন হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে –এই মহামন্ত্র কীৰ্ত্তন করার মাধ্যমে ভক্তিযোগ অনুশীলন শুরু করে সম্পূর্ণভাবে কৃষ্ণভাবনামৃতে মগ্ন হয়, তখনই কেবল পরম পুরুষোত্তম ভগবানকে জানা যায়। নির্বিশেষবাদী অভতেরা মনে করে যে, শ্রীকৃষ্ণের দেহ এই জড়া প্রকৃতির তৈরি এবং তার শ্রীবিগ্রহ, লীলা আদি সবই মায়া। এই ধরনের নির্বিশেষবাদীদের বলা হয় মায়াবাদী। তারা পরমতত্ত্ব সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অজ্ঞ।

বিংশতি শ্লোকে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, কামেস্তৈস্তৈহতজ্ঞানাঃ প্রপদাহে নাদেবতাঃ -“কামনা-বাসনা দ্বারা যারা অন্ধ, ভারাই বিভিন্ন দেব-দেবীর শরণাপন্ন হয়।” এটিও স্বীকৃত হয়েছে যে, ভগবানের পরম ধাম ছাড়াও বিভিন্ন দেব-দেবীর নিজস্ব ভিন্ন ভিন্ন গ্রহলোক আছে। ত্রয়োবিংশতিতম ােকে বলা হয়েছে, দেবান্ দেবযজো বাতি মতা যান্তি মামপি― দেব-দেবীর উপাসকেরা দেব-দেবীদের বিভিন্ন লোকে যায় এবং যারা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ভক্ত, তারা কৃষ্ণলোকে যায়। যদিও এই সব কিছুই স্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, তবুও মূঢ় নির্বিশেষবাদীরা দাবি করে যে, ভগবান নিরাকার এবং তাঁর এই সমস্ত রূপ আরোপণ মাত্র। গীতা পড়ে কি কখনও মনে হয় যে, বিভিন্ন দেব-দেবী ও তাঁদের লোকগুলি নির্বিশেষ? তা থেকে স্পষ্টভাবে বুঝতে পারা যায় যে, পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও বিভিন্ন দেব- দেবীরা কেউই নির্বিশেষ নন। তাঁরা সকলেই সবিশেষ ব্যক্তি। শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরম পুরুষোত্তম ভগবান এবং তাঁর নিজস্ব গ্রহধাম আছে এবং দেব-দেবীদেরও তাদের ভিন্ন ভিন্ন গ্রহলোক আছে।

তাই অদ্বৈতবাদীদের মতবাদ এই যে, পরমতত্ত্ব নিরাকার এবং তাঁর রূপ কেবল আরোপণ মাত্র, তা সভ্য বলে প্রমাণিত নয়। এখানে স্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যে, পরম-তত্ত্বের সবিশেষ রূপ আরোপিত নয়। ভগবদ্গীতা থেকে আমরা স্পষ্টভাবে বুঝতে পারি যে, বিভিন্ন দেব-দেবীর ও ভগবানের রূপ একই সঙ্গে বিদ্যমান এবং ভগবান শ্রীকৃষ্ণের রূপ সচ্চিদানন্দময়। বেদেও বার বার উল্লেখ করা হয়েছে যে, পরমতত্ত্ব হচ্ছেন আনন্দময়োই আসাৎ অর্থাৎ স্বভাবতই তিনি চিৎ- ঘনানন্দ এবং তিনি অনন্ত শুভ মঙ্গলময় গুণের আধার। গীতাতে ভগবান বলেছেন যে, যদিও তিনি অজ, তবুও তিনি আবির্ভূত হন। গীতার মাধ্যমে ভগবানের সম্বন্ধে এই সমস্ত তত্ত্ব আমরা স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করতে পারি। মায়াবাদীরা যে মনে করে ভগবান নির্বিশেষ, সেটি আমাদের ধারণারও অতীত। গীতার মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি যে, নির্বিশেষবাদীদের অদ্বৈতবাদ সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। এখানে স্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে, পরমতত্ত্ব ভগবান শ্রীকৃষ্ণের রূপ আছে এবং ব্যক্তিত্ব আছে।

error: Content is protected !!