শ্লোকঃ ১৯

বহূনাং জন্মনামন্তে জ্ঞানবান্মাং প্রপদ্যতে ।

বাসুদেবঃ সর্বমিতি স মহাত্মা সুদুর্লভঃ ॥ ১৯ ৷।

বহনাম—বহু, জন্মনাম — জন্মের অন্তে — পরে; জ্ঞানবান — তত্ত্বজ্ঞানী; মা- আমাতে; প্রপদ্যতে—প্রপত্তি করেন; বাসুদেবঃ – বাসুদেব; সর্বস্—সমস্ত; ইতি— এভাবে; সঃ—সেইরূপ; মহাত্মা — মহাপুরুষ; সুদুর্লভঃ – অত্যন্ত দুর্লভ।

গীতার গান

ক্রমে ক্রমে জ্ঞানীজন বহু জন্ম পরে ।

আমার চরণে শুদ্ধ প্রপত্তি সে করে ৷৷

বাসুদেবময় তদা জগৎ দর্শন ।

দুর্লভ মহাত্মা সেই শাস্ত্রের বর্ণন ৷।

অনুবাদঃ বহু জন্মের পর তত্ত্বজ্ঞানী ব্যক্তি আমাকে সর্ব কারণের পরম কারণ রূপে জেনে আমার শরণাগত হন। সেইরূপ মহাত্মা অত্যন্ত দুর্লভ।

তাৎপর্যঃ বহু বহু জন্মে ভগবদ্ভক্তি সাধন করার ফলে অথবা পারমার্থিক কর্ম অনুষ্ঠান করার ফলে জীব এই অপ্রাকৃত বিশুদ্ধ জ্ঞান প্রাপ্ত হয় যে, পারমার্থিক উপলব্ধির চরম লক্ষ্য হচ্ছেন পরম পুরুষোত্তম ভগবান। পারমার্থিক উপলব্ধির প্রারম্ভিক স্তরে, সাধক যখন ভোগাসক্তির জড় বন্ধন নিবৃত্তি করার চেষ্টা করেন, তখন তাঁর প্রবৃত্তি কিছুটা নির্বিশেষবাদের প্রতি আকৃষ্ট থাকে, কিন্তু ক্রমে ক্রমে তিনি যখন উন্নতি লাভ করেন, তখন তিনি বুঝতে পারেন যে, পারমার্থিক জীবনেও অপ্রাকৃত ক্রিয়াকর্ম আছে এবং তাকে বলা হয় ভক্তিযোগ। এটি বুঝতে পেরে, তিনি পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতি অনুরক্ত হন এবং তাঁর শ্রীচরণকমলে আত্মনিবেদন করেন। এই অবস্থায় তিনি বুঝতে পারেন যে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কৃপাই হচ্ছে সর্ব সারসর্বস্ব, শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন সর্ব কারণের পরম কারণ এবং এই বিশ্বচরাচর তাঁর থেকে স্বাধীন স্বতন্ত্র নয়। তিনি বুঝতে পারেন, এই জড় জগৎ চিন্ময় বৈচিত্র্যেরই বিকৃত প্রতিবিঘ্ন এবং সব কিছুই পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে কোন না কোনভাবে সম্বন্ধযুক্ত। তাই, তিনি বাসুদেব অথবা শ্রীকৃষ্ণের পরিপ্রেক্ষিতে সব কিছু চিন্তা করেন। বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণকে সর্বত্র দেখার এই অভ্যাস পরম লক্ষ্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতি তার পূর্ণ সমর্পণ ত্বরান্বিত করে। এই প্রকার শরণাগত মহাত্মা অত্যন্ত দুর্লভ।

এই শ্লোকটি শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের তৃতীয় অধ্যায়ে (শ্লোক ১৪-১৫) খুব সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে—

সহস্রশীর্ষ পুরুষঃ সহস্রাক্ষঃ সহস্রপাৎ ।

স ভূমিং বিশ্বতো বৃদ্ধাহত্যতিষ্ঠদ্ দশাঙ্গুলম্ ॥

পুরুষ এবেদং সর্বং যদ্ভূতং যজ্ঞ ভবাম্ ।

উতামৃতত্বস্যেশানো যামেনাতিয়োহতি ॥

ছান্দোগ্য উপনিষদে (৫/১/১৫) বলা হয়েছে, ন বৈ বাচোন চক্ষুংসি ন শ্রোত্রাণি ন মনাংসীত্যাচক্ষতে প্রাণা ইত্যেবাচক্ষতে প্রাণো হোবৈতানি সর্বাণি ভবত্তি “জীবের দেহের মধ্যে বাক্শক্তি, দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তি, চিন্তাশক্তি আসল জিনিস নয়; প্রাণশক্তিই সমস্ত ক্রিয়াকলাপের কেন্দ্রবিন্দু।” ঠিক সেই রকমভাবে, ভগবান বাসুদেব অর্থাৎ পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন সব কিছুর মধ্যে মূল সত্তা। এই দেহের মধ্যে বাক্যশক্তি, দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তি, চিন্তাভাবনার শক্তি আদি রয়েছে। কিন্তু এই সব যদি পরমেশ্বর ভগবানের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত না হয়, তা হলে এগুলির কোনই গুরুত্ব থাকে না। আর যেহেতু বাসুদেব সর্বব্যাপক এবং সব কিছুই হচ্ছেন বাসুদেব স্বয়ং, তাই ভক্ত পূর্ণজ্ঞানে আত্মসমর্পণ করেন। (তুলনীয়— ভগবদ্গীতা ৭/১৭ ও ১১ /৪০ )

শ্লোকঃ ২০

কামৈস্তৈস্তৈহৃতজ্ঞানাঃ প্রপদ্যন্তেহন্যদেবতাঃ ।

তং তং নিয়মমাস্থায় প্রকৃত্যা নিয়তাঃ স্বয়া ॥ ২০ ৷৷

কামৈঃ—কামনাসমূহের দ্বারা, ভৈঃ– সেই; তৈঃ– সেই, হৃত অপহৃত, জ্ঞানাঃ — জান, প্রপদ্যন্তে—পত্তি করে: অন্য — অন্য দেবতাঃ – দেব-দেবীদের; তম্— সেই তম্—সেই; নিয়মম্ — নিয়ম; আস্থায় — পালন করে; প্রকৃত্যা — স্বভাবের দ্বারা নিয়তাঃ —নিয়ন্ত্রিত হয়ে, স্বয়া — স্বীয় ।

গীতার গান

যে পর্যন্ত কামনার দ্বারা থাকে বশীভূত ৷

প্ৰপত্তি আমাতে তদা নহে ত’ সম্ভূত।।

সেই কাম দ্বারা তারা হৃতজ্ঞান হয় ।

আমাকে ছাড়িয়া অন্য দেবতা পূজয় ৷৷

অনুবাদঃ জড় কামনা-বাসনার দ্বারা যাদের জ্ঞান অপহৃত হয়েছে, তারা অন্য দেব-দেবীর শরণাগত হয় এবং তাদের স্বীয় স্বভাব অনুসারে বিশেষ নিয়ম পালন করে দেবতাদের উপাসনা করে।

তাৎপর্যঃ যারা সর্বতোভাবে জড় কলুষ থেকে মুক্ত হতে পেরেছে, তারাই পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চরণে আত্মসমর্পণ করে তাঁর প্রতি ভক্তিযুক্ত হয়। যতক্ষণ পর্যন্ত জীব জড় জগতের কলুষ থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত হতে না পারছে, ততক্ষণ সে স্বভাবতই অভক্ত থাকে। কিন্তু এমন কি বিষয় -বাসনার দ্বারা কলুষিত থাকা সত্ত্বেও যদি কেউ ভগবানের আশ্রয় অবলম্বন করে, তখন সে আর ততটা বহিরঙ্গা প্রকৃতির দ্বারা আকৃষ্ট হয় না; যথার্থ লক্ষ্যের প্রতি উত্তরোত্তর অগ্রসর হতে হতে সে শীঘ্রই সমস্ত প্রাকৃত কাম-বিকার থেকে সর্বতোভাবে মুক্ত হয়। শ্রীমদ্ভাগবতে বলা হয়েছে যে, সমস্ত জড় কামনা-বাসনা থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত শুদ্ধ ভক্তই হোক, অথবা প্রাকৃত অভিলাষযুক্ত হোক, অথবা জড় কলুষ থেকে মুক্তিকামীই হোক না কেন, সকলেরই কর্তব্য হচ্ছে বাসুদেবের শরণাগত হয়ে তাঁর উপাসনা করা। শ্রীমদ্ভাগবতে তাই বলা হয়েছে (২/৩/১০)-

অকামঃ সর্বকামো বা মোক্ষকাম উদারধীঃ ।

তীরেণ ভক্তিযোগেন যজেত পুরুষং পরম্ ।।

যে সব স্বল্পবুদ্ধি মানুষের পারমার্থিক জ্ঞান অপহৃত হয়েছে, তারাই বিষয়-বাসনার তাৎক্ষণিক পূর্তির জন্য দেবতাদের শরণাপন্ন হয়। সাধারণত, এই স্তরের মানুষের। ভগবানের শরণাগত হয় না, কারণ রজ ও তমোগুণের দ্বারা কলুষিত থাকার ফলে তারা বিভিন্ন দেব-দেবীর উপাসনার প্রতি অধিক আকৃষ্ট থাকে। দেবোপাসনার বিধি-বিধান পালন করেই তারা সন্তুষ্ট থাকে। বিভিন্ন দেব-দেবীর উপাসকেরা তাদের তুচ্ছ অভিলাষের দ্বারা এতই মোহাচ্ছন্ন থাকে যে, তারা পরম লা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ থাকে। ভগবানের ভক্ত কিন্তু কখনই এই পরম লক্ষ্য থেকে ভ্রষ্ট হন। না। বৈদিক শাস্ত্রে ভিন্ন ভিন্ন উদ্দেশ্য সাধনের জন্য ভিন্ন ভিন্ন দেব-দেবীকে পূজা করার বিধান দেওয়া আছে। যেমন, রোগ নিরাময়ের জন্য সূর্যদেবের উপাসনা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এর ফলে অভতেরা মনে করে যে, বিশেষ কোন উদ্দেশ্য সাধনের জন্য দেব-দেবীর ভগবান থেকেও শ্রেষ্ঠ। কিন্তু ভগবানের শুদ্ধ ভক্ত জানেন যে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন সব কিছুর অধীশ্বর। শ্রীচৈতন্য- চরিতামৃতে (আদি ৫/১৪২) বলা হয়েছে—একলে ঈশ্বর কৃষ্ণ, আর সব ভৃতা । তাই, শুদ্ধ ভক্ত কখনও তাঁর বিষয়-বাসনা চরিতার্থ করবার জন্য দেব-দেবীর কাছে যান না। তিনি সর্বতোভাবে পরমেশ্বর ভগবানের উপর নির্ভরশীল এবং ভগবানের কাছ থেকে তিনি যা পান তাতেই তিনি সন্তুষ্ট থাকেন।

শ্লোকঃ ২১

যো যো যাং যাং তনুং ভক্তঃ শ্রদ্ধয়ার্চিতুমিচ্ছতি ।

তস্য তস্যাচলাং শ্রদ্ধাং তামেব বিদধাম্যহম্ ॥ ২১ ৷৷

যঃ যো; যঃ— যে, যাম্― যে; যাম্― যে: তনুম্—দেব-দেবীর মূর্তি; ভক্তঃ – ভক্ত; শ্রদ্ধয়া—শ্রদ্ধা সহকারে, অচিতুম্—পূজা করতে, ইচ্ছতি — ইচ্ছা করে, তস্য — তার তথ্য—তার; অচলাম্ – অচলা; শ্রদ্ধাম্ — শ্রদ্ধা; তাম্—তাতে; এর— অবশ্যই; বিদধামি—বিধান করি; অহম্ — আমি।

গীতার গান

আমি অন্তর্যামী তার থাকিয়া অন্তরে ।

সেই সেই দেবপূজা করাই সত্বরে ॥

সেই সেই শ্রদ্ধা দিই করিয়া অচল ৷

অতএব অন্য দেব করয়ে পূজন ৷।

অনুবাদঃ পরমাত্মারূপে আমি সকলের হৃদয়ে বিরাজ করি। যখনই কেউ দেবতাদের পূজা করতে ইচ্ছা করে, তখনই আমি সেই সেই ভক্তের তাতেই অচলা শ্রদ্ধা বিধান করি।

তাৎপর্যঃ ভগবান প্রত্যেককেই স্বাধীনতা দিয়েছেন; তাই, কেউ যদি জড় সুখভোগ করার জন্য কোন দেবতার পূজা করতে চায়, তখন সকলের অন্তরে পরমাত্মত্মারূপে বিরাজমান পরমেশ্বর ভগবান তাদের সেই সমস্ত দেবতাদের পূজা করার সব রকম সুযোগ-সুবিধা দান করেন। সমস্ত জীবের পরম পিতা ভগবান কখনও তাদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেন না। পক্ষান্তরে, তিনি তাদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করার

সব রকম সুযোগ-সুবিধা দান করেন। এই সম্বন্ধে কেউ প্রশ্ন করতে পারে যে, জড় জগৎকে ভোগ করার ফলে জীব যদি মায়ার ফাঁদে পতিত হয়, তা হলে সর্বশক্তিমান ভগবান কেন তাদের এই সুযোগ প্রদান করেন। এর উত্তর হচ্ছে, পরমাত্মারূপে ভগবান যদি সেই সমস্ত সুযোগ-সুবিধা না দিতেন, তা হলে জীবের ব্যক্তিগত স্বাধীনতার কোন মূলাই থাকত না। তাই, তিনি প্রতিটি জীবকে তাদেরই ইচ্ছানুরূপ আচরণ করার জন্য পূর্ণ স্বাতন্ত্র দান করেন। কিন্তু তাঁর পরম নির্দেশ আমরা ভগবদ্গীতাতে পাই—সব কিছু পরিত্যাগ করে তাঁর শরণাগত হোন। আর মানুষ যদি তা করে, তা হলেই সে সুখী হতে পারে।

জীবাত্মা ও দেবতা, এরা উভয়েই পরম পুরুষোত্তম ভগবানের ইচ্ছার অধীন। তাই, জীব নিজের ইচ্ছায় দেব-দেবীর পূজা করতে পারে না এবং দেব-দেবীরাও ভগবানের ইচ্ছা ব্যতীত বর দান করতে পারেন না। ভগবান বলেছেন যে, তাঁর ইচ্ছা কিনা একটি পাতাও নড়ে না। সাধারণত, সংসারে বিপদগ্রস্ত মানুষেরাই বৈদিক নির্দেশ অনুসারে দেবোপাসনা করে। যেমন, রোগ নিরাময়ের জন্য রোগী সূর্যোপাসনা করে, বিদ্যার্থী বাগদেবী সরস্বতীর পূজা করে এবং সুন্দরী স্ত্রী লাভ করার জন্য কোন ব্যক্তি শিবপত্নী উমার পূজা করে। এভাবেই শাস্ত্রে বিভিন্ন দেবতাদের পূজা করর বিধান দেওয়া আছে। আর যেহেতু প্রতিটি জীবই কোন বিশেষ জাগতিক সুযোগ-সুবিধা উপভোগ করার অভিলাষী হয়, তাই ভগবান তাদের অন্তরে বিশেষ বিশেষ দেব-দেবীদের প্রতি অচলা শ্রদ্ধা দান করে তাঁদের উপাসনা করতে অনুপ্রাণিত করেন এবং তার ফলে তারা সেই সমস্ত দেব-দেবীর কাছ থেকে বর লাভ করতে সমর্থ হয়। এভাবেই আমরা দেখতে পাই যে, ভিন্ন ভিন্ন দেব- দেবীর প্রতি জীবের যে অনুরাগ জন্মায়, তা ভগবানেরই দ্বারা নির্দিষ্ট হয়। দেব- দেবীরা তাঁদের নিজেদের শক্তির প্রভাবে জীবকে তাঁদের প্রতি অনুরক্ত করতে পারেন না। জীবের অন্তরে পরমাত্মারূপে বিদ্যমান থেকে শ্রীকৃষ্ণাই মানুষকে দেবোপাসনায় অনুপ্রাণিত করেন। দেবতারা প্রকৃতপক্ষে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বিশ্বরূপের বিভিন্ন অঙ্গ, তাই তাঁদের কোনই স্বাতন্ত্র্য্য নেই। বেদে বলা হয়েছে, “পরমাত্মারূণে পরমেশ্বর ভগবান দেবতাদের হৃদয়েও বিরাজ করেন, তাই তিনিই বিভিন্ন দেব-দেবীর মাধ্যমে জীবের প্রার্থনা পূর্ণ করেন। এভাবেই দেবতা ও জীবাত্মা কেউই স্বাধীন নয়, তারা সকলেই ভগবানের ইচ্ছার অধীন।”

error: Content is protected !!