শ্লোকঃ ১৬

চতুর্বিধা ভজন্তে মাং জনাঃ সুকৃতিনোহর্জুন ।

আর্তো জিজ্ঞাসুরর্থার্থী জ্ঞানী চ ভরতর্ষভ ৷৷ ১৬ ৷৷

চতুর্বিধাঃ-চার প্রকার; ভজন্তে — ভজনা করেন: মাম্― আমাকে: জনাঃ — ব্যক্তিগণ: সুকৃতিনঃ—গুণাকর্মা; অর্জুন – হে অর্জুন, আর্ডঃ- আর্ত, জিজ্ঞাসুঃ —অনুসন্ধিৎসু অর্থার্থী — ভোগ অভিলাষী; জ্ঞানী — তত্ত্ব, চ– ভরতসভ – হে ভরতশ্রেষ্ঠ।

গীতার গান

সুকৃতি করেছে যারা সেই চারিজন ।

আর্ত অর্থার্থী জিজ্ঞাসু কিম্বা জ্ঞানী হন ॥

প্রপত্তি সহিত তারা করয়ে ভজন ৷

অসুরাদি মায়াযুদ্ধে হারায় জীবন।।

অনুবাদঃ হে ভরতশ্রেষ্ঠ অর্জুন! আর্ত, অর্থার্থী, জিজ্ঞাসু ও জ্ঞানী—এই চার প্রকার পুণাকর্মী ব্যক্তিগণ আমার ভজনা করেন।

তাৎপর্যঃ দুষ্কৃতকারীদের ঠিক বিপরীত হচ্ছে শাস্ত্রের নির্দেশ অনুসরণকারী এবং তাঁদের বলা হয় সুকৃতিনঃ অর্থাৎ সুকৃতিসম্পন্ন মানুষ। এরা সব সময়ই শাস্ত্র নির্দেশিত বিধি- নিষেধগুলি মেনে চলে, সমাজের নীতি মেনে চলে এবং এরা সকলেই অল্প-বিস্তর ভগবদ্ভক্ত। এরাও আবার চারটি শ্রেণীতে বিভক্ত — (১) আর্ত, (২) অর্থার্থী (৩) জিজ্ঞাসু ও (৪) জ্ঞানী। এই সমস্ত ব্যক্তি ভিন্ন ভিন্ন কারণের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ভগবানের শ্রীচরণে শরণাগত হয়। এরা শুদ্ধ ভারত নয়, কারণ ভক্তির বিনিময়ে এরা কোন না কোন অভিলাষ পূর্তির কামনা করে। সব রকমের কামনা থেকে মুক্ত এবং জড়-জাগতিক কোন অভিলাষ থাকে না। ভক্তিরসামৃতসিন্ধু গ্রন্থে (পূর্ব ১/১১) শুদ্ধ বলা হয়েছে—

অন্যাভিলাষিতাশূনাং জ্ঞানকর্মাদানাবৃতম্ ।

আনুকূলোন কৃষ্ণানুশীলনং ভক্তিরতমা ॥

“জড়-জাগতিক লাভের অভিলাষ বর্জন করে, জ্ঞান, কর্ম, যোগ আদি নৈমিত্তিক ধর্মের আচরণ থেকে মুক্ত হয়ে, অনুকূলভাবে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দিব্য প্রেমভক্তি সেবা করাই হচ্ছে শুদ্ধ ভগবদ্ভক্তি।”

এই চার শ্রেণীর ব্যক্তিরা যখন ভগবানের সেবা করে, তখন সাধুসঙ্গের প্রভাবে তারাও শুদ্ধ ভক্তে পরিণত হয়। দুষ্কৃতকারীদের পক্ষে ভগবদ্ভক্তি করা খুবই কঠিন, কারণ তারা অত্যন্ত স্বার্থপর, অসংযত ও পারমার্থিক উদ্দেশ্যহীন। কিন্তু তবুও সৌভাগ্যক্রমে তাদের কেউ যদি শুদ্ধ ভগবত্তত্তের সংস্পর্শে আসে, তা হলে তারাও শুদ্ধ ভক্তে পরিণত হতে পারে।

যারা সকান কর্মের ফল ভোগ করবার জন্য সর্বদাই নানা রকম কাজে ব্যস্ত, তারা নানা রকম দুঃখ-দুর্দশার দ্বারা নিপীড়িত হয়ে ভগবানের শরণাগত হয় এবং শুদ্ধ ভগবদ্ভক্তের সংস্পর্শে আসার ফলে দুঃখের মধ্যেও তারা ভগবদ্ভতে পরিণত হয়। নৈরাশ্যের ফলেও অনেকে সাধুসঙ্গ করে এবং তার প্রভাবে ভগবানের কথা জানতে জিজ্ঞাসু হয়। তেমনই, আবার শূন্যগর্ভ দার্শনিকেরাও সমস্ত জাগতিক জ্ঞানের নিরর্থকতা উপলব্ধি করতে পেরে ভগবৎ-তত্ত্বজ্ঞান লাভ করার প্রয়াসী হয় এবং ভগবানের সেবা করতে শুরু করে। তার ফলে নির্বিশেষ ব্রহ্ম এবং ভগবানের আংশিক প্রকাশ পরমাত্মা স্তর অতিক্রম করে, পরমেশ্বর ভগবান অথবা তাঁর শুদ্ধ ভক্তের কৃপায় ভগবানের সাকার রূপের জ্ঞান লাভ করে। মোটের উপর এই সমস্ত আর্ত, অর্থার্থী, জিজ্ঞাসু ও জ্ঞানীরা যখন উপলব্ধি করতে পারে যে, পরমার্থ সাধন করার সঙ্গে জড়-জাগতিক লাভ-ক্ষতির কোন সম্পর্ক নেই, তখন তারা শুদ্ধ ভতে পরিণত হয়। এই পরম শুদ্ধ ভক্তির স্তরে উন্নীত না হওয়া পর্যন্ত ভগবৎ- সেবায় নিয়োজিত ভক্ত সকাম কর্মের দ্বারা দূষিত হয়ে থাকে এবং জড়-জাগতিক জ্ঞানের অন্বেষণও করতে থাকে। তাই, শুদ্ধ ভগবদ্ভক্তির স্তরে উন্নীত হতে হলে, এই সমস্ত প্রতিবন্ধকগুলি অতিক্রম করতে হয়।

শ্লোকঃ ১৭

তেষাং জ্ঞানী নিত্যযুক্ত একভক্তিবিশিষ্যতে ।

প্রিয়ো হি জ্ঞানিনোহত্যর্থমহং স চ মম প্রিয়ঃ ॥ ১৭ ॥

তেষাম্—তাঁদের মধ্যে; জানী—তত্ত্বজ্ঞ, নিত্যযুক্তঃ —সর্বদাই আমাতে একাগ্রচিত্ত, এক–একমাত্র; ভক্তিঃ—ভগবদ্ভক্তিতে, বিশিষ্যতে — শ্রেষ্ঠ, প্রিয়ঃ—প্রিয়; হি— যেহেতু; জ্ঞানিনঃ—জ্ঞানীর, অত্যর্থ—অত্যন্ত, অহম্ — আমি; সঃ – তিনি; চ ও: মম—আমার; প্রিয়ঃ—প্রিয়।

গীতার গান

এই চারিজন মধ্যে জ্ঞানী সে বিশিষ্ট ৷

প্রিয় হয় জ্ঞানী মোর অতি সে বলিষ্ঠ।।

অনুবাদঃ এই চার প্রকার ভক্তের মধ্যে নিত্যযুক্ত, আমাতে একনিষ্ঠ তত্ত্বজ্ঞানীই শ্রেষ্ঠ। কেন না আমি তাঁর অত্যন্ত প্রিয় এবং তিনিও আমার অত্যন্ত প্রিয় ।

তাৎপর্যঃ সব রকম জড় বাসনার কলুষ থেকে মুক্ত হয়ে আর্ত, অর্থার্থী, জিজ্ঞাসু ও জ্ঞানীরা শুদ্ধ ভক্তে পরিণত হয়। কিন্তু এদের মধ্যে সমস্ত জড় বাসনা থেকে নিস্পৃহ তত্ত্বজ্ঞানী বাস্তবিকই শুদ্ধ ভগবস্তুতে পরিণত হন। এই চার শ্রেণীর মধ্যে যিনি পূর্ণ জ্ঞানবান এবং সেই সঙ্গে ভক্তিপরায়ণ, ভগবান বলেছেন যে, তিনিই প্রকৃতপক্ষে ভগবানের শুদ্ধ ভক্তে পরিণত হন। প্রকৃত জ্ঞান অন্বেষণ করার ফলে মানুষ উপলব্ধি করতে পারে যে, জড় দেহটি থেকে আত্মা ভিন্ন এবং এই তত্ত্বানুসন্ধানের পথে উত্তরোত্তর উন্নতি লাভ করে তিনি নিরাকার ব্রহ্মা ও পরমাত্মার জ্ঞান উপলব্ধি করেন। পূর্ণরূপে শুদ্ধ হওয়ার পর তিনি উপলব্ধি করতে পারেন যে, তাঁর স্বরূপে তিনি ভগবানের নিতা দাস। শুদ্ধ ভক্তদের সঙ্গ লাভ করার ফলে আর্ত, অর্থার্থী, জিজ্ঞাসু ও জ্ঞানী—এঁরা সকলেই শুদ্ধ হন। কিন্তু যে মানুষ প্রাথমিক সাধনাবস্থায় ভগবান সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞানসম্পন্ন এবং সেই সঙ্গে ভক্তিপরায়ণ, তিনি ভগবানের অতিশয় প্রিয়। যিনি ভগবানের অপ্রাকৃতত্ব সম্পর্কে ৬দ্ধ জ্ঞানে অধিষ্ঠিত, ভক্তিযোগের পথে ভগবান তাঁকে এমনভাবে সংরক্ষণ করেন যে, জড় জগতের কোন কলুষতা আর তাকে স্পর্শ করতে পারে না।

শ্লোকঃ ১৮

উদারাঃ সর্ব এবৈতে জ্ঞানী ত্বাত্মৈব মে মতম।

আস্থিতঃ স হি যুক্তাত্মা মামেবানুত্তমাং গতিম্ ৷৷ ১৮ ॥

উদারাঃ—উদার, সর্ব—সকলে, এর অবশ্যই, এতে – এরা; জ্ঞানী; জ্ঞানী, তু- কিন্তু; আত্মা এব—আমার নিজের মতো; মে—আমার মতন—মত; আস্থিতঃ — অবস্থিত, সঃ— তিনি। হি— যেহেতু যুক্তাত্মা – ভক্তিযোগে যুক্ত; নাম্—আমাকে; এব—অবশ্যই; অনুত্তমাম্ — সর্বোৎকৃষ্ট; গতিম্ — গতি।

গীতার গান

উক্ত চারিজন ভক্ত সকলে উদার ।

শুদ্ধভক্তি প্রাপ্ত হন ক্রমশ বিস্তার ॥

তার মধ্যে জ্ঞানী ভক্ত অতি সে আত্মীয় ।

সে কারণে উত্তম গতি হয় বরণীয় ।।

অনুবাদঃ এই সকল ভক্তেরা সকলেই নিঃসন্দেহে মহাত্মা, কিন্তু যে জ্ঞানী আমার তত্ত্বজ্ঞানে অধিষ্ঠিত, আমার মতে তিনি আমার আত্মস্বরূপ। আমার অপ্রাকৃত সেবায় যুক্ত হয়ে তিনি সর্বোত্তম গতিস্বরূপ আমাকে লাভ করেন।

তাৎপর্যঃ ভগবৎ-তত্ত্বজ্ঞানী ভগবদ্ভতেরা ভগবানের প্রিয়, কিন্তু তা বলে যে ভগবান তাঁর জন্য ভক্তদের ভালবাসেন না, তা নয়। ভগবান বলেছেন যে, তাঁরা সকলেই উদার, কারণ যে কোন উদ্দেশ্য নিয়ে যাঁরাই ভগবানের কাছে আসেন, তাঁরা সকলেই মহাত্মা। ভগবদ্ভক্তির বিনিময়ে যে সমস্ত ভক্ত কোন কিছু লাভের আশা করেন, ভগবন তাঁকেও গ্রহণ করেন, কারণ সেই ক্ষেত্রেও প্রীতির আদান-প্রদান হয়। ভগবানকে ভালবেসেই তাঁরা তাঁর কাছে কোন বিষয় লাভের কামনা করেন। তারপর তাঁর বাঞ্ছাপূর্তি-জনিত সন্তুষ্টির ফলে তিনি আরও গভীরভাবে ভগবানকে ভালবাসেন। কিন্তু তবুও পূর্ণ জ্ঞানবান ভগবদ্ভক্ত ভগবানের অতিশয় প্রিয়, কারণ তাঁর একমাত্র প্রয়োজন হচ্ছে প্রেমভক্তি সহকারে ভগবানের সেবা করা। এই ধরনের ভক্ত ভগবৎ-সান্নিধ্য বা ভগবৎ-সেবা বিনা এক মুহূর্তও বাঁচতে পারেন না। সেই রকম ভগবানও তাঁর ভাতের প্রতি এতই অনুরক্ত যে, তাঁকে ছেড়ে তিনি থাকতে পারেন । শ্রীমদ্ভাগবতে (৯/৪/৬৮) ভগবান বলেছেন-

সাধবো হৃদয়ং মহাং সাধুনাং হৃদয়ং অহম্ ।

মদনাৎ তে ন জানন্তি নাহং তেভ্যো মনাগপি ॥

ভক্তেরা আমার হৃদয়ে সর্বদাই নিবাস করেন এবং আমিও সর্বক্ষণই তাঁদের হৃদয়ে বিরাজমান থাকি। আমারে ছাড়া ভক্ত আর কিছুই জানেন না, আর আমিও তাই ভক্তকে কখনই ভুলতে পারি না। আমার শুদ্ধ ভক্তের সঙ্গে আমার যে সম্পর্ক তা প্রগাঢ় প্রেমময় ও আন্তরিক। পূর্ণজ্ঞানী শুদ্ধ ভক্তেরা কখনই পারমার্থিক সান্নিধা বর্জন করেন না, তাই তাঁরা আমার এত প্রিয়।”

error: Content is protected !!