শ্লোকঃ ১৩

ত্রিভির্গুণময়ৈর্ভাবৈরেভিঃ সর্বমিদং জগৎ ।

মোহিতং নাভিজানাতি মামেভ্যেঃ পরমব্যয়ম্ ॥ ১৩॥

ত্রিভিঃ—তিন; গুণময়ৈঃ— গুণের দ্বারা ভাবৈঃ—ভাবের দ্বারা; এভিঃ এই সর্বস্— সমগ্র; ইদম্—এই; জগৎ— জগৎ; মোহিতম — মোহিত, ন অভিজানাতি — জানতে পারে না, মাম্—আমাকে; এভ্যঃ – এই সকলের অতীত; পরম্পরম; অব্যয়ম্— অবায়।

গীতার গান

এই তিনগুণ দ্বারা মোহিত জগত ।

না বুঝিতে পারে মোরে পরম শাশ্বত ॥

অনুবাদঃ (সত্ত্ব, রজ ও তম) তিনটি গুণের দ্বারা মোহিত হওয়ার ফলে সমগ্র জগৎ এই সমস্ত গুণের অতীত ও অব্যয় আমাকে জানতে পারে না।

তাৎপর্যঃ জড়া প্রকৃতির এই তিনটি গুণের দ্বারা সমগ্র জগৎ বিমোহিত হয়ে আছে। জড়া প্রকৃতি বা মায়ার প্রভাবে যারা বিমোহিত, তারা বুঝতে পারে না যে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন এই জড়া প্রকৃতির অতীত।

প্রকৃতির প্রভাবে জড় জগতে প্রতিটি জীব ভিন্ন ভিন্ন দেহ প্রাপ্ত হয় এবং ভিন্ন ভিন্ন মানসিক ও দৈহিক গুণাবলীতে ভূষিত হয়। এই গুণের প্রভাবে মানুষেরা চারটি বর্ণে বিভক্ত হয়। যাঁরা সত্ত্বগুণের দ্বারা প্রভাবিত, তাঁদের বলা হয় ব্রাহ্মণ। যারা রজোগুণের দ্বারা প্রভাবিত, তাঁদের বলা হ্যা ক্ষত্রিয়। যারা রজ ও তমোগুণের দ্বারা প্রভাবিত, তাদের বলা হয় বৈশ্য। যারা সম্পূর্ণ তমোগুণের দ্বারা প্রভাবিত, তাদের বলা হয় শূদ্র। আর তার থেকেও যারা হেয়, তারা হচ্ছে পশু। তবে, এই বর্ণবিভাগ নিত্য নয়। আমি ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য কিংবা শূদ্র অথবা যা-ই হই না কেন, যে কোন অবস্থাতেই এই জীবনটি অনিত্য। কিন্তু যদিও জীবন অনিত্য এবং আমরা জানি না পরবর্তী জীবনে কি দেহ আমরা লাভ করব, তবুও মায়ার দ্বারা মোহিত হয়ে আমরা আমাদের দেহটিকেই আমাদের স্বরূপ বলে মনে করি এবং ভাবতে শুরু করি যে, আমরা আমেরিকান, রাশিয়ান, ভারতীয়, কিংবা ব্রাহ্মণ, হিন্দু, মুসলমান আদি। এভাবেই যখন আমরা জড় গুণের দ্বারা আবদ্ধ হয়ে পড়ি, তখন সমস্ত গুণের অন্তরালে যে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আছেন, তা আমরা ভুলে যাই। তাই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, জড়া প্রকৃতির তিনটি গুণের দ্বারা বিমোহিত হয়ে মানুষ বুঝতে পারে না যে, এই সমস্ত বিশ্ব-চরাচরের উৎস হচ্ছেন পরম পুরুষোত্তম ভগবান স্বয়ং।

পশু পক্ষী, মানুষ, গন্ধর্ব, কিন্নর, দেব-দেবী আদি প্রতিটি বিভিন্ন জীবই জড়া প্রকৃতির দ্বারা প্রভাবিত এবং এরা সকলেই অপ্রাকৃত পরমেশ্বর ভগবানকে ভুলে গেছে। যারা রজ ও তমোগুণের দ্বারা আচ্ছাদিত, এমন কি যারা সত্ত্বগুণ-সম্পন্ন, তারও পরম তত্ত্বের নির্বিশেষ ব্রহ্ম-উপলব্ধির ঊর্ধ্বে যেতে পারে না। শ্রীভগবান, যিনি পরম পুরুষ, যাঁর মধ্যে পরিপূর্ণ শ্রী, ঐশ্বর্য, জ্ঞান, বীর্য, যশ ও বৈরাগ্য বিদ্যমান, সেই ষড়ৈশ্বর্যপূর্ণ সবিশেষ ভগবানের সামনে তারা বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। সুতরাং, যারা সত্ত্বগুণে অধিষ্ঠিত রয়েছে, তারাও যখন এই তত্ত্বকে বুঝতে পারে না, তখন রজ ও তমোগুণের দ্বারা আচ্ছাদিত জীবের সম্বন্ধে আর কি আশা করা যেতে পারে? কৃষ্ণভাবনামৃত বা কৃষ্ণভক্তি হচ্ছে জড়া প্রকৃতির এই তিন গুণের অতীত। আর যাঁরা সর্বতোভাবে কৃষ্ণভাবনায় মগ্ন হয়ে আছেন, তাঁরাই হচ্ছেন প্রকৃত মুক্ত।

শ্লোকঃ ১৪

দৈবী হ্যেষা গুণময়ী মম মায়া দূরত্যয়া ৷

মামে যে প্রপদ্যন্তে মায়ামেতাং তরন্তি তে ।৷ ১৪ ॥

দৈবী—অলৌকিকী; হি—নিশ্চয়; এষা—এই গুণময়ী — ত্রিগুণময়ী, মম – আমার মায়াশক্তি; দুরতায়া — দুরতিক্রমণীয়া; মাম্—আমাকে; এর – অবশ্যই, যে—যাঁরা; প্রপদ্যন্তে—শরণাগত হন; মায়াম্ এতাম্—এই মায়াশক্তিকে, তরন্তি— উত্তীর্ণ হন, তে—তাঁরা।

গীতার গান

অতএব গুণময়ী আমার যে মায়া ৷

বহিরঙ্গা শক্তি সেই অতি দূরত্যয়া ॥

সে মায়ার হাত হতে যদি মুক্তি চায় ৷

আমার চরণে সেই প্রপত্তি করয় ৷।

অনুবাদঃ আমার এই দেবী মায়া ত্রিগুণাত্মিকা এবং তা দুরতিক্রমণীয়া। কিন্তু যাঁরা আমাতে প্রপত্তি করেন, তাঁরাই এই মায়া উত্তীর্ণ হতে পারেন।

তাৎপর্যঃ পরমেশ্বর ভগবান অনন্ত দিব্য শক্তির অধীশ্বর এবং সেই শক্তিরাজি দিব্যগুণ-সম্পন্ন। যদিও জীব তাঁর সেই শক্তিসম্ভূত এবং তাই দিব্য, কিন্তু জড়া শক্তির সংস্পর্শে আসার ফলে তাদের সেই প্রকৃত দিব্য স্বরূপ আচ্ছাদিত হয়ে পড়েছে। এভাবেই জড়া শক্তির প্রভাবে আচ্ছাদিত হওয়ার ফলে জীব তার বন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারে না। পূর্বেই বলা হয়েছে যে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণের থেকে উদ্ভূত হওয়ার ফলে চিন্ময় পরা শক্তি ও জড় অপরা শক্তি উভয়ই নিত্য। জীব ভগবানের নিত্য পরা শক্তির অংশ, কিন্তু অপরা প্রকৃতি বা মায়ার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়ার ফলে তার মোহও নিত্য। তাই জড় জগতের বন্ধনে আবদ্ধ জীবকে বলা হয় নিত্যবদ্ধ। জড় জগতের সময়ের হিসাবে কেউই বলতে পারে না, জীব করে বদ্ধ অবস্থা প্রাপ্ত হয়েছে। তাই এই জড় জগতের বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়া তার পক্ষে অত্যন্ত কঠিন। জড়া প্রকৃতি যদিও ভগবানের অনুৎকৃষ্টা শক্তি, তবুও পরমেশ্বর ভগবানের পরম ইচ্ছার দ্বারা পরিচালিত হওয়ার ফলে ভগবানের উৎকৃষ্টা শক্তি জীব তাকে অতিক্রম করতে পারে না বা তার প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারে না। অনুৎকৃষ্টা জড়া শক্তি বা মায়াকে ভগবান এখানে দৈবী বলে অভিহিত করেছেন, কেন না তা ভগবানের সঙ্গে সম্পর্কিত। ভগবানের ইচ্ছাশক্তির দ্বারা পরিচালিত হওয়ার ফলে এই অপরা প্রকৃতি নিকৃষ্ট হওয়া সত্ত্বেও অদ্ভুতভাবে সৃষ্টি এবং বিনাশের কাজ করে চলেছে। এই সম্বন্ধে বেদে বলা হয়েছে— মায়াং তু প্রকৃতিং বিদ্যা্যায়িনং তু মহেশ্বরম । “মায়া যদিও মিথ্যা অথবা অনিতা, তবুও মায়ার অন্তরালে রয়েছেন পরম যাদুকর পরম পুরুষ ভগবান, যিনি হচ্ছেন মহেশ্বর, পরম নিয়ন্তা।” (শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ ৪ / ১০ )

ভ্রুণ শব্দের আর একটি অর্থ হচ্ছে রজ্জু। এর থেকে বোঝা যায় যে, মায়া এ সমস্ত রজ্জুর দ্বারা বন্ধ জীবকে দৃঢ়ভাবে বেঁধে রেখেছে। যে মানুষের হাত- পা দড়ি দিয়ে বাঁধা, সে নিজে মুক্ত হতে পারে না। মুক্ত হতে হলে তাকে এমন কারও সাহায্য নিতে হয়, যিনি নিজে মুক্ত। কারণ, যে নিজেই বদ্ধ, সে কাউকে মুক্ত করতে পারে না; অর্থাৎ মুক্ত পুরুষেরাই কেবল অপরকে মুক্ত করতে পারেন। তাই, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অথবা তাঁর প্রতিনিধি শ্রীগুরুদেরই কেবল বন্ধ জীবকে জড় বন্ধন থেকে মুক্ত করতে পারেন। এই ধরনের পরম সাহায্য ব্যতীত জড়া প্রকৃতির বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়া যায় না। ভক্তিযোগ বা কৃষ্ণভাবনা এই মুক্তির পরম সহায়ক হতে পারে। শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন মায়াশক্তির অধীশ্বর। তাই, তিনি যখন এই অলঙ্ঘনীয় মায়াকে আদেশ দেন কাউকে মুক্ত করে দিতে, মায়া তৎক্ষণাৎ তাঁর সেই আদেশ পালন করেন। জীব হচ্ছে ভগবানের সন্তান, তাই জীব যখন ভগবানের শরণাগত হয়, তখন ভগবান তাঁর অহৈতুকী করণাবশে পিতৃবৎ স্নেহে তাকে মুক্ত করতে মনস্থ করেন এবং তিনি তখন মায়াকে আদেশ দেন তাকে মুক্ত করে দিতে। তাই, ভগবানের চরণ কমলের শরণাগত হওয়াটাই হচ্ছে কঠোর জড়া প্রকৃতির কবল থেকে মুক্ত হওয়ার একমাত্র উপায়।

মান এর কথাগুলিও তাৎপর্যপূর্ণ। মাম্ মানে শ্রীকৃষ্ণকে বা বিষ্ণুকেই বোঝায়— ব্রহ্মা। কিংবা শিব নয়। যদিও ব্রহ্মা এবং শিব অসীম শক্তিসম্পন্ন এবং তারা প্রায় বিষ্ণুর সমকক্ষ, কিন্তু ভগবানের এই রজোগুণ ও তমোগুণের গুণাবতারেরা কখনই জীবকে মায়ার বন্ধন থেকে মুক্ত করতে পারে না। পক্ষান্তরে বলা যায়, ব্রহ্মা এবং শিবন্ত মায়ার দ্বারা প্রভাবিত। বিষ্ণুই কেবল মায়াধীশ। তাই, তিনিই কেবল বন্ধ জীবকে মায়ার বন্ধন থেকে মুক্ত করতে পারেন। এই সম্বন্ধে বেদে (শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ ৩/৮) প্রতিপন্ন করা হয়েছে, তমেব বিদিতা, অর্থাৎ “শ্রীকৃষ্ণকে জানার মাধ্যমেই কেবল জড় বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়া যায়।” স্বয়ং মহাদেব স্বীকার করেন যে, বিষ্ণুর কৃপার ফলেই কেবল মুক্তি লাভ করা যায়। তিনি বলেছেন, মুক্তিপ্রদাতা সর্বেষাং বিষ্ণুরের ন সংশয়ঃ—“ভগবান শ্রীবিষ্ণুই যে সকলের মুক্তিদাতা, সেই সম্বন্ধে কোন সংশয় নেই ।”

শ্লোকঃ ১৫

ন মাং দুষ্কৃতিনো মূঢ়াঃ প্রপদ্যন্তে নরাধমাঃ ।

মায়য়াপহৃতজ্ঞানা আসুরং ভাবমাশ্রিতাঃ ॥ ১৫ ॥

ন—না; মাম—আমাকে; দুষ্কৃতিনঃ — দুষ্কৃতকারী: মূঢ়াঃ — মূঢ়ঃ প্রপদ্যন্তে — শরণাগত হয়; নরাধমাঃ— নিকৃষ্ট নরগণ মায়য়া—মায়ার দ্বারা; অপহৃত — অপহৃত; জ্ঞানাঃ —যাদের জ্ঞান; আসুরম্—আসুরিক ভাবম্ স্বভাব, আশ্রিতাঃ – আশ্রয় করে।

গীতার গান

কিন্তু যারা দুরাচার নরাধম মূঢ় ।

সর্বদাই গুণকার্যে অতিমাত্ৰা দৃঢ় ৷।

মায়ার দ্বারাতে যারা অপহৃত জ্ঞান

প্রপত্তি করে না তারা যত অসুরান্ ॥

অনুবাদঃ মূঢ়, নরাধম, মায়ার দ্বারা যাদের জ্ঞান অপহৃত হয়েছে এবং যারা আসুরিক ভাবসম্পন্ন, সেই সমস্ত দুষ্কৃতকারীরা কখনও আমার শরণাগত হয় না।

তাৎপর্যঃ ভগবদ্গীতাতে বলা হয়েছে যে, পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শ্রীচরণকমলে শুধুমাত্র আত্মসমর্পণ করলেই অনায়াসে দুরতিক্রম্য মায়াকে অতিক্রম করা যায়। প্রশ্ন হতে পারে যে, তথাকথিত পণ্ডিত, দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক, ব্যবসায়ী, পরিচালক, রাজনীতিবিদ ও জনসাধারণের নেতারা কেন সর্ব শক্তিমান পরমেশ্বর ভগবানের শ্রীচরণে শরণাগত হন না? মানব সমাজের নেতারা জড়া প্রকৃতির বিধান থেকে মুক্তি লাভ করার জন্য বহু বছর ধরে অব্যবসায় সহকারে অনেক বড় বড় পরিকল্পনা করে। কিন্তু সেই মুক্তি লাভ করাটা যদি কেবল মাত্র ভগবানের শ্রীচরণে আত্মসমর্পণ করার মতো সহজ ব্যাপার হয়, তা হলে এই সমস্ত বুদ্ধিমান ও কঠোর পরিশ্রমী নেতারা সেই সহজ সরল পন্থাকে অবলম্বন করে না কেন?

ভগবদ্গীতাতে অত্যন্ত সরলভাবে সেই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হয়েছে। যে সমস্ত তত্ত্বজ্ঞ পুরুষ সমাজের যথার্থ নেতা, যেমন—ব্রহ্মা, শিব, কুমার, মনু, ব্যাসদেব, কপিল, দেবল, অসিত, জনক, প্রহ্লাদ, বলি এবং পরবর্তীকালে মাচার্য, রামানুজাচার্য, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু এবং আরও অনেকে—যাঁরা হচ্ছেন বিশ্বস্ত দার্শনিক, রাজনীতিবিদ, শিক্ষক, বৈজ্ঞানিক, তাঁরা সকলেই পরম শক্তিমান পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চরণে আত্মসমর্পণ করেছেন। যারা প্রকৃতপক্ষে দার্শনিক নয়, বৈজ্ঞানিক নগ্ন, শিক্ষক নয়, শাসক নয়, কিন্তু স্বার্থসিদ্ধির জন্য সেই প্রকার ভান করে লোক ঠকায়, তারা কখনই ভগবানের নির্ধারিত পন্থা অবলম্বন করে না। ভগবান সম্বন্ধে তাদের কোন ধারণা নেই; তারা কেবলমাত্র মনগড়া জড়-জাগতিক পরিকল্পনা রচনা করে এবং তার ফলে সমাজের সমস্যা লাঘব হওয়ার পরিবর্তে তাদের ব্যর্থ প্রচেষ্টার দ্বারা তা আরও জটিল হয়ে ওঠে। কারণ, জড়া প্রকৃতি এতই শক্তিশালী যে, আসুরিক ভাবাপন্ন নাস্তিক নেতাদের সব রকম শাস্ত্রবিরোধী পরিকল্পনাগুলি সে ব্যর্থ করে দেয় এবং ‘পরিকল্পনা কমিশনগুলির’ জ্ঞানের দত্ত নস্যাৎ করে দেয়।

নাস্তিক পরিকল্পনাকারীদের এখানে দুষ্কৃতিনঃ অথবা ‘দুষ্কৃতকারী’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। কৃতী মানে সুকৃতিকারী। ভগবৎ-বিদ্বেষী পরিকল্পনাকারীরা অনেক সময়ে খুব বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন ও গুণ-সম্পন্নও হয়, বেন না যে কোন বড় পরিকল্পনা, তা ভালই হোক অথবা খারাপই হোক, সফল করতে হলে বুদ্ধির প্রয়োজন হয়। কিন্তু পরমেশ্বরের পরিকল্পনার বিরুদ্ধাচরণ করে বলে নিরীশ্বরবাদী পরিকল্পনাকারীদের দুষ্কৃতী বলা হয় অর্থাৎ তাদের বুদ্ধি ও প্রচেষ্টা ভুল পথে চালিত হচ্ছে।

ভগবদ্‌গীতাতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, জড়া শক্তি সম্পূর্ণভাবে ভগবানের নির্দেশে পরিচালিত হয়। এর কোনও স্বাধীন-স্বতন্ত্র ক্ষমতা নেই। কোন কিছুর প্রতিবিম্ব যেমন প্রকৃত বস্তুর উপর নির্ভরশীল, জড়া প্রকৃতিও ঠিক তেমনই ভগবানের উপর নির্ভরশীল, কিন্তু তবুও জড়া শক্তি অত্যন্ত শক্তিশালী। ভগবৎ- বিমুখ নাস্তিকদের ভগবৎ-তত্ত্বজ্ঞান নেই, তাই তারা কখনই বুঝতে পারে না জড়া প্রকৃতি কিভাবে পরিচালিত হয় এবং ভগবানের পরিকল্পনা কি। মায়ার প্রভাবে সম্মোহ এবং রজোগুণ ও তমোগুণের দ্বারা আচ্ছাদিত থাকার ফলে তার সব কয়টি পরিকল্পনাই ব্যর্থ হয়। হিরণ্যকশিপু, রাবণ আদি অসুরেরা বিদ্যা-বুদ্ধিতে কারও চাইতে কম ছিল না। তারা সকলেই ছিল মস্ত বড় বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক, শিক্ষক ও পরিচালক। কিন্তু ভগবানের ইচ্ছায় তাদের সেই সমস্ত বিরাট বিরাট পরিকল্পনাগুলি ধূলিসাৎ হয়ে যায়। এই সমস্ত দুরাচারীদের চারটি ভাগে ভাগ করা যায়—মুঢ়, নরাধম, মায়াপহৃত জ্ঞান ও আসুরিক ভাবাপন্ন।

(১) মুট হচ্ছে তারা, যারা কঠোর পরিশ্রমী ভারবাহী পশুর মতো মূর্খ। তারা সব সময় তাদের নিজেদের পরিশ্রমের ফল নিজেরাই ভোগ করতে চায়। তাই, তারা শ্রীভগবানকে তাদের কর্ম উৎসর্গ করতে পারে না। গাধা হচ্ছে ভারবাহী পশুর শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। এই পশুটি তার মনিবের জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে পারে। এই বেচারি গাধা জানে না সে কার জন্য দিন-রাত খেটে চলেছে। একটুখানি ঘাস খেয়ে উদরপূর্তি করে, মনিবের হাতে মার খাওয়ার আতঙ্কে একটুখানি ঘুমিয়ে উঠে এবং গর্দভীর লাথি খেতে খেতে তার যৌন ক্ষুধার তৃপ্তি করে সে মনে করে যে, সে খুব সুখেই আছে। এই গাধাগুলি মাঝে মাঝে কবিতা আবৃত্তি করে জীবন-দর্শন আওড়ায়, কিন্তু তার রাসভ-নাদের কলে সে অন্যদের কেবল জ্বালাতনই করে। গূঢ় সকাম কর্মীদের অবস্থাও ঠিক এই গাধারই মতো। তারা জানে না কার জন্য কর্ম করা উচিত। তারা জানে না যে, কর্ম করার প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে যজ্ঞ, অর্থাৎ ভগবানকে সন্তুষ্ট করাই হচ্ছে কর্ম করার যথার্থ উদ্দেশ্য।

এই সমস্ত কর্মী, যারা তাদের স্বকল্পিত কর্তব্যের ভার লাঘব করার জন্য দিন- রাত গাধার মতো খেটে চলেছে, তারা প্রায়ই বলে যে, জীবের অমরত্বের কথা শোনবার মতো সময় তাদের নেই। এই সমস্ত মূঢ় লোকগুলির কাছে ক্ষয়িষ্ণু জাগতিক লাভটাই হচ্ছে সব কিছু। অথচ এরা জানে না দিন-রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে তারা যে কর্ম করছে, তার একটা নগণ্য অংশই কেবল তারা উপভোগ করতে পারে। অনর্থক বিষয় লাভের জন্য তারা দিনরাত না ঘুমিয়ে গাধার মতো পরিশ্রম করে, মন্দাগ্নি আদি উদরপীড়ায় পীড়িত হয়ে এক রকম অনাহারে থেকে তারা তাদের কল্পিত প্রভুর সেবায় রত থাকে। তাদের যথার্থ প্রভুকে না জেনে তারা ধনদেবতার পরিচর্যা করে তাদের অমূল্য সময় নষ্ট করে। দুর্ভাগ্যবশত, তারা কখনই সমস্ত প্রভুর পরম প্রভুর শরণাগত হয় না, অথবা তারা নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে তাঁর কথা শ্রবণ করে না। বিষ্ঠাহারী শূকর কখনই দুধ, ঘি, চিনির তৈরি মিঠাই খেতে চায় না। তেমনই, মূঢ় কর্মীরা অস্থির পার্থিব জগতের ইন্দ্রিয়-তৃপ্তিদায়ক কথাই কেবল শ্রবণ করে, কিন্তু যে শাশ্বত প্রাণশক্তি জড় জগৎকে চালনা করছে, সেই অপ্রাকৃত শক্তির কথা শোনবার বিন্দুমাত্র সময় পায় না।

(২) অন্য শ্রেণীর দুরাচারীদের বলা হয় নরাধম অর্থাৎ তারা হচ্ছে সব চাইতে নিকৃষ্ট স্তরের মানুষ। ৮৪,০০,০০০ যোনির মধ্যে ৪,০০,০০০ হচ্ছে মনুষ্য-যোনি। এর মধ্যে অসংখ্য নিম্ন শ্রেণীর মানুষ আছে, যারা সাধারণত অসভ্য। সভ্য মানুষ হচ্ছেন তাঁরা, যাঁরা শাস্ত্রের নির্দেশ অনুসারে সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় জীবন যাপন করে। আর সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে উন্নত হলেও যাদের জীবন ধর্মীয় অনুশাসনের দ্বারা পরিচালিত হয় না, তাদের নরাধম বলে গণ্য করা হয়। ভগবানকে বাদ দিয়ে কখনও কোন ধর্ম হয় না। কারণ, ধর্মের পথ অনুসরণ করার উদ্দেশ্য হচ্ছে পরম-তত্ত্বকে জানা এবং তাঁর সঙ্গে মানুষের নিতা সম্পর্কের কথা অবগত হওয়া। গীতাতে পরমেশ্বর ভগবান স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন যে, তাঁর উপরে ক্ষমতাশালী কেউ নেই এবং তিনিই হচ্ছেন পরম সত্য। তাঁর ঊর্ধ্বে আর কোনও ক্ষমতা নেই। সভ্য মানব-জীবনের উদ্দেশ্য হচ্ছে পরম সত্য বা সর্ব শক্তিমান, পরম পুরুষ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে মানুষের নিতা সম্পর্কের লুপ্ত চেতনার পুনর্জাগরণ করা। মনুযা-শরীর পাওয়া সত্ত্বেও যে এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে না, তাকে বলা হয় নরাধম । শাস্ত্রের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি যে, শিশু যখন মাতৃগর্ভে থাকে (যে অবস্থাটি অত্যন্ত অস্বস্তিকর), তখন সে ভগবানের কাছে প্রতিজ্ঞা করে যে, সেই অবস্থা থেকে মুক্ত হলেই সে ভগবানের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করবে। বিপদে পড়লে ভগবানকে প্রার্থনা জানানো জীবের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি, কারণ ভগবানের সঙ্গে তার নিত্য সম্বন্ধ রয়েছে। কিন্তু প্রসব হওয়ার পরেই শিশু তার জন্ম-যন্ত্রণার কথা ভুলে যায় এবং মায়ার প্রভাবে তার মুক্তিদাতাকেও ভুলে যায় ।

শিশুর অভিভাবকদের কর্তব্য হচ্ছে, তাঁদের সন্তানদের সুপ্ত ভগবৎ-প্রেমকে পুনর্জাগরিত করা। ধর্মশাস্ত্র মনু স্মৃতিতে নির্দেশিত দশকর্ম সংস্কারের উদ্দেশ্য হচ্ছে, বর্ণাশ্রম পদ্ধতির মাধ্যমে এই ভগবৎ-প্রেমকে পুনর্জাগরিত করা। কিন্তু আধুনিক যুগে পৃথিবীর কোথাও এই পদ্ধতি কঠোরভাবে অনুসরণ করা হয় না। তাই, আধুনিক যুগে শতকরা নিরানব্বই জন মানুষই নরাধমে পরিণত হয়েছে।

যখন সমগ্র জনগণই নরাধমে পরিণত হয়, তখন স্বাভাবিক ভাবেই সর্ব শক্তিময়ী মায়ার প্রভাবে তাদের তথাকথিত শিক্ষা সম্পূর্ণভাবে অর্থহীন হয়ে পড়ে। গীতার মানদণ্ড অনুসারে, তিনিই হচ্ছেন প্রকৃত পণ্ডিত, যিনি একজন বিদ্বান ব্রাহ্মণ, একটি কুকুর, একটি গরু, একটি হাতি ও একজন চণ্ডালকে সমদৃষ্টিতে দেখেন। এই হচ্ছে শুদ্ধ ভগবদ্ভক্তের দৃষ্টিভঙ্গি। পরমেশ্বর ভগবানের অবতার শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু যথার্থ নরাধম জগাই ও মাধাই ভ্রাতৃদ্বয়কে উদ্ধার করেন এবং এভাবেই তিনি দেখিয়ে গেছেন যে, প্রকৃত ভগবদ্ভক্তের করুণা কিভাবে সব চাইতে অধঃপতিত মানুষের উপরেও বর্ষিত হয়। তাই, যে নরাধমকে ভগবান পর্যন্ত পরিত্যাগ করেছেন, ভগবদ্ভক্তের কৃপার প্রভাবে তার হৃদয়ে আবার পারমার্থিক কৃষ্ণভাবনার উন্মেষ হতে পারে।

শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু ভাগবত-ধর্ম অথবা ভগবদ্ভক্তদের কার্যপদ্ধতি প্রচার করে। উপদেশ দিয়ে গেছেন যে, শ্রদ্ধাবনত চিত্তে মানুষকে পরমেশ্বর ভগবানের বাণী শ্রবণ করতে হবে। ভগবানের দেওয়া এই উপদেশের সারমর্ম হচ্ছে ভগবদ্গীতা। শ্রদ্ধাবনত চিত্তে ভগবানের দেওয়া উপদেশ শ্রবণ করার ফলে নরাধমও উদ্ধার পেতে পারে, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ভগবানের চরণে আত্মসমর্পণ করা তো দূরে থাকুক, এই সমস্ত নরাধমগুলি ভগবানের বাণী পর্যন্ত কানে শুনতে চায় না। এভাবেই নরাধমেরা সব সময়ই মানব-জীবনের পরম কর্তব্যকে একেবারেই অবহেলা করে। (৩) পরবর্তী শ্রেণীর দুষ্কৃতকারীদের বলা হয় মায়য়াপহাতজ্ঞানাঃ, অর্থাৎ মায়ার প্রভাবে যাদের পাণ্ডিত্যপূর্ণ জ্ঞান অপহৃত হয়েছে। সাধারণত এরা অধিকাংশই খুব বিদ্বান হয়— যেমন বড় বড় দার্শনিক, কবি, বৈজ্ঞানিক, সাহিত্যিক আদি। কিন্তু মায়াশক্তি তাদের বিপথগামী করেছে, তাই তারা পরমেশ্বর ভগবানকে অবজ্ঞা করে থাকে।

আজকের জগতে অসংখ্য মায়য়াপহৃতজ্ঞানাঃ মানুষ দেখা যায়, এমন কি অনেক ভগবদ্‌গীতার পণ্ডিতও এই ধরনের মূঢ়। গীতাতে সহজ সরল ভাষায় বলা হয়েছে, যে, শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন স্বয়ং পরম পুরুষোত্তম ভগবান। তাঁর সমকক্ষ অথবা তাঁর থেকে মহৎ আর কেউ নেই। তাঁকে সমস্ত মানুষের আদি পিতা ব্রহ্মারও পিতারূপে বর্ণনা করা হয়েছে। বস্তুত, শ্ৰীকৃষ্ণকে কেবল ব্রহ্মারই পিতা বলা হয় না, তিনি সমস্ত যোনিভুক্ত জীবেরও পিতা। তিনি নির্বিশেষ ব্রহ্মের আশ্রয় এবং সমস্ত জীবের অন্তর্যামী পরমাত্মা হচ্ছেন তাঁরই অংশ। তিনি সব কিছুরই উৎস, তাই তাঁর চরণারবিন্দের শরণাগত হওয়ার জন্য প্রত্যেককেই পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। সুদৃঢ়ভাবে এই সব সুস্পষ্ট নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও মায়য়াপহৃতজ্ঞানাঃ মানুষেরা ভগবানকে অবজ্ঞা করে এবং তাঁকে আর একজন সাধারণ মানুষ বলে মনে করে। তারা জানে না যে, এই দুর্লভ মনুষ্য শরীর ভগবানেরই নিত্য চিন্ময় শ্রীবিগ্রহের অনুকরণে রচিত হয়েছে।

মায়য়াপাতজ্ঞানাঃ মূর্খেরা গীতার যে প্রামাণাবর্জিত ব্যাখ্যা করে, তার ফলে তারা প্রকৃতপক্ষে গীতার যথাযথ অর্থের কদর্থ করে। গুরু পরম্পরাক্রমে গীতার জ্ঞান প্রাপ্ত না হওয়ার ফলে তারা গীতার প্রকৃত অর্থ উপলব্ধি করতে পারে না। তারা যে মনগড়া ব্যাখ্যা করে তা সম্পূর্ণরূপে ভ্রান্ত এবং তাদের সেই সমস্ত মতবাদগুলি পারমার্থিক সাধনার পথে দুরতিক্রম্য প্রতিবন্ধকের মতো হয়ে দাঁড়ায়। এই সমস্ত মোহগ্রস্ত ব্যাখ্যাকাররা কখনই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চরণারবিন্দের শরণাগত হয় না এবং অন্য কাউকেও ভগবানের শরণাগত হওয়ার শিক্ষাদান করে না।

(৪) সর্বশেষ শ্রেণীর দুষ্কৃতকারীদের বলা হয় আমুরং ভাবমাশ্রিতাঃ অথবা আসুরিক ভাবাপন্ন ব্যক্তি। এই ধরনের মানুষেরা নির্লজ্জভাবে নাস্তিক। এই শ্রেণীর নররূপধারী অসুরেরা তর্ক করে যে, পরমেশ্বর ভগবান কখনই এই জড় জগতে অবতরণ করতে পারেন না। কিন্তু ভগবান যে কেন এই জড় জগতে অবতরণ করতে পারেন না, সেই সম্বন্ধে তারা কোন যুক্তিও প্রদর্শন করতে পারে না। এদের কেউ কেউ আবার বলে যে, ভগবান নির্বিশেষ ব্রহ্মের অধীন, যদিও গীতাতে ঠিক এর বিপরীত কথাই বলা হয়েছে। পরম পুরুষোত্তম ভগবানের প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে এই সমস্ত নাস্তিকেরা স্বকপোলকল্পিত অপ্রামাণিক একাধিক অবতারদের অবতারণা করে। এই ধরনের মানুষদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে ভগবানের নিন্দা করা, তাই তারা কখনই শ্রীকৃষ্ণের চরণারবিন্দের শরণাগত হতে পারে না।

দক্ষিণ ভারতের শ্রীযামুনাচার্য আলবন্দার বলেছেন, “হে ভগবান! তুমি যদিও তোমার অপ্রাকৃত রূপ, গুণ ও লীলার দ্বারা অলঙ্কৃত, সমস্ত শাস্ত্র যদিও তোমার বিশুদ্ধ সময় শ্রীবিগ্রহকে অঙ্গীকার করে এবং দেবীগুণ সম্পন্ন জ্ঞানী আচার্যেরা তোমার জয়জয়কার করেন, কিন্তু তবুও আসুরিক ভাবাপন্ন নিরীশ্বরবাদীরা কখনই তোমাকে জানতে পারে না।”

তাই, উপরোক্ত (১) মুঢ়, (২) নরাধম, (৩) মায়াপহৃত-জ্ঞান (8) আসুরিক ভাবাপ! নাস্তিকেরা শাস্ত্র ও মহাজনদের উপদেশ সত্ত্বেও কখনই পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চরণারবিন্দের শরণাগত হয় না।

error: Content is protected !!