শ্লোকঃ ১০

বীজং মাং সর্বভূতানাং বিদ্ধি পার্থ সনাতনম্ ।

বুদ্ধির্বুদ্ধিমতামস্মি তেজস্তেজস্বিনামহম্ ॥ ১০॥

বীজম—বীজ, মাম্—আমাকে; সর্বভূতানাম্ — সর্বভূতের; বিদ্ধি— জানবে; পার্থ— হে পৃথাপুত্র; সনাতনম্— নিতা; বুদ্ধি: –বুদ্ধি; বুদ্ধিমতাম্—বুদ্ধিমানদের; অস্মি— হই, তেজঃ- -তেজ, তেজস্বিনাম্— তেজস্বীগণের, অহম্ — আমি ।

গীতার গান

উৎপত্তির বীজরূপ সবার সে আমি ।

সনাতন তত্ত্ব পার্থ সকলের স্বামী ॥

বুদ্ধিমান যেবা হয় তার বুদ্ধি আমি ।

তেজস্বীর তেজ হয় যাহা অন্তর্যামী ॥

অনুবাদঃ হে পার্থ, আমাকে সর্বভূতের সনাতন কারণ বলে জানবে। আমি বুদ্ধিমানের বুদ্ধি এবং তেজস্বীদের তেজ।

তাৎপর্যঃ বীজ থেকে সব কিছু উৎপত্তি হয় এবং শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন সব কিছুর বীজ। সচল ও অচল নানা রকমের জীব আছে। পশু, পাখি, মানুষ এই ধরনের জীবের জঙ্গম অর্থাৎ সচল। গাছপালা আদি হচ্ছে স্থাবর অর্থাৎ অচল, কেবল এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে। চুরাশি লক্ষ বিভিন্ন জীবের মধ্যে কেউ স্থাবর, কেউ আবার জঙ্গম। কিন্তু তাদের সকলেরই বীজ হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণ। বৈদিক শাস্ত্রে বলা হয়েছে, গ্রা বা পরমতত্ত্ব হচ্ছেন তিনিই, যাঁর থেকে সব কিছু উদ্ভূত হয়েছে। শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন পরমব্রহ্ম বা পরম আত্মা। ব্রহ্ম হচ্ছে নির্বিশেষ, কিন্তু পরমব্রহ্ম হচ্ছেন সবিশেষ। নির্বিশেষ ব্রহ্ম যে সবিশেষ রূপের মধ্যেই অবস্থিত, তা ভগবদ্গীতায় বলা হয়েছে। তাই, মূলত শ্ৰীকৃষ্ণই সব কিছুর উৎস। তিনিই সব কিছুর মূল। একটি গাছের মূল যেমন সমস্ত গাছটিকে প্রতিপালন করে, শ্রীকৃষ্ণও তেমন সব কিছুর আদি মূলরূপে সমস্ত জড় জাগতিক অভিপ্রকাশের প্রতিপালন করেন। বৈদিক শাস্ত্রে (কন্ঠ উপনিষদ ২/২/১৩) সেই কথা প্রমাণিত হয়েছে—

নিত্যো নিত্যানাং চেতনশ্চেতনানাম্

একো বহুনাং যো বিদধাতি কামান্।

যা কিছু নিত্য, তার মধ্যে তিনিই হচ্ছেন পরম নিতা। যা কিছু চেতন, তার মধ্যে তিনিই হচ্ছেন পরম চেতন। তিনি একাই সব কিছুর প্রতিপালন করেন। বুদ্ধি ছাড়া কেউ কোন কিছু করতে পারে না এবং শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন যে, তিনিই সমস্ত বুদ্ধির উৎস। মানুষের বুদ্ধির বিকাশ না হলে সে ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে জানতে পারে না।

শ্লোকঃ ১১

বলং বলবতাং চাহং কামরাগবিবর্জিতম্ ।

ধর্মবিরুদ্ধো ভূতেষু কামোহস্মি ভরতর্ষভ ৷৷ ১১ ৷৷

বলম্—বল; বলবতাম বলবানের; চ–এবং; অহম — আমি; কাম—কাম; রাগ— আসত্তি; বিবর্জিতম্—বিহীন; ধর্মবিরুদ্ধঃ —ধর্মের অবিরোধী; ভূতে—সমস্ত জীবের মধ্যে; কামঃ –কাম, অম্মি — হই; ভরতষভ – হে ভরতকুলশ্রেষ্ঠ।

গীতার গান

বলবান যত আছে তার বল আমি ।

কামরাগ বিবর্জিত যত অগ্রগামী ৷৷

ধর্ম অবিরুদ্ধ কাম হে ভরতভ ।

সে সব বুঝহ তুমি আমার বৈভব ।৷

অনুবাদঃ হে ভরত ভ ! আমি বলবানের কাম ও রাগ বিবর্জিত বল এবং ধর্মের অবিরোধী কামরূপে আমি প্রাণীগণের মধ্যে বিরাজমান ।

তাৎপর্যঃ যে বলবান তার কর্তব্য হচ্ছে দুর্বলকে রক্ষা করা। ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য যখন অপরকে আক্রমণ করা হয়, লুণ্ঠন করা হয়, তখন সেটি বলের অপচয় করা হয়। তেমনই, কাম বা যৌন জীবনের উদ্দেশ্য হচ্ছে ধর্মপরায়ণ সন্তান উৎপাদন করা। তা না করে যদি ইন্দ্রিয়-তৃপ্তির জন্য যৌন জীবন যাপন করা হয়, তা অন্যায়। প্রতিটি পিতা-মাতার পরম কর্তব্য হচ্ছে তাঁদের সন্তানদের কৃষ্ণভাবনাময় করে গড়ে তোলা।

শ্লোকঃ ১২

যে চৈব সাত্ত্বিকা ভাবা রাজসাস্তামসাশ্চ যে।

মত্ত এবেতি তান্ বিদ্ধি ন ত্বহং তেষু তে ময়ি ৷৷ ১২ ৷৷

যে—যে সকল; চ–এবং; এব— অবশ্যই, সাত্ত্বিকাঃ—সাত্ত্বিক; ভাবাঃ — ভাবসমূহ; রাজসাঃ—রাজসিক; তামসাঃ — তামসিক; চ–ও; যে যে সমস্ত; মত্তঃ — আমার থেকে; এব—অবশ্যই; ইতি—এভাবে; তান—সেগুলি; বিদ্ধি — জানবার চেষ্টা কর; ন—নই; তু—কিন্তু, অহম — আমি; তে—তাদের মধ্যে তে— তারা; ময়ি — আমাতে।

গীতার গান

যে সব সাত্ত্বিক ভাব রজস তমস ।

আমা হতে হয় সব আমি নহি বশ ॥

অনুবাদঃ সমস্ত সাত্ত্বিক, রাজসিক ও তামসিক ভাবসমূহ আমার থেকেই উৎপন্ন বলে • জানবে। আমি সেই সকলের অধীন নই, কিন্তু তারা আমার শক্তির অধীন।

তাৎপর্যঃ এই জড় জগতে সব কিছুই প্রকৃতির তিনটি গুণের প্রভাবে সাধিত হয়। জড়া প্রকৃতির এই ত্রিগুণ যদিও ভগবান শ্রীকৃষ্ণ থেকে সৃষ্টি হয়েছে, তবুও তিনি কখনই এই গুণত্রয়ের দ্বারা প্রভাবিত হন না। দৃষ্টান্তস্বরূপ, রাজা যেমন আইন সৃষ্টি করে দোষীদের দণ্ড দেন, কিন্তু তিনি নিজো সেই আইনের অতীত। তেমনই জড়া প্রকৃতির সমস্ত গুণ — সত্ত্ব, রজ ও তম পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ থেকে উদ্ভূত হয়েছে, কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ কখনও এই সমস্ত গুণের দ্বারা প্রভাবিত হন না। তাই তিনি নির্গুণ, অর্থাৎ এই গুণগুলি যদিও তাঁর থেকে সৃষ্টি হয়েছে, তবুও তিনি এই সমস্ত গুণের অতীত। এটিই হচ্ছে পরমেশ্বর ভগবানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

error: Content is protected !!