শ্লোকঃ ৭

মত্তঃ পরতরং নান্যৎ কিঞ্চিদস্তি ধনঞ্জয় ।

ময়ি সর্বমিদং প্রোতং সূত্রে মণিগণা ইব ॥ ৭ ॥

মত্তঃ—আমার থেকে, পরতরম্ — শ্রেষ্ঠ; ন–না; অন্যৎ – অনা; কিঞ্চিৎ – কিছু অস্তি— আছে, ধনঞ্জয় – হে ধনঞ্জয়; মথি আমাতে, সর্বস্—সব কিছু; ইদম্ এই; প্রোতম্—গাঁথা; সূত্রে — সূত্রে; মণিগণাঃ- মণিসমূহের; ইব—মতন।

গীতার গান

আমাপেক্ষা পরতত্ত্ব শুন ধনঞ্জয় ।

পরাৎপর যে তত্ত্ব অন্য কেহ নয় ॥

আমাতেই সমস্ত জগৎ আছে প্রতিষ্ঠিত ।

সূত্রে যেন গাঁথা থাকে মণিগণ যত ।৷

অনুবাদঃ হে ধনঞ্জয়! আমার থেকে শ্রেষ্ঠ আর কেউ নেই। সূত্রে যেমন মণিসমূহ গাঁথা থাকে, তেমনই সমস্ত বিশ্বই আমাতে ওতঃপ্রোতভাবে অবস্থান করে।

তাৎপর্যঃ পরমতত্ত্ব সবিশেষ না নির্বিশেষ এই সম্বন্ধে বহু আলোচিত মতবিভেদ আছে। ভগবদ্গীতাতে বলা হয়েছে যে, পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন পরমতত্ত্ব এবং প্রতি পদক্ষেপেই আমরা সেই সত্যের প্রমাণ পাই। বিশেষ করে এই শ্লোকটিতে পরমতত্ত্ব যে সবিশেষ পুরুষ, তা জোর দিয়ে বলা হয়েছে। পরমেশ্বর ভগবানের সবিশেষত্ব সম্বন্ধে ব্রহ্মসংহিতাতেও বলা হয়েছে—ঈশ্বরঃ পরমঃ কৃষ্ণঃ সচ্চিদানন্দবিগ্রহঃ । অর্থাৎ, পরমতত্ত্ব পরম পুরুষ ভগবান হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণ, তিনিই হচ্ছেন সমস্ত আনন্দের উৎস, তিনিই হচ্ছেন আদিপুরুষ গোবিন্দ এবং তাঁর শ্রীবিগ্রহ হচ্ছেন সং, চিহ্ন ও আনন্দময়। ব্রহ্মার মতো মহাজনদের কাছ থেকে যখন আমরা নিঃসন্দেহে জানতে পারি যে, পরমতত্ত্ব হচ্ছেন পরম পুরুষ এবং তিনি হচ্ছেন সর্ব কারণের পরম কারণ, তখন আর তাঁর সম্বন্ধে কোন সন্দেহ থাকে না। নির্বিশেষবাদীরা অবশ্য বৈদিক ভাষ্য মতে শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের (৩/১০) এই শ্লোকটির উল্লেখ করে তর্ক করে—ততো যদুত্তরতরং তদরূপমনাময়ম্ / য এতবিদুরমৃতাতে ভবতাথেতরে দুঃখমেরাপিযত্তি। “এই জড় জগতে ব্রহ্মা হচ্ছেন প্রথম জীব। সুর, অসুর ও মানুষের মধ্যে তিনিই হচ্ছেন শ্রেষ্ঠ। কিন্তু ব্রহ্মার ও ঊর্ধ্বে এক অপ্রাকৃত তত্ত্ব বর্তমান, যাঁর কোন জড় আকৃতি নেই এবং যিনি সব রকমের জড় কলুষ থেকে মুক্ত। তাঁকে যে জানতে পারেন, তিনি এই জড় বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে অপ্রাকৃত জগতে প্রবেশ করতে পারেন। আর যারা তাঁকে জানতে পারে না, তারা এই জড় জগতে নানা রকম দুঃখকষ্ট ভোগ করে।”

নির্বিশেষবাদীরা এই শ্লোকের অরূপ শব্দটির উপরে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে। কিন্তু এই অরূপম্ শব্দটির অর্থ নির্বিশেষ নয়। এর দ্বারা ভগবানের সচ্চিদানন্দময় অপ্রাকৃত রূপকে নির্দেশ করা হয়েছে, যা ব্রহ্মসংহিতার উপরে উদ্ধৃত অংশে ব্যক্ত হয়েছে। শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের অন্যান্য শ্লোকেও (৩/৮-৯) সেই কথার সত্যতা প্রমাণ করে বলা হয়েছে–

বেদাহমেতং পুরুষং মহান্তমাদিত্যবর্ণং তমসঃ পরস্তাৎ ।

তমেব বিদিত্বাহতি মৃত্যুমেতি নানাঃ পন্থা বিদ্যতেহয়নায় ।।

যস্মাৎ পরং নাপরমন্ত্রি কিঞ্চিদ্ যমানাণীয়ো ন জ্যায়োহতি কিঞ্চিৎ 

 বৃক্ষ ইব শুকো দিবি তিষ্ঠতোকঃ তেনেদং পূর্ণং পুরুষেণ সর্বম্ ॥

“আমি সেই পরমেশ্বরকে জানি, যিনি সর্বতোভাবে সংসারের সকল অজ্ঞানতার অন্ধকারের অতীত। যিনি তাকে জানেন, তিনিই কেবল জন্ম-মৃত্যুর বন্ধন থেকে চিরতরে মুক্তি পেতে পারেন। এই পরম পুরুষের জ্ঞান ব্যতীত আর কোন উপায়েই মুক্তি লাভ করা যায় না।

“এই পরম পুরুষের অতীত আর কোন সত্য নেই, কেন না তিনি হচ্ছেন সর্বশ্রেষ্ঠ। তিনি ক্ষুদ্রতম থেকে ক্ষুদ্রতর এবং তিনি মহত্তম থেকেও মহত্তর। একটি গাছের মতো মৌনভাবে অধিষ্ঠিত রয়েছেন এবং তিনি সমস্ত পরব্যোমকে আলোকে উদ্ভাসিত করে রেখেছেন। একটি গাছ যেমন তার শিকড় বিস্তার করে, তিনিও তেমনই তাঁর বিভিন্ন শক্তিকে বিস্তৃত করেছেন।”

এই সমস্ত শ্লোক থেকে আমরা অনায়াসে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, পরমেশ্বর ভগবানই হচ্ছেন পরমতত্ত্ব, যিনি তাঁর জড় ও চিন্তায় অনন্ত শক্তির প্রভাবে সর্বব্যাপ্ত।

শ্লোকঃ ৮

রসোঽহমপ্সু কৌন্তেয় প্রভাস্মি শশিসূর্যয়োঃ ৷

প্রণবঃ সর্ববেদেষু শব্দঃ খে পৌরুষং নৃষু ॥ ৮॥

রসঃ স্বাদ অহম্ —আমি; অপু — জনে; কৌন্তেয় — হে কুন্তীপুত্র: প্রভা – জ্যোতি; অস্মি—আমি হই, শশিসূর্যয়োঃ—চন্দ্র ও সূর্যের প্রণবঃ-ওয়ার, সর্ব সমগ্র, বেদেষু—বেদে; শব্দঃ শব্দ খে— আকাশে পৌরুষম্—ক্ষমতা; নম্—মানুষে।

গীতার গান

জলের যে সরসতা আমি সে কৌন্তেয় ।

চন্দ্রসূর্য প্রভা যেই আমা হতে জ্ঞেয় ৷।

সর্ববেদে যে প্রণব হয় মুখ্যতত্ত্ব ।

আকাশের শব্দ সেই আমি হই সত্য ।।

অনুবাদঃ হে কৌন্তেয়! আমিই জলের রস, চন্দ্র ও সূর্যের প্রভা, সর্ব বেদের প্রণব, আকাশের শব্দ এবং মানুষের পৌরুষ।

তাৎপর্যঃ এই শ্লোকে বর্ণনা করা হয়েছে, কিভাবে ভগবান তাঁর বিভিন্ন জড়া শক্তি ও চিৎ- শক্তির দ্বারা সর্বত্র পরিব্যাপ্ত। ভগবান সম্বন্ধে জানতে সচেষ্ট হলে প্রথমে তাঁর বিভিন্ন শক্তির প্রকাশের মাধ্যমে তাঁকে অনুভব করা যায়। তবে এই স্তরের যে ভগবৎ-উপলব্ধি তা নির্বিশেষ। যেমন সুর্যদেব হচ্ছেন একজন পুরুষ এবং তাঁকে উপলব্ধি করা যায় তাঁর সর্বব্যাপক শক্তি তাঁর বিরণের মাধ্যমে। তেমনই, পরমেশ্বর ভগবান যদিও তাঁর নিত্য ধামে বিরাজমান, তবুও তাঁর সর্বব্যাপক শক্তির প্রকাশের মাধ্যমে তার অস্তিত্ব উপলব্ধি করা যায়। জলের স্বাভাবিক স্বাদ হচ্ছে জলের একটি সক্রিয় ধর্ম। আমরা কেউ সমুদ্রের জল পান করতে চাই না, তার কারণ সেখানে বিশুদ্ধ জলের সাথে লবণ মেশানো রয়েছে। আস্বাদনের শুদ্ধতার জন্যই জলের প্রতি আমাদের আকর্ষণ এবং এই শুদ্ধ আস্বাদন ভগবানেরই অনন্ত শক্তির একটি অভিপ্রকাশ। নির্বিশেষবাদীরা জলের স্বাদের মধ্যে ভগবানের অস্তিত্ব অনুভব করে এবং সবিশেষবাদীরাও ভগবান যে করুণা করে মানুষের তৃষ্ণা নিবারণের জন্য জনের সৃষ্টি করেছেন, তার জন্য তাঁর গুণকীর্তন করেন। এভাবেই পরম পুরুষের উপলব্ধি হয়। প্রকৃতপক্ষে নির্বিশেষবাদ আর সবিশেষবাদের মধ্যে কোন বিবাদ নেই। যিনি বাস্তবিক ভগবানকে জেনেছেন, তিনি জানেন যে, নির্বিশেষ ও সবিশেষ উভয় রূপেই তিনি সব কিছুর মধ্যে বিরাজ করছেন এবং এতে কোন বিরোধ নেই।

তাই শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু মহা মহিমান্বিত অচিন্তা-ভেদাভেদ-তত্ত্ব অর্থাৎ একই সাথে একত্ব ও পৃথকত্ব প্রতিষ্ঠিত করে আমাদের পূর্ণ ভগবৎ-তত্ত্বজ্ঞান দান করেছেন।

সূর্য ও চন্দ্রের রশ্মিচ্ছটাও মূলত ভগবানের দেহনির্গত নির্বিশেষ ব্রহ্মজ্যোতি থেকে প্রকাশিত হয়। তেমনই বৈদিক মন্ত্রের প্রারম্ভে ভগবানকে সম্বোধনসূচক অপ্রাকৃত শব্দব্রহ্ম প্রণব বা ‘ওঁকার’ মন্ত্রও ভগবানের থেকে প্রকাশিত হয়েছে। যেহেতু নির্বিশেষবাদীরা পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে তাঁর অসংখ্য নামের দ্বারা সম্বোধন করতে খুবই ভয় পায়, তাই তারা অপ্রাকৃত শব্দব্রহ্ম ওঁকারের মাধ্যমে তাঁকে সম্বোধন করে। কিন্তু তারা বোঝে না যে, একার হচ্ছে ভগবান শ্রীকৃষ্ণেরই শব্দ প্রকাশ। কৃষ্ণভাবনার পরিধি সর্বব্যাপ্ত, তাই কৃষ্ণচেতনার উপলব্ধি যিনি লাভ করেছেন, তাঁর জীবন সার্থক। ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে যারা জানে না, তারা মায়াবদ্ধ। শ্রীকৃষ্ণ সম্বন্ধে অবগত হওয়াই হচ্ছে মুক্তি, আর তাঁর সম্বন্ধে অজ্ঞ থাকাই হচ্ছে বন্ধন।

শ্লোকঃ ৯

পুণ্যো গন্ধঃ পৃথিব্যাং চ তেজশ্চাস্মি বিভাবসৌ ।

জীবনং সর্বভূতেষু তপশ্চাস্মি তপস্বিষু ॥ ৯ ॥

পুণ্যঃ- পবিত্র, গন্ধঃ গন্ধ, পৃথিব্যাম পৃথিবীর, চও, তেজঃ- অস্মি—আমি হই; বিভাবসৌ— অগ্নির: জীবনম্— আয়ু : সর্ব-সমস্ত: ভূতেষু — প্রাণীর, তপঃ—তপশ্চর্যা; চ–ও; অস্মি হই, তপস্বি— তপস্বীদের।

গীতার গান

পৃথিবীর পুণ্য গন্ধ সূর্যের প্রভাব

জীবন সর্বভূতের তপস্বীর তপ ॥

অনুবাদঃ আমি পৃথিবীর পবিত্র গন্ধ, অগ্নির তেজ, সর্বভূতের জীবন এবং তপস্বীদের তপ।

তাৎপর্যঃ পূর্ণা শব্দটির অর্থ হচ্ছে, যার বিকার হয় না; পুণ্য হচ্ছে মৌলিক। এই জড় জগতে সব কিছুরই একটি বিশিষ্ট সৌরভ বা গন্ধ আছে। যেমন ফুলের গন্ধ, মাটির গন্ধ, আগুনের গন্ধ, জলের গন্ধ, বাতাসের গন্ধ আদি। তবে, পবিত্র নিষ্কলুষ, আদি অকৃত্রিম যে সুবাস সব কিছুর মধ্যে প্রবিষ্ট থাকে, তা হচ্ছে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ। তেমনই, সব কিছুরই বিশেষ একটি স্বাদ আছে, তবে রাসায়নিক দ্রব্যের মিশ্রণে এই স্বাদের পরিবর্তন করা যায়। তাই প্রতিটি বস্তুর নিজস্ব ঘ্রাণ, সুবাস ও আদ আছে। বিভাবসু মানে অগ্নি। এই অগ্নি ছাড়া কলকারখানা চলে না, রান্না করা যায় না, অর্থাৎ আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কোন কাজই করা যায় না। সেই আগুন স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ, সেই আগুনের তাপই হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণ। আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে বলা হয় যে, আমাদের উদরস্থ নিম্নতাপের ফলেই অজীর্ণতা হয়। সুতরাং, খাদ্য হজম করবার জন্যও আমাদের আগুনের প্রয়োজন। কৃষ্ণভাবনার প্রভাবে আমরা জানতে পারি যে, মাটি, জল, বায়ু, অগ্নি আদি সব রকমের সক্রিয় উপাদান এবং সব রকমের রাসায়নিক ও ভৌতিক পদার্থ শ্রীকৃষ্ণ থেকে উদ্ভূত হয়েছে। মানুষের আয়ুও নির্ভর করে শ্রীকৃষ্ণের উপরে। তাই, শ্রীকৃষ্ণের কৃপার ফলে মানুষের আয়ু দীর্ঘ অথবা সীমিত হয়। এভাবেই আমরা দেখতে পাই যে, কৃষ্ণভাবনা প্রত্যেক ক্ষেত্রেই সক্রিয় রয়েছে।

error: Content is protected !!