শ্লোকঃ ২৮

যেষাং ত্বন্তগতং পাপং জনানাং পুণ্যকর্মণাম্ ।

তে দ্বন্দ্‌মোহনির্মুক্তা ভজন্তে মাং দৃঢ়ব্রতাঃ ॥

॥ যেযাম্ — যে সমস্ত, তু— কিন্তু, অন্তরতম্—সম্পূর্ণরূপে দূরীভূত; পাপম্‌—পাপ; জনানাম্—ব্যক্তিদের; পুণ্য—পুণ্য, কর্মণাম্ — কর্মকারী; তে – তাঁরা দ্বন্দু — মোহ — মোহ: নিমুক্তাঃ — বিমুক্ত; ভজন্তে — ভজনা করেন: মাম্ আমাকে দৃঢ়ত্রতাঃ দৃঢ় নিষ্ঠার সঙ্গে।

গীতার গান

নিষ্পাপ হয়েছে যারা পুণ্যকর্ম দ্বারা ।

দ্বন্দমোহ হতে মুক্ত হয়েছে যাহারা ।।

তারা হয় দৃঢ়ত্রত ভজনে আমার ৷

নির্ভয় তাহারা সব জিনিতে সংসার ।।

অনুবাদঃ যে সমস্ত পুণ্যবান ব্যক্তির পাপ সম্পূর্ণরূপে দূরীভূত হয়েছে এবং যাঁরা দ্বন্দমোহ থেকে মুক্ত হয়েছেন, তাঁরা দৃঢ় নিষ্ঠার সঙ্গে আমার ভজনা করেন।

তাৎপর্যঃ যাঁরা অপ্রাকৃত স্তরে উন্নীত হওয়ার যোগ্য, তাঁদের কথা এই শ্লোকে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু যারা পাপী, নাস্তিক, মূঢ় ও প্রবঞ্চক, তাদের পক্ষে ইচ্ছা ও দ্বেষের দ্বন্দ্ব থেকে মুক্ত হওয়া অত্যন্ত দুষ্কর। যাঁরা ধর্মীয় বিধি-বিধান পালন করে জীবনকে, অতিবাহিত করেছেন এবং যাঁরা পুণ্যকর্ম করে নিষ্পাপ হয়েছেন, তাঁরা ভগবানের শরণাগত হতে পারেন এবং ক্রমে ক্রমে পূর্ণজ্ঞান লাভ করে পরম পুরুষোত্তম ভগবানকে জানতে পারেন। তখন তাঁরা পরম পুরুষোত্তম ভগবানের ধ্যানে ধীরে ধীরে সমাধিস্থ হতে পারেন। এটি হচ্ছে আধ্যাত্মিক স্তরে উন্নীত হওয়ার পন্থা। শুদ্ধ ভক্তদের সঙ্গের প্রভাবে কৃষ্ণভাবনায় এই উন্নত স্তর লাভ করা সম্ভব, কেন না মহান ভক্তদের সঙ্গের ফলে মানুষ মোহ থেকে উদ্ধার পেতে পারে।

শ্রীমদ্ভাগবতে (৫/৫/২) বলা হয়েছে যে, যদি কেউ জড় জগতের বন্ধন থেকে মুক্ত হতে চায়, তাকে অবশ্যই ভগবদ্ভক্তের সেবা করতে হবে ( মহৎসেবাং দ্বারমাহবিমুক্তেঃ); কিন্তু বিষয়ী লোকদের সঙ্গের প্রভাবে মানুষ জড় অস্তিত্বের অন্ধতম প্রদেশের দিকে ধাবিত হয় (তমোদ্বারা যোষিতাং সঙ্গিসম্)। ভগবানের অনুগত মহাভাগবতেরা জড় জগতের বন্ধনে আবদ্ধ, মোহাচ্ছঃ মানুষদের উদ্ধার করবার জন্য এই পৃথিবী পর্যটন করেন। নির্বিশেষবাদীরা জানে না যে, ভগবানের নিত্য দাসরূপে তাঁদের স্বরূপ ভুলে যাওয়াই হচ্ছে ভগবানের আইন লঙ্ঘন করা। জীব যতক্ষণ পর্যন্ত তার স্বরূপে অধিষ্ঠিত না হচ্ছে, ততক্ষণ সে পরমেশ্বর ভগবানকে জানতে পারে না, অথবা দৃঢ় সংকতের না দিবা ভগবৎ সেবায় নিয়োজিত হতে পারে না।

শ্লোকঃ ২৯

জরামরণমোক্ষায় মামাশ্রিত্য যতন্তি যে

তে ব্ৰহ্ম তদ্ বিদুঃ কৃৎস্নমধ্যাত্মং কর্ম চাখিলম্ ॥ ২৯ ॥

জরা—বার্ধক্য, মরণ—মৃত্যু মোক্ষায়—মুক্তি লাভের জন্য; মাম্—আমাকে আশ্রিতা — আশ্রয় করে; যতন্তি—যত্ন করেন; যে—যাঁরা; তে—তাঁরা: ব্রহ্মা ব্রহ্ম; তৎ—সেই; বিদুঃ – জানতে পারেন; কৃৎস্নস্—সব কিছু অধ্যাত্মম্— অধ্যাত্মতত্ত্ব, কর্ম—কর্মতত্ত্ব, চ—ও; অখিলম্—সম্পূর্ণরূপে ।

গীতার গান

আমাকে আশ্রয় করি যে জন সংসারে ।

জরা মরণ মোক্ষের মার্গ সদা যত্ন করে ॥

সে যোগী জানে তত্ত্ব ব্রহ্ম পরমাত্মা ।

কিংবা কর্মগতি যাহা জানে সে ধর্মাত্মা ॥

অনুবাদঃ যে সমস্ত বুদ্ধিমান ব্যক্তি জরা ও মৃত্যু থেকে মুক্তি লাভের জন্য আমাকে আশ্রয় করে যত্ন করেন, তাঁরা প্রকৃতপক্ষে ব্রহ্মভূত, কেন না তাঁরা অধ্যাত্মতত্ত্ব ও কর্মতত্ত্ব সব কিছু সম্পূর্ণরূপে অবগত।

তাৎপর্যঃ জন্ম, মৃত্যু, জরা ও ব্যাধির দ্বারা এই জড় শরীর আক্রান্ত হয়, কিন্তু চিন্ময় দেহ কখনই এদের দ্বারা প্রভাবান্বিত হয় না। চিন্ময় দেহের জন্ম, মৃত্যু, জরা ও ব্যাধি নেই। তাই, কেউ যখন তার চিন্ময় দেহ ফিরে পায়, তখন সে ভগবানের নিত। পার্যনত্ব লাভ করে এবং ভগবানের নিত্য সেবায় নিযুক্ত হয়, তখন সে যথার্থই মুক্ত। অহম্ ব্রহ্মাস্মি— আমি ব্রহ্ম। কথিত আছে — প্রত্যেকের জানা উচিত যে, সে হচ্ছে ব্রহ্ম বা আত্মা। ভক্তিমার্গে ভগবানের সেবা করার মধ্যেও এই ব্রহ্মানুভূতির অবকাশ রয়েছে, যা এই শ্লোকে বলা হয়েছে। ভগবানের শুদ্ধ ভক্তেরা ব্রহ্মভূত স্তরে অবস্থান করেন এবং তাঁরা অপ্রাকৃত ও প্রাকৃত সব কিছু সম্বন্ধেই অবগত।

ভগবৎ-সেবা পরায়ণ চার প্রকার অশুদ্ধ ভক্তের যখন অভীষ্ট সিদ্ধি হয় এবং ভগবানের অহৈতুর্কী কুপার ফলে পূর্ণরূপে কৃষ্ণভাবনামৃত লাভ হয়, তখন তারাও ভগবানের দিবা সাহচর্য লাভ করে। কিন্তু যারা বিভিন্ন দেব-দেবীর উপাসনা করে, তারা কখনই পরমেশ্বর ভগবানের নিত্য ধামে পৌঁছতে পারে না। এমন কি অল্প- বুদ্ধিসম্পন্ন ব্রহ্মজ্ঞানীরাও ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পরম ধাম গোলোক বৃন্দাবনে পৌঁছতে পারে না। যাঁরা সর্বতোভাবে কৃষ্ণভাবনাময় কর্ম করেন (মাম্ আশ্রিতা), তাঁদেরই যথার্থ ‘ব্রহ্ম’ বলে অভিহিত করা যায়, কারণ, তাঁরা বাস্তবিকই কৃষ্ণলোকে উত্তীর্ণ হওয়ার অভিলাষী। এই ধরনের ভক্তের শ্রীকৃষ্ণের ভগবত্তা সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নেই, তাই তাঁরা বাস্তবিকই ‘ব্রহ্ম’।

যারা ভগবানের অর্চা বিগ্রহের উপাসনা করেন, অথবা জড় বন্ধন থেকে মুক্ত হবার জন্য ভগবানের ধ্যান করেন, তাঁরাও ভগবানের কৃপার ফলে ব্রহ্ম, অধিভূত আদির তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পারেন। সেই কথা ভগবান পরবর্তী অধ্যায়ে বিশদভাবে বর্ণনা করেছেন।

শ্লোকঃ ৩০

সাধিভূতাধিদৈবং মাং সাধিযজ্ঞং চ যে বিদুঃ

প্রয়াণকালেঽপি চ মাং তে বিদুর্যুক্তচেতসঃ ।। ৩০ ।।

সাধিভূত—অধিভূত: অধিদৈবম্ — অধিদেব, মাম্ আমাকে; সাধিযজ্ঞম্ — অধিযজ্ঞ সহ; চ—এবং; যে—যাঁরা, বিদুঃ— জানেন, প্রয়াণকালে — মৃত্যুর সময় অপি- এমন কি; চ–এবং; মাম্― আমাকে, তে—তাঁরা; বিদুঃ – আমাতে আসক্তচিত্ত।

গীতার গান

অধিভূত অধিদৈব কিংবা অধিযজ্ঞ ।

সেই সব তত্ত্বজ্ঞানে যারা হয় বিজ্ঞ ।।

তাহারাও প্রয়াণ সময়ে বুঝে মোরে ।

পরমাত্মার সালোক্য লাভ সেই করে ।।

অনুবাদঃ যাঁরা অধিভূত তত্ত্ব, অধিদৈবতত্ত্ব ও অধিযজ্ঞ তত্ত্ব সহ আমাকে পরমেশ্বর ভগবান বলে অবগত হন, তাঁরা আমাতে আসক্তচিত্ত, এমন কি মরণকালেও আমাকে জানতে পারেন।

তাৎপর্যঃ কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত হয়ে যে মানুষ ভগবানের সেবা করেন; তিনি কখনই পরমেশ্বর ভগবানকে পূর্ণরূপে উপলব্ধির পথ থেকে বিচ্যুত হন না। কৃষ্ণভাবনার অপ্রাকৃত সান্নিধ্য লাভ করার ফলে মানুষ বুঝতে পারে যে, ভগবান হচ্ছেন সমস্ত দেড় জগতের নিয়ন্তা, এমন কি বিভিন্ন দেব-দেবীরাও তাঁর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এভাবেই, অপ্রাকৃত সান্নিধ্য লাভ করার ফলে ধীরে ধীরে পরমেশ্বর ভগবানের প্রতি মানুষের বিশ্বাস দৃঢ় হয় এবং মৃত্যুর সময়েও এই ধরনের কৃষ্ণভাবনাময় ব্যাক্তি শ্রীকৃষ্ণকে ভোলেন না। স্বভাবতই তিনি ভগবানের কৃপা লাভ করে অনায়াসে ভগবানের অপ্রাকৃত ধাম গোলোক বৃন্দাবনে উন্নীত হন।

এই সপ্তম অধ্যায়ে বিশেষভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, কিভাবে পূর্ণ কৃষ্ণচেতনা লাভ করা যায়। কৃষ্ণভাবনাময় ব্যক্তির সান্নিধ্যের ফলেই কৃষ্ণভাবনা শুরু হয়। ভাই পারমার্থিক সঙ্গ লাভ করার ফলে সরাসরিভাবে ভগবানের সঙ্গে সংযোগ হয় এবং তাঁর কৃপার ফলে জানতে পারা যায় যে, শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন পরম পুরুষোত্তম ভগান। সেই সঙ্গে এটিও জানা যায় যে, স্বরূপত কৃষ্ণদাস হওয়া সত্ত্বেও কিভাবে জীব শ্রীকৃষ্ণকে ভুলে যায় এবং জাগতিক কর্মের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। সৎসঙ্গের প্রভাবে কৃষ্ণভাবনায় ক্রমান্বয়ে উন্নতি সাধন করার ফলে জন হৃদয়ঙ্গম করতে পারে যে, কৃষ্ণকে ভুলে থাকার দরুন সে জড়া প্রকৃতির অনুশাসনে আবদ্ধ

হয়ে পড়েছে। সে আরও বুঝতে পারে যে, মনুষ্যজন্ম লাভ করার ফলে সে তার অন্তরে কৃষ্ণভাবনা বিকশিত করে তোলবার এক মহৎ সুযোগ লাভ করেছে এবং ভগবানের অহৈতুকী কৃপা লাভ করবার জন্য এই সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করা উচিত।

এই অধ্যায়ে নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে— আর্ত, জিহ্বা, অর্থার্থী, ব্রহ্মজ্ঞান, পরমাত্মার জ্ঞান, জন্ম, মৃত্যু, জরা ও ব্যাধির হাত থেকে মুক্ত হওয়ার উপায় এবং ভগবানের আরাধনা। তবে, যিনি যথার্থ কৃষ্ণভাবনামৃত লাভ করেছেন, তিনি অন্য কোন পদ্ধতিকেই কোন রকম গুরুত্ব দেন না। তিনি কৃষ্ণভাবনায় মগ্ন হয়ে সর্বদাই ভগবানের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেন এবং এভাবেই তিনি শ্রীকৃষ্ণের নিতা দাসরূপে তাঁর স্বরূপে অধিষ্ঠিত হন। সেই অবস্থায় তিনি শুদ্ধ ভক্তি সহকারে ভগবানের লীলা শ্রবণ ও কীর্তন করে মহানন্দ অনুভব করেন। তিনি নিশ্চিতভাবে জানেন যে, এরই মাধ্যমে তাঁর পরম প্রাপ্তি সাধিত হবে। এই সুদৃঢ় বিশ্বাসকে বলা হয় ‘দৃঢ়ব্রত’। এর থেকেই শুরু হয় ভক্তিযোগ বা অপ্রাকৃত ভগবৎ-সেবা। সমস্ত শাস্ত্রাদিতে এই কথা স্বীকৃত হয়েছে। ভগবদ্‌গীতার সপ্তম অধ্যায়ের সারমর্ম হচ্ছে এই সুদৃঢ় বিশ্বাস।

ভক্তিবেদান্ত কহে শ্রীগীতার গান ।

শুনে যদি শুদ্ধভক্ত কৃষ্ণগত প্ৰাণ ৷৷

ইতি—পরম-তত্ত্বের বিশেষ জ্ঞান বিষয়ক বিজ্ঞান-যোগ’ নামক শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার সপ্তম অধ্যায়ের ভক্তিবেদান্ত তাৎপর্য সমাপ্ত।

error: Content is protected !!