সপ্তম অধ্যায়

বিজ্ঞান-যোগ

শ্লোকঃ ১

ময্যাসক্তমনাঃ পার্থ যোগং যুঞ্জন্মদাশ্রয়ঃ ।

অসংশয়ং সমগ্রং মাং যথা জ্ঞাস্যসি তচ্ছ্রিণু ॥ ১ ॥

শ্রীভগবান্ উবাচ— পরমেশ্বর ভগবান বললেন; ময়ি —আমাতে; আসক্তমনাঃ— অভিনিবিষ্ট চিত্ত; পার্থ—হে পৃথার পুত্র; যোগম্ — যোগ; যুঞ্জন—যুক্ত হয়ে; মদাশ্রয়ঃ—আমার ভাবনায় ভাবিত হয়ে (কৃষ্ণভাবনা); অসংশয়ম্ — নিঃসন্দেহে সমগ্র—সম্পূর্ণরূপে; মাম্― আমাকে; যথা— যেরূপে; জ্ঞাস্যসি — জানবে; তৎ- তা; শৃণু—শ্রবণ কর।

গীতার গান

শ্রীভগবান কহিলেনঃ

আমাতে আসক্ত হয়ে যোগের সাধন ।

তোমারে কহিনু পার্থ সব এতক্ষণ ৷৷

সে যোগ আশ্রয় করি সমগ্র যে আমি।

অসংশয় বুঝিবে যে অনিবার্য তুমি ॥

শুন পার্থ সেই কথা তোমাকে যে কহি ।

ভক্তিযোগ শুদ্ধ সত্ত্ব যাতে তুষ্ট রহি ॥

অনুবাদঃ শ্রীভগবান বললেন – হে পার্থ। আমাতে আসক্তচিত্ত হয়ে, আমাতে মনোনিবেশ করে যোগাভ্যাস করলে, কিভাবে সমস্ত সংশয় থেকে মুক্ত হয়ে আমাকে জানতে পারবে, তা শ্রবণ কর।

তাৎপর্যঃ ভগবদ্‌গীতার এই সপ্তম অধ্যায়ে ভগবৎ-তত্ত্বের বিশদ বর্ণনা করা হয়েছে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সর্ব ঐশ্বর্যপূর্ণ। তার এই সমস্ত ঐশ্বর্যের প্রকাশ কিভাবে হয়, তা এখানে বর্ণনা করা হয়েছে। চার ধরনের সৌভাগ্যবান লোক ভগবানের শ্রীচরণে আসক্ত হন এবং চার ধরনের হতভাগ্য লোক কখনই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শরণাগত হন। না, তাঁদের কথাও এই অধ্যায়ে বর্ণনা করা হয়েছে।

ভগবদ্গীতার প্রথম ছয়টি অধ্যায়ে বর্ণনা করা হয়েছে যে, জীবের স্বরূপ হচ্ছে তার চিন্ময় আত্মা এবং বিভিন্ন যোগ-সাধনার মাধ্যমে সে চিন্ময় স্তরে উত্তীর্ণ হতে পারে। ষষ্ঠ অধ্যায়ের শেষে স্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যে, মনকে সর্বতোভাবে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ভাবনায় নিযুক্ত করা বা সর্বতোভাবে কৃষ্ণভাবনাময় হওয়াই সর্বপ্রকার যোগ-সাধনার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। মনকে সর্বতোভাবে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চরণে একাগ্র করার মাধ্যমে পরম-তত্ত্বকে সম্পূর্ণরূপে উপলব্ধি করা যায়, এছাড়া আর কোন উপায়েই তা সম্ভব নয়। নির্বিশেষ ব্রহ্মজ্যোতি অথবা অন্তর্যামী পরমাত্মা উপলব্ধি পরম তত্ত্বের পূর্ণজ্ঞান নয়, কেন না তা হচ্ছে আংশিক উপলব্ধি। পূর্ণ ও বিজ্ঞানসম্মত জ্ঞান হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণ এবং কৃষ্ণভাবনাময় মানুষের কাছে সব কিছুই পূর্ণ প্রকাশিত হয়ে থাকে। সম্পূর্ণভাবে কৃষ্ণভাবনামৃত লাভ করার ফলে নিঃসন্দেহে অবগত হওয়া যায় যে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন পরম জ্ঞান। বিভিন্ন প্রকার যোগ হচ্ছে কৃষ্ণভাবনা অর্জনের পথে পদক্ষেপ মাত্র। সরাসরিভাবে ভগবদ্ভক্তি লাভ করে যিনি ভগবানের শ্রীচরণে আত্মসমর্পণ করেন, তিনি অনায়াসে ব্রহ্মতত্ত্ব ও পরমাত্মাতত্ত্ব সম্বন্ধে সর্বতোভাবে অবগত হন। কৃষ্ণভাবনাময় ভক্তিযোগ অনুশীলন করার মাধ্যমে সব কিছুই পরিপূর্ণরূপে জানতে পারা যায়। তখন সর্বতোভাবে জানা যায় ভগবান কে, জীব কি, জড়া প্রকৃতি কি এবং তাদের প্রকাশ কিভাবে হয়।

তাই, ভগবদ্গীতার ষষ্ঠ অধ্যায়ের শেষ শ্লোকের নির্দেশ অনুসারে ভক্তিযোগের অনুশীলন শুরু করা উচিত। নববিধা ভক্তির মাধ্যমে মনকে শ্রীকৃষ্ণের ধ্যানে মগ্ন করা যায়। তাদের মধ্যে সর্বপ্রথম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে শ্রবণম্। ভগবান তাই অর্জুনকে বলেছেন, তণু অর্থাৎ “আমার কাছ থেকে শ্রবণ কর।” ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চেয়ে নির্ভরযোগ্য আর কেউ নেই, আর তাই তাঁর কাছ থেকে শ্রবণ করার মাধ্যমে এই জ্ঞান আহরণ করলে শুদ্ধ কৃষ্ণভাবনাময় মানুষ হয়ে ওঠার শ্রেষ্ঠ সুযোগ লাভ করা যায়। তাই এই জ্ঞান সরাসরি শ্রীকৃষ্ণের কাছ থেকে অথবা শ্রীকৃষ্ণের শুদ্ধ ভক্তের কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করতে হয়— কেতাবি বিদ্যায় অহঙ্কারী, অভত ভুঁইফোড়ের কাছ থেকে নয়।

শ্রীমদ্ভাগবতের প্রথম স্কন্ধের দ্বিতীয় অধ্যায়ে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে উপলব্ধির এই পদ্ধতি বর্ণনা করে বলা হয়েছে—

শৃণ্বতাং স্বকথাঃ কৃষ্ণঃ পুণ্যশ্রবণকীর্তনঃ ।

হৃদ্যন্তঃস্থো হাভদ্রাণি বিধুনোতি সুহৃৎসতাম্ ।।

নষ্টপ্রায়েষভদ্রেষু নিত্যং ভাগবতসেবয়া ।

ভগবত্যুত্তমশ্লোকে ভক্তিভবতি নৈষ্ঠিকী ।।

তদা রজস্তমোভাবাঃ কামলোভাদয়শ্চ যে।

চেত এতৈরনাবিদ্ধং স্থিতং সত্ত্বে প্রসীদতি ।।

এবং প্রসন্নমনসো ভগবদ্ভক্তিযোগতঃ ।

ভগবত্তত্ত্ববিজ্ঞানং যুক্তসঙ্গসা জায়তে ।।

ভিদাতে হৃদয়গ্রহি শ্ছিদ্যন্তে সর্বসংশয়াঃ ।

ক্ষীয়ন্তে চাসা কর্মাণি দৃষ্ট এবাত্মনীশ্বরে ।।

“বৈদিক শাস্ত্রসমূহ থেকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা শ্রবণ করলে অথবা ভগবদ্‌গীতা থেকে ভগবানের শ্রীমুখ-নিঃসৃত বাণী শ্রবণ করলে কল্যাণ হয়। কেউ যখন কৃষ্ণকথা শ্রবণ করেন, তখন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, যিনি সকলের অন্তরে বিরাজমান, তিনি পরম বন্ধুর মতো তাঁর হৃদয়কে সমস্ত কলুষ থেকে মুক্ত করেন। এভাবেই ভক্তের হৃদয়ে সুপ্ত পারমার্থিক জ্ঞানের বিকাশ হয়। শ্রীমদ্ভাগবত ও ভগবদ্ভক্তের কাছ থেকে তিনি যত কৃষ্ণকথা শোনেন, ততই তাঁর অন্তরে ভগবদ্ভক্তি সুদৃঢ় হয়। ভগবদ্ভক্তি বিকশিত হওয়ার ফলে রজোগুণ ও তমোগুণ থেকে মুক্তি লাভ হয়। এবং এভাবেই কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ আদি অন্তর্হিত হয়। এই সমস্ত কলুষ থেকে মুক্ত হওয়ার ফলে ভগবস্তুত তখন শুদ্ধ সত্ত্বে অধিষ্ঠিত হন। তিনি তখন আন্তরিকভাবে ভগবৎ-সেবায় সঞ্জীবিত হন এবং পরিপূর্ণরূপে ভগবৎ-তত্ত্বের বিজ্ঞান উপলব্ধি করেন। এভাবেই ভক্তিযোগ সাধন করার ফলে জড় আসক্তির গ্রন্থি ছিন্ন হয় এবং মানুষ তখন অচিরেই অসংশয়ং সমগ্রম্, অর্থাৎ পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সম্বন্ধে অবগত হন।” (ভাগবত ১/২/১৭-২১)

তাই, কৃষ্ণতত্ত্বের বিজ্ঞান বুঝতে হয় পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কাছ থেকে অথবা কৃষ্ণভাবনাময় ভক্তের কাছ থেকে।

শ্লোকঃ ২

জ্ঞানং তেঽহং সবিজ্ঞানমিদং বক্ষ্যাম্যশেষতঃ ।

যজজ্ঞাত্বা নেহ ভূয়োহন্যজ্ঞাতব্যমবশিষ্যতে ॥ ২ ॥

জ্ঞানম্ -জ্ঞানের কথা, তে– তোমাকে, অহম্ — আমি; স বিজ্ঞানম্ – বিজ্ঞান সমন্বিত, ইদম—এই; বক্ষ্যামি বলব, অশেষতঃ — পূর্ণরূপে, সৎ-1, জ্ঞাত্বা- জেনে; ন–না; ইহ—এই জাতে; ভূয়ঃ—পুনরায়; অনাৎ—আর কিছু, জ্ঞাতব্যম্- জানবার, অবশিষ্যতে বাকি থাকে।

গীতার গান

আমার বিষয়ে যে হয় জ্ঞান বিজ্ঞান ।

সে বিষয়ে অশেষত শুন দিয়া মন ।।

জানিলে সে তত্ত্বজ্ঞান জ্ঞাতব্য বিষয় ৷

সহজেই সব তত্ত্ব সমাধান হয় ৷।

অনুবাদঃ আমি এখন তোমাকে বিজ্ঞান সমন্বিত এই জ্ঞানের কথা সম্পূর্ণরূপে বলব, যা জানা হলে এই জগতে আর কিছুই জানবার বাকি থাকে না।

তাৎপর্যঃ পূর্ণজ্ঞান বলতে প্রপঞ্চময় জগৎ, এর পশ্চাতে চেতন ও উভয়ের উৎস সম্পর্কিত জ্ঞানকে বোঝায়। এটিই হচ্ছে অপ্রাকৃত জ্ঞান। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে এই বিশেষ জ্ঞান দান করেছিলেন, তার কারণ হচ্ছে অর্জুন ছিলেন তাঁর অন্তরঙ্গ ভক্ত ও সখা। চতুর্থ অধ্যায়ের প্রথমে ভগবান সেই কথা ব্যাখ্যা করেছেন এবং এখানেও তিনি প্রতিপন্ন করেছেন যে, ভগবানের ভক্তই কেবল গুরু-পরম্পরা ধারায় সাক্ষাত্ ভগবানের কাছ থেকে পরম তত্ত্বজ্ঞান লাভ করতে পারেন। তাই, যথার্থ বুদ্ধিমত্তা সহকারে সমস্ত জ্ঞানের উৎসকে জানবার প্রয়াসী হতে হয়, যিনি হচ্ছেন সমস্ত কারণের কারণ এবং সমস্ত যোগ-সাধনায় ধ্যানের একমাত্র বিষয়বস্তু। যখন সমস্ত কারণের কারণকে জানা যায়, তখন যা কিছু জ্ঞাতব্য তা সবই জানা হয়ে যায় এবং আর কোন কিছুই অজানা থাকে না। বেদে (মুণ্ডক উপনিষদ ১/৩) বলা হয়েছে—কস্মিন্ নু ভাবো বিজ্ঞাতে সর্বমিদং বিজ্ঞাতং ভবতীতি !

শ্লোকঃ ৩

মনুষ্যাণাং সহস্রেষু কশ্চিদ্ যততি সিদ্ধয়ে ৷

যততামপি সিদ্ধানাং কশ্চিন্মাং বেত্তি তত্ত্বতঃ ॥ ৩॥

মনুষ্যাণাম্—মানুষের মধ্যে, সহস্রেষু—হাজার হাজার, কশ্চিৎ— কোন একজন; যততি— যত্ন করেন; সিদ্ধয়ে—সিদ্ধি লাভের জন্য; যততাম্— সেই প্রকার যত্নশীল; অপি – বাস্তবিকই; সিদ্ধানাম্ — সিদ্ধদের, কশ্চিৎ— কেউ, মাম্ — আমাকে বেত্তি— জানতে পারেন; তত্ত্বতঃ -স্বরূপত ।

গীতার গান

সহস্ৰ মনুষ্য মধ্যে কোন একজন ।

সিদ্ধিলাভ করিবারে করয়ে যতন ॥

যত্নশীল সেই কার্যে কোন একজন ।

সিদ্ধিলাভ করিবারে উপযুক্ত হন ৷।

তার মধ্যে কেহ কেহ আমাকে তত্ত্বত ।

বুঝিতে সমর্থ হন বিবেকবশত ॥

অনুবাদঃ হাজার হাজার মানুষের মধ্যে কদাচিৎ কোন একজন সিদ্ধি লাভের জন্য যত্ন করেন, আর সেই প্রকার যত্নশীল সিদ্ধদের মধ্যে কদাচিৎ একজন আমাকে অর্থাৎ আমার ভগবৎ-স্বরূপকে তত্ত্বত অবগত হন।

তাৎপর্যঃ শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা যথায তাৎপর্য মানব-সমাজে নানা রকম মানুষ আছে এবং হাজার হাজার মানুষের মধ্যে দুই- একজন কেবল আত্মতত্ত্ব, দেহতত্ত্ব ও পরমতত্ত্ব সম্বন্ধে অবগত হওয়ার জন্য পরমার্থ সাধনের যথার্থ প্রয়াসী হন। সাধারণ অবস্থায় মানুষ পশুর মতো জীবন যাপন করে, অর্থাৎ তার একমাত্র চিন্তা হচ্ছে আহার, নিদ্রা, ভয় ও মৈথুন। কদাচিৎ কেউ দিব্যজ্ঞান লাভের জন্য আগ্রহী হয়। গীতার প্রথম ছয় অধ্যায়ের প্রয়োজনীয়তা কেবল সেই সাধকেরই আছে, যারা আত্মজ্ঞান তথা পরমাত্ম জ্ঞান লাভের জন্য জ্ঞানযোগ, ধ্যানযোগ ও বিবেক, বুদ্ধি আদি আত্মানুভূতির মার্গ অনুগমন করেন। কিন্তু কৃষ্ণভাবনাময় ভক্তেরাই কেবল কৃষ্ণকে জানতে পারেন। অন্য অধ্যাত্মবাদীরা নির্বিশেষ ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করতে পারেন, কারণ তা শ্রীকৃষ্ণকে উপলব্ধির চেয়ে সহজ। শ্রীকৃষ্ণ পরম পুরুষোত্তম, কিন্তু সেই সঙ্গে তিনি ব্রহ্ম এবং পরমাত্মা জ্ঞানেরও অতীত। যোগীরা ও জ্ঞানীরা শ্রীকৃষ্ণকে উপলব্ধি করতে গিয়ে বিভ্রান্ত হয়ে যান। যদিও নির্বিশেষবাদীদের অগ্রগণ্য শ্রীপাদ শঙ্করাচার্য তাঁর গীতার ভাষ্যে স্বীকার করে গেছেন যে, শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরব্রহ্ম স্বয়ং ভগবান, কিন্তু তবুও তাঁর অনুগামীরা কৃষ্ণকে ভগবান বলে মানতে চায় না, কারণ শ্রীকৃষ্ণকে উপলব্ধি করা খুবই দুঃসাধ্য, এমন কি নির্বিশেষ ব্রহ্মানুভূতি হওয়ার পরেও কৃষ্ণতত্ত্ব সুদুর্বোধ্য থাকে।

শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান, সর্ব কারণের কারণ, আদি পুরুষ গোবিন্দ। ঈশ্বরঃ পরমঃ কৃষ্ণঃ সচ্চিদানন্দবিগ্রহঃ / অনাদিরাদির্গোবিন্দঃ সর্বকারণকারণম্। অভক্তদের পক্ষে তাঁকে জানা অত্যন্ত কঠিন। যদিও তারা বলে, ভক্তিমার্গ অতি সহজ, কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা তার অনুগমন করতে পারে না। ভক্তিমার্গ যদি এতই সহজ হয়, তা হলে তারা তা পরিত্যাগ করে অত্যন্ত কষ্টসাপেক্ষ নির্বিশেষ পথ গ্রহণ করে কেন? প্রকৃতপক্ষে, ভক্তিমার্গ সহজ নয়। তথাকথিত কোন মনগড়া পন্থায় ভক্তিযোগ অনুশীলন করা সহজ হতে পারে, কিন্তু শাস্ত্রীয় বিধি অনুসারে যথার্থ ভক্তিযোগ অনুশীলন করা মনোধর্মী জ্ঞানী ও দার্শনিকদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই, তারা অচিরেই ভক্তিমার্গ থেকে ভ্রষ্ট হয়। ভক্তিরসামৃতসিন্ধু গ্রন্থে (পূর্ব ২/১০১) শ্রীল রূপ গোস্বামীপাদ বলেছেন—

শ্রুতি-স্মৃতি-পুরাণাদি পঞ্চরাত্র-বিধিং বিনা ।

ঐকান্তিকী হরেভক্তিরুৎপাতায়ৈব কলতে ॥

“উপনিষদ, পুরাণ, নারদ-পঞ্চরাত্র আদি প্রামাণিক বৈদিক শাস্ত্রবিধির অনুগামী না হয়ে যে ভগবদ্ভক্তি, তা কেবল সমাজে উৎপাতেরই সৃষ্টি করে।”

ব্রহ্মবেত্তা নির্বিশেষবাদী অথবা পরমাত্ম-তত্ত্বজ্ঞ যোগী কখনই পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের যশোদানন্দন অথবা পার্থসারথি রূপকে জানতে পারে না।

এমন কি মহা মহিমাময় দেবতারাও কখনও কখনও শ্রীকৃষ্ণের সম্বন্ধে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন (মুহান্তি যত সূরয়ঃ)। মাং তু বেদ ন কশ্চন— ভগবান নিজেই বলেছেন, “কেউই আমাকে তত্ত্বত জানতে পারে না।” আর কেউ যদি তাঁকে জেনে থাকে, তবে স মহাত্মা সুদুর্লভং—“এমন মহাত্মা অত্যন্ত দুর্লভ।” এভাবেই ভগবদ্ভক্তির আশ্রয় গ্রহণ না করলে, মহাপণ্ডিত অথবা দার্শনিকেরাও শ্রীকৃষ্ণকে তত্ত্বত জানতে পারে না। কেবলমাত্র শুদ্ধ ভক্তেরাই কেবল শ্রীকৃষ্ণের সর্বকারণকারণত্ব, সর্বশক্তি, শ্রী, যশ, সৌন্দর্য, জ্ঞান ও বৈরাগ্য আদি অচিন্ত্য চিন্ময় গুণসমূহ কিঞ্চিৎরূপে জানেন, কারণ শ্রীকৃষ্ণ তাঁর ভক্তদের প্রতি সর্বদাই অনুগ্রহশীল। শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন ব্রহ্মা- উপলব্ধির পরাকাষ্ঠা। তাই ভক্তেরাই কেবল তাকে তত্ত্বত উপলব্ধি করতে পারেন। শাস্ত্রে বলা হয়েছে-

অতঃ শ্রীকৃষ্ণনামাদি ন ভবেদ্‌গ্রাহামিন্দ্রিয়ৈঃ ।

সেবোন্মুখে হি জিহ্বাদৌ স্বয়মেব স্ফুরতাদঃ।।

“জড় স্থূল ইন্দ্রিয়ের দ্বারা কখনই শ্রীকৃষ্ণকে জানতে পারা যায় না। ভক্তের ভক্তিতে প্রসন্ন হলে শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং তাঁর কাছে নিজেকে প্রকাশিত করেন।”

(ভক্তিরসামৃতসিন্ধু পূর্ব ২/২৩৪) ।

error: Content is protected !!