দেখা যায় –সনাতন ধর্মীয় সৃষ্টিতত্বে কোথায়ও কার্যকারণ সম্পর্কের ধারা বজায় নাই এবং জীব বা জড় পদার্থ, ইহাদের কোনো কিছু সৃষ্টির জন্য কোনো উপাদানের উল্লেখ নাই, আছে শুধু ব্যবহার। উহা যেন পূর্ব হইতেই প্রস্তুত ছিল। সৃষ্টিতত্ত্বের ধর্মীয় ব্যাখ্যায় যুক্তির কোনো স্থান নাই। কার্যকারণ সম্পর্ক বজায় রাখিয়া যুক্তির সাহায্যে জগতের প্রত্যেকটি ঘটনা ব্যাখ্যা করিবার চেষ্টা করিল দর্শন। পরবর্তীকালে দর্শনশাস্ত্রের কার্যকারণ সম্পর্ক ও যুক্তিসমূহের উপর ভিত্তি করিয়া প্রমাণসহ জাগতিক ঘটনা ব্যাখ্যা করিতে চেষ্টা করিল বিজ্ঞান।

সৃষ্টিতত্ত্বের ধর্মীয় মতবাদের অনেকটাই আজ বিজ্ঞানের কাছে অবান্তর বলিয়া প্রতিপন্ন হইয়াছে। “পৃথিবী চ্যাপ্টা নহে, গোল” –ইহা এখন সর্ববাদীসম্মত সত্য। “পূর্ব হইতে সূর্যের পশ্চিম দিকে গতি কোনো স্বর্গীয় দূতের টানাটানিতে হয় না, উহা হয় পৃথিবীর আহ্নিক গতির ফলে” –ইহা এখন পাঠশালার শিশুরাও জানে। “পৃথিবী মাছ, গরু বা জলের উপর অবস্থিত নহে এবং চন্দ্র, সূর্য ও তারকারা ছাদ-আকৃতি আসমানে লটকানোও নহে; উহারা সকলেই শূন্যে অবস্থিত” –ইহা অবিশ্বাস করিবার মতো লোক এখন দুনিয়ায় অল্পই আছে।

সৃষ্টিতত্ত্বে বিজ্ঞানের এলাকা সুবিশাল। ধর্ম যেমন এক কথায়, গ্রন্থের কয়েক পঙক্তি বা পৃষ্ঠায়। বিশ্বের যাবতীয় সৃষ্টিতত্ত্ব সাগ করিয়াছে, বিজ্ঞান তাহা পারে নাই। বিজ্ঞানের সৃষ্টিতত্ত্ব বহুশাখাবিশিষ্ট এবং প্রত্যেক শাখায় গ্রন্থরাজি অজস্র। যেমন –আকাশতত্ত্ব, ভূতত্ত্ব, উদ্ভিদতত্ত্ব, দেহতত্ত্ব, জীবতত্ত্ব, ভূণতত্ত্ব ইত্যাদি। উহার আলোচনাসমূহের বিষয়সূচী লিখাও দুই-চারিখানা পুস্তকে সম্ভব নহে। কাজেই আমরা শুধু উহার কয়েকটি বিষয়ের কিঞ্চিৎ আভাস দিতে চেষ্টা করিব।

বিশ্বের বিশালতা

সনাতন ধর্মীয় মতে –পৃথিবী বিশ্বের কেন্দ্রে অবস্থিত, যাবতীয় সৃষ্টির মধ্যে বৃহত্তম বস্তুপিণ্ড এবং মানুষ জীবকুলের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ, ঈশ্বরের শখের সৃষ্টি এক বিশেষ জীব। মানুষ ঈশ্বরের শখের সৃষ্টি এক বিশেষ জীব কি না, সেই আলোচনা পরে হইবে; এখন দেখা যাক– পৃথিবী বিশ্বের কেন্দ্রে অবস্থিত ও বৃহত্তম পদার্থ কি না।

 কোনো স্থানের কেন্দ্রবিন্দু ঠিক করিতে হইলে উহার পরিধি জানা দরকার। পরিধি নির্ধারণ না করিয়া কেন্দ্র নির্ধারণ অসম্ভব। কিন্তু ধর্মীয় মতবাদে বিশের পরিধি নির্ধারণ না করিয়াই পৃথিবীকে বিশ্বের কেন্দ্র বলিয়া সাব্যস্ত করা হইয়াছে।

পৃথিবী সূর্য হইতে প্রায় ৯৩০ লক্ষ মাইল দূরে থাকিয়া এক গোলাকার (দুইদিকে ঈষৎ চাপা) কক্ষপথে ভ্রমণ করিতেছে এবং প্রায় একই সমান্তরালে কম-বেশি দূরে থাকিয়া আরো ১০টি গ্রহ সূর্যকে প্রদক্ষিণ করিতেছে। গ্রহদের এই আবর্তনক্ষেত্রকে বলা হয় সৌরজগত। সৌরজগতের কেন্দ্রে অবস্থিত আছে সূর্য এবং সীমান্তে আছে ভালকান গ্রহ। পৃথিবী উহার কেন্দ্রেও নহে এবং সীমান্তেও নহে।

বুধ, শুক্র ও মঙ্গল গ্রহ ভিন্ন পৃথিবীর চেয়ে ছোট গ্রহ সৌরাকাশে আর নাই। পৃথিবীর ব্যাস মাত্র ৭,৯২৬ মাইল। কিন্তু ইউরেনাসের ব্যাস ৩০,৮৮০ মাইল, নেপচুনের ব্যাস ৩২,৮৪০ মাইল, শনির ব্যাস ৭৫,০৬০ মাইল এবং বৃহস্পতির ব্যাস ৮৮,৭০০ মাইল। পৃথিবী অপেক্ষা সূর্য ওজনে ৩৩০ হাজার গুণ বেশি এবং আয়তনে প্রায় ১৩ লক্ষ গুণ বড়। সৌররাজ্যে পৃথিবী নেহায়েত ছোট জিনিষ এবং মহাকাশে ইহার দৃশ্যমান অস্তিত্বই নাই।

সৌরজগতের বাহিরে যে সকল জ্যোতিষ্ক দেখা যায়, উহাদের দূরত্ব এত বেশি যে, উহা লিখিয়া কোনো ভাষায় প্রকাশ করিতে হইলে মাইল বা ক্রোশে কুলায় না। তাই বিজ্ঞানীরা উহা হিসাব করেন আলোক বৎসরে। এক সেকেণ্ডে প্রায় ১৮৬ হাজার মাইল বেগে চলিয়া আলোকরশ্মি এক বৎসরে যতদূর পথ অতিক্রম করিতে পারে, বিজ্ঞানীরা তাহাকে বলেন ‘এক আলোক বৎসর। সৌরজগতের বাহিরের যে কোনো জ্যোতিষ্কের দূরত্ব নির্ণয় করিতে হইলে আলোক বৎসর ব্যবহার করিতে হয়। পৃথিবী হইতে সূর্যের দূরত্ব প্রায় ৯৩০ লক্ষ মাইল, সূর্য হইতে পৃথিবীতে আলো আসিতে সময় লাগে প্রায় ৮ মিনিট। কিন্তু মহাকাশের কোটি কোটি নক্ষত্রের মধ্যে সবচেয়ে কাছে অন্য যে নক্ষত্রটি আছে, তাহার আলো পৃথিবীতে আসিতেও সময় লাগে প্রায় ৪ বৎসর। মহাকাশে চারি আলোক বৎসরের কম দূরত্বে কোনোদিকে সূর্য ব্যতীত কোনো নক্ষত্রই নাই।

আজ পর্যন্ত মহাকাশে প্রায় ১০,০০০ কোটি নক্ষত্রের সন্ধান বিজ্ঞানীরা পাইয়াছেন। উক্তরূপ দূরে দূরে থাকিয়া ঐ সমস্ত নক্ষত্র যে বিশাল স্থান জুড়িয়া আছে, তাহাকে বলা হয় নক্ষত্র জগত। নক্ষত্ররা প্রত্যেকেই এক একটি সূর্য, কোনো কোনোটি মহাসূর্যও বটে। মহাকাশে এরূপ নক্ষত্রও আছে, যাহারা আমাদের সূর্য অপেক্ষা কোটি কোটি গুণ বড়।[৪]

আমাদের সূর্য যে নক্ষত্র জগতে অবস্থিত, সেই নক্ষত্র জগতটি আবর্তিত হইতেছে। আমাদের সৌরজগতটি এই নক্ষত্র জগতের কেন্দ্র হইতে প্রায় ৩০ হাজার আলোক বৎসর দূরে থাকিয়া প্রতি। সেকেণ্ডে প্রায় ১৭৫ মাইল বেগে নক্ষত্র জগতের কেন্দ্রকে প্রদক্ষিণ করিতেছে। একবার প্রদক্ষিণ করিতে সময় লাগে প্রায় ২২২ কোটি বৎসর। আমাদের এই সৌরজগতটিও নক্ষত্র জগতের কেন্দ্রে নহে।[৫]

নক্ষত্র জগতকে সুদূর হইতে দেখিলে উহার নক্ষত্রগুলিকে ভিন্ন ভিন্ন দেখা যায় না, সমস্ত নক্ষত্র মিলিয়া একটি ঝাপসা আলো বা মেঘের মতো দেখায়। ঐ রকম মেঘকে নীহারিকা বলা হয়। (ইহা ভিন্ন আর এক জাতীয় নীহারিকা আছে, উহারা শুধু বাম্পময়)। বিজ্ঞানীরা এই পর্যন্ত প্রায় ১০ কোটি নীহারিকা বা নক্ষত্র জগতের সন্ধান পাইয়াছেন এবং সবগুলি নীহারিকা মিলিয়া যে পরিমাণ স্থান জুড়িয়া আছে, তাহাকে বলেন নীহারিকা জগত বা ‘বিশ্ব। আমাদের নক্ষত্র জগত বা নীহারিকাটি যে বিশ্বের কেন্দ্রে অবস্থিত, এমন কথাও বলা যায় না। এই বিশ্ব এতই বিশাল যে, ইহার এক প্রান্ত হইতে আর এক প্রান্তের দূরত্ব অর্থাৎ ব্যাস প্রায় ৪,০০০ কোটি আলোক বর্ষ।[৬] বিজ্ঞানীপ্রবর আইনস্টাইন বলেন যে, নীহারিকা জগত বা বিশ্ব ক্রমশ প্রসারিত হইতেছে।

বিশ্বের আয়তনের বিশালতা আমরা শুধু কথায় বা লেখায়ই প্রকাশ করিতে পারি, কিন্তু ধারণায় আনিতে পারি না। এই কল্পনাতীত বিশ্ব এমনই বিশাল যে, জীবসমাকুল পৃথিবী, গ্রহসমাকুল সৌরজগত, এমনকি সৌরসমাকুল নক্ষত্র জগত পর্যন্ত ইহার মধ্যে হারাইয়া যায়। অর্থাৎ বিশ্বে এমনও স্থান আছে, যেখান হইতে চাহিলে আমাদের পৃথিবী, সূর্য, এমনকি বিশাল নক্ষত্র জগতও অদৃশ্য হইয়া পড়ে।

 বিশ্বের আকৃতি

এককালে মানুষের ধারণা ছিল যে, পৃথিবী থালার মতো গোল ও চ্যাপ্টা এবং ইহার চতুর্দিকে প্রাচীর বা পর্বত দ্বারা ঘেরাও করা। সেই প্রাচীর বা পর্বতের নাম কোহেক্বাফ। কোহেকৃাফের বহির্ভাগে কি আছে না আছে, কোনো মানুষ তাহা জানে না। তখন স্থির হইয়াছিল যে, পৃথিবীর উপরে আছে আসমানি ছাদ এবং সীমান্তে কোহেক্বাফ। কিন্তু নিচে? কেহ বলিলেন, পৃথিবীর নিচে জল, কেহ বলিলেন মাছ; এইরূপ কেহ গরু, কেহ কচ্ছপ ইত্যাদি বলিলেন। এই সব অলীক কল্পনার জন্য উহাদের নিন্দা করা যায় না। কেননা সেই যুগের মানুষ হইলে আমরা কি বলিতাম? হয়তো ঐরূপই কিছু। আর তাহারা যদি এই যুগের মানুষ হইতেন এবং ভূগোল খগোল পাঠ করিতেন, তবে তাহারাও বলিতেন, “পৃথিবী কমলালেবুর মতো গোল এবং শূন্যে থাকিয়া নিজে নিজে ঘুরপাক খায় ও নিয়ত সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে; অধিকন্তু পৃথিবীর ন্যায় আরও ১০টি গ্রহ আছে, উহারাও পৃথিবীর মতো সূর্যের চতুর্দিকে ঘুরপাক খায়।”

সেকালে এই গোটা পৃথিবীটিকেই বলা হইত জগত। এখন দেখা যাইতেছে যে, জগত একটি নহে, অনেক। যেমন –সৌরজগত, নক্ষত্র জগত, নীহারিকা জগত ইত্যাদি। আর এই সকল জগতকে একত্রে বলা হয় বিশ্ব। এখন প্রশ্ন হইল এই যে, এই বিশ্বের আকৃতি কিরূপ?

আমরা যে নক্ষত্র জগতে বাস করি, এই জগতটির আকৃতি গোল অথচ চ্যাপ্টা, কতকটা ডাক্তারদের ট্যাবলেট-এর মতো। আমাদের পৃথিবী উত্তর-দক্ষিণে চাপা, অর্থাৎ ইহার বিষুবীয় অঞ্চলের ব্যাস ৭,৯২৬ মাইল ও মেরু অঞ্চলের ব্যাস ৭,৯০০ মাইল; ব্যবধান ২৬ মাইল মাত্র। আর আমাদের নক্ষত্র জগতটির বড় ব্যাস ১২০ হাজার আলোক বর্ষ এবং ছোট ব্যাস ২০ হাজার আলোক বর্ষ; ব্যবধান ১ লক্ষ আলোক বর্ষ।

প্রত্যেকটি নক্ষত্র জগত বা নীহারিকার মাঝখানের দূরত্ব লক্ষ লক্ষ আলোক বর্ষ। যে কোনো দুইটি নীহারিকার মাঝখানে যে স্থান, সেখানে তাপ নাই, চাপ নাই, আলো নাই; অর্থাৎ কোনো পদার্থই নাই। উহা চিরঅন্ধকার, চিরশীতল, বিশাল মহাশূন্য! মতান্তরে –বস্তুশূন্য কোনো স্থান নাই। কেননা সমস্ত বিশ্বব্যাপী ইথর বিদ্যমান এবং উহা একটি পদার্থ।[৭]

নীহারিকাগুলি পরস্পর দূরে সরিয়া যাইতেছে এবং নীহারিকা বিশ্বটি ক্রমশ স্ফীত হইতেছে। বিজ্ঞানীগণ বলেন যে, আমাদের নক্ষত্র জগত হইতে যে নীহারিকার দূরত্ব যত বেশি, সেই নীহারিকার দূরে সরিয়া যাওয়ার বেগও তত বেশি। প্রতি এক লক্ষ আলোকবর্ষ দূরত্ব বৃদ্ধিতে প্রতি সেকেণ্ড ১০০ মাইল বেগ বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে সবচেয়ে দূরের নীহারিকার দূরে সরিয়া যাওয়ার বেগ আলোর বেগের ৯/১০; অর্থাৎ প্রতি সেকেণ্ড ১,৬৭,৪০০ মাইল। নীহারিকাগুলি কত যুগ-যুগান্ত হইতে এইরূপ প্রচণ্ড বেগে ছুটিয়া চলিয়াছে, তাহার ইয়ত্তা নাই এবং কোনো কালেও যে উহারা কোনো সীমান্তে পৌঁছিবে– বিজ্ঞানীগণ আজ পর্যন্ত তাহারও কোনো হদিস পান না।

আর একটি কথা এই যে, আমরা যে পৃথিবীটিতে আছি, তাহারই চতুষ্পর্শ্বে যে নক্ষত্র নীহারিকাগুলি ভীড় জমাইয়া আছে, এইরূপ মনে করিবার কোনো কারণ নাই। হয়তো এই বিশ্বের। অনুরূপ কোটি কোটি বিশ্ব লইয়া ‘মহাবিশ্ব গঠিত হইয়া থাকিবে। আবার কোটি কোটি মহাবিশ্ব লইয়া ‘পরমবিশ্ব’, অতঃপর ‘চরমবিশ্ব’ ইত্যাদি অনন্ত বিশ্ব থাকা বিচিত্র নহে।[৮] তাই বলিতে হয়, বিশ্ব অসীম। আর অসীমের কোনো আকৃতি থাকিতে পারে না। কাজেই বিশ্বের নির্দিষ্ট কোনো আকৃতি নাই।

বিশ্বের উপাদান

জগতের যে কোনো পদার্থের উপাদানসমূহের পরিচয় জানিতে হইলে পদার্থটিকে ভাঙ্গা আবশ্যক। বিজ্ঞানীগণ জগতের বিবিধ পদার্থের মৌলিক উপাদান নির্ণয়ের জন্য জৈবাজৈব বহু পদার্থই ভাঙ্গিয়া দেখিয়াছেন। ইহাতে তাহারা ফল যাহা পাইয়াছেন, এইখানে তাহার কিছু আভাস দিতে চেষ্টা করিব।

প্রথমত, বিশ্বের একটি অংশ নীহারিকা, নীহারিকার অংশ নক্ষত্র বা সূর্য, সূর্যের অংশ গ্রহ এবং গ্রহের অংশ উপগ্রহ ইত্যাদি। আমাদের পৃথিবী একটি গ্রহ এবং ইহার একটি অংশ হিমালয় পর্বত। এই হিমালয়কে ভাঙ্গিলে পাওয়া যাইবে ক্রমে প্রস্তরখণ্ড, কত্তকর, শেষ পর্যন্ত ধূলিকণা। এই ধূলিকণাকে ক্রমাগত ভাগিতে থাকিলে পাওয়া যাইবে অণু।

জগতের কঠিন, তরল ও বায়বীয় যে কোনো পদার্থ ভাঙ্গিয়া পাওয়া যায় এই অণু। এই অণুর পর্যায়ে পৌঁছা পর্যন্ত পদার্থের পূর্ব গুণাগুণ বজায় থাকে। অণু এত ছোট যে, খালি চোখে উহা দেখা যায় না। একটি অণুর ব্যাস এক সেন্টিমিটারের পাঁচ কোটি ভাগের এক ভাগের সমান। একটি ক্ষুদ্র জলকণাকে যদি পৃথিবী বলিয়া মনে করা হয়, তবে একটি অণু হইবে একটি ফুটবলের সমান। বিজ্ঞানী অ্যাস্টন বলেন, “এক গ্লাস জলের প্রতিটি অণুর গায়ে লেবেল আঁটিয়া অর্থাৎ চিহ্নিত করিয়া ঐ জল যদি পৃথিবীর সাগর, মহাসাগর, নদী ও পুকুরাদির যাবতীয় জলের সহিত ভালোরূপে মিশাইয়া দেওয়া যায় এবং মিশ্রিত জল হইতে এক গ্লাস জল তোলা হয়, তবে এই এক গ্লাস জলে চিহ্নিত অণুর সংখ্যা থাকিবে অন্তত দুই হাজার।”

জগতের বস্তুসমূহের রূপ-গুণের যে বৈচিত্র, তাহা এই অণুর পর্যায়ে আসিয়াই শেষ হইয়া যায়। বিজ্ঞানীগণ বিবিধ কৌশলে এই অণুকে ভাঙ্গিয়াছেন এবং অণুকে ভাঙ্গিয়া যাহা পাইয়াছেন, তাহাকে বলা হয় পরমাণু বা অ্যাটম। যে সকল পদার্থ অণুর পর্যায় পর্যন্ত স্বধর্ম বজায় রাখিতে পারে এবং তৎপরে হারাইয়া ফেলে, তাহাদের বলা হয় যৌগিক ও যে সকল পদার্থ পরমাণুর পর্যায় পর্যন্ত স্বধর্ম বজায় রাখিতে পারে, তাহাদের বলা হয় মৌলিক পদার্থ।

তুঁতে ও লবণ দুইটি যৌগিক পদার্থ। ইহাদের অণুকে ভাঙ্গিলে কাহারও নিজ নিজ রূপগুণ বজায় থাকে না। অঁতের অণুকে ভাঙ্গিলে পাওয়া যায় তামা, গন্ধক ও অক্সিজেন নামক বায়বীয় পদার্থের পরমাণু এবং লবণের অণুকে ভাঙ্গিলে পাওয়া যায় সোডিয়াম ও ক্লোরিন নামক পদার্থের পরমাণু। সুতরাং পুঁতে ও লবণ যৌগিক পদার্থ এবং তামা, গন্ধক, অক্সিজেন, সোডিয়াম ও ক্লোরিন মৌলিক পদার্থ। কোনো যৌগিক পদার্থের অণুকে ভাঙ্গিলে বিভিন্ন মৌলিক পদার্থের পরমাণু পাওয়া যায়, কিন্তু মৌলিক পদার্থের অণুকে ভাগিলে অন্য কিছুই পাওয়া যায় না। যেমন স্বর্ণ একটি মৌলিক পদার্থ। উহার অণুকে ভাঙ্গিলে স্বর্ণ পাওয়া যায়, অন্য কিছু নহে। প্রকৃতিতে স্বভাবত যে সকল যৌগিক পদার্থের সৃষ্টি হয়, তাহার সংখ্যা প্রায় ৪ লক্ষ। কিন্তু মৌলিক পদার্থের সংখ্যা বেশি নহে।

ধর্মগুরুরা সৃষ্টিতত্ত্বের ব্যাখ্যা করিয়াছেন বটে, কিন্তু উহার উপাদান লইয়া মাথা ঘামান নাই। এই বিষয়ে দার্শনিকেরাই প্রথম আরম্ভ করেন জগতসৃষ্টির উপাদানসমূহের খোঁজ-খবর লইতে। আদিতে দার্শনিকদের কাছে মৌলিক পদার্থের সংখ্যা ছিল ৪টি। যথা –জল, অগ্নি, মৃত্তিকা ও বায়ু; অর্থাৎ আব, আতস, খাক, বাত। প্রাথমিক স্তরের বিজ্ঞানীদের কাছে ছিল স্বর্ণ, রৌপ্য, লৌহ, তাম্র ও পারদাদি ৮টি মৌলিক পদার্থ বা ধাতু। বিজ্ঞানের উৎকর্যের সাথে সাথে নূতন নূতন মৌলিক পদার্থ আবিষ্কৃত হইতে থাকে এবং ১৭৮৯ খ্রীস্টাব্দে ইউরেনিয়াম আবিষ্কৃত হইলে ধাতুর সংখ্যা দাঁড়ায় ৯২টি। ১৯৪০ সালে নেপচুনিয়াম ও প্লুটোনিয়াম নামক দুইটি ধাতু আবিষ্কৃত হয় এবং পর পর ১৯৫৭ সালের মধ্যে আরও ৮টি ধাতু আবিষ্কৃত হয়। সর্বশেষ ধাতুটির নাম রাখা হইয়াছে নোবেলিয়াম। বিজ্ঞানীগণ কোনো কোনো সূত্রের সাহায্যে জানিতে পারেন যে, সম্ভবত অজানা ধাতু আরও দুইটি আছে। সে যাহা হউক, অধুনাতন ধাতুর সংখ্যা ১০২টি। আলোচ্য মৌলিক ও যৌগিক পদার্থের বিভিন্ন অনুপাত ও বিভিন্ন কৌশলে সংযোজনার ফলে উদ্ভূত হইয়াছে জগতের যাবতীয় সৃষ্টিবৈচিত্র।

১০২টি মৌলিক পদার্থের মধ্যে অধিকাংশই কঠিন, কিছুসংখ্যক বায়বীয় এবং অল্পসংখ্যক তরল। যেমন –সোনা, রূপা, লোহা, তামা, শীশা ইত্যাদি কঠিন; হাইড্রোজেন, নাইট্রোজেন, অক্সিজেন, হিলিয়াম ইত্যাদি বায়বীয় এবং পারদাদি তরল। ইহার মধ্যে কতক সহজ ও স্বাভাবিকভাবে মিশিয়া যৌগিক পদার্থের সৃষ্টি করে। যেমন –হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন মিশিয়া জল এবং অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, কার্বনাদি মিশিয়া বাতাস সৃষ্টি করে। ইহাদিগকে বলা হয় প্রাকৃতিক যৌগিক পদার্থ।

কতগুলি মৌলিক পদার্থ আছে, তাহারা একে অন্যের সহিত সহজে মিশিতে চায় না। বিজ্ঞানীগণ রাসায়নিক ও বৈদ্যুতিক নানা উপায়ে উহাদিগকে মিশাইয়া নানাবিধ কৃত্রিম যৌগিক পদার্থ সৃষ্টি করেন। যেমন –পিতল, কাসা, কঁচ, প্লাস্টিক, বিবিধ রং ইত্যাদি। আজকাল পৃথিবীর আনাচে-কানাচে বিশেষত বাজারে কৃত্রিম যৌগিক পদার্থের তৈয়ারী মালামালের এতই ছড়াছড়ি যে, কোনো ব্যক্তির পক্ষে তাহার সংখ্যা নির্ণয় করা দুঃসাধ্য।

বিজ্ঞানীদের রসায়নাগারে কৃত্রিম উপায়ে প্রাকৃতিক যৌগিক পদার্থ যে তৈয়ারী হইতেছে না। তাহা নহে। বাতাসের নাইট্রোজেন ও জলের হাইড্রোজেনকে বেশি উষ্ণতায় ও প্রচণ্ড চাপে রাসায়নিক মিলনে অ্যামোনিয়ায় পরিণত করা হয় এবং এই অ্যামোনিয়া হইতে প্রস্তুত হয় সোরা।

এক একটি পরমাণু যে কত ছোট, তাহা কল্পনায় আনা যায় না এবং সংখ্যা দ্বারা লিখিতে পারিলেও উহার পাঠোদ্ধার করা যায় না। উদাহরণস্বরূপ দেখান যাইতে পারে যে, একটি হাইড্রোজেন পরমাণুর ওজন এ্যাম হিসাবে লিখিতে হইলে উহাতে দশমিক বিন্দুর ডানদিকে ২৪টি শূন্য বসাইয়া ১৭ সংখ্যাটি বসাইতে হয়।

যথা–.০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০১৭ গ্রাম।[৯]

এই কল্পনাতীত ক্ষুদ্র পরমাণুকেও বিজ্ঞানীগণ ভাঙ্গিতে সক্ষম হইয়াছেন এবং পরমাণুর গর্ভে পাইয়াছেন কয়েকটি শক্তিকণিকা। তাহাদের নাম দেওয়া হইয়াছে ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন, পজিট্রন, মিসোটুন, নিউট্রিনো ইত্যাদি।

বিজ্ঞানীগণ বলেন যে, প্রকৃতির রূপবৈচিত্রে যতই তারতম্য থাকুক না কেন, উহাদের মৌলিক উপাদান একই। অর্থাৎ ইলেকট্রন-প্রোটনাদি শক্তিকণিকা। তারতম্য শুধু পরমাণুগর্ভে ইলেকট্রন প্রোটনাদির সংখ্যায়।

বিজ্ঞানীগণ পদার্থের পরমাণু ভাঙ্গিয়া যে সব শক্তিকণিকা পাইয়াছেন, এক কথায় উহাকে বলা হয় তড়িৎ বা বিদ্যুৎ। এই বিদ্যুৎশক্তি বর্তমান জগতের যে সকল পরিবর্তন সাধন করিয়াছে ও করিতেছে তাহা দেখিলে বা ভাবিলে বিস্মিত হইতে হয়। এই শক্তি শুধু টেলিগ্রাফ, টেলিফোন, বিজলিবাতি, রেডিও এবং নানাবিধ কল-কক্সা চালনায়ই সীমাবদ্ধ নহে; ইহা গোটা মানব জাতির শিক্ষা, সভ্যতা ও মানবতায় পরিবর্তন আনয়ন করিয়াছে।

বিজ্ঞানীগণ কয়েকটি উপায়ে জানিতে পারেন যে, বিশ্বের কোনো স্থানে ইলেকট্রনাদি ধ্বংস হইতেছে এবং তাহার ফলে এক মহাশক্তির জন্ম হইতেছে। তাই বিজ্ঞানীগণ ইলেকট্রনাদির বিনাশে শক্তি উৎপাদনের প্রচেষ্টায় আত্মনিয়োগ করেন এবং তাহাতে সাফল্য লাভ করেন। দেখা গিয়াছে যে, ইলেকট্রনাদি ধ্বংসে শক্তি উৎপন্ন হইতে পারে এবং শক্তি সংহর্ত হইয়া ইলেকট্রনাদির সৃষ্টি হইতে পারে। তাই বিজ্ঞানীগণ বলেন যে, বিশ্বের যাবতীয় পদার্থের মৌলিক উপাদান শক্তি।


৪. খগোল পরিচয়, মো, আ, জব্বার, পৃ. ২৭।

৫. নক্ষত্র পরিচয়, প্রমথনাথ সেনগুপ্ত, পৃ. ১৪, ১৫।

৬, নক্ষত্র পরিচয়, প্রমথনাথ সেনগুপ্ত, পৃ. ১৬।

৭ খগোল পরিচয়, মো. আ, জব্বার, পৃ. ১১১, ১১২।

৮, জগত ও মহাজগত, এম, এ, জব্বার, পৃ. ৪৩।

৯. বিশ্বের উপাদান, চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য, পৃ. ৭।

error: Content is protected !!
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x