জীবন রহস্য জানার কৌতূহলটি মানবমনে বহুদিনের পুরাতন। এই কৌতূহলের নিবৃত্তির জন্য মানুষ বহু মতবাদের জন্ম দিয়াছে। কিন্তু তন্মধ্যে প্রাধান্য লাভ করিয়াছে মাত্র দুইটি। উহার একটি হইল সৃষ্টিবাদ, অপরটি বিবর্তনবাদ।
বর্তমান জগতে আমরা যত রকম গাছপালা ও জীব-জানোয়ার দেখিতেছি, ঈশ্বর নামক এক পরম পুরুষ তাহার প্রত্যেকটিকে বর্তমান রূপেই সৃষ্টি করিয়া পৃথিবীতে ছাড়িয়া দিয়াছেন; ইহাদের মধ্যে কাহারও ‘জাতিগত রূপ’-এ কোনো পরিবর্তন বা নূতনত্ব নাই; ইহারা প্রত্যেকে নিজ নিজ জাতিগত রূপ ও চরিত্রগত বৈশিষ্ট বজায় রাখিয়া বংশবৃদ্ধি করিতেছে মাত্র –সাধারণত এইরূপ ধারণাকে বলা হয় সৃষ্টিবাদ এবং জড় কিংবা জীবজগতে এক-এর রূপান্তরে বহুর উৎপত্তি – এইরূপ ধারণাকে বলা হয় বিবর্তনবাদ।
পূর্বে আলোচিত বেদ ও বাইবেলাদির সৃষ্টিতত্ত্বসমূহ সৃষ্টিবাদের অন্তর্ভুক্ত এবং সামান্য মতানৈক্য থাকিলেও জগতের যাবতীয় ধর্মীয় মতবাদই সৃষ্টিবাদের আওতাভুক্ত। জগত ও জীবনের সৃষ্টি সম্বন্ধে যাবতীয় বিজ্ঞানীদের সর্বস্বীকৃত যে মত, তাহাই বিবর্তনবাদ। এই বিষয়ে বিশেষ আলোচনা পরে করিব।
প্রাণ কি?
প্রাণ কি, এই প্রশ্নের উত্তর এক কথায় দেওয়া কাহারও পক্ষে সম্ভব নহে। তাহার কারণ এই যে, প্রাণ মানুষের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নহে।
আমরা প্রাণের অস্তিত্ব অনুভব করিতে পারিব না তাহার লক্ষণ ব্যতিরেকে। প্রাণের লক্ষণ প্রধানত স্পন্দন ক্ষমতা, বোধশক্তি, খাদ্যের সাহায্যে দেহপুষ্টি, বংশবৃদ্ধি ইত্যাদি। ইহার মধ্যে, খাদ্যের সাহায্যে দেহপুষ্টি ও বংশবৃদ্ধি –এই দুইটি প্রধান এবং সৃষ্টির আদিম প্রক্রিয়া।
ধর্মীয় মতে, জীবন জীবদেহ হইতে ভিন্ন। দেহসৃষ্টির পূর্বে উহা কোথায়ও কোনো অবস্থায় বর্তমান ছিল এবং দেহাবসানের পরেও কোনো অবস্থায় কোথায়ও থাকিবে। এই মতে, দেহ পার্থি এবং জীবন ঐশ্বরিক।
জগতের যাবতীয় কার্যাবলীর মধ্যে যে সকল কার্যের কারণসমূহ সাধারণ মানুষের সহজবোধ্য, তাহাকে পার্থিব এবং যে সকল কার্যের কারণসমূহ সহজবোধ্য নহে, তাহাকে ঐশ্বরিক বলাই ধর্মীয় মতবাদের নীতি। বিশেষত যে সকল ঘটনাকে ঐশ্বরিক বলা হয়, তাহার কোনো কারণ খোঁজ করিতে যাওয়াও ধর্মীয় মতে নিষেধ। বরং বলা হয়, উহা গুরুতর অন্যায় বা মহাপাপ। কিন্তু বিজ্ঞানের নীতি হইল অজানাকে জানা ও অচেনাকে চেনা। তাই ধর্মের শত বাধা-নিষেধ সত্ত্বেও বিজ্ঞানীগণ প্রাণসৃষ্টির রহস্য উদঘাটনের প্রচেষ্টায় বিরত থাকিতে পারেন নাই। বিজ্ঞানীগণ এই প্রচেষ্টায় যেটুকু সাফল্য লাভ করিয়াছেন, এখন তাহার সামান্য আলোচনা করিব।
জৈব পদার্থ
আমরা পূর্বের আলোচনায় জানিয়াছি যে, জগতের যাবতীয় পদার্থ দুই জাতীয় –মৌলিক ও যৌগিক। আবার যে সব পদার্থের দ্বারা উদ্ভিদ ও জীবদেহ তৈয়ারী, তাহাকে বলা হয় জৈব পদার্থ, বাকিগুলিকে বলা হয় অজৈব।
জৈব ও অজৈব পদার্থের মধ্যে আসল পার্থক্য এই যে, জৈব পদার্থের প্রত্যেকটি অণুর কেন্দ্রে সব সময়ই থাকে একটি মৌলিক পদার্থের পরমাণু– কার্বন। কোনো অজৈব পদার্থের অণুর কেন্দ্রে কখনও কার্বন থাকে না। কার্বনকে বাংলা ভাষায় বলা হয় অগার। যে কোনো জৈব পদার্থ পোড়াইলে অঙ্গার পাওয়া যায়। কিন্তু কোনো অজৈব পদার্থ পোড়াইলে কখনও অঙ্গার পাওয়া যায় না। যেমন –কাঁচ, পাথর বা কোনো ধাতু পোড়াইয়া কিছুতেই অঙ্গার পাওয়া যাইবে না। যেহেতু তাহাদের কোনো অণুর কেন্দ্রেই কার্বন বা অঙ্গর নাই।
জৈব পদার্থের মুখ্য উপাদান কার্বন হইলেও তাহার সাথে পদার্থবিশেষে মিশিয়া থাকে হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, গন্ধক, ফসফরাস এবং আরও অনেক পদার্থ। জৈব পদার্থের অণুর গর্ভে কার্বনের সঙ্গে ইহাদের বিভিন্ন জাতীয় পরমাণুর বিভিন্ন ভঙ্গিতে মিলনের ফলে জন্ম হয় বিভিন্ন জাতীয় জৈব পদার্থের। যেমন –কার্বন ও হাইড্রোজেন মিলিয়া হয় হাইড্রোকার্বন। আর ইহা হইতে হয় নানাবিধ খনিজ তৈল বা ঐ জাতীয় যাহা কিছু।
জীবদেহের রক্ত, মাংস, মেদ, মজ্জা সকলই জৈব পদার্থ; এমনকি কফ, থুথু, ঘর্ম এবং মল-মূত্রও। ইহাদের স্বাভাবিক ক্ষয়ের পূরণ ও পুষ্টির জন্য জীবের আবশ্যক হয় খাদ্যের। খাদ্য গ্রহণের আসল উদ্দেশ্য হইল কার্বন সংগ্রহ করা। জীবের জীবন সংগ্রামে খাদ্য লইয়া যে কাড়াকাড়ি ও মারামারি, তাহা সমস্তই এই কার্বন সংগ্রহের ঝামেলা।
গাছেরা কার্বন সংগ্রহ করে বাতাস হইতে এবং জীব-জন্তুরা কার্বন সংগ্রহ করে শাক-পাতা, তরি-তরকারি ও জীবজন্তুর মাংস হইতে। সংগৃহীত কার্বন জীবদেহে বিবিধ প্রক্রিয়ার শেষে রূপান্তরিত হয় জৈব পদার্থে। আবার বহুকাল মাটির তলায় চাপা থাকিয়া গাছপালা রূপান্তরিত হয় কয়লায় এবং জীবজন্তুর দেহ রূপান্তরিত হয় খনিজ তৈলে।
এতক্ষণ যাহা বলা হইল, তাহা সবই জৈব পদার্থের ব্যবহার ও রূপান্তর বিষয়ক। এখন প্রশ্ন থাকিল এই যে, জৈব পদার্থের সৃষ্টি হইল কিভাবে? বিজ্ঞানীগণ এ প্রশ্নের উত্তর দিয়াছেন।
জ্যোতির্বিজ্ঞানীগণ আলোক বিশ্লেষক যন্ত্রের সাহায্যে জানিতে পারিয়াছেন যে, উত্তাপের কম বেশি হিসাবে ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণীর নক্ষত্র আছে। কোনো শ্রেণীর নক্ষত্রের উত্তাপ ২৮,০০০° সে. পর্যন্ত বা আরও বেশি, আবার কোনো শ্রেণীর নক্ষত্রের উত্তাপ মাত্র ৪,০০০° সে. এবং উহার মধ্যবর্তী উত্তাপে আছে অজস্র নক্ষত্র। স্পেক্টোস্কোপ যন্ত্রের সাহায্যে বিভিন্ন নক্ষত্রের উপাদান বিশ্লেষণ। দ্বারা বিজ্ঞানীরা জানিতে পারিয়াছেন যে, খুব বেশি উত্তপ্ত নক্ষত্রদের কার্বন পরমাণুরা একা একা ভাসিয়া বেড়ায়, অন্য কোনো পরমাণুর সাথে জোড় বাঁধে না। কিন্তু যে সকল নক্ষত্রের উত্তাপ ১২,০০০° সেন্টিগ্রেডের কাছাকাছি, সেখানে কার্বন পরমাণু হাইড্রোজেন পরমাণুর সঙ্গে জোড় বাঁধিয়া সৃষ্টি করিয়াছে হাইড্রোকার্বন। এই হাইড্রোকার্বন একটি জৈবিক পদার্থ। সুতরাং দেখা যাইতেছে যে, এইখান হইতেই জৈবিক পদার্থ সৃষ্টির সূত্রপাত।
আমাদের সূর্যের বাহিরের উত্তাপ প্রায় ৬০০০° সে.। সেখানে দেখা যায় যে, কার্বনের সঙ্গে একাধিক মৌলিক পদার্থের পরমাণুর মিলন ঘটিয়াছে। যেমন –কার্বনের সঙ্গে হাইড্রোজেন, কার্বনের সঙ্গে নাইট্রোজেন, এমনকি কার্বনের সঙ্গে কার্বনের। ইহাতে সেখানে একাধিক জৈব পদার্থের জন্ম হইয়াছে।
ভূপতিত উল্কাপিণ্ডের দেহ পরীক্ষা করিয়া বিজ্ঞানীরা প্রমাণ পাইয়াছেন যে, উল্কার দেহে কার্বন ও ধাতুর মিলনে জন্ম লইয়াছে কার্বাইড। ইহা একটি জৈব পদার্থ।
বিজ্ঞানীরা বলেন যে, নক্ষত্র, সূর্য ও উল্কার দেহে যে প্রক্রিয়ায় জৈব পদার্থ জমিতে পারিয়াছে, পৃথিবীতেও এককালে অনুরূপ প্রক্রিয়ায় জৈব পদার্থসমূহের জন্ম হইয়া থাকিবে। বিজ্ঞানীরা তাহাদের পরীক্ষাগারে কৃত্রিম উপায়ে বহু জৈব পদার্থ তৈয়ার করিতে সক্ষম হইয়াছেন। যথা –শর্করা, প্রোটিন, স্নেহপদার্থ (চর্বি জাতীয়), নীল, ভিটামিন, হর্মোন ইত্যাদি।
বিজ্ঞানীগণ বলেন যে, প্রোটিন তৈয়ার হয় হাজার হাজার কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন ও ও নাইট্রোজেন পরমাণুর সুবিন্যস্ত সংযোগে এবং পৃথিবীর আদিম সমুদ্রে প্রোটিন তৈয়ার হইবার মতো অনুকূল অবস্থাও বজায় ছিল। পৃথিবীর আদিম সমুদ্রে লক্ষ লক্ষ বৎসর ধরিয়া হাইড্রোকার্বনের নানা রূপান্তরে তৈয়ার হইয়াছিল প্রোটিন এবং তাহা হইতে জন্ম লইয়াছিল। জীবদেহের মূল উপাদান প্রোটোপ্লাজম।
প্রোটোপ্লাজম কি?
প্রকৃতির একমাত্র কাজ — পরিবর্তন বা রূপান্তর। ইহাকে বিবর্তন বলা যায়। বিভিন্ন বিষয়ে প্রাকৃতিক পরিবর্তনে সময়ের ব্যবধান অত্যধিক। প্রকৃতি দুধকে দধি এবং তালের রসকে তাড়ি করিতে কয়েক ঘণ্টা সময়ের মধ্যেই পারে। কিন্তু রেডিয়ামকে শীশায় পরিণত করিতে তাহার সময়। লাগে লক্ষ লক্ষ বৎসর। ঐরূপ কার্বনাদি জৈব পদার্থ হইতে একটি প্রোটোপ্লাজম তৈয়ার করিতে প্রকৃতির সময় লাগিয়াছে প্রায় একশত কোটি বৎসর।
পদার্থ জৈব বা অজৈব, যাহাই হউক, উহা জীব নামে অভিহিত হইতে পারে না, যে পর্যন্ত উহাতে জীবনের কোনো লক্ষণ প্রকাশ না পায়। পূর্বেই বলিয়াছি যে, জীবনের প্রধান লক্ষণ –দেহপুষ্টি ও বংশবিস্তার। কোনো পদার্থে যদি ঐ দুইটি লক্ষণ দেখিতে পাওয়া যায়, তাহা হইলে নিশ্চয়তার সহিত বলা যায় যে, ঐ পদার্থটি সজীব। এখন দেখা যাক যে, কোন পদার্থে ঐ লক্ষণ। দুইটি পাওয়া যায়।
প্রোটোপ্লাজমের মুখ্য উপাদান প্রোটিন এবং ইহা ভিন্ন আরও জৈব-অজৈব অনেকগুলি পদার্থ। উহা আদিম সমুদ্রে জলে গোলা দ্রব অবস্থায় ছিল। উহাকে ইংরাজিতে বলে সলিউশন। চিনি বা লবণ গোলা জলকেও সলিউশন বলা যায়। কিন্তু প্রোটোপ্লাজম ঐ ধরণের সলিউশন নহে, উহা এক বিশেষ ধরণের সলিউশন। ইংরাজিতে বলা হয় কলয়ডাল সলিউশন।
চিনি বা লবণ জলে দ্রবীভূত হইলে উহাকে ছাকন প্রণালী দ্বারা জল হইতে ভিন্ন করা যায় না। কিন্তু কলয়ডাল সলিউশন ছাঁকুনিতে আটকা পড়ে। তাই বলিয়া এই আটকা পড়াই ইহার বিশেষত্ব নহে। মাটি বা চুন গোলা জলও সূক্ষ্ম ছাঁকুনি দ্বারা ছাকিলে মাটি ও চুন ভিন্ন হইয়া যায়। কিন্তু ইহা কলয়ডাল সলিউশন নহে। যেহেতু মাটি বা চুন জলে গোলা হইলে সময়ান্তরে উহা থিতাইয়া পড়ে। কিন্তু কলয়ডাল সলিউশন কোনো কালেই থিতায় না। উহা এইরূপ এক বিশেষ পদার্থ যে, জলে সম্পূর্ণ মেশে না, অথচ কোনোকালেই থিতায় না। জানিয়া রাখা উচিত যে, কলয়ডাল সলিউশন জৈব পদার্থের হইতে পারে, আবার অজৈব পদার্থেরও হইতে পারে। অজৈব পদার্থের কলয়ডাল সলিউশন হয়তো জলে সম্পূর্ণ মিশিয়া থাকে, নচেৎ থিতাইয়া পড়ে। কিন্তু জৈব পদার্থের কলয়ডাল সলিউশনই জলে সম্পূর্ণ মেশে না, অথচ থিতাইয়া পড়ে না। এইখানে লক্ষ্য করিবার বিষয় এই যে, অজৈব পদার্থের সঙ্গে জৈব পদার্থের একটি চরিত্রগত পার্থক্য প্রকট হইয়া উঠিয়াছে এবং সে এখন হইতে আর জড় পদার্থের নিয়মে অপরের শক্তিতে চালিত হইতে রাজি নহে। তাই কলয়ডাল সলিউশনের এই স্বকীয়তা।
কলয়ডাল সলিউশনের আর একটি বিশেষ গুণ এই যে, জলে অন্য যে সব জৈব-অজৈব পদার্থ থাকে, উহাকে আত্মসাৎ করিয়া নিজ দেহ পুষ্ট করিতে থাকে। এইভাবে লক্ষ লক্ষ বৎসর অতিবাহিত হইলে কলয়ডাল জৈব পদার্থটি আয়তনে ও ওজনে বহুগুণ বৃদ্ধি পায় ও শেষে ফাটিয়া দুই টুকরা হইয়া যায়। কিন্তু দুই টুকরা হইয়া উহারা মরে না, আলাদা আলাদা থাকিয়া আগের মতোই পুষ্ট হইতে থাকে এবং কালক্রমে আবার দুই টুকরা ফাটিয়া চারি টুকরা হয় ও কালে চারি টুকরা ফাটিয়া আট টুকরা হয়। এইভাবে চলিতে থাকে কলয়ডাল পদার্থটির পুষ্টি ও বংশবৃদ্ধির ধারা। এইখানে লক্ষ্যণীয় এই যে, কলয়ডাল পদার্থটির মধ্যে জীবন-এর সর্বাপেক্ষা বড় দুইটি লক্ষণ প্রকাশ পাইয়াছে– একটি পুষ্টি, আর একটি বংশবিস্তার। এই বিশেষ ধরণের কলয়ডাল পদার্থটির নাম প্রোটোপ্লাজম বা সেল (Cell), বাংলায় বলা হয় জীবকোষ।[২৪]
বিজ্ঞানীগণ বলেন যে, আদিম সমুদ্রের জলে অতি তুচ্ছ প্রোটোপ্লাজম বিন্দুকে আশ্রয় করিয়াই হইয়াছিল প্রাণ-এর অভ্যুদয় এবং জগতে জীবন-এর অভিযান শুরু।
কৃত্রিম উপায়ে প্রাণসৃষ্টি
প্রকৃতিরাজ্যে আদিম প্রাণসৃষ্টি সম্বন্ধে বৈজ্ঞানিক মতবাদের যে আলোচনা করা হইল তাহাতে বুঝা যায় যে, ‘প্রাণ’ শক্তিটি কোনো কোনো পদার্থের সম্মিলিত রাসায়নিক ক্রিয়ায় উদ্ভূত একটি অভিনব শক্তি। এইখানে একটি প্রশ্ন আসিয়া থাকে যে, প্রকৃতিরাজ্যে রাসায়নিক সম্মিলনে এখনও কি প্রাণের সৃষ্টি হইয়া থাকে? ইহার উত্তরে বিজ্ঞানীগণ বলিয়া থাকেন– না। কেননা, তখনকার পৃথিবীর প্রাকৃতিক অবস্থা এমন এক পর্যায়ে ছিল অর্থাৎ তাপ, আলো, বায়ুচাপ, জলবায়ুর উপাদান ইত্যাদির পরিমাণ এরূপ ছিল, যাহাতে তখন প্রাণের উদ্ভব সম্ভব হইয়াছিল। কিন্তু সেই আদিম অবস্থা এখন আর নাই এবং ভবিষ্যতেও তাহার পুনরোদ্ভব হইবার সম্ভাবনা নাই। এখন চলিতেছে বীজোৎপন্ন প্রাণপ্রবাহ অর্থাৎ প্রাণ হইতে প্রাণের উদ্ভবের ধারা। তবুও অনেকদিন হইতে বিজ্ঞানীগণ ভাবিতেছিলেন যে, কৃত্রিম উপায়ে অবস্থান্তর ঘটাইয়া প্রাণ সৃষ্টি করা যায় কি না?
কৃত্রিম উপায়ে প্রাণসৃষ্টি ও চন্দ্রলোকে গমন করা মানুষের পক্ষে সম্ভব কি না, তাহা লইয়া আলোচনা হইয়াছিল কয়েক বৎসর পূর্বে বিজ্ঞানীদের এক সম্মেলনে এবং আলোচনায় স্থির হইয়াছিল যে, উহা সম্ভব। অতঃপর অনেক বিজ্ঞানী গবেষণা চালাইতে থাকেন উহা বাস্তবায়নের জন্য। বিষয় দুইটির লক্ষ্যবস্তু হইল পরস্পর বিপরীতমুখী। উহার একটি হইল বহির্জগতে সুদূর মহাকাশে অবস্থিত এবং অপরটি হইল জীবের অন্তর্জগতে, একেবারে কেন্দ্রে অবস্থিত। এই বিষয় দুইটি লইয়া দুই দল বৈজ্ঞানিকের মধ্যে চলিতে থাকিল অতিদূর ও অতিনিকটের রহস্যোদঘাটনের পাল্লা।
যাঁহাদের গবেষণার পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণাদি বহির্মুখী অর্থাৎ আকাশ-মহাকাশ জুড়িয়া যাহাদের কর্মক্ষেত্র, তাহাদের গবেষণার যাবতীয় সংবাদ দৈনিক, মাসিক ও বেতারাদিতে ব্যাপক প্রচারের ফলে পৃথিবীময় তুমুল হৈ চৈ পড়িয়া গিয়াছিল অনেক বারেই। কোনো মানুষের কাছে এখন আর উহা অজানা আছে বলিয়া মনে হয় না। বিশেষত টেলিভিশন যন্ত্রযোগে চন্দ্রাভিযানের দৃশ্য স্বচক্ষে দেখিয়াছেন হাজার হাজার লোকে। পক্ষান্তরে, যাহারা প্রাণসৃষ্টি সম্বন্ধে গবেষণা করিতে থাকেন, তাহাদের গবেষণার পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণাদি হইল অন্তর্মুখী, অর্থাৎ গবেষণাগারেই সীমাবদ্ধ এবং জনসাধারণের দৃষ্টিসীমার আড়ালে অবস্থিত। বিশেষত চন্দ্রাভিযানের সংবাদের ন্যায় প্রাণসৃষ্টির সংবাদ তত ব্যাপক আকারে প্রচারিত হয় নাই। তাই কৃত্রিম উপায়ে প্রাণসৃষ্টি’ –এই বিষয়টি অনেকেই অবগত নহেন। কিন্তু প্রাণ সৃষ্টির অভিযান সফল হইয়াছে চন্দ্রাভিযান সফল হইবার প্রায় দেড় বৎসর পূর্বে।
১৯৬৭-৬৮ সালের শীতকালে (ডিসেম্বর-জানুয়ারি) ক্যালিফোর্নিয়ার। স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ডক্টর আর্থার কোর্ণবার্গ এবং তাহার সহকারীগণ মিলিয়া টেস্টটিউবে অজৈব পদার্থ C, H, ০, N ইত্যাদির সংমিশ্রণে জৈব ভাইরাস সৃষ্টি করিতে সক্ষম হন। উক্ত ভাইরাস প্রকৃতিজাত (আল্লাহর সৃষ্টি) জীবন্ত ভাইরাসের ন্যায় নড়াচড়া করে। ইহাতে বহুকালের বৈজ্ঞানিক কল্পনা বাস্তবে পরিণত হয়। [ লাইফ ইন এ টেস্টটিউব, দি এ্যামেজিং ওয়ার্লড অফ নেচার, ডোনাল্ড, পৃ. ২৩০]
আলোচ্য আবিষ্কারটি হইল বিজ্ঞানীদের প্রযোজিত জীবননাট্য অভিনয়ের মাত্র প্রথম অক। ইতঃপূর্বে ১৮২৮ খ্রী. জার্মান বৈজ্ঞানিক ফ্রেড্রিক ওহলার টেস্টটিউবে ইউরিয়া (একটি জৈব পদার্থ) তৈয়ার করিয়া প্রমাণ করিয়া দেন, প্রকৃতির ন্যায় মানুষ জৈব পদার্থ তৈয়ার করিতে পারে। জানি না, ইহার যবনিকা কত দূরে। সে যাহা হউক, এখন অভিজাত প্রাণের বিবর্তন সম্বন্ধে কিছু আলোচনা করা যাক।
প্রাণের বিবর্তন
প্রাক-ক্যাম্ব্রিয়ান যুগের শেষের দিকের কথা। তখন আকৃতি ও প্রকৃতিতে সেল বা জীবকোষগুলি জীব পদবাচ্য নহে। কিন্তু উহাতে জীবনের প্রধান দুইটি লক্ষণ যখন প্রকাশ পাইয়াছে, তখন উহাকে আর নির্জীবও বলা চলে না। জীবকোষগুলির কোনো ইন্দ্রিয় নাই, বিশিষ্ট কোনো চেহারা নাই, আহার করে সর্বশরীর দিয়া চুষিয়া। পর্যাপ্ত পুষ্টিকর আহার পাইলে অতিদ্রুত বংশবৃদ্ধি করিতে পারে। শরীরের কোনো এক স্থানে আঘাত পাইলে সর্বশরীর শিহরিয়া উঠে। ইহাতে দেখা যায় যে, জীবকোষে জীবনের আর একটি লক্ষণ প্রকাশ পাইয়াছে– বোধশক্তি।
আদিম জীবকোষের বংশাবলী আজও দেখা যায় খাল-বিলের নোংরা জলে। উহা নরম তুলতুলে জেলির মতো শেওলা জাতীয় এক প্রকার জলো পদার্থ। অণুবীক্ষণ যন্ত্র দ্বারা দেখিলে উহাতে দেখা যায় অসংখ্য বিন্দু বিন্দু জীবকোষ। ইহাদের বলা হয় অ্যামিবা। ইহারাই জীবজগতের আদিম প্রাণী এবং এককোষবিশিষ্ট জীব।
কালক্রমে কোনো কোনো জীবকোষ একা একা না থাকিয়া মধুপোকার মতো কতগুলিতে একত্র জটলা করিয়া থাকিতে আরম্ভ করে। জটলার বাহিরের দিকের কোষগুলি খাদ্য সংগ্রহ করিলে ভিতরের কোষগুলি উহা চুষিয়া লয় এবং স্বস্থানে থাকিয়া উহাদের পুষ্টি ও বংশবৃদ্ধি হইতে থাকে। ইহার ফলে জটলাটির কলেবর বৃদ্ধি পায়। জটলার ভিতরের কোষগুলির স্বতন্ত্র সত্তা বজায় থাকে, কিন্তু বাহিরে হইয়া যায় এক। এইভাবে নানা আকৃতিবিশিষ্ট জটলা তৈয়ার হইয়া সমুদ্রজলে হয় বহুকোষী জীব-এর আবির্ভাব।
উদ্ভিদ ও জীব
আজ হইতে প্রায় একশত কোটি বৎসর আগের কথা। তখন ভূপৃষ্ঠের কোথায়ও গাছপালা বা জীবজন্তুর চিহ্ন নাই। সমুদ্রের জল লবণহীন, কিছুটা গরম এবং উহাতে মিশিয়া আছে নানাবিধ জৈবাজৈব পদার্থ, অধিকাংশই কার্বন-ডাই-অক্সাইড। আকাশ ঘন কুয়াশায় ভরা, যেহেতু তখনও আকাশের সমস্ত জলীয় বাষ্প বৃষ্টির আকারে ঝরিয়া পড়ে নাই। কাজেই ভূপৃষ্ঠের কোথায়ও অবাধে সূর্যের আলো পৌঁছে না। বাতাসে অক্সিজেন নাই বলিলেই চলে, আছে প্রচুর কার্বন-ডাই অক্সাইড। এহেন অবস্থার মধ্যে সমুদ্রের জলে অতি ধীরে ধীরে চলিতেছিল জীবাণুদের বংশবিস্তার।
কালক্রমে পৃথিবী আরও শীতল হইয়া আকাশের সমস্ত জলীয় বাষ্প প্রায় নিঃশেষে ঝরিয়া পড়িলে, সূর্যালোক অবাধে ভূপৃষ্ঠে পতিত হইতে থাকে এবং সূর্যালোক পাইয়া জীবাণুরাজ্যে এক নবজাগরণের সাড়া পড়িয়া যায়।
শীতের দিনে ভোরের রৌদ্র সকলেই ভালোবাসে। কিন্তু উহা উপভোগ করিবার সুযোগ সকলে। পায় না। আবার রোদ পোহাইলে আরাম পাওয়া যায় বটে, কিন্তু উহাতে পেট ভরে না। রোদ পোহাইলে যদি পেট ভরিত, তাহা হইলে খাদ্য সংগ্রহের ঝঞ্ঝাট না করিয়া জীবেরা আজীবন রোদ পোহাইত। সাগরের জলে রৌদ্র পড়িলে যে সকল জীবাণু উহা উপভোগ করিবার সুযোগ পাইল, তাহারা একটি আশ্চর্য সুবিধা পাইয়া গেল। উহারা দেখিল যে, রোদ পোহাইলে পেট ভরে। সুতরাং উহারা নড়াচড়া না করিয়া সংবৎসর শুধু রোদ পোহাইয়া দেহ পুষ্ট ও বংশবৃদ্ধি করিতে লাগিল। এইরূপ সুবিধাভোগী জীবাণুরা হইল উদ্ভিদ। আর যে সকল জীবাণু সমুদ্রের গভীর জলে থাকিবার দরুন বা অন্য কোনো কারণে সূর্যালোকের সংস্পর্শ পাইল না, খাবার সংগ্রহের জন্য তাহাদের কিছু কিছু নড়াচড়া না করিয়া গত্যন্তর রহিল না। সূর্যদেবের শাপ এই সকল জীবাণুর বর হইল। অসুবিধাভোগী জীবাণুরা হইল জীব বা জন্তু। এই বিষয়টি আর একটু বিস্তারিতভাবে বলি।
আজকাল আমরা গাছপালার পাতায় যে সবুজ রঙের বাহার দেখি, উহা রঙের বাহার মাত্র নহে। গাছের পাতায় সূর্যালোক পতিত হইয়া সবুজ রঙের একটি প্রলেপ পড়ে। উহাকে বলে ক্লোরোফিল। ক্লোরোফিল পদার্থটির একটি বিশেষ ক্ষমতা এই যে, উহা বাতাসের কার্বন-ডাই অক্সাইডকে ধরিয়া উহার কার্বন ও অক্সিজেনকে দুই ভাগে বিভক্ত করে এবং কার্বনকে গাছের দেহপুষ্টির জন্য রাখিয়া অক্সিজেনকে বাতাসে ফিরাইয়া দেয়। যে সকল জীবাণুর দেহে সূর্যালোক পতিত হইল, তাহাদের শরীরে জন্সিল ক্লোরোফিল এবং উহার সাহায্যে জীবাণুরা বসিয়া বসিয়া খাবার খাইয়া অচল জীবন যাপনে অভ্যস্ত হইল। ইহারা জাতিতে হইল উদ্ভিদ। পূর্বেই বলিয়াছি যে, ঐ সময়ের বাতাসে ছিল প্রচুর পরিমাণে কার্বন-ডাই-অক্সাইড। তাই উদ্ভিদাণুরা অনায়াসে অতিমাত্রায় পুষ্টিকর খাদ্য কার্বন পাইয়া দ্রুত বংশবৃদ্ধি করিতে থাকে এবং বিবর্তনের ধারা অনুসারে নানা শ্রেণীতে বিভক্ত হইয়া ক্রমোন্নতির পথে আগাইয়া চলে। বিবর্তনের প্রথম ধাপে দেখা যায় শেওলা জাতীয় বিবিধ নিম্নশ্রেণীর জলজ উদ্ভিদ।
যে সকল জীবাণু সূর্যালোক হইতে বঞ্চিত রহিল, তাহারা অন্য উপায়ে কার্বন সংগ্রহের চেষ্টায়। থাকিল। উদ্ভিদাণুর দেহে প্রচুর কার্বন মজুত পাইয়া জীবাণুরা উহাদের আত্মসাৎ করিতে লাগিল। তৈয়ারী খাবার সবসময় মুখের কাছে থাকে না, উহা খোঁজ করিতে হয় এবং যদিও দুই-একটি মুখের কাছে ভাসিয়া আসে, তবুও উহাকে খাইয়া ফেলিলে কিছুদূর না আগাইয়া আর একটি পাওয়া অসম্ভব। তাই জীবাণুরা খাবার সংগ্রহের তাগিদেই কিছু কিছু চলাফেরায় অভ্যস্ত হইল। বিশেষত উদ্ভিদাণুদের খাইয়া খাইয়া জীবাণুদের রাক্ষুসেপনা বাড়িয়া গেল। সবল জীবাণুরা দুর্বল জীবাণুদের খাইতে আরম্ভ করিল। ইহাতে আর একটি ফল হইল এই যে, শিকারী চায় ধরিতে আর শিকার চায় পালাইতে, কাজেই আক্রমণ ও আত্মরক্ষার জন্য জীবাণুরা দ্রুত চলাচলে অভ্যস্ত হইল এবং প্রচুর আয়াসলভ্য খাদ্য খাইয়া বিবর্তনের ধারামতে বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত হইয়া ক্রমোন্নতির পথে দ্রুত অগ্রসর হইতে লাগিল। ইহাদের বিবর্তনের প্রথম ধাপে দেখা যায় ট্রাইলোবাইট নামক কয়েক শ্রেণীর পোকা জাতীয় জলজ জীব।
বিজ্ঞানীগণ বলেন যে, মানুষ, পশু, পাখি ইত্যাদি জীব ও বৃক্ষ, লতা, তৃণাদি উদ্ভিদ –ইহারা সকলেই এককালে ছিল সাগরের জলের বাসিন্দা। উহাদের আকৃতি, প্রকৃতি, খাদ্য ও বাসস্থানের যত বৈচিত্র, তাহা ঘটিয়াছে ক্রমবিবর্তনের ফলে।
জীবজগতের বিবর্তন
পরিবর্তন জগতের রীতি। বিশ্বে এমন কোনো পদার্থ নাই, যাহার কোনোরূপ পরিবর্তন বা। রূপান্তর নাই। বিজ্ঞানীগণ বলেন যে, পৃথিবীতে আজ আমরা যে আম, জাম, শাল, সেগুন। ইত্যাদি বৃক্ষরাজি ও অসংখ্য রকম লতাগুল্ম দেখিতেছি, উহারা চিরকালই ঐরূপ ছিল না। আদিতে উহারা ছিল শেওলা জাতীয় এক প্রকার জলজ উদ্ভিদ এবং হাতি, ঘোড়া, শিয়াল, কুকুর। ও অন্যান্য যাবতীয় জীব, এমনকি মানুষও তাহার বর্তমান রূপে ছিল না। গোড়ার দিকে উহারা সকলেই ছিল এক জাতীয় জলজ পোকা।
প্রকৃতির অমোঘ বিধানে জীবজগতে যে রূপান্তর ঘটিয়া থাকে, বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় তাহাকে বলে বিবর্তন (Evolution)। বিবর্তন দুই রকম। যথা –১. মানুষের ইচ্ছা বা বুদ্ধির দ্বারা জন্তু। বা উদ্ভিদের মধ্যে মিলন ঘটাইলে, তাহার ফলে এক ঈপ্সিত স্বতন্ত্র জাতির উৎপত্তি হয় –ইহাকে বলা হয় কৃত্রিম নির্বাচন (Artificial Selection), ২. ইচ্ছা বা বিচারবুদ্ধির বালাই নাই, স্বাভাবিকভাবেই বিভিন্ন প্রাণীর মিলন সংঘটন ও নব নব জাতির বিকাশ হইয়া থাকে– ইহাকে বলা হয় প্রাকৃতিক নির্বাচন (Natural selection)। প্রাকৃতিক নির্বাচন ও কৃত্রিম নির্বাচনে পার্থক্য অনেক আছে। প্রধানত কৃত্রিম নির্বাচন বেশি সময়সাপেক্ষ নহে। কিন্তু প্রাকৃতিক নির্বাচনে কোনো প্রাণীর এতটুকু রূপান্তর ঘটিতে সময় লাগে লক্ষ লক্ষ বৎসর।
মেণ্ডেলপন্থী বিজ্ঞানীগণ জীববিজ্ঞানে বিশেষত চিকিৎসা ও উদ্ভিদবিজ্ঞানে তথা কৃষিক্ষেত্রে নানাবিধ অলৌকিক কার্য সম্পাদন করিতেছেন। আমেরিকার স্বনামখ্যাত লুথার মানুষের চাহিদা বা পরিকল্পনানুযায়ী অল্প সময়ের মধ্যে নানারকম নুতন জাতীয় ফুল, ফল বা ফসলের গাছ উৎপন্ন করিয়া দিয়া উদ্ভিদজগতে যুগান্তর আনয়ন করিয়াছেন। আর প্রাকৃতিক নির্বাচনে বানরের লেজ খসিতে, মস্তিষ্ক বড় হইতে এবং সামান্য কিছু কিছু অবয়বগত পরিবর্তন হইতে সময় লাগিয়াছে সাত কোটি বৎসর।
বিবর্তন কেন হয় এবং কি রকম হয়, এই সকলের বিশদ আলোচনা করা এই ক্ষুদ্র পুস্তকে অসম্ভব এবং যাবতীয় জীবের বিবর্তনের বিষয় আলোচনা করাও সম্ভব নহে। আমরা শুধু মানুষ জাতির বিবর্তনের মাত্র প্রধান প্রধান ধাপগুলির আলোচনা করিব।
বিজ্ঞানীগণ বলেন যে, জন্মের সময় পৃথিবীর তাপ সূর্যের বহিরাবরণের তাপের সমান ছিল। অতঃপর তাহা বিকীর্ণ হইয়া জীবসৃষ্টির অনুকূল তাপের সৃষ্টি হইতে সময় লাগিয়াছে প্রায় ২০০ কোটি বৎসর। ইহার পর প্রায় ১৫০ কোটি বৎসর হইল পৃথিবীতে জীবনের আবির্ভাব ঘটিয়াছে এবং চোখের দেখায় চিনিতে পারার মতো জীবের সৃষ্টি হইয়াছে মাত্র ৫০ কোটি বৎসরের মধ্যে। কিন্তু উহার মধ্যে ৫ হাজার বৎসরের বেশি সময়ের লিখিত ইতিহাস মানুষের হাতে নাই।
এখন প্রশ্ন হইতে পারে যে, অনন্ত অতীতের বহু খবর মানুষ জানিতে পাইয়াছেন ধর্মগুরুদের কাছে এবং ধর্মগুরুরা পাইয়াছেন প্রত্যাদেশরূপে বা সৃষ্টিকর্তার সাথে আলাপ-আলোচনা করিয়া; বিজ্ঞানীগণ উহা পাইলেন কোথায়?
এই কথা সত্য যে, বিজ্ঞানীগণ কোনোরূপ প্রত্যাদেশ বা সৃষ্টিকর্তার দেখা-সাক্ষাত পান নাই। তাঁহারা বলেন যে, সৃষ্টির ইতিহাস লেখা আছে সৃষ্ট পদার্থের গর্ভে। তাহারা যে লিপির সাহায্যে অতীতকালের জীবেতিহাস জানিতেছেন, তাহার নাম জীবাশ্ম বা ফসিল (Fossil)।
ফসিল কি?
ভূতত্ত্ব হইতে জানা যায় যে, পৃথিবীর সমতল ভূমি ও সমুদ্রতল স্তরে স্তরে সজ্জিত আছে। পর্বতাদি হইতে নদীর জল পলি আনিয়া প্রতি বৎসর সমতলভূমি বা সমুদ্রতলে উহা বিছাইয়া দেওয়ার ফলে ঐ স্তরের সৃষ্টি হয়। ক্রমশ স্তর যতই উঁচু হইতে থাকে, ইহাতে নিম্নাঞ্চলের মাটি কঠিন হইয়া পাথরের আকৃতি ধারণ করে। ভূবিজ্ঞানীগণ বিভিন্ন স্তরের প্রকৃতি ও গুণাগুণ পরীক্ষা করিয়া বলিতে পারেন যে, কোন্ স্তরের বয়স কত।
গাছের গুঁড়ি বহুকাল মাটির নিচে চাপা পড়িয়া থাকিলে উহা পাথরের আকার ধারণ করে। এই অবস্থায় উহাকে আমরা পাথর কয়লা বলি। ঐরূপ কোনো জন্তুর দেহ বহুকাল মাটির নিচে চাপা পড়িয়া থাকিলে উহার কতকালসমূহ পাথরের আকার ধারণ করে। বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় উহাকে বলা হয় জীবাশ্ম বা ফসিল। সেই স্তর সৃষ্টি হইবার সমকালে ভূপৃষ্ঠে যে জীব বর্তমান ছিল, সেই জীবের দেহের কিছু না কিছু চিহ্ন সেই স্তরে থাকিয়া গিয়াছে এবং উহা ফসিলরূপে বর্তমান আছে। বলা বাহুল্য যে, ভূগর্ভস্থ যে স্তর যত নিমে, সেই স্তর তত পুরাতন এবং যে স্তর যত উপরে, সেই স্তর তত আধুনিক। ভূগর্ভস্থ কোনো বিশেষ স্তরে প্রাপ্ত ফসিল পর্যবেক্ষণ করিয়া বিজ্ঞানীগণ বলিতে পারেন যে, ঐ জন্তুটি কোন যুগে বা কত বৎসর পূর্বে বর্তমান ছিল এবং উহার আকৃতি, প্রকৃতি, চাল-চলন এমনকি আহার-বিহার কি রকম ছিল।
যুগ বিভাগ
হিন্দুশাস্ত্র মতে, যুগ চারিটি। যথা –সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলি.। বৈশাখ মাসের শুক্লপক্ষীয় তৃতীয়ায় রবিবারে সত্য যুগের উৎপত্তি হয়। এই যুগের পরিমাণ ১৭,২৮,০০০ বৎসর। এই যুগে মৎস্য, কুর্ম, বরাহ ও নৃসিংহ– এই চারি অবতার। সত্যযুগে বৈবস্বত, মনু, ইক্ষাকু, বলি, পৃথু, মান্ধাতা, পুরোরবা প্রভৃতি রাজা ছিলেন। মানবগণের লক্ষ বৎসর পরমায়ু ও একবিংশতি হস্ত পরিমিত দেহ ছিল।
কার্তিক মাসের শুক্লা নবমী তিথিতে সোমবারে ত্রেতা যুগের উৎপত্তি। এই যুগের পরিমাণ ১২,৯৬,০০০ বৎসর। ত্রেতায় বামন, পরশুরাম, শ্রীরামচন্দ্র –এই তিন অবতার। এই যুগে। ককুস্থ, ত্রিশঙ্কু, হরিশচন্দ্র, মরুত্ত, অনরণ্য, সগর, অংশুমান, রঘু, অজ, দশরথ প্রভৃতি রাজা রাজত্ব করিয়াছিলেন। এই সময় লোকের পরমায়ু ছিল দশ সহস্র বৎসর এবং দেহ ছিল চতুর্দশ হস্ত পরিমিত।
ভাদ্র মাসের কৃষ্ণা ত্রয়োদশী তিথিতে বৃহস্পতিবারে দ্বাপর যুগের আরম্ভ হয়। এই যুগের পরিমাণ ৮,৬৪,০০০ বৎসর। এই যুগে বলরাম ও বুদ্ধ –এই দুই অবতার। শাল, বিরাট, ময়ূরজ, শান্তনু, দুর্যোধন, যুধিষ্ঠির, জরাসন্ধ প্রভৃতি এই যুগের রাজা ছিলেন। এই কালে মানুষের সহস্র বৎসর পরমায়ু ও সপ্ত হস্ত পরিমিত দেহ ছিল।
মাঘী পূর্ণিমায় শুক্রবারে কলিযুগের উৎপত্তি হয়। এই যুগের পরিমাণ ৪,৩২,০০০ বৎসর। এই যুগের শেষভাগে কল্কি অবতার আবির্ভূত হইবেন। এই সময়ে মানুষের পরমায়ু ১২০ বৎসর এবং দেহ সার্ধ-ত্রিহস্ত পরিমিত। এই যুগের মাত্র ৫,০৭০ বৎসর গত হইয়াছে (বাংলা ১৩৭৭ সন পর্যন্ত)।
উল্লিখিত চারি যুগের শাস্ত্রীয় বিবরণের সমালোচনা বা সত্যাসত্য যাচাই করা আমাদের উদ্দেশ্য নহে, উহা যুগমানবের কর্তব্য। আলোচ্য যুগচতুষ্টয়ের মোট বয়স ৪৩,২০,০০০ বৎসর এবং কলিযুগের শেষ হইতে এখনও ৪,২৬,৯৩২ বৎসর বাকি। সুতরাং অতীত হইয়াছে ৩৮,৯৩,০৬৮ বৎসর। কলিযুগের অবসানে কোন্ যুগ আসিবে এবং সত্যযুগের পূর্বে কোনোও জীব বা যুগ ছিল কিনা, শাস্ত্রকার তাহার কোনো ইঙ্গিত দেন নাই। আলোচ্য যুগচতুষ্টয়ের অতীত কাল বিজ্ঞানীদের সর্বাধুনিক প্লিটোসেন উপযুগটির সমানও নহে (এই যুগটির বর্তমান বয়স প্রায় ৫০ লক্ষ বৎসর)। পক্ষান্তরে বাইবেলের মতে, বিশ্বের সৃষ্টি বা মানুষের সৃষ্টি হইয়াছে খ্রী. পূ. ৪০০৪ সালে। অর্থাৎ এখন (১৯৭০) হইতে ৫,৯৭৪ বৎসর আগে।
উপরোক্ত যুগচতুষ্টয়ের বয়সের হিসাবে দেখা যায় যে, মোট বয়সের ১০ ভাগের ৪ ভাগ সত্য যুগ, ৩ ভাগ ত্রেতা যুগ, ২ ভাগ দ্বাপর যুগ এবং ১ ভাগ কলির ভাগে পড়িয়াছে। অর্থাৎ কলির বয়সের দ্বিগুণ দ্বাপর, তিন গুণ ত্রেতা, এবং চারি গুণ পড়িয়াছে সত্য যুগের ভাগে। এইরূপ আঙ্কিক যুগবিভাগ বিজ্ঞানীগণ করেন না, তাঁহাদের যুগবিভাগ অন্য রকম।
প্রত্নতত্ত্ববিদগণ ভূগর্ভের স্তরগুলিকে কালক্রমিক কতগুলি ভাগে বিভক্ত করিয়াছেন। উহার এক একটি ভাগকে বলা হয় এক একটি যুগ। এখন হইতে পঞ্চাশ কোটি বৎসর আগের সমস্ত যুগকে একত্রে বলা হয় আর্কেও জোইক (Archaeo Zoic) মহাযুগ বা প্রাক-ক্যামব্রিয়ান যুগ। এই যুগে যে সমস্ত প্রাণী বর্তমান ছিল, তাহাদের অস্তিত্বের সন্ধানটুকু পাওয়া যায় মাত্র, বিশেষভাবে কিছু। জানার উপায় নাই। যেহেতু তাহাদের দেহ ছিল নরম তুলতুলে, দেহে আবরণ বলিতে কিছু ছিল না। তাই তাহাদের কোনো ফসিল ভূগর্ভে পাওয়া যায় না।
ক্যামব্রিয়ান যুগ আরম্ভ হইবার পর হইতে কোনো কোনো প্রাণীদেহ কঠিন খোলস বা বর্মে আবৃত হয়। যেমন– চিংড়ি, কাঁকড়া ইত্যাদি। এই সময় হইতেই শিলালিপি বা ফসিল প্রাপ্ত হওয়া যায়। জীববিজ্ঞানীগণ যে সময় হইতে ফসিল বা শিলালিপির সাহায্যে জীবজগতের ইতিহাস জানিতে পারেন, সেই সময়টিকে তাঁহারা বলেন ঐতিহাসিক যুগ। এই ঐতিহাসিক যুগটিকে আবার তিন পর্যায়ে ভাগ করা হইয়াছে। যথা –পুরাজীবীয় (Palaeo Zoic), মধ্যজীবীয় (Meso Zoic) ও নবজীবীয় (Caino Zoic) যুগ। এই তিনটি যুগের ব্যাপ্তি ৫০ কোটি বৎসর। ইহার মধ্যে পুরাজীবীয় যুগ ৩১ কোটি বৎসর। ইহা ৫০ কোটি বৎসর আগে আরম্ভ হইয়া শেষ হইয়াছে ১৯ কোটি বৎসর আগে। এই যুগটির ৬টি উপযুগ আছে। মধ্যজীবীয় যুগটির ব্যাপ্তি ১২ কোটি বৎসর। ইহা ১৯ কোটি বৎসর আগে আরম্ভ হইয়া শেষ হইয়াছে ৭ কোটি বৎসর আগে। এই যুগটির তিনটি উপযুগ আছে। নবজীবীয় যুগ অর্থাৎ বর্তমান যুগটি মাত্র ৭ কোটি বৎসর আগে আরম্ভ হইয়া এখনও চলিতেছে। ইহার ৫টি উপযুগ আছে। সর্বশেষ উপযুগটির নাম প্লিসটোসেন উপযুগ। এই যুগটি ৫০ লক্ষ বৎসর আগে আরম্ভ হইয়া এখনও চলিতেছে। জীবজগতের বিবর্তন বিশেষত মানুষ জাতির বিবর্তনের ক্ষেত্রে এই প্লিসটোসেন উপযুগটির গুরুত্ব অপরিসীম। বিবর্তনের ক্রমিক ধারা হৃদয়ঙ্গম করিতে হইলে যুগ ও উপযুগগুলি সম্বন্ধে মোটামুটি একটি ধারণা থাকা আবশ্যক। এইখানে স্তরক্ৰমিক যুগের একটি তালিকা দেওয়া হইল। উহা পাঠকের বিবর্তনবাদ বুঝিবার সহায়তা করিবে।
স্তরক্রমিক যুগবিভাগ
(সাম্প্রতিক হইতে অতীতে)
স্তর | যুগ | উপস্তর | উপযুগ | উপযুগ আরম্ভ কোটি বৎসর আগে | উপযুগের ব্যপ্তি কোটি বৎসর |
---|---|---|---|---|---|
০৪ | নবজীবীয় যুগ ইহা স্তন্যপায়ীদের যুগ। এই যুগটির বর্তমান বয়স প্রায় ৭ কোটি বৎসর । | ৫ ৪ ৩ ২ ১ | প্লিস্টোসেন মিওসেনমাউওসেন ওলিগোসেন এয়োসেন | ১/২১X১/২৩ ৪৭ | ১/২১X১/২৩ ১৩ |
০৩ | মধ্যজীবীয় যুগ ইহা সরীসৃপদের যুগ। ইহার ব্যাপ্তি ১২ কোটি বৎসর। উপযুগ ৩টি। | ৩২১ | ক্রেটাশিয়াসজুরাসিকট্রিয়াসিক | ১১১৪১৯ | ৪৩৫ |
০২ | পুরাজীবীয় যুগ ইহা আদিম প্রাণীদের যুগ। ইহার ব্যাপ্তি ৩১ কোটি বৎসর। এই যুগটির ৬টি উপযুগ। | ৬৫৪৩২১ | পারমিয়ানকার্বনিফেরাসডেভোনিয়ানসেলুরিয়ানঅর্ডোভিসিয়ানক্যামব্রিয়ান | ২২২৮৩২৩৪৩৯৫০ | ৩৬৪২৫ ১১ |
০১ | প্রাক-ক্যামব্রিয়ান বা আর্কেও জোইক মহাযুগ পৃথিবীর সৃষ্টি হইতে শুরু করিয়া পুরাজীবীয় যুগ বা ক্যামব্রিয়ান উপযুগের পূর্ব পর্যন্ত এই যুগটি। ইহার ব্যাপ্তি কোন মতে ৩০০ কোটি বৎসর এবং কোন মতে ৪০০ কোটি বৎসর বা তাহারও বেশি। |
ক. পুরাজীবীয় যুগ (Palaeo Zoic)- এই যুগের প্রথমে ভূপৃষ্ঠে যে স্তরের সৃষ্টি হইয়াছিল, তাহা পর্যবেক্ষণ করিয়া বিজ্ঞানীগণ স্থলভাগে কোনো জীবের অস্তিত্ব পান নাই, সমুদ্রে পাইয়াছেন জলজ উদ্ভিদ ও আলপিনের মাথার মতো ক্ষুদ্র এক জাতীয় পোকা, উহাদের বলা হয় ট্রাইলোবাইট। কয়েক কোটি বৎসর পর দেখা যায় যে, ঐ পোকার আকার হইয়াছে প্রায় এক ফুট। বর্তমানে উহার সকল শাখাই বাঁচিয়া নাই। যে দুই একটি দল বাঁচিয়া আছে, খুব সম্ভব তাহারা উহাদের বংশধর কাঁকড়া, গলদা চিংড়ি ইত্যাদি।
ট্রাইলোবাইটদের এক দল নদী বা হ্রদে আশ্রয় লয়। ইহাদের নাম ইউরীপটেরিড়। ভূপৃষ্ঠের আলোড়নে নদী বা হ্রদ শুকাইয়া গেলে উহাদের বেশির ভাগই মারা পড়ে, কৃতক সমুদ্রে চলিয়া যায় এবং কোনো কোনো দল শুকনায়ও বাঁচিয়া থাকে। ইহাদের পরিবর্তিত রূপ বৃশ্চিক, মাকড়সা ইত্যাদি এবং কেহ কেহ উড়িবার ক্ষমতা লাভ করিয়া হয় পতঙ্গ। যাহারা সমুদ্রে চলিয়া যায়, কয়েক কোটি বৎসরের মধ্যে তাহাদের দেহ হয় খোলস বা চর্মে আবৃত (বর্ম নহে)।
বর্মধারী জীব যথা –কাকড়া, কাছিম, শামুকাদি জীবেরা যত সহজে শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করিতে পারে, চর্মধারী জীবেরা তত সহজে আত্মরক্ষা করিতে পারে না। তাই আত্মরক্ষার তাগিদে দ্রুত চলাচলের জন্য চমধারী জীবের দেহে তৈয়ার হয় মেরুদণ্ড। আজ হইতে প্রায় ৩৫ কোটি বৎসর পূর্বে অর্ডোভিসিয়ান উপযুগের শেষের দিকে প্রথম মেরুদণ্ডবিশিষ্ট যে সকল জীবের জন্ম হয়, তাহাদিগের এক দলকে বলা হয় মাছ।
মাছেরা সচরাচর কানকোর সাহায্যেই জল হইতে বাতাস সংগ্রহ করিয়া শ্বাসকার্য চালাইয়া থাকে। কিন্তু কালক্রমে কোনো কোনো মাছের আবার ফুসফুস গঠিত হইয়াছিল। এই ধরণের মাছ এখনও দেখিতে পাওয়া যায় আফ্রিকার সাগরে, যেমন– কোয়েলাকান্থ মাছ। ফুসফুসওয়ালা মাছেরা ডাঙ্গায় উঠিয়া পড়িলেও মারা যায় না, জল ও স্থল উভয় স্থানেই বাঁচিয়া। থাকিতে পারে।
যে সকল মাছ সমুদ্র উপকূলের কাছাকাছি বাস করিত, ঢেউয়ের আঘাতে বা জোয়ারের জলের সাথে তাহাদের কেহ কেহ ডাগায় উঠিয়া পড়িত। ইহাদের অনেকেই মরিয়া যাইত, কিন্তু সকলেই মরিত না। পরবর্তী ঢেউয়ের বা জোয়ারের জল আসা পর্যন্ত বাঁচিয়া থাকিতে পারিত। এইভাবে যে সকল মাছ জল ও ডাগায় বাঁচিয়া থাকার শক্তি অর্জন করিল, তাহারা হইল উভচর প্রাণী। ইহাদের বংশধর আজিকার কুমির, ব্যাঙ ইত্যাদি। উভচরদের সকলেরই ডাঙ্গার জীবন পছন্দ হয় নাই। কতক উভচর জন্তু আবার জলে বাস করিতে আরম্ভ করে। তাহাদের বর্তমান বংশধর তিমি, শুশুক ইত্যাদি।
উভচরদের কোনো কোনো শাখা স্থায়ীভাবে স্থলে বাস করিতে আরম্ভ করে। পরিবেশ পরিবর্তনের সাথে সাথে তাহাদের শরীরের নানা পরিবর্তন দেখা দেয়। তাহাদের লেজ আর চ্যাপ্টা থাকিল না, শল্ক হইল পশম এবং পাখনা হইল পা। এইভাবে ২৮ কোটি বৎসর পূর্বে। উভচর মৎস্যদের যে দলটি স্থায়ীভাবে ডাঙ্গাবাসী হইল, তাহাদের নাম হইল সরীসৃপ। জীব সৃষ্টির আদি হইতে আজ পর্যন্ত যত রকম জীব জন্মিয়াছে, তন্মধ্যে এই সরীসৃপরাই অতি বৃহৎ ও ভয়ানক। এই বিষয় পরে আলোচিত হইবে।
পুরাজীবীয় যুগের শেষ ভাগে ভূপৃষ্ঠে উদ্ভিদের সাতিশয় সমৃদ্ধি হইয়াছিল। সমুদ্রতীর ও জলাভূমিতে জন্মিয়াছিল নিবিড় অরণ্য। ভূপৃষ্ঠের আলোড়নে সেই নিবিড় অরণ্য মাটির নিচে চাপা পড়িয়া অত্যধিক চাপ ও তাপের প্রভাবে রূপান্তরিত হইয়াছে কয়লায়। এই কারণে এই যুগটির নামকরণ হইয়াছে কার্বনিফেরাস। আজকাল আমরা যে পাথর কয়লা ব্যবহার করিয়া থাকি, তাহা এই যুগের অর্থাৎ ২৮ কোটি বৎসর আগের বৃক্ষদের দেহের ধ্বংসাবশেষ বা ফসিল।
খ. মধ্যজীবীয় যুগ (Mesozoic)- এই যুগের গাছপালা, জীবজন্তু সবই ছিল অতিকায়। জীবজন্তুর মধ্যে সরীসৃপরাই ছিল সংখ্যায় বেশি এবং বিশালাকার। তাই এই যুগটিকে সরীসৃপদের যুগও বলা যায়। এই যুগটি ১৯ কোটি বৎসর আগে আরম্ভ হইয়া শেষ হইয়াছে ৭ কোটি বৎসর আগে।
এই যুগের নানাবিধ সরীসৃপের মধ্যে যে শ্রেণীর সরীসৃপেরা প্রাধান্য লাভ করিয়াছিল, তাহাদিগকে বলা হয় ডাইনোসর। এই ডাইনোসরের আবার কয়েকটি প্রকারভেদ আছে। যথা –ব্রন্টোসরাস, ট্রাইনোসরাস, অল্লোসরাস, গোগোসরাস, সেরাটোসরাস, স্টেগোসরাস ইত্যাদি।
একটি ব্রন্টোসরাসের দৈর্ঘ্য ছিল অন্তত ২৫ গজ এবং উহার ওজন ছিল ৫০ টন, অর্থাৎ ১,৩৫০ মণ। একটি ট্রাইরানোসরাসের ওজন ছিল প্রায় ১০ টন এবং লম্বায় ছিল ৫০ ফিটেরও বেশি।
আকৃতি ও প্রকৃতিতে পার্থক্য থাকিলেও ঐসকল সরীসৃপদের কতক বিষয়ে মিল ছিল। উহারা সকলেই পিছনের বিরাট পা ও লেজের উপর ভর দিয়া ছুটিত, সামনের ক্ষুদে ক্ষুদে থাবা দুইটি ব্যবহার করিত একমাত্র খাবার ও লড়াইয়ের জন্য এবং উহারা সকলেই ছিল মাংসাশী।
একদল সরীসৃপ আকাশে উড়িতে শুরু করিয়াছিল। ইহাদের বলা হয় টেরোডাকটিল। ইহাদের গায়ে পালক বা পশম ছিল না, ছিল শুধু চামড়ার ডানা ও ধারালো দাঁতওয়ালা মুখ (কতকটা বাদুড়ের ন্যায়)। মধ্যজীবীয় যুগের শেষের দিকে ক্রেটাশিয়াস উপযুগে, অর্থাৎ প্রায় ৮ কোটি বৎসর আগে টেরোডাকটিলেরা এইরূপ বিশালকায় হইয়াছিল যে, এক ডানার প্রান্ত হইতে আর এক ডানার প্রান্তের মাপ ছিল ২৫ ফিট। এই উড়ন্ত সরীসৃপরাই ছিল আধুনিক পাখির পূর্বপুরুষ। একই যুগেই দেখা যায় যে, ঐ উড়ন্ত সরীসৃপদের রূপান্তর হইতে আরম্ভ করিয়াছে এবং উহাতে পাখির লক্ষণ দেখা দিয়াছে। এইরূপ আর একটি উড়ন্ত জীব আর্কিওপটেরিক। এইটি পাখি ও সরীসৃপের মিশ্ররূপ — আধা পাখি, আধা সরীসৃপ।
আধুনিক সাপ, কুমির, গিরগিটি ইত্যাদির মতো সেই যুগের সরীসৃপরা ছিল ডিম্বপ্রসূ জীব। কিন্তু দেখা যায় যে, ট্রিয়াসিক উপযুগে অর্থাৎ আজ হইতে প্রায় ১৫ কোটি বৎসর আগে একদল ক্ষুদে ক্ষুদে জীব ডিম্ব প্রসব না করিয়া গর্ভধারণ ও বাচ্চা প্রসব করিত। এই সময় হইতেই স্তন্যপায়ী জীবের আবির্ভাব হয়। বিশেষত সরীসৃপদের রক্ত ছিল ঠাণ্ডা, কিন্তু স্তন্যপায়ীদের রক্ত গরম।
মধ্যজীবীয় যুগের শেষের দিকে ক্রেটাশিয়াস উপযুগে ব্রন্টোসরাসাদি কোনো জাতের ডাইনোসরের চিহ্ন (ফসিল) পাওয়া যায় না। এইরূপ অতিকায়, মহাশক্তিশালী একটি জীবের সম্পূর্ণ জাতি ধ্বংস হওয়ার কারণ লইয়া জীববিজ্ঞানীদের অনেক আলোচনা চলিতেছে। কেহ বলেন, “বিপ্লব বা যুগ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ডাইনোসরদের দৈহিক পরিবর্তন না হওয়ায় ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার সঙ্গে খাপ খাওয়াইয়া চলিতে না পারায় ডাইনোসরেরা বংশরক্ষা করিতে পারে নাই।” কেহ বলেন, “মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে যেরূপ যৌবন ও বার্ধক্য আছে এবং বার্ধক্যে সন্তানোৎপাদিকা শক্তি থাকে না বা কমিয়া যায়, প্রত্যেক জীবের জাতিগত জীবনেও তদ্রুপ বার্ধক্য আছে এবং জাতিগত জীবনের বার্ধক্যেও ঐ জাতির সন্তানোৎপাদিকা শক্তি থাকে না বা কমিয়া যায়। মধ্যজীবীয় যুগের সরীসৃপ তথা ডাইনোসরদের জাতিগত জীবনের বার্ধক্য হেতুই উহারা সবংশে লুপ্ত হইয়া গিয়াছে।” ভূপৃষ্ঠে ডাইনোসরের একাধিপত্য ছিল প্রায় ১০ কোটি বৎসর।
অন্যান্য জীবদের বেলায় যাহাই ঘটিয়া থাকুক না কেন, স্তন্যপায়ীরা দুইটি বড় রকম সুবিধা পাইয়াছিল, যাহা অন্যান্য জীবদের ভিতর ছিল না। প্রথমত উষ্ণ রক্তের অধিকারী হওয়ায় স্তন্যপায়ী জীবেরা শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা বা যে কোনো রকম প্রাকৃতিক পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেদের খাপ খাওয়াইয়া নিতে পারিয়াছিল। দ্বিতীয়ত স্তন্যপায়ীদের সন্তানবাৎসল্য ছিল। অন্যান্য জীবদের মধ্যে এই দুইটির একটিও ছিল না। কাজেই অন্যান্য জীবগণকে পিছনে ফেলিয়া স্তন্যপায়ীরা উন্নতির পথে আগাইয়া চলিয়াছিল।
গ. নবজীবীয় যুগ (Caino zoic)- আজ হইতে ৭ কোটি বৎসর পূর্বে এয়োসেন উপযুগের প্রথমেই দেখা যায় যে, স্তন্যপায়ী জীবগণ বহু শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত হইয়া অধিকাংশ ভূভাগ জুড়িয়া বসবাস করিতেছে। ঐ যুগের স্তন্যপায়ীগণ আকারে এখনকার স্তন্যপায়ী জীবের চেয়ে ছোট ছিল। বর্তমান যুগের হাতি, ঘোড়া, শূকর, গণ্ডার ইত্যাদি প্রাণীদের আদিপুরুষ ছিল একটি স্তন্যপায়ী জীব, উহার নাম ফেনাডোকাস। আকারে ইহা শিয়ালের চেয়ে বড় ছিল না।
হিংস্র ও মাংসাশী একদল স্তন্যপায়ী জীব ছিল, যাহার নাম ক্রিয়োডোন্ট। কালক্রমে এই ক্রিয়োডোন্টরা দুই দলে ভাগ হইয়া যায়। এক দলের চেহারা ছিল কুকুরের মতো, ইহাদের ক্রমবিবর্তনে কুকুর, নেকড়ে বাঘ, ভালুক ইত্যাদি এবং আর এক দলের চেহারা ছিল বিড়ালের মতো, ইহাদের ক্রমবিবর্তনে জন্মিয়াছে বিড়াল, বাঘ, সিংহ ইত্যাদি।
অন্যান্য স্তন্যপায়ীদের মধ্যে ছিল এক প্রকার ক্ষুদে ক্ষুদে জীব। ইহারা গাছে চড়িতে পারিত। ও ডালে ডালে লাফালাফি করিত।
নবজীবীয় যুগের প্রথম পর্বের সকল স্তন্যপায়ী জীব আজ বর্তমান নাই। কোনো কোনো দল লুপ্ত হইয়া গিয়াছে, আবার কোনো কোনো নূতন দলের আবির্ভাব ঘটিয়াছে। সাত কোটি বৎসর লাগিয়াছে উহাদের বর্তমান আকারে পৌঁছিতে।
যে সকল জীব মাটিতে, বিশেষত বনে-জঙ্গলে চলাফেরা করে, তাহাদের দৃষ্টিশক্তির চেয়ে ঘ্রাণশক্তি বেশি। কেন না, ঝোঁপ-জঙ্গলের বাধাজনিত কারণে দৃষ্টিশক্তি তত বেশি কাজে লাগে না। অদূরে ঝোঁপের আড়ালে কোনো শিকার থাকিলে ঘ্রাণের সাহায্যে তাহার অবস্থিতি জানিয়া তাহাকে আক্রমণ করিতে হয়। অথবা কোনো হিংস্র প্রাণী থাকিলেও তাহা ঘ্রাণের সাহায্যে জানিয়া পলাইবার চেষ্টা করিতে হয়। অর্থাৎ আক্রমণ ও আত্মরক্ষা উভয়ের জন্যই ঘ্রাণশক্তি প্রখর হওয়া দরকার। কিন্তু বৃক্ষারোহী জীবদের ঘ্রাণশক্তি বিশেষ কোনো কাজেই আসে না। তাহাদের চাই প্রখর দৃষ্টিশক্তি। এক ডাল হইতে লাফাই আরেকটি ডাল ধরিতে হইলে চাই লক্ষ্যস্থলের দূরত্ব। ও অবস্থান সঠিকভাবে নির্ণয় করা, অন্যথায় জীবন বিপন্ন হইতে পারে। এইরূপ ক্রমিক চেষ্টার ফলে বৃক্ষারোহী জীবদের দৃষ্টিশক্তি উন্নততর হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে চক্ষু ও অক্ষিগোলকের অবস্থান পালটাইয়া যায়। অন্যান্য প্রাণীরা দুই চক্ষুতে একটি বস্তুর দুইটি ছবি দেখে। কিন্তু বৃক্ষরাহীদের চক্ষুর অবস্থান পরিবর্তিত হইয়া এরূপ হইল যে, উহারা দেখে একটি। ইহাতে লক্ষ্যভ্রষ্ট হইবার সম্ভাবনা কম।
চতুষ্পদ জন্তুর চারিটি পা-ই ব্যবহার করিতে হয় হাঁটার জন্য। কিন্তু বৃক্ষারোহীদের শাখা হইতে শাখান্তরে লাফালাফি করিতে সামনের পা দুইটি ব্যবহার করিতে হয় ধরার জন্য। এইরূপে উহাদের সামনের পা দুইটি হইল থাবা।
বৃক্ষারোহীদের আরো কয়েকটি বিষয়ে অভিজ্ঞতালাভ হইয়াছিল। ডালে ডালে লাফালাফি করিবার কালে প্রতি মুহূর্তে কর্তব্য নির্ধারণ অর্থাৎ লক্ষ্য স্থির করার জন্য দ্রুত মস্তিষ্ক চালনা। করিতে করিতে মস্তিষ্ক বড় হইতেছিল। অভিজ্ঞতাবৃদ্ধির সাথে সাথে পিছনের দুই পায়ে ভর দিয়া হাঁটায় অভ্যস্ত হইয়াছিল এবং থাবা দুইটি ব্যবহার করিতে আরম্ভ করিল আক্রমণ ও আত্মরক্ষার জন্য।
দুই পায়ে চলাফেরায় সুবিধা অনেক। ইহাতে সামনের পা দুইটি সব সময়ই থাকে মুক্ত। প্রথমত আঁচড়াইয়া-কামড়াইয়া শিকার ধরা বা আক্রমণকারী শত্রুর কবল হইতে রক্ষা পাওয়ার অপেক্ষা ডালপালার (লাঠির) ব্যবহার বহুগুণে উত্তম। দ্বিতীয়ত মুখের সাহায্যে খাদ্য আহরণের চেয়ে থাবার সাহায্যে খাদ্যদ্রব্য তুলিয়া মুখে দেওয়ায় শ্রান্তি কম এবং শান্তি বেশি। এইরূপ নানাবিধ সুবিধা পাইয়া একদল বৃক্ষারোহী জীব পুরামাত্রায় দ্বিপদ হইয়া উঠিল এবং উহাদের থাবা দুইটি পরিণত হইল হাতে।
থাবা ব্যবহার করে না, মুখের সাহায্যেই খাবার তুলিয়া লয় –এইরূপ চতুষ্পদ জন্তুদের প্রায় সকলেরই মুখমণ্ডল হয় লম্বাটে। যথা –গরু, ঘোড়া, শিয়াল, কুকুর ইত্যাদি। আর যাহারা থাবা ব্যবহার করে, এইরূপ জন্তুদের প্রায়ই মুখমণ্ডল হয় গোল। যথা –বাঘ, বিড়াল, সিংহ ইত্যাদি। দ্বিপদ জন্তুরা খাবার তুলিয়া মুখে দেওয়া ও মশা-মাছি তাড়াইবার কাজে হাত ব্যবহার করিতে আরম্ভ করিলে, তাহাদের মুখমণ্ডল হইতে থাকে গোল এবং মশা মাছি তাড়ানো ও ধূলাবালি ঝাড়া ইত্যাদি কোনো কাজে লেজের ব্যবহার না থাকায় লেজটি হইতে থাকে ছোট। কালক্রমে উহাদের মেরুদণ্ডের শেষ প্রান্তে সামান্য একটু নমুনা ছাড়া লেজের আর কোনো চিহ্নই। থাকিল না। ইহাদের বলা হয় প্যারাপিথেকাস।
উক্তরূপে একটি অভিনব জন্তুর উদ্ভব হইলে, কালক্রমে উহারা আবার দুই ভাগে বিভক্ত হইয়া পড়ে। উহাদের মধ্যে একটির লেজ নাই, মুখমণ্ডল ঈষৎ গোল, উহারা সোজা হইয়া হাঁটিতে পারে এবং যাবতীয় কাজে হাত ব্যবহার করে। এই জন্তুটি বানর নহে, শিম্পাঞ্জি, গরিলা বা ওরাংওটাং নহে এবং পুরাপুরি মানুষও নহে। ইংরাজিতে ইহাদিগকে বলা হয় অ্যানথ্রোপয়েড এপ বা মানুষসদৃশ বানর। ইহারাই মানুষের পূর্বপুরুষ। প্যারাপিথেকাসের অপর শাখার জন্ধুদের সাথে অ্যানথ্রোপয়েড এপ-এর চালচলন ও আকৃতিগত পার্থক্য সামান্য হইলেও তাহারা বনমানুষের পূর্বপুরুষ।[২৫]
ক্রমবিবর্তন কোনোটিই অল্প সময়ে হয় না। ক্ষুদ্র একবিন্দু প্রোটোপ্লাজম হইতে চোখের দেখায় চিনিতে পারার মতো জীবের সৃষ্টি হইতে, তুলতুলে শরীরে বর্মসাজ ও মেরুদণ্ড জন্মিতে সময় লাগিয়াছিল প্রায় একশত কোটি বৎসর এবং জলচর হইতে উভচর, স্থলচর, সরীসৃপ ও পশু (বানর) রূপ ধারণ করিয়া তাহার লেজ খসিতে সময় লাগিয়াছিল আরও প্রায় পঞ্চাশ কোটি বৎসর।
[২৪. পৃথিবীর ঠিকানা, অমল দাসগুপ্ত, পৃ. ১৯৪–১৯৮]
[২৫. পৃথিবীর ঠিকানা, অমল দাসগুপ্ত, পৃ. ২১৮–২২৪।]
“আরজ আলী মাতুব্বর” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ