জাহেদ আহমদ

এক.

বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে

আমরা রয়েছি বসে,

বিবি তালাকের ফতোয়া খুঁজেছি

ফেকাহ্ ও হাদীস চষে ।

বাহিরের দিকে যত মরিয়াছি

ভিতরের দিকে তত

গুনতিতে মোরা বাড়িয়া চলেছি

গরু-ছাগলের মত ।

– কাজী নজরুল ইসলাম

ইন্টারমিডিয়েট লেভেলে কলেজের ইংরেজি এন্থলজিতে পড়া একটি গল্প আমার মনকে খুব নাড়া দিয়েছিল। অনেকেই গল্পটির কথা জেনে থাকবেন। আমেরিকান লেখিকা মারজারি কিনান রাওলিন্স-এর ‘এ মাদার ইন ম্যানভিল’ (A Mother in Manville)। কাহিনী এরকম লেখালেখি বিষয়ক একটা এসাইনমেন্টের কাজে লেখিকা মারজারি নর্থ ক্যারোলিনার পাহাড়ে অবস্থিত একটি অনাথ বাচ্চাদের আশ্রমে কিছুদিন কাটান। সেখানে জেরি নামে একটা বাচ্চার সাথে তার পরিচয় ঘটে। জেরি লেখিকাকে প্রতিদিন আগুন পোহানোর কাঠ কেটে দিত। সে ছিল প্রত্যয়ী, পরিশ্রমী এবং অত্যন্ত মেধাবী। জেরি আলাপ প্রসঙ্গে লেখিকাকে জানায়, তার মা জীবিত এবং মাঝে মাঝে তাকে দেখতেও আসেন এটাসেটা উপহার নিয়ে । গল্পের শেষ পর্যায়ে লেখিকা আশ্রমে চাকরিরত জনৈক মহিলার কাছ থেকে জানতে পারেন যে, জেরীর মা-বাবা কেউই আসলে জীবিত নেই এবং তাকে কেউ দেখতে আসার কথাও ঠিক নয়। এখানেই গল্পের সমাপ্তি ঘটলেও পাঠক-পাঠিকার মনে কাহিনীটি একাধিক প্রশ্নের জন্ম দেয়। জেরী কি তাহলে মিথ্যুক? কেন সে ফাঁদিয়ে ওরকম একটি গল্প লেখিকাকে বলতে গেল? সম্ভাব্য ব্যাখ্যা একাধিক, জেরী অনাথ বালক হিসেবে কারো করুণা বা সহানুভূতি নিতে চায়নি। অথবা, লেখিকাকে দেখে তার মায়ের কথা মনে পড়েছে; তাই নিজের একাকিত্ব ও অসহায়ত্বকে চেপে রাখতে কল্পনায় সে একজন মাকে সৃষ্টি করেছে। তা না হলে সম্ভবত তার আত্ম পরিচয়ের সঙ্কট দেখা দিত ।

উপরের গল্পটি বিশেষভাবে মনে পড়ল সম্প্রতি যখন পত্রিকার পাতায় একটি ‘বিশেষ’ লেখার ওপরে চোখ বুলাচ্ছিলাম। উক্ত লেখাটিতে লেখক মরিয়া হয়ে উঠেছেন দেখাতে যে, আল- কোরানের সাথে বিজ্ঞানের বিভিন্ন আবিষ্কারের বিস্ময়কর(?) মিল রয়েছে। বেশ কিছু দেশি-বিদেশি রেফারেন্সও তিনি টেনে এনেছেন যা বিজ্ঞান এবং বিজ্ঞান গবেষণার পদ্ধতির সাথে অপরিচিত পাঠক- পাঠিকাদের খুব সহজেই বিভ্রান্ত করতে পারবে; তারা মনে করতে পারেন, কোরান বোধ হয় এক ধরনের বিজ্ঞান গ্রন্থ। হয়ত এও ভাবতে পারেন (বা ভাবেন) প্রায় সাড়ে চৌদ্দশ বছর আগেই বিজ্ঞানের এমনসব তথ্য পবিত্র কিতাবে লেখা হয়েছিল, যা আধুনিক জগতে বিজ্ঞানীরা পরিশ্রমলব্ধ গবেষণার মাধ্যমে মাত্র জানতে শুরু করেছেন! তবে এসব বিশ্বাস মুসলমানদের মাঝে একেবারে নতুন নয়। সেই ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি, ‘আমাদের কোরানেই পৃথিবীর সমস্ত জ্ঞান-বিজ্ঞান নিহিত রয়েছে। এগুতে পারছি না কেবল শয়তানের ওয়াসেওয়াসে।’ কিংবা “কাফির-নাসারারা যে এত উন্নতি করছে, তা আসলে আমাদের কোরান গবেষণা করে, অথচ আমরা নিজেরা পারছি না সঠিক আমলের অভাবে । কিন্তু আমাকে আজ পর্যন্ত কেউ কোনদিন বলে দিতে পারলেন না, ‘সঠিক আমল জিনিসটি আসলে কী কিংবা, বক্তা নিজেই বা কেন ‘সঠিক আমল’টি অভ্যাস করে কোটি কোটি মুসলমানদের দুর্দশা লাঘব করতে সক্ষম হচ্ছেন না। একজন শিক্ষিত মুসলমানের কলম দিয়ে যখন এসব বালখিল্যতায় ভরা কথা বা লেখা বেরিয়ে আসে, তখন পাঠকের বিভ্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা একটু বেশি বৈকি। কারণ এরা আবার নিজেদের একই সাথে ‘আধুনিক’ এবং ‘পাক্কা মুসলিম’ লেবাসে ঢাকতে পারঙ্গম । কেউ কেউ ভাবেন, ঐসব লেখা মুসলমানদের সামনে এগোনোর পথে অনুপ্রাণিত করবে। কিন্তু আসলে কি তাই? জবাবে বলব, জ্বী-না। বাস্তবতা বড়ই রূঢ়। কোরানে যদি বিজ্ঞানের ব্যাপারে এতই ইঙ্গিত থেকে থাকত, তাহলে প্রশ্ন আসে পৃথিবীর সমস্ত জনসংখ্যার প্রায় এক-পঞ্চমাংশ মুসলমান হলেও বর্তমানে সমস্ত পৃথিবীতে মুসলমান বিজ্ঞানীদের সংখ্যা কেন এক-শতাংশেরও কম? কিংবা কেন পৃথিবীর সমস্ত মুসলিম দেশে যত বিজ্ঞানী রয়েছে, অমুসলিম ইসরাইলের একা রয়েছে তার চাইতে দ্বিগুণ সংখ্যক বিজ্ঞানী? তবে অর্বাচীণ শ্রেণীর যেসব লেখকদের কথা বলছি অর্থাৎ যারা কিনা ধর্মগ্রন্থে বিজ্ঞান খুঁজে পান, তাদের মধ্যে সবাই যে কেবল মুসলমান, তা নয়। খ্রিষ্টানদের মধ্যেও একদল মূর্খ রয়েছে যারা একইরকমভাবে বাইবেলে বিজ্ঞানের সূত্র সন্ধান করে বেড়ায়। ঠিক তেমনি, হিন্দুদের মধ্যে রয়েছে তথাকথিত বৈদিক সাইনস’-এর একদল প্রবক্তা। গত বিজেপি সরকারের আমলে বেদকে বিজ্ঞান শিক্ষায় অন্তর্ভুক্তির দাবিতে পুরো ভারতে এরা রীতিমত ঝড় তুলেছিল। এদের অনেকে এখনও সে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে আমি এই লেখায় মূলত ‘কোরানে বিজ্ঞান’ খোঁজার বিষয়টির অন্তঃসারশূন্যতা এবং যুক্তিহীনতার দিকেই মনোনিবেশ করব। অন্যান্য ধর্মগ্রন্থে বিজ্ঞান খোঁজার বিষয়ে ইন্টারনেটে সার্চ করলে প্রচুর লেখা পাওয়া যাবে। আমাদের ‘মুক্তমনা’ হিউম্যানিস্ট ফোরামেও এই বিষয়ে যথেষ্ট সংখ্যক লেখা রয়েছে (উৎসাহীরা ইন্টারনেটে এই ঠিকানায় ব্রাউজ করতে পারেনঃ www.mukto-mona.com)

 

দুই.

কোরানে কি সত্যি বিজ্ঞান লুকায়িত ?

মনে মনে চিন্তা করছিলাম ব্যাপারটি নিয়ে । এমনটি কেন হয়, বিজ্ঞানীরা যখন কোন কিছু আবিষ্কার করে ফেলেন, কেবল তখনি কতিপয় অন্ধ মুসলমান, খ্রিস্টান ও হিন্দু মূর্খ এটি তাদের নিজ ধর্মগ্রন্থে আছে বলে চেঁচামেচি শুরু করে দেয়, কিন্তু উল্টোটি কখনোই দেখা যায় না, অর্থাৎ কোরান-বেদ- বাইবেলের তথাকথিত লুক্কায়িত সূত্র ধরে কেউ আজ পর্যন্ত একটিও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার করতে পারেনি? আমাকে কেউ কি মাত্র একটা স্ট্যান্ডার্ড সায়েন্স জার্নাল (যেমন – Science, Nature, etc)-এর নাম বলতে পারবেন যেখানে বিজ্ঞানী তার রেফারেন্সের তালিকায় কোরান, বেদ, বাইবেলকে উল্লেখ করেছেন? (আমি গবেষণাধর্মী বিজ্ঞান জার্নালের কথা বলছি; ‘বাইবেল- কোরান ও বিজ্ঞান’ বা ‘মহাগ্রন্থ কোরান ও বিজ্ঞান’ জাতীয় স্থুল কোন গ্রন্থের কথা বলছি না) উত্তর খুঁজতে গিয়ে ‘এ মাদার ইন ম্যানভিল’ গল্পের কথা মনে পড়ল । আমার কাছে ব্যাপারটা বেশ মজার বলে মনে হল । একটু চিন্তা করলে দেখা যাবে, যে সব মুমিন-মুসলমান লেখক কোরানে বিজ্ঞান বলে চেঁচামেচি করেন, তাদের সাথে উপরে উল্লিখিত গল্পের মূল চরিত্র জেরীর মননের অদ্ভুত সাদৃশ্য রয়েছে, অন্তত মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে তাই মনে হয়। আপন অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে বিনয়ী, প্রত্যয়ী এবং বুদ্ধিদীপ্ত হওয়া সত্ত্বেও জেরী যেমন কল্পনায় একজন মাকে সৃষ্টি করেছে— যিনি সন্তানকে ভালবাসেন, উপহারসহ দেখতে আসেন, তার সাথে সময় কাটান; ঠিক তেমনি কতিপয় মুসলমান লেখক- লেখিকা আত্মপরিচয়ের সঙ্কট থেকে আপন ‘উম্মাহ’র পরিত্রাণের উপায় হিসেবে একর পর এক সৃষ্টি করে চলেছেন কোরানে বিজ্ঞানে অস্তিত্বের গল্প । এই প্রবণতা একজন মানুষের মধ্যে তখনই ততো বেশি দেখতে পাবেন, তার স্বীয় অস্তিত্ব ও পরিচয়ের সঙ্কট যখন যত বেশি হবে। উপরের গল্পে লেখিকার মাতৃসম স্নেহ, ভালবাসা জেরীকে কল্পনায় মা আবিষ্কারের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। আর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে অমুসলিমদের বিশাল কর্তৃত্ব কতিপয় মুসলমান লেখক- লেখিকাদের ঠেলে দিচ্ছে কোরানে বিজ্ঞান খোঁজার দিকে। এই শ্রেণীর কিছু শিক্ষিত মুসলমানদের ভয়াবহ অজ্ঞতার কিছু বাস্তব উদাহরণ দেয়া যাক ।

মুসলিম আত্মীয়-স্বজন এবং বন্ধু-বান্ধবদের অনেকে আমাকে নিয়ে আক্ষেপ করেন। জানতে চান, ধার্মিক মুসলমান পরিবারে জন্ম নিয়েও আমি কেন ধর্মে বিশ্বাস করি না। কেউ কেউ রেফারেন্স দিয়ে আমাকে ইম্প্রেস করার চেষ্টা করেন। যেমন— আরে ভাই, এত বই পড়েন অথচ এটাও জানেন না, স্বয়ং আমেরিকার একজন মনীষী (?) পর্যন্ত গবেষণা করে রায় দিয়েছেন, মহানবি মুহম্মদ (স.) হচ্ছেন সর্বকালের(!) সর্বশ্রেষ্ঠ(!) মহামানুষ(!)। বিশেষণের ভুল প্রয়োগ দেখে আমি অবাক হই । বুঝতে পারি, অজ্ঞতার চেয়ে ভয়াবহ মানসিক অসুখ ধরনীর বুকে খুব কমই আছে। কারণ আমেরিকার সেই তথাকথিত ‘মনীষী’র বইটির সরাসরি ইংরেজি ভার্সন আমি পড়েছি আর এদের বেশির ভাগই পড়েছেন এর অসম্পূর্ণ এবং ভুল বাংলা অনুবাদ (যা ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে বাজারে ছাড়া হয়েছে)। বইটি লিখেছেন মাইকেল এইচ. হার্ট (Michael H. Hart) নামের আমেরিকান একজন সাংবাদিক। বইটির তিনি নাম দিয়েছেন The 100: A Ranking of the Most Influential Persons in History। মাইকেল হার্ট নিজেই বইটির ভূমিকায় (যা অবৈধ বাংলা ভার্সনে অনুপস্থিত) পরিষ্কার করে উল্লেখ করেছেন, তিনি যা করতে চেষ্টা করেছেন, তা হচ্ছে ইতিহাসে সর্বাধিক প্রভাব বিস্তারকারী (The most influential) লোকজনের একটি তালিকা তৈরি করতে, যার সাথে যে কেউ দ্বিমত পোষণ করতে পারেন এবং যা কোনো ক্রমেই ‘সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ’ বা The greatest human beings-এর তালিকা নয়। যেমন- বইটিতে ইতিহাসে সর্বাধিক প্রভাব বিস্তারকারী মানুষ হিসেবে সর্বপ্রথমে যেমন মহানবী হযরত মুহম্মদ (স.)কে স্থান দেয়া হয়েছে, তেমনি একই তালিকায় ৩৯ নং-এ আছেন স্বয়ং হিটলার! অন্যান্য র‍্যাংকিং-এ এসেছে স্ট্যালিন, চেঙ্গিস খানদের নাম । মজার ব্যাপার, বইটির অবৈধ বাংলা সংস্করণের সংখ্যা একাধিক এবং টাইটেল বইয়ের নাম এসেছে বিকৃত আকারে, ‘ইতিহাসের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষদের তালিকা।’ বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে অনেকে বইটির কেবল বাংলা অনুবাদ পড়েছেন, আর ইংরেজিটা ছুঁয়ে দেখলেও খুব সম্ভবত The most influential এবং The greatest men in the human history এর মধ্যে পার্থক্য বোঝার মত বুদ্ধিমত্তা এদের নেই! তারা অহেতুক রেফারেনসে আপ্লুত হন। কমবেশি একই রকম অজ্ঞতার প্রকাশ ঘটায় অনেক শিক্ষিত মুসলমান যখন তারা মরিস বুকাইলি নামের সৌদি রাজপরিবারে চাকরি করা একজন খ্রিষ্টান ডাক্তারের (কোন বিজ্ঞানী নয়) একটি বইয়ের বিষয়বস্তুতে। বইটির নাম : ‘Bible, Quran and Science’ (বাইবেল, কোরান এবং বিজ্ঞান) । মজার ব্যাপার বাইবেল, কোরান এবং বিজ্ঞানের মধ্যে কোরানকে চূড়ান্ত সত্য(?) বললেও মরিস বুকাইলি নিজে কিন্তু মুসলমান হননি! হওয়ার অবশ্য দরকারও নেই, কারণ জানা গেছে, কোরানকে আধুনিক পাঠক-পাঠিকার কাছে জনপ্রিয় করার উদ্দেশ্যে সৌদি শাসকরা বুকাইলিকে এই দায়িত্ব দিয়েছিল যে তিনি যেন একটি ইম্প্রেসিভ বই লিখে দেন। বিনিময়ে বুকাইলি পেয়েছেন বিরাট অঙ্কের পেট্রোডলার!

 

তিন.

একটি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের নমুনা

বিজ্ঞান কার্য-কারণ (cause and effect) নীতি, অনুসন্ধান, পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষা- নিরীক্ষা এবং নিবিঢ় গবেষণার ভিত্তিতে এগোয়, কারো ব্যক্তিগত বিশ্বাসের মূল্য নেই এখানে । আর ধর্মগ্রন্থের পুরো ব্যাপারটাই হচ্ছে অগাধ এবং প্রশ্নহীন বিশ্বাস । তেলে জলে কি আর মেশে? বিজ্ঞানীদের এক একটি আবিষ্কার প্রকৃত অর্থে বহু বছরের নিরবচ্ছিন্ন অধ্যয়ন, মৌলিক গবেষণা এবং পূর্বসূরিদের একই বিষয়ে রেখে যাওয়া তথ্য-উপাত্তের বিশ্লেষণের মাধ্যমে ঘটে থাকে। এখানে অলৌকিক গ্রন্থাবলীর কোন স্থান নেই । আর তা বলা মানে, একজন বিজ্ঞানীর কৃতিত্ত্বকে খাটো করা। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেছি, ডি-এন-এ (DNA) আবিষ্কারের কথা। ডি-এন-এ অণুর পুরো নাম ডি অক্সি রাইবো নিউক্লিক এসিড। একে বলা হয় ‘জীব দেহের প্রধান অণু’ (the master molecule of life)। কেউ কেউ আদর করে ডি-এন-এ’কে ডাকেন ‘প্রচার মাধ্যমের প্রেয়সী’ (The Darling of the media)। যারা বিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রী না, তারাও জিন থেরাপি, ক্লোনিং, মানব জিনোম প্রকল্প (Human Genome Project) ইত্যাদির নাম শুনে থাকবেন। এসবগুলি কাজ ও গবেষণার মূল টার্গেট বা অস্ত্র হচ্ছে ডি-এন-এ (যার সাথে জিনের পার্থক্য হচ্ছে, বিশাল দৈর্ঘ্যের একেকটি ডি-এন-এ অণুতে রয়েছে অনেকগুলি আলাদা আলাদা অংশ, যা জিন (Gene) বলে পরিচিত)। এই ড়ি-এন- এ’র উপাদান ও গঠন আবিষ্কার করতে বিজ্ঞানীদের সময় লেগেছে প্রায় একশ বছর। যদিও ১৯৫৩ সালের জেমস ওয়াটসন ও ফ্রান্সিস ক্রিক-এর ডাবল হেলিক্স মডেল ডি-এন-এ আবিষ্কারের ইতিহাসে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য ঘটনা, বায়োলজি বা মলিকুলার বায়োলজির যে কোনো ছাত্র/গবেষক মাত্রই জানেন- পূর্ববর্তী বিজ্ঞানীদের গবেষণা এবং পর্যবেক্ষণের সূত্র ছাড়া ১৯৫৩ সালের যুগান্তকারী ঘটনাটি সম্ভব ছিল না। আমি নিচে ডি-এন-এ আবিষ্কারের ক্রোনোলজিকাল স্তরগুলো উল্লেখ করছি- (সূত্র : nature, human genome issue)

  • ১৮৬৯ সাল— সর্বপ্রথম জীব কোষ থেকে ডি-এন-এ পৃথক করা হয় ।
  • ১৮৭৯ সাল— মাইটোসিস কোষ বিভাজন পর্যবেক্ষণ করা হয় ।
  • ১৯০০ সাল- জোহান ম্যান্ডেলের মটরশুঁটি বিষয়ক গবেষণার সন্ধান লাভ ।
  • ১৯০২ সাল— বংশগতি (Hereditary) বিষয়ে ক্রোমোজোম তত্ত্বের ধারণার উদ্ভব।
  • ১৯০৯ সাল- সর্বপ্রথম ‘জিন’ শব্দটি চালু হয় (এটি কোরানে বর্ণিত কোন ‘জিন’ নয়— লেখক)।
  • ১৯১১ সাল- ফ্রুট ফ্লাই (Drosophila melanggaster) নিয়ে গবেষণা ক্রোমোজোম তত্ত্বের ধারণাকে শক্তিশালী করে।
  • ১৯৪১ সাল- এক জিন এক এনজাইম তত্ত্বের ধারণা ।
  • ১৯৪৩ সাল— এক্সরে ডিফ্রেকশন (Xray diffraction) টেকনিকের প্রয়োগ করে ডি-এন-এর উপর গবেষণা করা হয়।
  • ১৯৪৪ সাল- ডি-এন-এ ট্রান্সফরমেশন (Transformation) নীতির আবিষ্কার । ১৯৫২ সাল— জিন যে আসলে ডি-এন-এ দিয়ে তৈরি, তা জানা যায় ৷

১৯৫৩ সাল- জেমস ওয়াটসন, ফ্রান্সিস ক্রিক এবং উইলকিনস ডাবল হেলিক্স মডেল-এর মাধ্যমে ডি-এন-এ’র গঠন ও উপাদান ব্যাখ্যা করেন (সে সময় ওয়াটসনের বয়স ছিল মাত্র ২৩ বছর- লেখক)। ১৯৬৩ সালে সে জন্য তাদেরকে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়।

প্রিয় পাঠক-পাঠিকা, ওপরের উদাহরণ দ্বারা আশা করি বোঝাতে সক্ষম হয়েছি যে, কোরান- বেদ- বাইবেলের সাথে বিজ্ঞানের আবিষ্কারের সামঞ্জস্য খোঁজা একধরনের অজ্ঞতা ও আহাম্মকি বৈ অন্য কিছু নয়। অথচ কেউ কেউ তাই করছেন। আর এ হীন কাজে তাদের সঙ্গী হচ্ছেন স্বার্থান্বেষী, লোভী এবং নামসর্বস্ব প্রচারপ্রিয় বিজ্ঞানী। যেমন- বাংলাদেশে ড. শমসের আলী ‘Scientific Indications in The Holy Quran’ নামক বইটির তৃতীয় কভার পেজে কোরানের একটি আয়াত উল্লেখ করে তার সাথে বড় করে ডি-এন-এ অণুর ছবি জুড়ে দিয়ে বোঝাতে চেয়েছে, কোরানে ডি-এন-এ ব্যাপারে পর্যন্ত ইঙ্গিত রয়েছে। আয়াতটি এ রকম— ‘এবং তোমাদের এবং পৃথিবীর প্রাণীদের গঠন-প্রকৃতিতে নিশ্চিত বিশ্বাসীদের জন্য রয়েছে সংবাদ’ (৪৫ঃ৪)।

বলুন তো, এর সাথে ডি-এন-এ অণুর সম্পর্কটা কোথায়? এই মূর্খতা (নাকি, শঠতা?) শেষ হবে কবে? এবার ভ্রুণতত্ত্বের সাথে কোরানের তথাকথিত মিলের ব্যাপারে একটি উদাহরণ দিচ্ছি।

 

ভ্রুণতত্ত্ব (Embroyology) কি কোরান থেকে এসেছে?

কোরানের বহু জায়গায় বলা হয়েছে, জমাট রক্ত থেকে মানুষের সৃষ্টি করা হয়েছে (২৩ঃ১৪; ৭৫ঃ৩৮; ৯৬; ২); যার সাথে বিজ্ঞানের অমিল ছাড়া কোন মিল নেই। ‘জমাট রক্ত’ প্রসঙ্গ ঘুরে ফিরে বার বার কেন কোরানে আসল? এরকম প্রশ্ন মনে আসতেই পারে। এর উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের একটুখানি দৃষ্টি দিতে হবে হজরত মুহম্মদের পূর্ববর্তী সমাজ ও ইতিহাসের দিকে। মুহম্মদের জন্ম (৫৭০ খ্রিষ্টাব্দ) গ্রীক দার্শনিক এরিস্টটলের জন্মের (খ্রিস্টপূর্ব ৩৮৪) প্রায় এক হাজার বছর পরে। দর্শন-সাহিত্য-বিজ্ঞান তখনও (এমনকি এর পরেও) এরিস্টটলের চিন্তা- চেতনার মধ্যেই আবর্তিত হচ্ছিল। স্বাভাবিক কারণেই এরিস্টটলীয় এসব ধারণা কম বেশি মুহম্মদকেও প্রভাবিত করেছিল। এক্ষেত্রে মুহম্মদের নিরক্ষরতা বড় কোন বাধা হওয়ার কথা নয় । জমাট বাঁধা রক্ত (আলাক্বা, আরবিতে) জীব সম্পর্কিত তার অনেক তত্ত্বই কালক্রমে ভুল প্রমাণিত হয়েছে। যেমন- মানব প্রজনন সম্পর্কে এরিস্টটল এই ভ্রান্ত ধারণাতে বিশ্বাস করতেন যে, যৌবনবতী মহিলার ঋতুস্রাব (menstrual blood) এর ওপর পুরুষের বীর্যের ক্রিয়ার ফলেই মাতৃগর্ভে শিশুর জন্ম হয়ে থাকে! জমাট-বাঁধা রক্ত থেকে জন্মের কোরানিক তত্ত্বে এরিস্টটলের এই ভ্রান্ত ধারণারই প্রতিফলন ঘটেছে। সন্দেহ নেই, কোরানের এই ধারণাটি মারাত্মকভাবে ভুল । অথচ অনেক মুমিন এই সত্যকে মেনে নেবেন না কেবলমাত্র এই অন্ধবিশ্বাসের কারণে— ‘কোরান আল্লাহর বাণী, কাজেই ভুলত্রুটির ঊর্ধ্বে।’ মূলত ভ্রূণের পর্যায়ক্রমিক বৃদ্ধির বিভিন্ন স্তরে এমন কোন পর্যায় নেই, যেখানে ভ্রুণকে জমাট রক্ত সদৃশ মনে হতে পারে, যখন মিসকারেজ (miscarrige) বা প্রাকৃতিক উপায়ে গর্ভপাত ঘটে। তর্কের খাতিরেও যদি মেনে নেই ভ্রুণটি জমাট রক্ত সদৃশ, তাহলেও ভুলে যাওয়া চলবে না- এটি কেবল মৃতভ্রুণের ক্ষেত্রে ঘটে অর্থাৎ যেটির আর পূর্ণাঙ্গ মানব শিশুতে রূপান্তরিত হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই ।

জমাট রক্ত আসলে কী, সে সম্পর্কে প্রাণ রাসায়নিক (Biochemical) ব্যাখ্যাটা এখানে জেনে নেয়া ভাল, যাতে তথাকথিত ধর্মীয় বিজ্ঞানের সমর্থকরা মনগড়া ব্যাখ্যা দ্বারা বারবার আমাদের বিভ্রান্ত করার সুযোগ না পান। আঘাত বা দুর্ঘটনার ফলে রক্তক্ষরণ ঘটলে শরীরে স্বাভাবিক নিয়মেই ক্ষত বা আঘাতের স্থানে রক্ত জমাট বাধে। কৈশিক রক্তনালীর (capillary vessles) চাইতে বড় যেকোন রক্তনালী থেকে রক্তক্ষরণ ঘটলে জখম বা আঘাতের স্থানে রক্ত জমাট বাধে যাতে অতিরিক্ত ক্ষরণ আর না ঘটতে পারে। এক্ষেত্রে অনুচক্রিকা বা প্লেটলেট (তিন প্রকার রক্তকোষের একটি) এর ভূমিকা সর্বপ্রধান এবং সর্বপ্রথম। যখন শরীরে কোথাও কোন জখম বা আঘাত ঘটে, স্বাভাবিক অনুচক্রিকাগুলি তখন সক্রিয় অনুচক্রিকায় রূপান্তরিত হয়। এগুলির তখন আকৃতির পরিবর্তন ঘটে থাকে এবং এরা আঠালো হয়ে রক্তনালীর দেয়ালে জমা হয়ে প্লাগ (plug) তৈরি করে। এই সক্রিয় অনুচক্রিকাগুলি থেকে একই সময়ে রক্তপ্লাজমায় বিশেষ এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থের নিঃসরণ ঘটে থাকে। অনেকগুলি জটিল প্রাণরাসায়নিক বিক্রিয়ার সাহায্যে ফাইব্রিনোজেন তখন ফ্রাইব্রিনে পরিণত হয় । ফ্রাইব্রিন হচ্ছে এক ধরনের অদ্রবণীয় প্রোটিন বা ফাইব্রিল নামক অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সুতা জাতীয় বস্তুর সমন্বয়ে জটিল জালিকার সৃষ্টি করে। রক্তকোষ এবং প্লাজমা (উভয়ের সমন্বয়েই রক্ত গঠিত) তখন ফাইব্রিলের এই জালে আটকা পড়ে গিয়ে ক্লক বা জমাট রক্তের সৃষ্টি করে ।

 

জ্যোতির্বিজ্ঞান (Astronomy), মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং কোরান

গ্রহ-নক্ষত্র এবং জ্যোতিষ্কমণ্ডলী সম্পর্কে ‘আল-কোরানের’ ব্যাখ্যা একটু পর্যালোচনা করা যাক; কেননা ভ্রুণবিদ্যার মত এটিও ‘ধর্মীয়-বিজ্ঞানী’ এবং তাদের পৃষ্ঠপোষক মুমিন বান্দদের আরেকটি অতি প্রিয় বিষয়। সন্দেহ নেই, আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞান (Astronomy) অনেক মুসলিম-মনীষীর মৌলিক গবেষণা এবং অধ্যয়নের নিকট প্রভূতভাবে ঋণী। উদাহরণস্বরূপ আল-সুফী, আল-বিরুনি, আল-জারকালি প্রমুখ জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের নাম করা যায়। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, এসব মনীষী কোরান বা অন্য কোন ধর্মীয়গ্রন্থের সূত্র ধরে কিছুই আবিষ্কার করেননি। কেননা ক্লাসিক্যাল ইসলাম বা স্বর্ণযুগে মুসলমান মনীষীরা যতটা না ছিলেন আচারসর্বস্ব মুসলমান, তার চাইতে অধিক তাদের পরিচিতি ছিল ‘যুক্তিবাদী’ মনীষী হিসেবে । এদের সম্পর্কে পাকিস্তানের বিখ্যাত নিউক্লিয়ার পদার্থ বিজ্ঞানী এবং কায়েদ-এ আযম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পারভেজ হডবয়ের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য’ : ইসলামের স্বর্ণযুগে বিজ্ঞান অগ্রগতি লাভ করেছিল কারণ- ইসলামের অভ্যন্তরে তখন ছিলেন মুতাজিলা নামধারী শক্তিশালী যুক্তিবাদী ঐতিহ্যের ধারক একদল চিন্তাবিদ। সবকিছুই পূর্ব-নির্ধারিত এবং আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ ব্যাতীত মানুষের অন্য কোন উপায় নেই।’ নিয়তিবাদীদের এ মতবাদের তীব্র বিরুদ্ধাচরণ করে মুতাজিলারা মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তিকে প্রাধান্য দিয়েছেন। মুতাজিলারা যখন রাজনৈতিক ক্ষমতায় ছিলেন, জ্ঞান তখন সমৃদ্ধি লাভ করেছিল। কিন্তু দ্বাদশ শতাব্দীতে গোড়া ইসলামী চিন্তাবিদ ইমাম আল-গাজ্জালির নেতৃত্বে ইসলামি রক্ষণশীলতার পুনরাবির্ভাব ঘটে। আল-গাজ্জালী যুক্তির স্থলে দৈববাণী এবং স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির স্থলে নিয়তিকে তুলে ধরেন। কার্য এবং কারণ (cause and effect) সম্পর্ককে তিনি অস্বীকার করেন এই বলে যে, মানুষের ভবিষ্যৎ জানার শক্তি নেই, কেবল সৃষ্টিকর্তা এ বিষয়ে অবগত। গণিতশাস্ত্রকে আল-গাজ্জালি ‘ইসলামবিরোধী’ এবং ‘মানব মনের জন্য ক্ষতিকারক’ বলে মন্তব্য করেন। গোঁড়ামির জালে ইসলামের সমৃদ্ধি আটকা পড়ে যায়। মহামতি খলিফা আল-মামুন এবং হারুন- আল-রশিদ এর শাসনামলে রাজদরবারে মুসলিম, খ্রিষ্টান এবং ইহুদী মনীষীদের একত্রে জড়ো হয়ে জ্ঞান-চর্চা এবং মত-বিনিময় করার যে প্রবণতা বহাল ছিল, তা পরবর্তীকালে চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। মুসলিম বিশ্বে সহিষ্ণুতা, মেধা এবং বিজ্ঞানের মৃত্যু ঘটে। যুক্তিবাদী ধারার সর্বশেষ মুসলিম মনীষী হচ্ছেন চতুৰ্দশ শতাব্দীর আবদাল রাহমান ইবনে খালদুন । ‘

ক্ল্যাসিক্যাল ইসলাম যুগের অনেক মুসলমান মনীষীর বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ কোরানের অনেক আয়াতকে ‘অযৌক্তিক’ এবং ‘অবৈজ্ঞানিক’ প্রমাণ করেছে । যেমন : কোরানের বর্ণনা অনুযায়ী, সূর্য অস্তমিত হয় একটি ‘পঙ্কিল জলাশয়ে’ বা muddy spring-এ (১৮:৮৬), তেমনি উদিত হয় একটি বিশেষ স্থান থেকে (১৮:৯০)। আমরা জানি, খালি চোখে সূর্য পূর্বাকাশে উদিত হয় এবং পশ্চিমাকাশে অস্ত যায় বলে মনে হলেও বিজ্ঞানের বিচারে তা আসলে সত্য নয় কেননা মহাশূন্যে অবস্থিত রয়েছে আমাদের সৌরজগতটি এবং সূর্য সেটির কেন্দ্র। পৃথিবীসহ অন্যান্য গ্ৰহ সূর্যকে কেন্দ্র করে যেমন অবিরত ঘুরছে, ঠিক তেমনি এরা নিজেদের কক্ষপথে হচ্ছে আবর্তিত অর্থাৎ ঘূর্ণায়মান লাটিমের বেলায় যেমনটি হয়। প্রায় ২৪ ঘণ্টায় পৃথিবী নিজস্ব কক্ষপথে একবার ঘুরে। এই কারণে সৌর জগতের কেন্দ্রে অবস্থিত সূর্যের সকল আলো একই সাথে এসে গোলাকার ও ঘূর্ণায়মান পৃথিবী গায়ে এসে পড়তে পারে না । যেখানে পড়ে, সেখানটায় হয় দিন; বাকি জায়গায় অন্ধকার অর্থাৎ রাত। কিন্তু কোরানে বর্ণিত গ্রহ-নক্ষত্র সম্পর্কিত বক্তব্যের সাথে বিজ্ঞানের এসব তথ্যের কোনো মিল নেই। এর একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক কারণ রয়েছে । গ্রীক ধারণার বশবর্তী হয়ে সে সময় প্রায় সকলে অজ্ঞতাবশত বিশ্বাস করতেন, পৃথিবীর আকার গোলাকৃতি নয়, বরং চ্যাপ্টা; এবং পৃথিবী হচ্ছে মহাবিশ্বের কেন্দ্ৰ (একে বলা হয় এরিস্টটলের ভূকেন্দ্রিক মহাবিশ্ব সম্পর্কিত মতবাদ বা Geocentric theory of universe)। তবে মুসলিম গণিতবিদ ও জ্যোতির্বিদ আল-বিরুনি সে সময়ও (মৃত্যু ১০৪৮ সাল) বিশ্বাস করতেন যে, ঘূর্ণনশীল পৃথিবীর আকৃতি হচ্ছে গোল এবং মোটেও চ্যাপ্টা নয়। তাই বিজ্ঞানী বলতে হলে আল-বিরুনিকে বলা উচিত, কোনো পয়গম্বরকে নয় ।

উপরের তথ্যগুলি দ্বারা এটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করা হয় যে, কোরান আসলে বিজ্ঞানের গ্রন্থ নয়, ধর্মীয় গ্রন্থই (কেউ কেউ আবার দাবি করেন এটি আসলে মানুষেরই তৈরি একটি গ্রন্থ)। তাদের যুক্তি, তা না হলে মহাজ্ঞানী আল্লাহ কী করে সক্রেটিসের ভ্রান্তমতবাদগুলি পবিত্র আল-কোরানের পাতায় নিয়ে আসলেন? কোরানে এরকম অবৈজ্ঞানিক এবং অসামঞ্জস্যে ভর্তি বর্ণনার আরও কিছু উদাহরণ রয়েছে। কোরানের একটি আয়াত (২:২৯) অনুযায়ী, আল্লাহ প্রথমে পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন । অতঃপর দিন-রাত এবং সবশেষে পৃথিবী। আরেক জায়গায় বেহেস্ত এবং পৃথিবী তৈরির মোট সময় সম্পর্কে বলতে গিয়ে আল্লাহ ভুল করে ফেলেছেন! যেমন: কোরানে কিছু কিছু আয়াত (৭:৫৪, ১০:৩, ২৫:২৯) অনুযায়ী আল্লাহ সর্বমোট ছয় দিনে বেহেস্ত ও পৃথিবী বানিয়েছেন; কিন্তু একই কোরানের ৪১:৯ আয়াত অনুযায়ী, আল্লাহ দুই দিনে পৃথিবী তৈরি করেছেন এবং সেখানে প্রয়োজনীয় পরিবেশ তৈরিতে সময় লেগেছে আরও চারদিন (আয়াত ৪১:১০)। সবশেষে বেহেস্ত ও পৃথিবী সৃষ্টিতে মোট ব্যায়িত সময় হচ্ছে (২+৪+২) সর্বমোট ৮ দিন । তাহলে বেহেস্ত ও পৃথিবী সৃষ্টিতে সর্বমোট ব্যয়িত সময়ের ক্ষেত্রে মহাসত্য গ্রন্থ আল কোরানের কোন বিবরণটি আসলে সত্য-ছয় (৬) দিন, নাকি আট (৮) দিন?

 

চার.

বেদ চার-পাঁচ হাজার বছর ধরে পৃথিবীতে আছে, কোরানের বয়সও দেড় হাজার বছরের কাছাকাছি; সেই তুলনায় আধুনিক বিজ্ঞানের বয়স মাত্র কয়েকশ বছর। অথচ দেখুন, বিদ্যুৎ, টেলিফোন, টেলিভিশন, রেল-কার উড়োজাহাজ, কম্পিউটার- সবই কিন্তু গত দু’তিনশ বছরেই আবিষ্কৃত হয়েছে। কেন আমাদের এতো ‘মহাজ্ঞানী’ পয়গম্বররা এগুলির একটিও আবিষ্কার করতে পারেনি? চিন্তা করে দেখুন, সামান্য একটা মোটরযান সে সময় থাকলে সংবাদবাহককে উটের পৃষ্ঠে চড়ে কষ্ট করে রোদ-বৃষ্টি পোহায়ে নবির সংবাদ নিয়ে এখানে- সেখানে যেতে হত না। রিমোর্ট কন্ট্রোলড ফাইটার প্লেন বা মিসাইল থাকলে ঘর থেকেই শত্রু নাশ করা যেত, অকারণে সাহাবিরা মারা যেতেন না; কেউ নিজের দন্তগুলিও খোয়াতেন না শত্রুর পাথরের আঘাতে! তথাপি, বিশেষ বাহনে চড়ে সাত আসমানের ওপরে বেহেস্ত- দোযখ দেখার কাহিনী শুনে আবেগে অনেকের চোখে জল চলে আসে, কিন্তু মস্তিষ্কে কোনো প্রশ্ন আসে না! কাজেই কার্যকারণ (cause and effect) নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানের সাথে কোরান- বেদ- বাইবেলকে না মেলানোই উত্তম ।

 

কোনটি বিজ্ঞান আর কোনটি ভুয়া বিজ্ঞান

এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও অনেক মুসলিম মনে করেন, আমাদের নবি সাধারণ রক্তমাংসের কোন মানুষ ছিলেন না, ছিলেন নূরের তৈরি (এই কারণে বাংলাদেশে একবার কেউ কেউ দাবি তুলেছিল, হাইস্কুলের বাংলা পাঠ্যপুস্তকে সাহিত্যিক মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী লিখিত ‘মানুষ মুহম্মদ’ প্রবন্ধটি নিষিদ্ধ করার জন্য; যদিও লেখাটি নবী মুহম্মদের সম্পূর্ণ পক্ষে ছিল), নবীর আঙুলের ইশারায় চাঁদ দু’টুকরো হয়ে গিয়েছিল। দেশে তো বটেই, এমনকি প্রবাসেও বাঙালি মুসলমানরা এরকম বয়ান শোনার জন্য অল্পশিক্ষিত মোল্লাদের হাজার হাজার পাউন্ড-ডলার খরচ করে দেশ থেকে ভাড়া করে নিয়ে আসেন। সম্প্রতি আমরা জেনেছি, কেবল সৌরজগতের একা (মিলিয়ন মিলিয়ন সৌরজগৎ নিয়ে তৈরি এক- একটি গ্যালাক্সি আর মহাবিশ্বে এরকম বহু বিলিয়ন বিলিয়ন গ্যালাক্সি রয়েছে। আমাদের সৌরজগত মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে অবস্থিত) রয়েছে কমপক্ষে ২১টি উপগ্রহ বা চাঁদ (সূত্র : ন্যাশনাল জিওগ্রাফি)। নিশ্চয় সে সময় এই ২১টি চাঁদের খবর জানা থাকলে, আজ হয়তোবা আমরা শুনতাম কোনো মহাপুরুষের আঙুলের ইশারায় ২১টি চাঁদ দু’টুকরো হয়ে গিয়েছিল । তখন নিশ্চয় কারো-কারো সারাজীবন চোখের জল ফেলতে হত ভাবাবেগের ঠেলায় ।

প্রশ্ন হচ্ছে, কোন বিষয়টি বিজ্ঞান আর কোন বিষয়টি বিজ্ঞান নয়- এ ব্যাপারটি একজন সাধারণ মানুষ বুঝবেন কি করে? বিষয়টি সুরাহার জন্য বিশ্বজনীন পবিজ্ঞান গবেষণার অনেকগুলি নীতিমালা (criteria) চালু আছে। এদের একটি, যাকে ইংরেজিতে replicability বলা হয়, বাংলা হচ্ছে— গবেষণার ফলাফলের অভিন্নতা। ব্যাপারটি হাইপোথেটিক্যালি একটু ব্যাখ্যা করা যাক। ধরুন, কেউ একজন দাবি করে বসলেন, তিনি ক্যান্সার বা এইডস নিরাময়ের একটি ওষুধ পেয়ে গেছেন এবং সেটি ১০০% কার্যকরী। এখন লোকটির সেই দাবি কি একজন বিজ্ঞানী মেনে নেবেন, নাকি স্রেফ পাগলামি বলে বাতিল করে দিবেন? এই ক্ষেত্রে একজন বিজ্ঞানী পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং গবেষণা ছাড়া কোন মন্তব্যই করার অধিকার রাখেন না। কিন্তু প্রশ্ন হল, পরীক্ষা করতে হলে তাকে কিভাবে এগুতে হবে? এই ক্ষেত্রে যিনি ওষুধটি আবিষ্কার করেছেন, তাকে প্রয়োজনীয় তথ্যের যোগান দিতে হবে। তবে গোপনে তা করলে হবে না। যেকোন স্ট্যান্ডার্ড সায়েন্স জার্নালে তিনি ওষুধটি আবিষ্কারের পদ্ধতি এবং কার্যকারিতা বিষয়ে যেসব রোগীদের ওপর গবেষণা চালিয়েছেন, সেসবের সংশ্লিষ্ট বিবরণ এবং উপাত্ত (statistical data) ছাপাবেন। এখন অন্য আরেকজন বিজ্ঞানী (পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তের) একই পদ্ধতি এবং পরিবেশে গবেষণা করে যদি ওষুধটির কার্যকারিতার বিষয়ে একইরকম বা প্রায় কাছাকাছি রকম সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেন, কেবল তখনই একজন বিজ্ঞানী বলতে পারেন ক্যান্সার বা এইডসের ওষুধটি আসলেই একটি নতুন আবিষ্কার এবং ১০০% কার্যকরী। এরই নাম replicability। কথিত ‘মিরাজ’ এর কাহিনী, বা যীশুর ‘পুনরুত্থান’ এর কাহিনী বিজ্ঞান দ্বারা সমর্থিত নয়, কারণ এটি কখনোই কোন বিজ্ঞানী কর্তৃক তাত্ত্বিক বা ব্যবহারিক— কোনভাবেই প্রদর্শন বা প্রমাণ করা সম্ভব নয়। একইরকম কথা বলা যায়— ‘স্বপ্নে পাওয়া গাছ দিয়ে চিকিৎসা’ জাতীয় পত্রিকার পাতায় প্রকাশিত পীর-তান্ত্রিক-বাবাদের প্রতারণামূলক বিজ্ঞাপন সম্পর্কে 1 নর্থ আমেরিকার বিখ্যাত ম্যাজিসিয়ান (যিনি ‘মুক্তমনা’র একজন লেখকও বটে) জেমস র‍্যান্ডির এ বিষয়ে একটি মজার চ্যালেঞ্জ আছে। যে কেউ বিজ্ঞানের নীতিমালা মেনে নিয়ে অলৌকিকত্ব বা সুপার ন্যাচারাল বিষয়ে প্রমাণ দিতে পারলে নগদ এক মিলিয়ন ডলার পুরস্কার পাবেন। আমাদের দেশের তথাকথিত ‘পীর’ এবং ‘আধ্যাত্মিক সাধক-সাধিকারা’ চাইলে র‍্যান্ডির সাথে যোগাযোগ করতে পারেন। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে প্রবীর ঘোষও অনুরূপ চ্যালেঞ্জ দিয়ে রেখেছেন বহুদিন থেকে। বাংলাদেশের জনপ্রিয় ম্যাজিশিয়ান জুয়েল আইচেরও এ ব্যাপারে একটি ঘোষণা আছে। ল্যাবরেটরিতে কেউ অতিপ্রাকৃতিক ব্যাপারে অস্তিত্ব প্রমাণ করতে পারলে তাকে লক্ষ টাকা (রিয়েল ফিগারটা এই মুহূর্তে আমার মনে পড়ছে না— লেখক) পুরস্কার দেয়া হবে। বাংলাদেশে হাজার-হাজার পীল-ফকির- তান্ত্রিকদের কেউই আজ অবধি জুয়েলের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছেন বলে আমার জানা নেই। অথচ প্রতিনিয়ত পত্রিকায় প্রতারণামূলক বিজ্ঞানের মাধ্যমে হতাশাগ্রস্ত ও কুসংস্কারে আচ্ছন্ন পাবলিকের কাছ থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। মূল প্রসঙ্গে ফিরে যাই ।

প্রশ্ন আসতে পারে, বিজ্ঞানীদের পর্যবেক্ষণ-পরীক্ষায় কি ভুল হতে পারে না? কিংবা বিজ্ঞানের কথাই কি সর্বদা ধ্রুব সত্য বলে মানতে হবে? উত্তরে বলব : বিজ্ঞানীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় অবশ্যই ভুল হতে পারে, অনেক সময় হয়ও; কিন্তু একজন বিজ্ঞানী বা তার তত্ত্বকে যদি অন্য আরেকজন বিজ্ঞানী বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি (পরীক্ষা-নিরীক্ষা-পর্যবেক্ষণ এবং গবেষণা) দ্বারা প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে ভুল প্রমাণ করতে পারেন, তাহলে প্রথম বিজ্ঞানীকে নতুন তথ্য উপাত্ত-ফলাফলের ভিত্তিতে তার থিওরি অবশ্যই পর্যালোচনা করতে হবে, তা তিনি প্রফেসর স্টিফেন হকিংনস বা ড. কদম আলী, যেই হোক না কেন । বিজ্ঞানের যে বৈশিষ্ট্যটি যুক্তিবাদী ও মানবতাবাদীদের বেশি আকৃষ্ট করে থাকে, তা হচ্ছে এই ব্যাপারটি। সে জন্যই বলেছি, বিজ্ঞানে ব্যক্তিগত মতামতের মূল্য নেই। ধর্মগ্রন্থের সাথে বিজ্ঞানের এটিই মূল তফাৎ। কোরান অপরিবর্তনীয়, অলংঘনীয়; বিজ্ঞান তা নয়, কেননা পরিবর্তনশীলতা হচ্ছে প্রকৃতির বৈশিষ্ট্য আর সতত পরিবর্তনশীল। সেই প্রকৃতির রহস্যের উন্মোচন হচ্ছে বিজ্ঞানের মহান লক্ষের একটি।

 

শেষ কথা

ধর্ম সম্পৰ্কীয় ভ্রান্ত বিশ্বাস এবং অতি-প্রাকৃতিক কাহিনী সম্পর্কে নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করলে অনেকে আমাকে প্রায়শই এই বলে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেন, ভাই যার যার বিশ্বাস তার কাছে। কেন খামোখা মানুষের বিশ্বাসে আঘাত করে তাদের কষ্ট দেন? বলতে ইচ্ছে হয়, মানুষকে অহেতুক কষ্ট দিয়ে যারা চিত্তে সুখ অনুভব করেন, তারা স্যাডিস্ট এবং আমি মোটেও তাদের একজন নই। তবে কেন আমি কোরান এবং বিজ্ঞান সম্পর্কে এতসব কথা লিখছি? এতে কি ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মনে আঘাত লাগতে পারে না? প্রশ্ন আসতেই পারে। আর তার জবাবও রয়েছে ।

মুসলমানরা সংখ্যায় পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-পঞ্চমাংশ। মোটেও চাট্টিখানি কথা নয়। এক বিলিয়নের মত মুসলমানদের ঘরে শিশু-কিশোরদের সংখ্যা কত হতে পারে? নিশ্চয়ই তা সংখ্যার মাপে বিশাল এবং গুরুত্বপূর্ণ । এখন এই কয়েক শত কোটি কিশোরেরা কি করে বিজ্ঞান শিক্ষায় শিক্ষিত হবে যদি তাদের মাতা-পিতা, গুরুজনদের সকলেই বিশ্বাস করেন যে, আল কোরানেই রয়েছে সকল বিজ্ঞান? তারা কি জবাব দেবেন (বা দিচ্ছেন) যদি তাদের স্কুল পড়ুয়া ছেলেমেয়েরা বিজ্ঞানের ক্লাশ শেষ করে এসেই জিজ্ঞাস করে : আচ্ছা, আব্বু-আম্মু, বিজ্ঞানের কার্য-কারণ (cause and effect) নীতির সাথে ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত আদম- হাওয়া-শয়তান, ফুঁক দিয়ে পৃথিবী সৃষ্টির ব্যাপারটি কি মেলে? কিংবা, ঝড়-বৃষ্টিতো প্রাকৃতিক কারণে ঘটে থাকে, এর সাথে ফেরেস্তা মিকাইলের কি সম্পর্ক? আমার খুব জানতে ইচ্ছা হয়, মুসলমান বাবা-মায়েরা এসব প্রশ্নের উত্তরে কি বলেন তাদের সন্তানদের। তারা কি বলেন, “বিজ্ঞানের ক্লাশে যা শিখেছো সব মিথ্যে আর ধর্মগ্রন্থের বর্ণনাই সত্যি?’ নাকি, ‘বিজ্ঞান এবং ধর্মগ্রন্থ দুটোই সত্যি?’ এই দুটো উত্তরই মিথ্যা। আমার বিশ্বাস, সকলে না হলেও মুসলমান মাতা-পিতার অন্তত কেউ কেউ সন্তানদের সামনে সত্য গোপন করাটাকে প্রশ্রয় দেন না এবং সরাসরি বলে দেন, ‘কার্য-কারণ নীতি’র উপর প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানের সাথে ধর্মগ্রন্থের কোন মিল নেই। মিল খোঁজার চেষ্টা করা বৃথা। এ দুটো সম্পূর্ণ আলাদা দুটি বিষয় ৷ যেসব মাতা-পিতা এই সত্যটি তাদের সন্তানদের কোন রাখ-ঢাক ছাড়াই বলার ক্ষমতা রাখেন, তারা কেবল নিজেদের সন্তানদের সত্য, সুন্দর এবং বিজ্ঞানধর্মী মানসিকতা বিকাশের পথটিই সুগম করেন না, তারা এ ক্ষেত্রে মানবতারও একটি উপকার করছেন। কেননা, আমরা সবাই জানি আগামীদিনের সুন্দর পৃথিবী বিনির্মাণের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কাজটি আমরা আজই শুরু করতে পারি, তা হচ্ছে— আমাদের নতুন প্রজন্মকে সত্য, সুন্দর এবং বিজ্ঞানের আলোয় আলোকিত করা।

 

তথ্য তালিকা

১. Islam and Science: Religious Orthodoxy and the Battle for Rationality by Pervez Hoodbhoy

২. Pervez Hoodbhoy, “Muslims and the West After September 11”, Washington Post (2002)

৩. www.randi.org

error: Content is protected !!