প্ৰদীপ দেব
১
রিলিজিয়ন (religion) আর প্রোপার্টি (property) উভয় অর্থেই আমরা ধর্ম শব্দটি ব্যবহার করি, যদিও শব্দ দুটি একই অর্থবোধক নয়। এই পার্থক্যটুকু বোঝানোর জন্য রিলিজিয়ন শব্দের প্রতিশব্দ হিসেবে প্রবন্ধে উপাসনা-ধর্ম শব্দটি ব্যবহার করা হচ্ছে।
২
প্রকৃতিতে মানুষ ছাড়া আরো লক্ষাধিক প্রজাতির প্রাণী আছে। কিন্তু শুধুমাত্র মানুষই উপাসনা-ধর্ম পালন করে। কারণ মানুষ তাদের নিজস্ব প্রয়োজনে উপাসনা-ধর্মের সৃষ্টি করেছে এবং তার সুফল কাজে লাগানোর জন্য নানারকম ফন্দি-ফিকির চালিয়ে যাচ্ছে। বলাবাহুল্য, সে কাজে মানুষ অনেকটাই সফল । মানুষ নিজেদের মতো করে সৃষ্টিকর্তার ধারণা তৈরি করে নিয়েছে বলেই মানুষের তৈরি সৃষ্টিকর্তার বেশিরভাগ আচরণই মানুষের মতো। তার রাগ আছে, অনুরাগ আছে, ঘৃণা আছে, লোভ আছে এমনকি সীমাবদ্ধতাও আছে। কারণ মানুষের তৈরি একেশ্বরবাদীদের ঈশ্বর- আরেকটি ঈশ্বর তৈরি করতে পারেন না। পশুপাখিদের মধ্যে ঈশ্বরের ধারণা থাকলে— তাদের ঈশ্বর তাদের মতই হতো। মানে ছাগলের ঈশ্বর হতো ছাগলের মত, গরুর ঈশ্বর গরুর মতই আচরণ করতো ।
মানুষ অন্যান্য প্রাণীর চেয়ে নিজেদের শ্রেষ্ঠ ভাবে বলেই নিজেদের ঈশ্বরকে অন্যান্য প্রাণী, উদ্ভিদ ও জড় বস্তুরও সৃষ্টিকর্তা বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে। এজন্য তারা নানারকম ধর্মগ্রন্থে নানারকম কাল্পনিক কাহিনী-উপকাহিনীর জন্ম দিয়েছে- যেখানে দেখানো হয়েছে— জীব ও জড়বস্তু নির্বিশেষে সকলে ঈশ্বরের ধারণা মেনে চলছে। কিন্তু মানুষ ছাড়া অন্য কোন প্রাণীর ভেতরে যে ঈশ্বর বিশ্বাস কাজ করে- তা প্রমাণ করার কোন উপায় নেই।
কিছু কিছু মানুষ ঈশ্বরে বিশ্বাস করে। মানুষের জীবনে ঈশ্বর-বিশ্বাস একটি প্রধান সংস্কার। এই সংস্কার ভালো কি মন্দ- সেটা ব্যক্তিনির্ভর। একেক জনের ক্ষেত্রে একেকভাবে কাজ করে এই বিশ্বাস। সে কারণেই ঈশ্বর-বিশ্বাস অবৈজ্ঞানিক। বিজ্ঞানের সাথে একে মেলানোর চেষ্টা করার কোন মানে হয় না। কারণ বিজ্ঞান মানুষের ব্যক্তিগত বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করে না। বিজ্ঞান অগ্রসর হয় নিজস্ব পদ্ধতিতে, নিয়ম কানুনের পথ ধরে ।
৩
বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে সাথে উপাসনা-ধর্মের প্রয়োজনীয়তা কমতে শুরু করেছে। উপাসনা-ধর্মকে পুঁজি করে আখের গোছানো এখন আর আগের মত সহজ নেই। একজন বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ এখন উপাসনা-ধর্মের অলৌকিক আষাঢ়ে গল্পে বিশ্বাস করে না । উপাসনা-ধর্মকে এখন বিজ্ঞানের আশ্রয় নিতে দেখা যাচ্ছে প্রায় সময়েই । উপাসনা-ধর্মে বিজ্ঞান আছে এটা প্রমাণ করতে পারলেই যেন প্রমাণ করা হয়ে যায় যে ধর্মই সকল বিজ্ঞানের উৎস।
ধর্মীয় মোল্লাদের অযৌক্তিক উপাসনা-ধর্ম ব্যাখ্যায় সাময়িক একটি উন্মাদনা সৃষ্টি করা গেলেও মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিত শক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না । বর্তমানে বিজ্ঞান জানা কেউ- বিজ্ঞানের অধ্যাপক বা বৈজ্ঞানিক গবেষক যদি উপাসনা-ধর্মের পক্ষে বলেন- মনে করা হচ্ছে তাতে খুব কাজ হয় । তাই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো মোটা অংকের পারিতোষিক দিয়ে বিজ্ঞান জানা লোক ভাড়া করছে উপাসনা-ধর্ম প্রচারের কাজে।
এক্ষেত্রে বাইবেল সমর্থনকারীরা অনেক দূর এগিয়ে গেছেন । তারা নতুন নতুন কৌশলে বাইবেলের সাথে আধুনিক বিজ্ঞানের সমন্বয় ঘটানোর লক্ষ্যে নানারকম জগাখিচুড়ি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে শুরু করেছেন। ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব যেহেতু সত্য বলে প্রমাণিত হচ্ছে— এবং যেহেতু তা সত্য হলে বাইবেলের জেনেসিস মিথ্যা হয়ে যায়— সেহেতু প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা চলছে বুদ্ধিদীপ্ত নকসা বা ইন্টিলিজেন্ট ডিজাইন নামক আপাত মধুর একটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের। বুদ্ধিদীপ্ত নকসা আসলে . বাইবেলের সৃষ্টিতত্ত্বকে টিকিয়ে রাখার একটি প্রাণান্তকর চেষ্টা যাতে বলা হচ্ছে, শুধুমাত্র প্রাকৃতিক নিয়মেই এক প্রজাতি থেকে অন্য প্রজাতিতে বিবর্তন সম্ভব নয়। বিবর্তন একটি জটিল বৃদ্ধিবৃত্তিক প্রক্রিয়া এবং এর পেছনে অবশ্যই রয়েছে অতি বুদ্ধিমান সত্তার অর্থাৎ ঈশ্বরের হাত । ঈশ্বরই বুদ্ধিবৃত্তিক নকশা তৈরি করে দেন আর সে নকশা অনুসারেই সব ঘটে। অর্থাৎ বলা হচ্ছে যতই তোমরা প্রমাণ কর না কেন যে, বিবর্তন স্বতঃস্ফূর্ত- আমরা কিন্তু মানছি না । এ সম্পর্কিত একটি চমৎকার লেখা সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে মুক্তমনায়। অভিজিৎ রায় ও বন্যা আহমেদ ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন: আমেরিকায় সৃষ্টিতত্ত্বের বিবর্তন প্রবন্ধে ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইনের মুখোশ উন্মোচন করেছেন সুনিপুনভাবে (১)। সুতরাং বাইবেলে বর্ণিত খ্রিস্টপূর্ব ৪০০৪ সালের ২৩ অক্টোবর সকাল ৯টায় ঈশ্বর নিজের হাতে পৃথিবী সৃষ্টি করে মানুষ সৃষ্টি করেছেন, এ জাতীয় কথার কোন বৈজ্ঞানিক সত্যতা পাওয়া যাচ্ছে না। বরং প্রকৃতিতে যে জীবাশ্ম পাওয়া যাচ্ছে তাতে বিবর্তন তত্ত্বের ভিত্তিই শক্ত হচ্ছে আরও ।
এসব মাথায় রেখেই বাইবেলসেবীরা এগোচ্ছে সামনের দিকে। এর মধ্যেই গড়ে উঠেছে নানারকম ক্রিশ্চিয়ান সায়েনস সেন্টার। ভ্যাটিকানের পোপরা রেখে ঢেকে হলেও স্বীকার করছেন যে মধ্যযুগে ধর্মের নামে বিজ্ঞানীদের ওপর অত্যাচার করা উচিত হয়নি। এবং সবচেয়ে বুদ্ধিমত্তার সাথে যে কাজটি বাইবেলসেবীরা করতে শুরু করেছে তা হলো বাইবেলের নতুন নতুন ব্যাখ্যা । কিছুদিন পরে সত্যিই দেখা যাবে বাইবেলের নতুন সংস্করণ পুরনো সংস্করণের চেয়ে আলাদা। সেখানে নতুন জেনেসিস লেখা হলেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না ।*
৪
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কিছু সুবিধা আছে। যেহেতু তাদের ধর্মের কোন একক প্রবক্তা নেই, ধর্মগ্রন্থের সংখ্যাও কম নয়- এবং যেহেতু তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের বেশিরভাগই আচার-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি-সংস্কার নির্ভর- এবং যেহেতু তাদের দেবতার সংখ্যা অসংখ্য (তেত্রিশ কোটি!) সেহেতু তারা যেকোন সময়েই তাদের ধর্মীয় ব্যাখ্যা বদলে নিতে পারে। জ্যোতিষীরা যেমন ঘটনা ঘটে যাবার পরে প্রচার করতে শুরু করে যে ঘটনা ঘটার আগেই তারা তা ঘটবে জানতেন- জ্ঞান অর্জিত হবার পরে তা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কেউ কেউ তাদের ধর্মীয় গ্রন্থে এই জ্ঞানের কথা খুঁজে পান । রাজীব গান্ধী নিহত হবার পরে অনেক জ্যোতিষী দাবি করেছিলেন যে, তারা তা আগেই জানতেন। পুরনো তারিখ দিয়ে নতুন সংবাদপত্র ছাপিয়ে প্রচার চালানো হয় জ্যোতিষীদের পক্ষে। ঠিক একইভাবে নতুন কোন বৈজ্ঞানিক তথ্য আবিষ্কৃত হবার সাথে সাথে তা ধর্মীয় গ্রন্থে খুঁজে পাবার কথা প্রচারিত হয় ।
হিন্দু জ্যোতিষীরা নবগ্রহ বলে যে নয়টি গ্রহের কথা বলেন- তা হলো রবি (সূর্য), সোম (চন্দ্র), মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র, শনি, রাহু ও কেতু । রাহু ও কেতু কী জিনিস তা আমি জানি না । হিন্দুধর্মে অনেক প্রবক্তার মতে রাহু আর কেতু হলো যথাক্রমে নেপচুন ও প্লুটো।(২) সে না হয় বোঝা গেলো। কিন্তু সোম আর রবি গ্রহের কী হবে? চাঁদ আর সূর্য দুটোই গ্রহ? এ সম্পর্কে কোন ব্যাখ্যা নেই। ইউরেনাস আর পৃথিবী কেন তাদের নবগ্রহে ঠাঁই পায়নি তাও জানা যায় না ৷ কিন্তু মজার ব্যাপার হলো আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত জ্যোতিষীরা আধুনিক উপায়েই প্রতারণা করেন। তারা কোন ধরনের বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব, তথ্য না জেনেই কোয়ান্টাম তত্ত্বের কথা বলেন, কসমিক রশ্মির কথা বলেন, বিভিন্ন ধরনের ক্রিয়া-বিক্রিয়ার কথা বলে মানুষকে বিভ্রান্ত করেন। তারা ইউরেনাস নেপচুন প্লুটোর নামও নেন, আর কম্পিউটারও ব্যবহার করেন গণনা কার্যে। প্লুটো যে এখন আর গ্রহ নয়— তা জানার পরে দেখা যাবে তার পক্ষেও অনেক যুক্তি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে তাদের ধর্মীয় গ্রন্থে ।
*কোরানসেবীরাও পিছিয়ে নেই। সম্প্রতি বিভিন্ন ইসলামিক স্যাটেলাইট চ্যানেলের মাধ্যমে এ ধরনের প্রোপাগাণ্ডা চালানো হচ্ছে জীববিজ্ঞান থেকে মহাজাগতিক বিজ্ঞানের সকল তত্ত্ব ও তথ্য কোরানেই নিহিত । বাংলাদেশের ইসলামসেবী বিজ্ঞানীরাও পিছিয়ে নেই- ড. শমসের আলী, ড. আজাহারুল ইসলাম প্রমুখরা জনগণকে ভ্রান্তপথে চালুর কাজে নিয়োজিত। – সম্পাদক মণ্ডলী
৫
কোরান একদম অপরিবর্তনীয়- এরকম একটি অবস্থান নিয়ে কিছুটা বেকায়দায় আছে ইসলাম ধর্ম-বিশ্বাসীরা। সপ্তম শতাব্দির জ্ঞানের ওপর নির্ভর করে লেখা কোরানের সব বাণী একবিংশ শতাব্দীতে এসেও একই রকমভাবে প্রযোজ্য হতে পারে না। তাই যখনই দেখা যাচ্ছে কোরানে যা লেখা আছে তা মিলছে না বাস্ত বতার সাথে, তখনই তাকে বাস্তবসম্মত করার লক্ষ্যে নতুন ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, কোরানে যা লেখা আছে তাকে আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করলে ভুল করা হবে। অথচ এই একই কথা বলার জন্য অনেককেই নিগৃহীত হতে হয়েছে অতীতে। দার্শনিক আল কিন্দি (৮০১-৮৭৩) বলতেন, রিজ্জনদের কাজ হচ্ছে তাদের পূর্বপুরুষেরা যা প্রকাশ করতে পারেননি তা নিজদের ভাষায় এবং সমসাময়িক প্রথামত সম্পূর্ণ করা। কেতাবে সাধারণ মানুষকে বোঝাবার জন্য যেসব কথা বলা হয়েছে তা যেখানে রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে তা আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করলে বড় ভুল হবে। জান্নাতের হুর ও অন্যান্য আকর্ষণীয় বস্তুকে আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করা ঠিক হবে না। কোরানে যখন বলা হয়, সূর্য, চন্দ্ৰ, নক্ষত্র, পর্বতমালা, বৃক্ষ, পশুপাখি আল্লাহকে সিজদা করে তখন সিজদার অর্থ ধরতে হবে মান্য করা, সত্যি সত্যি সর্বাঙ্গ প্রণিপাত করা নয়।’ এসব কথা আজকাল যারা কোরানে বিজ্ঞান খুঁজে বেড়ান- তারা খুবই বলেন। অথচ একথা বলার অপরাধে ষাট বছর বয়সী দার্শনিক আল কিন্দিকে সেদিন ৫০ দোররা মারা হয়, আর জনতা সোল্লাসে সেই শাস্তিদান উপভোগ করে।
৬
একথা সত্য যে সকল ধর্মগ্রন্থেই কিছু ভাল ভাল নৈতিক ও দার্শনিক কথাবার্তা আছে। কিন্তু সেগুলোকে একবারে বিজ্ঞান বানিয়ে ফেলার চেষ্টা করাটা আসলেই বোকামী। কারণ উপাসনা-ধর্ম বড়জোর কিছু ন্যায়নীতি ভালমন্দের কথা বলে- সৃষ্টিতত্ত্বের কথাও বলে যা বিজ্ঞান নয় মোটেও। কারণ বৈজ্ঞানিক সত্য হলো বস্তুনিষ্ঠ যা সবার জন্যই সত্য। কিন্তু ধর্মীয় সত্য হলো সাম্প্রদায়িক। ইসলামে কিছু কিছু জিনিস হারাম- যা হিন্দুধর্মে হালাল। আবার হিন্দুদের কিছু কিছু হারাম জিনিস— মুসলমানদের জন্য হালাল। বিজ্ঞানে এরকম কোন ব্যাপার থাকতে পারে না। উপাসনা-ধর্মে ঈশ্বরকে সর্বশক্তিমান বলা হয়ে থাকে। কিন্তু এই সর্বশক্তিমানেরও সাধ্য নেই প্রাকৃতিক ধর্মকে অস্বীকার করার। বৈজ্ঞানিক সত্যের কাছে উপাসনা-ধর্ম যেভাবে অপ্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে- তাতে সন্দেহ নেই যে, উপাসনা-ধর্ম বিজ্ঞানকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকতে চাইবে। সে কারণেই উপাসনা- ধর্মের পৃষ্ঠপোষকেরা ধর্মের কেতাবে বিজ্ঞান খুঁজে বেড়াচ্ছেন। কারণ তারা জেনে গেছেন যে উপাসনা-ধর্ম ছাড়া বিজ্ঞান টিকে থাকবে। কিন্তু বিজ্ঞান ছাড়া উপাসনা- ধর্মের টিকে থাকার কোন উপায় নেই।
তথ্য সূত্র
১. অভিজিৎ রায় ও বন্যা আহমেদ (ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন : আমেরিকায় সৃষ্টিতত্ত্বের বিবর্তন www.mukto-mona.com/articles/bonna/part 10-ID.pdf
২ . সংযোজিত টীকা দেখুন (সম্পাদক)
সংযুক্ত টীকাঃ রাহু-কেতু উপাখ্যান
বিষ্ণুপুরাণের মতে রাহু ছিলেন একজন দৈত্য বা দানব, তার পিতা ছিলেন বিপ্রাচিত্তির, আর মাতা ছিলেন সিংহিকা। সিংহিকা ছিলেন দিতির কন্যা। পুরাণের কাহিনী মতে, দেবতা-দানবের যৌথ সমুদ্র মন্থনে উত্থিত অমৃত যখন দৈত্যদের বঞ্চিত করে দেবতাদের মধ্যে বিতরণ করা হচ্ছিল, সে সময় রাহু দেবতার ছদ্মবেশে দেবতাদের সাথে মিশে গিয়েছিলেন। কিন্তু তার এই ছদ্মবেশ সূর্য ও চন্দ্রের চোখে ধরা পড়ে। রাহু যখন অমৃত পান করছিল এবং গলা পর্যন্ত পৌছানোর মুহূর্তে সূর্য ও চন্দ্র বিষ্ণুকে রাহুর এই ছদ্মবেশের কথা জানিয়ে দিলে বিষ্ণু তার সুদর্শন চক্র দিয়ে রাহুর মস্তক দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। কিন্তু যেহেতু স্বল্প পরিমাণ হলেও রাহু অমৃত পান করেছিল তাই তার খণ্ডিত মস্তক ও দেহ অমর রয়ে গেল । কর্তিত মস্তকটিকে বলা হয় ‘রাহু’ আর মস্তকহীন দেহকে বলা হয় কেতু । পুরাণ মতে তখন থেকে রাহু ও কেতু সৌর মণ্ডলের সদস্য হয়ে সূর্য ও চন্দ্রের সঙ্গী হয়ে সতত আকাশে বিচরণ করতে থাকে। এ কারণেই হিন্দু জ্যোতিষীদের আকাশ গণনায় গ্রহের সংখ্যা নয়টি— রবি (সূর্য), সোম (চন্দ্র), বুধ, মঙ্গল, শুক্র, বৃহস্পতি, শনি, রাহু আর কেতু । এরা সবাই পৃথিবীর চারদিকে বৃত্তাকার কক্ষে পরিভ্রমণরত । বিষ্ণুপুরাণ বলে যে সূর্য ও চন্দ্রের ওপর রাহুর তখন থেকেই ক্রোধ, সেজন্য গ্রহণ কালে রাহু চন্দ্রকে গ্রাস করলে চন্দ্র গ্রহণ হয়, আর সূর্যগ্রহণের সময় রাহু সূর্যকে গিলে ফেলে। কিন্তু যেহেতু রাহুর কোন দেহ নেই তাই রাহু চন্দ্র বা সূর্যকে হজম করতে পারে না, কর্তিত গলা দিয়ে বেরিয়ে যায়। ফলে গ্রহণ শেষ হয় ৷
মহাভারতেও এই উপাখ্যানের বর্ণনা রয়েছে। সেখানে এও বলা হয়েছে যে বিষ্ণু কর্তৃক রাহুর মস্তক ছিন্ন হলে “রাহুর পর্বত-শিরাকার প্রকাণ্ড মস্তক ছেদনমাত্রে গগণ মণ্ডলে আরোহণ করিয়া ভীষণ-নাদে গর্জন করিতে লাগিল। তাহার কবন্ধকলেবর সকাননা সন্দ্বীপা সপর্বতা বসুন্ধরাকে কম্পিত করিয়া ভূপৃষ্ঠে পতিত হইল। তদবধি চন্দ্র ও সূর্য্যের সহিত রাহুমুখের চিরশত্রুতা জন্মিল । এই নিমিত্তই অদ্যাপি এই রাহু মুখ তাহাদিগকে গ্রাস করিয়া থাকে।” এই হল চন্দ্র-সূর্য গ্রহণের পৌরাণিক ব্যাখ্যা ।
এতো গেল পুরাণের গল্প। কিন্তু প্রাচীন হিন্দু জ্যোতিষীরা রাহু ও কেতু বলে যে দুটি তথাকথিত গ্রহের(?) উল্লেখ করে থাকে তার বাস্তবে অস্তিত্ব কোথায়? সূর্য পৃথিবীর ওপর সমান্তরাল আলো ফেলার কারণে তার বিপরীতে একটি ছায়া-শঙ্কু (Shadow cone) সৃষ্টি করে। পৃথিবীর চারদিকে সূর্যের আপাত বার্ষিক গতির কারণে এই ছায়া শঙ্কুটিও রবিমার্গে ঘুরতে থাকে। রবিমার্গে সূর্যের গড় গতিবেগ প্রতি সেকেন্ডে ১৮.৫০ মাইল। পৃথিবী ও সূর্যের কেন্দ্র সব সময় রবিবৃত্ত তলে অবস্থান করে। পূর্ণিমার সন্ধিক্ষণে চন্দ্রপথের পথে রবিবৃত্তের সমকোণে ধৃত সমতলে ছায়া-শঙ্কুটি একটি ছায়াবৃত্ত সৃষ্টি করবে। এই ছায়াবৃত্তটি সেই মুহূর্তে ঐ অবস্থানে থাকা চন্দ্রের পৃষ্ঠে পতিত হলে চন্দ্র গ্রহণ হয়, তবে এ সন্ধিক্ষণে সূর্য-পৃথিবী ও চন্দ্র মোটামুটি একই সমতলে থাকে। হিসেব করে দেখানো যায় যে, পৃথিবীর ছায়া-শঙ্কটির দৈর্ঘ ৮৫৯,০০০ মাইল এবং ঐ স্থানে ছায়াবৃত্তটির ব্যাসার্ধ ২,৮৫৯ মাইল, অন্যদিকে চন্দ্রের ব্যাসার্ধ ১০৮২ মাইল। তাহলে দেখা যাচ্ছে ২৮৫৯ মাইল ব্যাসার্ধের একটি ছায়া গোলক পৃথিবীর চারদিকে গ্রহ সদৃশ ঘুরতে থাকে, আর একেই হিন্দু জ্যোতিষীরা নাম দিয়েছে রাহু গ্রহ। কেতুর রহস্যটি অনেকটাই ধোঁয়াশে। পুরাণে গ্রহণের ব্যাপারে কেতুর কোন ভূমিকার কথা বলা নেই। পুরাণের কল্পনায় রাহু চন্দ্র ও সূর্যকে পুর্ণিমায় ও অমাবস্যায় গ্রাস করলে যথাক্রমে চন্দ্রগ্রহণ ও সূর্যগ্রহণ হয়। বস্তুত অমাবস্যার সন্ধিক্ষণে চন্দ্রের ছায়াশঙ্কু পৃথিবী পৃষ্ঠে পতিত হলে ঐ অঞ্চলের অধিবাসীরা সূর্যকে দেখতে পায় না— এটিই হল সূর্যগ্রহণ। পৃথিবীর চারদিকে চন্দ্র ঘুরতে থাকলে ছায়া-শঙ্কুটিও পূর্বদিকে ঘুরতে থাকে মোটামুটি প্রতি ঘণ্টায় ২১০০ মাইল বেগে। যেহেতু বিষুব রেখায় পৃথিবীর ঘূর্ণন মোটামুটি প্রতি ঘণ্টায় ১০৪০ মাইল, তাই ছায়া শঙ্কুটির কার্যকর বেগও প্রতি ঘণ্টায় ১০৪০ মাইল। চন্দ্রের এই ছায়া বৃত্তটিকে হয়তো হিন্দু জ্যোতিষীরা কেতু নামে গ্রহের মর্যাদা দিয়েছিল। হিসেব করে দেখা গেছে চন্দ্রের ছায়া-শঙ্কুটির দৈর্ঘ্য ২৩২,৪৯৬ মাইল। আশ্চর্যের বিষয় হিন্দু জ্যোতিষ astrology চর্চায় রাহু ও কেতুর উল্লেখ থাকলেও, ভারতীয় জ্যোতির্বিদ্যায় astronomy কিন্তু এ দুটি গ্রহের কোন উল্লেখ নেই। বৈদিক আমলে ৫টি জ্যোতিষ্ককে গ্রহের মর্যাদা দেয়া হয়েছিল যথা রবি (সূর্য), সোম (চন্দ্র), মঙ্গল, বৃহস্পতি ও শুক্র। সিদ্ধান্ত আমলে আর্যভট্ট, বরাহমিহির প্রমুখ জ্যোতির্বিদরা আরও দুটি গ্রহের সন্ধান পেয়েছিলেন- বুধ ও শনি। দীর্ঘকাল ধরে ভারতীয় জ্যোতির্বিদ্যায় গ্রহের তালিকায় এই ৭টি জ্যোতিষ্কেরই নাম ছিল, রাহু বা কেতুর কোন উল্লেখ নেই ৷
(দ্রষ্টব্য, পৌরাণিক অভিধান, সুধীরচন্দ্র সরকার সংকলিত, ষষ্ঠ সংস্করণ মাঘ, ১৩৯৬, পৃষ্ঠা ১২৭ ও ৪৭৪; মহাভারত ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩২, কালীপ্রসন্ন সিংহ)।
– অজয় রায়
প্রথম অধ্যায়ঃ যুক্তিবাদ মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্কতা
♦ মন্দের যুক্তি ও ঈশ্বরের অস্তিত্ব
♦ বিজ্ঞান মনস্কতা ও বিজ্ঞানমনস্ক সমাজনির্মাণ
♦ ইন্টিলিজেন্ট ডিজাইন নিয়ে কূটকচাল
♦ ব্রুনোর আত্মত্যাগ ও যুক্তিবাদ
♦ ইহজাগতিকতা ও আরজ আলী মাতুব্বর- একজন যুক্তিবাদী দার্শনিক
♦ বাংলাদেশে চেতনা-মুক্তির লড়াই
♦ ইসলাম যেভাবে নিজের পথ থেকে সরে গেছে
♦ বিজ্ঞান, বিজ্ঞানমনস্কতা বনাম কোরানিক বিজ্ঞান
দ্বিতীয় অধ্যায়ঃ ধর্ম ও নৈতিকতা
♦ জীবিত ইসলামের মৃত গৌরবের কথা
♦ রামায়ণ কাহিনীর ঐতিহাসিকতা একটি একাডেমিক আলোচনা
♦ মানবতাভিত্তিক সংবিধান এবং অমানবিক বিধান
♦ ধর্মের উপযোগিতাঃ জনৈক বিবর্তনবাদীর দৃষ্টিতে
♦ ধর্মরাষ্ট্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও রাষ্ট্রধর্ম
♦ মানুষের জন্য ধর্ম, না ধর্মের জন্য মানুষ?
♦ বিজ্ঞান কি উপাসনা-ধর্মের প্রতিদ্বন্দ্বী
তৃতীয় অধ্যায়ঃ অন্যান্য প্রসঙ্গ
♦ হাইপেশিয়াঃ এক বিস্মৃতপ্ৰায় গণিতজ্ঞ নারীর বেদনাঘন উপাখ্যান
♦ শাশ্বত এথেন্সের নারী ও তার বিপর্যস্ত ধারাবাহিকতা
“স্বতন্ত্র ভাবনাঃ মুক্তচিন্তা ও বুদ্ধির মুক্তি” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ