মুর্খরা সব শোনো, মানুষ এনেছে গ্রন্থ, গ্রন্থ আনে নি মানুষ কোনো।
— কাজী নজরুল ইসলাম
মহাবৈজ্ঞানিক গ্রন্থে স্থির পৃথিবী
এই প্রবন্ধটির সূচনা হয়েছিল একটি নির্দোষ ই-মেইলের জবাব দিতে গিযে। বছর সাতেক আগে আমি (অভিজিৎ রায়) তখন সবে বাংলাদেশ থেকে পাড়ি জমিয়েছি বাইরের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিনা পয়সায় ইন্টারনেট ব্যবহারের আমেজ সামলাতে সময় লাগছে। কুযোর ব্যাঙ-কে কুয়ো থেকে তুলে সমুদ্রে ছেড়ে দিলে যেমন দশা হয় তেমনই দশা তখন আমার কম্পিউটার নামের চার কোনা বাক্সের মাঝে জ্ঞানের অবারিত দু্যার। আমি নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে পড়ে রইলাম সমুদ্র সিঞ্চনে। এমনই এক সময় সদ্য পরিচিত এক ভদ্রলোকের পাঠানো এক ই-মেইলে এক ওয়েবসাইটের ঠিকানা পেলাম। ঠিকানাটা আসলে একটা অনলাইন পত্রিকার। খুব যে। আগ্রহ নিয়ে গেলাম তা নয়। কিন্তু গিযে অবাকই হলাম। পড়লাম বেশকিছু লেখকের তথ্যবহুল উঁচুমানের লেখা। অজানা অচেনা পত্রিকায় এমন যুক্তিবাদী ইহজাগতিক লেখা? তাও আবার লিখছে কিছু সাহসী বাঙালি। সত্যিই অবাক করার মতো ব্যাপার।
অবশ্য পত্রিকাটিতে সকলেই যে ধর্মের শিকল থেকে মুক্ত হয়ে প্রগতিশীল লেখা লিখতেন বা লিখছেন, তাও নয়। পশ্চিমা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এক ভদ্রলোকের কথা খুব-ই মনে পড়ছে। উনি সবসময়ই একটি বিশেষ প্রাচীন ধর্মগ্রন্থের মধ্যে আধুনিক বিজ্ঞানের তত্ব খুঁজতেন। এই ফ্যাশনটা ইদানীংকালে বাংলাদেশি শিক্ষিত মুসলমানদের ভেতরে প্রকট আকারে চোখে পড়ছে। বিশেষত দুই বিজ্ঞানী মরিস বুকাইলি এবং কিথ মুরের ‘অবিস্মরণীয় অবদানের পর (ইদানীং সেই তালিকায় যুক্ত হয়েছে তুরস্কের হারুন ইয়াহিয়া নামের আরেক ছদ্ম-বিজ্ঞানী) আজ তারা ১৪০০ বছর আগের লেখা ধর্মগ্রন্থের মধ্যে ‘বিগব্যাং’ খুঁজে পান, মহাবিশ্বের প্রসারণ খুঁজে পান, মানব সৃষ্টির ক্রমবিকাশ খুঁজে পান, অণু পরমাণু, ছায়াপথ, নক্ষত্ররাজি, শ্বেত বামন, কৃষ্ণগহ্বর, ভ্রুণ তত্ব, আপেক্ষিক তত্ব, সুপার স্ট্রিং তত্ব, সবই অবলীলায় পেয়ে যান। তো সেই ভদ্রলোকও বুকাইলি-মুরের প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে কোরআন যে কত ‘সুপার সায়েন্টিফিক বই, তা প্রমাণের জন্যে পাতার পর পাতা লিথে যেতে থাকলেন। আমি অবশেষে তার একটি লেখার প্রতিবাদ করার সিদ্ধান্ত নেই। বলি, কী দরকার আছে এই হাজার বছর আগেকার কতকগুলো সুরার মধ্যে বিগব্যাং-এর তত্ত্ব অনুসন্ধান করার? বিগব্যাং সম্বন্ধে জানতে চাইলে অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের ওপর গাদা গাদা বই বাজারে আছে; দেখুন না ডিফারেন্সিয়াল ইকুযেশন সমাধানের জন্য তো আমাদের গণিতের বই-ই দেখতে হবে, কোরআন হাদিস চষে ফেললে কি এর সমাধান মিলবে? এ যেন বারুদে আগুন লাগলো। উনি এর পরদিন বিশাল মহাভারত আকারের মহাকাব্য লিখে বুঝিয়ে দিলেন ইসলাম এবং বিজ্ঞান বিষয়ে আমার জ্ঞান কত তুচ্ছ; কত নগণ্য, কত অজ্ঞ, কত আহাম্মক আমি। এদিক ওদিক-সেদিক থেকে দৃষ্টান্তের পর দৃষ্টান্ত হাজির করে ‘প্রমাণ করে বুঝিযে পর্যন্ত দিলেন-”দ্যাখ ব্যাটা কোরআনে আধুনিক বিজ্ঞানের সবকিছুই আছে, কোরআন কত বিজ্ঞানময় কিতাব!’
এরপর আমাকেও কি-বোর্ড তুলে নিতে হলো। কী করব, পিঠ যে তখন দেওয়ালে ঠেকে গেছে। বললাম, একটু চোখ-কান খুলে যদি ধর্মগ্রন্থগুলোর ইতিহাসের দিকে তাকানো যায়, তাহলে বোঝা না যাওয়ার তো কথা নয় যে, সেই গ্রন্থগুলো লেখা হয়েছে বহু বছর আগে যখন মানুষের বিজ্ঞানের ওপর দখল এবং জ্ঞান ছিল খুবই সীমিত। এটা আশা করা খুবই বোকামি যে সেই সময়কার লেখা একটা বইয়ের মধ্যে বিগব্যাং-এর কথা থাকবে, সুপার স্ট্রিং-এর কথা থাকবে, আইনস্টাইনের রিলেটিভিটির কথা থাকবে। আধুনিক বিজ্ঞান নয়, ওই সমস্ত বইগুলোতে ফুটে উঠেছে প্রাচীন সমাজ-ব্যবস্থার চালচিত্র, প্রকাশ পেয়েছে তৎকালীন সমাজের মানুষের ধ্যান ধারণা, বিশ্বাস, আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা; এর এক চুলও বাড়তি কিছু নয়। একটা উদাহরণ দিলেই ব্যাপারটা স্পষ্ট হবে। কোরআন যখন লিখিত হয়েছিল, তখনো গ্যালিলিও, ব্রুনো, কোপার্নিকাসের মতো মনীষীরা এই ধরাধামে আসেননি। তখনকার মানুষদের আসলে জানবার কথা নয় যে তাদের পরিচিত বাসভূমি পৃথিবী নামক এই গ্রহটি যে ‘সূর্য নামক নক্ষত্রের চারিদিকে ক্রমাগত পাক খেয়ে চলেছে। জন্মের পর থেকেই মানুষ। সাদা চোখে সূর্যকে পূর্ব দিক থেকে পশ্চিমে যেতে দেখেছে, আর রাত হলেই দেখেছে ‘চাঁদ’ কে এর পেছনে পদার্থবিজ্ঞানের কোনো নিয়ম তারা কল্পনা করতে পারে নি, ধরে নিয়েছিল, এগুলো বোধহয় ঈশ্বরের আইন। ঠিক সে কথাগুলোই কোরআন-হাদিস-বেদ-বাইবেলে লেখা আছে। যেমন, ধরা যাক সুরা লুকমান (৩১ : ২৯) এর কথা। এখানে বলা আছে-’আল্লাহই রাতকে দিনে এবং দিনকে রাতে পরিবর্তন করেন, তিনিই সূর্য এবং চন্দ্রকে নিয়মাধীন করেছেন; প্রত্যেকেই এক নির্দিষ্ট পথে আবর্তন করে। সূর্য আর চাঁদের এই ভ্রমণের কথা শুধু। সুরা লুকমানে নয়, রয়েছে সুরা ইয়াসিন (৩৬ : ৩৮), সুরা যুমার (৩৯ : ৫), সুরা রা’দ (১৩ : ২), সুরা। আম্বিয়া (২১ : ৩৩), সুরা বাকারা (২ : ২৫৮), সুরা কাফ (১৮ : ৮৬), সুরা ত্বোয়াহায় (২০ : ১৩০)। কিন্তু সারা কোরআন তন্নতন্ন করে খুঁজলেও পৃথিবীর ঘূর্ণনের সপক্ষে একটি আয়াতও মিলবে না। আল্লাহর দৃষ্টিতে পৃথিবী স্থির, নিশ্চল। সুরা নামলে (২৭ : ৬১) পরিষ্কার বলা আছে যে, দুনিয়াকে বসবাসের স্থান করেছেন আর তার মধ্যে নদীসমূহ সৃষ্টি করেছেন আর এটিকে (পৃথিবী) স্থির রাখবার জন্য পাহাড়-পবর্ত সৃজন করেছেন …’। একইভাবে সুরা রুম (৩০ : ২৫), ফাধির (৩৫ : ৪১), লুকমান (৩১ : ১০), বাকারা (২ : ২২), নাহল (১৬ : ১৫) পড়লেও সেই একই ধারণা পাওয়া যায় যে কোরআনের দৃষ্টিতে পৃথিবী আসলে স্থির।
আমি ভদ্রলোককে সবিনয়ে বলেছিলাম, তিনি যদি সত্যিই মনে করেন যে আধুনিক বিজ্ঞানের সকল তত্বই কোরআনে আছে, তাহলে শুধু একটি আয়াত যদি কোরআন থেকে দেখাতে পারেন যেখানে লেখা আছে ‘পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরছে, অথবা নিদেনপক্ষে ‘পৃথিবী ঘুরছে’ আমি তার সকল দাবি মেনে নেব। আরবিতে পৃথিবীকে বলে আরদ’ আর ঘূর্ণন হচ্ছে ‘ফালাক’। একটি মাত্র আয়াত আমি দেখতে চাই যেখানে ‘আরদ’ এবং ‘ফালাক’ পাশাপাশি ব্যবহৃত হয়েছে। উনি দেখাতে পারলেন না।
পারার কথাও নয়। কারণ কোরআনে এধরনের কোনো আয়াত নেই। এর কারণটা আমি আগেই বলেছিতখনকার যুগের মানুষেরা চিন্তা করে তো বের করতে পারে নি পৃথিবীর আহ্নিক আর বার্ষিক গতির কথা। টলেমির পৃথিবীকেন্দ্রিক মতবাদকে মাথা থেকে সরিয়ে কোপার্নিকাসের সূর্যকেন্দ্রিক মতবাদে মানুষের চিন্তা ভাবনার উত্তরণ ঘটেছে আসলে আরও অনেক বছর পরে। হযরত মুহাম্মদের যুগে মানুষেরা এমনকি ‘রাত্রিবেলা সূর্য কোথায় থাকে এই রহস্য ভেদ করতে গিযে ‘গলদঘর্ম হয়ে উঠেছিল। পৃথিবী সমতল এ জ্ঞান খাটিয়ে মানুষ তখন ধারণা করত একেবারে শেষ প্রান্তে গিয়ে ‘সূর্যদেব সত্যিই অস্ত যান!’ চিন্তাশীল পাঠকেরা জুলকারনাইনের কথা উল্লেখিত, কোরআনের সেই বিখ্যাত সুরাটিতে চোখ বোলালেই বিষয়টি বুঝতে পারবেন—
অবশেষে যখন সে সূর্যাস্তের দেশে পৌঁছল, সে সূর্যকে এক পঙ্কিল জলাশযে ডুবতে দেখল এবং সেখানে দেখতে পেল এক জাতি। আমি বললাম, হে জুলকারনাইন, হয় এদের শাস্তি দাও, না হয় এদের সাথে ভালো ব্যবহার করো। (১৪ : ৪৬)
যারা কোরআনের মধ্যে অনবরত বিগব্যাং এবং সুপার স্ট্রিং তত্ত্বের খোঁজ করেন, তারা কি একবারের জন্যও ভাবেন না আল্লাহ কেমন করে এত বড় ভুল করলেন! কীভাবে আল্লাহ ভাবলেন যে সূর্য সত্যিই কোথাও না কোথাও অস্ত যায়? কোরআন কি মহা বিজ্ঞানময়’ কিতাব নাকি ভ্রান্তিবিলাস? অনেক পাঠকই হয়ত জানেন না যে মহানবী মুহাম্মদকে শ্রেষ্ঠতম বিজ্ঞানী, চিন্তাবিদ ও দার্শনিক বলে অভিহিত করা হয়, তিনি রাতে সূর্য কোথায় থাকে এই রহস্যের কীরকম ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন : এক সাহাবার (আবু জর) সাথে মতবিনিময় কালে মহানবী বলেছিলেন যে, রাত্রিকালে সূর্য থাকে খোদার আরশের নিচে। সারা রাত ধরে সূর্য নাকি খোদার আরশের নিচে থেকে আল্লাহর ইবাদত বন্দেগি করে আর তারপর অনুমতি চায় ভোরবেলা উদযের (সহি বোখারী, হাদিস নং ৬/৬০/৩২৬-৩২৭, ৪/৫৪/৪২১)[২২৬] পৃথিবীর ঘূর্ণনের কারণে সূর্য যে আমাদের দৃষ্টির আড়াল হয় (একইভাবে বিপরীতে অবস্থানকারীদের দৃষ্টিগোচর হয়) সেটা ছিল সেসময়ের মানুষের অজানা। কিন্তু তাদের মনে প্রশ্ন ছিল, আর সবসময় ধর্ম যা করে ঠিক তেমনিভাবে অজানা এ প্রশ্নটির উত্তরে আল্লাহকে টেনে এনে সেখানেই সঠিক উত্তর খোঁজার যৌক্তিক পথ রুদ্ধ করে দিয়েছিলেন নবীজি!
যারা প্রাচীন ধর্মগ্রন্থগুলোকে বিজ্ঞানের মোড়কে পুরতে চান, তারা কি এই আয়াতগুলোর কথা জানেন না? অবশ্যই জানেন। জানার পর তারা একটি মনগড়া ব্যাখ্যা দিয়ে মনকে শান্ত করেন। অনেকে আবার সেগুলো ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষকে বিভ্রান্ত করেন। আর এখানেই আমাদের আপত্তি। কেবল কোরআনে নয়, অন্য সকল অলৌকিক গ্রন্থেও আমরা নিশ্চল এবং স্থির পৃথিবীর ধারণা পাই। বাইবেল বলে–
‘আর জগতও অটল, তা বিচলিত হবে না’ (ক্রনিকলস ১৬/৩০)
‘জগৎ ও সুস্থির, তা নড়াচড়া করবে না।’ (সাম ৯৩/১) ‘তিনি পৃথিবীকে অনড় এবং অচল করেছেন’ (সাম ৯৬/১০)
‘তিনি পৃথিবীকে এর ভিত্তিমূলের ওপর স্থাপন করেছেন, তা কখনও বিচলিত হবে না’ (সাম ১০৪/৫) ইত্যাদি।
একইভাবে বেদেও রয়েছে–
‘ধ্রুবা দৌবা পৃথিবী ধ্রুবাস : পর্বতা ইমো’ (ঋগ্বেদ দশম মণ্ডল, ১৭৩/৪)
অর্থাৎ, ‘আকাশ নিশ্চল, পৃথিবী নিশ্চল, এ সমস্ত পর্বতও নিশ্চল।
ঋগ্বেদের আরেকটি শ্লোকে রয়েছে–
‘সবিতা যৈন্ত্র : পৃথিবীমর-দগ্ধম্ভনে সবিতা দ্যামদৃং হত।’ (ঋগ্বেদ দশম মণ্ডল, ১৪৯/১)।
অর্থাৎ ‘সবিতা নানা যন্ত্রের দ্বারা পৃথিবীকে সুস্থির রেখেছেন তিনি বিনা খুঁটিতে আকাশকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করেছেন।
উপরের শ্লোকটি একটি বিশেষ কারণে আরও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। এটি থেকে বোঝা যায়, বৈদিক যুগে মানুষেরা পৃথিবীকে তো স্থির ভাবতেনই, আকাশকে ভাবতেন পৃথিবীর ছাদ। তারা ভাবতেন ঈশ্বরের অপার মহিমায় এই খুঁটি বিহীন ছাদ আমাদের মাথার ওপরে ঝুলে রয়েছে। কোরআনের সুরা লুকমানে (৩১ : ১০) বর্ণনা আছে এইভাবে–
‘তিনিই খুঁটি ছাড়া আকাশকে ছাদ স্বরূপ ধরে রেখেছেন কিন্তু আজ এই বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির যুগে আমরা জানি, আকাশ কখনোই পৃথিবীর ছাদ নয়। সত্যিকার অর্থে তো আকাশ বলেই কিছু নেই। আকাশ হচ্ছে আমাদের দৃষ্টির প্রান্তসীমা। পৃথিবীতে বায়ুমণ্ডল থাকার কারণে আমাদের চোখে আকাশকে নীল দেখায়। চাঁদে বায়ুমণ্ডল নেই, তাই চাঁদের আকাশ কালো। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে যে, ‘মহাবিজ্ঞানময়’ কিতাবগুলোতেও এধরনের কোনো বিজ্ঞানভিত্তিক সঠিক দৃষ্টিভঙ্গির সন্ধান পাওয়া যায় না। মানুষ কবে বড় হবে? ধর্মগ্রন্থগুলো থেকে মুখ সরিয়ে কবে সত্যি সত্যিই একদিন বুঝতে শিখবে ‘আকাশ’ শব্দটার মানে? সুনীলের কবিতার একটা গাছ তলায় দাঁডিযে’ কবিতার কয়েকটি লাইন এ প্রসঙ্গে খুবই অর্থবহ–
… এতগুলো শতাব্দী গড়িয়ে গেল, মানুষ তবু ছেলেমানুষ
রয়ে গেল
কিছুতেই বড় হতে চায় না
এখনও বুঝলো না ‘আকাশ’ শব্দটার মানে
চট্টগ্রাম বা বাঁকুড়া জেলার আকাশ নয়
মানুষ শব্দটাতে কোনো কাঁটাতারের বেড়া নেই
ঈশ্বর নামে কোনো বড় বাবু এই বিশ্ব সংসার চালাচ্ছেন না।
ধর্মগুলো সব রূপকথা
যারা এই রূপকথায় বিভোর হয়ে থাকে
তারা প্রতিবেশীর উঠোনের ধুলোমাখা শিশুটির কান্না শুনতে
পায় না
তারা গর্জন বিলাসী ..
সমতল পৃথিবী
আমার নিবন্ধটি সেই অনলাইন পত্রিকাটিসহ অন্যান্য জায়গায় প্রকাশের পর বেশ কিছু প্রতিক্রিয়া হয়। আমার এক ধার্মিক বান্ধবী ই-মেইলে জানায়, ‘হতে পারে কোরআনে কোথাও বলা নাই যে পৃথিবী ঘুরছে। কোরআনে তো কতকিছুই সোজাসুজি বলা নাই। যেমন, কোরআনে তো এ কথাও বলা নাই যে পৃথিবী গোলাকার। কিন্তু তার মানে তো এই নয় যে কোরআনের দৃষ্টিতে পৃথিবী সমতল।”
উত্তরে আমি জানালাম, কোরআনের দৃষ্টিতে পৃথিবী সত্যিই সমতল! নিম্নোক্ত এই সুরাগুলো তার প্রমাণ–
.. পৃথিবীকে বিস্তৃত করেছি (কার্পেটের মতো) এবং ওতে পর্বতমালা সৃষ্টি করেছি …’ (১৫ : ১৯)
‘যিনি তোমাদের জন্য পৃথিবীকে (সমতল) শয্যা করেছেন এবং ওতে তোমাদের জন্য চলার পথ দিয়েছেন … (২০ : ৫৩, যুখরুখ ৪৩ : ১০)
‘ আমি বিস্তৃত করেছি (কার্পেটের মতো) পৃথিবীকে এবং ওতে পর্বত মালা স্থাপন করেছি … (৫০ : ৭)
‘আমি ভূমিকে বিছিযেছি, আর তা কত সুন্দরভাবে বিছিযেছি …’ (৫২ : ৪৪)।
‘আল্লাহ তোমাদের জন্য ভূমিকে করেছেন বিস্তৃত … (৭১ : ১৯) ইত্যাদি।
উপরের আয়াতগুলো থেকে বোঝা যায়, পদার্থবিদরা যেভাবে আজ গোলাকার পৃথিবীর ধারণা পোষণ করেন, কোরআনের পৃথিবী তার সাথে মোটেও সংগতিপূর্ণ নয়। সমতলভাবে বিস্তৃত পৃথিবীর কথা বোঝানোর জন্য যত রকমের শব্দ ব্যবহার করা যেতে পারে তার প্রায় সবই। কোরআনে ব্যবহৃত হয়েছে। শব্দগুলো হচ্ছে ফিরাশা, মাদ্দা, মাদাদনা, মান্দা, মাদাদনাহা, ফারাশনা, আল-মাহিদুন, বিতা, মিহাদা, দাহাহা[২২৭], সুতিহাত এবং তাহাহা। একই ধরনের শব্দ বিভিন্ন পদে ব্যবহৃত হয়েছে। এগুলো সবই সমতল পৃথিবীর স্বরূপকেই তুলে ধরে[২২৮]। আমি এই প্রসঙ্গে পূর্বোক্ত সুরা কাহাফ (১৮ : ৮৬) এর প্রতি আবারও পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই যেখানে বলা আছে আল্লাহর এক বিশ্বস্ত বান্দা কাদামাটি পূর্ণ একটি নির্দিষ্ট স্থানে সূর্যকে ডুবতে দেখেছিলেন। একই সুরার ৯০ নং আযাতে একটি নির্দিষ্ট স্থান হতে সূর্যোদয়েরও বর্ণনা আছে। স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জাগে আল্লাহ কেন ভাবলেন যে সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের জন্য একটি নির্দিষ্ট স্থান দরকার? এর মধ্য থেকে একটি সত্যিই বেরিয়ে আসে, আর তা হলো কোরআনের গ্রন্থাকার পৃথিবীকে গোলাকার ভাবেন নি, ভেবেছেন সমতল।
নামাজ পড়ার নির্দিষ্ট সময়ের কথা মাথায় রাখলে পরিষ্কার বোঝা যায় প্রাচীনকালে মানুষের মতো আল্লাহও সমতল পৃথিবীর ধারণা থেকে একদমই বেরুতে পারেন। নি। আমাদের বাঙালি কৃষক-দার্শনিক আরজ আলী মাতুব্বর তার ‘সত্যের সন্ধান’ বইতে চমৎকারভাবে ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করেছেন। এই সুযোগে সেটা আবার একটু ঝালিয়ে নেওয়া যাক। ইসলামি শাস্ত্রে প্রত্যেকদিন পাঁচবার নামাজ পড়ার বিধান আছে। এই পাঁচবারের জন্য নির্দিষ্ট সময় বরাদ্দ আছে, আবার কোনো কোনো সময়ে নামাজ পড়া আবার নিষিদ্ধ। যেমন, সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত অথবা মধ্যাহ্নে নামাজ পড়ার কোনো নিয়ম নেই। কিন্তু পৃথিবীর আহ্নিক গতির ফলে আমরা জানি যেকোনো স্থির মুহূর্তে বিভিন্ন দ্রাঘিমার ওপর বিভিন্ন সময় দেখা দেয় এবং প্রতিমুহূর্তেই পৃথিবীর কোনো না কোনো স্থানে নির্দিষ্ট উপাসনা চলতে থাকে। এর মানে কী? যেমন ধরা যাক, বরিশালে যখন সূর্যোদয় হচ্ছে, তখনও কলকাতায় সূর্য ওঠে নি আর চট্টগ্রামে কিছুক্ষণ আগেই সূর্য উঠে গেছে। কাজেই বরিশালে যখন ইসলামের দৃষ্টিতে নামাজ পড়া হারাম, তখন কলকাতা বা চট্টগ্রামে তা হারাম নয়। তা হলে নির্দিষ্ট সময়ে উপাসনা নিষিদ্ধ করার কোনো মানে আছে? যুক্তিবাদী আরজ আলী ‘সত্যের সন্ধানে’ বইতে একটি মজার প্রশ্ন করেছেন। ধরা যাক, একজন লোক বেলা দেড়টায় জোহরের নামাজ পড়ে বিমানে চড়ে মক্কায় যাত্রা করলেন। সেখানে পৌঁছে তিনি দেখলেন যে ওখানে তখনও দুপুর হয় নি। ওখানে জোহরের ওয়াক্তের সময় হলে কি তার আরেকবার জোহরের নামাজ পড়তে হবে? আপাত নিরীহ এই প্রশ্নটির মধ্যেই কিন্তু উত্তরটি লুকিয়ে আছে আরজ আলী নিজেই এর উত্তর দিয়েছেন–
এক সময় পৃথিবীকে স্থির আর সমতল মনে করা হতো। তাই পৃথিবীর সকল দেশে বা সকল জায়গায় একই রকম সময় সূচিত হবে, বোধহয় এইরকম ধারণা থেকে ওই সমস্ত নিয়ম-কানুন প্রবর্তিত হয়েছিল। কিন্তু এখন প্রমাণিত হয়েছে যে, পৃথিবী গোল ও গতিশীল।
আসলে আধুনিক জীবনযাত্রার সাথে তাল মেলাতে পুরনো ধর্মীয় কানুন মানতে গিয়ে দেখা দিচ্ছে নানা জটিলতা। ভবিষ্যতে এই জটিলতা আরও বাড়বে। যেমন, কোনো নভোচারী অথবা কোনো বিমান চালক ১০৪১.৬৭ মাইল বেগে পশ্চিম দিকে বিমান চালালে সূর্যকে সবসময়ই তার কাছে গতিহীন বলে মনে হবে। অর্থাৎ বিমান আরোহীদের কাছে সকাল, দুপুর আর সন্ধ্যা বলে কিছু থাকবে না। সূর্য যেন স্থিরভাবে একস্থানে দাঁড়িয়ে থাকবে। এই অবস্থায় বিমান আরোহীদের নামাজ-রোজার উপায় কী? ভবিষ্যতে মেরু অঞ্চলের কাছাকাছি যদি বসতি গড়তে হয়, তবে দেখা দেবে আরও এক সমস্যা। সেখানে প্রায় ছয় মাস থাকে দিন আর ছয় মাস থাকে রাত। সেখানে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোজা রাখা আর দিনে পাঁচ বার নামাজ পড়া কি আদৌ সম্ভব? এটি বোঝা মোটেই কঠিন নয় যে, প্রাচীনকালে মানুষের সমতল পৃথিবী ব্যাপারে ভুল ধারণার কারণেই আজকের দিনে নিয়ম পালনে এই জটিল সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।
ইতিহাসের পাতায় এবার চোখ রাখা যাক। এগারো শতকের বিখ্যাত আরবীয় বিজ্ঞানী ইবন-আল হাইয়াম ধারণা করেছিলেন যে পৃথিবী সমতল নয়, বরং গোলাকার। তার সমস্ত কাজ সেসময় ধর্মবিরোধী বলে বাজেয়াপ্ত করা হয়, আর তার সমস্ত বইও পুড়িয়ে দেওয়া হয়[২২৯]। ১৯৯৩ সালে, সৌদি আরবের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা শেখ আবদেল আজিজ ইবন বাজ এই বলে একটি ফতোয়া জারি করেন–
এই পৃথিবী সমতল। যারা এই সত্যটা মানে না তারা সকলেই নাস্তিক, শাস্তিই তাদের কাম্য।
কার্ল স্যাগানের ‘The Demon-Haunted World’ বইয়ে এই বিখ্যাত ফতোয়ার উল্লেখ পাওয়া যাবে[২৩০]।
হিন্দু পুরাণগুলোর অবস্থাও তথৈবচ। নরসিংহ পুরাণের ১৬৯ পৃষ্ঠায় সমতল পৃথিবীর পরিষ্কার বর্ণনা আছে। তাই গুজরাটে বারোদায় ‘জাম্বুদ্ভিপা’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান এখনও বৈদিক সমতল পৃথিবীকে ‘বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণ করার প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
১৯৯৯ সালের ১৫ই সেপ্টেম্বর কেনসাস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক টিম মিলার দাবি করলেন যে, ‘বাইবেল অনুযায়ী, পৃথিবীর চারটি প্রান্ত আছে।’ এবং তিনি আরও দাবি করলেন যে, তিনি বিশ্বাস করেন পৃথিবী আসলে হয় চতুর্ভুজ আকৃতির অথবা আয়তাকার। আসলে কোরআন, বাইবেল আর বেদের মতো ধর্মগ্রন্থে লেখা ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে কিছু মানুষ এই একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও মনে করে পৃথিবী গোলাকার নয়, সমতল। তারা আন্তর্জাতিক সমতল পৃথিবী সমিতি (International Flat Earth Society[২৩১]) এবং ‘আন্তর্জাতিক চতুর্ভুজাকার পৃথিবী সমিতি (The International Square Earth Society[২৩২]) এধরনের হাস্যকর সমস্ত নামে বিভিন্ন সংগঠন গড়ে তুলেছে যাদের একমাত্র কাজ হচ্ছে পৃথিবীবাসীকে বোঝানো যে, বিজ্ঞান যাই বলুক না কেন, পৃথিবী কিন্তু সমতল!
ভুল করে ভুল করা
তথ্যগত ভুল কিংবা প্রাচীন চিন্তাধারার নিদর্শন রয়েছে কোরআন শরীফে ভ্রান্ত ‘সমতল এবং অনড়’ পৃথিবীর ধারণাই কেবল নয়, এখানে আছে অদৃশ্য ‘শয়তান জ্বীন’ এর উপস্থিতির উল্লেখ (৬ : ১০০, ৬ : ১১২, ৬ : ১২৮, ৬ : ১৩০, ৭ : ৩৮, ১১ : ১১৯, ১৫ : ২৭। ইত্যাদি), যাদের কাজ হচ্ছে একজনের ওপর আরেকজন দাঁড়িয়ে ‘Exalted Assembly’ তৈরি করা (৩৭ : ০৪) আর কানাকানি করে গোপন কথা শুনে ফেলা (৭২ : ৪, ৩৭ : ৬/১০)। আকাশে আমরা উল্কাপাত ঘটতে দেখি কারণ এই অদৃশ্য শয়তান এবং জ্বীনদের ভয় দেখানোর জন্যই আল্লাহ এমনটা ঘটান (৭২ : ৯, ৩১ : ১০)। কীভাবে জুলকারনাইন এক পঙ্কিল জলাশযে’ সূর্যকে ডুবতে দেখেছেন, তার উল্লেখ যে কোরআনে আছে, তা তো এ অধ্যায়ের আগেই বলেছি। এধরনের ভুল আরও আছে। যেমন, বলা আছে শুক্রাণু তৈরি হয় মেরুদণ্ড এবং পাঁজরের মধ্যবর্তী জায়গা থেকে (৫৬ : ৬-৭); মাতা মেরিকে বর্ণনা করা হয়েছে অ্যারনের (মুসার বড় ভাই) বোন হিসেবে (১৯ : ২৮)। এগুলো সঠিক নয়। আর হাদিসে বলা হয়েছে যে, যখন কোনো পুরুষের শুক্রাণু কোনো মহিলার জরায়ুতে প্রবেশ করে, তখন আল্লাহ কর্তৃক নিযুক্ত ফেরেশতারা তার দায়িত্ব নিয়ে নেয় (সহি বোখারী ১.৬.৩১৫, ৪.৫৪ . ৪৩০; সহি মুসলিম ৩৩.৬৩৯২ ইত্যাদি), মানুষের অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলো ইসলামি পাপ বয়ে নিয়ে যায়’ (সুনান নাসাই ১.১৪৯), এমনকি কোরআন-হাদিস অনুযায়ী মানব অঙ্গগুলো কথা পর্যন্ত বলতে পারে (কোরআন ৪১ : ২০, ৪১ : ২১, ৩৬ : ৬৫, ২৪ : ২৪)। তাও না হয়। মানা গেল, কিন্তু হাদিসে উটের মূত্রকে যে রোগনাশকারী মহৌষধ হিসেবে বর্ণনা করে তা নিয়মিতভাবে পান করার পরামর্শ যে দেওয়া হয়েছে, তা কি আমরা জানি? যেমন, সহি বোখারীর ভলিউম ৭, বই ৭১, হাদিস নং ৫৯০ দেখা যাক–
আনাস (রা.) হতে বর্ণিত : কিছু লোকের মদিনার আবহাওয়া প্রতিকূল মনে হচ্ছিল। রাসুল (সা.) তাদেরকে নির্দেশ দিলেন উটের রাখালের সাথে বাস করতে এবং উটের দুধ ও মূত্র থেতে (ঔষধ হিসেবে)। তারা রাখালের সাথে থাকতে লাগলো এবং উটের দুগ্ধ এবং মূত্র পান করতে লাগলো যতদিন পর্যন্ত তারা সুস্থ হয়ে ওঠে। এরপর তারা রাখালকে মেরে তার উট নিয়ে পালাতে লাগলো। খবর পেয়ে রাসুল (সা.) তাদেরকে ধরে আনতে বললেন। তাদেরকে রাসুলের সামনে উপস্থাপন করার পর তিনি তাদের হাত পা কেটে এবং চোখে লৌহ তপ্ত শলাকা ঢুকিয়ে হত্যা করার আদেশ দিলেন।
উটের দুধের পাশাপাশি মূত্র পানের উপকারিতার কথা বলা আছে আরও অনেক হাদিসেই, এবং ইবনে ইসহাকের সিরাতেও[২৩৩]।
কোরআনের কয়েকটি আয়াত থেকে পাওয়া যায়, এই মহাবিশ্ব তৈরি করতে আল্লাহ সময় নিয়েছেন ছয় দিন (৭ : ৫৪, ১০ : ৩, ১১ : ৭, ৫০ : ৩৮, ৫৭। : ৪ ইত্যাদি), কিন্তু ৪১ : ৯-১২ থেকে জানা যায়, তিনি পৃথিবী তৈরি করতে ২ দিন সময় নিয়েছিলেন, এরপর এর মধ্যে পাহাড়-পর্বত বসাতে আর অন্যান্য আনুষঙ্গিক ইমারত তৈরি করতে আরও চার দিন, সবশেষে সাত আসমান বানাতে সময় নিয়েছেন আরও দু-দিন। সব মিলিয়ে সময় লেগেছে মোট আট দিন। কাজেই কোরআন অনুযায়ী আল্লাহ মহাবিশ্ব বানিয়েছেন কয় দিনে-ছয় দিনে নাকি আট দিনে? সুরা ৭৯ : ২৭ ৩০ অনুযায়ী আল্লাহ বেহেশত’ বানিয়েছিলেন আগে, তারপর বানিয়েছিলেন পৃথিবী, কিন্তু অন্য কিছু আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, আগে পৃথিবী পরে বেহেশত (২ : ২৯ এবং ৪১ : ৯-১২ দ্র.)। কখনও বলা হয়েছে আল্লাহ সবকিছু ক্ষমা করে দেন (৪ : ১১০, ৩৯ : ১৫৩) কিন্তু আবার অন্যত্র বলা হয়েছে, তিনি সবকিছু ক্ষমা করেন না (৪ : ৪৮, ৪ : ১১৬, ৪: ১৩৭, ৪ : ১৬৮)। সুরা ৩ : ৮৫ এবং ৫ : ৭২ অনুযায়ী ইসলাম ধর্মে যারা নিজেদের সমর্পণ করে নি তারা। সবাই দোজখে যাবে তা সে খ্রিস্টান, ইহুদি, প্যাগান যেই হোক না কেন, কিন্তু আবার ২ : ৬২ এবং ৫ : ৬৯ অনুযায়ী, ইহুদি এবং খ্রিস্টানদের সবাই দোজখে যাবে না। কখনও বলা হয়েছে মুহাম্মদকে সাহায্যের জন্য প্রস্তুত আছেন এক হাজার জন ফেরেশতা (৮ : ৯-১০) কখনোবা বলেছেন এই সাহায্যকারী ফেরেশতাদের সংখ্যা আসলে তিন হাজার (৩ : ১২৪, ১২৬)। কথনও আল্লাহ বলেছেন তার একটি দিন পার্থিব এক হাজার বছরের সমান (২২ : ৪৭, ৩২ : ৫), কখনোবা বলেছেন, তার দিন পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান (৭০ : ৪)। মানব সৃষ্টি নিয়েও আছে পরস্পর-বিরোধী তথ্য। আল্লাহ কোরআনে কখনও বলেছেন তিনি মানুষ বানিয়েছেন পানি থেকে (২৫ : ৫৪, ২৪ : ৪৫), কখনোবা জমাট রক্ত বা ‘ক্লট’ থেকে (৯৬: ১-২), কখনোবা কাদামাটি থেকে (১৫ : ২৬, ৩২: ৭, ৩৮ : ৭১, ৫৫ : ১৪) আবার কখনোবা ‘ডাস্ট বা ধূলা থেকে (৩০ : ২০, ৩৫ : ১১) ইত্যাদি। একই সাথে এত ধরনের পরস্পরবিরোধী তথ্য ঠিক কোন ঐশী অর্থ প্রকাশ করে?
পৌরাণিক বিগব্যাং
আবারও ফিরে আসি বিজ্ঞানময় কিতাবের জগতে। ফিরে আসতেই হয় বারে বারে-বুকাইলি, হারুন ইয়াহিয়া আর মুরদের কল্যাণে। সোজা হয়ে প্রশ্নটার মুখোমুখি দাঁড়াতেই হয় অবশেষে-’সত্যিই কি কোরআন অলৌকিক, অতিপ্রাকৃত আর মহা-বিজ্ঞানময় এক নিখুঁত ঐশী কিতাব?’ বব ডিলানের বাংলা করে কবীর সুমন যেভাবে গেযেছে, সেভাবেই বলি-’প্রশ্নগুলো সহজ, আর উত্তরও তো জানা’। উত্তর হচ্ছে-মোটেই কোরআন অলৌকিক কোনো গ্রন্থ নয়। কোরআনে আসলে কোথাও বিগব্যাং-এর কথা নেই, রিলেটিভিটির কথা নেই, কৃষ্ণগহ্বরের কথা নেই, অণু-পরমাণুর কথাও নেই। বিগব্যাং আর রিলেটিভিটির নামে যা দেখা যায়, তা হলো আদিম সুরাগুলোর ‘আধুনিক এবং চতুর’ ব্যাখ্যা। নিচের উদাহরণটি দেখা যাক–
অবিশ্বাসীরা কি ভেবে দেখে না, আকাশ ও পৃথিবী একসাথে মিশে ছিল, পরে আমি উভয়কে পৃথক করে দিলাম (২১ : ৩০)
‘কিতাব-বিশেষজ্ঞ’-এর দল এই আয়াতটির মধ্যে বিগব্যাং-এর গন্ধ খুঁজে পান। কিন্তু আসলেই কি এর মধ্যে বিগব্যাং-এর কোনো আলামত আছে? একটু যৌক্তিক মন নিয়ে আলোচনা করা যাক। এই আয়াত এবং তার পরবর্তী আয়াতগুলোর দিকে তাকানো যাক
‘আকাশ ও পৃথিবী একসাথে মিশে ছিল, পরে আমি উভয়কে পৃথক করে দিলাম’ (২১ : ৩০)।
এবং আমি এ জন্য পৃথিবীতে পর্বতমালা স্থাপন করেছি, যেন তা সহ এটি না নড়ে’ (২১ : ৩১)।
‘এবং আকাশকে করেছি সুরক্ষিত ছাদ’ (২১ : ৩২)।
‘আল্লাহই উপ্ন দেশে স্তম্ভ ছাড়া আকাশমণ্ডলী স্থাপন করেছেন’ (১৩ : ২)।
এই আয়াতগুলো আমাদের আকাশ আর পৃথিবীর মধ্যকার সম্পর্ক বিষযে আসলে খুব প্রাচীন আর অস্পষ্ট একটি ধারণা দেয়। আল্লাহ আকাশকে ‘স্তম্ভ বিহীন’ ছাদ হিসেবে স্থাপন করার পর পৃথিবীতে পর্বতমালা স্থাপন করলেন যাতে কিনা আমাদের এ পৃথিবী না নড়ে, ঠিক যেমনটি আমরা পাতলা কোনো কাগজ বাতাসে উড়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য ওটাকে পেপার ওযেট দিয়ে চাপা দেই। আল্লাহ মানুষের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য কী করলেন? আকাশকে অদৃশ্য খুঁটির ওপর বসিয়ে দিলেন। এগুলো কী করে বিংশ শতাব্দীর জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলামত হয়? আর সবচেয়ে বড় কথা, ‘আকাশ ও পৃথিবী একসাথে মিশে ছিল, পরে আমি উভয়কে পৃথক করে দিলাম এই আয়াতটি যদি মহা-বিস্ফোরণের (বিগব্যাং) প্রমাণ হয়, তবে কোথায় এখানে বিস্ফোরণের উল্লেখ? ‘বিগব্যাং’ শব্দটি নিজেই এখানে তাৎপর্যবাহী। এই আয়াতের কোথায় রয়েছে সেই বিখ্যাত ব্যাঙ’ (বিস্ফোরণ)–এর ইঙ্গিত?
উপরন্ত, পদার্থবিজ্ঞানে ‘বিগব্যাং’ স্থান-কাল অদ্বিতীয়ত্বের (space-time singularity) সাথে জড়িত, পদার্থের সাথে নয়। বিগব্যাং-এর প্রক্রিয়া যখন শুরু হয়েছিল তখন পৃথিবীর অস্তিত্বই ছিল না, পৃথিবীর জন্ম হয়েছে বিগব্যাং-এর সাড়ে নয়শ কোটি বছর পরে উপরের আয়াতটি শুধু আকাশ ও পৃথিবী একসাথে মিশে থাকার (বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে যার কোনো অর্থই হয় না) কথাই বলছে আর পরে বলছে উভয়কে পৃথক করে’ (বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে আবারও যার কোনো অর্থ নেই) দেওয়ার কথা যা বৈজ্ঞানিক বক্তব্য হতে পারে না, বিগব্যাং তো অনেক পরের কথা।
কতগুলো অর্থহীন শব্দমালা ‘আকাশ ও পৃথিবী একসাথে মিশে ছিল, পরে আমি উভয়কে পৃথক করে দিলাম’ কখনোই বৈজ্ঞানিকভাবে বিগব্যাং’কে প্রকাশ করে না[২৩৪]। কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞান থেকে আমরা জানি, মহাবিস্ফোরণ-মুহূর্তে প্রকৃতির চারটি বল-শক্তিশালী নিউক্লিয় বল, দুর্বল নিউক্লিয় বল, তড়িৎ-চুম্বকীয় বল আর মাধ্যাকর্ষণ বল ‘একীভূত শক্তি’ (super force) হিসেবে প্রকৃতিতে বিদ্যমান ছিল। উপরের আয়াতটিতে কোথায় তার ইঙ্গিত? কীভাবে একজন ওই আয়াতটি থেকে হাবলের ধ্রুবক বের করতে পারবে? কীভাবে মাপতে পারবে ডপলারের বিচ্যুতি? উত্তর নেই।
জ্যোতিপদার্থবিজ্ঞানের সাম্প্রতিক গবেষণার দিকে খানিকটা চোখ বুলানো যাক। অ্যালেন গুথ এবং আঁদ্রে লিন্ডের সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে পাওয়া ফলাফল থেকে জানা গিয়েছে, আমাদের মহাবিশ্ব যদি কোয়ান্টাম ফ্লাকচুযেশনের মধ্য দিয়ে স্থান-কালের শূন্যতার ভিতর দিয়ে আবির্ভূত হয়ে থাকে, তবে এ পুরো প্রক্রিয়াটি কিন্তু একাধিকবার ঘটতে পারে, এবং হয়ত বাস্তবে ঘটেছেও। ব্যাপারটিকে বলে মাল্টিভার্স বা ‘অনন্ত মহাবিশ্বের ধারণা[২৩৫]। এ ধারণায় মনে করা হয়, কেওটিক ইনফ্লেশনের মাধ্যমে সম্প্রসারিত বুদ্বুদ (Expanding Bubbles) থেকে আমাদের মহাবিশ্বের মতোই অসংখ্য মহাবিশ্ব তৈরি হয়েছে, যেগুলো একটা অপরটা থেকে সংস্পর্শবিহীন অবস্থায় দূরে সরে গেছে। এধরনের অসংখ্য মহাবিশ্বের একটিতেই হয়ত আমরা অবস্থান করছি (পকেট মহাবিশ্ব) অন্যগুলোর অস্তিত্ব সম্বন্ধে একেবারেই জ্ঞাত না হয়ে।
আসলে কোরআনে কেন আকাশ ও পৃথিবী একসাথে মিশে থাকার কথা আছে তা সহজেই অনুমেয়। সেসময় প্যাগানসহ মধ্যপ্রাচ্যের অনেক গোত্রের উপকথা এবং লোককথাতেই আকাশ আর পৃথিবী মিশে থাকার আর হরেক রকমের দেব-দেবী দিয়ে পৃথক করার কথা বলা ছিল। যেমন মিশরের লোককথায় ‘গেব’ নামেরে এক দেবতা ছিলেন যিনি ছিলেন মৃত্তিকার দেবতা। এই গেবকে তার মা এবং বোন (আসমানের দেবী) থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার ফলেই আকাশ আর পৃথিবী একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। আবার সুমেরীয় উপকথা গিলগামেশের কাহিনীতেও আসমানের দেবী ‘অ্যান’কে মৃত্তিকার দেবতা ‘কী’ এর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার কথা বলা আছে। এ সমস্ত উপকথা থেকে প্যাগান রেফারেন্সগুলো বাদ দিলে যা থাকবে, তা কোরআনেরই কাহিনী।
কাজেই, বিজ্ঞানের চোখে বিগব্যাংই শেষ কথা নয়। বিজ্ঞানের সাম্প্রতিক গবেষণাগুলো বিগব্যাং-এর আগে কী ছিল তারও একটি সার্বিক উত্তর খুঁজতে সচেষ্ট হয়েছে। আসলে ইনফ্লেশন বা স্ফীতি নিয়ে আঁদ্রে লিন্ডে আর তার দলবলের সাম্প্রতিক গবেষণার ফলাফল যদি সত্যি হয়ে থাকে তবে সত্যিকার অর্থেই সেই উত্তপ্ত বিগব্যাং’ যার মধ্য দিয়ে এ মহাবিশ্ব তৈরি হয়েছে বলে ধারণা করা হয়, তাকে বিদায় জানানোর সময় এসে গিয়েছে। কারণ, সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, বিগব্যাং দিয়ে মহাবিশ্বের শুরু নয়, বরং মহাবিশ্বের শুরু হয়েছে ইনফ্লেশন দিয়ে। অর্থাৎ, বিগব্যাং-এর পরে ইনফ্লেশনের মাধ্যমে মহাবিশ্ব তৈরি (যা কিছুদিন আগেও সত্যি বলে ভাবা হতো) হয় নি, বরং ইনফ্লেশনের ফলেই কিন্তু বিগব্যাং হয়েছে, তারপর সৃষ্টি হয়েছে আমাদের মহাবিশ্ব। আঁদ্রে লিন্ডের কথায়[২৩৬]–
১৫ বছর আগেও আমরা ভাবতাম ইনফ্লেশন হচ্ছে বিগব্যাং-এর অংশ। এখন দেখা যাচ্ছে বিগব্যাং-ই বরং ইনফ্লেশনারি মডেলের অংশবিশেষ।
এখন কথা হচ্ছে, বিগব্যাং-এর মডেল কখনও ভুল প্রমাণিত হলে কিংবা পরিবর্তিত/পরিশোধিত হলে কী হবে? সাথে সাথে কি ধার্মিকেরাও বিগব্যাং-এর সাথে ‘সংগতিপূর্ণ আয়াতকে বদলে ফেলবেন? তাহলে তখন ‘আকাশ ও পৃথিবী একসাথে মিশে ছিল’-এই আপ্তবাক্যের কী হবে? এই ধরনের আশঙ্কা থেকেই কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন বিশ্বাসী পদার্থবিজ্ঞানী আব্দুস সালাম জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানের বিগব্যাং তত্বকে কোরআনের আয়াতের সাথে মেশাতে বারণ করতেন। তিনি বলতেন[২৩৭]–
বিগব্যাং তত্বের সাম্প্রতিক ভাষ্যটি বর্তমানে মহাবিশ্বের উৎপত্তির সর্বোৎকৃষ্ট ব্যাখ্যা প্রদান করছে। কিন্তু আগামীকাল যদি এর চাইতেও কোনো ভালো ব্যাখ্যা পাওয়া যায়, তাহলে কী হবে? তাহলে কি নতুন বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির সাথে তাল মেলাতে গিয়ে ধর্মগ্রন্থের আয়াত বদলে ফেলা হবে?
খুবই যৌক্তিক শঙ্কা। ঠিক একই কারণে ১৯৫১ সালে যখন Pope Pius XII বাইবেলের সৃষ্টিতত্বের সাথে বিগব্যাং বা মহাবিস্ফোরণ তত্ত্বের মিল খুঁজে পেলেন, তখন জ্যোর্তিবিজ্ঞানী এবং খ্রিস্টান ধর্মযাজক জর্জ হেনরি লেমিত্রি (যিনি ‘বিগব্যাং’ প্রতিভাসের একজন অন্যতম প্রবক্তা) পোপকে বিনয়ের সঙ্গে এধরনের যুক্তিকে ‘অভ্রান্ত হিসেবে প্রচার করা থেকে বিরত থাকতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই পরামর্শ মানছে কে?
মিরাকল নাইন্টিন
প্রার্থনা করে এমন ঠোঁটের চেয়ে একটি কর্মঠ হাত অনেক বেশি উত্তম। ধর্ম এবং বিজ্ঞান দুটি একেবারে দু মেরুর বস্তু হলেও মানুষ আজ একটি জিনিস বুঝতে পেরেছে, বিজ্ঞান আসলে কাজ করে, ফল দেয়। অন্যদিকে, পদে পদে ধর্মের অসাড়তা তারা অনুবাধন করতে পারলেও পরকালের লোভে পড়ে কেউই অবশ্য সেটাকে নিজের মনে জায়গা দিতে চান না। অস্তিত্ব টিকিযে রাখার লোভে ধর্ম আজ তাই নতুন এক খোলসে নিজেদের গা ঢাকা দেওয়ার চেষ্টা করছে। নিজেদের বিজ্ঞানময় প্রমাণ করে টিকিয়ে রাখতে চাচ্ছে বিজ্ঞানের যুগে। আর তা করতে গিয়ে সৃষ্টি করেছে মিথ্যা, চালাকির এক প্রশান্ত মহাসাগরের উপরে তেমন কিছু উদাহরণ নিয়ে আলোচনা হলো। এখন দৃষ্টিপাত করা যাক একেবারে ভিন্ন একটি ব্যাপারের দিকে।
কোরআনে কেবল বিজ্ঞানময় কথাবার্তা নয়, নিজের শ্রেষ্ঠত্বের নমুনা মানুষের কাছে তুলে ধরার জন্য স্রষ্টা তার লিখিত এ গ্রন্থে এক অলৌকিক ব্যাপার রেখে দিয়েছেন-তিনি কোরআনকে বেঁধে দিয়েছেন উনিশ সংখ্যা দ্বারা। অলৌকিক এ বিষয়টি অবশ্য মুসলিমদের অজানাই থেকে যেত যদি না এ শতকেই বিষয়টি প্রথমবারের মতো জনসমক্ষে তুলে না ধরতেন রাশাদ খলিফা নামের এক ভদ্রলোক[২৩৮]। এ আবিষ্কারের মাধ্যমে। রাশাদ খলিফা মুসলিম বিশ্বে হইচই ফেলে দেন। বিভিন্ন ভাষায় বিভিন্ন দেশে শ’থানের বেশি বই রচিত হয় বিষয়টি নিয়ে। বাংলাদেশে মেজর কাজী জাহান মিয়া লিখিত ‘আল-কোরআন দ্য চ্যালেঞ্জ’ নামক বইটির প্রথম চ্যালেঞ্জটি হচ্ছে এই ১৯ মিরাকল[২৩৯]। ড. খন্দকার আব্দুল মান্নান লিখিত কম্পিউটার ও আল কোরআন’ নামক বইটিতে স্থান পেয়েছে ১৯-এর চমৎকারিত্ব[২৪০]। আল কোরআন অ্যাকাডেমির প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক হাফেজ মুনির উদ্দীন আহমদ আরও এক ধাপ এগিয়ে। কোরআনের বাংলা অনুবাদ করার পর প্রথমেই তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে রাশাদ খলিফার উনিশের ম্যাজিকের কথা তুলে ধরেন[২৪১]। কী তবে সেই উনিশের ম্যাজিক?
সুরা আল-মুদাচ্ছিরের ৩০ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘ইহার ওপর আছে উনিশ। এর আগে পরে কী উল্লেখ আছে, কার ওপরে উনিশ আছে এমন সকল প্রশ্নকে পাশ কাটিযে খলিফা অপ্রাসঙ্গিকভাবে শুধু আয়াতটি তুলে এনে দাবি করেন, এর মাধ্যমে আল্লাহ কোরআনকে উনিশ দিয়ে বেধে রাখার কথা উল্লেখ করেছেন। দাবিকে যৌক্তিক প্রমাণের জন্য তিনি কিছু উদাহরণ হাজির করেন। যেমন : কোরআনের সুরা সংখ্যা ১১৪ যা ১৯ দিয়ে নিঃশেষে বিভাজ্য। কোরআনের আয়াত সংখ্যা ৬৩৪৬, যা ১৯ দিয়ে নিঃশেষে বিভাজ্য (১৯ x ৩৩৪ = ৬৩৪৬) এবং এ সংখ্যাটির অঙ্কগুলোর যোগফল ১৯ (৬ + ৩ + ৪ + ৬ = ১৯), কোরআনে ‘বিসমিল্লাহ ১১৪ বার এসেছে যা ১৯ দিয়ে নিঃশেষে বিভাজ্য হয়। এছাড়া ‘বিসমিল্লাহ’-তে ১৯টি বর্ণ রয়েছে, কোরআনের সর্বমোট বর্ণসংখ্যা ৩২৯১৫৬, যা ১৯ দিয়ে নিঃশেষে বিভাজ্য (১৯ x ১৭৩২৪ = ৩২৯১৫৬), কোরআনে ‘আল্লাহ’ শব্দটি ২৬৯৮ বার উল্লেখিত হয়েছে যা ১৯ দিয়ে নিঃশেষে বিভাজ্য (১৯ x ১৪২ = ২৬৯৪)।
এছাডা ‘আল্লাহ’ উল্লেখ আছে এমন আয়াতগুলোর আয়াত নম্বর যোগ করলে যোগফল হয় ১১৮১২৩, যা ১৯ দিয়ে। নিঃশেষে বিভাজ্য (১৯ x ৬২১৭ = ১১৮১২৩) ইত্যাদি ইত্যাদি। রাশাদ খলিফার প্রদানকৃত পুরো গাণিতিক হিসাবটি যেকোনো মানুষকে আকৃষ্ট করবে। যিনি ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী তিনি প্রমাণটি দেখে তৃপ্তির ঢেকুর তুলবেন জিনিসটা মাথায় রাখার চেষ্টা করবেন, ক্ষেত্র বিশেষে কোনো সংশয়বাদীর সাথে তর্কে লিপ্ত হলে তলোয়ার হিসেবে ব্যবহার করবেন। আর যিনি অবিশ্বাসী তিনিও সামান্য দ্বন্দ্বে পড়ে যাবেন।
অলৌকিক কোরআন নিয়ে আলোচনায় যাওয়ার আগে সামান্য একটু জল ঘোলা করা যাক! সেই পিথাগোরাসের আমল থেকে শুরু হওয়া সংখ্যা নিয়ে এধরনের ধাঁধাময় খেলার ইতিহাস অনেক প্রাচীন। Numerology তথা সংখ্যাতত্ব হিসেবে পরিচিত বিষয়টি আধুনিক বিজ্ঞান জন্মলগ্নেই গণিত থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে গিযেছে; যেমনটি জ্যোতিষশাস্ত্র আলাদা হয়েছে। জ্যোতির্বিজ্ঞান থেকে, আলকেমি আলাদা হয়েছে রসায়ন থেকে। বিজ্ঞানের কুসংস্কারাচ্ছন্ন অপব্যবহারকেই অপবিজ্ঞান আখ্যায়িত করা হয়। সংখ্যাতত্ব একটি অপরিপূর্ণ গণিত বা অপবিজ্ঞান সংখ্যাতত্ত্বের উদাহরণ অজস্র। সেই মধ্যযুগ থেকে সংখ্যাতত্বে মত্ত ইহুদিরা সেসময়ই তাদের ধর্মগ্রন্থ তোরাহ-র দ্বিতীয় গ্রন্থ এক্সোডাস থেকে স্রষ্টার রহস্যময় নাম বের করেছিল। এক্সোডাসের ১৪ : ১৯-২১, এই তিনটি আয়াতের মাধ্যমে তারা স্রষ্টার ৭২টি নাম উদ্ভাবন করেছে। এই প্রতিটি আয়াতে ৭২টি করে বর্ণ আছে। প্রথমে তারা প্রথম আয়াতটি ডান থেকে বামে লিখে তারপর দ্বিতীয় আয়াত বাম থেকে ডানে লিখেছে। সবশেষে তৃতীয় আয়াতটিকে আবার ডান থেকে বামে লেখার মাধ্যমে। সম্পূর্ণ কাজটিকে তারা ১৮টি কলাম এবং ১২ সারিতে ভাগ করা হয়েছে। ১৮ গুণ ১২ = ৭২ গুণ ও এই সুত্র ধরে তারা ১২টি সারিকে ৩ সারি ৩ সারি করে ভাগ করেছে। মোট চারটি ভাগ হয়েছে যার প্রতিটিতে ১৪ কলাম ও ৩ সারি। প্রতি ভাগের একটি কলাম দ্বারা স্রষ্টার একটি তিন অক্ষরের নাম পাওয়া গেছে। এভাবে মোট ১৮ গুণ ৪ = ৭২ টি তিন অক্ষরের নাম পাওয়া। গেছে। চার ভাগের প্রতিটিকে আবার আরেকটি বর্ণের সাথে মেলানোর মাধ্যমে স্রষ্টার চার অক্ষরের একটি নাম পাওয়া গেছে[২৪২]।
আজ অবধি সেই চার অক্ষরের নামটির ও তার সঠিক উচ্চারণ জানার চেষ্টা করছে তারা। আরও মজা পাওয়া যাবে যুক্তরাষ্ট্রে সংগঠিত নাইন ইলেভেনের বিমান হামলার ঘটনার সংখ্যাতত্ত্ব নিয়ে হামলার তারিখ ৯/১১ : ৯ + ১ + ১ = ১১; ১১ই সেপ্টেম্বর বছরের ২৫৪তম দিন : ২ + ৫ + ৪ = ১১; ১১ই সেপ্টেম্বর পর বছর শেষ হতে ১১১ দিন বাকি থাকে; ১১৯ হচ্ছে ইরাক/ইরানের রাষ্ট্রীয় কোড ১ + ১ + ৯ = ১১; ইংরেজি ‘Afghanistan’ শব্দটিতে ১১ অক্ষর রয়েছে; ইংরেজি ‘The Pentagon’ শব্দটিতে ১১ অক্ষর রয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি। Ernest Vincent Wright (১৮৭৩-১৯৩৯) নামের একজন মার্কিন লেখক Gadsby: Champion of Youth (Wetzel Publishing Co, ১৯৩৯) নামে পঞ্চাশ হাজার একশ দশ শব্দের এক উপন্যাস লিখেছিলেন। যেখানে তিনি ইংরেজি বর্ণ E আছে এমন একটি শব্দও ব্যবহার করেন নি। কোনো ধরনের ব্যাকরণগত ভুল, বাক্যের অসামঞ্জস্যতা, ভাব প্রকাশের দুর্বলতাবিহীন এ উপন্যাসে ব্যবহৃত হয়নি he, she, they, them, theirs, her, herself, myself, himself, yourself, love, hate-এর মতো শব্দ[২৪৩]!
আসলে একটু মাথা খাটালে পৃথিবীর প্রায় সকল বিষয় নিয়েই সংখ্যাতত্বের খেলা সম্ভব। সেটি গণিতবিদদের দ্বারা সমর্থিত না হলেও মানুষকে আনন্দ কিংবা ধাঁধায় ফেলার জন্য যথেষ্ট।
ধরুন, একটি সমুদ্র সৈকত। আপনি একটি নিক্তি নিলেন এবং সমুদ্র সৈকতের একটি একটি করে বালুর ওজন মাপা শুরু করলেন। যেসব বালুর ওজন হচ্ছে এক গ্রাম সেটিকে আপনি থলেতে ভরে রাখলেন। যেগুলো না সেগুলো ফেলে দিলেন। আরও ধরি, আপনার হাতে অফুরন্ত সময় রয়েছে এবং এই অফুরন্ত সময় আপনি শুধু বালুর ওজন মাপবেন এবং এক গ্রামের ওজনের বালু আলাদা করবেন। তাহলে দীর্ঘসময় পর আপনি বেশ বড় একটি বালুর স্যাম্পল জোগাড় করতে পারবেন। যাদের প্রত্যেকের ওজন এক গ্রাম করে। এখন যদি আপনি ঘোষণা দেন যে, এই সমুদ্র সৈকতটি একটি মিরাকল এবং এর প্রত্যেকটি বালু কণার ওজন এক গ্রাম তাহলে কী তা যুক্তিসংগত হবে? হবে না। কারণ গণিত আমাদের বলে, এই সৈকতে প্রতিটি বালুকণার ওজন এক গ্রাম-এই শর্ত আরোপ করার আগে আপনাকে শতকরা কতভাগ বালুর ওজন এক গ্রাম তা নির্ণয় করতে হবে। যদি শতকরা মান ৯০-৯৯% হয় তাহলে আমরা সেই শর্ত সঠিক বলে ধরে নিতে পারি।
শতকরা= [এক গ্রাম ওজন এমন বালুর সংখ্যা/পরীক্ষণীয় মোট বালুর সংখ্যা (যে বালু আপনি ফেলে দিয়েছেন। যে বালু আপনি রেখেছেন) ] x ১০০
আপনার পরীক্ষায় এক বস্তা বালুর বিপরীতে কমপক্ষে এক হাজার বস্তা বালু আপনি বাদ দিয়েছেন (কারণ তাদের ওজন এক গ্রাম নয়)। সুতরাং আপনার শতকরা মান হবে খুব কম। অর্থাৎ মিরাকলটি সত্যি নয়। মূল ব্যাপার হলো, যেকোনো বই থেকেই আপনি ‘বিশেষ কিছু অংশ/অপশন বাছাই করতে পারেন। তারপর যেই যেই অপশন আপনার মিরাকল প্রমাণে কাজে লাগবে তা রেখে (ধরুন সাত দ্বারা বিভাজ্য) বাকিগুলো ফেলে দিতে পারেন। কোরআনের ক্ষেত্রে যেমন, একটি শব্দের অষ্কর সংখ্যা, চ্যাপ্টারের সংখ্যা, নির্দিষ্ট একটি শব্দ সর্বমোট কতবার ব্যবহৃত হয়েছে সেই সংখ্যা ইত্যাদি-ইত্যাদি গ্রহণ করা হয়েছে। ঠিক তেমনিভাবে আপনি চাইলে অন্য একটি নির্দিষ্ট সংখ্যা, বিজোড় সুরার সংখ্যা, জোড় চ্যাপ্টারের সংখ্যা, বিজোড় চ্যাপ্টারে কতটি অক্ষর রয়েছে-জোড়টিতে কতটি রয়েছে ইত্যাদি নিতে পারেন। অর্থাৎ আপনি মাথা খাটিয়ে অসীমসংখ্যক অপশন/বিশেষ অংশ বাছাই করতে পারেন। ডক্টর খালিফা তাই করেছেন। অসংখ্য অপশন থেকে তিনি উনিশ দ্বারা বিভাজ্য প্রমাণ করা যায় এমন অপশনগুলো গ্রহণ করেছেন-বাকিগুলো ফেলে দিয়েছেন। কিন্তু কোরআনে যদি আসলেই উনিশের মিরাকল থেকে থাকে তাহলে তা সবকিছুতেই থাকবে-শুধু কয়েকটি জিনিসে নয়। যেমন, কোরআনের রুকু সংখ্যা ৫৪০টি, ৩০টি পারা, ৭টি মঞ্জিল রয়েছে, যেগুলো ১৯ দিয়ে নিঃশেষে বিভাজ্য হতে পারত। ২৩ বছর ধরে কোরআন নাজিল হয়েছে সুতরাং ২৩ সংখ্যাটি ১৯ দ্বারা বিভাজ্য হতে পারত, মুহাম্মদ ৪০ বছর বয়সে নবুয়ত লাভ করেন, সেটি ১৯ দ্বারা বিভাজ্য হতে পারত, কোরআনের প্রতিটি আয়াতের শব্দ ও বর্ণ সংখ্যা ১৯ দিয়ে বিভাজ্য হতে পারত। কিন্তু হয় নি[২৪৪]।
জল অনেক ঘোলা ইতোমধ্যেই হয়ে গেল। পাঠক হয়ত এখন মনে মনে ভাবছেন, তাতে কী হয়েছে, কতগুলোতেই তো গাণিতিক মিল রয়েছে, ব্যাপারটি অলৌকিক হওয়াই স্বাভাবিক। তবে জেনে রাখুন, লৌকিক বিষয়কে অলৌকিকে রূপান্তরিত করে দর্শকদের মোহাচ্ছন্ন করার জন্য আসলে আশ্রয় নিতে হয় মিথ্যা, প্রতারণার। খলিফাও সেই সূত্র লঙ্ঘন করেন নি। একটি বিষয় নিয়েই আলোচনা করা যাক।
ডক্টর রাশাদ খলিফা বলেন—
The key to Muhammad’s perpetual miracle is found in the very first verse of the Qur’an, ‘IN THE NAME OF GOD, MOST GRACIOUS, MOST MERCIFUL = BISM ALLaH, AL RaHMAN, AL-RAHIM…
মুহাম্মদের বলে যাওয়া-কোরআন যে একটি মিরাকল তার সন্ধান লাভ করা যায়, কোরআনের সর্ব প্রথম আয়াতেই–
IN THE NAME OF GOD, MOST GRACIOUS, MOST MERCIFUL = BISM ALLaH, AL-RaHMAN, AL-RAHIM…
এই প্রথম আয়াতের অক্ষর গণনা করে (ইংরেজিতে শুধু বড় হাতের অক্ষর) আমরা দেখতে পাই যে, এখানে উনিশটি অক্ষর রয়েছে। এবং এতে যে শব্দগুলো রয়েছে সেগুলো প্রত্যেকটি উনিশের গুণিতক। যেমন প্রথম অক্ষর, ISM উনিশ বার; দ্বিতীয় শব্দ, ALLaH ২৬৯৮ বার, যা ১৯-এর গুণিতক (১৯ বার ১৪২); তৃতীয় শব্দ, AL-RaHMaN আছে ৫৭ বার, (১৯ বার ৩); সর্বশেষ শব্দ, AL RaHIM আছে ১১৪ বার (১৯ বার ৬)।
ড. খালিফা দাবি করেছেন, কোরআনের এই অলৌকিকত্বে মানুষের কোনো হাত নেই। অথচ, ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ বাক্যে যে ১৯টি বর্ণ আছে, এই মৌলিক দাবিতেই মানুষের হাত আছে। আরবি বাক্যটিকে ইংরেজিতে প্রতিবর্ণীকরণ করার সময় আমরা যদি স্বরবর্ণ বাদ দেই, তাহলে বাক্যটি এরকম দাঁড়ায় : BSM ALLH ALRHMN ALRHIM, উল্লেখ্য, আরবিতে স্বরবর্ণগুলো লেখা হয় না, পড়ার সময় ধরে নেওয়া হয়। এই প্রতিবর্ণীকৃত বাক্যে বর্ণের সংখ্যা ১৯। কিন্তু, আরবিতে ‘তাশদিদ’ বলে একটি প্রতীক আছে, কোনো বর্ণের ওপর সে প্রতীক থাকলে তা দুই বার উচ্চারণ করতে হয়। ALLAH শব্দের দ্বিতীয় L-এর ওপর একটি তাশদিদ আছে। সেক্ষেত্রে এই লাম দুই বার উচ্চারণ করে এভাবে লেখা যেত (বা এভাবে লেখা উচিত) : ALLLAH; আর বর্ণ সংখ্যা হয়ে যেত ২০টি।
তাশদিদ যুক্ত বর্ণ দুই বার ধরা হয়েছে নাকি এক বার ধরা হয়েছে, সে বিষয়টি ড. খালিফা কোথাও স্পষ্ট করে বলেন নি। এছাড়া যে স্বরবর্ণগুলো লেখা হয় না, কিন্তু পড়ার সময় ধরা হয় সেগুলো অন্তর্ভুক্ত করা বা। বাদ দেওয়ার ব্যাপারটাও তিনি স্পষ্ট করেন নি।
পরবর্তী সমস্যা BISM শব্দ নিয়ে। এটি প্রকৃতপক্ষে দুটি শব্দের সমন্বয় : Bi (এক্ষেত্রে এই শব্দের অর্থ ‘মধ্যে) এবং ISM (অর্থ ‘নাম)।
ড. খালিফা সবসময় আরবি বর্ণক্রম ব্যবহারের কথা বলেছেন। এই আরবি বর্ণক্রম ব্যবহার করে ISM শব্দটির অনুসন্ধান করা যেতে পারে। আবদুল বাকি কর্তৃক প্রস্তুতকৃত কোরআনের একটি নির্ঘণ্ট ঘেঁটে এই আশ্চর্যজনক তথ্য পাওয়া গেছে।
BiSM শব্দটি কোরআনের প্রথম আয়াতেই আছে। এই শব্দটি কোরআনের মাত্র তিনটি স্থানে উল্লেখিত হয়েছে : ১ : ১১, ১১ : ৪১ এবং ২৭ : ৩০] কিন্তু বিচ্ছিন্নভাবে কেবল ISM শব্দটি কোরআনে মোট ১৯ বার উল্লেখিত হয়েছে।
কিন্তু তৃতীয় আরেকটি তালিকা আছে। ISMuHu শব্দের অর্থ ‘তার নাম। এটি আরবিতে একটি অখণ্ড শব্দ হিসেবে লেখা হয়। কোরআনে এটি ৫ বার এসেছে।
সবগুলো ফল যোগ করলে পাওয়া যায় : ৩ + ১৯ + ৫ = ২৭, স্পষ্টতই এখানে ১৯ এর সাংখ্যিক তাৎপর্য আর থাকছে না।
আমাদের সামনে আরও অনেকগুলো অনুমানের ব্যাপার আছে, যেগুলো সম্বন্ধে ড. খালিফা কোনো ব্যাখ্যা দেন নি। কোন বিবেচনায় তিনি তিনবার উল্লেখিত BiSM শব্দটি গণনা থেকে বাদ দিয়েছেন? যে শব্দ নিয়ে গবেষণা করছিলেন সেই শব্দটিই বাদ দেওয়ার পিছনে কোনো যুক্তিই দেখান নি। আর কেবল বিচ্ছিন্ন ISM শব্দ গণনার ব্যাপারেই বা তিনি কোন নীতি অনুসরণ করেছেন? সর্বনামযুক্ত বিশেষ্য ISMuHu-কে কেন বাদ দিলেন?
তাহলে কি এই তিন ধরনের শব্দের অর্থের মধ্যে কোনো ব্যাখ্যা লুকিয়ে আছে? হয়তবা, যেসব স্থানে এই শব্দগুলোর মাধ্যমে কেবল আল্লাহর নাম বোঝানো হয়েছে সেগুলোকেই ড. খালিফা গণনা করেছেন। কিন্তু নিম্নোক্ত দুটি আয়াতের দিকে লক্ষ্য করলে এই ধারণাও ভুল বলে প্রমাণিত হয়। সুরা মায়িদার ৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে–
…but pronounce God’s name (ISM ALLaH) over it…
এবং সুরা বাকারার ১১৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে–
And who is more unjust than he who forbids in places for the worship of God, that His name (ISMuHu) should be pronounced?
মূল আরবি বা ইংরেজি অনুবাদ কোনোটিতেই এই শব্দগুলোর মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই, একটি ছাড়া : এখানে ‘God’s name সরাসরি বিধেয় এবং His name উদ্দেশ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। আরবি বর্ণক্রমে এই শব্দ দুটির লেখ্য রূপের ভিত্তিতেই কেবল দুটিকে ভিন্নস্থানে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।
আরও কথা আছে, কিসের ভিত্তিতেই বা ড. খালিফা এই শব্দগুলোর বহুবচন রূপগুলো বাদ দিলেন? এগুলোর বহুবচন কোরআনে আরও ১২ বার এসেছে। বিশেষত সুরা আ’রাফের ১৪০ নম্বর আয়াতের কথা উল্লেখ করা MT, ‘The most beautiful names belong to God…’
বহুবচন বাদ দেওয়ার কেবল একটি কারণই থাকতে পারে। সেটি হচ্ছে, বহুবচনগুলো গণনা করলে মোট সংখ্যাটি ১৯ না হয়ে ৩৯ হয়ে যায়।
উপর ALLAH শব্দটির ব্যবহারের ধরনের ব্যাপারেও সন্দেহ আছে। এই শব্দের সাথে যখন Li উপসর্গ যুক্ত হয় তখন দুইয়ে মিলে LiLaH বা LiLLah শব্দের জন্ম দেয়। এখানে উপসর্গটির অর্থ প্রতি। এই লিল্লাহ শব্দেও একটি লাম-এর উপর তাশদিদ আছে। (উদাহরণ হিসেবে ২ : ২২ আয়াতটি দেখা যেতে পারে) ব্যাকরণ অনুসারে এই প্র উপসর্গযুক্ত শব্দটি ঠিক BiSM-এর মতো করেই ব্যবহৃত হয়। পূর্বের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা বলতে পারি ড. খালিফা এবার প্র উপসর্গযুক্ত শব্দগুলো বাদ দিয়ে কেবল মূল শব্দটিই গণনা করবেন। কিন্তু তিনি তা করেন নি। এবার ঠিকই LiLaH গুলো গণনা করেছেন, কারণ এগুলো গণনা না করলে মোট সংখ্যাটা ২৬৯৮ হতো না এবং তা ১৯ দিয়েও বিভাজ্য হতো না। এধরনের যাদৃচ্ছিক ব্যবহারের পেছনে কি আদৌ কোনো যুক্তি আছে?
ISM এর সাথে Bi যুক্ত হয়ে যখন BiSM হয়েছে তখন ড. খালিফা সেটা বাদ দিয়েছেন, কিন্তু ALLAH-র সাথে Li যুক্ত হয়ে যখন LiLaH হয়েছে তখন তিনি সেগুলো ঠিকই গণনা করেছেন; এ কেবল ১৯ দিয়ে বিভাজ্য একটি সংখ্যায় পৌঁছানোর জন্য।
AL-RaHMaN শব্দের ক্ষেত্রে কোনো দ্বিধা নেই। এটি কোরআনে ৫৭ (১৯ বার ৩) বারই উল্লেখিত হয়েছে। লেখকও এমনটিই বলেছেন।
এবার AL-RaHIM শব্দের দিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক। ড. খালিফা বলেছেন, এই শব্দ মোট ১১৪ (৬ বার ১৯) বার এসেছে। কিন্তু আবদুল-বাকির নির্ঘণ্ট অনুসারে কোরআনে এই শব্দটি হুবহু এই রূপে মাত্র ৩৪ বার উল্লেখিত হয়েছে। অর্থাৎ এই ৩৪ স্থানেই শব্দের আগে AL নামক ডেফিনিট আর্টিক্যালটি আছে। কিন্তু বাকি ৮১ স্থানে শব্দের আগে কোনো ডেফিনিট আর্টিক্যাল নেই। এখন আর্টিক্যালসহ এবং ছাড়া সবগুলোই যদি আমরা গণনা করি, তাহলে মোট সংখ্যাটি দাঁড়ায় ১১৫] এক বার এর বহুবচনও উল্লেখিত হয়েছে। তাহলে মোট ১১৬ হয়ে যাচ্ছে১১৫ এবং ১১৬, কোনোটিই ১৯ দ্বারা বিভাজ্য নয়।
ড. খালিফার এই আবিষ্কারকে অনেকেই সম্পূর্ণ অনুমোদন দিয়েছেন। ড. Bechir Torki এ নিয়ে রীতিমতো ৪ পৃষ্ঠার এক বিশাল সারাংশ রচনা করেছেন। এইসবগুলো অনুমোদনপত্র বা সারাংশতেও উপরে উল্লেখিত চারটি মৌলিক অনুমিতির ব্যাপার সম্পূর্ণ এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।
ড. খালিফা ALLAH শব্দে তাশদিদের কারণে দ্বিত্ব হয়ে যাওয়া লামগুলো গণনা থেকে বাদ দিয়েছেন, আবার অলিখিত স্বরবর্ণগুলোও বাদ দিয়েছেন।
তিনি ISM এর মোট সংখ্যা গণনা করতে গিযে BiSM শব্দটি সম্পূর্ণ এড়িয়ে গেছেন, কিন্তু ওদিকে আবার ALLaH শব্দ গণনা করতে গিযে LiLaH অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
এছাড়াও তিনি তার গণনা থেকে ISMuHu বাদ দিয়েছেন, যদিও ব্যাকরণগত দিক দিয়ে এটি হুবহু ISM এর মতোই অর্থ বহন করে।
এছাড়া তিনি ISM এবং AL-RaHIM শব্দের বহুবচন রূপগুলো বাদ দিয়েছেন। উপরন্তু তার AL-RaHIM শব্দের গণনা ভুল হয়েছে।
সুতরাং মিরাকল প্রমাণের জন্য খলিফা নিজের ইচ্ছামতো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন-’মিলিয়ে দেবার জন্য। কিন্তু সে ব্যাপারে কোনো ব্যাখ্যা প্রদান করেন নি। তার অন্যান্য সিদ্ধান্তগুলোও একই দোষে দোষী। সেগুলো এবং অন্যান্য বিভিন্ন ঘটনার গাণিতিক মিরাকল নিয়ে বাংলা ব্লগের অন্যতম লেখা হিসেবে প্রকাশিত মুক্তমনায় সৈকত চৌধুরী এবং অনন্ত বিজয় দাশের লেখা, কোরআনের ‘মিরাকল ১৯’-এর উনিশ-বিশ245! তাদের এ প্রবন্ধটি শুদ্ধস্বর থেকে প্রকাশিত ‘পার্থিব (২০১১) বইয়েও সঙ্কলিত হয়েছে।
সবই ব্যাদে আছে
এখানে একটি কথা বলা প্রয়োজন। ওই অনলাইন পত্রিকাটিতে অধ্যাপক ভদ্রলোকের সাথে বিতর্কের কারণে কোরআন এবং কোরআন-বিশেষজ্ঞদের কথা বারে বারে উঠে এসেছে বলে এমন ভাবার কোনো কারণ নেই যে অন্যান্য ধর্মের ‘কিতাব বিশেষজ্ঞের দল’ এই অভিযোগ থেকে মুক্ত। এরা কেউই আসলে ধোয়া তুলসিপাতা নয়; বরং, একই মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ। কিছু হিন্দু ভাববাদী ‘বৈজ্ঞানিক আছেন, যারা মনে করেন মহাভারতে কৃষ্ণ অর্জুনকে যে বিশ্বরূপ দেখিয়েছে তা আসলে বিগব্যাং ছাড়া কিছু নয়। মৃণাল দাসগুপ্ত ভারতের জাতীয় বিজ্ঞান আকাঁদেমির বিখ্যাত বিজ্ঞানী। উনি দাবি করেন, আজ আধুনিক বিজ্ঞান যে সমস্ত নতুন তত্ত্ব ও তথ্য প্রতিদিনই আবিষ্কার করছে, তার সবকিছুই নাকি প্রাচীনকালের মুনি ঋষিরা বের করে গেছেন। বেদে নাকি সেসমস্ত আবিষ্কার ‘খুবই পরিষ্কারভাবে লিপিবদ্ধ আছে। মি. দাসগুপ্তের ভাষায়, রবার্ট ওপেনহেইমারের মতো বিজ্ঞানীও নাকি গীতার বিশ্বরূপ দর্শনে এতই অভিভূত হয়ে গিয়েছিলেন যে ল্যাবরেটরিতে আণবিক শক্তির তেজ দেখে নাকি গীতা থেকে আবৃত্তি করেছিলেন–
দিবি সূৰ্য্যসহস্রস্য ভবেদ যুগপদুথিতা।
যদি ভাঃ সদৃশী সা সাদ ভাসন্তস মহাত্মনঃ
বিজ্ঞান জানা কিছু শিক্ষিত হিন্দু বুদ্ধিজীবী আছেন যারা ভাবেন আধুনিক বিজ্ঞান আজ যা আবিষ্কার করছে, তা সবই হিন্দু পুরাণগুলোতে লিপিবদ্ধ জ্ঞানের পুনরাবৃত্তি। হিন্দুদের সাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান রামকৃষ্ণ মিশন তাদের মুখপত্র ‘উদ্বোধন’-এ বলা শুরু করেছে যে, কৃষ্ণগহ্বর কিংবা সময় ধারণা নাকি মোটেই নতুন কিছু নয়। হিন্দুধর্ম নাকি অনেক আগেই এগুলো জানতে পেরেছিল। কীভাবে? ওই যে বহুল প্রচারিত সেই আপ্তবাক্যে ‘ব্রহ্মার এক মুহূর্ত পৃথিবীর সহস্র বছরের সমান’L কিছু ধর্মবাদীর দৃষ্টিতে মহাভারতের কাল্পনিক কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ ছিল আসলে এক ‘পারমাণবিক যুদ্ধ’ (Atomic War)। প্রশান্ত প্রামাণিক নামে ভারতের এক জনপ্রিয় বিজ্ঞান লেখক’ ‘ভারতীয় দর্শনে আধুনিক বিজ্ঞান বইয়ে তার কল্পনার ফানুসকে মহেঞ্জোদারো পর্যন্ত টেনে নিয়ে বলেছেন-’সম্ভবত দুর্যোধনেরই কোনো মিত্র শক্তি পারমাণবিক যুদ্ধে ধ্বংস হয়ে থাকবে মহেঞ্জোদারোতে’ (পৃ. ৬)। ‘সবই ব্যাদে আছে’ মার্কা এইসব বকচ্ছপ ভাববাদীরা অবলীলায় দাবি করে ফেলেন যে, নলজাতক শিশু (Test Tube Baby) আর বিকল্প মা (Surrogate Mother) আধুনিক বিজ্ঞানের দান মনে করা হলেও তা হিন্দু সভ্যতার কাছে নাকি নতুন কিছু নয়। দ্রোণ-দ্রোণী, কৃপ-কৃপীর জন্মের পৌরাণিক কাহিনিগুলো তারই প্রমাণ। এমনকি কিছুদিন আগে উপসাগরীয় যুদ্ধে ব্যবহৃত স্কাড আর প্যাট্রিয়ট মিসাইল নাকি হিন্দু পুরাণে বর্ণিত ‘বরুণ বাণ’ আর ‘অগ্নিবাণ’ বই কিছু নয়। তারা সবকিছুতেই এমনতর মিল পেয়ে যান। যেমনিভাবে ভারতের ‘দেশ’-এর মতো প্রগতিশীল পত্রিকায় ২২ এপ্রিল ১৯৯৫ সংখ্যায় প্রকাশিত বিজ্ঞান ও ভগবান’ নিবন্ধের লেখক হৃষীকেশ সেন বেদান্তে বর্ণিত উর্ণনাভ বা মাকড়শার মধ্যে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মডেলের মিল পেয়ে গেছেন।
খ্রিস্টান সমাজেও এই ধরনের ‘হাসজারু’ প্রচেষ্টা বিরল নয়। বিজ্ঞানী ফ্রাঙ্ক টিপলার পদার্থবিজ্ঞানে অবদানের জন্য ইদানীং যত না বিখ্যাত, তার চেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছেন খ্রিস্টধর্মকে ‘বিজ্ঞান’ বানানোর জন্য। ওমেগা পয়েন্ট নামে একটি ধারণা দিয়েছেন টিপলার যা মহাসংকোচন (বিগ ক্রাঞ্চ)–এর সময় সিংগুলারিটির গাণিতিক মডেলকে তুলে ধরে। এ পর্যন্ত ঠিক ছিল। কিন্তু টিপলার মনে করেন এই ওমেগা পয়েন্টই হচ্ছে ‘গড’। শুধু তাই নয়, যিশুর অলৌকিক জন্মকে (ভার্জিন বার্থ) তিনি বৈজ্ঞানিক বৈধতা দিতে চান যিশুকে বিরল xx male বানিয়ে, যিশুর পুনরুত্থানকে ব্যারন অ্যানাইহিলেশন প্রক্রিয়ার সাথে তুলনা করেছেন, ইনকারনেশন বা অবতারকে বলেছেন বিপরীতমুখী ডিম্যাটেরিয়ালাইজেশন পদ্ধতি, ইত্যাদি। এ সমস্ত রঙ-বেরঙের গালগপ্প নিয়েই তার সাম্প্রতিক বই The Physics of Christianity (2007)! বলা বাহুল্য মাইকেল শারমার, ভিক্টর স্টেঙ্গর, লরেন্স। ক্রাউসসহ অনেক বিজ্ঞানী এবং দার্শনিকই টিপলারের যুক্তিকে খণ্ডন করেছেন[২৪৬], কিন্তু তাতে অবশ্য আধুনিক ‘বিজ্ঞানময় খ্রিস্টধর্মোন্মাদনা থেমে যায় নি, যাবেও না। ফ্রাঙ্ক টিপলারের অনেক আগে ১৯৭৫ সালে ফ্রিজোফ কাপরা একই মানসপটে লিখেছিলেন ‘The Tao of Physics’– প্রাচ্যের তাওইজমের সাথে বিজ্ঞানকে জুড়ে দিয়ে। চীনের প্রাচীন দার্শনিকেরা ইন এবং য্যান (yin and yang) নামে পরস্পরবিরোধী কিন্তু একীভূত সত্ত্বার কথা বলেছিলেন মানুষের মনে ভালো-মন্দ মিলেমিশে থাকার প্রসঙ্গে। ফ্রিজোফ কাপরা সেই ইন এবং ই্যাংকে ঠেলে নিয়ে গিয়েছিলেন কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যার জগতে পদার্থের দ্বৈত সত্ত্বার (dual nature of matter) বর্ণনা হাজির করে, পদার্থ যেখানে কখনও কণা হিসেবে বিরাজ করে, কখনোবা তরঙ্গ হিসেবে। আধুনিক পদার্থবিদ্যার শূন্যতার ধারণাকে মিলিয়ে দিয়েছেন তাওইজমের ‘চী’ (chi or qi)-এর সাথে–
যখন কেউ জানবে যে, মহাশূন্য ‘চী’ দিয়ে পরিপূর্ণ, তখনই কেবল সে অনুধাবন করবে, শূন্যতা বলে আসলে কিছু নেই।
মুক্তমনার বিশিষ্ট সদস্য ‘অপার্থিব জামান’ ধর্মগ্রন্থের মধ্যে বিজ্ঞান খোঁজার এই অপচেষ্টার বিরুদ্ধে একটি নিবন্ধে লিখেছিলেন–
প্রায়শই ধর্মবাদীরা ধর্মগ্রন্থের একটি নির্দিষ্ট আয়াত বা শ্লোকের মধ্যে আধুনিক বিজ্ঞান খুঁজে পান। এটি একটি হাস্যকর অপচেষ্টা। ওমনিভাবে খুঁজতে চাইলে যেকোনো কিছুতেই বিজ্ঞানকে খুঁজে নেওয়া সম্ভব। যেকোনো রাম-শ্যাম-যদু-মধু আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ব আবিষ্কারের অনেক আগে কোনো কারণে বলে থাকতে পারে- ‘সবকিছুই আসলে আপেক্ষিক। কিন্তু আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ব আবিষ্কারের পর সেই সমস্ত রাম শ্যাম-যদু-মধুরা যদি দাবি করে বসে এই বলে ‘হুঁ! আমি তো আইনস্টাইনের আগেই জানতাম আপেক্ষিক তত্বের কথা’ তবে তা শুধু হাস্যকরই নয়, যে সমস্ত নিবেদিতপ্রাণ বিজ্ঞানীরা তাদের শ্রমলব্ধ গবেষণার মাধ্যমে নিত্য-নতুন আবিষ্কারে পৃথিবীবাসীকে উপকৃত করে চলেছেন, তাদের প্রতি চরম অবমাননাকরও বটে। সবাই জানে, আপেক্ষিক তত্ব আবিষ্কারের জন্য আইনস্টাইনকে কখনোই কোনো ধর্মগ্রন্থের সাহায্য নিতে হয় নি, বরং আপেক্ষিক তত্ব আবিষ্কারের পর পরই তা ধর্মবাদীরা নিজ নিজ ধর্মগ্রন্থে জুড়ে দেওয়ার জন্য নানা জায়গায় মিল খুঁজে পেতে শুরু করলেন। বলা বাহুল্য, আধুনিক বিজ্ঞান যে সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দানে এখনও অক্ষম, সেই সমস্ত জায়গায়। ধর্মবাদীরাও কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে নীরব। যেমন, বিজ্ঞান এখনও নিশ্চিতভাবে জানে না যে আমাদের এই মহাবিশ্ব বদ্ধ, খোলা নাকি ফ্ল্যাট। তাই ধর্মবাদীদেরও কেউ তাদের ঐশী কিতাব থেকে আমাদের জন্য ভবিষ্যদ্বাণী করে কোনো ধরনের আলোকপাত করতে পারছেন না। কিন্তু আমি নিশ্চিত যে, বিজ্ঞানের কল্যাণে কথনও যদি। এর উত্তর বেরিয়ে আসে, তবে সাথে সাথে ধর্মবাদীরা বিভিন্ন প্রাচীন ধর্মগ্রন্থের কতকগুলো অস্পষ্ট আয়াত অথবা শ্লোক হাজির করে এর অতিপ্রাকৃত দাবি করবেন। মূলত প্রতিটি ক্ষেত্রেই (গোঁজা) মিলগুলো পাওয়া যায় বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারগুলো প্রকাশ পাওয়ার পর, তার আগে নয়। এ কি স্রেফ ঘটনার কাকতালীয় সমাপতন?
আমরা অপার্থিব জামানের মন্তব্যের সাথে সামগ্রিকভাবে একমত। প্রতিটি ক্ষেত্রেই ধর্মগ্রন্থে ‘আধুনিক বিজ্ঞানের সন্ধান পাওয়া যায়, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারগুলো প্রকাশ পাওয়ার পর, তার আগে নয়। কারণ বিজ্ঞানের দায় পড়ে নি ধর্মগ্রন্থ থেকে দীক্ষা নিয়ে আলোর সন্ধান লাভ করতে, বরং ধর্মগুলোই জেনে গেছে, বিজ্ঞান ছাড়া তারা টিকে থাকতে পারবে না। কাজেই, নিত্যনতুন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারগুলোকে ধর্মগ্রন্থের সাথে জুড়ে দেওয়ার জন্য ধর্মবাদীরা এখন মুখিয়ে থাকে। একটা সময় বাইবেল-বিরোধী সূর্যকেন্দ্রিক তত্ব প্রকাশের জন্য কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও, ব্রুনোর ওপর অত্যাচারের স্টিমরোলার চালিয়েছিল বাইবেল-ওয়ালারা, সেই তারাই এখন বাইবেলের নানা জায়গায় সৌরকেন্দ্রিক তত্ত্বের ‘আলামত’ পেয়ে যান। কোরআনের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার থাটে। কিছুদিন আগেও দেখতাম অনেকেই ডারউইনের বিবর্তনবাদের বিরুদ্ধে রীতিমতো জিহাদ শুরু করেছিলেন কোরআনের আয়াতকে উদ্ধৃত করে। আজকে বিবর্তনতত্ত্বের সপক্ষের প্রমাণগুলো এতই জোরালো হয়ে উঠেছে যে, সেগুলোকে আর অস্বীকার করা যাচ্ছে না। তাই শুরু হয়েছে বিবর্তনবাদের সপক্ষে আয়াত খোঁজা। পেয়েও গেছেন কিছু কিছু একটা ওয়েবসাইটে দেখলাম, ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে যে, কোরআনের ৪ : ১, ৭ : ১১, ১৫ : ২৮-২৯, ৭৬ : ১-২ প্রভৃতি আয়াতগুলো নাকি বিবর্তন তত্ত্বের ‘সরাসরি’ প্রমাণ। এ সমস্ত আয়াতে ‘সৃষ্টি’ বোঝাতে ‘খালাকা’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, যার আভিধানিক অর্থ হচ্ছে ‘গ্র্যাজুয়াল চেঞ্জ’ অতএব ইহা বিবর্তন’। অনুমান আর কয়েক বছরের মধ্যে শুধু বিবর্তন নয়, অচিরেই তারা মাল্টিভার্স, কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন, স্ট্রিং তত্ব, প্যান্সপারমিয়া, জেনেটিক কোড, মিউটেশন এধরনের অনেক কিছুই ধর্মগ্রন্থে পেয়ে যাবেন (কিছু কিছু হয়ত এর মধ্যেই পেয়েও গেছেন)। তবে এধরনের সমন্বয়ের চমৎকার খেলা দেখিয়েছে হিন্দু ধর্মবাদীরাই। যখন বিগত শতকের পঞ্চাশের দশকে ফ্রেডরিক হয়েল, হারমান বন্দি আর জযন্ত নারলিকার মিলে স্থিতিশীল মহাবিশ্ব তত্ত্বের (Steady state theory) অবতারণা করেছিলেন, তখন তা ভারতের হিন্দুত্ববাদীদের মধ্যে তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। কারণ এটি বেদে বর্ণিত ‘চির শাশ্বত’ মহাবিশ্বের ধারণার সাথে মিলে যায়। কিন্তু মহাজাগতিক পটভূমি বিকিরণের (Cosmic background radiation) খোঁজ যখন বিজ্ঞানীরা পেলেন, তখন তা স্থিতিশীল মহাবিশ্বকে হটিযে মহাবিস্ফোরণ তত্ত্ব বা বিগব্যাংকে বৈজ্ঞানিক সমাজে প্রতিষ্ঠিত করে দিল। হিন্দুত্ববাদীরাও সাথে সাথে ভোল পালটে ‘চির শাশ্বত’ মহাবিশ্ব বাদ দিয়ে ‘অদ্বৈত ব্রহ্ম’র খোঁজ পেয়ে গেলেন। অর্থাৎ, মহাবিশ্বের সৃষ্টি থাকুক, না থাকুক, চিরশাশ্বত হোক আর না হোক, স্থিতিশীল হোক আর অস্থিতিশীলই হোক সবই কিন্তু তাদের ধর্মগ্রন্থে আছে।
ধর্মবাদীদের গোঁজামিল দেওয়ার এই প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা (সঠিকভাবে বললে ‘অপচেষ্টা’) দেথে প্রবীর ঘোষ তার আমি কেন ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না বইতে খুবই মজার একটি প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন–
ধরা যাক, রাস্তার একটি মাতালকে এই বিশ্ব ব্ৰহ্মাণ্ডের মডেল সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলো। মাতালটি হয়ত রক্ত-চোখে প্রশ্নকারীর দিকে তাকিয়ে থেকে রাস্তা থেকে পড়ে থাকা মদের বোতলটি তুলে নিয়ে ঢক ঢক করে গলায় মদ ঢালতে শুরু করল। তারপর অবশেষে শূন্য বোতলটি রাস্তায় ফেলে দিয়ে হেঁটে চলে গেল। পুরো ব্যাপারটিকে কিন্তু ইচ্ছে করলেই বিশ্ব ব্রান্ডের সাথে গোঁজামিল দিয়ে জুড়ে দেওয়া যায়। মদের বোতলটি যখন পূর্ণ ছিল, সেই অবস্থাটিকে আমাদের এখনকার প্রসারণশীল মহাবিশ্বের সাথে তুলনা করা যায়। মাতালটি গলায় মদ ঢেলে বোতল খালি করতে শুরু করল এই বোঝাতে যে, এক সময় বিশ্বের এই প্রসারণ থেমে যাবে আর শুরু হবে সংকোচন। শেষ পর্যন্ত মাতালটি শূন্য বোতল রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে এটাই বোঝাতে চাইছে যে মহাবিশ্ব সংকুচিত হতে হতে পূর্বের সমস্ত সৃষ্টিকে ধ্বংস করে সিংগুলারিটি বিন্দুতে চলে আসবে।
কী অদ্ভুত ‘মহা-বিজ্ঞানময়’ নির্বুদ্ধিতা! বাংলাদেশে বেশ ক’বছর ধরেই চলছে এই নির্বুদ্ধিতার খেলা, মাতাল সাজার আর মাতাল বানানোর নিরন্তর প্রক্রিয়া। এখানে ‘জ্ঞানের কথা’, ‘লজ্জা’ ‘নারী’র মতো প্রগতিশীল বই অবলীলায় নিষিদ্ধ করা হয় মানুষের ‘ধর্মানুভূতি’-তে আঘাত লাগার অজুহাতে, আরজ আলী মাতুব্বরের ‘সত্যের সন্ধান’ আর দেবীপ্রসাদ চৌধুরীর ‘যে গল্পের শেষ নেই’ পড়ার অপরাধে মুক্তিযোদ্ধা ওহাবকে ‘জুতোর মালা পরিয়ে সারা গ্রাম ঘোরানো হয়, তসলিমাকে দেশ থেকে নির্বাসিত করা হয়, মুক্তবুদ্ধির চর্চা করার জন্য আহমেদ শরীফ-আলী আসগর-কবীর চৌধুরীদের ‘মুরতাদ’ ঘোষণা করা হয়, চাপাতির আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হতে হয় মুক্তমনা অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদকে, আর অপরপক্ষে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে বের করা হয় ‘Scientific Identification in Holy Quran2-93 মতো ছদ্ম-বিজ্ঞানময় গ্রন্থ। ভক্তি-রসের বান ডেকে অদৃষ্টবাদ আর অলৌকিকত্বের রমরমা বাজার তৈরি করতে চলছে বুকাইলি-মুর-দানিকেন-নাযেকদের বইয়ের ব্যাপক প্রচার আর প্রসার। বাংলাদেশের সারা বাজার এখন ‘আল-কোরআন এক মহা বিজ্ঞান, ‘মহাকাশ ও কোরআনের চ্যালেঞ্জ’, ‘বিজ্ঞান না কোরআন’, ‘বিজ্ঞান ও আল কোরআন’ জাতীয় ছদ্ম বৈজ্ঞানিক বইয়ে সয়লাব। মুক্তমনা এবং শিক্ষা আন্দোলন মঞ্চের যৌথ প্রয়াসে প্রকাশিত ‘স্বতন্ত্র ভাবনা’ (চারদিক, ২০০৮) বইটির ভূমিকায় উদ্ধৃত হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. অজ্য রাযের একটি প্রাসঙ্গিক উক্তি–
জ্ঞানের একমাত্র উৎস যদি পবিত্র ধর্মগ্রন্থগুলো হয়, তাহলে সেই সমাজে নেমে আসবে বন্ধ্যাত্ব, সমাজ হবে জড় চেতনা-চিন্তায় আচ্ছন্ন, সৃষ্টিশীলতার স্থান দখল করবে কুসংস্কার, মূর্খতা, কূপমণ্ডুকতা আর অজ্ঞানতা। আমাদের সমাজে দেখা যাচ্ছে কুসংস্কার আর প্রযুক্তিবিদ্যার ফসলকে আত্মস্থ করার পারস্পরিক সহাবস্থান। বিজ্ঞানের যুক্তি চাই না, চাই তার ফসল, পাশে থাক অন্ধবিশ্বাস আর ভাগ্যের কাছে আত্মসমর্পণ। এই সমাজেই সম্ভব ড্রয়িং রুমে রঙিন টেলিভিশন সেট স্থাপন, এবং হিস্টিরিয়া-আক্রান্ত কন্যাকে পীরের চিকিৎসা কেন্দ্রে প্রেরণ। এই সমাজেই সম্ভব অণুরসায়নবিদদের রসায়ন চর্চার পাশাপাশি তথাকথিত পীরের পদচুম্বন।
সত্যিই তাই। অদ্ভুত উটের পিঠে সত্যিই বুঝি চলেছে স্বদেশ। বিজ্ঞানের এই অগ্রগামীতার যুগে প্রাত্যহিক জীবনে ধর্মের বাঁধন ক্রমশ যখন শিথিল হয়ে পড়ছে, মানুষের মনে দেখা দিচ্ছে নানা ধরনের সংশয় আর প্রশ্ন তখনই ধর্মকেন্দ্রিক নিবর্তন মূলক শোষণ ব্যবস্থা বজায় রাখার মতলবে শুরু হয়েছে এক নতুন ধরনের নিরন্তর মগজ ধোলাই আর তা হচ্ছে আধুনিক বিজ্ঞানের মোড়কে ধর্মকে পরিবেশন। কিছু মানুষ রসাল চাটনির মতো তা খাচ্ছেও বেশ। ধর্মের নেশায় পুঁদ হয়ে মানুষ ভাবতে শিখছে ১৪০০ বছর আগে লেখা ‘বিজ্ঞানময়’ কিতাবে সত্যিই বুঝি মহা বিস্ফোরণের কথা আছে, অথবা প্রাচীন কোনো শ্লোকে আছে কাল প্রসারণের ইঙ্গিত। কে দেবে এই মোহান্ধ জাতিকে মুক্তি? ওমর খৈয়ামের একটি কবিতার কথা খুব মনে পড়ছে–
যদি মাতালের শিক্ষাকেন্দ্র মাদ্রাসাগুলো এপিকিউরাস, প্লেটো, অ্যারিস্টটলের দর্শন-শিক্ষালয় হতো, যদি পীর দরবেশের আস্তানা ও মাজারগুলো গবেষণা প্রতিষ্ঠান হতো, যদি মানুষ ধর্মান্ধতার পরিবর্তে নীতিজ্ঞানের চর্চা করত, যদি উপাসনালয়গুলো সর্ববিদ্যাচর্চা-কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠত, ধর্মতত্বের চর্চার পরিবর্তে যদি গণিত বীজ গণিতের। উন্নতি সাধন করত, ধর্ম যা মানবজাতিকে বিভক্ত করে তা ‘মানবতা’র দ্বারা প্রতিস্থাপিত হতো, পৃথিবী তাহলে বেহেস্তে পরিণত হতো, পরপারের বেহেস্ত বিদায় নিত, প্রেম-প্রীতি মুক্তি-আনন্দে জগৎ পরিপূর্ণ হতো নিঃসন্দেহে।
ওমর খৈয়াম বহু বছর আগে যে কথা বলেছিলেন, বাংলাদেশের জন্য সেকথাগুলো আজও কী নিদারুণ সত্য! স্বতন্ত্র ভাবনায় ড. অজয় রায় যেভাবে লিখেছিলেন[২৪৭], তার সাথে সুর মিলিয়ে আমাদেরও বলতে ইচ্ছে করে, ওমর তুমি আর একবার আসো এই দেশে, কুসংস্কারাচ্ছন্ন এই দেশে, ফতোয়াবাজদের এই দেশে আজ তোমার বড় প্রয়োজন।